টানা ১০টা দিন কান্নাকাটি করার পর রেখা বুঝতে পারল যে বিয়ে করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই। বছর পনেরোর এক কিশোরী যতটা প্রতিবাদ করতে পারে সেটা সে প্রাণপণ করেছিল, তবে তার মা-বাবা বিশেষ পাত্তা দেননি সেসবে। তার মা ভাগ্যশ্রী বলছিলেন, "ও কাঁদতে কাঁদতে বলছিল বটে যে আরও পড়াশোনা করতে চায়।"
ভাগ্যশ্রী এবং তাঁর স্বামী অমর, দুজনেরই বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, থাকেন মহারাষ্ট্রের বীড জেলার এক হতদরিদ্র গ্রামে। প্রতিবছর নভেম্বর নাগাদ তাঁরা হয় পশ্চিম মহারাষ্ট্র কিংবা কর্ণাটকে আখ কাটাইয়ের কাজে যান। টানা ছয়মাস হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুজনের হাতে আসে মোট ৮০,০০০ টাকা। দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মাতঙ্গ জাতির মানুষ তাঁরা। নিজেদের কোনও জমিজমা নেই, তাই দূর দূরান্তে খেতমজুরির কাজ নিতে বাধ্য হন।
প্রতি বছর আখ কাটতে যাওয়ার আগে তাঁরা রেখা এবং তার দুই ভাইবোনকে (বয়স ১২ এবং ৮) তাদের ঠাম্মার দ্বায়িত্বে রেখে যেতেন (গতবছর মে মাসে মারা গেছেন তিনি)। তিন ভাইবোন গ্রামের ঠিক বাইরেই একটা সরকারি ইস্কুলে পড়ত, তবে অতিমারি এসে বাধ সাধলো তাতে। ২০২০ সালের মার্চে যখন লকডাউন শুরু হয়, রেখা তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। আজ প্রায় ৫০০ দিন হতে চলল, বীড জুড়ে সমস্ত ইস্কুলের দরজায় তালা ঝুলছে।
"ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম যে ইস্কুল টিস্কুল খুলবে না আপাতত," বলছিলেন ভাগ্যশ্রী, "ক্লাস যখন চলত তখন পড়ুয়ার দল, স্যার, দিদিমণি, সবাই থাকত চারিপাশে। গাঁ গমগম করতো আমাদের। ইস্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে রেখাকে একলা ফেলে যেতে ভয় করে আমাদের।"
তাই গতবছর জুন মাসে তাঁরা আদিত্য বলে একটি ২২ বছরের ছেলের সঙ্গে রেখার বিয়ে দিয়ে দেন। আদিত্যর মা-বাবা ৩০ কিমি দূরে একটা গ্রামে থাকেন, ভাগ্যশ্রী ও অমরের মতো তাঁরাও পরিযায়ী শ্রমিক, ফি বছর বাইরে কাজ করতে যান তাঁরা। নভেম্বর ২০২০, আখ কাটার মরসুম শুরু হওয়ার মুখে রেখা আর আদিত্যও পাততাড়ি গুটিয়ে বেরিয়ে পড়ল পশ্চিম মহারাষ্ট্রের দিকে, পিছনে ইস্কুলের খাতায় পড়ে রইল কেবল মেয়েটির নাম।
অতিমারির কারণে রেখার মতো কিংবা আরও কমবয়সী কিশোরীরা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। ইউনিসেফের তরফ থেকে ২০২১ সালের মার্চে 'কোভিড-১৯: বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে আসা বিপদ ' শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয়েছে যে এই দশকের মধ্যে অতিরিক্ত ১ কোটি বালিকা বাল্যবিবাহের শিকার হতে পারে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে ইস্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাড়তে থাকা দারিদ্র, কোভিডের ফলে অনাথ হয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য আরও কিছু কারণের ফলে "লাখ লাখ বাচ্চা মেয়েদের অবস্থা দিনকে দিন আরোই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।"
ইউনিসেফের রিপোর্টটি বলছে যে গত দশ বছরে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ১৫ শতাংশ যেমন কমেছিল, তেমনই বিশ্বজুড়ে প্রায় ২.৫ কোটি মেয়েকে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া থেকে বাঁচানো গিয়েছিল। জঘন্য এই প্রথার বিরুদ্ধে তিল তিল করে গড়ে ওঠা লড়াই আজ অতিমারির কারণে সংকটের মুখে, অন্যান্য অনেক জায়গার মতো মহারাষ্ট্রেও এই একই চিত্র ফুটে উঠছে।
এপ্রিল ২০২০ থেকে জুন ২০২১ - এই সময়কালের মধ্যে ৭৮০টি বাল্যবিবাহ আটকানো হয়েছে, এমনটাই নথিভুক্ত রয়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের নারী ও শিশু উন্নয়ন দপ্তরের খাতায়। এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, টাংড়ে ও কাম্বলে বুঝিয়ে বললেন
মহারাষ্ট্রে সংঘটিত বাল্যবিবাহের সংখ্যায় ৪ শতাংশ হ্রাস দেখা গিয়েছিল ২০১৫ আর ২০২০ সালের মাঝে। ২০১৫-১৬ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ( এনএফএইচএস-৪ ) তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে ২৬ শতাংশেরই ১৮ বছর (মেয়েদের ক্ষেত্রে বিবাহের আইনসম্মত ন্যূনতম বয়স) হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যায়। ২০১৯-২০ সালের সমীক্ষায় ( এনএফএইচএস-৫ ) দেখা যাচ্ছে যে এই পরিসংখ্যানটি হ্রাস পেয়ে ২২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এটাও দেখা গিয়েছে যে ২৫-২৯ বছর বয়সী পুরুষের মধ্যে মোটে ১০.৫ শতাংশের বিয়ে হয়ে যায় ২১ বছরের আগে (ছেলেদের ক্ষেত্রে বিবাহের আইনসম্মত ন্যূনতম বয়স)।
অতিমারির কারণে বাল্য ও কৈশোরবিবাহের সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই, কোথাও কোনরকমের পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। বীড-নিবাসী সমাজকর্মী তত্ত্বশীল কাম্বলে (৩৪) জানালেন যে রাজ্য সরকারের একমাত্র মাথাব্যথা কেমনভাবে বাচ্চা ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায়। অথচ এটা কেবলমাত্র সেই বাচ্চাদের জন্যই খাটে যাদের মা-বাবারা অত্যাধুনিক স্মার্টফোন এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগের পিছনে খরচা করার মতো ক্ষমতা রাখেন।
২০১৭-১৮ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা বলছে যে গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে মাত্র ১৮.৫ শতাংশ পরিবারের কাছে। যদিও মহারাষ্ট্রের ১৭ শতাংশ গ্রামবাসী (যাদের বয়স ৫ বছর কিংবা তার বেশি) "ইন্টারনেট ব্যবহার করতে সক্ষম," তবে এই পরিসংখ্যানটি মহিলাদের ক্ষেত্রে মোটে ১১ শতাংশ।
প্রান্তিক সম্প্রদায়ের বাচ্চারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংযোগ থেকে বঞ্চিত বলে দেখা যায়, এমন সব পরিবার যেখানে দারিদ্র এবং আর্থসামাজিক অসুরক্ষা ইতিমধ্যেই মেয়েদের বাধ্য করছে বাল্যবিবাহের শিকার হতে। বীডে গেলে খুব সহজেই বোঝা যাবে যে কেমনভাবে ইস্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অবস্থাটা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
এনএফএইচএস-৫ অনুযায়ী ২০১৯-২০তে বীডের ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলারা বলেছেন যে তাঁদের প্রায় ৪৪ শতাংশই বাল্যবিবাহের শিকার। এর পিছনে লুকিয়ে আছে তীব্র দারিদ্র। খরা এবং কৃষিসংকটে জর্রজিত এই জেলাটির বেশিরভাগ মানুষই পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের আয় বলতে আখ কাটার মরসুমি কাজের থেকে প্রাপ্ত মজুরি।
আখ কাটার কাজে জোড়া শ্রমিকের প্রয়োজন, একজন গোছ ধরে কাটবে আর অন্যজন বান্ডিল বেঁধে ট্রাক্টরে তুলবে। তাই ঠিকাদারেরা সাধারণত বিবাহিত দম্পতিদেরই কাজে নেন, যাতে বনিবনাতে কোনও অসুবিধা না হয়। টাকাপয়সা মেটানোটাও সহজ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে, কারণ অন্যান্য লোকের মতো দম্পতিরা তো আর মজুরির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা করবেন না। ফলত, বিয়ের পর মহিলারা তাঁদের বরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন দুপয়সা রোজগারের আশায়। মা-বাবারা ভাবেন যে এতে তাঁদের মেয়ের কোনও বিপদআপদও হবে না, আবার আর্থিক বোঝাও খানিক লাঘব হবে।
তত্ত্বশীল কাম্বলে বলছিলেন যে অতিমারির কারণে আর্থিক অনটন বেড়ে যাওয়ায় মা-বাবাদের হাতে দুটো বই আর উপায় থাকছে না: "সন্তান যদি ছেলে হয় তো শিশুশ্রম, আর যদি মেয়ে হয় তো বাল্যবিবাহ।" চাইল্ড ওয়েলফার কমিটির (দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্ত বাচ্চাদের রক্ষা এবং দেখভালের দ্বায়িত্বে রয়েছে এই বিধিবদ্ধ সংস্থাটি) সদস্য হিসেবে কাম্বলে বীড জেলায় অসংখ্য বাল্যবিবাহ আটকেছেন।
মার্চ ২০২০তে কোভিড অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটির বীড তালুকের সদস্য অশোক টাংড়ের সঙ্গে মিলে ১০০টিরও বেশি বাল্যবিবাহ আটকেছেন কাম্বলে। ৫৩ বছরের টাংড়ে জানালেন: "এ তো মোটে যেগুলোর হদিস পেয়েছিলাম আমরা, আড়ালে আবডালে না জানি আরও কত মেয়ে আছে যাদের জীবনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এভাবে।"
বাল্যবিবাহের একটি বড়ো কারণ হল অতিমারির ফলে মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা কমে যাওয়া। "ছেলের মা-বাবারা আগের মতো বরপণ চাইছে না আর, বিয়েশাদিতে আগে যতটা খরচা হত এখন তার ধারেকাছেও হচ্ছে না," বলছিলেন টাংড়ে। "খুব বেশি লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা বারণ তো, তাই ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক আত্মীয়কে নিয়েই কাজ মিটিয়ে ফেলছে সবাই।"
অন্যদিকে কোভিডের কারণে জেঁকে বসেছে মৃত্যুভয়, মা-বাবারা এটা ভেবেই অস্থির যে তাঁরা মারা গেলে তাঁদের মেয়ের কী হবে। "এতকিছু মিলিয়েই হুহু করে বেড়ে চলেছে বাল্যবিবাহের ঘটনা। এমনকি ১২ বছরের বাচ্চা মেয়েদেরও বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে মা-বাবারা," জানালেন টাংড়ে।
এপ্রিল ২০২০ থেকে জুন ২০২১ – এই সময়কালের মধ্যে ৭৮০টি বাল্যবিবাহ আটকানো হয়েছে, এমনটাই নথিভুক্ত রয়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের নারী ও শিশু উন্নয়ন দপ্তরের খাতায়। এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত রক্ষণশীল, টাংড়ে ও কাম্বলে বুঝিয়ে বললেন। উপরোক্ত সময়ের মধ্যে সরকারি খাতায় বীড জেলায় মোটে ৪০টি বাল্যবিবাহ আটকানোর কথা উল্লেখ করা হলেও তাঁরা এর চেয়ে অনেক বেশি বিয়ে আটকেছেন।
তবে উক্ত পরিসংখ্যানটি যতই রক্ষণশীল হোক না কেন, অতিমারির কারণে বাল্য ও কৈশোরবিবাহ যে বিপজ্জনক হারে বেড়ে চলেছে, সেটা অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই। সরকারি তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৯ অবধি মহারাষ্ট্র জুড়ে ১৮৭টি বাল্যবিবাহ আটকানো হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে যে কোভিড-১৯ অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি মাসে বাল্যবিবাহ আটকানোর সংখ্যাটি।
এমন অনেকেই আছেন যাঁরা সমাজের নাড়িনক্ষত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহল, কর্মক্ষেত্রের সুবাদে সারাক্ষণ চোখ খোলা থাকে যাঁদের। এ হেন বিয়ে আটকাতে তাঁদের উপরেই ভরসা করেন কাম্বলে এবং টাংড়ে। "আশাকর্মী এবং গ্রামসেবকেরা আমাদের খবর পৌঁছে দেন সময়মতো, তবে একই গ্রামে থাকেন তো, তাই বড্ড ভয়ে ভয়ে কাজ করেন তাঁরা," বলছিলেন কাম্বলে, "মেয়ের পরিবার যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় তাহলেই চিত্তির, যে খবর দিয়েছে তার টিকে থাকা দায় হয়ে দাঁড়ায়।"
অনেক সময় গ্রামের অভ্যন্তরীণ রেষারেষির ফলেই তাঁরা সময়মতো খবর পেয়ে যান, জানালেন টাংড়ে: "ধরুন দুটো গোষ্ঠীর ভিতর ভয়ানক রেষারেষি আছে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই দলের খবর অন্য গোষ্ঠীর কেউ একজন ফাঁস করে দিচ্ছে। কিংবা ধরুন একটি বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর ওই গ্রামেরই কোনও একটা ছেলে তার প্রেমে পাগল, সে ক্ষেত্রে এই ছেলেটি এসে আমাদের খবর দিয়ে যায়।"
তবে সময়মতো খবর পাওয়া মানেই কিন্তু বিয়ে আটকানো নয়। মেয়ের পরিবার যেনতেনপ্রকারেণ চেষ্টা করে বিয়েটা যাতে না আটকায়, অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবও ব্যবহার করেন তাঁরা। "আমাদের ভয় দেখিয়ে, মেরে-ধমকে থামাতে চায়, অনেকে তো ঘুষ দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টাও করেছে," বলছিলেন কাম্বলে, "তবে আমরা আগেভাগেই পুলিশকে জানিয়ে রাখি। কেউ কেউ চট করে হার মেনে নেয় ঠিকই, তবে অনেকক্ষেত্রেই দেখেছি শেষ না দেখে হাল ছাড়তে চায় না।"
২০২০ সালের অক্টোবরে কাম্বলে ও টাংড়ে খবর পান যে স্মিতা নামের ১৬ বছরের জনৈক মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হতে চলেছে, বিয়ের আর একদিন বাকি মোটে। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। বীড সদর থেকে ৫০ কিমি দূরে সেই গ্রামে যখন পৌঁছন তখনও বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। মেয়ের বাবা বিট্ঠল তো রেগে চিৎকার করতে শুরু করেন: "ও আমার মেয়ে, আমি যা খুশি তাই করতে পারি ওর সঙ্গে!" টাংড়ে জানালেন, "ব্যাপারটা যে কতটা গম্ভীর সেটা বুঝতে তার বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। আমরা তাকে সটান পুলিশের কাছে নিয়ে গিয়ে নালিশ ঠুকে দিলাম।"
মেয়েটির কাকা কিশোর বলছিলেন, স্মিতা পড়াশুনায় বড্ড ভালো ছিল। “তবে ওর মা-বাবা কেউই তো লেখাপড়া করেনি, তাই ওসবের দাম দিত না। তবে আসল ব্যাপারটা কী জানেন? এই লকডাউনের মার্কেটে বেচারারা দিনে দূবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছিল না। গাঁয়ে কাজকম্ম কিস্যুটি নেই আর। তাই মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করলে দিনে দু'থালা ভাত বাঁচবে, এটাই ভেবেছিল ওরা।" স্মিতার মা-বাবা, অর্থাৎ পূজা ও বিট্ঠল দুজনেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। ইটভাটায় মাস চারেক কাজ করলে সর্বসাকুল্যে হাজার কুড়ি টাকা জোটে তাঁদের।
বাল্যবিবাহ একবার আটকানো মানেই যে সব মুশকিল আসান হয়ে গেল তা নয়, মেয়ের পরিবার আবারও যে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না সে ব্যাপারে কাম্বলে আর টাংড়েকে সতর্ক থাকতে হয়। গণ্ডগোলটা এইখানেই। "ধরুন কোনও একটি মেয়ের বিয়ে আমরা আটকেছি, তারপর একদিন সে যদি হঠাৎই ইস্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়ে তখন সেখানকার শিক্ষকরা আমাদের তুরন্ত জানিয়ে দিতেন। আর এখন যেহেতু ইস্কুল টিস্কুল সব বন্ধ, তাই খবরাখবর জোগাড় করাটা নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।"
বিট্ঠলকে বলা হয়েছে বটে দু'মাস বাদে বাদে থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে, তবে "তার উপর আমাদের একরত্তিও ভরসা নেই", জানালেন টাংড়ে। বিট্ঠল পাছে লুকিয়ে লুকিয়ে আবার তাঁর কিশোরী মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন, এই ভয়টাই পাচ্ছেন টাংড়ে।
বিয়ে ভাঙার পর মাস তিনেক কাকা কিশোরের বাড়িতে গিয়ে থেকেছিল স্মিতা। একদা হাসিখুশি মেয়েটা একেবারে থম মেরে গিয়েছিল, জানালেন কিশোর: "একদম কথাবার্তা বলত না কারও সঙ্গে, সারাক্ষণ নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকত। নিজের টুকিটাকি কাজকম্ম, খবরের কাগজ পড়া, বাড়ির কাজে একটু আধটু হাত লাগানো, এইটুকুই। এত অল্প বয়েসে বিয়েথা করার একফোঁটাও ইচ্ছে ছিল না মেয়েটার।"
নারীস্বাস্থ্যের উপর বহু গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে বাল্যবিবাহের ফলে সৃষ্ট বিবিধ সমস্যার কথা। প্রসূতির মৃত্যুর সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এই কুপ্রথার সাতকাহন। ২০১১ সালের আদমশুমারির নিরিখে জাতীয় শিশু-অধিকার সুরক্ষা কমিশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে 'আ স্ট্যাটিস্টিকাল অ্যানালিসিস অফ চাইল্ড ম্যারেজ ইন ইন্ডিয়া' শিরোনামে। এই রিপোর্টিতে বলা হয়েছে যে গর্ভধারণকাল ও প্রসবকালে হওয়া মৃত্যুর পরিসংখ্যানে ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলাদের তুলনায় ১০-১৪ বছর বয়সী বালিকা ও কিশোরীদের সংখ্যা পাঁচগুণ বেশি। এছাড়াও গর্ভধারণের সময়ে কিংবা তার আগে কোনও মা যদি অপুষ্টির শিকার হন তবে তাঁর শিশুটিও জন্ম থেকেই অপুষ্টিতে ভুগবে।
রেখার ক্ষেত্রেও খানিক তেমনটাই হয়েছিল। স্পষ্টত অপুষ্টিতে ভোগার কারণে অল্পেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত মেয়েটি। তাই ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওকে বাপের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। "২০২১ সালের জানুয়ারি, মোটে দু-তিন মাস হয়েছে কি হয়নি মেয়েটা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে গেছে, হঠাৎই একদিন ফিরে এল আমাদের কাছে," বললেন ভাগ্যশ্রী।
রুগ্ন রেখার পক্ষে আখ কাটা কিংবা ২৫ কিলো আখের বান্ডিল মাথায় করে বওয়া – এই দুটো কাজের কোনওটাই সম্ভব ছিল না। "অত খাটাখাটনি সইছিল না মেয়েটার। ওর বরের রুজিরোজগারেও টান পড়ছিল," দুঃখ করছিলেন ভাগ্যশ্রী, "তাই তো ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিয়েটা ভেঙে ফেরত পাঠিয়ে দিল।"
ফিরে আসার পর দিনকয়েক বাড়িতেই পড়েছিল রেখা। "বিয়ের মাস কয়েক পর মেয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলে গাঁয়ের লোক ছেড়ে দেবে ভেবেছেন? হাজারটা প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে সবাই। তাই ওকে মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা।"
ওদিকে আখ কাটার মরসুম আসতে চলেছে, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন অমর ও ভাগ্যশ্রী। সেই সঙ্গে রেখার একটা কিছু 'গতি' করার জল্পনাও চলছে পুরোদমে। তবে সেবারের মতো নয় আর ব্যাপারটা, বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই আর মেয়েটার।
পরিচয় গোপন রাখতে গল্পে ব্যবহৃত কিশোরী এবং তাদের পরিবারবর্গের নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি পুলিৎজার সেন্টারের সহায়তাপ্রাপ্ত একটি সিরিজের অংশ।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)