তখনও গাঢ় অন্ধকার, তবে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। রাত ২টো বাজে, আর তিন ঘণ্টা পরেই পুলিশ এসে পড়বে তাঁকে আটকাতে। কাসারুপু ধনরাজু এবং তাঁর দুই সহকর্মী সেই স্থান পার করে এসেছেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যেখানে পুলিশ পাহারা বসবে। খানিক পরেই মিলবে মুক্তি – আর অথই জল।
“প্রথম প্রথম আমি যেতে খুব ভয় পাচ্ছিলাম,” ১০ই এপ্রিলের তাঁর বাইরে বেরোনোর প্রসঙ্গে বললেন তিনি। “প্রচুর সাহস জোটাতে হয়েছে। আমার পয়সার দরকার ছিল। ভাড়াটা তো দিতে হবে।” ধনরাজু ও তাঁর সাথীরা, মরিয়া জেলেদের দলটি তাঁর ছোট্ট বাইরে মোটর লাগানো নৌকোয় পাড়ি দেন। লকডাউনের জন্য জেটিতে মাছ ধরা ও অন্যান্য কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। রোজ সকাল ৫টার মধ্যেই পুলিশ চলে আসে বিশাখাপত্তনমের মাছ ধরার জেটির দুটি প্রবেশ পথে। এখানকার বাজার এখন সাধারণ মানুষ ও জেলে সবার নাগালের বাইরে।
সূর্য ওঠার আগেই ধনরাজু ফিরে আসেন ৬-৭ কিলোগ্রাম বঙ্গারু থিগা (সারাধণ পোনা মাছ) নিয়ে। “কান ঘেঁষে বেঁচে গেছি,” তিনি বলেন। “আমি ফেরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এল। ধরতে পারলেই মারত। কিন্তু এমন ভয়ানক সময়ে, বাঁচার জন্য যা পারি তা-ই করতে হবে। আজ ভাড়া দেব, কিন্তু কাল হয়তো আবার অন্য কোনও প্রয়োজন হবে। আমার কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়নি, অথচ এটা আমার ক্ষতি করে চলেছে আর্থিক দিক থেকে।”
পুলিশের নজরদারির বাইরে, চেঙ্গাল রাও পেটার ড.এনটিআর রোডের পিছনের একটা সরু গলিতে নিজের পুরোনো জং ধরা রোমা সাইকেলে একটা হোয়াইট বোর্ড দিয়ে অস্থায়ী দোকান বানিয়ে লুকিয়ে মাছ করেছেন তিনি। “সাইকেলটা নিয়ে বড়ো রাস্তায় যেতে পারলে খুব ভালো হত, কিন্তু পুলিশের ভয় ছিল,” বললেন ধনরাজু। সাধারণ সময়ে যে মাছ বিক্রি হয় ২৫০টাকা কেজি দরে, তিনি সেই মাছ বিক্রি করেছেন ১০০ টাকা কেজি দরে।
স্বাভাবিক সময়ে ধনরাজু ৬-৭ কিলো পোনা বিক্রি করলে তাঁর আয় হত ১,৫০০টাকা থেকে ১,৭৫০ টাকা। কিন্তু তাঁর সাইকেলের মাছের স্টল তেমন লোক টানেনি। দুইদিন যাবৎ ধরে আনা মাছ বিক্রি করে আয় করেছেন মোটে ৭৫০টাকা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পাপ্পু দেবী নামে ৪৬ বছরের এক মহিলা, তিনি ক্রেতাদের জন্য মাছ কেটে ধুয়ে দিয়ে ধনরাজুকে সাহায্য করেন। প্রতিটা কাটা ও ধোয়ার জন্য তিনি ১০-২০টাকা করে পান ক্রেতাদের থেকে। তিনিও ছিলেন ঝুঁকি নিয়েই, টাকার জন্য।
জেটিতে যখন পুরোদমে কাজ চলে, পাপ্পু দেবীর দৈনিক আয় থাকে ২০০-২৫০ টাকা। মাছ কাটা ও ধোয়াই ছিল তাঁর একমাত্র জীবিকা। “এখন দিনে একবার খাচ্ছি। আমাকে জুন মাস অবধি কোনওরকমে বাঁচতে হবে। হয়তো ভাইরাসের জন্য এটা [লকডাউন] আরও বেশিদিনও চলতে পারে,” তিনি বলছিলেন। তারপর খানিক চুপ করে থেকে, আশার সুরে বললেন, “আমার মনে হয় আমি টিকে যাব এই যাত্রা।” স্বামীহারা পাপ্পু দেবী দুই সন্তানের মা, অন্ধ্রপ্রদেশের ভিজিয়ানগরম জেলার মেনতাডা তহসিলের ইপ্পালাভালাসা গ্রামের বাসিন্দা আদতে তিনি।
মার্চ মাসে দেবী তাঁর মেয়েকে ইপ্পাভালাসায় নিজের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন, “আমার মা-বাবার দেখাশোনা করতে পাঠালাম। আমিও যেতাম এই মাসেই। কিন্তু এখন তো সেটা অসম্ভব মনে হচ্ছে।”
২০২০ সালের ২রা এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী জেলেদের সমুদ্রে যাওয়ার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়াও ৬১ দিনের প্রজনন মরসুমকালীন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে - এপ্রিল ১৫ থেকে জুন ১৪। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ওই সময়ে মোটরচালিত ও যন্ত্রচালিত নৌকোর চলাচলে বাধা রয়েছে, মাছের মজুদ সংরক্ষণের জন্য। “আমি মার্চ ১৫ থেকে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কারণ প্রায় ১৫ দিন আমি স্বাভাবিক দামের অর্ধেক বা তারও কমে মাছ বেচেছি,” বললেন চেঙ্গাই রাও পেটা এলাকায় বসবাসকারী জেলে ৫৫ বছর বয়সী বাসুপাল্লে আপ্পারাও। “মার্চে আমি মাত্র ৫,০০০ টাকা রোজগার করেছি।” সাধারণত মাস গেলে তাঁর ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা আয় থাকে।
“এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে [বার্ষিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হওয়ার আগে] আমাদের ভালো লাভ হয় কারণ সেই সময়ে সাধারণত ক্রেতা সংখ্যা অনেক বেশি থাকে,” আপ্পারাও বললেন। “গত বছর, প্রজনন মরসুমের আগে ১০-১৫ দিনে আমি মোট ১৫,০০০ টাকা আয় করেছিলাম,” তিনি সোৎসাহে জানালেন।
এই বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাছের দাম ভীষণভাবে পড়ে গেছে – ভাঞ্জারাম (স্প্যানিশ ম্যাকারেল) এবং সান্দুভাই (পমফ্রেট), যা সাধারণত বিক্রি হয় ১,০০০ টাকা কিলো দরে, এই সময়ে তা বিক্রি হয়েছে ৪০০-৫০০ টাকা কিলো দরে। আপ্পারাওয়ের মতে, করোনা ভাইরাস জনিত আতঙ্কের ফলেই এটা হয়েছে। তিনি হেসে উঠে বললেন, “একজন লোক এসে আমাকে বলেছিল আমার জাল ফেলা বন্ধ করা উচিত কারণ মাছ চিন থেকে ভাইরাস নিয়ে আসছে। আমার পড়াশোনা নেই ঠিকই, কিন্তু এটা আদৌ সত্যি বলে আমার মনে হয় না।”
সরকার থেকে বিনামূল্যে রেশন বাবদ মাথাপিছু পাঁচ কিলোগ্রাম করে চাল দেওয়া হলেও আপ্পারাও সামনে কঠিন দিন দেখতে পাচ্ছেন। “প্রতিবছরই প্রজনন মরসুম খুব কঠিন, কিন্তু আগের সপ্তাহগুলোতে হওয়া লাভের জন্য আমরা চালিয়ে নিতে পারতাম,” তিনি বললেন। “এই বছরটা অন্যরকম, আমাদের কোনও আয় নেই, কোনও লাভও নেই।”
অল্প সময় এবং জেলেদের জন্য, ১২ই এপ্রিল রাজ্য সরকার লকডাউন শিথিল করে, তাঁদের তিনদিন সমুদ্রে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এমনিতেও ওই ৭২ ঘণ্টার শেষে প্রজনন মরসুম শুরু হয়ে যাবে। জেলেদের জন্য এটা একটা স্বস্তি – কিন্তু “বড্ড কম সময়,” আপ্পারাও মনে করেন, “আর লকডাউনের জন্য ক্রেতাও খুব কম থাকবে।”
চেঙ্গাল রাও পেটার এই সরু গলিতেই থাকেন চিন্থাপাল্লে থাথারাও, এখানে থরে থরে এলোমেলো সাজানো দেশলাই বাক্সের মতো ঘরগুলোর একটিতে থাকেন তিনি। এর মধ্যেই একটি সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে পাওয়া যাবে তাঁর আধো অন্ধকার ঘর। থাথারাও, ৪৮ বছর বয়সী এই জেলে, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হেঁটে পৌঁছে যান সেই জায়গায় যেখান থেকে সমুদ্র তট দেখা যায়। লকডাউনে এই অবধি যাওয়ার অনুমতি আছে। পাপ্পু দেবীর মতোই তিনিও এসেছেন ভিজিয়ানগরম জেলার ইপ্পালাভালাসা থেকে।
“সমুদ্রের জন্য মনকেমন করে আমার। আমি জেটিটাকে বড্ড মিস করি। মাছগুলোকে মিস করি,” ম্লান হেসে তিনি বললেন। মাছ থেকে আসা উপার্জনটুকুও তাঁর খোয়া গেছে, তার কথাও মনে হয়। শেষবার তিনি সমুদ্রে গেছেন ২০২০ সালের ২৬শে মার্চ।
“বরফে রাখা সত্ত্বেও সেই সপ্তাহে প্রচুর মাছ থেকে গেছিল,” বললেন তাথারাও। “আমি খুব খুশি যে মাছগুলো ছিল,” মাঝপথে থামিয়ে তাঁর স্ত্রী সথ্য বলেন, “আমরা ভালো মাছ খেতে পেলাম!”
৪২ বছর বয়সী সথ্য মূলত গৃহিণী হলেও, থাথারাওকে মাছ বিক্রিতেও সাহায্য করেন। লকডাউনের সময়টায় বাড়িটা তাঁর কাছে অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। “সাধারণত, আমি একাই থাকি; এখন আমার ছেলে আর বর বাড়িতে রয়েছে। কত মাস আমাদের একসঙ্গে বসে দুপুর বা রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। টাকাপয়সার টানাটানি থাকলেও এই যে নিজেরা একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছি, এটা আমার ভালো লাগছে,” তিনি বললেন, আর আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠল তাঁর চোখমুখ।
থাথারাও এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না বছর দুই আগে নৌকো কেনার জন্য নেওয়া ধার মেটাবেন কেমন করে। তিনি বলছিলেন, হয়তো কোনও সুদখোর মহাজনের কাছেই যাবেন – এবং বছরের শেষে ঋণ শোধের চেষ্টা করবেন। “তিনদিন মাছ ধরার [বিধি শিথিলের সময়কাল] নিয়মে কোনও পার্থক্যই হবে না, এখন মাছের দাম এত পড়ে গেছে,” তিনি বলেন। “মাছ ধরার থেকে কঠিন সেটা ঠিকঠাক দামে বিক্রি করা।”
“আমার ছেলেকে নিয়েও চিন্তা। গতমাসেই ওর চাকরি গেছে,” তিনি জানালেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর চুক্তি শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত ২১ বছরের চিন্থাপাল্লে তরুণ একটি বেসরকরি সংস্থায় ঢালাইকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। “আমি কাজ খুঁজছিলাম, কিন্তু করোনা ভাইরাস...” তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
“আমরা বস্তিবাসী মানুষ, আমাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব পালন করা অসম্ভব। এখনও এই এলাকায় কেউ পজিটিভ হয়নি, কিন্তু ভগবান না করুন, কারও যদি হয় – আমাদের বাঁচার কোনও উপায় নেই, আমার মনে হয়,” থাথারাও বললেন। “কোনও মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারই আমাদের বাঁচাতে পারবে না।” তাঁর কাছে কোনও সার্জিকাল মাস্ক নেই, তিনি একটি রুমাল বেঁধে রাখেন। সথ্য তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়েই মুখ ঢাকেন।
“পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল নয়। আমার বা আমার পরিবারের কারও যদি ভাইরাস সংক্রমণ হয়, আমাদের চিকিৎসা করানোর টাকা নেই,” জোর করে হেসে থাথারাও বললেন। আর সথ্যের বক্তব্য, “আমাদের কারও স্বাস্থ্যবিমাও নেই, জমা টাকাও নেই, আমাদের শুধু শোধ করে যাওয়ার জন্য ধার আছে, আর চেপে রাখার জন্য আছে একরাশ ক্ষুধা।”
থাথারাও, সথ্য ও পাপ্পু দেবীর মতো জেলে সম্প্রদায়ের আরও অনেকেই অন্যান্য জায়গা থেকে বিশাখাপত্তনম এসেছেন জীবিকার তাগিদে। অন্যান্য বছর তাঁরা মাঝেসাঝে নিজেদের গ্রামে ফিরে যান, বিশেষত প্রজননের মরসুমের এই দুইমাস। এই বছর সেটার সম্ভাবনা কম।
“আগে এই দুইমাস আমাদের বাড়ি ভাড়া দিতে হত না – এখন দিতে হয়,” বললেন থাথারাও। “প্রজনন মরসুমের সময়ে, আমরা (তাঁর গ্রামে) অন্যের জমিতে ছোটোখাটো কাজ খুঁজে নিই, দিনে ৫০ টাকা পাই।” সাধারণত বন্য প্রাণীর হাত থেকে ফসল রক্ষা করার কাজটাই তাঁরা পান।
“মাঝে মাঝে ওইটা করতে গিয়ে আমি গণ্ডগোল করে ফেলি,” তিনি হেসে বললেন। “জেলেরা দ্বারা আর কোনও ভার্থুকু থেরুভু (ব্যবসা বা পেশা কাজ) হয় না। আমরা এখন শুধু এইটুকু আশাই করছি মাছের প্রজনন মরসুমের পর আর এই ভাইরাসটা যেন না থাকে।”
প্রজাশক্তির বিশাখাপত্তনম ব্যুরো চিফ মধু নারাভাকে তাঁর আলোকচিত্রগুলির জন্য ধন্যবাদ।
অনুবাদ: সানন্দা