সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ১৬ জন শ্রমিক মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে ঘু মন্ত অবস্থায় ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে মারা গেছেন। এই ঘটনায় আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এ টা ই যে মৃত শ্রমিকেরা ট্রেন লাইনে কেন ঘুমোচ্ছিলেন। অথচ আমাদের প্রথম প্রশ্ন এটা হল না যে কারা তাঁদের হাঁটতে বাধ্য করল। এই প্রতিক্রিয়া আমাদের সম্বন্ধে কী বলছে?
কটা ইংরেজি কাগজ ট্রেনে চাপা পড়া এই শ্রমিকদের নাম ছাপার কথা ভেবেছে? এঁদের মুখ নেই, নাম নেই। গরিবদের প্রতি এটাই আমাদের মনোভাব। যদি এটা প্লেন ভেঙে পড়ার ঘটনা হত, তাহলে হেল্পলাইনে ফোন করে তথ্য পাওয়া যেত। যদি ৩০০ জনও মারা যেত, তাহলেও খবরের কাগজে তাদের নাম বেরোত। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ১৬ জন গরিব, তাদের মধ্যে আট জন আবার গোণ্ড আদিবাসী, তাঁদের কথা কে আর ভাববে? তাঁরা রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন যাতে বাড়ি ফিরতে পারেন – এমন একটা স্টেশনে যাতে পৌঁছতে পারেন যেখান থেকে বাড়ি ফেরার ট্রেন পাবেন। তাঁরা সম্ভবত শ্রান্ত-বিধ্বস্ত হয়েই রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ভেবেছিলেন এই লাইনে কোনও ট্রেন চলছে না।
ভারতবর্ষে বিপুল সংখ্যায় শ্রমজীবী মানুষ, সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বিষয়ে আপনার কী মত?
একটা দেশের ১৩০ কোটি মানুষকে আমরা তাদের জীবন স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য মাত্র চারটে ঘণ্টা সময় দিলাম। আমাদের প্রখ্যাত সিভিল সার্ভেন্ট এম জি দেবশ্যাম বলেছিলেন, “একটা ক্ষুদ্র সামরিক বাহিনিকে চার ঘণ্টার নোটিসে একটা বিরাট অ্যাকশনে ঠেলে দেওয়া হল।” আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে একমত হই বা না হই, তাঁদের বেরিয়ে পড়ার যুক্তির মধ্যে কোনও গলদ ছিল না। তাঁরা ঠিকই জানেন, এবং প্রতি ঘণ্টায় আমরা তা প্রমাণও করছি যে তাঁদের সরকার, কারখানার মালিক এবং মধ্যবিত্ত কর্তারা কতটা অবিশ্বাসের পাত্র, কতটা অবিবেচক, এবং কতটা নিষ্ঠুর। এছাড়াও আমরা তা প্রমাণ করছি আইনের মাধ্যমে তাঁদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে।
আপনরা আতংকের পরিবেশ তৈরি করেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হাইওয়েতে ফেলে রেখে আপনারা গোটা দেশকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। যে সমস্ত বিয়েবাড়ি, স্কুল, কলেজ, কম্যুনিটি সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছিল সেগুলোকে সহজেই পরিযায়ী এবং গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ের স্থানে পরিণত করা যেত। বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের জন্য পাঁচতারা হোটেলকে আমরা কোয়ারান্টাইন সেন্টার বলে ঘোষণা করলাম।
আর যখন কিনা আমরা পরিযায়ীদের জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করলাম, তখন আমরা পুরো ভাড়া চেয়ে বসলাম। তারপর আমরা এসি ট্রেন আর রাজধানীর মতো ৪৫০০ টাকা ভাড়া ধার্য করলাম। আরও ভয়ানক হল, তারপরে বলা হয় যে অনলাইন টিকিট কাটতে হবে, যেন তাঁদের সবার স্মার্টফোন আছে। ফলে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মাত্র এই টিকিট কাটতে পারলেন।
কর্ণাটকে আবার ট্রেন বাতিল করা হল কারণ মুখ্যমন্ত্রী নির্মাণক্ষেত্রের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিল্ডাররা জানালেন তাঁদের কেনা গোলামেরা পালিয়ে যাচ্ছে। আদতে আপনারা এখন যা দেখছেন তা হল আসন্ন দাস বিদ্রোহকে মূলেই বিনাশ করার প্রক্রিয়া।
চিরকালই আমরা গরিবদের জন্য একটা মান ধার্য করেছি, আর বাকিদের জন্য আরেক। যদি অপরিহার্য পরিষেবার তালিকা বানান তাহলে দেখবেন যে ডাক্তারদের বাদ দিলে গরিব মানুষই অপরিহার্য। অনেক নার্স অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নন। তাছাড়াও রয়েছেন সাফাইকর্মী, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, বিদ্যুৎ কর্মী, শক্তি উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজ করেন এমন শ্রমিক এবং কারখানায় কর্মরত শ্রমিক। হঠাৎ করে আপনি দেখছেন অভিজাত শ্রেণি কতটা অপ্রয়োজনীয় এই দেশে।
বহু দশক ধরে পরিযান (মাইগ্রেশন) হয়ে চলেছে। এবং লকডাউনের আগেও এঁদের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। আমরা সচরাচর পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করে থাকি, সেটাকে আপনি কেমনভাবে দেখেন?
পরিযায়ী শ্রমিকের মধ্যে রকমফের আছে। মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে শ্রেণি বিভাজনটা মাথায় রাখতে হবে। আমি জন্মেছিলাম চেন্নাইতে। উচ্চশিক্ষা দিল্লিতে, সেখানে আমি চারবছর ছিলাম। তারপর আমি মুম্বই আসি এবং ৩৬ বছর আমি হল এখানেই থেকেছি। আমি যতবার স্থান পরিবর্তন করেছি, তাতে আমার লাভই হয়েছে – কারণ আমার শ্রেণি এবং জাত। আমার সামাজিক পুঁজি এবং নেটওয়ার্ক দুটোই আছে।
অনেকে বহু দিনের জন্য অন্য জায়গায় থাকেন – যাঁরা ‘ক’ স্থান থেকে ‘খ’ স্থানে এসে ‘খ’ স্থানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যান।
আবার অনেকে বছরের বিশেষ সময়ে পরিযান করেন। যেমন মহারাষ্ট্রে আখ চাষিরা পাঁচমাসের জন্য কর্ণাটকে যান এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্টোটাও ঘটে – ওখানে কাজ করে আবার নিজেদের গ্রামে ফিরে আসেন। অনেকে টুরিস্ট মরসুমে কালাহান্ডি থেকে রায়পুর গিয়ে রিকশা চালায়। আবার এমন অনেকে আছেন যাঁরা ওড়িশার কোরাপুট থেকে ভিজিয়ানাগরমের ইটভাটায় কয়েক মাসের জন্য কাজ করতে চলে যান।
অন্য আরও বহু দল আছে, কিন্তু যাঁদের নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবনাচিন্তা করা উচিত তাঁরা হলেন সেই পরিযায়ী শ্রমিক, আমরা কেউ কেউ যাঁদের বলি ‘ফুটলুজ’ বা চলমান শ্রমিক। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে তাঁদের অন্তিম গন্তব্য সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তাঁরা একজন ঠিকাদারের সঙ্গে এসে মুম্বইয়ের কোনও নির্মাণক্ষেত্রে ৯০ দিন কাজ করেন। কাজের সময় শেষ হলে সেখানে তাঁদের আর কিছু থাকে না। তারপর সেই ঠিকাদার মহারাষ্ট্রের অন্য কোনও অঞ্চলের আরেকজন ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করিয়ে দেন এবং সেখানে যাওয়ার বাসে তুলে দেন। এবং এই বন্দোবস্তটা চলতেই থাকে। এটা পুরোপুরি অফুরান নিরাপত্তাহীনতায় ভরা এক ভয়াবহ জীবন। এবং এঁরা সংখ্যায় লক্ষ-লক্ষ।
পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা ঠিক কবে থেকে খারাপ হতে শুরু করল?
এক শতকের বেশি সময় ধরেই মাইগ্রেশন হয়ে আসছে। কিন্তু গত ২৮ বছরে এই হার প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। ২০১১ সালের আদমসুমারিতে দেখা যাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতে স্বাধীনতার পরে সবথেকে বেশি মাইগ্রেশন হয়েছে।
২০১১ সালের এই আদমসুমারি থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে ১৯২১ সালের পর এই প্রথম ভারতের শহরে জনসংখ্যা গ্রামীণ ভারতের জনসংখ্যার থেকে অনেক বেশি ছিল। শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক কম হয়, কিন্তু তবুও দেখা যাচ্ছে যে শহরেই জনসংখ্যা বেড়েছে।
২০১১ সালের আদমসুমারির এই তথ্যগুলি নিয়ে কোনও প্যানেলে আলোচনা, কোনও বিশেষজ্ঞকে বসিয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার খুঁজে পাবেন না। কতজন বোদ্ধা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে, গ্রাম থেকে শহর এবং গ্রাম থেকে গ্রামে ঘটে চলা মাইগ্রেশনের প্রবলতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছে?
মাইগ্রেশন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে গ্রামের দুরবস্থার কথাও বলতে হয়, মাইগ্রেশনের মূলে তো সেটাই রয়েছে, তাই না?
আমরা কৃষির সর্বনাশ করলাম, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেল। গ্রামের দিকে অন্য সমস্ত পেশাও ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষি বাদ দিলে গ্রামে তাঁত এবং হস্তশিল্পের কাজে সর্বাধিক মানুষ নিযুক্ত হন। মাঝি, জেলে, খেলনা নির্মাতা, খেজুর রস সংগ্রহকারী, তাঁতি, রাঙাইয়ের কাজে নিযুন্ত মানুষজনের সবাই একে একে ধ্বসে পড়ছেন। কী-ই বা উপায় ছিল তাঁদের?
আমরা ভাবছি পরিযায়ী শ্রমিকেরা আর কখনও শহরে ফিরবেন কি না। কেউ ভাবছে কী তাঁরা আদৌ এখানে এসেছিলেন কেন?
আমি সত্যিই বিশ্বাস করি যে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ শহরে ফিরে আসবেন। অনেক সময় লাগবে হয়তো। কিন্তু বহু দিন আগেই আমরা গ্রামে তাঁদের যা সুযোগ থাকতে পারত তাকে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং নিজেদের জন্য সস্তা শ্রমের জোগানের ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বিভিন্ন
রাজ্যে যে শ্রম আইন সংশোধন করা হচ্ছে
সেই বিষয়ে আপনার কী মত?
প্রথমত এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান এবং প্রচলিত আইনের অবমাননা। দ্বিতীয়ত, এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক শ্রমের ঘোষণা। তৃতীয়ত, এটা বিশ্বব্যাপী শ্রম-সময়ের স্বীকৃত মানকে ১০০ বছর পিছিয়ে দেবে। পৃথিবীর যেখানে শ্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেখানেই আট ঘণ্টার শ্রম সময়কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
গুজারাতের ঘোষণা দেখুন। এখানে বলা হচ্ছে শ্রমিকদের কোনও ওভারটাইম দেওয়া হবে না। রাজস্থানের সরকার ওভারটাইম দেবে, কিন্তু তার সীমা হল সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা। শ্রমিক কাজ করবে টানা ৬ দিন, দিনে ১২ ঘণ্টা করে।
এই সবকিছুই করা হয়েছে কারখানা আইনের অব্যাহতি এবং ব্যতিক্রমকে দেখিয়ে। তাতে বলা হয়েছে যে একজন শ্রমিককে ওভারটাইম-সহ সর্বাধিক ৬০ ঘণ্টা কাজ করতে বলা যেতে পারে। দিনে ১২ ঘণ্টা হলে সেটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মোট ৭২ ঘন্টায়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই বাড়তি ঘণ্টাগুলোয় কাজ করতে চান কি না, তা নিয়ে শ্রমিকদের কোনও মতামত দেওয়ার পরিসর থাকবে না। এরকম একটা ধারণা আছে যে কাজের সময় বেড়ে গেল উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই নানান গবেষণা প্রমাণ করছে যে এই ধারণা সত্যি নয়। গত শতাব্দীতে বহু কারখানা আট ঘণ্টা শ্রম সময় ধার্য করেছিল কারণ তাদের সমীক্ষা থেকে বোঝা যায় যে বাড়তি ঘণ্টাগুলোয় উৎপাদন ক্লান্তি এবং অবসাদের কারণে কমে যায়।
এইসব কথা বাদ দিলেও, এটা আসলে মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ - শ্রমকে দাসত্বে পরিণত করার ফিকির। বিভিন্ন রাজ্য বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির হয়ে চুক্তিবদ্ধ শ্রমের দালালি করছে। জেনে রাখুন, জনগণের দুর্বলতম অংশ, অর্থাৎ দলিত, আদিবাসী, এবং মহিলাদের এটা সবথেকে বেশি আঘাত করবে।
ভারতবর্ষের তিরানব্বই শতাংশ শ্রমিক নিজেদের অধিকারকে কাজে লাগাতে পারেন না কারণ তাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করছেন। এমতাবস্থায় আপনার দাবি হল, “বাকি ৭ শতাংশের অধিকারও ধ্বংস করে দেওয়া হোক।” রাজ্যগুলি যুক্তি দেখাচ্ছে যে শ্রম আইন সংশোধিত হলে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ সেখানেই আসে যেখানে পরিকাঠামো ভালো, অবস্থা ভালো এবং সাধারণভাবে সমাজ মোটামুটি স্থিতিশীল। যদি উত্তরপ্রদেশ এগুলির মধ্যে একটাও হত, তাহলে দেশের পরিযায়ী শ্রমিক সৃষ্টির তালিকায় ওই রাজ্য সবার ওপরে থাকত না।
এই পদক্ষেপের পরিণতি কী হতে পারে?
উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন বাতিল করেছে। সাংবিধানিক এবং আইনি জটিলতার জন্য তিন-চারটি আইন বাতিল করতে পারেনি। আপনাদের দাবি যে অবস্থা যতই শোচনীয় হোক না কেন, শ্রমিকদের কাজ করতেই হবে। আপনি মানুষকে মানুষের মর্যাদাটুকু দিচ্ছেন না এবং বলছেন যে খোলা হাওয়া, শৌচালয় এবং বিরতিতে কোনও অধিকার তাঁদের নেই। এটা মুখ্যমন্ত্রীদের বানানো অধ্যাদেশ এবং এর মধ্যে কোনও আইনি প্রক্রিয়াই নেই।
এখান থেকে এগোতে চাইলে আমাদের কী করতে হবে?
এই দেশে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতেই হবে। এই অতিমারি তাঁদের যে এতখানি আঘাত করছে, তার কারণ আমাদের সমাজে বিদ্যমান ভয়াবহ অসাম্য। যে আন্তর্জাতিক শ্রম কনভেনশানগুলির আমরা অংশীদার, সেগুলিকেই আমরা অমান্য করছি।
বি আর আম্বেডকর এটা স্পষ্ট দেখেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে শুধু সরকার নিয়ে কথা বললেই হবে না। ব্যবসার পদতলে আসীন শ্রমিকদের কথাও আমাদের বলতে হবে। তিনি যে আইন প্রবর্তনে সাহায্য করেছিলেন, যে আইনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, রাজ্যগুলি আজ সেই আইন তুলে দিচ্ছে।
রাজ্য সরকারগুলিতে শ্রম বিভাগ থাকে। তার কী ভূমিকা হওয়া উচিত?
রাজ্যস্তরের শ্রম বিভাগের কাজ হওয়া উচিত শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্রের শ্রম মন্ত্রী শ্রমিকদের বলছেন কর্পোরেটগুলোর কথা শুনতে। কিছু পাল্টাতে হলে আসলে সামাজিক চুক্তিটাই পাল্টাতে হবে। যদি পৃথিবীর সবথেকে বৈষম্যমূলক সমাজকে যদি চিহ্নিত না করতে পারেন, তাহলে এই বিষয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকবে – খুব দ্রুত।
যে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছেন তাঁদের বেশিরভাগই তরুণ এবং তাঁরা রেগে আছেন। আমরা কি আদতে একটা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি?
আগ্নেয়গিরিটা ফেটে পড়ছে। আমরা সেটা না দেখার চেষ্টা করছি। দেখুন না, সরকার, মিডিয়া, কারখানার মালিক এবং সমাজ হিসেবে আমাদের ভণ্ডামি।
মার্চের ২৬ তারিখ অবধি আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে জানতামই না। হঠাৎ দেখলাম লাখ লাখ শ্রমিক রাস্তায়। আর আমাদের গায়ে লাগছে কারণ আমরা পরিষেবাগুলো হারিয়েছি। মার্চের ২৬ তারিখ অবধি আমাদের কোনও মাথাব্যথাই ছিল না। তাঁদের যে সমানাধিকার আছে তা আমরা ভাবিইনি। একটা পুরনো প্রবাদ আছে – গরিব লেখাপড়া শিখলে বড়োলোকের পাল্কিবাহক খোয়া যায়। আমরাও হঠাৎই যেন আমাদের পাল্কিবাহকদের হারিয়ে ফেলেছি।
মহিলা এবং শিশুদের ওপর মাইগ্রেশন বিশেষ করে যে প্রভাব ফেলে, তার বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে পরিযানের প্রভাব ভয়াবহ। অপুষ্টির ক্ষেত্রে মহিলা এবং বাচ্চা মেয়েরাই সবথেকে বরো শিকার। স্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলে তারা অনেক, অনেক বেশি দুর্বল। অল্পবয়সী মেয়েরা যে কতরকম কষ্ট স্বীকার করে, সেসবের কথা বলা তো দূরের কথা, ভাবাই হয় না। গোটা দেশে লাখ লাখ মেয়ে স্কুল থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পায় – হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কোনও বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই মেয়েরা এখন অস্বাস্থ্যকর বিকল্পতেই ফিরে যাচ্ছে।
আর পরিযায়ী শ্রমিকদের হেঁটে বাড়ি ফেরার কষ্ট?
পরিযায়ী শ্রমিকেরা অনেক সময়ই দীর্ঘ পথ হাঁটেন। যেমন, গুজারাতের কারখানা বা মধ্যবিত্ত মালিকের থেকে হেঁটে হেঁটে দক্ষিণ রাজস্থানে পৌঁছে যান তাঁরা। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে।
তাঁরা চল্লিশ কিলোমিটার হাঁটেন, কোনও ধাবা বা চায়ের দোকানে দাঁড়ান, সেখানে খানিক কাজকর্ম করে, বিনিময়ে খেতে পান। সকালবেলা আবার বেরিয়ে পড়েন। পরের বড়ো বাস স্টেশনে আবার একই কাজ করেন। এইভাবে বাড়ি ফেরার পথে রোজগার করে চলেন। এই জায়গাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা খিদে, তেষ্টা, পেট খারাপ এবং অন্যান্য অসুখের কবলে পড়বেন।
তাঁদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ভবিষ্যতে কী করা উচিত?
উন্নয়নের যে পথে আমরা আছি সেই পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে তার সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলতে হবে এবং অসাম্যের ওপর তীব্র আঘাত হানতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্ভোগ সমাজের অসম পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত।
সংবিধানে যে “সবার জন্য ন্যায়: সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক”-এর কথা আছে, সেটার গুরুত্ব না বুঝতে পারলে এই কাজ সম্ভব নয়। এবং সামাজিক আর অর্থনৈতিক যে রাজনৈতিকের আগে বসেছে, তা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। আমার মনে হয় যাঁরা এটা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে গুরুত্বের একটা বোধ ছিল। আপনার সংবিধানই আপনাকে রাস্তা দেখাবে।
ভারতের উচ্চবিত্ত মানুষ এবং সরকার অবশ্য সত্যিই মনে করে যে আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাব, এবং তাদের এই বিশ্বাস আমাদের চরম নিপীড়ন, দমন, এবং হিংসার দিকে নিয়ে যাবে।
কভারের ছবি : সত্যপ্রকাশ পাণ্ডে
এই সাক্ষাৎকারটি ২০২০ সালের ১৩ই মে ফার্স্টপোস্টে প্রকাশিত হয়।
অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য