ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে রীতিমতো ধুলোর ঝড় উড়িয়ে বাইকে চেপে হাজির হলেন আড়ইকলাচেলভি, পরনে নীল শাড়ি, ইয়াব্বড় নাকছাবি আর ঝলমলে একাখান হাসি। মিনিট কয়েক আগেই, তাঁর লংকার খেত থেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন – আমরা যেন তাঁর তালাবন্ধ বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করি। ভরদুপুর বেলা, সবে মার্চ মাস তো কী হয়েছে? রামানাথপুরমের আসমানে উন্মত্ত সূর্য। নাতিদীর্ঘ ছায়া আর দিগন্ত জোড়া পিপাসা। পেয়ারা গাছের মিষ্টি ছায়ায় বাইকটা দাঁড় করিয়ে সদর দরজা খুলে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। ঢংঢং করে বেজে উঠল গীর্জার ঘণ্টা। জল এনে দিলেন আমাদের, ঢকঢক করে সে জল খেয়েই বসে পড়লাম আড্ডায়।

শুরু করলাম তাঁর মোটরবাইক দিয়ে। ৫১ বছর বয়সী এক মহিলা বাইক চালাচ্ছেন, তার উপর এরকম ছোট্ট একখান গ্রামে, সচরাচর চোখে পড়ে না যে। “কিন্তু এই যন্তরটা যে বড্ড কাজের,” একগাল হাসি নিয়ে জানালেন আড়ইকলাচেলভি। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে চালাতে শিখে গিয়েছিলেন। “ভাইয়ের থেকে শিখেছি, তখন ক্লাস এইটে পড়তাম। সাইকেল চালাতে জানতাম, তাই খুব একটা শক্ত ছিল না।”

দু’চাকার এই বাহনটি না থাকলে জীবনে অনেক কষ্ট পেতে হত, বলে উঠলেন তিনি। “বহু বছর ধরেই আমার স্বামী বাড়িতে থাকত না। জলের মিস্ত্রি ছিল তো, প্রথমে সিঙ্গাপুর, তারপর দুবাই আর কাতারে গিয়েছিল কাজে। মেয়েদের বড়ো করেছি, খেতিবাড়ির কাজও করেছি।” পুরোটাই একা হাতে।

আজীবন চাষি হয়েই থেকেছেন জে. আড়ইকলাচেলভি। হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন মেঝেতে, টানটান পিঠ, হাঁটুর উপর রাখা দুটি হাতে শোভা পাচ্ছিল একটি করে চুড়ি। শিবগঙ্গাই জেলার কালাইয়ারকোইল গ্রামে একটি চাষি পরিবারে জন্ম তাঁর। মুদুকুলাথুর ব্লকের পি. মুথুবিজয়াপুরম জনপদের এই বাড়িটি থেকে সড়কপথে পাক্কা দেড় ঘণ্টা লাগে সেখানে যেতে। “আমার ভাইরা থাকে শিবগঙ্গাইয়ে। ওখানে তো অনেকেরই নলকূপ আছে। আর এখানে সেচের জন্য ঘণ্টায় ৫০ টাকা দিয়ে জল কিনতে হয়।” রামানাথপুরমে রমরমিয়ে চলে জলের কারবার।

Adaikalaselvi is parking her bike under the sweet guava tree
PHOTO • M. Palani Kumar

সুমিষ্ট পেয়ারা গাছের নিচে নিজের বাইকটা দাঁড় করাচ্ছেন আড়ইকলাচেলভি

Speaking to us in the living room of her house in Ramanathapuram, which she has designed herself
PHOTO • M. Palani Kumar

রামানাথপুরমে বাড়ির বৈঠকখানায় বসে কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে, বাড়ির নকশাটা নিজেরই করা

ছোট্টবেলা থেকেই মেয়েদের হস্টেলে রেখে বড়ো করেছেন আড়ইকলাচেলভি। খেত-খামারের কাজ সামলে মেয়েদের দেখতে যেতেন, ফিরে এসে শুরু হত গেরস্থালির কাজ। আজ ছয় একর জমির উপর চাষ করেন তিনি। এক একর নিজের, বাদবাকিটা ইজারায় নেওয়া। “ধান, লংকা, তুলো: এগুলো বিক্রিবাটার জন্য। আর নিজের হেঁশেলের জন্য ধনে, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, লাউ-কুমড়ো, ছাঁচি পেঁয়াজ...”

আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন হলঘরের দেওয়ালে একটি উঁচু তাকের দিকে। “ধানটুকু বস্তায় ভরে ওইখানে তুলে রাখি, যাতে ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচানো যায়। আর লংকাগুলো তোলা থাকে রান্নাঘরের তাকে।” এমনটা না করলে ঘরে নাকি চলাফেরার জায়গাটুকুও থাকত না। লাজুক হেসে জানালেন: বছর কুড়ি আগে যখন এই বাড়িটা বানানো হয়, তখন তিনি নাকি নিজেই মাথা খাটিয়ে এই তাকের নকশা বানিয়েছিলেন। সদর দরজায় খোদাই করা মাতা মেরির প্রতিকৃতিটাও তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। পুষ্পবক্ষে দণ্ডায়মান মেরি, কাঠখোদাইয়ের অপূর্ব কাজ। ভিতরের কামরাগুলো পেস্তা রঙের। ফুলে ফুলে সাজানো হালকা সবুজ দেওয়ালগুলোয় টাঙানো রয়েছে তাঁর পরিবারের আলোকচিত্র এবং যিশু ও মাতা মেরির ছবি।

নান্দনিকতার কথা না হয় থাক আপাতত, তবে বাজারদর না বাড়া ইস্তক তিনি যে খেতের ফসল বেচেন না, এইটা বোধহয় বাড়ির ভিতর এতটা জায়গা না থাকলে সম্ভব হত না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজে দেয় সেটা। এই যেমন সরকারি হিসেবে ধানের বাজারদর ১৯ টাকা ৪০ পয়সা হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় দালালরা ১৩ টাকার বেশি দিতেই চায় না। আড়ইকলাচেলভির জবানে: “দুই কুইন্টাল [২০০ কেজি] চাল বেচেছি সরকারকে। কিন্তু ওরা লংকা নিতে চায় না কেন বলুন তো?”

প্রত্যেক লংকা চাষি চান যাতে ফসলের বাজারদর ভালো হয় এবং বেশি কমা-বাড়া না করে, জোর গলায় জানালেন সেটা। “ধানের মতো একগাদা বৃষ্টি বা জমাজলের কোনোটাই সহ্য করতে পারে না লংকা। এবছর বীজ ফুটে সবেমাত্র ছোট্ট ছোট্ট চারা গজিয়েছে, ওমনি তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টি নামল অসময়ে। আর ফুল ফোটার আগে যখন পানির সত্যিই দরকার, তখন শুকনো খটখটে।” মুখ ফুটে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ কথা বললেন না বটে, তবে ক্রমশ বদলাতে থাকা বৃষ্টি-বাদলার মরসুমের দিকেই ইঙ্গিত ছিল তাঁর – অতিবৃষ্টি, হড়বড়িয়ে বৃষ্টি, বেমরসুমে, বেআক্কেলে সময়ে। তাঁর আন্দাজ: যতটা ফসল ফলে, এবার মেরেকেটে তার পাঁচভাগের একভাগ ফলেছে মোটে। “নির্ঘাত ভরাডুবি হবে।” অথচ ‘রামনাড মুন্দু’ নামক যে প্রজাতির লংকাটি তিনি চাষ করেন, তার দর এবার ৩০০ টাকা কেজি, অর্থাৎ ‘আকাশছোঁয়া’।

Adaikalaselvi is showing us her cotton seeds. Since last ten years she has been saving and selling these
PHOTO • M. Palani Kumar

তুলোর বীজ বার করে এনে আমাদের দেখাচ্ছেন আড়ইকলাচেলভি। বিক্রিবাটার জন্য গত দশ বছর ধরে এগুলো জমিয়ে রাখছেন তিনি

She is plucking chillies in her fields
PHOTO • M. Palani Kumar

নিজের খেতে লংকা তুলছেন আড়ইকলাচেলভি

আড়ইকলাচেলভির মনে আছে এককালে যখন দু-একটাকায় গোছা গোছা লংকা মিলত। আর বেগুন বিকত ২৫ পয়সা কেজিতে। “আরে বাবা, বছর তিরিশ আগে তুলোর দর ছিল ৩-৪ টাকা কিলো। শুধু তাই নয়, দিন গেলে ৫ টাকা দিলেই মজুর ভাড়া করা যেত। আর এখন? বাড়তে বাড়তে ২৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। অথচ তুলোর দাম মাত্র ৮০ টাকা কিলো।” অন্যভাবে বলতে গেলে মজুরি ৫০ গুণ বাড়লেও বাজারদর বেড়েছে কেবল ২০ গুণ। চাষির কিছুই করার নেই। চুপচাপ মুখ বুজে খেটে যাও, এই আর কি।

আড়ইকলাচেলভি ঠিক সেটাই করেন। তাঁর সঙ্গে দুটো কথা বললেই বোঝা যায় যে মানুষটি কতখানি একরোখা। আঙুলের ইশারা করে ডানদিকে দেখিয়ে বললেন, “লংকা-খেতটা এইদিকে, আর ওইদিকে কিছুটা জমির উপর চাষ করি, আরও খানিকটা রয়েছে অন্যদিকে, ওই যে।” শূন্যে আঁকিবুকি কাটছিল হাতদুটি তাঁর। “বাইকটা আছে তাই দুপুর হলে চট করে ফিরে আসি চাট্টি খেতে। বস্তা-টস্তা বইবার জন্য কোনও মরদ লাগে না, ক্যারিয়ারে চাপিয়ে দিব্যি নিজেই বাড়ি ফিরে আসি,” মুচকি হেসে জানালেন। চেনা ও অচেনার মিশেলে অনন্য শোনাচ্ছিল তাঁর আঞ্চলিক তামিল লব্জ।

“২০০৫ সালে এই বাইকটা কেনার আগে ইস্তক গাঁয়েরই কারও থেকে ধার করতাম।” তাঁর কাছে টিভিএস কোম্পানির এই মোপেডখানা মহার্ঘ্য কোনও বিনিয়োগের থেকে কোনও অংশে কম নয়। আজ তিনি গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েদের দুইচাকা চালানোয় সাহস জোগান। “অনেকে তো ইতিমধ্যেই শিখে গেছে চালাতে,” বলেই একগাল হেসে বাইকে চড়ে বসলেন। গন্তব্য সেই খেত, আমরা আমাদের গাড়িতে চেপে পিছু নিলাম তাঁর। পিছনে রইল পড়ে রোদে শুকোতে থাকা লংকা। রামানাথপুরমের এই রক্তরাঙা গালিচার ঝালে অচিরেই সুস্বাদু হয়ে উঠবে সুদূর কোনও হেঁশেল, একটি একটি করে গুন্দু মিলাগাই (মোটা লংকা) মিশে যাবে খাবারে...

*****

“দেখিনু তাহারে সবুজ বাহারে, পাকিয়া হইল লাল,
সুস্বাদু খানা যতেক আহারে, আঁখি ভরি ক্ষণকাল...”
সন্ত ও সুরকার পুরন্দরদাস রচিত একটি গানের একাংশ

বেশ মজাদার পংক্তি – হ্যাঁ, অনেকভাবেই বিশ্লেষণ করা যায় ঠিকই, তবে কে.টি. আচায়া তাঁর ‘ইন্ডিয়ান ফুড, আ হিস্টোরিকাল কম্প্যানিয়ন’ বইটিতে বলছেন: ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় সাহিত্যে এটিই লংকার প্রথম উল্লেখ। তাঁর মতে, এই ভারতীয় খাদ্য হতে এই মশলাটিকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব, তাই “এটি যে বরাবর এদেশে মিলত না, সেটা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।” তবে এই গানটি থেকে আন্দাজমতন একটা তারিখ পাওয়া যায়: এটির স্রষ্টা “দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত সুরকার পুরন্দরদাস, যাঁর সময়কাল ১৪৮০ থেকে ১৫৬৪।”

এ গানের পরের দিকের পংক্তিতে বলা আছে:

“কাঙালির ত্রাতা সে যে, খাবারের স্বাদ – খাইলে জিভেই ভাঙে আগুনের বাঁধ। পান্ডুরঙ্গ তব বিট্ঠল নাম – ভুলেছি তোঁহার কথা, ঝরে কালঘাম।”

সুনীতা গোগাটে ও সুনীল জালিহালের লেখা ‘রোমান্সিং দ্য চিলি’ বইটিতে বলা আছে: ‘পর্তুগিজরা দক্ষিণ আমেরিকা দখল করার পর,’ ক্যাপসিকাম অ্যানাম, অর্থাৎ লংকা নামের মশলাটি ‘তাদের হাত ধরে ভারতের উপকূলে এসে পৌঁছয়।’

A popular crop in the district, mundu chillies, ripe for picking
PHOTO • M. Palani Kumar

তোলার জন্য তৈরি হয়ে আছে মুন্দু লংকা, এ জেলার জনপ্রিয়তম ফসলগুলির মধ্যে এটি একটি

A harvest of chillies drying in the sun, red carpets of Ramanathapuram
PHOTO • M. Palani Kumar

রামানাথপুরমের রক্তরাঙা গালিচা, কড়া রোদে শুকোচ্ছে খেতের লংকা

ততদিন অবধি খাবারে ‘ঝাল’ বলতে শুধু গোলমরিচই ছিল এদেশে, কিন্তু লংকা আসার পর সাততাড়াতাড়ি মরিচ তার সিংহাসন হারায়, কারণ এটি “দেশের সর্বত্র চাষ করা যেত...ব্যবহারিক মূল্যে গোলমরিচ এটির ধারেকাছেও আসে না,” লিখেছেন আচায়া। তবে হ্যাঁ, অধিকাংশ ভারতীয় ভাষাতেই মরিচের নামেই নতুন এই মশলাটির নাম রাখা হয়। উদাহরণস্বরূপ তামিল ভাষায় গোলমরিচের নাম ‘মিলাগু’ এবং লংকার নাম ‘মিলাগৈ’, অর্থাৎ এ মহাদেশ থেকে সে মহাদেশ, এ যুগ হতে সে যুগ, সবই বাঁধা পড়ে গেছে কেবল দুটি স্বরবর্ণের সুতোয়।

অচিরেই নতুন এই মশলাটিকে আপন করে নিয়েছিলাম আমরা। আর আজ শুকনো লাল লংকার উৎপাদনে ভারতের স্থান বিশ্বের প্রথম সারিতে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তো একেবারেই শীর্ষে। ২০২০ সালে মোট ১৭ লাখ টন শুকনো লাল লংকা উৎপাদন করেছিল ভারত। অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা থাইল্যান্ড ও চিনের প্রায় পাঁচগু ণ। ভারতের সবচাইতে ‘ঝাল’ রাজ্য যে অন্ধ্রপ্রদেশ, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছিল ৮,৩৬,০০০ টন। সেবছর তামিলনাড়ুর ফলন ছিল ২৫,৬৪৮ টন, আর এ রাজ্যের ভিতর সব্বার আগে জ্বলজ্বল করছে রামানাথপুরম জেলার নাম। তামিলনাড়ুতে যত একর জমিতে (৫৪,২৩১ একর) লংকা চাষ হয়, তার এক-চতুর্থাংশ (১৫,৯৩৯ একর) রয়েছে এই জেলায়।

জীবনে প্রথমবার আমি লংকা ও রামানাথপুরমের চাষিদের ব্যাপারে পড়ি সাংবাদিক পি. সাইনাথের কালজয়ী রচনা ‘এভরিবডি লাভস্ আ গুড ড্রাউট’-এর ‘দ্য টিরানি অফ দ্য থারাগর’ নামক অধ্যায়টিতে। কাহিনির শুরুটা ছিল এরকম: “থারাগরের (কমিশন এজেন্ট) সামনে দুটি বস্তা নামিয়ে রেখেছিলেন এক ক্ষুদ্র চাষি, তার একটির ভিতর হাত ঢুকিয়ে এক কেজি লংকা বার করে আনলেন থারাগর। তারপর সাভি ভাথলের (ঈশ্বরের বখরা) দোহাই দিয়ে সেটা তাচ্ছিল্য ভরে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।”

তাজ্জব বনে যাওয়া রামাস্বামীর কথা জেনেছিলাম সাইনাথের কলমে: “এক একর জমির চারভাগের তিনভাগ চষে কোনওমতে বেঁচে আছেন এই চাষি।” ফসলটা যে অন্য কারও কাছে গিয়ে বেচবেন তারও উপায় নেই, কারণ দালাল যে “বীজ পোঁতার আগেই গোটা ফসলটা” কিনে নিয়েছেন। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সাইনাথ যখন বই লেখার তাগিদে এ দেশের দরিদ্রতম ১০টি জেলায় ঘুরছিলেন, থারাগরের দল তখন এভাবেই হাতের মুঠোয় ধরে রাখত চাষিদের।

তারপর, ‘তবে ওরা ভাত খাক’ নামক সিরিজটা লেখার জন্য ২০২২ সালে আমি ফিরে যাই রামানাথপুরমে। সাম্প্রতিককালে কীভাবে বেঁচে আছেন লংকাচাষিরা, সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম।

*****

“মায়িল, মুয়াল, মাডু, মান (ময়ূর, খরগোশ, গরু এবং হরিণ): এদের জন্য ফসলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে অতিবৃষ্টি কিংবা খরা।”
ভি. গোবিন্দরাজন, লংকাচাষি, মুম্মুদিসাথান, রামানাথপুরম

রামানাথপুরম শহরে এক লংকা ব্যবসায়ীর দোকান, নীলামের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন অসংখ্য নারী ও পুরুষ। প্রত্যেকেই কৃষক, টেম্পো আর বাসে চেপে পৌঁছেছেন বাজারে, বসে আছেন পশুখাদ্যের বস্তা (ব্রান্ডের নাম ‘ডাবল্ হর্স) পেতে। আঁচল বা তোয়ালে, যাঁর কাছে যেটা আছে সেটা দিয়েই নিজেদের হাওয়া করছেন। বিচ্ছিরি গরম, তবে চাষিদের মতে নিদেনপক্ষে এই যে খানিক খানিক ছায়া রয়েছে, ওটাই বাঁচোয়া। তবে তাঁদের খেত-খামারে কোত্থাও কোনও ছায়া নেই। আসলে কি জানেন? কড়া রোদ ছাড়া লংকাগাছ বাঁচবেই না।

Mundu chilli harvest at a traders shop in Ramanathapuram
PHOTO • M. Palani Kumar
Govindarajan (extreme right) waits with other chilli farmers in the traders shop with their crop
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: স্তূপ করে মুন্দু লংকা রাখা আছে রামানাথপুরমের একটি আড়তে। ডানদিকে: অন্যান্য চাষিদের সঙ্গে নিজের খেতের ফসল নিয়ে অপেক্ষা করছেন গোবিন্দরাজন (এক্কেবারে ডানদিকে)

তিন বস্তা লাল লংকা বয়ে এনেছেন ভি. গোবিন্দরাজন, একেকটার ওজন ২০ কেজি। “এবছর একদম ভালো ফসল হয়নি।” মাথা নেড়ে মাগাসুল, অর্থাৎ ফসলের কথা জানালেন। “উপরন্তু উপরি খরচাগুলো যে কমতেই চাইছে না।” মিলাগাই (লংকা) জিনিসটা নিজে কিন্তু বেশ শক্ত ধাতের। মাল্লিগাইয়ের (জুঁই) মতো অমন পানসে পুতু নয় যে কীটনাশক ঢেলে রীতিমতো স্নান করাতে হবে।

তাঁর থেকে লংকাচাষের নানান কৌশলের কথা বিস্তারিত জানতে পারলাম। সাত-সাতটিবার লাঙল চালাতে হয়: প্রথম দু’বার বেশ গভীর করে, তারপর গ্রীষ্মকালীন পাঁচবার। এবার আসে সারের পালা। রাত্তিরবেলা করে এক সপ্তাহ ধরে ১০০টি ছাগল ছেড়ে রাখেন তাঁর খেতে, যাতে তাদের বিষ্ঠায় জমিটা উর্বর হয়। এটার পিছনে ২০০ টাকা খরচা হয় প্রতি রাতে। এছাড়াও রয়েছে বীজ আর ৪-৫ দফা আগাছা নিড়ানোর খরচ। “ছেলের একটা ট্রাক্টর আছে, তাই বিনিপয়সায় আমার জমিটা তৈরি হয়ে যায়,” না হেসে পারলেন না গোবিন্দরাজন, “ঘণ্টা-পিছু ৯০০-১,৫০০ টাকা বেরিয়ে যায় অন্যদের, কে কীরকম কাজের জন্য ট্রাক্টর ভাড়া করছে তার উপর নির্ভর করছে।”

আমাদের কথা বলতে দেখে আরও কয়েকজন চাষি ভিড় জমালেন। পুরুষদের পরণে হাঁটুর উপর গুটিয়ে নেওয়া লুঙ্গি আর ধুতি, গামছাগুলো হয় গলায় জড়ানো কিংবা পাগড়ির মতো করে বাঁধা। মহিলাদের অঙ্গে উজ্জ্বল ফুলেল ছাপ নাইলনের শাড়ি, খোঁপায় জড়ানো হলদে কনকাম্বরম (কনকাম্বরী), কিংবা সুগন্ধি মাল্লিগাই (জুঁই)। আমায় চা খাওয়ালেন গোবিন্দরাজন। টালি-ছাওয়া ছাদের ফাঁকফোঁকর আর স্কাইলাইট দিয়ে ঝরে পড়ছিল রোদ্দুর। সোনা সে রোদের ছোঁয়ায় ডাগর ডাগর চুনি হয়ে উঠেছিল স্তূপ করে রাখা টকটকে লংকাগুলো।

এ. বাসুকীর থেকে জানতে পারলাম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা, ৩৫ বছর বয়সী এই কৃষকের বাড়ি রামানাথপুরম ব্লকের কোনেরি জনপদে। ওখানে উপস্থিত আর পাঁচজন মহিলার মতো তাঁরও দিন শুরু হয় মরদদের আগে। ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে যাবে, তাই ৭টা বাজার বহু আগেই উঠে পড়েন, হাটে বেরোনোর আগে বাচ্চাদের জন্য চাট্টি খাবার রেঁধে বাঁধছাঁদ না করলে চলবে? পাক্কা ১২ ঘণ্টা পর ঘরে ফেরেন বাসুকী। এবার সংসারের অন্য কাজ সামাল দেওয়ার পালা।

এবছর ফসলের পুরো ১২টা বেজে গেছে, জানালেন তিনি, “কিছু তো একটা গণ্ডগোলে হয়েইছে, লংকাগুলো ঠিকমতো গজালোই না। আমবুত্তুম কোট্টিদুচু (সম্পূর্ণ ভরাডুবি)।” ৪০ কেজি লংকা, অর্থাৎ ফসলের আধা নিয়ে এসেছেন, আশা করছেন যে বাদবাকি ৪০ কেজি মরসুমের শেষে ফলবে। তবে খানিক উপরি রোজগারের জন্য একমাত্র মনরেগার কাজটাই ভরসা।

Vasuki (left) and Poomayil in a yellow saree in the centre waiting for the auction with other farmers
PHOTO • M. Palani Kumar

অন্যান্য চাষিদের মাঝে নিলামের অপেক্ষায় বসে রয়েছেন বাসুকী ও পুমাইল (হলুদ শাড়ি পরিহিতা)

Govindrajan (left) in an animated discussion while waiting for the auctioneer
PHOTO • M. Palani Kumar

নিলামকারীর দেখা নেই, এদিকে হাত-পা নেড়ে আলোচনায় মেতেছেন গোবিন্দরাজন (বাঁদিকে)

পি. পুমাইল (৫৯) যে মুম্মুদিসাথান জনপদ থেকে ২০ কিলোমিটার পথ ঠেঙিয়ে এতদূর আসতে পেরেছেন, সেটা বিশাল একখান ব্যাপার – কারণ একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি তাঁকে। এ রাজ্যের শহরাঞ্চলে কোনও বাসভাড়া লাগে না মহিলাদের , ২০২১ সালে মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্তালিনের নেতৃত্বে ডিএমকে সরকার ক্ষমতায় আসামাত্র এই যোজনাটির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল।

পুমাইল তাঁর টিকিটখানা দেখালেন আমায়, লেখা আছে ‘মাগালির’ (মহিলা) এবং ‘বিনেপয়সার টিকিট’। কত টাকা বাঁচল তাহলে? উত্তর এল, ৪০। কয়েকজন পুরুষ মিলে গজগজ করছিলেন, বিনিপয়সায় যাতায়াত করতে পেলে তেনারাও খুশি হবেন। এটা শোনামাত্র খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম সবাই, বিশেষ করে মহিলারা।

তবে পলক ফেলতে না ফেলতেই মিলিয়ে গেল সেই হাসি। ফসলের পরিমাণ কেন কমে আসছে দিনকে দিন, একে একে তার কারণগুলি তামিল ভাষায় বলতে থাকলেন গোবিন্দরাজন। মায়িল, মুয়াল, মাডু, মান (ময়ূর, খরগোশ, গরু এবং হরিণ), “সঙ্গে আছে অতিবৃষ্টি কিংবা খরা।” ফুল ফোটা আর ফল ধরার সময় যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরার পালা, তখন খাঁখাঁ করছিল আসমান। “এককালে বিশাল পরিমাণে লংকা ফলত,” ছাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন মানুষটি, “ওই অবধি... একজন উপরে উঠে চারিদিকে ঢালতে থাকত, যতক্ষণ না পুরোটা পাহাড় হয়ে যাচ্ছে।”

আজ সেই পাহাড় পরিণত হয়েছে ছোট্ট ঢিবিতে, বড়োজোর হাঁটু অবধি পৌঁছয়, উপরন্তু লংকাগুলোও বিভিন্ন ধরনের – রক্তজমাট লাল কেউ, তো উজ্জ্বল আলতারঙা অন্যটি। তবে হ্যাঁ, ঝাঁঝে কেউ কম যায় না, হামেশাই দেখলাম কেউ না কেউ হাঁচি দিচ্ছে বা কাশছে। বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের দৌরাত্ম্য চলছে ঠিকই, তবে এই আড়তের নন্দ ঘোষ কিন্তু একা এই লংকাই।

The secret auction that will determine the fate of the farmers.
PHOTO • M. Palani Kumar
Farmers waiting anxiously to know the price for their lot
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: এই গোপন নিলামেই নির্ধারিত হবে চাষিদের ভাগ্য। ডানদিকে: লংকার দর কতটা উঠল, তা জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন কৃষকেরা

নিলামকারী এস. জোসেফ সেঙ্গোল আসতে দেরি করছিলেন, অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন সবাই। কিন্তু উনি এসে পৌঁছতেই পরিবেশটা বদলে গেল এক লহমায়। লংকার ঢিবিগুলোর পাশে জড়ো হতে লাগলেন প্রত্যেকে। এদিকে জোসেফের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ঢিবিগুলোর উপর দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন ফসলের গুণমান। এবার একটা তোয়ালে চাপিয়ে ঢেকে ফেললেন তাঁর ডান হাতটা। একে একে ক্রেতারা এসে চেপে ধরতে লাগলেন তাঁর তোয়ালে-চাপা আঙুলগুলো, নিলামটা গোপন কিনা, তাই। তবে হ্যাঁ, খদ্দেরদের মধ্যে কিন্তু একজনও মহিলা নেই।

একজন বহিরাগতের পক্ষে এ নিলামের গুপ্ত কথা বোঝা অসম্ভব। পুরুষ খদ্দেরের দল তোয়ালে-ঢাকা তালু ছুঁয়ে, আঙুল আঁকড়ে কিংবা টোকা দিয়ে বিভিন্ন সংখ্যার কথা বলছিলেন নিঃশব্দে। অর্থাৎ একেকটা ঢিবি লংকার জন্য তাঁরা যে দরটা হাঁকছেন, সেটা। কিনতে অনিচ্ছুক হলেও অসুবিধা নেই, সোজা গিয়ে তালুর মাঝে আঙুল বুলিয়ে ‘শূন্য’ এঁকে দাও। এ কাজের জন্য খানিকটা করে কমিশন পান নিলামকারী – বস্তা-পিছু ৩ টাকা। ওদিকে নিলামের জন্য চাষির থেকে মোট বিক্রিবাটার ৮ শতাংশ নিয়ে নেয় আড়তের মালিক।

সংখ্যা জানিয়ে সরে যান ক্রেতা, নিলামকারীর সামনে উঠে আসেন আরেকজন খদ্দের, এবার তাঁর পালা তোয়ালের নিচে কারসাজি দেখানোর। তারপর আরও একজন, এমনি করে সব্বার পালা চুকে গেলে ঘোষিত হয় সর্বোচ্চ দর। সেদিন প্রতি কেজি ৩১০ থেকে ৩৮৯ টাকা অবধি উঠেছিল লাল লংকার দাম। লংকার গুণমান নির্ধারিত হয় আকার ও রঙের নিরিখে।

দৃশ্যতই অখুশি কৃষকের দল। দর সে যত উঠুক না কেন, ফসলের পরিমাণ তিলমাত্র হলে আখেরে লোকসানই হয়। গোবিন্দরাজনের বক্তব্য: “ওঁরা বলছেন বটে, মূল্য সংযোজন করলে তবেই রোজগারপাতি বাড়বে। কিন্তু বলুন দেখি, সময়টা পাব কোত্থেকে? লংকা গুঁড়িয়ে প্যাকেটে ভরব, না চাষ করব?”

ওদিকে নিলামের দরবার এবার তাঁর ফসলটুকুর পালা, চকিতে রাগের স্থানে দেখা দিলো দুশ্চিন্তা। “এদিকে আসুন, ভালো করে দেখতে পাবেন,” হাঁক আমাকে ডাকলেন, “পরীক্ষার পর নম্বরের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকার মতো,” দাঁতের ফাঁকে গামছাটা আঁকড়ে ধরে বলে উঠলেন মানুষটি, গুপ্ত সে হাত মেলানোর কারসাজির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন, শরীর জুড়ে ফুটে উঠেছে উৎকণ্ঠা। ঘোষিত হল দর, একগাল হেসে জানালেন গোবিন্দরাজন: “কিলো-পিছু ৩৩৫ টাকা পেয়েছি।” ওঁর ছেলের খেতের লংকাগুলো অপেক্ষাকৃত বড়ো ছিল, তাই প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা বেশি পেয়েছেন তিনি। বাসুকীর ভাগে দর উঠল ৩৫৯ টাকা। চাষিরা খানিক হাঁফ ছাড়লেন বটে, তবে কামকাজ সাঙ্গ হতে ঢের দেরি। এবার একে একে লংকা ওজন করে, টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে, চাট্টি খেয়েদেয়ে, টুকিটাকি বাজার সেরে বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার পালা...

Adding and removing handfuls of chillies while weighing the sacks.
PHOTO • M. Palani Kumar
Weighing the sacks of chillies after the auction
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: বস্তা ওজন করার সময় চলছে মুঠোভরা লংকা কমা-বাড়া করার পালা। ডানদিকে: নিলামের শেষে মাপা হচ্ছে বস্তায় ভরা লংকার ওজন

*****

“আগে আগে সিনেমা দেখতে যেতাম। তবে সিনেমা হলে গিয়ে শেষ ছবি দেখেছি সেই ১৮ বছর আগে: থুলাথা মানামুম থুল্লুম।” (সাড়া দেবে অসাড় হৃদয়)
এস. অম্বিকা, লংকাচাষি, মেলায়াকুড়ি, রামানাথপুরম

“মাঠে যাওয়ার একখান শর্টকাট আছে, মোটে আধা ঘণ্টার পথ,” বললেন এস. অম্বিকা, “তবে সড়ক হয়ে যেতে গেলে অনেক সময় লাগবে।” অজস্র বাঁকওয়ালা সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পরমাকুড়ি ব্লকের মেলায়াকুড়ি গ্রামে তাঁর লংকার খেতে গিয়ে উঠলাম শেষমেশ। দূর থেকে নজর কাড়ে শ্যামল গাছের সারি: পান্নার মতো পাতা, ডালে ডালে ধরে আছে বিচিত্র বর্ণের লংকা, পাক ধরার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে তারা: কেউ পদ্মরাগমণি, কারও অঙ্গে হলুদের ছোপ, কেউ বা মখমলের শাড়ির ন্যায় অপরূপ আরাক্কু (খয়েরি)। চন্দ্রবক্ষে বিজলি সম উড়ে বেড়াচ্ছে কমলা রঙের প্রজাপতির দল, ঠিক যেন ডানা খুঁজে পেয়েছে কচি লংকার ঝাঁক।

অবশ্য এই রূপকথা ঘোর কাটতে দশটা মিনিটও লাগল না। সুয্যিমামার সে কি তেজ, অথচ তখনও ১০টা বাজেনি! খটখটে শুকনো মাটি, ঘামের চোটে জ্বালা করছে চোখ। এ জেলার যেখানেই যান না কেন, বসুধার বুকে আঁকাবাঁকা ফাটল আপনার চোখে পড়বেই, যেন মেঘের পিপাসায় কাতর হয়ে উঠেছে রামানাথপুরমের মাটি। অম্বিকার লংকাখেতটিরও একই হাল, ফাটলে ফাটলে ঢাকা পড়ে গেছে মাটি। তবে অম্বিকার মতে মাটিটা কিন্তু শুকনো নয়। পায়ের আঙুল দিয়ে চাপ দিলেন, চকিতে বসে গেল ভুসকো মাটি, “নিজেই দেখুন, মাটিটা কেমন ভেজা-ভেজা, তাই না?” লক্ষ্য করলাম, পায়ের মধ্যমায় তাঁর রুপোলি মেত্তিসের (চুটকি) বাহার।

কত প্রজন্ম ধরে চাষ করেই বেঁচে আছে অম্বিকার বাড়ির লোকজন। ৩৮ বছর বয়সী এই মানুষটির পিছু পিছু কৃষিকাজ মাঠে এসেছেন তাঁর ভাদ্রবৌ এস. রানি (৩৩)। পরিবার-পিছু এক একর করে জমি আছে ওঁদের। লংকা ছাড়াও আগাঠি নামক এক প্রজাতির পালংশাক চাষ করেন, পোষা ছাগলগুলোর পেট ভরাতে এ গাছালির জুড়ি মেলা ভার। তবে মাঝেমধ্যে ঢ্যাঁড়শ আর বেগুনচাষও করেন তাঁরা। হ্যাঁ, এতকিছুর জন্য অতিরিক্ত খাটাখাটনি করতে হয় তো বটেই, তবে উপরি খানিক রোজগার না করলে চলবে কেমন করে?

রোজ সকাল ৮টা নাগাদ খেতে পৌঁছে যান অম্বিকা ও রানি, পাহারা দেন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। “নইলে ছাগলগুলো যে গাছপালা মুড়িয়ে খাবে সব!” ভোর ৪টে বাজতে না বাজতেই তাঁরা উঠে পড়েন রোজ, ঘরদোর ঝেঁটিয়ে, জল তুলে, রান্নাবান্না সেরে, বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে, বাসনকোসন মেজে, খাবারদাবার বাঁধাছাঁদা করে, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগিদের চারা-পানি দিয়ে, পায়ে হেঁটে মাঠে পৌঁছান। তারপর, ঘাম ঝরিয়ে মাঝেসাঝে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে যান। গরু-ছাগলদের জল খাইয়ে আবার ফিরে এসে লংকাগাছের পরিচর্যা চলে। দিনের শেষে আরও আধা ঘণ্টা যায় সেই শর্টকাট বেয়ে ঘরে ফিরতে। সে রাস্তায় দেখলাম একদল খুদে খুদে কুকুরছানা তাড়া করে ফিরছে তাদের মাকে। যাক বাবা, অন্তত একজন মা তো ফুরসৎ পাচ্ছে কিছুটা হলেও...

Ambika wearing a purple saree working with Rani in their chilli fields
PHOTO • M. Palani Kumar

নিজেদের লংকা খেতে কাজ করছেন অম্বিকা (বেগুনি শাড়ি পরিহিতা) ও রানি

Ambika with some freshly plucked chillies
PHOTO • M. Palani Kumar

সদ্য তোলা লংকা হাতে অম্বিকা

মায়ের ফোনে ফোন করেছিল অম্বিকার ছেলে, বার তিনেক বাজতেই যন্ত্রটা তুলে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন: “এন্নাড়া, কি চাই তোর?” চোখমুখ কুঁচকে শুনতে লাগলেন ছেলে কী বলছে, শেষে আলতো খানিক বকুনি দিয়ে কেটে দিলেন ফোনটা। বাচ্চাকাচ্চাদের গোঁ সাংঘাতিক, বলে উঠলেন দুজনেই। “সে যা-ই রান্না করি না কেন, ডিম আর আলু ওদের চা-ই চাই। বাধ্য হয়ে তাই কখনও এটা আর কখনও ওটা ভেজে দিই। আর রোববার এলে ওদের মর্জিমতন মাংস কিনে আনি।”

কথা বলতে বলতেই লংকা তুলতে শুরু করে দিয়েছিলেন অম্বিকা ও রানি। আশেপাশের খেতেও দেখলাম মহিলারা এই একই কাজে ব্যস্ত। তড়িৎ গতিতে ডালপালা তুলে তুলে আলতো হাতে ভেঙে নিচ্ছিলেন লংকার বোঁটা। পাড়তে পাড়তে মুঠো ভরে গেলে লংকার ঠাঁই হয় রঙের বালতিতে। আগে অবশ্য তালপাতার ঝুড়ি ইস্তেমাল করতেন, জানালেন অম্বিকা। তবে এখন তাঁরা সব্বাই এই ধরনের প্লাসটিকের বালতি ব্যবহার করেন, এগুলো এতটাই শক্তপোক্ত যে মরসুমের পর মরসুম চলতে থাকে, ভাঙে-টাঙে না।

ফিরে এলাম অম্বিকার ঘরে। ছাদের উপর গনগনে রোদ্দুর, একলা মনে শুকোচ্ছে তাঁর ঘামঝরানির ফসল। সোহাগ ভরে টুকটুকে লংকাগুলো নেড়েচেড়ে উল্টে দিচ্ছেন, যাতে ঠিকমতো শুকোয়। খানকতক মুঠোয় ভরে নাড়তে নাড়তে বলে উঠলেন, “ভালমতন শুকিয়ে গেলে গাডা-গাডা (ঝুম-ঝুম) আওয়াজ হবে।” অর্থাৎ বীজ নাড়ার শব্দ। তখন এগুলো জড়ো করে এনে ওজন মাফিক ভরা হবে বস্তায়, তারপর গাঁয়ের কমিশন এজেন্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার পালা। তবে অপেক্ষাকৃত বেশি দাম পেতে হলে গন্তব্য পরমাকুড়ি কিংবা রামানাথপুরমের বাজার।

“একটু কালার (বোতলবন্দি পানীয়) খাবেন নাকি?” একতলার রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অম্বিকা।

কাছেই একটা বেড়া-দেওয়া মাঠের ভিতর রাখা আছে তাঁর ছাগলগুলি, দেখাতে নিয়ে গেলেন আমাকে। তার-বাঁধা খাটিয়ার নিচে ঝিম মেরে ছিল কয়েকটা পাহারাদার কুকুর, এগুলি তাঁর পরিবারের পুষ্যি। কাছেই যেতেই গরগর করে উঠলেন তেনারা। “আমার বর যখন ফাংশান-টাংশানে খাবার পরিবেশন করতে যায়, এরা তখন আমাকেও পাহারা দেয়। তবে উনি কিন্তু আদতে চাষিই, কিংবা দিনমজুর, যখন যেমন কাজ জোটে আর কি।”

ফেলে আসা নতুন দাম্পত্যের কথা বলতে গিয়ে মুখখানি তাঁর লাল হয়ে গেল লজ্জায়। “আগে আগে সিনেমা দেখতে যেতাম। তবে সিনেমা হলে গিয়ে শেষ ছবি দেখেছি সেই ১৮ বছর আগে: থুলাথা মানামুম থুল্লুম । অর্থাৎ, সাড়া দেবে অসাড় হৃদয়টিও। নামের জাদুতে হেসে উঠলাম আমরা দুইজনেই।

Women working in the chilli fields
PHOTO • M. Palani Kumar

লংকা খেতে কাজে ব্যস্ত মহিলারা

Ambika of Melayakudi village drying her chilli harvest on her terrace
PHOTO • M. Palani Kumar

খেতের লংকা ছাদের উপর শুকোচ্ছেন মেলায়াকুড়ি গ্রামের অম্বিকা

*****

“ক্ষুদ্র চাষি লংকা ফলালে তা বিক্রির পর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ শতাংশ।”
কে. গান্ধিরাসু, অধ্যক্ষ, মুন্দু চিলি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, রামানাথপুরম

“সেই সকল চাষিদের কথা ভাবুন – যাঁদের পাঁচ কি দশ বস্তা লংকা আছে। প্রথমেই গ্রাম থেকে মাণ্ডি পর্যন্ত যেতে টেম্পো বা অন্য কিছু একটা ভাড়া করতে হয় নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে,” বলছিলেন গান্ধিরাসু, “সেখানে যেতেই বেনিয়ারা এসে দর বেঁধে দিয়ে কমিশনের নামে ৮ শতাংশ ছিনিয়ে নেবে। তৃতীয়ত, ওরা ইচ্ছে করে ওজনে কলকাঠি নাড়ে, যাতে বেনিয়াদের সুবিধা হয়। একেকটা বস্তায় আধা কিলো পর্যন্ত কমিয়ে দেয় ব্যাটারা, বিশাল ক্ষতি। এ ব্যাপারে অসংখ্য চাষি নালিশ ঠুকেছেন।”

“উপরন্তু পরিবারের একজনকে সারাটাদিন পড়ে থাকতে হয় আড়তে, চাষের কাজ মাথায় ওঠে। ব্যবসায়ীর কাছে নগদ টাকা থাকলে হাতে হাতে দিয়ে দেয় সে, নয়ত আবারও একদিন আসতে বাধ্য হন চাষিরা। এছাড়াও আড়তে যিনি যাচ্ছেন তিনি যদি পুরুষ হন তো সাধারণত দুপুরের খাবারদাবার সঙ্গে করে নিয়ে যান না, ফলত বাধ্য হন হোটেলে খেতে। আমরা সবকিছু হিসেবনিকেশ করে দেখেছি, সবসুদ্ধু ১৮ শতাংশ খোয়া যায় মোট রোজগারের থেকে।”

রামনাড মুন্দু চিলি প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামক একটি কৃষক উৎপাদক সংগঠন চালান গান্ধিরাসু। ২০১৫ থেকে তাঁরা লড়ে চলেছেন যাতে চাষিদের রোজগার বৃদ্ধি পায়। একাধারে চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ তিনি, মুদুকুলাথুর শহরে তাঁর দফতরে দেখা করলেন আমাদের সঙ্গে। “রুজিরোজগার কীভাবে বাড়ানো যায়? প্রথমেই কমাতে হবে চাষের খরচা। দ্বিতীয়ত উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত আসছে বেচাকেনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা (মার্কেটিং ইন্টারভেনশন্)। আপাতত আমরা ওই বেচা-কেনার স্তরেই কাজ করছি।” বিশেষ করে রামানাথপুরম জেলায় তো এই ধরনের মধ্যস্থতার প্রয়োজন মারাত্মক। “পরিযানের সমস্যা এখানে বিশাল,” বুঝিয়ে বললেন তিনি।

সরকারি তথ্যের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় গান্ধিরাসুর কথাগুলো। তামিলনাড়ুর গ্রামীণ রূপান্তর প্রকল্পের নির্ণয়সূচক রিপোর্টে রামানাথপুরম জেলা সম্পর্কে বলা আছে: আন্দজমতন প্রতিবছর প্রায় ৩০০০-৫০০০ জন চাষি কাজের খোঁজে বাইরে চলে যান। এখানে এটাও বলা আছে: ফড়েদের প্রভাব, জলসম্পদের ঘাটতি, খরা এবং হিমঘরের অভাব ইত্যাদি নানান বাধার সৃষ্টি হয়েছে উৎপাদনের পথে।

গান্ধিরাসুর মতে পানির হাতেই নাকি আসল চাবিকাঠি। “যান, কাবেরীর ব-দ্বীপ অঞ্চল বা পশ্চিম তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখুন। জানেন কী চোখে পড়বে?” নাটকীয় ভাবে একটু দম নিলেন, “বিজলির খুঁটি। কারণ চারিদিক ছেয়ে আছে নলকূপে।” অথচ রামানাথপুরমে গুটিকয় আছে কেবল, জানালেন তিনি। বৃষ্টির ভরসায় চাষ করার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, মরসুমের দয়ায় বাঁধা পড়ে যায় জীবন।

Gandhirasu, Director, Mundu Chilli Growers Association, Ramanathapuram.
PHOTO • M. Palani Kumar
Sacks of red chillies in the government run cold storage yard
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: রামানাথপুরমের মুন্দু চিলি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক গান্ধিরাসু। ডানদিকে: সরকারি হিমঘরের চত্বরে বস্তাবন্দি লাল লংকা

আবারও কাঁটায় কাঁটায় মিলে যায় সরকারি তথ্য, এবার যেটা খুঁজে পেলাম জেলার পরিসংখ্যানগত হ্যান্ডবুকে । রামানাথপুরমের বিদ্যুৎ বিতরণ চক্র (ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন সার্কেল) দ্বারা প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী: ২০১৮-১৯ সালে মোটে ৯,২৪৮টি নলকূপ ছিল এই জেলায়। অর্থাৎ রাজ্য জুড়ে বসানো ১৮ লাখ নলকূপের একটি ছোট্ট ভগ্নাংশ কেবল।

অবশ্য, রামানাথপুরমের জন্য এই সমস্যাগুলির একটিও নতুন নয়। সাংবাদিক পি. সাইনাথ তাঁর ‘এভরিবডি লাভস্ আ গুড ড্রাউট’ (১৯৯৬ সালে প্রকাশিত) বইটিতে প্রখ্যাত লেখক মেলানমাই পোন্নুস্বামীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এখানে পোন্নুস্বামী বলেছেন: “সাধারণ মানুষ ভুল জানেন, এই জেলায় সত্যিই উচ্চমানের চাষ করা সম্ভব। কিন্তু সেকথা মাথায় রেখে আর কে-ই বা কাজ করেছে?” এছাড়াও তিনি জানিয়েছিলেন: “রামনাডে যত জোত রয়েছে, তার ৮০ শতাংশেরও অধিক দুই একরের কম, ফলত অর্থনীতির দিক থেকে দেখতে গেলে অলাভজনক। তালিকার শিয়রে জ্বলজ্বল করছে সেচের অভাব।”

সম্ভাবনার বিষয়ে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় পোন্নুস্বামীর কথা। ২০১৮-১৯ সালে ৪,৪২৬.৬৪ মেট্রিক টন লংকার লেনদেন হয়েছিল রামানাথপুরম জেলায় , যার মূল্য ছিল ৩৩.৬ কোটি টাকা। (সেচযুক্ত জমির সিংহভাগ ছিল ধানচাষের দখলে, অথচ ওই সময়টায় কেবল ১৫.৪ কোটি টাকার চাল কেনাবেচা হয়েছিল)।

তিনি খোদ চাষিবাড়ির সন্তান, উপরন্তু স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও চাষের কাজ থামাননি, সুতরাং লংকাচাষে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনা সম্পর্কে গান্ধিরাসু বেশ ভালভাবেই অবগত। চট করে এ চাষের অর্থনৈতিক দিকটা বুঝিয়ে দিলেন। সাধারণত এক একর জমিতে লংকা ফলান কৃষকেরা। ফসল তোলার সময় জনাকয় মজুর ভাড়া করেন বটে, তবে চাষের সিংহভাগটাই সামলান বাড়ির লোকজন। “এক একর জমিতে মুন্দু লংকা ফলাতে ২৫,০০০-২৮,০০০ টাকা লাগে। ফসল তুলতে ১০-১৫ জন দরকার, অর্থাৎ আরও ২০,০০০ টাকা।” দিন গেলে মাথা-পিছু এক বস্তা করে লংকা তোলেন খেত-মজুররা। স্থানে স্থানে জটলা পাকিয়ে ঘন হয়ে থাকে লংকাগাছ, আর ঠিক সেই জায়গাগুলোতেই কাজ করা সবচাইতে মুশকিল।

একেক দফা লংকা চাষে সময় লাগে ছয়মাস। অক্টোবরে বীজ পোঁতা হয়, তারপর পালা করে আসে দুটি বোগাম (ফলন): প্রথম ফলন হয় তামিল পঞ্জিকার থাই মাসে, অর্থাৎ জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ। দ্বিতীয়টি শেষ হয় চিঠিরাই মাসে, অর্থাৎ মধ্য এপ্রিলে। ২০২২ সালে অকাল বৃষ্টির ফলে তাল হারায় পুরো ঋতুচক্রটি। প্রথম দফার একটা চারাগাছও বাঁচেনি, পরের দফায় ফুল আসে দেরিতে এবং ফলনও হয়েছে অল্প।

চাহিদা ছিল ষোল আনা, অথচ কমতি পড়েছিল জোগানে, ফলত অন্যান্য বছরের চাইতে এবার দরটা বেশ ভালোই ছিল। রামানাথপুরম ও পরভাকুড়ির বাজারে একটা কথাই লেগেছিল চাষিদের ঠোঁটে – মার্চের গোড়ায় যখন প্রথম প্রথম লংকা এসে পৌঁছয় আড়তে, তখন দর কেজি-পিছু দর উঠেছিল ৪৫০ টাকা। বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল, দামটা নাকি বাড়তে বাড়তে ৫০০ ছুঁতে পারে।

Ambika plucks chillies and drops them in a paint bucket. Ramnad mundu, also known as sambhar chilli in Chennai, when ground makes puli kozhambu (a tangy tamarind gravy) thick and tasty
PHOTO • M. Palani Kumar

লংকা পেড়ে একটা রঙের বালতিতে ভরে রাখছেন অম্বিকা। চেন্নাইয়ের লোকজন রামনাড মুন্দুকে সম্বর লংকা বলে ডাকে, এটিকে বেটে নিয়ে থিকথিকে সুস্বাদু পুলি কোরাম্বু (টকঝাল তেঁতুলের ক্বাথ) বানানো হয়।

A lot of mundu chillies in the trader shop. The cultivation of chilli is hard because of high production costs, expensive harvesting and intensive labour
PHOTO • M. Palani Kumar

আড়ত-বোঝাই মুন্দু লংকা। উৎপাদন ও ফসল কাটার কাজ অতিরিক্ত খরচসাপেক্ষ এবং অত্যধিক শ্রমনির্ভর হওয়ায় এই লংকাটি চাষ করা বেশ কঠিন

গান্ধিরাসুর কথায় উক্ত সংখ্যাগুলি নাকি ‘সুনামি’। তাঁর মতে এক কেজি মুন্দু লংকা ১২০ টাকায় বিকোলে না রবে মুনাফা না হবে লোকসান। একর-পিছু ১,০০০ কেজি লংকা ফললে মেরেকেটে ৫০,০০০ টাকা লাভ হয় চাষির। “বছর দুই আগে পর্যন্ত লংকার দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করত। বাজারদরের বেশ উন্নতি হয়েছে আজ। তবে ৩৫০ টাকা প্রতি কেজি দরটার উপর চোখ বুজে ভরসা করা যায় না, এটা নেহাতই ব্যতিক্রম।”

ফসল হিসেবে মুন্দু লংকার বেশ নামডাক আছে এ জেলায়, জানালেন তিনি। তবে এই প্রজাতিটি ‘অতি বিচিত্র’, গান্ধিরাসুর মতে এটি নাকি লিলিপুট টমেটোর মতো দেখতে। “চেন্নাইয়ের লোকে রামনাড মুন্দুকে সম্বর লংকা বলে ডাকে। কারণ এর খোসাগুলো বেশ মোটা, বেটে নিলে দিব্যি থিকথিকে পুলি কোরাম্বু (টকঝাল তেঁতুলের ক্বাথ) রাঁধা যায়। চমৎকার স্বাদ হবে।”

ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মুন্দুর বাড়বাড়ন্ত চাহিদা। অনলাইনেও এর দেখা মেলে, একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ অ্যামাজনে ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার পরেও এটির দর ছিল ৭৯৯ টাকা প্রতি কেজি।

“কীভাবে যে এটার লবি করব, ভেবেই পাচ্ছি না আমরা,” স্বীকার করলেন গান্ধিরাসু, “বিস্তর ঝঞ্ঝাট রয়েছে বিক্রিবাটায়।” উপরন্তু তাঁর এফপিও-টির সদস্য তালিকায় সহস্রাধিক কৃষক থাকা সত্ত্বেও সব্বাই যে ওঁদের কাছেই নিজের নিজের ফসল বেচেন, তা কিন্তু নয়। “সব্বার ফসল কিনে যে নেব, একসঙ্গে অতটা পুঁজি জোগাড় করা আমাদের সাধ্যের অতীত, তাছাড়া অতখানি লংকা মজুতই বা করি কীভাবে?”

মজুত করতে পারলেই যে সব সমস্যা মিটে যাবে তা কিন্তু নয়, বিশেষ করে বাজারদর বাড়া অবধি এফপিও যদি ফসল ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় – কারণ মাসের পর মাস ফেলে রাখলে লংকাগুলো কালচে হয়ে যায়, আর লংকাগুঁড়োয় হানা দেয় নানান ধরনের পোকামাকড়। রামানাথপুরম শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি সরকারি হিমঘরে রয়েছে। গতবছর সেখানকার হিমশীতল চত্বরে বস্তার পর বস্তা লংকা মজুত করে রেখেছিলেন চাষিরা। কৃষক ও বেনিয়াদের এক জায়গায় এনে জড়ো করার চেষ্টা চালাচ্ছিল প্রশাসন, তবে চাষিদের মন থেকে দ্বিধা কাটতেই চায়নি। সুদূর হিমঘরে যে কীভাবে তাঁরা ফসল নিয়ে যাবেন, আর সেখান থেকে ফেরত আনার পর কতটুকুই বা লাভ পড়ে থাকবে, সে ধন্দ রয়েই গিয়েছিল।

তবে এফপিও কিন্তু নিজ দ্বায়িত্বে কোনও খামতি রাখেনি। প্রথাগত কীটনাশক পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য চাষিদের পিড়াপিড়ি করছে তারা। “এ অঞ্চলের মানুষ এককালে লংকাখেতের চারিধারে আমানাক্কু (রেড়ি) লাগাত, কারণ মিলাগাইয়ে হানা দিতে আসা পোকারা ওর দিকে আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া ধরুন রেড়ির গাছালি তো এমনিতেই বেশ বড়োসড়ো হয়, তাই ছোটখাট পাখিরাও এসে জোটে। পোকামাকড় খেয়ে সাফ করে দেয় ওরা। জীবন্ত বেড়া, ঠিক যেন উয়িরভেল্লি।”

Changing rain patterns affect the harvest. Damaged chillies turn white and fall down
PHOTO • M. Palani Kumar

বদলাতে থাকা বৃষ্টির জেরে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসল। নষ্ট হয়ে যাওয়া লংকাগুলো সাদাটে হয়ে খসে যায় ডাল থেকে

A dried up chilli plant and the cracked earth of Ramanathapuram
PHOTO • M. Palani Kumar

রামানাথপুরমের ফুটিফাটা মাটি ও শুকিয়ে যাওয়া লংকাগাছ

গান্ধিরাসুর মনে পড়ে, খেতের আল বরাবর কীভাবে আমানাকু ও আগাঠির (জনপ্রিয় এক প্রজাতির পালংশাক, যেটি অগস্ট ট্রি নামেও পরিচিত) গাছ লাগাতেন তাঁর মা। “লংকার পরিচর্যা করতে গেলে আমাদের ছাগলগুলো ছুটত পিছু পিছু। তখন একপাশে ওদের বেঁধে রেখে আগাঠি আর আমানাকুর পাতা খাওয়াতেন মা। এখানেই শেষ নয়। মিলাগাই আর আমানাকু দুটোই কিন্তু ফসল, একজন বড়ো তো আরেকজন ছোটো। লংকাচাষের মুনাফা ঘরে তুলতেন আমার বাবা। আর রেড়ি বেচে যেটুকু আয় হতো, মা সেটা নিজের কাছে রেখে দিতেন।”

অতীতের পাঠশালা হতে নেওয়া শিক্ষা তো আছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ ও বিজ্ঞানের থেকে সাহায্য নিতে উৎসুক গান্ধিরাসু। “রামানাথপুরমে, বিশেষ করে মুদুকুলাথুরে একখান গবেষণা কেন্দ্রের প্রয়োজন লংকার জন্য,” জোরগলায় জানালেন তিনি, “ধান, কলা, এলাচ, হলুদ – সবেরই তো গবেষণা কেন্দ্র আছে। নিজে ইস্কুল-কলেজে গেলে তবেই না আপনি সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে চাইবেন। ঠিক তেমনই, গবেষণা কেন্দ্র থাকলে তবেই না সমস্যার সমাধান খুঁজতে মুখিয়ে উঠবেন। তারপর, একদিন না একদিন দেখবেন লংকাগুলো ঠিক ‘পরবর্তী ধাপে’ পৌঁছে গেছে।”

আপাতত মুন্দু প্রজাতিটি যাতে ভৌগলিক নিদর্শন তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ পায় সে ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগেছে তাঁর এফপিও। “এ লংকার বিভিন্ন গুণমান বহুজনবন্দিত। এবার যে একখান বই না ছাপালেই নয়, তাই না?”

হরেক কিসিমের কৃষি-সমস্যার সমাধান রূপে অনেকেই ‘মূল্য সংযোজন’-এর হয়ে গলা ফাটান, তবে গান্ধিরাসুর মতে এটা লংকার ক্ষেত্রে কার্যকরী না-ও হতে পারে। তাঁর কথায়: “দেখুন, জনাপিছু ৫০-৬০ বস্তা লংকা ফলে। ও দিয়ে আর কিই বা করবেন চাষিরা? মশলার কোম্পানিগুলো এত সস্তায় লংকাগুঁড়ো বেচে যে দল বেঁধে মাঠে নামলেও ওদের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে না আমাদের এফপিও। তাছাড়া ও ব্যাটারা তো শুধু মার্কেটিংয়ের খাতেই কোটি কোটি টাকা ঢালে।”

তবে হ্যাঁ, অদূর ভবিষ্যতে যে জলবায়ু পরিবর্তনটাই প্রধান অসুখ হয়ে দেখা দেবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই তাঁর।

“এ সমস্যা মেটাতে আমরা করছিটা কী বলুন দেখি?” সওয়াল ছুঁড়লেন গান্ধিরাসু, “এই তো, তিনদিন আগেই ঝড়ঝাপটার আশঙ্কা ছিল। মার্চ মাসে নাকি ঝড়, বাপের জন্মে কখনও শুনিনি। অতিবৃষ্টি হলে একটা লংকাগাছও বাঁচবে না। কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়, সে রাস্তা ঢুঁড়তেই হবে চাষিদের।”

*****

“যতটুকু দরকার, ঠিক ততখানিই ধার করেন মহিলারা, একটা পয়সাও কমবেশি হয় না। শিক্ষা, বিয়েশাদি, প্রসব – এসবের জন্য ঋণ নিতে হলে আমরা কক্ষনো না বলব না। এমনকি এগুলো তো চাষবাসেরও আগে।”
লংকাচাষি তথা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী জে. আড়ইকলাচেলভি, মুথুবিজয়াপুরম, রামানাথপুরম

“পাছে গোটা গাছটাই না উপড়ে ফেলেন, সেই ভয়টাই তো পাচ্ছেন, তাই না?” খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন আড়ইকলাচেলভি। পড়শির খেতে কাজে পাঠিয়েছিলেন আমায়। খেতমজদুরের বড্ডো অভাব, তাই কিঞ্চিত সাহায্য চাইতে এসেছিলেন আড়ইকলাচেলভির প্রতিবেশী। তবে চোখের নিমেষে দেখলাম নিজের দেওয়া ‘ধন্যবাদ’ আর নিজেই হজম করতে পারছেন না সেই মানুষটি। আসলে কী জানেন? আমি যে কতখানি আনাড়ি, এটা ঠাহর করতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি তাঁর। আড়ইকলাচেলভি অবশ্য ইতিমধ্যেই বালতি বাগিয়ে টপাটপ দুটো গাছের লংকা পেড়ে সাফ করে দিয়েছিলেন। আপাতত তৃতীয় গাছটির ফসল তুলতে ব্যস্ত। এদিকে আমি তো প্রথম গাছেই কুপোকাত। তড়িঘড়ি একখান মোটা দেখে লংকা পাড়লাম। গোড়াটা যতখানি পুরুষ্টু, ঠিক ততটাই পোক্ত। বাড়িতে রেখে আসা আমার নিজের অঞ্জলাপেট্টিতে (মশলার বাক্স) যে শুকনো ভঙ্গুর লংকাগুলো আছে, তার সঙ্গে এগুলির কোনও তুলনাই হয় না। ঠিকই বলছেন আড়ইকলাচেলভি, ভয় করছে বই কি! পাছে আস্ত ডালটাই না ভেঙে ফেলি!

Adaikalaselvi adjusting her head towel and working in her chilli field
PHOTO • M. Palani Kumar

নিজের লংকা খেতে কর্মরত আড়ইকলাচেলভি, গামছাটা বেশ ভাল করে মাথায় পেঁচিয়ে নিচ্ছেন

মজা দেখতে ভিড় জমালেন জনাকয় মহিলা। ঘনঘন মাথা নাড়ছিলেন সেই পড়শি। আড়ইকলাচেলভি অবশ্য “হুঁ, হাঁ” করে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার মুঠোয় মোটে খান আট লংকা, ওদিকে তাঁর বালতিটা ভর্তি হল বলে। “আপনি পারলে চেলভিকে সঙ্গে করে চেন্নাই নিয়ে যান,” না বলে আর থাকতে পারলেন না পড়শি মহাশয়, “খেত-খামারের কাজ আরামসে করে ফেলে, অফিসের কাজকম্ম করতেও বিশেষ অসুবিধা হবে না।” হায় রে, চাকরির সুপারিশ পাওয়া আর হল না আমার। বোঝাই যাচ্ছে, একেবারে ফেল করেছি এ পরীক্ষায়।

আড়ইকলাচেলভি কিন্তু ঘরে একটা অফিস চালান। এফপিও থেকে বানানো সেই দফতরে একটা কম্প্যুটার আর জেরক্স যন্ত্র আছে। তাঁর কাজ হল পাট্টার খোঁজখবর নিতে আসা লোকেদের জন্য নথিপত্রের ফটোকপি বানিয়ে দেওয়া। “এর চেয়ে বেশি কিছু করার সময় পাই না। খেতিবাড়ি ছাড়াও আমার ছাগলগুলো আছে, হাঁস-মুরগি আছে, ওদের দেখভাল করতে হয়।”

খেত এবং অফিস ব্যতীত একটি মাগালির মন্দ্রম (মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী) চালান তিনি। পাঁচটি দলে বিভক্ত ৬০ জন সদস্য রয়েছে এই গ্রামে, দল-পিছু নিযুক্ত আছেন ২ জন করে থালাইভা (নেত্রী)। সেই ১০ জন থালাইভার মধ্যে আড়ইকলাচেলভি অন্যতম। গোষ্ঠীর হয়ে টাকাপয়সা সংগ্রহ এবং বিতরণ করার দায়িত্বে রয়েছেন এই ১০ জন। “লোকজন তো আকাশছোঁয়া সুদে ধার করে – রেন্ডু ভাট্টি, আঞ্জু ভাট্টি (বাৎসরিক ২৪ থেকে ৬০ শতাংশ)। আমাদের মাগালির মন্দ্রমে কিন্তু সুদের হার অরু ভাট্টি – প্রতি এক লাখে ১,০০০ টাকা।” অর্থাৎ বাৎসরিক ১২ শতাংশ। “তবে পয়সাকড়ি যতটা সংগ্রহ হয়, পুরোটা কিন্তু কোনও একজনকে ধরে দিই না। এখানে তো সব্বাই ক্ষুদ্রচাষি, দিনকাল খারাপ হলে তো প্রত্যেকেকেই একটু একটু করে সাহায্য লাগবে, তাই না?”

যতটুকু দরকার, ঠিক ততখানিই ধার করেন মহিলারা, একটা পয়সাও কমবেশি হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনটি জিনিস সর্বাগ্রে রাখেন তাঁরা: “শিক্ষা, বিয়েশাদি, প্রসব – এসবের জন্য ঋণ নিতে হলে আমরা কক্ষনো না বলব না। এমনকি এগুলো তো চাষবাসেরও আগে,” বুঝিয়ে বললেন তিনি।

এছাড়াও আরেকটি ক্ষেত্রে বদল নিয়ে এসেছেন আড়ইকলাচেলভি – ঋণ পরিশোধে। “আগে আগে একটা বাঁধাধরা পরিমাণ চোকাতে হত প্রতিমাসে। আমি এসে বললাম: আমরা তো সবাই চাষি। কখনও কখনও মাসের পর মাস ঘুরে যায়, হাতে একটা টাকাও থাকে না, তারপর আবার ফসল বেচে নগদ টাকার বন্দোবস্ত করি। যে যখন পারবে, তখন শোধ দেবে। এমন একটা উপায় বানাতে হবে যাতে সব্বার লাভ হয়, তাই নয় কি?” সত্যিই, অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিং প্রথার একখান পাঠ পড়ালেন বটে। এ এমনই এক চর্চা, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে স্থানীয় যাপনরীতির বাস্তব।

Adaikalaselvi, is among the ten women leaders running  women’s self-help groups. She is bringing about changes in loan repayment patterns that benefit women
PHOTO • M. Palani Kumar

আড়ইকলাচেলভি সহ মোট দশজন নেতৃত্ব দেন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে। মেয়েদের যাতে সুবিধা হয়, তার জন্য ঋণ পরিশোধের ছকে আমূল পরিবর্তন আনছেন তিনি

৩০ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল আড়ইকলাচেলভির, তারও আগে থেকে মাগালির মন্দ্রমটি রয়েছে এই গ্রামে। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করে তারা। মার্চে আমরা যখন গিয়েছিলাম, তার পরের সপ্তাহান্তেই নারী দিবস উদযাপন করার কথা ভেবে রেখেছিল মাগালির মন্দ্রম। “গীর্জায় রোববারের প্রার্থনা হয়ে গেলে আমরা কেক বিতরণ করব,” আলতো হেসে জানালেন তিনি। এছাড়াও তাঁরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন, আবার পোঙ্গাল বানিয়ে সবাইকে খাওয়ানও।

যতটা সাহসী, ঠিক ততটাই খোলামনে কথা বলেন আড়ইকলাচেলভি, ফলত গাঁয়ের যে পুরুষদের মদ খাওয়া বা বধু-নির্যাতনের মতো বদগুণ আছে, উনি গিয়ে গিয়ে তাঁদের বোঝান। অন্যান্য মহিলারাও ওঁর বাইক চালানো আর দশকের পর দশক ধরে একা-হাতে খেতের কাজ সামলানো দেখে অনুপ্রাণিত হন। “অল্পবয়সী মেয়েরা তো সব্বাই বেশ পাকা, বাইক-টাইক চালায়, উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু,” তীক্ষ্ণ স্বরে ছুঁড়লেন সওয়ালটা, “চাকরি-বাকরি কোথায়?”

তবে তাঁর স্বামী এখন দেশেই আছেন, খেতিবাড়ির কাজে হাতও লাগান, ফলত কিছুটা হলেও ফুরসৎ পেয়েছেন আড়ইকলাচেলভি। কিন্তু ওটুকু সময়ও বেকার বসে না থেকে হরেক রকমের কামকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এই যেমন বলা যেতে পারে তাঁর খেতের তুলোর কথা: “গত দশ বছর ধরে তুলোর বীজ ছাড়িয়ে আলাদা করে বেচি। ১০০ টাকা কিলোয় বিক্রি হয়। আমার খেতের বীজগুলো থেকে খুব তাড়াতাড়ি গাছ বেরোয়, তাই অনেকেই কিনতে আসে। যতদূর মনে পড়ে, গত বছর প্রায় ১৫০ কিলো বীজ বেচেছি।” এই বলেই একখান প্লাস্টিকের ঝোলা থেকে তিনটি ঢাকনা খুলে হরেক প্রকারের বীজ মেলে ধরলেন, ঠিক যেন কোনও জাদুকরের খরগোশের খেল। কৃষক, বাইক চালানোয় ওস্তাদ এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন বীজরক্ষকও বটেন, সত্যিই তাজ্জব ব্যাপার।

মে মাসের শেষের দিকে ফোন করেছিলাম, ততদিনে লংকা তোলা হয়ে গেছে তাঁর। “যে দরটা ৩০০ টাকারও উপর ছিল, ক্রমশ নেমে ১২০ টাকা কিলোয় এসে ঠেকেছে,” জানিয়েছিলেন তিনি। এক একর জমিতে ২০০ কেজির বেশি লংকা ফলেনি। একে তো বেচতে গিয়ে ৮ শতাংশ বেরিয়ে গেল কমিশনে, তার উপর প্রতি ২০ কেজিতে ১ কেজির লোকসান, কারণ ধড়িবাজ বেনিয়ারা একেকটা ১ কেজির বস্তা থেকে ২০০ গ্রাম মেরে নিয়ে কেবল ৮০০ গ্রামের দাম দেয়। এবছর লংকার দর খুব একটা তলিয়ে যায়নি বলেই বোধহয় মুনাফা না হলেও অন্তত লোকসান হয়নি। কিন্তু গাছগুলোর সঙ্গে ছিনিমিনি খেলেছে বৃষ্টি, কাতর কণ্ঠে বলছিলেন আড়ইকলাচেলভি, নয়ত এতটা কম ফলন হত না।

তবে হ্যাঁ, ফলন কম হলেও চাষির কাজ যে কমতেই চায় না। গাছে গাছে লংকা সে যতই অল্প ধরুক না কেন, সেটাও যত্ন সহকারে পেড়ে, শুকিয়ে, বস্তায় ভরে বেচতে হবে। আড়ইকলাচেলভি ও তাঁর সাথীরা যদি ঘাম না ঝরাতেন, তাহলে সম্বরে স্বাদ আসত কোথা থেকে বলুন তো?

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সাহায্য করেছিলেন রামনাড মুন্দু চিলি প্রোডাকশন কোম্পানির কে. শিবকুমার ও বি. সুগন্য। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন লেখক।

২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত আলোকচিত্র: এম. পালানি কুমার

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Aparna Karthikeyan

ଅପର୍ଣ୍ଣା କାର୍ତ୍ତିକେୟନ ହେଉଛନ୍ତି ଜଣେ ସ୍ୱାଧୀନ ସାମ୍ବାଦିକା, ଲେଖିକା ଓ ପରୀର ବରିଷ୍ଠ ଫେଲୋ । ତାଙ୍କର ତଥ୍ୟ ଭିତ୍ତିକ ପୁସ୍ତକ ‘ନାଇନ୍‌ ରୁପିଜ୍‌ ଏ ଆୱାର୍‌’ରେ ସେ କ୍ରମଶଃ ଲୋପ ପାଇଯାଉଥିବା ଜୀବିକା ବିଷୟରେ ବର୍ଣ୍ଣନା କରିଛନ୍ତି । ସେ ପିଲାମାନଙ୍କ ପାଇଁ ପାଞ୍ଚଟି ପୁସ୍ତକ ରଚନା କରିଛନ୍ତି । ଅପର୍ଣ୍ଣା ତାଙ୍କର ପରିବାର ଓ କୁକୁରମାନଙ୍କ ସହିତ ଚେନ୍ନାଇରେ ବାସ କରନ୍ତି ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ ଅପର୍ଣ୍ଣା କାର୍ତ୍ତିକେୟନ୍
Photographs : M. Palani Kumar

ଏମ୍‌. ପାଲାନି କୁମାର ‘ପିପୁଲ୍‌ସ ଆର୍କାଇଭ୍‌ ଅଫ୍‌ ରୁରାଲ ଇଣ୍ଡିଆ’ର ଷ୍ଟାଫ୍‌ ଫଟୋଗ୍ରାଫର । ସେ ଅବହେଳିତ ଓ ଦରିଦ୍ର କର୍ମଜୀବୀ ମହିଳାଙ୍କ ଜୀବନୀକୁ ନେଇ ଆଲେଖ୍ୟ ପ୍ରସ୍ତୁତ କରିବାରେ ରୁଚି ରଖନ୍ତି। ପାଲାନି ୨୦୨୧ରେ ଆମ୍ପ୍ଲିଫାଇ ଗ୍ରାଣ୍ଟ ଏବଂ ୨୦୨୦ରେ ସମ୍ୟକ ଦୃଷ୍ଟି ଓ ଫଟୋ ସାଉଥ ଏସିଆ ଗ୍ରାଣ୍ଟ ପ୍ରାପ୍ତ କରିଥିଲେ। ସେ ପ୍ରଥମ ଦୟାନିତା ସିଂ - ପରୀ ଡକ୍ୟୁମେଣ୍ଟାରୀ ଫଟୋଗ୍ରାଫୀ ପୁରସ୍କାର ୨୦୨୨ ପାଇଥିଲେ। ପାଲାନୀ ହେଉଛନ୍ତି ‘କାକୁସ୍‌’(ଶୌଚାଳୟ), ତାମିଲ୍ ଭାଷାର ଏକ ପ୍ରାମାଣିକ ଚଳଚ୍ଚିତ୍ରର ସିନେମାଟୋଗ୍ରାଫର, ଯାହାକି ତାମିଲ୍‌ନାଡ଼ୁରେ ହାତରେ ମଇଳା ସଫା କରାଯିବାର ପ୍ରଥାକୁ ଲୋକଲୋଚନକୁ ଆଣିଥିଲା।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ M. Palani Kumar
Translator : Joshua Bodhinetra

ପିପୁଲ୍ସ ଆର୍କାଇଭ୍ ଅଫ୍ ରୁରାଲ ଇଣ୍ଡିଆ (ପରୀ) ରେ ଭାରତୀୟ ଭାଷା କାର୍ଯ୍ୟକ୍ରମ, ପରୀଭାଷାର ବିଷୟବସ୍ତୁ ପରିଚାଳକ ଜୋଶୁଆ ବୋଧିନେତ୍ର। ସେ କୋଲକାତାର ଯାଦବପୁର ବିଶ୍ୱବିଦ୍ୟାଳୟରୁ ତୁଳନାତ୍ମକ ସାହିତ୍ୟରେ ଏମଫିଲ କରିଛନ୍ତି ଏବଂ ଜଣେ ବହୁଭାଷୀ କବି, ଅନୁବାଦକ, କଳା ସମାଲୋଚକ ଏବଂ ସାମାଜିକ କର୍ମୀ ଅଟନ୍ତି।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Joshua Bodhinetra