প্রথমবারটা প্রায় বেরিয়ে গিয়েছিল দিয়া।
চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সে, বাস কতক্ষণে ভর্তি হয়। সুরাট থেকে ঝালোড় যাওয়ার একটা টিকিট কেটেছিল। সেখান থেকে আর একঘণ্টার পথ, তারপরেই গুজরাটের সীমানা পেরিয়ে রাজস্থানের কুশলগড়ে তার বাড়ি।
জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিল দিয়া, রবি আসে পিছন থেকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে বাস থেকে নামিয়ে আনে তাকে।
চারপাশের লোকজন সবাই ব্যস্ত, মালপত্র তুলছে, বাচ্চা সামলাচ্ছে। রোষায়িত তরুণ আর সন্ত্রস্ত কিশোরীর দিকে তাকাবার সময় নেই কারও। “চিৎকার করতে ভয় করছিল,” বলছে দিয়া। রবির মেজাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাকে বলেছিল, চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়।
গত ৬ মাস ধরে তার আস্তানা তথা জেলখানা, অর্থাৎ নির্মাণ সাইটে ফিরে সে রাতে শুয়ে ঘুমোতে পারেনি দিয়া। সারা গায়ে ব্যথা। রবির মারের চোটে স্থানে স্থানে কেটেছড়ে গেছে, কালশিটে পড়েছে বহু জায়গায়। “ঘুঁসি মারছিল, লাথি মারছিল,” মনে করছে দিয়া। “ওকে যখন মারত রবিকে কেউ থামাতে পারত না।” পুরুষ কেউ বাধা দিলে বলা হত দিয়ার উপর নজর আছে তার। মেয়েরা যারা দেখতে পেত দূরে থাকত। কেউ আপত্তি জানালে রবি বলত, “মেরি ঘরওয়ালি হ্যায়, তুম কিঁউ বিচ মে আ রহে হো [আমার স্ত্রী হয়। তুমি নাক গলাচ্ছো কেন]?”
“প্রতিবার মার খাওয়ার পর হাসপাতালে যেতে হত মল্লম পট্টি [ক্ষতের ড্রেসিং] করাতে, ৫০০ টাকা করে খসত। রবির ভাই মাঝেমাঝে টাকা দিত, হাসপাতালে সঙ্গে যেত, একথাও বলত, “তু ঘর পে চলে যা [তুই বাপের বাড়ি ফিরে যা],” জানাচ্ছে দিয়া। কিন্তু সেটা কেমন ভাবে সম্ভব হবে দু’জনের কেউই জানত না।
দিয়া এবং রবি দু’জনেই রাজস্থানের বাঁসওয়ারা জেলার বাসিন্দা ভীল আদিবাসী। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি বহুস্তরীয় দারিদ্র্য রিপোর্ট অনুসারে দরিদ্র মানুষের সংখ্যায় রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে এই জেলা। তার মধ্যে বড়ো চাষজমির অভাব, সেচের অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব এবং সার্বিক দারিদ্র্যের কারণে কুশলগড় তেহসিল ছেড়ে দেশান্তরি হতে বাধ্য হচ্ছেন বহু ভীল আদিবাসী, যাঁরা তেহসিলের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ।
দিয়া আর রবিকে খালি চোখে দেখলে গুজরাটে রাজমিস্ত্রির কাজের খোঁজে আসা অনেকের মধ্যে আরও এক দেশান্তরি দম্পতি ছাড়া কিছুই মনে হবে না। কিন্তু দিয়া স্বেচ্ছায় দেশান্তরি হয়নি। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
রবির সঙ্গে একদিন বাজারে প্রথম যখন দেখা হয়, দিয়ার তখন ১৬ বছর বয়স, পাশেই সজ্জনগড়ের একটি স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। গ্রামের এক বয়স্ক মহিলা দিয়ার হাতে একটা চিরকুটে রবির ফোন নম্বর লিখে ধরিয়ে দিয়ে জোর করেছিলেন সে যেন রবির সঙ্গে একবার দেখা করে, রবি তার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এমনিই, খুব গুরুতর কিছু ব্যাপার নয়!
দিয়া ফোন করেনি। পরের সপ্তাহে বাজারে গিয়ে রবিকে সেখানে দেখে, অল্প কথা হয়েছিল। “হামকো ঘুমনে লে জায়েগা বোলা, বাগিডোরা। বাইক পে [আমায় বলেছিল বাগিডোরা ঘুরতে নিয়ে যাবে বাইক চাপিয়ে]। বলেছিল স্কুল থেকে এক ঘণ্টা আগে, দুপুর ২টো নাগাদ বেরিয়ে আসতে,” মনে করছে দিয়া। পরের দিন দিয়ার স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করছিল রবি, সঙ্গে এক বন্ধু।
“আমরা বাগিডোরা যাইনি। বাস স্ট্যান্ডে গেছিলাম। আমায় জোর করে আমেদাবাদের বাসে তুলে দিল,” জানাচ্ছে দিয়া। পাশের রাজ্যের আমেদাবাদ সেখান থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূর।
ভীতসন্ত্রস্ত দিয়া কোনওমতে বাবা-মাকে একটা ফোন করতে পেরেছিল। “আমার চাচা আমেদাবাদে এসেছিলেন আমায় নিয়ে যেতে। কিন্তু রবিকে ততক্ষণে গ্রামে ওর বন্ধুরা ফোন করে সব বলে দিয়েছে, তাই আমায় সুরাটে নিয়ে চলে আসে।”
তারপর থেকে দিয়া কারও সঙ্গে কথা বললেই সন্দেহ করতে শুরু করে রবি, মারধরেরও সেই শুরু। কল করার জন্য ফোন চাওয়া মানে যেচে যেচে মার খাওয়ার সামিল হয়ে যায়। দিয়ার মনে আছে, একদিন বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ উতলা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রবিকে বলেছিল একটিবার ফোনটা দিতে। তার জবাব, “আমায় বাড়িটার দোতলার ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিল। ভাগ্যক্রমে একটা জঞ্জালের স্তূপের উপর গিয়ে পড়েছিলাম। সারা গায়ে কেটেছড়ে গেছিল,” এখনও ব্যথা থেকে যাওয়া পিঠের একাধিক ক্ষত দেখিয়ে জানাল দিয়া।
*****
দিয়ার অপহরণের পর পর তাকে ফেরত আনার অনেক চেষ্টা করেছিলেন কমলা, দিয়ার ৩৫ বছর বয়সি, দিনমজুর মা। বাঁসওয়ারা জেলার ছোট্ট এক বস্তিতে তাঁদের এক-কামরার কাঁচা ঘরে বসে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন তিনি সেদিন। “বেটি তো হ্যায় হামারি। আপনে কো দিল নেহি হোতা কেয়া [আমারই মেয়ে তো। ওকে ফিরে পেতে মন চাইবে না]? রবি দিয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দিন কয়েক পর থানায় গিয়ে তার নামে এফআইআর করেন কমলা।
দেশে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যায় রাজস্থান তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে আছে। আবার এইধরনের অপরাধে চার্জশিট পেশ করার হার কিন্তু এ রাজ্যে সবচেয়ে কম – ৫৫ শতাংশ – বলছে জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো বা এনসিআরবি প্রকাশিত ক্রাইমস্ ইন ইন্ডিয়া ২০২০ রিপোর্ট। পুলিশের কেস ফাইল অবধি পৌঁছয় না প্রতি তিনটির মধ্যে দু’টি অপহরণের এফআইআরই। দিয়ারটিও কেস ফাইলে ওঠেনি।
“ওঁরা তো কেস তুলে নিয়েছিলেন,” মনে করে বললেন কুশলগড়ের ডেপুটি পুলিশ সুপার রূপ সিং। কমলা জানাচ্ছেন, বাঞ্জাড়িয়া বলে স্থানীয় খাপ-পঞ্চায়েত জাতীয় গ্রামের একটি দল বিষয়টায় হস্তক্ষেপ করে। তারা কমলা ও তাঁর স্বামী কিষনের উপর চাপ দিতে থাকে যাতে তাঁরা থানার বাইরে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেন রবির থেকে ‘কন্যাপণ’ চেয়ে – ভীলদের মধ্যে বিয়ের সময় পাত্রের পরিবারের তরফে পাত্রীর পরিবারকে পণ দেওয়ার রীতি আছে। (প্রসঙ্গত, পাত্র যদি পরে বিয়ে ভাঙতে চায়, তখন এই কন্যাপণ ফেরত চাইতে পারে যাতে সে আবার বিয়ে করতে পারে।)
দিয়ার পরিবার জানাচ্ছে, তাদের বলা হয়েছিল এক-দু’লাখ টাকা নিয়ে অপহরণের কেসটা তুলে নিতে। অগত্যা ‘বিয়ে’র সামাজিক স্বীকৃতিও মিলে গেল, দিয়া যে তখনও নাবালিকা এবং তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই। সাম্প্রতিকতম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা – ৫ বলছে, রাজস্থানে ২০-২৪ বছর বয়সি মহিলাদের এক-চতুর্থাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগে।
তিনা গরাসিয়া কুশলগড়ের এক সমাজকর্মী। নিজে ভীল আদিবাসী তিনা দিয়ার মতো ঘটনাগুলিকে স্রেফ পালিয়ে বিয়ে করার ঘটনা হিসেবে ছেড়ে দিতে রাজি নন। “আমাদের কাছে এধরনের যেসব ঘটনা আসে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার মনে হয় না মেয়েটি নিজের ইচ্ছেয় চলে গেছে। বা হয়তো গেছে, কিন্তু কোনওকিছুর লোভে, কিংবা স্রেফ প্রেমে পড়েই,” বলছেন বাঁসওয়ারা জেলায় আজীবিকা এনজিও-র লাইভলিহুড ব্যুরোর প্রধান। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশান্তরি মহিলাদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
“আমার চোখে এই চলে যাওয়াগুলো একটা ষড়যন্ত্রের অংশ, পাচারের একটা কৌশল। ভিতরে ভিতরে লোক থাকে যারা মেয়েদের এইধরনের সম্পর্কে ফাঁসায়,” যোগ করলেন তিনা। তাঁর দাবি, কোনও মেয়ের সঙ্গে শুধুমাত্র পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যও টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। “একটা ১৪-১৫ বছরের মেয়ে, তার প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ধারণা কতটুকু? জীবন নিয়েই বা কতটা?”
জানুয়ারির এক সকালে তিনার কুশলগড়ের অফিসে তিনটি পরিবার এসেছে তাদের মেয়েদের নিয়ে। সবারই গল্প কমবেশি দিয়ার সঙ্গে মেলে।
১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে স্বামীর সঙ্গে কাজের খোঁজে গুজরাটে চলে যান সীমা। “কারও সঙ্গে কথা বললেই তীব্র সন্দেহগ্রস্ত হয়ে যেত। একবার এত জোরে মেরেছিল যে ওই কান দিয়ে এখনও ঠিকমতো শুনতে পাই না,” জানালেন তিনি।
“ভয়ানক মারধর করত। এত যন্ত্রণা হত যে মাটি থেকে উঠতে পারতাম না; আর তারপর বলত আমি নাকি কামচোর [ফাঁকিবাজ]। অতএব ওই যন্ত্রণা নিয়েই কাজকর্ম করতে হত,” যোগ করলেন তিনি। যা আয় করতেন সোজা স্বামীর পকেটে ঢুকত, আর “ও আটাটুকুও কিনত না, সব মদ খেয়ে উড়িয়ে দিত।”
শেষ অবধি আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে স্বামীর কবল থেকে মুক্তি পান সীমা। তারপর থেকে সে অন্য এক মহিলার সঙ্গে থাকে। “আমি গর্ভবতী, কিন্তু ও বিয়েটাও ভাঙছে না, আমায় দিন গুজরানের জন্য কোনও টাকাপয়সাও দিচ্ছে না,” জানালেন তিনি। অগত্যা তাঁর পরিবার ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্ত্রী পরিত্যাগের অভিযোগে এফআইআর দায়ের করেছে। নারীর বিরুদ্ধে গৃহহিংসা-রোধী আইন , ২০০৫-এর ২০.১ (ডি) ধারা বলে, ভরণপোষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক, এবং এর অন্যথায় ফৌজদারি আইনবিধির ১২৫ ধারায় শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
রানির বয়সও ১৯ বছর, তিন বছরের এক সন্তান আছে, আর বর্তমানে আবারও গর্ভবতী। তাকেও স্বামী ত্যাগ করেছে, তার আগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও করেছে প্রচুর। “প্রতিদিন মদ খেয়ে এসে ঝগড়া শুরু করত, বলত “গন্দি অওরত, রন্ডি হ্যায় [নোংরা মেয়েছেলে, বেশ্যা একটা],” জানাচ্ছেন তিনি।
থানায় অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু আবার ওই বাঞ্জাড়িয়ার লোকজন এসে ৫০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে চুক্তি করায় যেখানে তার স্বামীর পরিবার লিখিত দেয় যে সে শুধরে যাবে। মাসখানেক পর আবার শুরু হয় অত্যাচার, কিন্তু এবার আর বাঞ্জাড়িয়াদের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। “আমি পুলিশে গেছিলাম, কিন্তু আগের অভিযোগ তুলে নিয়েছি বলে আর প্রমাণ নেই,” বলছেন রানি। স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর, কিন্তু এখন দায়ে পড়ে আইনের পাঠ পড়ছেন তিনি। ২০১৩ সালের তফসিলি জনজাতিগুলির পরিসংখ্যানগত বিবরণ বলছে, ভীল নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩১ শতাংশ ।
আজীবিকা ব্যুরো অফিসে দিয়া, সীমা, আর রানির মতো মেয়েদের আইনি তথা সার্বিক সহায়তা দেওয়া হয়। তাঁরা একটা পুস্তিকাও প্রকাশ করেছেন, “শ্রমিক মহিলাঁও কা সুরক্ষিত প্রবাস [শ্রমজীবী মহিলাদের নিরাপদ প্রবাসযাত্রা]” নাম দিয়ে, যাতে ছবি ও গ্রাফিক্স সহযোগে নানান হেল্পলাইন, হাসপাতাল, শ্রমিক কার্ড এবং আরও বহু মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া আছে। নির্যাতিতাদের পথ তবুও বন্ধুর, দিন কাটে থানা-কোর্ট-কাছারির চক্কর মেরে, কিন্তু পথের শেষ দেখা যায় না। তার সঙ্গে যদি জোড়ে ছোটো বাচ্চার দায়িত্ব, আবার কাজের খোঁজে প্রবাস পাড়ি দেওয়ার অবস্থাতেই থাকেন না অনেকে।
তিনা এই ঘটনাগুলিকে গৃহহিংসার পাশাপাশি অল্পবয়সি মেয়েদের পাচারের সমস্যা হিসেবেও দেখছেন। “আমরা অনেক ঘটনা দেখেছি যেখানে মেয়েটিকে বাধ্য করা হয়েছে ঘর ছাড়তে। তারপর এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষের হাতে হাতে ঘোরানো হয়েছে তাদের। আমার মনে হয় এটা তস্করি পাচার। সবকিছু বাদ দিয়ে যদি একদম সোজাসুজি ঘটনাগুলোকে দেখি, এগুলো নারী পাচার ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এটা ক্রমশ বাড়ছে,” যোগ করলেন তিনি।
*****
অপহরণের পর পরই, প্রথমে আমেদাবাদ এবং তারপর সুরাটে দিয়াকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। রবির সঙ্গে রোকড়ি করতে বেরোত সে – অর্থাৎ শ্রমিক মান্ডিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেখান থেকে কোনও ঠিকাদার এসে ৩৫০-৪০০ টাকার দিনমজুরির কাজে নিয়ে যেত তাদের। ফুটপাথে ত্রিপল খাটিয়ে শুতেন তাঁরা। কিছুদিন পর রবি কায়েম কাজ পেয়ে যায়, তারপর থেকে তারা বাড়ির সাইটেই থাকত, মাস মাইনে পেত।
“[কিন্তু] আমার রোজগার আমি নিজে কোনওদিন চোখেও দেখিনি। সব ও রেখে দিত,” জানাল দিয়া। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রান্না, ঘর সাফ করা, কাপড় কাচা এবং আর সমস্ত সংসারের কাজ করত সে। মাঝে মাঝে অন্য শ্রমজীবী মেয়েরা গল্পগুজব করতে আসত, কিন্তু রবি তার উপর নজরদারি বজায় রাখত।
“তিন-তিনবার আমার বাবা কারও না কারও হাত দিয়ে আমায় চলে আসার জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি যখনই বেরনোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম, কেউ না কেউ দেখে ফেলে [রবিকে] বলে দিত, আর ও আমায় যেতে দিত না। যেবার বাসে উঠে পড়েছিলাম, সেবারও কেউ একটা দেখে নিয়ে বলে দিয়েছিল, তাই ও আমার পিছু ধাওয়া করতে পেরেছিল,” বলছে দিয়া।
রোজগার হাতে পায় না, স্থানীয় ভাষা বলতে পারে না – দিয়া শুধু নিজের মাতৃভাষা ওয়াংড়ি বলতে পারে আর অল্প-স্বল্প হিন্দি – এই অবস্থায় গুজরাটে বসে রবির হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার সরকারি-বেসরকারি কোনওরকম সহায়তা পাওয়াই তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রবি তাকে জোর করে বাস থেকে নামিয়ে আনার মাস চারেক পর গর্ভবতী হয়ে পড়ে দিয়া। তার নিজের ইচ্ছায় এই গর্ভধারণ হয়নি।
মারধরের মাত্রা কিঞ্চিৎ কমে, কিন্তু বন্ধ হয়নি।
দিয়ার গর্ভাবস্থার আট মাসের মাথায় তাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসে রবি। সন্তানজন্মের জন্য তাকে ঝালোড়ের এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছেলেকে জন্মের পর বুকের দুধ খাওয়াতে পারেনি সে, কারণ শিশু টানা ১২ দিন আইসিইউ-তে ছিল এবং তার মধ্যে তার দুধ শুকিয়ে যায়।
সেই সময়ে রবির অত্যাচারের কথা দিয়ার পরিবারের কেউ জানত না। কিছুদিন থাকার পর বাড়ির সবাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল তাঁকে স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিতে – দেশান্তরি নতুন মায়েরা সদ্যোজাতদের সঙ্গে নিয়েই যান। কমলা ব্যাখ্যা করলেন, “মেয়েদের সাহারা [সহায়] হল তার বিয়ে-করা বর। ওরা একসঙ্গে থাকবে, কাজ করবে।” বাপের বাড়িতে থেকে গিয়ে নতুন মা আর শিশু সংসারে বোঝা হয়ে যাচ্ছিল।
এদিকে নির্যাতন তখন চলছে ফোনে ফোনে। বাচ্চার চিকিৎসার জন্য টাকা দিতে রাজি নয় রবি। বাড়ি ফিরে এসে ততদিনে মনে কিছুটা বল পেয়েছে দিয়া, তাই মাঝেসাঝে মুখে মুখে জবাবও দিয়ে দিত, “আচ্ছা তাহলে বাবাকে বলব।” কমলা স্মৃতিচারণ করলেন, “বহুত ঝগড়া করতে থে [ভীষণ ঝগড়া করত ও]।”
এমনই একটা ঝগড়ার মধ্যে রবি তাকে বলে সে অন্য মেয়ের সঙ্গে চলে যাবে। দিয়া জবাব দেয়, “তুমি যেতে পারলে আমিও পারি।” তারপর ফোন কেটে দেয়।
পাশের তেহসিলে নিজের বাড়িতেই তখন ছিল রবি। কয়েক ঘণ্টা পর তিনটে বাইকে করে আরও পাঁচজন লোক নিয়ে সে এসে হাজির দিয়ার বাড়িতে। দিয়াকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে যায় সে, প্রতিশ্রুতি দেয় আর এরকম ব্যবহার করবে না, আবার সুরাটেও নিয়ে যাবে।
“আমায় বাড়ি নিয়ে গেল। বাচ্চাকে একটা দোলায় রেখে দিল। মেরা ঘরওয়ালা [আমার স্বামী] আমায় থাপ্পড় মেরে, চুল ধরে টেনে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর ভাই আর বন্ধুরাও এল। গলা দবায়া [গলা টিপে ধরল], অন্যরা আমার হাত চেপে ধরল আর ও [রবি] অন্য হাতে একটা ক্ষুর দিয়ে আমার মাথা কামিয়ে দিল,” মনে করছে দিয়া।
দিয়ার মস্তিষ্কে দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেছে স্মৃতিটা। “আমায় একটা কাঠের থামে চেপে ধরেছিল। প্রাণপণে চিৎকার করছিলাম, কিন্তু কেউ আসেনি বাঁচাতে।” তারপর বাকিরা বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। “ও আমার কাপড় খুলে আমায় ধর্ষণ করল। ও বেরিয়ে গেল, তারপর আরও তিনজন ঢুকে এক এক করে আমায় ধর্ষণ করল। এই পর্যন্ত আমার মনে আছে, তারপর বেহোঁশ [অজ্ঞান] হয়ে গেছিলাম।”
ঘরের বাইরে তখন দিয়ার শিশুপুত্র পরিত্রাহী কান্না জুড়েছে। “শুনতে পেলাম আমার ঘরওয়ালা [স্বামী] আমার মাকে ফোনে বলছে, ‘ও ফিরবে না। আমরা এসে বাচ্চাটাকে দিয়ে যাব।’ মা রাজি হয়নি, বলে দেয় মা নিজেই আসবে।”
কমলা স্মৃতিচারণ করেন, তিনি যখন ও বাড়ি পৌঁছান রবি তাঁকে বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে। “আমি বললাম ‘না’। আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই।” আপাদমস্তক কাঁপতে কাঁপতে “যেন বা শ্মশানযাত্রার জন্য” মাথা-মোড়ানো দিয়া বেরিয়ে এল। “আমি আমার স্বামী, আর গ্রামের সরপঞ্চ আর মুখিয়াকে ফোন করলাম, ওরা পুলিশে খবর দিল,” মনে করছেন কমলা।
পুলিশ যতক্ষণে এসে পৌঁছলো অপরাধীরা গায়েব। দিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। “আমার সারাগায়ে কামড়ের দাগ ছিল,” মনে করছে সে। “ধর্ষণের কোনও পরীক্ষা হয়নি। আমার আঘাতের কোনও ছবি তোলা হয়নি।”
নারীর বিরুদ্ধে গৃহহিংসা-রোধী আইন, ২০০৫ -এর ৯ (জি) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, শারীরিক হিংসা ঘটে থাকলে পুলিশ শারীরিক পরীক্ষার নির্দেশ দিতে বাধ্য। দিয়ার পরিবার যদিও বলছেন যে তাঁরা পুলিশকে সবকিছু জানিয়েছিলেন, এই প্রতিবেদক যখন ডেপুটি সুপারকে প্রশ্ন করেন তিনি দাবি করেন যে দিয়া বয়ান বদল করেছিল, ধর্ষণের কোনও উল্লেখ করেনি, এবং তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা হয়েছে।
দিয়ার পরিবার এই কথা সম্পূর্ণ খণ্ডন করছে। “আধা আধা লিখা অউর আধা আধা ছোড় দিয়া [ওরা অর্ধেক লিখেছে আর অর্ধেক বাদ দিয়েছে],” বলছে দিয়া। “দু-তিনদিন পর আদালতে ফাইলটা পড়ি। দেখি যে আমায় যে চারজন ধর্ষণ করেছে সেটা কোথাও লেখেইনি। নামও লেখেনি, আমি কিন্তু নাম বলেছিলাম।”
প্রবাসে গৃহহিংসার শিকার মেয়েদের সমস্যা দ্বিগুণ – ঠিকাদারেরা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথাই বলে না, সবকিছু চলে স্বামীর মাধ্যমে, আর মেয়েরা যদি স্থানীয় ভাষা বলতে না পারেন তবে অন্যত্র সাহায্য চাওয়াও সম্ভব হয় না
রবি এবং আরও যে তিনজনকে দিয়া পুলিশের কাছে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রবির পরিবারের আরও কিছু সদস্যকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সবাই এখন জামিনে মুক্ত। রবির বন্ধু-পরিজন তাঁর জীবন শেষ করে দেওয়ার ধমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে বলে প্রায়ই শুনতে কানে আসে তাঁদের।
২০২৪ সালের শুরুর দিনে যখন এই প্রতিবেদক দিয়ার সঙ্গে দেখা করেন, দিয়ার রোজনামচা হল বারবার কোর্ট আর থানার চক্কর কাটা, আর ১০ মাসের শিশুপুত্রর লালন-পালন, যার মৃগীরোগ ধরা পড়েছে।
“যতবার কুশলগড় আসি, বাসে মাথাপিছু ৪০ টাকা [গচ্চা],” বলছেন দিয়ার বাবা কিষান। মাঝে মাঝে জরুরি ভিত্তিতে ডাক পড়ে, তখন বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটারের পথটা পাড়ি দিতে ২,০০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করতে হয়।
খরচ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কিন্তু কিষান আর প্রবাসে যাওয়ার কথা ভাবছেন না। “এই ব্যাপারটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বাইরে যাই কী করে? কিন্তু আবার কাজ না করলে সংসারই বা কথা থেকে চলবে?” প্রশ্ন তাঁর। “বাঞ্জাড়িয়া আমাদের ৫ লক্ষ টাকা দেবে বলেছিল মামলা তুলে নিলে। আমার সরপঞ্চ বললেন, ‘নিয়ে নাও।’ কিন্তু আমি বললাম না! কানুন অনুসারে সাজা হোক ওর।”
মাটির
বাড়ির মেঝেয় বসে এখন ১৯ বছরের দিয়া আশা করে যায়, তার নির্যাতক শাস্তি পাবে। এক ইঞ্চি
মতো চুল গজিয়েছে মাথায়। “আমার সঙ্গে যা পেরেছে করে নিয়েছে। আর ভয় পেয়ে কী হবে? আমি
লড়ব। ওর বোঝা উচিত এমন কাজ করলে তার ফল ভুগতে হয়। আর কারও সঙ্গে এমন করার সাহস পাবে
না।” গলা চড়ে যায় তার, “ওর শাস্তি হওয়া দরকার।”
এই প্রতিবেদনটি একটি সর্বভারতীয় সাংবাদিকতা প্রকল্পের অংশ যেখানে ভারতে যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকার মানুষদের যথাযথ যত্ন ও সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক, প্রশাসনিক, এবং কাঠামোগত বাধাগুলির উপর আলোকপাত করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস, ইন্ডিয়া’র সহায়তাপ্রাপ্ত একটি উদ্যোগ।
গোপনীয়তা বজায় রাখতে হিংসার শিকার মহিলা তথা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম বদলে দেওয়া হয়েছে।
অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী