২০ বছর আগে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত আজ তাঁকে এভাবে বিপদে ফেলবে, ভাবতেও পারেননি বালাসাহেব লোন্ধে। মহারাষ্ট্রের পুণে জেলার ফুরসুঙ্গি গঞ্জে প্রান্তিক চাষি পরিবারের সন্তান লোন্ধে অল্প বয়স থেকেই পারিবারিক চাষজমিতে কাজে লেগে পড়েন। মূলত তুলোর চাষ করতেন তাঁরা।
“এক বন্ধু এক মুসলিম পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, ওঁরা গবাদি পশু পরিবহণের ব্যবসা করতেন,” জানাচ্ছেন ৪৮ বছরের লোন্ধে। “ওঁদের ড্রাইভার দরকার ছিল, তাই আমি ওখানে ভিড়ে গেলাম।”
উদ্যোগী, পরিশ্রমী তরুণ লোন্ধে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যবসাটা বুঝতে শুরু করেছিলেন। বছর দশেক পরে লোন্ধে স্থির করলেন, তাঁর যথেষ্ট শেখা হয়েছে, আর টাকাও জমে গেছে পর্যাপ্ত পরিমাণ।
“৮ লাখ টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড ট্রাক কিনলাম, তারপরেও ২ লাখ টাকা মতো মূলধন হাতে ছিল,” বলছেন তিনি। “১০ বছরে বাজারে চাষি আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগও তৈরি হয়ে গেছিল।”
লোন্ধের উদ্যোগ ফল দিল শীঘ্রই। ফসলের দাম পড়ে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি আর জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে যখন তাঁর পাঁচ একরের চাষজমিতে লোকসান হতে শুরু করে, এই ব্যবসাই তাঁকে বাঁচিয়েছিল।
কাজটা খুবই সোজাসাপ্টা: গ্রামের সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে ইচ্ছুক চাষিদের থেকে গবাদি পশু কিনে তাতে কমিশন যোগ করে কসাইখানা বা গবাদি পশু কিনতে ইচ্ছুক অন্য চাষির কাছে বিক্রি করা। শুরুর বছর দশেক পর ২০১৪ সালে ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে আর একটা ট্রাক কেনেন তিনি।
পেট্রোলের দাম, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ আর ড্রাইভারের বেতন বাদ দিয়ে তাঁর গড় মাসিক আয় সে সময় মোটমাট ১ লক্ষ টাকার কাছাকাছি থাকত। মুসলিম কুরেশি গোষ্ঠীর প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য এই ব্যবসায়, গুটিকয়েক হিন্দুর মধ্যে একজন ছিলেন লোন্ধে। কিন্তু তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। “সবাই দরাজ হাতে সাহায্য করতেন, খদ্দেরের যোগাযোগ দিয়ে দিতেন,” জানাচ্ছেন তিনি। “ভেবেছিলাম এতদিনে সব গুছিয়ে নেওয়া গেছে।”
কিন্তু ২০১৪ সালে দেশে ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), আর লাফিয়ে বেড়ে যায় গোরক্ষার নামে গাজোয়ারির মাত্রা। গোরক্ষা-জনিত হিংসা ভারতে গণহিংসার একটা নির্দিষ্ট ধরন। হিন্দুধর্মে পবিত্র বলে গণ্য পশু গরু রক্ষার অজুহাতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা অহিন্দু – মূলত মুসলিমদের আক্রমণ করে এই ধরনের হিংসায়।
২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর সমীক্ষায় ধরা পড়ে, ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে ১০০টিরও বেশি গোহত্যা তথা গোমাংস-কেন্দ্রিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ২৮০ জন আহত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৪৪ জনের – সিংহভাগই ধর্মে মুসলিম।
২০১৭ সালে ইন্ডিয়াস্পেন্ড নামে একটি তথ্য সংগ্রাহক ওয়েবসাইট ২০১০ সাল থেকে গোরক্ষা-সংক্রান্ত গণহিংসার ঘটনাগুলির সার্বিক বিশ্লেষণ করে একটি রিপোর্ট পেশ করে। তাতে দেখা যায় এই ধরনের ঘটনায় নিহত মানুষদের ৮৬ শতাংশ মুসলিম, এবং ৯৭ শতাংশ হিংসার ঘটনা ঘটেছে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর। পরবর্তীকালে এই ট্র্যাকারটি বন্ধ করে দিয়েছে ওয়েবসাইটটি।
লোন্ধে জানাচ্ছেন, গত তিন বছরে এই ধরনের হামলা, এবং প্রাণে মারার হুমকি বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। এককালে মাসে ১ লক্ষ টাকা কামাতেন, গত তিন বছরে তাঁর লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। নিজের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কিত তিনি, ভয়ে থাকেন তাঁর ট্রাকচালকদের নিরাপত্তা নিয়েও।
“দুঃস্বপ্নের মতো লাগে,” বলছেন তিনি।
*****
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে ১৬টি করে মহিষ নিয়ে পুণের এক বাজারের পথে যাচ্ছিল লোন্ধের দু’টি ট্রাক। আধঘন্টার পথ পেরিয়ে ছোট্ট শহর কাটরাজ – সেইখানে তাঁর ট্রাক আটক করে গোরক্ষকদের দল।
মহারাষ্ট্রে ১৯৭৬ সাল থেকেই গরু হত্যা নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১৫ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস নিষেধাজ্ঞার আওতায় ষাঁড় ও বলদদের নিয়ে আসেন। কিন্তু লোন্ধের ট্রাকে ছিল মহিষ, যা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না।
“তা সত্ত্বেও দুই ড্রাইভারকে মারধর করা হয়, থাপ্পড় মারা হয়, গালি দেওয়া হয়,” বলছেন লোন্ধে। “একজন হিন্দু ছিল, আর একজন মুসলিম। আইনি সমস্ত অনুমতিপত্র ঠিকঠাক ছিল। তবুও আমার ট্রাকগুলো বাজেয়াপ্ত করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।”
‘গবাদি পশু নিয়ে ট্রাক চালানো এখন প্রাণ বাজি রাখার সমান। ভীষণ মানসিক চাপ পড়ে। গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে এই গুন্ডা-রাজ। ফুলেফেঁপে উঠছে শুধু আইনভঙ্গ করা লোকগুলোই’
১৯৬০ সালের পশু নির্যাতন বিরোধী আইনে লোন্ধে এবং তাঁর দুই ড্রাইভারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে পুনে নগর পুলিশ; কারণ দর্শানো হয় যে ছোট জায়গায় গাদাগাদি করে জল-বিচালি না দিয়ে পশুগুলিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। “গোরক্ষকরা মারমুখী, আর পুলিশও বাধা দেয় না,” বলছেন লোন্ধে। “এটা স্রেফ হয়রান করার একটা পন্থা।”
লোন্ধের গবাদি পশুগুলিকে পুনের মাওয়াল তালুকবর্তী ধামানে গ্রামের একটি খাটালে নিয়ে যাওয়া হয়। লোন্ধে বাধ্য হন আইনি পথে যেতে। প্রায় ৬.৫ লাখ টাকা জলে যেতে বসেছিল। ভালো উকিল ধরেন, নানা মহলে ছোটাছুটি করেন।
দুই মাস পর, ২৪ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে পুণের শিবাজী নগরের দায়রা আদালত রায় শোনায়। বিচারক নির্দেশ দেন, লোন্ধের মহিষ ফেরত দিতে হবে গোরক্ষকদের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন লোন্ধে। থানাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে এই নির্দেশ যথাযথভাবে রূপায়ণ করা হয়।
কিন্তু বিধি বাম। লোন্ধের স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মামলা জেতার পর পাঁচ মাস কেটে গেছে, গবাদি পশু এখনও ফেরত পাননি তিনি।
“রায়ের দু’দিন পরে পুলিশের কাছ থেকে ট্রাকদুটো ফেরত পেলাম,” জানালেন লোন্ধে। ট্রাক ছিল না বলে এই ক’দিন কোনও কাজকর্মও চালাতে পারিনি। কিন্তু তারপর যেটা হল সেটা আরও হতাশাজনক।”
“আদালতের নির্দেশে ট্রাক ফেরত পেলেও হয়রানি তখন সবে শুরু,” বলছেন লোন্ধে। মহিষ উদ্ধার করতে সন্ত তুকারাম মহারাজ গোশালায় যান লোন্ধে, কিন্তু গোশালার ইন-চার্জ রূপেশ গরাডে তাঁকে বলেন পরের দিন আসতে।
তারপর দিনে দিনে অজুহাতের পাহাড় জমতে থাকে – গরাডে বলতে থাকেন পশুগুলি ছাড়ার আগে ওদের কিছু পরীক্ষা করাতে হবে, কিন্তু ডাক্তার নাকি নেই। এর দিন কয়েক পরেই তিনি উচ্চতর আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন দায়রা আদালতের রায় খারিজ করে দিয়ে। লোন্ধে বলছেন, ক্রমশই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে গরাডে পশুগুলো ফেরত দেবেন না বলেই সময় বাড়ানোর নানা ফিকির করে যাচ্ছেন। “কিন্তু উনি যা বলছিলেন পুলিশ তাতেই সায় দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা হাস্যকর পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল।”
পুণে এবং তার আশপাশে কুরেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; গোরক্ষা বাহিনীগুলোর এটাই কর্মপদ্ধতি। এইরকম লোকসান হয়েছে বহু ব্যবসায়ীরই। গোরক্ষকদের যুক্তি হল, নিরাপত্তার কথা ভেবেই তারা নাকি পশু আটকে রাখে; কিন্তু কুরেশিরা সেই যুক্তিতে ভুলছেন না।
“এই গোরক্ষকদের যদি গরুদের সুরক্ষা নিয়ে এতই চিন্তা থাকে, তবে চাষিদের উপর হামলা হয় না কেন?” প্রশ্ন তুলছেন পুণের ব্যবসায়ী, ৫২ বছরের সমীর কুরেশি। “বিক্রি তো ওরাই করে। আমরা শুধু এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাই। আসল কথা হল মুসলিমদের হয়রান করা।”
২০২৩-এর অগস্টে সমীরের সঙ্গেও এই ঘটনা ঘটে; তাঁর ট্রাক আটক করে গোরক্ষকরা। মাসখানেক বাদে আদালতে মামলা জিতে পুরন্ধর তালুকের জেন্দেওয়াড়ি গ্রামের খাটালে যান পশু উদ্ধার করতে।
“কিন্তু ওখানে পৌঁছে দেখলাম আমার পশুগুলোর চিহ্নমাত্র নেই,” বলছেন সমীর। “আমার পাঁচটা বড়ো মহিষ ছিল, আর ১১টা বাচ্চা; ১.৬ লাখ টাকার।”
বিকেল ৪টে থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সাত ঘণ্টা ধরে সেখানে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেন সমীর, কেউ যদি আসে, তাঁর হারানো পশুগুলোর খোঁজ দেয়। তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ অফিসার তারপর তাঁর উপর চাপ দিতে থাকেন পরের দিন আসার জন্য। “পুলিশ ওদের প্রশ্ন করতে ভয় পায়,” বলছেন সমীর। “পরের দিন যখন এসে পৌঁছালাম, গোরক্ষকরা স্থগিতাদেশ বার করে নিয়েছে।”
আদালতের পথে ন্যায় পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন সমীর; ভয় হয়, মানসিক চাপ আর আইনি খরচ মিলিয়ে ওই পশুর যা দাম তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়ে যাবে তাঁর। “কিন্তু আমি জানতে চাই, আমাদের হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার পর ওরা পশুগুলো নিয়ে করেটা কী?” প্রশ্ন তাঁর। “আমার পশুগুলো কোথায় গেল? আমিই যে শুধু এটা খেয়াল করেছি তা নয় কিন্তু। আমার অনেক সতীর্থই দেখেছেন যে গোরক্ষকরা পশু কেড়ে নিয়ে যাওয়ার পর হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তারা। ওরা কী আবার বেচে দিচ্ছে? এটা কী চক্র চলছে একটা?”
কালেভদ্রে যদি বা গোরক্ষকরা পশু ফেরত দিয়ে দেয়, তারপর শুরু হয় মামলা চলাকালীন তাদের দেখভাল করার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি, জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পুণে-নিবাসী আর এক ব্যবসায়ী ২৮ বছরের শাহনাজ কুরেশি জানাচ্ছেন, পশু প্রতি দিনে ৫০ টাকা করে চাইছে গোরক্ষকরা। “মানে দাঁড়ালো, যদি মাস দুয়েকের জন্য ১৫টা পশুর দেখভাল করে, তো তাদের ফেরত আনতে আমাদের ৪৫,০০০ টাকা দিতে হবে,” হিসেব করে দেখালেন তিনি। “এত বছর এই ব্যবসায় আছি। এই কাজের জন্য এই পরিমাণ টাকা অভাবনীয়; এটা স্রেফ তোলাবাজি চলছে।”
পুণে জেলার সাসওয়াদ গঞ্জ শহরে এক গবাদি পশুবাহী ট্রাকচালকের গণপিটুনির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তখন ১৪ বছরের সুমিত গাওড়ে। সালটা ২০১৪।
“মনে আছে, দারুণ উত্তেজনা হয়েছিল,” বলছেন গাওড়ে। “ভাবছিলাম, আমারও গিয়ে যোগ দেওয়া উচিত।”
পশ্চিম মহারাষ্ট্রের যে অংশে পুণে জেলা অবস্থিত, সেখানে চরম জনপ্রিয় ৮৮ বছরের উগ্র হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সম্ভাজী ভিডে । শিবাজীর কাহিনি বিকৃত করে মুসলিম-বিরোধী প্রচারের কাজে ব্যবহার এবং বাচ্চা ছেলেদের মগজধোলাইয়ের ইতিহাস আছে তাঁর।
“ওঁর ভাষণ শুনতে যেতাম, যেখানে উনি বলতেন কীভাবে শিবাজী মুঘলদের পরাজিত করেছিলেন – যারা মুসলিম ছিল,” বলছেন গাওড়ে। “উনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে আমাদের জানাতেন, নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতন করতেন।”
১৪ বছরের গাওড়ের সংবেদনশীল মনে ভিডের ভাষণ বিরাট ছাপ ফেলেছিল। আর চোখের সামনে গোরক্ষকদের কীর্তিকলাপ দেখে আরও চেগে গিয়েছিলেন, বলছেন তিনি। ভিডে প্রতিষ্ঠিত ‘শিব প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান’ সংগঠনের নেতা পণ্ডিত মোদকের সঙ্গে গিয়ে যোগাযোগ করেন তিনি।
সাসওয়াড়-নিবাসী মোদক পুণে জেলার অন্যতম পরিচিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী মুখ, এবং অধুনা বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সাসওয়াড় এবং আশপাশের সব গোরক্ষকরা মোদকের অধীনেই কাজ করে।
গত এক দশক ধরে মোদকের জন্য কাজ করছেন গাওড়ে, আর এই মতাদর্শে তিনি পুরোপুরি সমর্পিত। “আমাদের পাহারা শুরু হয় রাত সাড়ে দশটায়, ভোর চারটে অবধি চলে,” জানাচ্ছেন তিনি। সন্দেহজনক মনে হলে আমরা ট্রাক থামাই। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে থানায় নিয়ে যাই। পুলিশ সবসময় সহযোগিতা করে।”
দিনের বেলা গাওড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কিন্তু যবে থেকে ‘গোরক্ষক’ হয়েছেন, আশপাশের মানুষ তাঁকে আলাদা শ্রদ্ধার চোখে দেখে, জানাচ্ছেন তিনি। “টাকার জন্য একাজ করছি না আমি,” জোর দিয়ে বলছেন তিনি। “প্রাণ বাজি রেখে কাজ করি, তাই হিন্দুরা সম্মান দেয় আমাদের।”
গাওড়ে জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে প্রায় ১৫০ জন গোরক্ষক আছে শুধু পুরন্ধর তালুকেই – যেখানে সাসওয়াড় অবস্থিত। “সব গ্রামে আমাদের লোক আছে,” জানান তিনি। “সবাই হয়তো গোরক্ষার কাজে যোগ দিতে পারে না, কিন্তু সন্দেহজনক ট্রাক দেখলে আমাদের খবর দিয়ে সাহায্য করে।”
গ্রামীণ অর্থনীতির কেন্দ্রস্থলে আছে গরু। দশক দশক ধরে চাষিরা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন এই পশু – বিয়েশাদি, চিকিৎসার খরচ, বা আসন্ন চাষের মরসুমের জন্য একলপ্তে বড়ো অংকের টাকা লাগলে গরু বিক্রি করে সে টাকা জোগাড় করেন তাঁরা।
কিন্তু গোরক্ষকদের এই বিরাট চক্র ধ্বংস করে দিয়েছে তাঁদের দুর্দিনের সঞ্চয়টুকু। বছর বছর তাদের সংখ্যা বাড়ছে, আরও চরম আকার ধারণ করছে তাদের কার্যকলাপ। শিব প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্থান ছাড়া বর্তমানে শুধু পুণে জেলাতেই সক্রিয় অন্তত আরও চারটি হিন্দুত্ববাদী দল – বজরং দল, হিন্দুরাষ্ট্র সেনা, সমস্ত হিন্দু আঘাডি, এবং হোলি হিন্দু সেনা – প্রত্যেকের ইতিহাসই রক্তক্ষয়ী।
“এই সব দলের সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করে,” জানালেন গাওড়ে। “আমাদের কাঠামোটা নমনীয়। আমাদের সবারই মূল উদ্দেশ্য এক, তাই আমরা পরস্পরকে সাহায্য করি।”
গাওড়ে জানাচ্ছেন, শুধু পুরন্ধরেই মাসে পাঁচটির কাছাকাছি ট্রাক আটক করে গোরক্ষকরা। এই নানা দলের সদস্যরা পুনের অন্তত সাতটি তালুকে সক্রিয়। অর্থাৎ মাসে ৩৫টা করে ট্রাক আটক হচ্ছে, বছরে ৪০০টা।
হিসেবটা মিলে যাচ্ছে।
পুণের কুরেশি সম্প্রদায়ের বর্ষীয়ানরা হিসেব করে জানাচ্ছেন, ২০২৩ সালে আনুমানিক ৪০০-৪৫০টি গাড়ি আটক হয়েছে তাঁদের – প্রত্যেকটিতে অন্তত ২ লাখ টাকার গবাদি পশু ছিল। খুব কম করে ধরলেও গোরক্ষকদের কারণে মহারাষ্ট্রের ৩৬টি জেলার মাত্র একটিতেই প্রায় ৮ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে – বংশানুক্রমিক জীবিকা থেকে সরে আসার কথা ভাবছেন কুরেশিরা।
“আমরা কখনও আইন হাতে তুলে নিই না,” দাবি গাওড়ের। “সবসময় নিয়ম মেনে চলি।”
গোরক্ষকদের রোষের শিকার ট্রাকচালকরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন।
*****
২০২৩-এর প্রথম দিকে সাসওয়াড়ে ২৫টি মহিষ-সহ শাব্বির মওলানির ট্রাক আটক করে গোরক্ষকরা। সেই রাতের কথা মনে করে এখনও কেঁপে ওঠেন শাব্বির।
“ভেবেছিলাম আজ রাতেই গণপিটুনিতে মরব,” বলছেন ৪৩ বছরের মওলানি। পুণের উত্তরে দু’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সাতারা জেলার ভাডালে গ্রামে বাড়ি তাঁর। “প্রচণ্ড মারধর, গালিগালাজ করে। আমি বলতে চেষ্টা করছিলাম, আমি তো ড্রাইভার শুধু। কিচ্ছু লাভ হয়নি।”
আহত মওলানিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁর উপর পশু নির্যাতন আইনে অভিযোগ দায়ের হয়। যারা তাঁকে মারধর করেছিল তাদের কোনও শাস্তি হয় না। “গোরক্ষকরা আমার ট্রাক থেকে নগদ ২০,০০০ টাকা চুরি করেছিল,” জানালেন তিনি। পুলিশকে আমি সেটা বলার চেষ্টা করলাম। প্রথমে ওরা আমার কথা শুনছিল। কিন্তু তারপর পণ্ডিত মোদক গাড়ি হাঁকিয়ে এল আর পুলিশ একেবারে গলে জল হয়ে গেল।”
মাসে ১৫,০০০ টাকা আয় করেন মওলানি। মাসখানেক পরে তাঁর মনিবের ট্রাকখানা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু গবাদি পশু এখনও গোরক্ষকদের জিম্মায়। “বেআইনি কিছু করে থাকলে পুলিশ আমাদের শাস্তি দিক,” বলছেন তিনি। “ওরা রাস্তায় ফেলে আমাদের মারধর করে কোন অধিকারে?”
আজকাল মওলানা যখনই বাড়ির বাইরে যান, দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না তাঁর স্ত্রী, ৪০ বছরের সামিনা। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর ফোন করতে থাকেন, স্বামী বেঁচে আছেন কিনা। “ওকে কী দোষ দেব,” বলছেন মওলানা। “এ কাজ ছেড়ে দিতে চাই, কিন্তু সারাজীবন তো এটাই করে এলাম। দুটো বাচ্চা আছে, মা অসুস্থ। সংসার চালাতে টাকা তো দরকার।”
সাতারা-নিবাসী আইনজীবী সরফরাজ সৈয়দ মওলানির মতো অনেকগুলি মামলা লড়েছেন। জানালেন, গোরক্ষকরা নিয়মিত আটক করা ট্রাক থেকে নগদ টাকা লুঠ করে, আর ড্রাইভারদের নির্দয়ভাবে মারধর করে। “কিন্তু এইসব কিছু কোনও এফআইআর-এ পৌঁছয় না,” বলছেন তিনি। “গবাদি পশু পরিবহণের ব্যবসা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমাদের পশ্চিম মহারাষ্ট্রের এর বাজারও সুপ্রসিদ্ধ। এই ট্রাকগুলো যেহেতু একটাই সড়কপথে যাতায়াত করে তাই ওদের [গোরক্ষক] পক্ষে ড্রাইভারদের উপর নজরদারি আর হেনস্থার কাজটা খুবই সহজ।”
লোন্ধে জানাচ্ছেন, কাজে রাখার জন্য ট্রাক চালক পাওয়া ক্রমশ দুষ্কর হয়ে উঠছে। “অনেকেই মজুরির কাজে ফিরে যাচ্ছে, মজুরি অনেক কম এবং অনিয়মিত হওয়া সত্ত্বেও,” জানালেন তিনি। “গবাদি পশু নিয়ে ট্রাক চালানো এখন প্রাণ বাজি রাখার সমান। ভীষণ মানসিক চাপ পড়ে। গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে এই গুন্ডা-রাজ।”
লোন্ধে জানালেন, আজকাল চাষিরা গবাদি পশুর জন্য দাম পাচ্ছেন অনেক কম। ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে, আর চালকের অভাবে আরও চাপ পড়ছে আগে থেকেই জর্জরিত শ্রমের বাজারেও।
“ফুলেফেঁপে উঠছে শুধু আইন নিয়ে ছেলেখেলা করা লোকগুলোই।”
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী