কোনও আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টের সাহায্য ছাড়াই, রোপি একটি বেসরকারি মাতৃসদনের চিকিৎসককে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মায়ের পেটে যমজ সন্তান আছে।
বছর দুয়েক আগের এই ঘটনাটির কথা বেশ রসিয়ে বললেন রোপি মান্নু বেতে। চিকিৎসকের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করার ভঙ্গি নকল করে তিনি বলেন, “ওইটা কানে লাগিয়ে” ডাক্তারটি ওই রোগাটে মহিলার মাঝারি মাপের পেটের দিকে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে রোপির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন।
হাসপাতালের প্রসব-কক্ষের একটি টুলে বসার আগে তিনি আবার বলেন, “ম্যাডাম দুটো বাচ্চা হবে, দুটো।" ৭০ পার করা রোপি ও যন্ত্রণাকাতর হবু-মা তখন উত্তর-পূর্ব মহারাষ্ট্রের মেলঘাট বনাঞ্চলের সীমান্তে অবস্থিত জৈতাদেহি গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে পরটওয়াড়া শহরে।
বিকেল নাগাদ ভূমিষ্ট হল এক শিশু-পুত্র আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উদয় হল আরও একটি শিশু — এটি কন্যা — ছেলেটির যমজ বোন।
গোবরে নিকোনো চকচকে মেঝে আর চিরাচরিত মাটির দেওয়ালে ছাওয়া ভিটেবাড়িতে একটি কাঠের নেড়া খাটিয়ায় বসে রোপি একচোট হাসলেন। ভিতরের তিনটি ঘর ফাঁকা — ছেলেরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক, পরিবারের দুই একর জমিতে তাঁরা কাজ করতে বেরিয়ে গেছেন।
কোরকু ভাষায় একটি গালি বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে, তর্জমায় যে শব্দটি গাধার গুপ্ত অঙ্গ বিশেষকে নির্দেশ করে! বলিরেখায় ছাওয়া মুখের কাটাকুটি গভীরতর হল যখন আরও খানিক হাসি ফুটিয়ে তিনি বেশ হৃষ্ট চিত্তে জানালেন যে কেমন সুন্দর করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ওই শহুরে চিকিৎসককে!
চার দশকের অভিজ্ঞতা-লব্ধ এই আত্মবিশ্বাস। কোরকু সম্প্রদায়ের মানুষ রোপি হলেন জৈতাদেহি গ্রামের শেষ চিরাচরিত দাইমাদের একজন; তাঁর আন্দাজ তিনি এ যাবৎ ৫০০-৬০০ বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন। যদিও তিনি তেমন করে কোনও হিসাব রাখেননি। সগর্বে জানালেন যে একটিও মৃত শিশু জন্মায়নি তাঁর হাতে। সব শিশুই দিব্যি ছিল। এই দাইমায়েরা, বিশেষ প্রশিক্ষণ বা সংশাপত্র-হীন চিরাচরিত প্রসব-সহায়িকা ধাত্রী।
মেলঘাট জঙ্গলের কোরকু আদিবাসী যাঁরা মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের অমরাবতী জেলার ধর্ণি ও চিখলদারা গ্রামে থাকেন, তাঁদের কাছে রোপির মতো মানুষেরা কেবলমাত্র বাড়িতে সন্তান প্রসবে সহায়ক নন। অভিজ্ঞ ধাত্রী রূপে তাঁরা প্রসবের পরের যত্ন থেকে অন্যান্য চিকিৎসা, সবেরই নিদান দেন জঙ্গল ঘেরা এই পার্বত্য অঞ্চলে — যেখান থেকে দ্রুত চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণ করতে বাইরে যাওয়া খুব কঠিন।
মেলঘাটের বেশিরভাগ গ্রামে এখনও এক বা দুই জন দাইমা আছেন, কিন্তু রোপি জানালেন যে তাঁদের সবারই এখন যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে এবং এই পেশায় নতুন আর কেউ আসছে না। জৈতাদেহিতে আর একজন দাই ছিলেন, তিনি বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। রোপি বলছিলেন ওই মৃতা দাই হয়তো নিজের মেয়ে অথবা বৌমাকে এই কাজ শিখিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর পরিবারের কেউই আর তাঁর পরে ধাত্রীর কাজ করেননি।
রোপির নিজের সন্তানরা সবাই বাড়িতেই জন্মেছে — সাহায্য করেছেন তাঁর মা আর অন্য এক ধাত্রী। তাঁর চার ছেলের একজন অসুস্থতাজনিত কারণে বছর দশেক আগে মারা গেছেন। এছাড়া তাঁর দুই মেয়েও আছেন। তাঁরা বিবাহিত এবং জৈতাদেহিতেই থাকেন। রোপির অনেকগুলি নাতি-নাতনি এবং প্রপৌত্র-কন্যাও আছে। (তাঁর মেয়েদের মধ্যে একজন এই কাজ খানিকটা শিখেছেন বটে তবে ধাত্রীর কাজ করেন না কেউই, জানালেন রোপি)।
"আমার ছেলের বৌ তো এতটাই ভয় পায় যে, যে ঘরে কোনও মহিলার সন্তান প্রসব করছে সেখানে সে কিছুতেই আমার সঙ্গে দাঁড়াবেও না। তাকিয়েও দেখবে না, মায় গজ কাপড়, সুতো বা অন্য কোনও কিছু আমাকে হাতে করে ধরিয়েও দেবে না। সে তো ভয়েই কাঁপতে থাকে,” রক্ত দেখে ভীত তরুণী বধূর কাঁপুনি নকল করে এসব কথা বলছিলেন রোপি।
রোপি মনে করেন পূর্ববর্তী প্রজন্মের নারীরা কেউ শরীরের ক্রিয়াদিকে ভয় পেতেন না। “আমাদের কোনও উপায় ছিল না বলেই হয়তো সাহস সঞ্চয় করতেই হত। যখন-তখন ছোটোখাটো কারণে দৌড়ানোর মতো ডাক্তার নার্স তো আর ছিল না।”
রোপির মা আর ঠাকুরমা উভয়েই ধাত্রী ছিলেন আর তিনি নিজে ঠাকুরমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরেই কাজ শিখেছেন। তাঁর মা নিজের এই চঞ্চল মেয়েটিকে, যে কিনা স্কুলেই যায়নি, তাকে সন্তান প্রসব করানোর কাজে কোনও বাড়ি গেলে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইতেন না। তাঁর মনে পড়ে, মা কোরকু ভাষায় বকা দিয়ে বলতেন, “বাড়িতে থাক! কিন্তু আমার যখন বয়স মাত্র ১২ কি ১৩ তখনও আমার ঠাকুমা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।” কাজেই ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগেই তিনি তাঁর প্রসব সহায়িকা ঠাকুরমার কাজের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।
*****
১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার জূড়ে বিস্তৃত মেলঘাটের বিস্তীর্ণ পাহাড় আর জঙ্গল জীব বৈচিত্রের ভাণ্ডার — এখানেই অবস্থিত মেলঘাটের ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য। এই শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্য কোরকু ও গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ এলাকার বাফার অঞ্চল তথা সীমান্তবর্তী স্থান জুড়ে নানান জনপদে এই আদিবাসীদের বাস। তাঁরা পশুপালন ও কৃষিকাজ ছাড়াও বাঁশ ও বনৌষধির মতো বনজ সম্পদের উপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল।
১৫০টি পরিবার নিয়ে গঠিত, বোর্ত্যাখেদা নামে একটি ছোটো জনপদ, চিখলদারা তালুক নগর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে একেবারে জঙ্গলের কোর এলাকাতেই অবস্থিত। প্রায় ৭০ বছর বয়সী চরকু বাবুলাল কসদেকর এইখানে দাইয়ের কাজ করছেন, তাঁর কথায়, “যতদূর অবধি আমার মনে পড়ে ততদিন ধরে।”। কয়েক দশক ধরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি খানিক ঘটে থাকলেও, তিনি বললেন, মেলঘাটের প্রতি ১০ জন সন্তানসম্ভবা মহিলার মধ্যে অন্তত পাঁচজনের পরিবার চায় বাড়িতেই সন্তান জন্মাক (২০১৫-১৬ সালের এনএফএইচএস-৪ গ্রামাঞ্চলে ৯১ শতাংশ প্রসব হাসপাতালে হয় একথা বললেও তা সম্ভবত মেলঘাটের মতো প্রত্যন্ত এলাকার বাস্তবকে তুলে ধরে না)।
২০২১ সাল এপ্রিল মাসে বোর্ত্যাখেদায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে একটি উপকেন্দ্র স্থাপিত হলেও এই একতলা বাড়িটি গড়ে ওঠার মাস দুয়েক পর আমি যখন সেটি দেখতে যাই তখনও সেখানে কলের জল পৌঁছায়নি। এখানে, একজন সহায়ক নার্স-ধাত্রী ২৪ ঘণ্টার জন্য অন-কল দায়িত্বে উপস্থিত থাকেন। একতলায় তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা থাকার কথা কিন্তু বোর্ত্যাখেদার সহায়ক নার্স-ধাত্রী শান্তা ভিহিকে দুরভে বৈবাহিক সূত্রে এই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা।
ওই উপকেন্দ্রে সামাজিক স্বাস্থ্য আধিকারিক হিসেবে একজন চিকিৎসকের থাকার কথা, কিন্তু গ্রামের মানুষজন আমাকে জানিয়েছেন যে কলের জলের ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে কারও পক্ষে কাজ করা কঠিন। ২০ কিলোমিটার দূরে, সেমাদোহ গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত সদ্য পাস করা এক তরুণ চিকিৎসকের কিছুদিনের মধ্যেই ওই উপকেন্দ্রে যোগ দেওয়ার কথা ছিল (গতবছর আমি যখন সেখানে যাই এটা তখনকার কথা)।
কিন্তু সহায়ক নার্স-ধাত্রী এএনএম বলেন যে বেশিরভাগ সন্তানসম্ভবা মহিলাই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে নারাজ। “নিজেদের সমাজের মহিলাদের উপর তাঁদের আস্থা অনেক বেশি,” জানালেন ৩০ বছর বয়সী শান্তা দুরভে, যিনি পার্শ্ববর্তী মোরশি ব্লকের উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এক দশকের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে এসেছেন।
সেমাদোহর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসব করাবার সময়েও তিনি চরকুকে আসতে বলেন। শান্তার মতে পরিবারের লোকজন দাইয়ের পরামর্শ সহজে মেনে নেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ যে বোর্ত্যাখেদায় আর এমন কোনও দাইমা নেই যিনি চরকুর কাজের ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাবেন। অন্য আরেকজন যিনি আছেন, তিনি বয়সজনিত কারণে আর কাজ করতে পারেন না আর তাছাড়া, কয়েক বছর আগে ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে সরকার এঁদের জন্য যে একটি স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল তিনি সেটি গ্রহণ করেননি।
চরকু এই একদিন ব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানালেন। তাঁর কথায়, “আমরা ভাবতাম আমরা সবই জানি কিন্তু ওরা আমাদের সাবান ব্যবহার করা, হাত ধোয়ার পদ্ধতি, নতুন ব্লেড ব্যবহার করার নিয়ম ইত্যাদি জরুরি বিষয় শিখিয়েছে।”
কোনও গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে যখন তিনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা কখনও বেসরকারি হাসপাতালে যান তখন সন্তান প্রসব করান কোনও একজন (মহিলা) নার্স। যতক্ষণ না একজন নার্স পারছেন না বলে হাল ছেড়ে দেন, ততক্ষণ পুরুষ চিকিৎসককে এড়িয়েই চলতে চান মহিলারা, জানালেন চরকু। কোনও জটিলতা দেখা দিলে তবেই চিকিৎসককে ডাকা হয়। সঙ্গে যাওয়ার জন্য চরকু অবশ্য কোনও পারিশ্রমিক পান না।
তবু কেনই বা তিনি যান? “যেতে বললে চলেই যাই। আমি সঙ্গে গেলে যদি মায়ের একটু স্বস্তি হয় তাহলে যাব না-ই বা কেন?”
আগে দুই-তিন পাই (চিরাচরিত মাপের বড়ো পিতলের পাত্র) ধান বা গম পেতেন তিনি এই কাজের জন্য। কখনও বা এরই সঙ্গে পেতেন সামান্য অর্থ।
বিগত কয়েক দশকে এই দাইমাদের আয় কিছু এমন বাড়েনি। ২০২১ সালের জুন মাসে, আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে একটি প্রসবের কাজ করে তিনি ৫০০ টাকা আর চার কিলো গম পেয়েছিলেন। প্রসব হয়েছিল দ্রুত, প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানটি ভূমিষ্ট হয়। “প্রসব বেদনা অনেক ক্ষণ ধরে চললেও আমার মজুরি সেই একই থাকত,” তিনি জানালেন।
বছর পাঁচেক আগে চরকুর স্বামী মারা যান; তিনি যে এক একর জমি চাষ করতেন তা-ই এখন তাঁর মেয়ে জামাই মিলে চাষ করেন। দাইয়ের কাজ থেকে কোনও স্থায়ী আয় তাঁর ছিল না বলে জানালেন চরকু। বিগত কয়েক বছরে তিনি কোনও মাসে ৪,০০০ টাকাও আয় করেছেন আবার কোনও মাসে ১,০০০ টাকাও আসেনি।
বোর্ত্যাখেদায় বিগত তিন দশকে যত বাচ্চা হয়েছে তাদের অর্ধেকের জন্মের সময়েই চরকু উপস্থিত থেকেছেন বলে জানালেন এখানকার মহিলারা। নিজের নাতি-পুতি তথা একটি পর-নাতিও হয়েছে তাঁরই হাতে।
তাঁর হাতে প্রসব হওয়া কিছু শিশু জন্মের কিছুদিন পর মারা যায় বলে তাঁর মনে পড়ে। “জন্মের সময়ে না, তার কিছুদিন পর।” মৃত্যুর কারণ তাঁর অজানা। কেউই জানে না বলে তিনি জানালেন।
এখন তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছে বলে তিনি বেশিরভাগ মহিলাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা নতুন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
*****
নিজের বয়সের সঠিক আন্দাজ করতে পারেন না রোপি; কিন্তু আজকাল তাঁর পায়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গোড়ালির কাছে ফুলে উঠছে আর হাঁটুতে বেজায় ব্যথা। এর জন্য তিনি শহরের কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে স্থানীয় বৈদ্যের দেওয়া তেল মালিশ করছেন। তাতে অবশ্য কোনও উপকার হয়নি।
যদিও তিনি এখনও গ্রামে ঘুরে চেনা-পরিচিতের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, মেয়েদের বাড়ি যান কিন্তু সন্তান প্রসব করাবার ডাক পেলে আর তা গ্রহণ করেন না, কারণ বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি এখন আর নিশ্চিত নন। আর তাছাড়া তাঁর নিজের চোখের দৃষ্টির উপরেও বিশেষ ভরসা রাখতে পারেন না তিনি। “আমি ওদের (পরটওয়াড়া) শহরের হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে অ্যাম্বুল্যান্স আসা অবধি সঙ্গে অপেক্ষা করি। গাড়িটার যদি তখন-তখনই গ্রামে ফেরার কথা থাকে তাহলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমি সঙ্গে যাই,” বললেন রোপি।
এককালে যখন তিনি ব্যস্ত দাই ছিলেন তখন যে কোনও অবস্থা দ্রুত অথচ ধীর-স্থিরভাবে সামাল দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর বেশ নাম-ডাক ছিল। “আমাকে কেউ ডাকতে এলে আমি আগে জানিয়ে দিতাম আমার কী কী লাগবে —একটা ব্লেড, সুতো আর ছূঁচ।” দাইদের অনেকেই প্রসবের পর দরকারে যোনি-মুখ দিব্যি দক্ষ হাতে সেলাই করতে পারেন — কাঁধ ঝাঁকিয়ে এমনভাবে তিনি একথা বললেন যেন এটা তেমন কোন বড়ো কথাই নয়!
তারপর প্রসব বেদনা সবে শুরু হয়েছে না অনেক ক্ষণ ধরে চলছে তার উপর নির্ভর করে তিনি দ্রুত নিজের বাড়ির কাজ-কর্ম সেরে হবু-মায়ের কাছে পৌঁছে যেতেন — সেখানে অধীর আগ্রহে পরিবারের সদস্যরা সবাই হাজির হত।
চিরকাল রোপি কাজ শুরু করতেন প্রার্থনা দিয়ে, তারপর হাত ধুয়ে প্রসব বেদনা ওঠা মায়ের যোনি-মুখ কতটা সম্প্রসারিত হয়েছে তা দেখে নিতেন।
“মা (হবু-মায়ের মা) কিচ্ছুটি করে না কিন্তু মেয়ের পাশে থেকে নিজেও কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। মেয়ের কান্নার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মা আবেদন করতে থাকে, ‘ও মা, ওর জ্বালা তাড়াতাড়ি দূর করে দাও না মা’। যেন এসব আমার হাতে!” রোপির গলায় বিস্ময়ের সুর।
কখনও কখনও প্রসব বেদনা অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে। এইরকম ক্ষেত্রে রোপি বাড়ি ফিরে এসে চটপট দুই গ্রাস খাবার নিজের বা স্বামী কিংবা ছেলের মুখে তুলে দিতেন। “সেই সব সময়ে মা আরও চিৎকার করে আমাকে বাচ্চা না হওয়া অবধি থেকে যেতে বলত। কিন্তু প্রসব ব্যথা তো সারা দিনরাত ধরেও চলতে পারে। সেসব পরিস্থিতিতে সবাই ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু আমি ভয় পেতাম না মোটেই!”
অনেক সময় তিনি একটু তেল চেয়ে (যে কোনও তেল, যা রান্নাঘরেই পাওয়া যায়) নিয়ে সন্তান সম্ভবা মায়ের পেটে মালিশ করে দিতেন। রোপি বলছিলেন যে তিনি হবু-মায়ের পেটে হাত রেখে বুঝতে পারতেন গর্ভের শিশু উল্টে (ব্রীচ পোজিশন) আছে কিনা বা চেপে মালিশ করে শিশুটিকে ঠিক দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে কিনা। তিনি এমন শিশুও প্রসব করিয়েছেন যার পা আগে বেরিয়েছে, কিন্তু তিনি বললেন সেইসব জটিল ক্ষেত্রেও তাঁকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
কিছু চিরাচরিত বিশ্বাস অবশ্য ঝেড়ে ফেলাটা বেশ কঠিন। নয় মাস সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর কারও প্রসব বেদনা না উঠলে চরকু ভূমকলের আশীর্বাদী জল কয়েক ঢোক খাওয়ার পরামর্শ দেন
প্রসবের জায়গাটাও সাধারণত ধাত্রীরাই পরিষ্কার করে দেন বলে রোপি জানালেন। “আগে আমরা তখন-তখনই বাচ্চাটিকে চানও করিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আর তা করি না,” তিনি বললেন। বাচ্চাকে একেবারে চান করিয়ে মায়ের হাতে প্রথমবার বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য তুলে দেওয়াই ছিল চিরাচরিত প্রথা।
চরকুও একই কথা বললেন, “আগে আমরা বাচ্চা জন্মানোর পরই উষ্ণ জলে স্নান করিয়ে দিতাম। মায়ের দুধ কখনও কখনও দেওয়া হত দুই একদিন পর।” কোনও কোনও বাড়িতে প্রথম দিন শিশুকে কেবল গুড় জল বা মধু জলই দেওয়া হত।
সদ্য ভূমিষ্ট শিশুকে স্নান করানো এখন বন্ধ হয়েছে প্রধানত, স্থানীয় সহায়ক নার্স ধাত্রী বা এএনএমদের প্রচার, হাসপাতালে প্রসব করার পক্ষে প্রচার আর মেলঘাটে শিশু-মৃত্যুর হারের দিকে রাজ্য প্রশাসনের নজর পড়ার কারণে (বিভিন্ন সমীক্ষায় ও রিপোর্টে , ওই অঞ্চলের শিশু মৃত্যুর উচ্চ হার এবং ভয়ানক অপুষ্টির কথা ধরা পড়েছে)। এখন শিশু জন্মের পরের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের বদলে শিশুর স্বাস্থ্যকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং বোর্ত্যাখেদার সহায়ক নার্স-দাই শান্তার উপস্থিতি, তথা ইউনিসেফের সহায়তায় প্রদত্ত সরকারি প্রশিক্ষণ এখন বাড়িতে প্রসবের প্রক্রিয়াকেও অনেকটা নিরাপদ করেছে।
এখন, মা খানিক বিশ্রাম নেওয়ার মধ্যে বাচ্চাটি যখন নড়াচড়া শুরু করে দাইরা তখন শুয়ে বা বসে নিরাপদ অবস্থায় কেমন করে তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয় তা মাকে শিখিয়ে দেন। তাছাড়া চরকু জানালেন যে এখন জন্মানোর আধা ঘণ্টা পরই বাচ্চাকে মায়ের দুধ দেওয়া হয়।
কিছু চিরাচরিত বিশ্বাস অবশ্য ঝেড়ে ফেলা কঠিন। নয় মাস সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর কারও প্রসব বেদনা না উঠলে চরকু ভূমকলের (চিরাচরিত দৈব নিরাময়কারী) আশীর্বাদী জল কয়েক ঢোক খাওয়ার পরামর্শ দেন।
রোপি আবার বলেন, যে একজন গর্ভবতীর ছেলে হবে না মেয়ে তা তিনি আগাম বলে দিতে ভালোবাসেন। শিশুপুত্র হলে পেট খুব বেশি ফুলে থাকে বলে তাঁর দাবি। “মেয়ে হলে পেট পাশের দিকে ছড়িয়ে বেড়ে থাকে।” এই আগাম বার্তাকে আবার তিনিই হেসে হালকা করে দিয়ে জানালেন যে এটা খানিক আন্দাজে বলা আর জন্মানোর আগে বাচ্চার লিঙ্গ জেনে যাওয়া ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধী।
বোর্ত্যাখেদা গ্রামের মানুষ জানালেন যে চিরাচরিত দাইরা এখন সামাজিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সহায়কের ভূমিকা পালন করেন, যার মধ্যে আছে গর্ভবতীর শারীরিক পরীক্ষা, তার কাছে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়ামের বড়ি পৌঁছে দেওয়া, বাচ্চা হওয়ার পরিকল্পনায় সাহায্য করা এবং সময় মতো প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি সুনিশ্চিত করা।
রোপির পরে গ্রামে যে আর কোনও দাই থাকবেন না তা নিয়ে জৈতাদেহি গ্রামের মানুষ চিন্তিত নন কারণ তাঁরা পরটওয়াড়া শহরের বেসরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি থাকেন। অন্যদিকে রোপি মনে করেন যে সরকারি মাতৃসদনগুলিকে তাঁর নিজের কিছু শিখিয়ে যাওয়ার আছে। তাঁর কথায়, “রোগাপাতলা মহিলাদের অনেকেই ক্রমাগত বমি করতে থাকে। মাংস খেতে চায় না, কোনও বিশেষ খাবার দেখলে মুখ বেঁকায়। পেটে বাচ্চা থাকলে সব খেতে হয়। কোনও কিছুতে বারণ নেই। হবু-মাকে এ বিষয়েও ডাক্তারের পরামর্শ দেওয়া উচিত।”
তাঁদের কোরকু সমাজে পরিবারে সন্তান জন্মানোর পাঁচদিন পরে যে অনুষ্ঠান হয় তাতে দাইমাকে নেমন্তন্ন করা হয়। বাচ্চা যে প্রাথমিক সঙ্কটের সময় কাটিয়ে উঠেছে তার স্বীকৃতি স্বরূপ কখনও কখনও তাঁদের কিছু প্রাপ্তি ঘটে। “কেউ কোনও দুর্ঘটনায় মারা যায়, আবার কারও বা মৃত্যু ঘটে রোগে বা জন্মের সময়েই,” দার্শনিক সুলভ ভঙ্গিতে বললেন রোপি। “একদিন সবাই মরবেই। কিন্তু প্রসবের সময়ে বেঁচে যাওয়াটা মা আর শিশু দুজনের জন্যই একপ্রকার যুদ্ধ জয়।”
শিশু বেঁচে গেলে যে কৃতজ্ঞতা তিনি লাভ করেছেন তা-ই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনা বলে রোপি মনে করেন। তিনি বললেন যে এখন আর কাজ করতে না পারায় এই একটা ব্যাপারেই তিনি বড্ড অভাব বোধ করেন। এখন তাঁর সাহায্য চাইতে এলে তিনি সবাইকে ফিরিয়ে দেন, বলেন, “যাও বাবা, আমি আর এখন কাজ করতে পারি না।”
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে
অনুবাদ: চিলকা