“২০ বছর আগে অবধি যখন নালাগুলি পরিষ্কার ছিল এই জল ছিল কাঁচের মতো। একটা পয়সা নীচে পড়ে গেলে দেখা যেত, যমুনার জল আমরা সরাসরি খেতে পারতাম,” বিষয়টি খোলসা করতে এক আঁজলা ঘোলা জল মুখের কাছে এনে বললেন মৎস্যজীবী রমন হালদার। আমাদের ত্রস্ত দৃষ্টি নজরে পড়ায় হতাশভাবে হেসে আঙুলের ফাঁক দিয়ে তিনি জল গড়িয়ে ফেলে দিলেন।
এখনকার যমুনায় প্লাস্টিক, রাংতার মোড়ক, গোবর, খবরের কাগজ, শুকনো ফুল, কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ, কাপড়, জল-কাদা, পচা খাবার, ভাসমান নারকেল, রাসায়নিক বর্জ্য আর কচুরিপানা দেখে আক্ষরিক ও অলীক - উভয় অর্থেই — এই শহরের ভোগের অভ্যাসটি আন্দাজ করা যায়।
রাজধানীর ভিতর দিয়ে এই নদীর মাত্র ২২ কিমি (যা কিনা নদীটির মাত্র ১.৬ শতাংশ) বয়ে গেলেও ১,৩৭৬ কিমি ব্যাপী যমুনা নদীর ৮০ শতাংশ আবর্জনা এখানেই পাওয়া যায়। এই কারণেই জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষক কমিটি, ২০১৮ সালে দিল্লির এই নদীকে ‘বর্জ্যবাহী নালা’ বলে উল্লেখ করেছে। এর ফলে জলে অক্সিজেন কমে গিয়ে ব্যাপক হারে মাছের মৃত্যু হয়।
দিল্লিতে নদীটির দক্ষিণভাগে অবস্থিত কালিন্দী কুঞ্জ ঘাটে গত বছর যেমন হাজার হাজার মৃত মাছ পাওয়া গিয়েছিল তেমনই প্রতি বছর কয়েক হাজার অন্যান্য জলজ প্রাণীরও মৃত্যু ঘটে।
“একটি নদীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে নদীর জলে মিশ্রিত অক্সিজেনের মাত্রা অন্তত ৬ কিংবা তার বেশি হওয়া দরকার। মিশ্রিত অক্সিজেন ৪-৫ মাত্রা পর্যন্ত মাছেদের দরকার হয়। যমুনা নদীর দিল্লিতে প্রবাহিত অংশে এই মাত্রা, ০ থেকে ০.৪ এর মধ্যে থাকে,” বললেন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জল-থেকে-মেঘ (ওয়াটার টু ক্লাউড) প্রকল্পের পরিচালক, প্রিয়াঙ্ক হিরানী। এই প্রকল্প নদীর বাস্তবিক দূষণ পরিমাপ করে।
দিল্লিতে এই নদীর উত্তর-পূর্ব ভাগে অবস্থিত রাম ঘাটের পাড়ে, এক ফালি ঘাস জমিতে বসে ৫২ বছর বয়সী মৎস্যজীবী হালদার ও তাঁর আর দুই সাথী চুপ-চাপ বসে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছিলেন। “আমি তিন বছর আগে কালিন্দী কুঞ্জ ঘাট থেকে এখানে চলে এসেছি। আগে ওখানে প্রচুর মাছ থাকলেও এখন অল্প কিছু শিঙি বা মাগুর জাতীয় মাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই মাছগুলিও এমন নোংরা যে এর থেকে অ্যালার্জি, জ্বর, পেট-খারাপ ও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হয়”, দূর থেকে পুঞ্জ মেঘের মতো দেখতে, হাতে বোনা একটা মাছ-ধরা জালের জট ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি বললেন।
আর সব মাছ জলের গভীরে থাকলেও মাগুর মাছ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেসে থাকে জলের উপরের দিকে — আর এইভাবে অন্য মাছের তুলনায় এদের বাঁচার সম্ভবনা বেড়ে যায়। খাদ্য শৃঙ্খলের নীচের দিকে থাকা অন্যান্য গভীর জলের মাছ খেয়ে এরা নিজেদের শরীরে বিষ জমা করে বলে জানালেন, দিল্লিতে বসবাসকারী, সমুদ্র সংরক্ষক, দিব্যা কারনাড। “এই মাংসাশী মড়াখেকো মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।”
*****
ভারতে ধরতে পারার মতো মাছের ৮৭ শতাংশই পাওয়া যায় জলের ১০০ মিটার গভীরতায়, জানালো এই সব বিষয়ে কর্মরত অকুপেশন অফ দ্য কোস্ট - দ্য ব্লু ইকনমি ইন ইন্ডিয়া নামের দিল্লিভিত্তিক একটি অলাভজনক গবেষক গোষ্ঠীর প্রকাশনা।
“এইভাবে মৎস্যজীবীদের ক্ষুদ্র-অর্থনীতি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে,” বললেন ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জাতীয় মঞ্চের প্রধান, পার্থ চ্যাটার্জি। “এঁরা স্থানীয় বাজারে মাছ নিয়ে আসেন, যদি তা না পান তাহলে তো দূরের বাজার থেকে কোনও যানবাহন ব্যবহার করে মাছ কিনে আনবেন — যানবাহনের ব্যবহার এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।” ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার মানে “অধিক জ্বালানী-শক্তির ব্যবহার, আর এর ফলে বিঘ্নিত হয় জলচক্র।”
এর ছাপ পড়ে “জলজ প্রাণীদের উপর আর নদীর জলের পুনর্নবীকরনণও বিঘ্নিত হয়। একে মেরামত করে নদী থেকে পরিচ্ছন্ন পানযোগ্য জল পেতে ব্যবহার করতে হবে আরও প্রচলিত শক্তি। এইভাবে আমরা প্রকৃতি নির্ভর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে শ্রম, খাদ্য, ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে এমন এক বাণিজ্য সংস্থা নিয়ন্ত্রিত চক্রের মধ্যে ফেলছি যা অধিক পুঁজি ও শক্তি নির্ভর... আর নদীগুলি, ইতিমধ্যে, বর্জ্য ফেলবার কাজে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।
শিল্পজাত বর্জ্য নদীতে ফেললে সবার আগে জানতে পারেন মৎস্যজীবীরা। “আমরা দুর্গন্ধ আর মাছের মৃত্যু দেখেই ধরতে পারি,” হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে, যেখানে যমুনা রাজধানীতে প্রবেশ করে, সেই পাল্লা এলাকায় বসবাসকারী ৪৫ বছর বয়সী মৎস্যজীবী মঙ্গল সাহনী বললেন। বিহারের শেওহার জেলায় নিজের ১৫-সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ কী করে করবেন এই নিয়ে সাহনী বিশেষ চিন্তিত। “সবাই আমাদের নিয়ে লেখালিখি করছেন কিন্তু আমাদের অবস্থার কোনও উন্নতি হচ্ছে না, বরং আরও খারাপ হচ্ছে,” বলে তিনি আমাদের খারিজ করে দিলেন।
কেন্দ্রীয় সামুদ্রিক মৎস্যচাষ গবেষণা কেন্দ্রের (সেন্ট্রাল মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইন্সটিটিউট) রিপোর্ট অনুসারে মোটামুটি ৮.৫ লাখ চিরাচরিত মৎস্যজীবী পরিবারের ৪০ লক্ষ মানুষ ভারতবর্ষের উপকূল জুড়ে বসবাস করেন। কিন্তু সম্ভবত এর ৭-৮ গুণ বেশি মানুষ মৎস্যনির্ভর অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। এনএসএসএফডব্লুআই-এর শ্রী চ্যাটার্জির মতে এর মধ্যে ৪০ লক্ষ ভূভাগে মৎস্যচাষের সঙ্গে জড়িত কাজের সঙ্গে যুক্ত। কয়েক দশক ধরেই মৎস্যচাষকে পূর্ণ সময়ের জন্য সংগঠিত পেশা হিসেবে নেওয়া থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে। “সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের ৬০-৭০ শতাংশ অন্য পেশায় সরে গেছেন বলে এই গোষ্ঠীটি ছোটো হয়ে যাচ্ছে,” বললেন পার্থ চ্যাটার্জি।
রাজধানীতে মৎস্যজীবীর অস্তিত্ব বিষয়টি এতোটাই অস্বাভাবিক যে কতজন মৎস্যজীবী দিল্লির উপর দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর অংশে ছিলেন তার কোনও হিসাব নেই, নেই কোনও প্রকাশিত তথ্য। গণনা করা এমনিতেই কঠিন কারণ এঁদের মধ্যে আছেন সাহনীর মতো অভিবাসীরাও। এইটুকু বর্তমান মৎস্যজীবীদের কাছ থেকেই জানা যায় যে তাঁদের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। যমুনা দীর্ঘজীবী হোক আন্দোলনের নেতা, বন বিভাগের অবসর প্রাপ্ত আধিকারিক মনোজ মিশ্র মনে করেন যে পূর্ণ সময়ের মৎস্যজীবীর সংখ্যা স্বাধীনতার আগে ছিল কয়েক হাজার আর এখন তা হয়েছে একশোর কম।
“যমুনা অঞ্চলে মৎস্যজীবীর সংখ্যা কমে যাওয়ার অর্থ হল হয় নদীটি মৃত অথবা মৃতপ্রায়,” বললেন রিসার্চ কালেক্টিভ-এর সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী আর এই অবস্থা একইসঙ্গে একদিকে মনুষ্য-সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলাফল আর অন্যদিকে তার কারণও বটে। তার মানে যে প্রাণী বৈচিত্র্য পরিবেশকে তাজা রাখে তাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,” বললেন চক্রবর্তী। “নির্গত কার্বনের ৪০ শতাংশ শুষে নেয় সারা পৃথিবীর সাগর-মহাসাগর - অতএব বলা যায় যে এর ফলে জীবনচক্র বিঘ্নপ্রাপ্ত হচ্ছে।”
*****
যেহেতু দিল্লির ৪০ শতাংশের সঙ্গে নালার সংযোগ নেই, অতএব সেপটিক ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য উৎস থেকে অগুনতি টন মল ও বর্জ্য পদার্থ সরসরি নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এনজিটি-এর মতে যেখানে ১,৭৯৭ বেআইনি কলোনিগুলির মধ্যে ২০ শতাংশের কিছু কমেই শুধুমাত্র নালার সংযোগ আছে, সেখানে “৫১,৮৩৭ টির মতো বিপুল সংখ্যক শিল্প সংস্থা আইন বহির্ভূত ভাবে বসতি এলাকায় স্থাপিত হয়েছে, আর তাদের শিল্পজাত বর্জ্য প্রথমে নালায় আর তারপর নদীতে গিয়ে পড়ে।”
মানুষের কৃতকর্মের মাত্রা, রূপরেখা আর অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি নদীর অপমৃত্যু হিসাবে বর্তমান সংকটকে দেখা যেতে পারে।
ধরার মতো মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে মৎস্যজীবীদের রোজগার নিদারুণভাবে কমে গেছে। আগে একজন ওস্তাদ মৎস্যজীবী ভালো সময়ে, মাসে ৫০,০০০ টাকাও রোজগার করতে পারতেন।
রাম ঘাটে বসবাসকারী আনন্দ সাহনী বিহারের মোতিহারি জেলা থেকে কিশোর বয়সে দিল্লি এসেছিলেন। “২০ বছরে আমার আয় অর্ধেক হয়ে গেছে। এখন আমি দিনে ১০০-২০০ টাকা আয় করি। পরিবার প্রতিপালনের জন্য আয়ের অন্য পথ খুঁজতে হবে আমাকে — মাছের কাজে এখন আর কোনও স্থায়িত্ব নেই,” বিষণ্ণ সুরে বললেন তিনি।
তুলনায় দূষণ কম, যমুনার রাম ঘাটে — এখানে ৩০-৪০টি মাল্লা (মাঝি ও ধীবর সম্প্রদায়) পরিবারের বাস। যা মাছ ধরেন এঁরা তার থেকে খানিক নিজেদের খাওয়ার জন্য রেখে বাকিটা সোনিয়া বিহার, গোপালপুর ও হনুমান চৌকের মতো স্থানীয় বাজারে কিলো প্রতি ৫০-২০০ টাকায় বিক্রি করেন — এই দাম মাছের ধরনের উপর নির্ভর করে।
*****
খামখেয়ালি বর্ষা আর তাপমাত্রায় হ্রাসবৃদ্ধি যমুনা ঘিরে সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে,” বললেন তিরুভন্তপুরমে অবস্থিত পরিবেশ বিষয়ে পরামর্শদাতা ডঃ রাধা গোপালন। প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে জলের গুণগত ও পরিমাণগত মান নিম্নগামী হওয়ার কারণে মাছেরও পরিমাণগত ও গুণগত মান পড়েছে।
জল দূষণের কারণে মাছ মরে যায়,” বললেন ৩৫-বছর বয়সী সুনীতা দেবী; তাঁর স্বামী, নরেশ সাহনী বেরিয়েছিলেন দিনমজুরের কাজ খুঁজতে। “মানুষ নানা ধরনের ময়লা, আজকাল বিশেষ করে প্লাস্টিক, ফেলে যায় এসে।” উৎসবের সময়ে তো মানুষ লুচি তরকারি জিলিপি লাড্ডুর মতো রান্না করা খাবারও ফেলে যায়, আর তাতে নদীতে পচন বাড়ে।
দুর্গাপুজোর পর মূর্তি বিসর্জন হলে নদীর বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে, এনজিটি এই মর্মে রিপোর্ট দাখিল করার পর ১০০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ২০১৯ সালের অক্টোবরে মূর্তি বিসর্জনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
নগর গড়ে ওঠে তিনটি জিনিসের সমাহারে : ‘ দরিয়া, বাদল আর বাদশা (নদী, মেঘ আর সম্রাট)’ - পুরাকালের এই প্রবাদকে বাস্তবায়িত করতেই যেন মুঘলরা দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন করেন ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীতে। তাঁদের জল ব্যবস্থা — যা প্রায় শিল্পের স্তরে উন্নীত হয়েছিল — আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক সৌধমাত্র। ইংরেজরা জলকে কেবল সম্পদ হিসাবেই দেখত বলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নতুন দিল্লি স্থাপন করল যমুনার দিকে পিছন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল ও নগরায়িত হয়ে ওঠে।
ন্যারেটিভস অ ফ দ্য এনভায়নমেন্ট অফ ডেলহি নামক গ্রন্থে (ভারতীয় জাতীয় ঐতিহ্য ও শিল্পকলা পর্ষদ দ্বারা প্রকাশিত) জানাচ্ছে বিংশ শতাব্দীর ৪০ থেকে ৭০-এর দশকে মাছ ধরা, নৌকাবিহার, বনভোজন ও সাঁতার ছিল দিল্লির ওখলা অঞ্চলের জনজীবনের নিত্য সঙ্গী। এমনকি ওখলা বাঁধের নিম্নভাগে গঙ্গার শুশুকও দেখা যেত, আবার জল খানিক কমে গেলে নদীর দ্বীপগুলিতে কচ্ছপরা রোদ পোয়াতো।
আগ্রা নিবাসী পরিবেশবিদ, ব্রিজ খান্ডেলওয়াল জানালেন, “যমুনার অবস্থা বিপজ্জনক।” ২০১৭ সালে উত্তরাখণ্ড উচ্চ ন্যায়ালয় গঙ্গা ও যমুনাকে প্রাণবন্ত ঘোষণা করা মাত্র শ্রী খান্ডেলওয়াল নিজের শহরের সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ‘খুনের চেষ্টার’ মামলা দায়ের করতে প্রয়াসী হন। তাঁর অভিযোগ - আধিকারিকরা যমুনাকে ধীর লয়ে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করছেন।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সাগরমালা প্রকল্প চালু করতে চলেছে — যাতে দেশের সব নদীপথকে বন্দরের সাথে যুক্ত করা হবে। কিন্তু “বড়ো পণ্যবাহী জাহাজ যদি পশ্চাদভূমি অবধি আসে তাহলে নদী দূষণ বাড়বে,” বলে সতর্ক করলেন এনএসএসএফডব্লুআই-এর পার্থ চ্যাটার্জি।
*****
হালদার তাঁর পরিবারের শেষ মৎস্যজীবী। পশ্চিমবঙ্গের মালদার মানুষ তিনি — প্রতি মাসে ১৫-২০ দিন রাম ঘাটে এসে থাকেন আর বাকি সময়ে থাকেন তাঁর দুই ২৫ ও ২৭ বছর বয়সী ছেলের কাছে নয়ডায়। এঁদের মধ্যে একজন মোবাইল সারান আর একজন এগ রোল আর মোমো বিক্রি করেন। “আমার ছেলেরা বলে আমার পেশা সেকেলে। আমার ছোটো ভাইও মাছ ধরে। এটা আমাদের ঐতিহ্য - ভালো মন্দ যাই হোক আমরা এই কাজই জানি। আমি জানি না আর কী করে আমি বাঁচবো...”
“এই যে ধরার মতো মাছ কমে গেছে এঁরা এখন বাঁচবেন কী করে?” প্রশ্ন তুললেন ডঃ গোপালন। “মনে রাখা দরকার যে মাছ তাঁদের পুষ্টি লাভেরও উপায়। সামাজিক-পরিবেশগত অবস্থা যার একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে — তাকে স্মরণে রেখে আমাদের বিবেচনা করতে হবে এঁদের কথা। এই দিকগুলি বাদ দিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে ভাবা যায় না – আমাদের দুই-ই দরকার পেশা এবং পরিবেশের বৈচিত্র্য।
এর মধ্যে সরকার পরিবেশগত সংকটের কথা বলছে বিশ্ব পরিবেশ কাঠামোকে মনে রেখে — এই নীতি কিন্তু জোর দিচ্ছে রপ্তানি করার স্বার্থে মৎস্যচাষের উপর, বললেন রিসার্চ কলেক্টিভের শ্রী চক্রবর্তী।
২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারত $৪.৮ বিলিয়ন টাকা মূল্যের চিংড়ি রপ্তানি করেছে। শ্রী চক্রবর্তী বলেন যে এই চিংড়ি ছিল মেক্সিকোর নিকটবর্তী প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি যা এখানে চাষ করা হয়েছিল। ভারত একফসলি মৎস্য চাষ শুরু করেছে কারণ “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকোর সাদা চিংড়ির খুব চাহিদা।” ভারতের রপ্তানিকৃত চিংড়ির মাত্র ১০ শতাংশ বিনা-চাষে ধরা কালো বাগদা চিংড়ি, যা ভারতবর্ষের জলভাগে প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়। ভারত যে জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে তা মানুষের জীবন-জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। “নীতি যদি রপ্তানিনির্ভর হয়, তাহলে তা স্থানীয় মানুষের পুষ্টি ও প্রয়োজনের দিকে মোটেই নজর দেবে না।”
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সত্ত্বেও নিজের কাজের বিষয়ে রমন হালদার যথেষ্ট গর্ববোধ আছে। একটি মাছ ধরার নৌকার দাম ১০,০০০ টাকা আর জালের দাম যেখানে ৩,০০০-৫,০০০ টাকা আর রমন হালদার আমাদের দেখালেন যে জাল তাঁরা ফোম, কাদা-মাটি আর দড়ি দিয়ে তৈরি করেন। একটা জাল দিয়ে তিনি প্রতিদিন ৫০-১০০ টাকা মূল্যের মাছ ধরতে পারেন।
৪৫ বছর বয়সী রাম পরভেশ আজকাল বাঁশ আর সুতো দিয়ে তৈরি খাঁচার মতো একটি জিনিস ব্যবহার করেন - এতে একবারে ১-১.৫ কিলগ্রাম মাছ ধরা পড়ে। “এটা আমরা আমাদের গ্রামে তৈরি করতে শিখেছি।” জলে নামানোর আগে আটার চাড়া - খাঁচার দুই দিকে দিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ধরা পড়ে ছোটো জাতের পুঁটি মাছ,” তিনি বুঝিয়ে বললেন। এখানে পুঁটি মাছ সহজেই পাওয়া যায় বলে জানালেন ভিম সিং রাওয়াত যিনি সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল-এর সঙ্গে আঞ্চলিক স্তরে কাজ করেন। “চিলওয়া আর বাচুয়া এখন অনেক কমে গেছে, বাম আর মল্লি তো আর পাওয়াই যায় না। দূষিত জলে মাগুর পাওয়া যায়”।
“আমরা যমুনার রক্ষক,” হেসে জানালেন চার দশক আগে বিহারের বৈশালী জেলায় নিজের পরিবারকে ছেড়ে চলে আসা ৭৫-বছর বয়সী অরুণ সাহনী। তাঁর দাবী, ১৯৮০-৯০-দশকে তিনি রুই, শোল, চিংড়ি, মল্লি সহ ৫০ কিলোগ্রাম মাছ রোজ ধরতেন। এখন ১০-ও হয় না, খুব ভালো দিনে বেশি হলে ২০ কিলোগ্রামের অধিক তো হয়ই না।
ঘটনাচক্রে, যমুনার উপর, কুতব মিনারের দ্বিগুণ উচ্চতার, বিখ্যাত সিগনেচার সেতুটি — রাম ঘাট থেকেই দেখা যায় — বানানো হয়েছিল ১,৫১৮ কোটি টাকায়। ১৯৯৩ থেকে যমুনাকে ‘পরিষ্কার’ করতে আজ অবধি ব্যয় হয়েছে ১,৫১৪ কোটি টাকার বেশি — কোনও সাফল্যই যদিও পাওয়া যায়নি।
এনজিটি সতর্ক করে বলেছে “...কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা স্থানীয় মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যকেই কেবল বিপদগ্রস্ত করছে না, যমুনার অস্তিত্বকেও সংকটে ফেলেছে এবং সেই সঙ্গে গঙ্গারও ক্ষতিসাধন করছে।”
“যমুনা অ্যাকশন প্রকল্পে”, নদীকে একটি সামগ্রিক সত্তা অথবা পরিবেশের অংশ হিসাবে না দেখে “পুরো বিষয়টিকে দেখা হয়েছে প্রয়োগগত দিক থেকে — এটাই এর সমস্যা,” বললেন ডঃ গোপালন। যে নালাপথ বেয়ে বৃষ্টির জল নদীতে পড়ে একটি নদী তারই ফল। দিল্লি শহর যমুনার ক্ষেত্রে সেই নালাপথ। সেই নালাপথ পরিষ্কার না করে নদীকে পরিষ্কার করা যায় না।”
মৎস্যজীবীরা যেন বা কয়লা-খনিগুলিতে অশনি সংকেতের নির্দেশ দেওয়া ক্যানারি পাখির মতো বললেন সমুদ্র সংরক্ষক, দিব্যা করনাড। “আমরা কেন বুঝতে পারছি না যে ভারি ধাতু স্নায়ুতন্ত্রে ভাঙন ধরায়? এও কেন বুঝতে পারছি না যে সবচেয়ে দূষিত নদীর নিকটবর্তী এলাকা থেকে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? মৎস্যজীবীরা কিন্তু এই যোগাযোগ ধরতেও পারছেন আর এর ফলাফল বুঝতেও পারছেন।”
“এইটুকু শান্তি আমার অবশিষ্ট আছে”, সূর্যাস্তের অনেক পরে নদীতে জাল ফেলার আগে, হেসে বললেন রমন হালদার। রাত ৯টার পর জাল ফেলে ভোরে সূর্যোদয়ের সময়ে তোলাই ভালো, তিনি জানালেন। কারণ “মরা মাছগুলি ততক্ষণে তাজা হয়ে যায়।”
পারি-র জলবায়ু বিবর্তনের উপর দেশব্যাপী রিপোর্টিং সংক্রান্ত প্রকল্পটি ইউএনডিপি সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য জলবায়ুর বিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি দেশের সাধারণ মানুষের স্বর এবং অভিজ্ঞতায় বিবৃত করা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা