মনরেগায় শেষবার কাজ পেয়েছেন পার্বতী ঠিক এক বছর আগে, ২০২৩ সালের মে মাসে। মাত্র পাঁচ দিনের কাজ।
ওই পাঁচদিন পার্বতী (শুধু এই নামটাই ব্যবহার করেন) তাঁর গ্রাম গৌর মধুকর শাহপুরের একটি রাস্তা সমান করার কাজ করেছেন। কিন্তু মনরেগা বা মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইনের অধীনে রাষ্ট্র-প্রতিশ্রুত বছরে নিশ্চিত ১০০ দিনের কাজ কপালে জোটেনি জাটভ (তফসিলি জাতি) সম্প্রদায়ভুক্ত ৪৫ বছর বয়সির। “আধপেটা খেয়ে দিন চালাচ্ছি,” বলছেন তিনি।
রাষ্ট্র আবারও তাঁর বিশ্বাস ভাঙে যখন ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অধীনে দম্পতির পাকা বাড়ির আবেদন খারিজ করা হয়। আর অপেক্ষা করতে না পেরে পার্বতী ও তাঁর স্বামী ছোটেলাল আত্মীয়দের থেকে ৯০,০০০ টাকা ধার করে দুই কামরার একটা পাকা বাড়ি তোলেন।
“কেউ যদি ভোট চাইতে আসে তো আমি আগে জানতে চাইব, আমার নাম যদি ভোটার তালিকায় থাকে তবে বাড়ি প্রাপকদের তালিকা থেকে উধাও হল কী করে?” ফুঁসতে ফুঁসতে প্রশ্ন তোলেন তিনি। পার্বতীর স্বামীও মনরেগায় কাজ করতেন, কিন্তু পাঁচ বছর আগে একবার পক্ষাঘাত বা প্যারালাইটিক অ্যাটাক হওয়ার হওয়ার পর থেকে আর কাজ করতে পারেন না। আজকাল মাঝেমধ্যে বারাণসী শহরের মজুর মান্ডিতে যান কাজের খোঁজে; দিনমজুরির দর সেখানে যাচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা করে।
গ্রামীণ অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বছরে ১০০ দিন কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয় মনরেগা। কিন্তু বারাণসী জেলার গ্রামে গ্রামে উঠে আসছে একই অভিযোগ: “গত দুই প্রধানী” বা পঞ্চায়েত প্রধানের মেয়াদ জুড়ে বছরে মাত্র ২০-২৫ দিনের কাজ পাওয়া যাচ্ছে। সময়কালটা মোটামুটি ১০ বছর।
পার্বতীর মাথায় এখন বিরাট ঋণের বোঝা যা তাঁর থাকার কথাই নয়। রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও সহায়তা পাননি, তাই ঠাকুর সম্প্রদায়ের জমিতে খেতমজুরির কাজ করে চালান। ফসল রোয়া আর কাটার মরসুমে কমবেশি দিন ১৫ কাজের জন্য ১০ কিলো করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয় সেখান থেকে।
রাজা তলব তেহসিলের অন্তর্ভুক্ত গৌর মধুকর শাহপুর গ্রামে মোটামুটি ১২০০ পরিবার থাকে, মূলত ‘তফসিলি জাতি’ এবং ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতি’ তালিকাভুক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁরা। নিজেদের ব্যবহারের জন্য ছোটো ছোটো জমিতে চাষবাস হয়, আর উপার্জন আসে মূলত মজুরির কাজ থেকে।
বারাণসী শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্রর ভিতরে পড়ে, যেখান থেকে এবার লোকসভায় তৃতীয় মেয়াদের জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই কেন্দ্র থেকে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে জিতে এসেছেন তিনি।
ভোটের তারিখ ১ জুন, সারা দেশের নজর আছে বারাণসীর উপর। অলিগলি থেকে বড়োরাস্তা, ল্যাম্পপোস্ট থেকে ই-রিকশার পিছন, সবকিছু গেরুয়া রঙের পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ – তাতে লেখা ‘হর দিল মে মোদী (প্রত্যেকের হৃদয়ে মোদী)’। সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে স্পিকার লাগানো অটো, তার থেকে অবিরাম তারস্বরে বাজছে মোদীর ভাষণ আর নবনির্মিত রামমন্দির স্থাপনায় তাঁর ভূমিকার জয়গান।
গৌর মধুকর শাহপুরে কিন্তু কোনও প্রচারের পোস্টার নেই। শুধু এই বস্তির একটা হনুমান মন্দিরের সামনে অযোধ্যার রামমন্দিরের অভিষেকে মোদীর একটি ছবি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পার্বতী কিন্তু বলছেন নিজের এবং পাঁচজনের পরিবারের মুখের ভাত জোটাতেই নাজেহাল তিনি, এই অবস্থায় রাষ্ট্র কেন কিছু করবে না: “সরকারই তো আধার কার্ড দেয়, সবার সব তথ্য ওদের কাছে আছে নিশ্চয়ই, তাহলে কে গরিব কে নয় সেটা খুঁজে বার করতে কেন পারে না?” তাঁর বাড়ির উপরে হাওয়ায় উড়ছে বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) নীল পতাকা।
গ্রামীণ নিশ্চয়তা যোজনাটির অধীনে কাজ সত্যিই কমে আসছে, সায় দিলেন মনরেগা মজদুর ইউনিয়নের রেণু দেবী। পারি-কে তিনি জানালেন, “২০১৯ থেকে মনরেগার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আগে যখন গ্রামবাসীদের জন্য আবেদন লিখে জমা দিতাম, হপ্তাখানেকের জন্য কাজ চলে আসত। এখন গোটা বছরে সাত দিনের কাজও জোগাড় করা দুষ্কর।”
শুধু ২০২১ সালেই মনরেগা মজদুর ইউনিয়নের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা বারাণসীর ব্লক স্তরের আধিকারিকদের নানান গ্রামে কাজ চেয়ে মোট ২৪টি চিঠি লিখেছেন।
জীরা দেবী শেষবার মনরেগা-র কাজ পেয়েছেন ওই বছরেই – ২০২১-এর জুনে।
গৌর মধুকর শাহপুর গ্রামের ওই একই বস্তিতে থাকেন জীরা। দিনমজুরি খেটে দিন চালানো ৪৫ বছরের জীরা একটা ঝোলা বার করে দেখালেন, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা থেকে পাওয়া সেই ঝোলার উপর প্রধানমন্ত্রী মোদীর ছবি এমবস করে বসানো। ভাগ্যের খেলায় এই ঝোলাতেই তাঁর জমানো আছে নানান সরকারি যোজনার জরুরি কাগজপত্র, যেগুলো কোনওটাই তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। “মোদীর কথা বলতে গেলে সবার আগে উনি কোন হেলিকপ্টারে চড়ে বসে আছেন তা খুঁজে বের করতে হবে,” হেসে বলেন তিনি।
জীরা জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনার অধীনে বাড়ির জন্য স্থানীয় গ্রামপ্রধান তাঁর থেকে ১০,০০০ টাকা ঘুষ চেয়েছিল। বারাণসীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পর্যন্ত চিঠি লিখেছিলেন তিনি, লাভ হয়নি। “বাড়ির দেওয়ালগুলো দেখুন, বস্তা আর পোস্টার জুড়ে জুড়ে বানানো!” খড়ে ছাওয়া ঘরখানায় বসে যোগ করেন তিনি।
মনরেগার কাজ না থাকাটা তাঁর মতো শ্রমিকের কাছে সর্বনাশের সামিল: তাঁদের পারিবারিক জমির পরিমাণ এক একরের এক দশমাংশেরও কম। ছেলে শিবম আর স্বামী রামলাল তাঁর রোজগারের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু চল্লিশের কোঠায় এসে আর শরীর দেয় না তাঁর: “গায়ে আর মাথায় ভয়ঙ্কর ব্যথা শুরু হয়ে যায় বলে আজকাল আর মাটিকাটার [মনরেগা-য় যেসব কাজ পাওয়া যায় তার অন্যতম] ঝুড়ি বইতে পারি না।”
তাঁরা বিন্দ (মাল্লা) সম্প্রদায়ের মানুষ, উত্তরপ্রদেশে যা অন্য অনগ্রসর বর্গের তালিকাভুক্ত। তাঁর স্বামী আর কাজে যেতে পারেন না। তাঁর ছেলে দৃষ্টিহীন, আগে প্রতিবন্ধকতা ভাতা পেতেন, কিন্তু গত বছর থেকে সেই ভাতা আসা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক চেষ্টা করেও আর চালু করা যায়নি।
সারাদিন খেতমজুরি করে পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া একগোছা রসুনের ডাঁটি হাতে নিয়ে প্রতিবেদক আর আশপাশে জড়ো হওয়া ভিড়টাকে শুনিয়ে ঘোষণা করেন জীরা দেবী, “ভোট দেব সেই মহিলাকে যিনি আমাদের মতো মানুষদের সহায় হন – মায়াবতী!”
বহুচর্চিত এই লোকসভা কেন্দ্রে এ হেন রাজনৈতিক অবস্থান রাখা কঠিন কাজ বটে।
কিন্তু জীরা আর পার্বতী একা নন। “এখনও কিছু স্থির করিনি [ভোট কাকে দেব]। কিন্তু মোদীজির কাজ নিয়ে আমরা খুশি নই,” বলছেন গ্রামের আর এক দিনমজুর অশোক।
তাঁর স্ত্রী সুনিতা সম্প্রতি মনরেগাতে তিন দিনের কাজ পেয়েছেন, গত বছর (২০২৩) পেয়েছিলেন পাঁচ দিন। গৌর মধুকর শাহপুর গ্রামের এই দম্পতির পরিবারে আছে তিন সন্তান: ১৪ বছরের সঞ্জনা, ১২ বছরের রঞ্জনা আর ১০ বছরের রাজন।
অশোক (শুধু এই নামই ব্যবহার করেন) এককালে মহার্ঘ্য বেনারসি শাড়ি বুনতেন, কিন্তু বাড়তে থাকা পরিবারে সেই রোজগারে আর কুলোচ্ছিল না। তাঁত বোনা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বারাণসী শহরের শ্রমিক মান্ডি আর নানা নির্মাণ প্রকল্পে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। মাসে ২০-২৫ দিন মতো কাজ থাকে, দিনমজুরি পান ৫০০ টাকার আশপাশে। “কোনওমতে সংসার টানছি,” হরিজন বস্তির বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইতস্তত মাটির হাঁড়িকুড়ি আর তাদের ঘিরে রাখা লাল পতাকা এড়িয়ে চলে যেতে যেতে বলে গেলেন অশোক; গন্তব্য শ্রমিক মান্ডি।
বারাণসী জেলার আর এক গ্রাম রাখৌনার সব বাড়ির গেটে গেটে নীল রঙের স্টিকার সাঁটানো: তাতে লেখা ‘ম্যায় হুঁ মোদীকা পরিবার [আমরাই মোদীর পরিবার]’। সান্থারা দেবীর বাড়িতে খাটিয়ায় রাখা পোস্টার, তাতে মোদীর সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি ঘোষণা করছে তাঁদের ‘ডাবল ইঞ্জিন কা সরকার’-এর কীর্তিকলাপ।
মাটির মেঝেয় বসে রুদ্রাক্ষের মালা গাঁথছেন তিনি; সাদামাটা জীর্ণ বাড়িটি ঘিরে ভনভন করে মাছির দল। ছয়জনের পরিবারটিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচাতে ভরসা খালি মাথার উপর খড়ের ছাউনিটুকু। প্রতিবেদককে তিনি বললেন, “আমাদের খেতও নেই, বাগানও নেই। কাজ না করলে খাব কী?”
মনরেগা শ্রমিক হিসেবে নথিভুক্ত সান্থারা গত বছরের (২০২৩) অগস্টে আট দিনের কাজ পেয়েছিলেন, পোখরি (পুকুর) খোঁড়ার। মনরেগার আয়ের ঘাটতি পূরণ করতে নানা কম রোজগারের কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে। রুদ্রাক্ষের মালা বেচে কয়েক মাস পর পর ২০০০-৫০০০ টাকা আসে। “ডজনপ্রতি ২৫ টাকা দর পাই। পাইকারি দোকানে এক-একবারে ২০-২৫ কিলো রুদ্রাক্ষ দেয়,” যোগ করেন তিনি।
সান্থারার প্রতিবেশী, ৫০ বছরের মুঙ্কা দেবীও গত এক বছর ধরে মনরেগা কাজের জন্য রোজগার সহায়কের (কাজের হিসাব রাখতে সাহায্য করেন যনি) ডাকের অপেক্ষায় আছেন। মুঙ্কার স্বামীর নামে ১.৫ বিঘা জমি আছে, সেখানে সবজিপাতি ফলিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু তা বাদে অন্যদের খেতেও কাজ করতে যেতে হয় তাঁকে। “এতে করে পরিবারে নমক-তেল [নুন আর তেল] অন্তত জুটে যায়,” নিত্যদিনের খাবার প্রসঙ্গে বলেন তিনি।
খেওয়ালি গ্রামের শকুন্তলা এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ভোট দেবেন না। “সরকার আমায় কাজ দেয়নি, তাই আমি কাউকেই ভোট দেব না,” ঘোষণা করে দিলেন। ভুয়ো মনরেগা শ্রমিকদের নাম বাদ দিতে গিয়ে ভুল করে সক্রিয় জব কার্ডের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে এই গ্রামের ১২ জন মহিলার নাম – শকুন্তলা তাঁদের একজন।
“মোদী আমাদের নারেগার কাজ কেড়ে নিয়েছেন। আমাদের অন্তত দুই মাসের নিয়মিত কাজ চাই, আর ৮০০ টাকা দিনমজুরি,” বলছেন খেওয়ালির আর এক বাসিন্দা শীলা। “বিনামূল্যের রেশন যোজনায় চাল আর গমের সঙ্গে ডাল, নুন আর তেলও দেওয়া উচিত,” যোগ করেন শকুন্তলা।
তাঁর বাড়ির উঠোন ভরে আছে পাথরের নন্দী (শিবের ষাঁড়) মূর্তিতে। “পালিশ করে করে হাত ছড়ে যায়, কিন্তু এক-একটায় ১৫০-২০০ টাকা পাই।” এই কাজ করে করে হাতের আঙুলগুলো ফুলে উঠেছে তাঁর, কিন্তু তাঁর মতো মনরেগায় নিয়মিত কাজ না পাওয়া মহিলাদের হাতে রোজগারের উপায় বড়োই সীমিত।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী