“এমনি এমনিই সিক্স প্যাক অ্যাব্স হয়েছে আমার, জিন্দেগিতে কক্ষনো ব্যায়াম-ট্যায়াম করিনি। নিজেই দেখুন দেখি, শাহবাজের হাতের বাইসেপস্-গুলো!” সহাস্যে তার সহকর্মীর দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠল সদ্যতরুণ আদিল।
মহম্মদ আদিল ও শাবাজ আনসারি দুজনেই মীরাটের জিম ও ফিটনেস সরঞ্জাম শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক। জিমে একেকজন ব্যায়ামবীর সারাটা সপ্তাহে যত ওজন তোলেন, এই ছেলেরা একদিনেই তার চাইতে ঢের বেশি ভারোত্তলন করে ফেলে। তবে এক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের মীরাট নগরবাসী মুসলিম পরিবারের অল্পবয়সি এই ছেলেগুলির লক্ষ্যটা শারীরিক সুস্থতা নয়, বরং রুজিরুটির তাগিদ। হবে না-ই বা কেন, পশ্চিম ইউপির এই জেলাটি যে ক্রীড়া-সরঞ্জাম তৈরির অন্যতম কেন্দ্রবিশেষ।
পেশায় ব্যবসায়ী মহম্মদ সাকিব জানাচ্ছেন, “এই তো দিনকতক আগে, ছেলেপুলেরা ফটোশুট করে নিজের নিজের বাইসেপ (হাতের উপরি ভাগের পেশি) আর অ্যাব্স (পেটের পেশি) মাপছিল।” সুরজ কুণ্ড সড়কের তাঁর ভাড়া-করা পারিবারিক জিম সরঞ্জাম শোরুমের কাউন্টারে বসেছিলেন ৩০ বছর বয়সি সাকিব সাহেব। এই এক-কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এলাকা মীরাটের ক্রীড়া-সরঞ্জাম প্রধান বাজার।
“গৃহিণীদের ইস্তেমাল করা সাদামাটা ডাম্বেল থেকে পেশাদার খেলোয়াড়দের খটমট যন্ত্রপাতি, ইদানিং তো সব্বাই জিম আর ফিটনেস সরঞ্জাম কিনতে চায়,” বললেন তিনি।
কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, শতব্যস্ত রাজপথে একের পর এক বিদ্যুৎচালিত তিন-চাকার গাড়ি (স্থানীয় জবানে ‘মিনি মেট্রো’) ঢুকছে আর বেরোচ্ছে, প্রত্যেকটায় ডাঁই করা লোহার রড ও নল, কিংবা হোম-জিম ও আয়রন-বারের মতো তৈরি সরঞ্জাম। “ব্যায়ামের যন্তরপাতি সব ভাগে ভাগে তৈরি হয়ে পরে একত্রে জোড়া লাগানো হয়,” শোরুমের কাঁচের দরজা দিয়ে লৌহ-সামগ্রীর আনাগোনা দেখতে দেখতে জানালেন মহম্মদ সাকিব।
লৌহ-সামগ্রী নির্মাণে মীরাট যে শীর্ষস্থানে রয়েছে, সেটা নতুন কিছু নয়। “কাঁচিশিল্পে এ শহরের জগতজোড়া নামডাক,” পারিকে জানিয়েছিলেন সাকিব সাহেব। ২০১৩ সালে, আনুমানিক তিন শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পটি ভৌগলিক নির্দেশক পেয়েছিল।
তবে মীরাটের এই ব্যায়াম-সংক্রান্ত সরঞ্জাম শিল্পের ইতিহাস কিন্তু একেবারেই পুরোনো নয়, মোটে ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে তার জন্ম। মহম্মদ সাকিবের কথায়, “এই জেলার স্পোর্টস্ গুড ইন্ডাস্ট্রিতে যে স্থানীয় সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই গেড়ে বসেছিল, তারা আর খানকতক পঞ্জাবি বেনিয়া মিলে এই শিল্পে পয়লাবার পা রেখেছিল। লোহার কাজে দক্ষ মজুররা আগে থাকতেই এখানে ছিলেন, আর জিমের যন্তরপাতি বানাতে যা যা লাগে, সেই রিসাইকেল করা (পুনর্ব্যবহৃত) লোহার নল, রড আর পাত তো বরাবরই শহরের লোহা মাণ্ডিতে পাওয়া যেত।”
এখানকার অধিকাংশ কামার ও লোহা-ঢালাই মজুর মুসলিম, প্রত্যেকেই নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। “প্রতিটা বাড়ির বড়োছেলে বেল ছোট্টবেলার থেকেই তালিম পেতে থাকে,” বলছিলেন সাকিব সাহেব, “ধরা হয়, সৈফি/লোহার জাতির (সাবকাস্ট) লোকেরা এই কাজে খুব দক্ষ।” সাকিব সাহেব নিজে আনসারি সম্প্রদায়ের মানুষ — মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায় (সাবকাস্ট) রাজ্যের অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের তালিকায় নিবন্ধিত।
তাঁর কথায়, “ইসলামাবাদ, জাকির হুসেন কলোনি, লিসাডি গেট ও জাইদি ফার্মের মতন মুসলিমপ্রধান মহল্লায় অসংখ্য কারখানা রয়েছে।” মীরাট জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৪ শতাংশ মুসলিম, এই নিরিখে রাজ্যে মীরাট সপ্তম স্থানে রয়েছে (জনগণনা ২০১১)।
এই যে কামারদের সিংহভাগ মুসলিম, এমনটা যে শুধু মীরাটেই লক্ষ্য করা যায় তা কিন্তু নয়। ২০০৬-এর ভারতীয় মুসলিম সমাজের ( সাচ্চার সমিতি রিপোর্ট ) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাবিষয়ক খতিয়ান রিপোর্ট মোতাবেক বানোয়াট ধাতব সামগ্রী সহ তিনটি প্রধান নির্মাণশিল্পে কর্মরত মজুরদের একটা বড়ো অংশ মুসলমান।
দুই ভাই মহম্মদ নাজিম ও মহম্মদ আসিমের সঙ্গে এই নগরীর লৌহশিল্পে কামকাজ শুরু করেছিলেন মহম্মদ সাকিব। সাকিব সাহেবের দুই ভাইয়ের বয়স তখন বছর পঁয়ত্রিশেক হবে। আসলে ২০০০-এর গোড়ার দিকে তাঁদের পৈত্রিক কাপড়ের ব্যবসার ভরডুবি হয়ে যায়, তাই বাধ্য হয়েছিলেন রুজিরুটির তাগিদে মজুরি শুরু করতে।
আহমেদ নগর মহল্লায় তাঁদের ঘরে ডাম্বেলের চাকতি বানানো আরম্ভ করেন আসিম বাবু, নাজিম সাহেব লেগে পড়েন গাড়িঘোড়ার কলকব্জা নির্মাণের কাজে। ওস্তাদ কারিগর ফকরুদ্দিন আলি সৈফির সহকারী হয়ে একখান ধাতব-সামগ্রী বানোয়াট কারখানায় কাজে ঢোকেন মহম্মদ সাকিব। “উনি আমায় হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ধাতুর টুকরো-টাকরা কেটে, বেঁকিয়ে, ঝালাই করে, জোড়াতালি দিয়ে ব্যায়ামাগারের সরঞ্জাম, দোলনা, জালি ফটক জাতীয় নানান মালপত্তর বানানো যায়,” সাকিব সাহেব জানালেন।
আজ তিন ভাই মিলে নিজেদের ফিটনেস অ্যান্ড জিম ইক্যুপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা চালান তাতিনা সানি গাঁয়ে, মীরাটে তাঁদের শোরুম থেকে এটি আনুমানিক নয় কিলোমিটার দূরে। নানানতর লোহার জিনিসপত্র নির্মাণের অন্যতম কেন্দ্র মীরাট — এ জেলা থেকে মূলত যন্ত্রপাতি, কাঁচি ও লোহার আসবাবপত্র রপ্তানি করা হয় (জনগণনা ২০১১)।
“মীরাট এমন অনেক ওস্তাদ লোহা-কারিগর আছে যাঁরা আমার চাইতে ঢের বেশি জ্ঞানী-গুণী। তফাত একটাই, আমি আজ মজুর থেকে মনিব হয়ে উঠতে পেরেছি, ওঁদের অধিকাংশই সেটা পারেননি,” বলছেন মহম্মদ সাকিব।
বাকি দুই ভাইয়ের জমানো টাকায় কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনসে স্নাতকোত্তর (এমসিএ) করার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই জীবনে এতদূর আসতে পেরেছেন। “গোড়ায় ভাইরা একটু ইতস্তত বোধ করছিল বটে, তবে এটুকু হাড়ে হাড়ে জানত যে আমি এমসিএ করলে ইতিমধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠা জিম আর ফিটনেস সরঞ্জাম শিল্পে তাদের পক্ষে পা রাখাটা আসান হয়ে যাবে,” বললেন তিনি।
*****
“ব্যায়ামাগারের সরঞ্জামের জন্য ধাতুর কলকব্জা কেটেকুটে, ঝালাই করে, পালিশ তুলে, রং করে, পাউডার কোটিং দিয়ে বাঁধছাঁদ করতে হয়। আর ছোটোছোটো অংশগুলো পরে পরস্পরের সঙ্গে জোড়া হয়ে থাকে,” কারখানাটা আমায় ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বোঝাচ্ছিলেন সাকিব সাহেব, “আমজনতা তো শুধুই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জিমখানায় তৈরি হওয়া ঝাঁচকচকে যন্ত্র দেখেছে, তাই এখানে কোন কোন অংশ বানানো হচ্ছে, সেসব দেখলেও তারা বুঝবে না।”
তাঁর বর্ণিত জিমখানা আর এই কারখানার মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল নেই। টিনের ছাউনি ঢাকা তিনটে দেওয়াল, তাতিনা সানির এই কারখানাটি কাজের নিরিখে তিনভাগে বিভক্ত — বানোয়াটি এলাকা, রং-চাপানোর এলাকা, এবং প্যাকিং এলাকা। চার নম্বর দেওয়ালটি নেই, যাতে খানিক হাওয়াবাতাস চলাচল করতে পারে — গ্রীষ্মকালে পারদ এখানে ৪০, মায় ৪৫ অবধি চড়ে, তখন এটা না থাকলেই নয়।
কারখানার ভিতর ঘুরছিলাম বটে, তবে অত্যন্ত সাবধানে, কোথায় কখন পা ফেলছি, সেটার উপর নজর রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।
১৫ হাত লম্বা লোহার রড আর নল, ৪০০ কিলোর লোহার সিলিন্ডার, বেজায় ভারি-ভারি চ্যাপ্টা ধাতব পাত, যা কেটেছেঁটে ভারোত্তলনের ওজন-চাকতি বার করা হয়, তড়িৎচালিত ইয়াব্বড় সব যন্ত্র, নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে থমকে থাকা জিমখানার সরঞ্জাম — সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝের উপর। মাঝে একখান সরুমতন শুঁড়িপথ আছে বটে, তবে একচুল এদিক ওদিক হলেই চিত্তির! হয় ধারালো কিছুতে কেটে রক্তারক্তি হবে, কিংবা ওজনদার কিছু পায়ে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে দফারফা।
এসব বাদামি, ধূসর, কালো-কালো অনড়-অচল জগদ্দলের মাঝে চলাফেরা করতে থাকেন উজ্জলরঙা গেঞ্জি পরা মজুরেরা। ইলেকট্রিক যন্ত্র চালাচ্ছেন, ধাতুর সংস্পর্শে এলেই তারাবাতির মতো ছিটকোচ্ছে স্ফুলিঙ্গ।
শ্রমিকদের মধ্যে তাতিনা সানির মানুষ একমাত্র ১৮ বছরের মহম্মদ আসিফ, বাকিরা সবাই মীরাট নগরীর সংলগ্ন এলাকাগুলিতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকেন। “এখানে আড়াই মাস কাজ করছি, তবে এটা আমার প্রথম চাকরি নয়। এর আগে অন্য একটা জিম-মেশিন কারখানায় মজদুরি করতাম,” আসিফ জানাচ্ছে, এই বয়সেই সে লোহার নল কাটাইয়ে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। যেমন-তেমন ভাবে ডাঁই করে রাখা ১৫ হাত লম্বা নলের গাদা থেকে একের পর এক পাইপ টেনে বার করে মেঝের উপর সাজিয়ে রাখছে ছেলেটি, তারপর যে ধরনের জিম-সরঞ্জাম বানানো হচ্ছে, সেটার নকশা অনুসারে ইঞ্চি-টেপ দিয়ে কাটাইয়ের জায়গা মেপে মেপে দাগ দিয়ে রাখছে।
“আমার আব্বু অটো চালান, তবে অটোটা নিজস্ব নয়,” আসিফ আরও জানিয়েছিল, “বাবা যা ইনকাম করেন তা দিয়ে সংসার চলে না, তাই সাত-তাড়াতাড়ি আমায় রোজগেরে হয়ে উঠতে হয়েছে।” মাস গেলে আজ সে ৬,৫০০ টাকা মজুরি পায়।
কারখানায় অন্য একটি জায়গায় ঘুর্ণিকরাত চালিয়ে নিরেট একখান লোহার বেলন টুকরো করছেন মহম্মদ নৌসাদ। ৩২ বছর বয়সি নৌসাদ সাহেব এখানকার লেদ-মেশিন যন্ত্রবিদ, ২০০৬ থেকে আসিম বাবুর সঙ্গে কাজ করছেন। ওজন অনুযায়ী বেশ কয়েকটি লোহার চাকতি একটার উপর আরেকটা সাজানো রয়েছে তাঁর কর্মস্থলে, সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, “হরেক কিসিমের ওজন-তোলা ব্যায়াম-সরঞ্জামে এগুলো খাপানো হবে।” তাঁর বেতন মাসিক ১৬ হাজার টাকা।
নৌসাদ সাহেবের কর্মস্থলটির বাঁদিকে বসে আছেন মহম্মদ আসিফ সৈফি, ৪২ ও আমির আনসারি, ২৭। তাঁরা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জুড়ে জুড়ে একটি আট-ভাগের মাল্টি-জিম বানাচ্ছেন, এটি কুপওয়ারার (জম্মু ও কাশ্মীর) একটি সামরিক শিবিরে পাঠানো হবে।
এই সংস্থার খদ্দেরদের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলি শ্রীনগর ও কাত্রা (জেঅ্যান্ডকে), আম্বালা (হরিয়ানা), বিকানের (রাজস্থান) ও শিলংয়ের (মেঘালয়) মতন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। “তাছাড়া মণিপুর বা কেরালার মতো রাজ্যের বেশ কিছু বেসরকারি জিমখানা রয়েছে। উপরন্তু আমরা নেপাল আর ভুটানেও রপ্তানি করি,” জানালেন সাকিব সাহেব।
মহম্মদ আসিফ সৈফি ও আমির আনসারি দুজনেই আর্ক ঝালাই বিশেষজ্ঞ, ছোটো যন্ত্রাংশ নির্মাণের পাশাপাশি তাঁরা সেগুলো জোড়া লাগিয়ে বৃহত্তর জিম-সরঞ্জামও বানান। কোম্পানি কতটা বরাত পাচ্ছে, আর মাসিক কতগুলো যন্ত্র তাঁরা বানিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন, সেটার নিরিখে এঁরা মাসিক ৫০-৬০ হাজার টাকা উপার্জন করেন।
“আর্ক ওয়েল্ডিং মেশিনের আগায় একটা পাতলা মতন বিদ্যুদ্বাহক (ইলেক্ট্রোড) রয়েছে, যেটা মোটাসোটা লোহার পরত ফুটো করে ঢুকে গলিয়ে দেয়,” আমায় বোঝাচ্ছিলেন আমির, “ধাতুর দুটো টুকরো জোড়ার সময় বিদ্যুদ্বাহকটা ধীরস্থির হাতে নাড়াচাড়া করতে হয়, ওই জন্যই এটা শিখে-টিখে ওস্তাদ হয়ে ওঠা খুবই কঠিন।”
“আমির আর আসিফ বাবুরা ঠেকায় [চুক্তিমাফিক] কাজ করেন,” বেতনের রকম-সকম বুঝিয়ে বললেন মহম্মদ সাকিব, “যে কাজে সবচেয়ে বেশি দক্ষতা লাগে সেগুলো চুক্তিমাফিক করাই, অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতার কাজগুলোর ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। ওস্তাদদের বেজায় চাহিদা, তাই তো ওঁরা বেশি বেশি পারিশ্রমিকের জন্য দরদাম করতে সক্ষম।”
হঠাৎই কারখানার ভিতর ঝুপ করে নেমে এলো অন্ধকার! লোডশেডিং হয়েছে, জেনারেটর চালু হওয়া অবধি কয়েক মুহূর্তের জন্য কামকাজ সব থমকে দাঁড়ালো। একেই তো বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলো চলছিল, তার সঙ্গে এবার যোগ হল জেনারেটরের গর্জন। অগত্যা, তারস্বরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন শ্রমিকরা, নইলে কিচ্ছুটি শোনা যাবে না।
পাশের কর্মস্থলে একটি জিম-সরঞ্জামের অংশাদির জোড়গুলো মেটাল ইনার্ট গ্যাস (মিগ) ওয়েল্ডার দিয়ে আরও মজবুত করে তুলছেন ২১ বছর বয়সি ইবাদ সলমানি। তাঁর কথায়: “মোটা পাত আর পাতলা পাত আলাদা আলাদা তাপমাত্রায় ঝালাই করতে হয়, এটা না জানলে লোহা গলে একাকার হয়ে যাবে।” মাস গেলে ১০ হাজার টাকা রোজগার করেন তিনি।
নুয়ে বসে ধাতুর যন্ত্রাংশ ঝালাই করছেন ইবাদ, হাতে একখান কবচ ধরা, নইলে স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে এসে চোখ-হাত সব ঝলসে দেবে। “আমাদের সব্বার কাছে সুরক্ষা-সরঞ্জাম আছে। কোনটা নিরাপদ, কোনটা বিপজ্জনক, কোনটায় সুবিধা বা অসুবিধা — মজুররা এসব নিজের নিজের মতো করে বুঝে নিয়ে সুরক্ষা-সরঞ্জাম ইস্তেমাল করেন।”
“আঙুল পুড়ে যায়; পায়ের উপর লোহার পাইপ এসে পড়ে। কেটে-ফেটে যাওয়া তো নেহাতই মামুলি,” উদাসীন কণ্ঠে বলছিলেন আসিফ সৈফি, “ছোট্টবেলার থেকেই আমাদের এসবে গা-সওয়া হয়ে গেছে। এ কাজ ছেড়ে দেওয়ার কোনও সওয়ালই ওঠে না।”
এখানে সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ কারিগর বাবু খান, বয়স ৬০, ফুলকির থেকে বাঁচতে টুকরো টুকরো সুতির কাপড় দিয়ে দুই বাহুর নিম্নভাগ, শরীর ও পা দুটো ঢাকছেন। “কম বয়সে অন্য একটা জিম-সরঞ্জাম কারখানায় লোহার রড ঝালাই করতাম, তবে ইদানিং বাফিংয়ের (পালিশের সর্বশেষ ধাপ) কাজ করি,” বললেন তিনি।
“কাটাকাটি ও ঝালাইয়ের বখতে ধাতুর গা খানিক এবড়ো-খেবড়ো হয়ে যায়, সেগুলো পালিশ করতে বাফিং লাগে, তকনিকি প্রক্রিয়া ওটা দিয়েই শেষ হয়,” বুঝিয়ে বললেন সাকিব সাহেব। বাবু সাহেবের মাসিক তনখা ১০ হাজার টাকা।
ধাতব যন্ত্রাংশের গা ও জোড়গুলো মসৃণ হয়ে গেলে তাতে বডি ফিলার পুট্টি লাগিয়ে রেগমল (শিরিষ কাগজ) দিয়ে ঘষেমেজে সাফ করার দায়িত্বে রয়েছেন ৪৫ বছরের শাকির আনসারি। সম্পর্কে তিনি মহম্মদ সাকিবের শ্যালক, এখানে আজ ছ’বছর ধরে ঠিকায় কাজ করছেন। তাঁর মাসিক বেতন হাজার পঞ্চাশেক। “আমার নিজস্ব বানোয়াট কারবার ছিল, ডিজেল-চালিত অটোরিক্সার লোহার মুখনল বানাতাম। কিন্তু সিএনজি (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) অটো এসে বাজার দখল করায় সে ব্যবসাটা চৌপাট হয়ে গেল,” শাকির বাবু দুঃখ করছিলেন।
যন্ত্রাংশের গায়ে তিনি প্রাইমার (প্রাথমিক রঙের প্রলেপ) ও রং চাপানোর পর সেগুলো যান্ত্রিক ভাবে পাউডার-কোটিং করা হয়, “যার ফলে এগুলোয় জং ধরে না, টেকসই হয়,” জানালেন সাকিব সাহেব।
সদ্য নির্মিত সরঞ্জামের অংশাদি এবার ফটকের কাছেই একটা জায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে বাঁধছাঁদ করা হয়, তারপর পালা ট্রাকে তুলে বিদায় জানানোর। প্যাকিং ও ফিটিংয়ের দায়িত্ব রয়েছে একদল তরুণ ছেলে — মহম্মদ আদিল, সমীর আব্বাসি, মহসিন কুরেশি ও শাবাজ আনসারি — বয়স ১৭-১৮ বছর এবং মাথা-পিছু আয় মাসিক ৬,৫০০ টাকা।
কুপওয়ারার সেনা ব্যায়ামাগারের লরি এসে গেছে, তাই চটপট মালপত্তর ট্রাকে তোলার কাজে লেগে পড়েছে ছেলেরা।
“ট্রাকে চেপে বরাতি মালপত্তর যেখানেই যাক না কেন, সেসব জোড়া লাগাতে আমরা ট্রেনে চেপে পিছু নিই। এই চাকরি আছে বলেই না পাহাড়-পর্বত, দরিয়া, মরুভূমি, এসব দেখার সুযোগ মিলছে,” বলে ওঠে সমীর।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র