পারি'র এই প্রতিবেদনটি পরিবেশ সংক্রান্ত সাংবাদিকতা বিভাগে ২০১৯ সালের রামনাথ গোয়েঙ্কা পুরস্কার প্রাপ্ত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি সিরিজের অংশ।
সাইক্লোনের স্মৃতি আজও কাজললতা বিশ্বাসকে তাড়া করে ফেরে। যদিও সাইক্লোন আইলা আঘাত হেনেছিল আজ থেকে দশ বছর আগে, তবু তাঁর পরিষ্কার মনে আছে ২০০৯ সালের ২৫শে মে দিনটা।
তখন সবে দুপুর। “নদীর [কালিন্দী] জল হুহু করে গ্রামের ভিতর ঢুকে সব বাড়ি-ঘর ভাসিয়ে দিল”, বললেন কাজললতা। নিজের গ্রাম গোবিন্দকাটি থেকে সাত কিমি দূরে কুমীরমারি গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন সেদিন তিনি। “আমরা ৪০-৫০ জন একটা নৌকায় আশ্রয় নিয়ে সারাটা দিনরাত কাটিয়েছিলাম। রাতে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। দেশলাই কাঠিগুলি পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিল। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের চমকেই কেবল কিছু ঠাওর করা সম্ভব হচ্ছিল।”
৪৮ বছর বয়সী কৃষক কাজললতা নিজের বাড়ির বাইরে বসে দুপুরের খাওয়ার জন্য মাছ কুটতে কুটতে বলতে থাকেন, “সেই রাত কখনও ভোলার নয়। এক ফোঁটা খাওয়ার জল ছিল না। আমি কোনরকমে একটু বৃষ্টির জল প্লাস্টিকের ব্যাগে ধরেছিলাম। তাই দিয়েই আমার দুই মেয়ে আর ও তাদের তুতো বোনের ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলাম খুব তেষ্টা পেলে।” এইসব কথা মনে করে তাঁর গলা কেঁপে উঠল।
পরদিন তাঁরা একটি নৌকা করে গ্রামে আসেন। তারপর বন্যার জলের মধ্যে হেঁটে বাড়ি ফেরেন। “জল যেখানে বেশি ছিল সেখানে আমার বড়ো মেয়ে তনুশ্রী – তার বয়স তখন ১৭ - প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ওর কাকিমার শাড়ির আঁচল ধরে ফেলেছিল,” বললেন কাজললতা - ওঁর চোখে ফুটে ওঠে আতঙ্ক।
তাঁর ছোটো মেয়ে, ২৫ বছরের অনুশ্রীর বিয়ের সময় সাইক্লোন ফণী এসে আবারও সেই ত্রাস সঞ্চার করেছে।
বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ৬ই মে। পঞ্চায়েত থেকে মাইকে আর সরকারের তরফে রেডিওতে ফণীর পূর্বাভাস আসতে শুরু করে এর কয়েকদিন আগে থেকেই। “ভাবুন আমাদের অবস্থাটা আর মনের ভয়ের কথা,” বললেন কাজললতা। “হাওয়ায় আর বৃষ্টিতে আমাদের সব প্রস্তুতি নষ্ট করে দেবে ভেবে আমরা ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। বিয়ের কদিন আগে খানিক বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভগ্যিস সাইক্লোন আমাদের গ্রামে আসেনি,” তাঁর গলায় স্বস্তি।
ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর ২রা মে অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা (সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য) ও পশ্চিমবঙ্গে ফণীর আগাম সতর্কবার্তা জারি করে। ফণীর কথা বলতে গিয়ে ৮০ বছর কৃষক ও রজত জুবিলি গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক প্রফুল্ল মণ্ডল কণ্ঠস্বর কয়েক ঘাট উপরে তুললেন, “ফণী খুব অল্পের জন্য সুন্দরবনকে ছেড়ে দিয়েছে। আমরা বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনেছি। ফণী আঘাত করলে ঘর-বাড়ি জমি-জমা সবসুদ্ধ আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম...”
মণ্ডল এবং কাজললতা দুজনেই জানেন সুন্দরবনে সাইক্লোন খুবই সাধারণ বিষয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট ও অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিভাগ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে সাইক্লোনজনিত কারণে ‘অতি ক্ষয়ক্ষতিপ্রবণ অঞ্চল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
মণ্ডল এবং কাজললতার গ্রাম যথাক্রমে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা এবং উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের ১৯টি ব্লকের মধ্যে আছে এই দুটিও। এর মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় ৬টি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ১৩টি।
ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ১০,২০০ বর্গ কিমি অঞ্চল জোড়া সুন্দরবন এক অতি বৃহৎ বদ্বীপ ও পৃথিবীর বৃহত্তম ঘনসন্নিবিষ্ট ম্যানগ্রোভ অরণ্য। “সুন্দরবন অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র...” বলছে বিল্ডিং রেসিলিয়েন্স ফর দ্য সাস্টেইনেব্ল ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য সুন্দরবনস্ নামের বিশ্ব ব্যাঙ্ক রিপোর্ট। “গোটা সুন্দরবন তার অসামান্য ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্রের জন্য খ্যাত - এর মধ্যে আছে রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ, নদীমোহনায় বসবাসকারী কুমির, ভারতীয় পাইথন, এবং নদীজাত বিভিন্ন প্রজাতির শুশুকের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। ভারতের স্তন্যপায়ী পশুর ১০ শতাংশ ও ভারতে প্রাপ্ত পাখির ২৫ শতাংশের অধিকের বাস সুন্দরবনে।”
৪,২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল ব্যাপী সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে এইসব বিচিত্র জীব ছাড়াও ৪৫ লক্ষ মানুষের বাস, তার মধ্যে চরম আবহাওয়া আর কঠিন ভূপ্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করা স্বল্প রুজি নির্ভর বহু প্রান্তিক মানুষের একটা বড়ো অংশও আছে।
যদিও আইলার পর এই অঞ্চলে বড়ো কোনও সাইক্লোন হয়নি তবু এই এলাকা খুবই ক্ষয়-ক্ষতি প্রবণ। পশ্চিমবঙ্গ সকারের ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের জন্য খড়্গপুর আইআইটির তৈরি করা ২০০৬ সালের রিপোর্ট বলছে যে ১৮৯১ থেকে ২০০৪ এর মধ্যে রাজ্যে ৭১টি সাইক্লোন হয়েছে। ওই সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার গোসাবা ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্লক — সেখানে ছয়টি অতি ভয়াবহ সাইক্লোন ও ১৯টি নিয়মিত সাইক্লোন হয়।
আইলা পূর্ববর্তী সাইক্লোনের কথা প্রফুল্ল মনে করতে পারেন। “শক্তিশালী হিংস্র বাতাস নিয়ে আসা ১৯৯৮ সালের সাইক্লোনের কথা আমি কখনও ভুলব না (স্বাধীনতার পর আইলার চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী ঝড় হিসাবে চিহ্নিত এই ঝড়। আইলা ছিল ‘ভয়াবহ সাইক্লোনিক ঝড়’)। তারও আগে ১৯৮৮ সালের ঝড়ের কথা মনে করতে পারি,” তিনি বললেন।
কিন্তু এই ঝোড়ো অতীত সত্ত্বেও নিম্নচাপজাত সাইক্লোন (ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের কাছে প্রতি ঘন্টা ৩১-৬০ কিমি বেগে আসা ঝড় যা সাইক্লোনের ৬২-৮০ গতিবেগের নিচে) নিম্ন গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে বিগত দশ বছরে ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানাচ্ছেন কলকাতার এক সমুদ্রবিজ্ঞনী ডঃ অভিজিত মিত্র তাঁর ২০১৯ সালে রচিত ম্যানগ্রোভ ফরেস্টস ইন ইন্ডিয়া। এক্সপ্লোরিং ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস শিরোনামের বইটিতে। “তার মানে এখন সাইক্লোন হচ্ছে আরও ঘনঘন,” তিনি বলছেন।
অন্য আরও কিছু সমীক্ষাও দেখাচ্ছে যে সুন্দরবন লাগোয়া বঙ্গপোসাগর অঞ্চলে সাইক্লোন বেড়েছে। ২০১৫ সালে ডাইভরসিটি পত্রিকায় প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে যে ১৮৮১ থেকে ২০০১ সময়কালে সাইক্লোনের ঘটনা বেড়েছে ২৬ শতাংশ। ১৮৭৭ থেকে ২০০৫ সালের মে, অক্টোবর, নভেম্বর মাস জুড়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৭ সালে করা একটি গবেষণা দেখাচ্ছে যে এই তীব্র সাইক্লোনের মাসগুলিতে ১২৯ বছরে সাইক্লোনের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে (আরও অনেকের মতো একথা বলছে জার্নাল অফ আর্থ সাইন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র)। ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৮০ থেকে ২০০৭ জুড়ে প্রতি দশকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে, যা বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের হার দশক প্রতি ০.০৬ ডিগ্রির তুলনায় বেশি।
এর ফলেই ঘটেছে নানা বিপত্তি। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান কেন্দ্রের অধ্যাপক সুগত হাজরা বলছেন, “সুন্দরবনে শেষ বড়ো সাইক্লোনের ঘটনা যদিও ২০০৯ সালে ঘটেছে, এর পরবর্তীতে উত্তর বঙ্গপোসাগরে একের পর এক সাইক্লোনের কারণে এই অঞ্চল বার বার প্লাবিত হয়েছে।”
বিশ্বব্যাঙ্ক রিপোর্ট বলছে বাঁধ “সুন্দরবনে, সাইক্লোন ঝড় ও সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জরুরি নিরপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, ও ১৯ শতাব্দীর ৩,৫০০কিমি বাঁধ নষ্ট হতে থাকার কারণে বদ্বীপ অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সাইক্লোনের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা অঞ্চলের মানুষ ও তাদের জমিজিরেতকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে...”
২০১১ সালের ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের গবেষণা পত্র বলছে যে সাগর দ্বীপ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে কৃত পরিমাপ অনুসারে সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনামূলক গড় উচ্চতা ২০০২-২০০৯ অবধি ১২ মিমি করে প্রতি বছর বেড়েছে বা ২৫ বছর সময়কালে বছর প্রতি ৮ মিমি হারে বেড়েছে বলা চলে।
উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ম্যানগ্রোভ অরণ্যেরও ক্ষতিসাধন করছে। এই অরণ্য উপকূলবর্তী অঞ্চলকে সাইক্লোন ও ভূমিক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্র এবং বাংলার বাঘের আবাসস্থল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের ২০১০ সালের টেম্পোরাল চেঞ্জ ডিটেকশন (২০০১-২০০৮) স্টাডি অফ সুন্দরবনস্ নামক সমীক্ষা বলছে অরণ্যের পরিধির হ্রাস ঘটিয়ে সাইক্লোন ম্যানগ্রোভ অরণ্যের স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে।
রজত জুবিলি গ্রামের মৎস্যজীবী অর্জুন মণ্ডল ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে গভীরভাবে সচেতন। সুন্দরবন গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা (সুন্দরবনস্ রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি) নামক একটি বেসরকারি অলাভজনক সংগঠনের সঙ্গে তিনি কাজ করতেন। “জলবায়ুর বিববর্তনের কথা সবাই শুনেছেন, কিন্তু তা আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করছে? এ সম্বন্ধে আমাদের আরও জানা দরকার,” ২০১৯ সালের মে মাসে তিনি আমাকে বলেছিলেন।
২৯ জুন ২০১৯-এ পীরখালিতে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে অর্জুন মণ্ডল বাঘের শিকার হন। সুন্দরবনের মানুষ বরাবরই বাঘের শিকার কিন্তু বাঘের আক্রমণ সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান ঘটনার কারণ অবশ্যই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির জন্য অরণ্যের ক্ষয়জনিত কারণে গ্রামের মনুষ্যবসতি অঞ্চলের সন্নিকটে বাঘের ঢুকে পড়া।
গোসাবা যেখানে অবস্থিত সেই মধ্যসুন্দরবন অঞ্চলে বিশেষ করে সাইক্লোনের আঘাতের কারণে জলে লবণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। “...সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বদ্বীপ এলাকায় বহতা জলের পরিমাণে হ্রাসের কারণে জলে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের চরম ক্ষতিসাধন করছে”, বলছে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট।
একটি গবেষণাপত্র যার সহ-রচয়িতা ডঃ মিত্র, সেটি সুন্দরবনকে ‘উচ্চ-লবণাক্ততাময়’ (হাইপারস্যালাইন) অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। “মধ্য-সুন্দরবন অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে জলে লবণের ভাগ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে জলবায়ুর বিববর্তনের স্পষ্ট যোগ আছে”, বলছেন ডঃ মিত্র।
অন্য গবেষকরা বলছেন বিদ্যাধরী নদীতে পলি পড়ার ফলে হিমালয়ে থেকে বহতা জল মধ্য ও পূর্ব সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারছে না। পলি পড়ার কারণ হিসাবে তাঁরা জমিদখল, চাষাবাদ, মনুষ্য বর্জ্য ও মৎস্য চাষজাত বর্জ্য নদীতে ফেলা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ (পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গার উপর) মধ্যসুন্দরবন অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
রজত জুবিলি গ্রামের মণ্ডল পরিবার জানে লবণ বৃদ্ধির পরিণাম — আইলার পর তিন বছর তাঁদের বিক্রি করার মতো চাল ছিল না। চাল বিক্রি করে ১০,০০০-১২,০০০ টাকার বার্ষিক রোজগার একেবারে উবে গিয়েছিল। “ধান চাষ নষ্ট হওয়ার ফলে গ্রাম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল কারণ গ্রাম থেকে পুরুষের দল কাজের খোঁজে তামিলনাডু কর্ণাটক গুজরাট মহারাষ্ট্রে পাড়ি দেন — সেখানে তাঁরা কারখানায় বা নির্মাণক্ষেত্রে শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দেন”, প্রফুল্ল মনে করে বললেন।
সারা রাজ্য জুড়ে আইলার তাণ্ডবে ২ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল তথা ৬০ লক্ষ মানুষের ক্ষতি হয় এবং ১৩৭ জনের মৃত্যু তথা এক লক্ষ ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়। “আমার গ্রামে এমন কেউ ছিলেন না যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হননি”, বললেন প্রফুল্ল। আমার ফসল, ঘরবাড়ি সব ধ্বংস হয়ে যায়। আমি ১৪টি ছাগল হারাই, ধান চাষ করতে পারিনি তিন বছর। সব আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। সে বড়ো কষ্টের সময় গেছে। জীবিকার জন্য আমি ছুতোরের কাজ নিই, তাছাড়াও আরও টুকিটাকি কাজ করতে শুরু করি।”
আইলার কারণে জমিতে লবণ বেড়ে যাওয়ায় কাজললতার পরিবার তাঁদের ২৩ বিঘা জমির (৭.৬ একর) মধ্যে ৬ বিঘা জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল। জমিতে লবণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে একটা ঘাসের শিসও গজায়নি টানা দুবছর। তারপর ধীরে ধীরে সর্ষে, বাঁধাকপি ফুলকপি, লাউ হতে শুরু করে, আমাদের খোরাকি হিসেবে যথেষ্ট হলেও বিক্রির জন্য তা যথেষ্ট ছিল না”, তিনি বললেন। “আমাদের একটা বড়ো পুকুরও ছিল, তাতে শোল মাগুর রুই মাছ হত — বিক্রি করে বছরে ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা রোজগার হত। আইলার পর জল এতটাই নোনা হয়ে যায় যে এখন প্রায় আর কোনও মাছই নেই।”
আইলার কারণে জমিতে লবণ ও ক্ষার বেড়ে যাওয়ায় জমির যে অবনতি হয়েছে তার ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ধান চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানাচ্ছে ২০১৬ সালে পরীক্ষামূলক জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি অ্যান্ড ও অ্যাগ্রিকালচারাল সাইন্স –এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র। এখানে বলা হচ্ছে যে ধান চাষ করতে হলে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিকমাত্রায় ফসফেট ও পটাশযুক্ত সার ব্যবহার করতে হবে।
“আইলার পর সারের ব্যবহার বেড়েছে। তাহলেই আমরা প্রয়োজনীয় পরিমাণ ফসল উৎপন্ন করতে পারি”, বললেন প্রফুল্ল মণ্ডলের ৪৮ বছর বয়সী পুত্র প্রবীর মণ্ডল। “এই জিনিস খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো না, কিন্তু তাও আমাদের খেতে হচ্ছে। আমার মনে আছে আমরা ছোটোবেলায় কেমন চাল খেতাম। শুধু শুধুই তা খেতে পারতাম। এখন তরকারি দিয়ে খেলেও মনে হয় কিছু একটা যেন নেই।”
তাঁর বাবার ১৩ বিঘা জমি (৪.২৯ একর) আছে, বিঘা প্রতি ৮-৯ বস্তা ধান হয় — এক বস্তায় ৬০ কিলো ধান ওঠে। “ধান বোনা, কাটা, তোলা আর সারের খরচ ধরলে দেখা যাবে যাবতীয় খরচের পর আয় খুব অল্পই হয়,” বললেন প্রবীর।
২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্র বলছে আইলার পর সুন্দরবন জুড়ে ধানের উৎপাদন অর্ধেক হয়ে গেছে — ১.৬ হেক্টর পিছু ৬৪-৮০ কুইন্টালের বদলে ৩২-৪০ কুইন্টাল হয়েছে। প্রবীর বললেন এখন ধান উৎপাদন আইলা পূর্ববর্তী পরিমাণে পৌঁছলেও ওঁদের পরিবারসহ গ্রামের অন্যান্যরা জুন থেকে সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিপাতের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকেন।
অথচ বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে অনিশ্চিত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মৌসুমী বর্ষার দেরিতে আগমন ও বৃষ্টিপাতে ঘাটতি হল জলবায়ুর পরিবর্তনের ফল,” বললেন প্রফেসর হাজরা।
বিগত দুই দশক ধরে উত্তর বঙ্গোপসাগর (যেখানে সুন্দরবন অবস্থিত) অঞ্চলে দিনে ১০০ মিলিমিটারের অধিক ভারি বৃষ্টিপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানাচ্ছে কলকাতার সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও ধান রোপণের সময়ে যথেষ্ট বৃষ্টি নেই বলে জানালেন প্রফেসর হাজরা — ৪ঠা সেপ্টেম্বর অবধি দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩০৭ মিলিমিটার ও উত্তর ২৪ পরগনায় ১৫৭ মিমি বৃষ্টিপাতে ঘাটতি হয়েছে।
কেবল এই বছর নয়, বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা বা আধিক্য কয়েক বছর ধরেই সুন্দরবনে ঘটে চলেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জুন থেকে সেপ্টেম্বরের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫৫২.৬ মিমি। ২০১২-২০১৭ সালের মৌসুমী বর্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এই ছয় বছরের মধ্যে চার বছরই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে, তারমধ্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে কম ছিল ২০১৭ (১১৭৩.৩ মিমি) ও ২০১২ (১১৩০.৪ মিমি) সালে।
এর বিপরীত হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায় – সেখানে দেখা গেছে বৃষ্টিপাতের আধিক্য। জুন থেকে সেপ্টেম্বরে এখানকার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১১৭২.৮ মিমি। ২০১২-২০১৭ মৌসুমী বর্ষার তথ্য বলছে যে ছয় বছরের মধ্যে চার বছরই অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে – তার মধ্যে ২০১৫ সালে ছিল সর্বাধিক - ১৪২৮ মিমি।
“মূল সমস্যাটা হল অকালবর্ষণ,” বললেন কাজললতা। “এই বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে - প্রায় বর্ষাকালের মতো। বয়োজ্যেষ্ঠরাও বললেন ফেব্রুয়ারি মাসে এমন বৃষ্টিপাতের কথা তাঁরা মনে করতে পারেন না।” জুন-জুলাই মাসে রোপণ করা আর নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাটা ধান থেকে আসা উপার্জনের উপর তাঁর পরিবার নির্ভরশীল। “ধান চাষ বৃষ্টিপাতের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বৃষ্টি না হলে ধান হবেই না।”
বিগত চার পাঁচ বছর ধরে বর্ষাকাল ছাড়াও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বৃষ্টি হচ্ছে তাঁর গ্রামে। সাধারণত এই সময়ে বৃষ্টি হয় ওখানে কিন্তু অতিবর্ষণ ধান চাষের ক্ষতি করতে পারে। “হয় বৃষ্টি হয় না নাহলে অকালে অতিবর্ষণ হয়। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর আমরা ভাবি এইবার আর [অকালে] অতিবর্ষণ হবে না। কিন্তু ঠিক সেটাই হয় আর ফসল একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। কথায় বলে, ‘আশায় মরে চাষা’।”
রজত জুবিলি গ্রামের প্রবীর মণ্ডলও খুব চিন্তিত। “জুন জুলাই জুড়ে [আমাদের গ্রামে] বৃষ্টি হয়নি। বেশ কিছু ধানের শিস শুকিয়ে যায়। ভাগ্যিস অগাস্ট মাসে বৃষ্টি এলো। কিন্তু তা কি যথেষ্ট হবে? যদি অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফসল ডুবে যায়?”
স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে অভিজ্ঞতা থেকে (বিকল্প চিকিৎসা ধারায় তাঁর বিএ ডিগ্রি আছে) প্রবীর জানালেন যে তাঁর রোগীদের মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ে অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে। “এখন অনেকেরই সর্দি-গর্মি হচ্ছে। যে কোনও সময়েই এর কবলে পড়ে প্রাণ সংশয় দেখা দিতে পারে,” তিনি বুঝিয়ে বললেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছাড়াও স্থলভাগের তাপমাত্রাও বাড়ছে সুন্দরবন অঞ্চলে। নিউইয়র্ক টাইমস্ -এর আবহাওয়া ও বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্বন্ধীয় ইন্টারঅ্যাক্টিভ পোর্টাল-এর তথ্য দেখাচ্ছে যে ১৯৬০ সালে যেখানে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার অধিক তাপমাত্রা সম্বলিত দিনের সংখ্যা ছিল ১৮০ সেখানে ২০১৭ সালে এমন দিনের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৮। শতাব্দীর শেষে এমন দিনের সংখ্যা হতে পারে ২১৩ থেকে ২৫৮।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, সাইক্লোন, খামখেয়ালি বৃষ্টিপাত, লবণাক্ততায় বৃদ্ধি, ক্রমহ্রাসমান ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও আরও নানান কারণে নিরন্তর জেরবার হতে থাকা সুন্দরবনের মানুষের জীবনে এখন অনিশ্চয়তাই ধ্রুবসত্য হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি ঝড় ও সাইক্লোনের সাক্ষী প্রফুল্ল মণ্ডলের চিন্তা: “কে জানে এরপর আরও কী হতে চলেছে!”
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা