“লকডাউন চলাকালীন আমাদের ধকল গিয়েছে খুব। কোভিড-১৯-এর সমীক্ষা ছাড়াও শুধু এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যেই সাতাশটা শিশুজন্মের ঘটনা সামলেছি আমি। মায়ের ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রসবের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, সবেতেই ওঁদের পাশে ছিলাম,” বললেন ওসমানাবাদ জেলার নিলেগাঁও গ্রামের স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী, এককথায় আশা (ASHA, অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট), তনুজা ওয়াগহোলে।
মার্চের শেষে লকডাউন আরোপিত করার পর থেকে, আগের মতো সাড়ে সাতটায় ওঠার বদলে ঘরের কাজ সামলে, স্বামী ও দুই ছেলের রান্না সেরে কাজে বেরোনোর জন্য, তনুজা ভোর চারটেয় ওঠা শুরু করেন। তাঁর কথায়, “সাড়ে সাতটা থেকেই যদি কাজ না শুরু করে দিই, সবার সঙ্গে দেখা হবে না আদৌ। মাঝেমাঝে তো আমাদের, আর আমাদের নির্দেশ-টির্দেশ এড়াতে লোকজন সকাল সকাল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।”
২০১০ সাল থেকে আশাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন বছর চল্লিশের তনুজা। আগে যেমন মাসে মোটামুটি পনেরো-কুড়ি দিন দৈনিক তিন-চার ঘণ্টা আশার কাজ করতে হত, তার বদলে এখন প্রতিদিন প্রায় ছ’ঘণ্টা কাজ করছেন তিনি।
তুলজাপুর তালুকের নিলেগাঁও গ্রামে কোভিড-১৯-এর সমীক্ষা শুরু হয়েছে ৭ই এপ্রিল। তনুজা ও তাঁর আশা সহকর্মী অলকা মুলে একসঙ্গে ৩০-৩৫ বাড়ি যাচ্ছেন প্রতিদিন। “আমরা বাড়ি-বাড়ি যাই আর খোঁজ নিই কারও জ্বর বা করোনা ভাইরাসের অন্য কোনও উপসর্গ আছে কিনা।” কেউ জ্বর হয়েছে বলে জানালে তাঁকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেওয়া হয়। যদি করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকে, তাহলে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খবর পাঠানো হয়। (তারপর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কাউকে গ্রামে পাঠায় কোভিড পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের জন্য; পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এলে, আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিভৃতবাস ও চিকিৎসার জন্য তুলজাপুরের গ্রামীণ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।)
গ্রামের সমস্ত বাড়ির খোঁজখবর নিতে আশাকর্মীরা প্রায় দিন পনেরো সময় নেন –তারপর আবারও পরের দফায় একই কাজ শুরু করার পালা। নিলেগাঁও গ্রামের প্রান্তে আছে দুটি তান্ড বা তফসিলি জনজাতি – যাযাবর লামান গোষ্ঠীর বসতি। তনুজার হিসেবে, গ্রামের মূল ও প্রান্তিক তান্ড মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী নিলেগাঁও গ্রামে ৪৫২টি পরিবারের বাস)।
গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, প্রসবে সহায়তা এবং নবজাতকের ওজন আর তাপমাত্রা মাপার মতো কাজগুলো নিয়মিত কাজের দায়িত্ব হিসেবেই তনুজা ও তাঁর সহকর্মীরা করে চলেছেন। বয়স্ক মানুষদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তনুজা। তিনি জানান, “এই সমস্ত কিছুর জন্য, সরকারের থেকে আমরা পেয়েছি শুধু একটা কাপড়ের মাস্ক, এক বোতল স্যানিটাইজার আর ১০০০ টাকা।” তাঁর কাছে মাস্ক এসে পৌঁছেছে ৬ই এপ্রিল – সমীক্ষা শুরুর মাত্র একদিন আগে, আর সমীক্ষার উৎসাহ ভাতা হিসেবে টাকাটা দেওয়া হয়েছে মাত্র একবার (এপ্রিল মাসে)।
শহরের হাসপাতালের প্রথম সারির কর্মীদের মতো, ব্যক্তিগত সুরক্ষার কোনও সরঞ্জামই পাননি আশাকর্মী বা ‘সামাজিক স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাকর্মীরা’। এমনকি একটা অতিরিক্ত মাস্কও দেওয়া হয়নি বলে জানালেন তনুজা। “আমাকেই কয়েকটা মাস্ক কিনতে হয়েছিল চারশো টাকা দিয়ে।” মাসিক ১৫০০ টাকা সাম্মানিক পান তিনি – ২০১৪ সাল থেকে ওসমানাবাদের আশাকর্মীদের জন্য এই অর্থমূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। এর সঙ্গে বিবিধ জাতীয় স্বাস্থ্য যোজনার অধীনে অতিরিক্ত ১৫০০ টাকা উপার্জন করেন “ কাজ ভিত্তিক ভাতা ” হিসেবে। ২০১৪ সাল থেকে এই পরিমাণটাও একই রয়েছে।
কিন্তু গ্রামীণ এলাকার লোকজন – মূলত নারী, শিশু ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর মানুষদের বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, আশাকর্মীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, টিকা এবং সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্য যোজনা সম্পর্কে সচেতনতাও তৈরি করেন তাঁরা।
কোভিড-১৯ সমীক্ষা চালানোর সময় মানুষজনের সঙ্গে নিবিড় আদানপ্রদান তাঁদের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করেছে। “প্রতিদিন বহু মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় আমায়। তাঁদের মধ্যে কতজন আক্রান্ত কে জানে? শুধু একটা কাপড়ের মাস্ক আদৌ যথেষ্ট?” প্রশ্ন তোলেন তুলজাপুর তালুকের দহিতানা গ্রামের আশাকর্মী, বছর বিয়াল্লিশের নাগিনী সুরভাসে। এই সবে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ তাঁদের তালুকের আশাকর্মীদের ‘ইনফ্রারেড থার্মোমিটার গান’ ও ‘পালস অক্সিমিটার’ দেওয়া হয়েছে।
২৪শে মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণার পর, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার বন্দোবস্তের ব্যাপারটাও ওসমানাবাদের আশাকর্মীদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। “এপ্রিল আর জুনের মধ্যে প্রায় তিনশো পরিযায়ী শ্রমিক আমাদের গ্রামে ফিরে আসেন। তারপর সংখ্যাটা দ্রুত কমতে থাকে আর জুনের শেষাশেষি একেবারে তা বন্ধ হয়ে যায়,” তনুজা বললেন। বেশিরভাগ মানুষ এসেছিলেন ২৮০ ও ৪১০ কিলোমিটার দূরে পুণে ও মুম্বই থেকে – দেশের মধ্যে যে দুটি জায়গায় করানোভাইরাস সংক্রমণ ছিল সব থেকে বেশি।
“কিন্তু ১৪ দিন বাড়িতেই নিভৃতবাসে থাকার নির্দেশ বারংবার দেওয়া হতে থাকলেও, অনেকেই বেরিয়ে পড়ছিলেন বাইরে।”
নিলেগাঁও থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে তুলজাপুর তালুকের ফুলওয়াড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে, প্রথম কোভিড সমীক্ষা হয় মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ই এপ্রিলের মধ্যে। “তার মাঝেই ১৮২ জন পরিযায়ী শ্রমিক ফুলওয়াড়িতে ফিরে আসেন। অনেকেই মুম্বই আর পুণে থেকে এসেছিলেন পায়ে হেঁটে। কেউ কেউ, মাঝরাতে সকলের নজর এড়িয়ে ঢুকেছিলেন গ্রামে,” জানালেন বছর বিয়াল্লিশের আশাকর্মী শকুন্তলা লঙ্গাড়ে। তিনি আরও জানাচ্ছেন, এই পঞ্চায়েতে ৩১৫টি পরিবার আর প্রায় ১৫০০ মানুষের বাস। শকুন্তলার বয়ানে, “৬ই এপ্রিলের আগে যখন সমীক্ষা শুরু হয়ে গেছিল রীতিমতো, আমি সুরক্ষার জন্য কিছুই পাইনি– না মাস্ক, না দস্তানা, না অন্য কোনও কিছু।”
ওসমানাবাদ জেলার লোহারা তালুকের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী ও আশা-সহায়ক অনিতা কদম জানান, কে কে গ্রামে ঢুকছেন সে হিসেব রাখা এবং তাঁরা নিভৃতবাসে যাচ্ছেন কিনা খোঁজ নেওয়াটা আশাকর্মীদের জন্য যথেষ্ট দুরূহ একটি কাজ। তাঁর কথায়, “তবু কোনও অভিযোগ ছাড়াই আমাদের আশাকর্মীরা তাঁদের কাজ করে চলেন।” বছর চল্লিশের অনিতা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নাম নথিভুক্ত করা ৩২ জন আশাকর্মীর কাজের তত্ত্বাবধান করেন। এর জন্য, মাসিক ৮,২২৫ টাকা আয় হয় তাঁর (সমস্ত ভাতা সমেত)।
মার্চের শেষে একটি করে ‘করোনা সহায়তা কক্ষ’ (হেল্প সেন্টার) স্থাপিত হয় ওসমানাবাদ জেলার প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে। এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন গ্রাম সেবক, পঞ্চায়েতের কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকারি স্কুলের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা – এবং একইসঙ্গে আশাকর্মী এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও। “করোনা সহায়তা কক্ষের ক্ষেত্রে বিরাট এক ভরসার জায়গা আমাদের আশাকর্মীরা। তাঁরা প্রতিদিন গ্রামে ঢুকতে থাকা মানুষজনের দৈনিক খোঁজখবর আমাদের দিয়েছিলেন,” বললেন তুলজাপুরের ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক প্রশান্তসিং মারোদ।
প্রথমদিকে, ওসমানাবাদের ১,১৬১ জন আশাকর্মী (২০১৪ সাল পর্যন্ত, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের সাইট অনুসারে; জেলাস্তরে কাজ করা একটি সংস্থার মতে তাঁদের বর্তমান সংখ্যা ১২০৭) অতিমারি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনওরকম আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পাননি। তার বদলে, জেলা কালেক্টরের কার্যালয় দ্বারা সংকলিত একটি পুস্তিকা তাঁরা পেয়েছিলেন করোনা ভাইরাসের ওপর। তার মধ্যে শারীরিক দূরত্ব ও গৃহ-নিভৃতবাস সংক্রান্ত নির্দেশিকা ছিল। এরপর, ১১ই মে একটি ওয়েবিনারে হাজির থাকতে হয় আশাকর্মীদের, যার উদ্দেশ্য ছিল অতিমারি পরিস্থিতি ও শহর থেকে পরিযায়ীদের প্রত্যাবর্তন পরবর্তী সতর্কতা গ্রহণের ব্যাপারে তাঁদের প্রস্তুত করা।
আশা-সহায়কদের দ্বারা পরিচালিত এই ওয়েবিনার কোভিড-১৯-এর উপসর্গ ও গৃহ-নিভৃতবাসের পদ্ধতিগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়। আশাকর্মীদের বলা হয় যাতে তাঁরা গ্রামে ঢোকা প্রত্যেক ব্যক্তির নাম নথিভুক্ত রাখেন এবং কোনও গোলমাল হলে পুলিশি সাহায্য নেন। “কোভিড-১৯ উপসর্গ সহ যে কোনও ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয় আমাদের,” জানালেন তনুজা। কোভিড-১৯ চলাকালীন গর্ভাবস্থার বিষয়গুলো কীভাবে সামলানো যায় সে বিষয় এবং শিশু ও বয়স্ক নাগরিকদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলোচনাও ছিল উল্লিখিত সেশনে।
কিন্তু আশাকর্মীরা আরও জরুরি দরকারগুলোকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সেই সময়ে, “সহায়কেরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমাদের দাবিগুলো সামনে আনতে পারবেন এই আশায় চিকিৎসা সংক্রান্ত আরও উন্নততর জিনিসপত্র চেয়েছিলাম আমরা,” তনুজা বললেন। তাঁরা আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন: রোগীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য যানবাহনের অভাব। “নিকটবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় [আন্দুর ও নলদূর্গ] বিপদকালীন পরিবহণ পরিষেবা নেই। সেখানে রোগীদের নিয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য বড্ড কষ্টকর,” জানান তনুজা।
দহিতানা গ্রামে, নাগিনী জানালেন সাত মাসের গর্ভবতী এক মহিলার কথা, স্বামীর সঙ্গে যিনি পুণে থেকে ফিরে এসেছিলেন। স্বামী ইমারতি ক্ষেত্রে কাজ করতেন, লকডাউনের সময় তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। “মে মাসের প্রথম সপ্তাহ তখন। আমি যখন মেয়েটিকে গৃহ-নিভৃতবাসের ব্যাপারে বোঝাতে যাই, খেয়াল করি সে ঢুলছে। মেয়েটিকে দেখেও বড়ো ফ্যাকাশে আর দুর্বল মনে হচ্ছিল। ভালো করে কথাও বলতে পারছিল না।” নাগিনী তাঁকে অবিলম্বে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে চান। “আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করলেও অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়নি। চারটে তালুকের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র দুটো গাড়িতেই কাজ চালায়। আমরা কোনওমতে একটা রিকশার বন্দোবস্ত করি মেয়েটির জন্য।”
নলদূর্গ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্তপরীক্ষায় দেখা যায় তাঁর শরীরে হিমোগ্লোবিন ভীষণ কম। নাগিনী বলেন, এখানে মেয়েদের মধ্যে রক্তাল্পতা হামেশাই দেখা যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল গর্ভাবস্থার সময়কালীন তীব্র রক্তাল্পতা। “আমাদের আরেকটা রিকশা খুঁজে, দহিতানা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে – তুলাজপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ওকে নিয়ে যেতে হয় রক্ত দেওয়ার জন্য। মোট রিকশা ভাড়া লেগে গিয়েছিল ১৫০০ টাকা। মেয়েটির আর্থিক অবস্থাও মোটেই ভালো ছিল না। তাই আমরা করোনা সহায়তা কক্ষের সদস্যদের থেকে টাকা তুলি। যথেষ্ট সংখ্যায় অ্যাম্বুলেন্সের বন্দোবস্ত করাটা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব, তাই নয়?”
কখনও কখনও, এরকম পরিস্থিতি হলে, আশাকর্মীরা তাঁদের নিজেদের কাছ থেকেও টাকা দেন। যদিও সে সামর্থ্য নেই তাঁদের। দশ বছর আগে এক অসুখে স্বামী মারা যাওয়ার পর নাগিনীই তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ছেলে ও শাশুড়ি তাঁর উপার্জনের ওপরেই নির্ভরশীল।
ফুলওয়াড়িতে, লকডাউনের সময়, শকুন্তলাকে তাঁর নিজের উপার্জনের খামতি পূরণ করতে হয়। (এবং এখনও তিনি জুন আর জুলাইয়ের বকেয়া টাকা পাননি)। তিনি জানালেন, “আমার স্বামী গুরুদেব লঙ্গাড়ে একজন খেত মজুর, আড়াইশো টাকা দৈনিক মজুরিতে খাটেন। কিন্তু এই গ্রীষ্মে প্রায় কোনও কাজই পাননি তিনি। জুন থেকে অক্টোবর মাসেই সবচাইতে বেশি কাজ মেলে এমনিতে।” সতেরো দুই বছরের দুটি মেয়ে আছে এই দম্পতির। গুরুদেবের মা-বাবাও এঁদের সঙ্গে থাকেন।
মে থেকে জুলাই মাসে, আন্দুর-ভিত্তিক হ্যালো (HALO) চিকিৎসা সংস্থার এক প্রকল্পের জন্য নিজের গ্রামেই খাবার রান্না করে খানিকটা বাড়তি অর্থ উপার্জন করেছেন শকুন্তলা। এই অলাভজনক সংস্থাটি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী আর আশাকর্মীদের কাছে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রান্না করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। রসদ ইত্যাদি তাঁদের সরবরাহ করা হয়। “লোহারা এবং তুলজাপুর তালুকে আমরা ৩০০ জনকে চিহ্নিত করি যাঁদের একান্তভাবেই সহায়তার দরকার ছিল। ১৫ই মে থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত আমরা তাঁদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছি,” জানাচ্ছেন বসওয়ারাজ নারে নামে সংস্থাটির এক সদস্য।
“নামমাত্র, অপর্যাপ্ত মাইনে দিয়ে যাঁদের চালাতে হয়, আমার মতো সেইসব আশাকর্মীদের সত্যিই সাহায্য হয়েছিল এতে। রান্না করে দুবারের খাবার ও এক কাপ চা দেওয়ার জন্য আমি দিনে জনপ্রতি ষাট টাকা করে পাচ্ছিলাম তখন। ছয়জনের জন্য রেঁধে, দিনে পেয়েছিলাম ৩৬০ টাকা,” বললেন শকুন্তলা। তাঁর বছর কুড়ির মেয়ের বিয়ের জন্য ২০১৯ সালে তিনি এক মহাজনের থেকে ৩ শতাংশ সুদে ৩ লক্ষ টাকা ধার করেন। লকডাউনের সময়েও প্রত্যেক কিস্তিতে টাকা দিয়ে ৮০,০০০ টাকা ফেরত দিয়েছেন তিনি।
শকুন্তলার বক্তব্য, “অতিমারির সময় আমায় কাজ করতে হচ্ছে বলে শাশুড়ি চিন্তা করতেন। বলতেন, ‘তুমিই এবার ঘরে নিয়ে আসবে এই রোগটাকে।’ উনি বুঝতে পারতেন না যে আমি এই গ্রামের দেখভাল করলে, না খেয়ে থাকতে হবে না আমার পরিবারকে।”
তনুজাও একই কর্মসূচীর দৌলতে রান্না করে দৈনিক ৩৬০ টাকা পাচ্ছিলেন সেই সময়। প্রতিদিন তিনি আশাকর্মীর নিয়মিত কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেন আর রান্না করে ছয়খানা টিফিন দিয়ে আসতেন।”
“চারটে নাগাদ তাঁদের চা দেওয়ার পর, আমি করোনা সহায়তা কেন্দ্রের দৈনিক অধিবেশনে যেতাম,” জানান তিনি।
১৩ই অগস্ট পর্যন্ত, তুলজাপুর তালুকে ৪৪৭টা এবং লোহারায় ৬৫টা কোভিড পজিটিভ হওয়ার ঘটনা ঘটে। দহিতানায় পজিটিভ হওয়ার খোঁজ মিলেছে ৪ জনের এবং নিলেগাঁও আর ফুলওয়াড়িতে এখনও পর্যন্ত একজনও পজিটিভ হননি বলে জানাচ্ছেন আশাকর্মীরা।
পঁচিশে জুন, মহারাষ্ট্র সরকার আশাকর্মীদের জন্য ২,০০০ টাকা ও আশা সহায়কদের জন্য ৩,০০০ টাকা মাসিক সাম্মানিক বৃদ্ধির কথা এবং জুলাই মাস থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা ঘোষণা করে। গ্রামীণ এলাকায় তাঁদের কোভিড সমীক্ষার নিদর্শন দেখিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপ রাজ্যের ৬৫,০০০-এরও বেশি আশাকর্মীকে “আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর এক শক্তিশালী স্তম্ভ” বলে অভিহিত করেন।
যদিও, ১০ই অগস্ট পর্যন্ত আমরা যে যে আশাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁরা জুলাই মাসের সাম্মানিক বা ভাতা কিছুই পাননি।
কিন্তু তাঁরা কাজ চালিয়ে গেছেন। “মানুষজনের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করি আমরা,” বলছেন তনুজা। “ঝড়-বৃষ্টি-খরা কিংবা করোনাভাইরাস যা-ই হোক না কেন, সবরকম পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্যের পরিচর্যায় আমরাই প্রথম এগিয়ে এসেছি। আমাদের প্রেরণা সাবিত্রীবাই ফুলে, যিনি ১৮৯৭-এর প্লেগের সময় মানুষের সাহায্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে।”
পুনশ্চ: অগস্টের ৭-৮ তারিখে দেশজুড়ে সংগঠনগুলো সারা-ভারত ধর্মঘটের ডাক দিলে, ওসমানাবাদের আশাকর্মী ও সহায়কেরা তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। স্থায়ী কর্মী হিসেবে আশাকর্মীদের বহাল করা, ন্যায্য (এবং সময়মতো) বেতন প্রদান, ভাতার বৃদ্ধি এবং পরিবহনের সুবিধের মতো বহুদিন মুলতুবি থাকা দাবিদাওয়াগুলো তো ছিলই, এরই পাশাপাশি অতিমারি পর্যায়ে সুরক্ষা সরঞ্জাম, কোভিড-১৯-এর কাজের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, প্রথম সারির কর্মীদের জন্য নিয়মিত কোভিড পরীক্ষা এবং বিমার ব্যবস্থা সংক্রান্ত দাবিগুলোতেও অনড় রয়েছেন আশাকর্মীরা।
অনুবাদ: রম্যাণি ব্যানার্জী