১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৫, ‘মাঙ্গ-মহারঞ্চ্যা দুঃখবিষয়ী’ (‘মাঙ্গ ও মাহার মানুষদের দুঃখ বিষয়ক’) শিরোনামে একটি কালজয়ী প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তা সালভে। দলিত জাতির এই মহিলা মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের স্থাপিত ইস্কুলে পড়তেন। মারাঠি ভাষায় প্রকাশিত ‘জ্ঞানোদয়’ নামের পাক্ষিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এই প্রবন্ধটি। মুক্তার আগুনঝরা কলম ঝলসে উঠেছিল ধর্মরক্ষকদের বিরুদ্ধে: “যে ধর্মে মোটে একজন সুবিধাভোগী, আর বাকিরা নিপীড়িত, সেটি যেন চিরতের মুছে যায় বিশ্বচরাচর হতে, এবং এমন একটি [বৈষম্যমূলক] ধর্ম নিয়ে গর্ব করার কথা আমরা যেন কস্মিনকালেও না ভাবি।”

মাঙ্গ জাতির মুক্তা যখন নিজ সম্প্রদায়ের কথা লিখেছিলেন, তখন মোটে ১৫ বছর বয়স ছিল তাঁর। জ্বালাময়ী সেই প্রবন্ধে বলা আছে ব্রাহ্মণরা কেমনভাবে সমগ্র সমাজের উপর ছড়ি ঘোরায় এবং দলিতদের উপর অত্যাচার করে। মুক্তার মতোই আলান্দির আধ্যাত্মিক নেতাদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান করে ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতায় তাঁদের নাকানি-চোবানি খাইয়ে ছেড়েছেন কাদুবাই খারাত। তাঁর গানে ফুটে ওঠে আমজনতার বেদনা ও সংগ্রামের কথা, অর্থের গভীরে গাঁথা থাকে অমোঘ দর্শন, ঝরে পড়ে সাম্যের মূল্যবোধ ও বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

*****

काखेत पोरगं हातात झाडनं डोईवर शेणाची पाटी
कपडा न लत्ता, आरे, खरकटं भत्ता
फजिती होती माय मोठी

माया भीमानं, भीमानं माय सोन्यानं भरली ओटी
मुडक्या झोपडीले होती माय मुडकी ताटी
फाटक्या लुगड्याले होत्या माय सतरा गाठी
पोरगं झालं सायब अन सुना झाल्या सायबीनी
सांगतात ज्ञानाच्या गोष्टी

सांगू सांगू मी केले, केले माय भलते कष्ट
नव्हतं मिळत वं खरकटं आणि उष्टं
असाच घास दिला भीमानं
झकास वाटी ताटी होता

तवा सारंग चा मुळीच पत्ता नव्हता
पूर्वीच्या काळात असंच होतं
बात मायी नाय वं खोटी
माया भीमानं, मया बापानं,
माया भीमानं माय, सोन्यानं भरली ओटी

এই হাতে পোলাপান, ওই হাতে ঝাড়ুখান,
মাথায় চাপানো ছিল গোবরের ঝোড়া,
ছেঁড়া শাড়ি চাইনে, এঁটোকাঁটা মাইনে,
শরমে শরমে ছিল জিন্দেগি ভরা।

ভীম, ভীম, মোর ভীম, জীবনটা ভরে দিল কাঁচা সোনা দিয়া।
ভাঙা সে ঝুপড়ি মোর, ভাঙা সে দুয়ার,
গিঁটে গিঁটে গিটকিরি শাড়ি পরা ভার,
ছোট্ট সে খোকা মোর হল অফিসার,
অফিসে যাচ্ছে দেখ বৌমা আমার,
বিদ্যেবুদ্ধি ভারী, জীবনটা ভরে দিল কথামালা দিয়া।

মাজাভাঙা খাটুনি, ইহা মোর জবানি,
এঁটোকাঁটা সবই শেষ, পেটে মারি কিল...
এইখনে ভীমরায় দুমুঠো খাওয়ালো তাই,
শুদ্ধ রেকাবি তাঁর সোনা ঝিলমিল।

ছিল না সারঙ কবি, কে জানে কোথায় ভাবি,
কেটেছে সেদিনগুলো হাড়ভাঙা পেটকাটা মজদুরি দিয়া...
মিছে কথা কইছি নে, শোন্ সখী শুনবি নে?
ভীম ভীম, বাপ মোর, জীবনটা ভরে দিল কাঁচা সোনা দিয়া।


PHOTO • Courtesy: TISS Tuljapur
PHOTO • Courtesy: TISS Tuljapur

বছর কয়েক আগে তুলজাপুরে ডঃ আম্বেদকর স্মারক বক্তৃতা আয়োজিত হয়েছিল টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ। একতারি হাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাদুবাই খারাত

ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের হাজার হাজার গান শুনেছি আমরা। তবে হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছেছে, বা আমাদের সামগ্রিক স্মৃতির অংশ হয়ে উঠেছে — তেমন গানের সংখ্যা নেহাতই কম। কাদুবাই খারাতের এই গানটি অবশ্য এমনই কালজয়ী। অপার এ গানের জনপ্রিয়তা, সে গৃহকোণ হোক বা হৃদয় — সর্বত্র জায়গা করে নিয়েছে। আম্বেদকরকে ঘিরে যে সব গান মুখে মুখে ফেরে, তার মধ্যে এটি অন্যতম।

গানটির এমন জনপ্রিয়তার পিছনে অনেক কারণ আছে। পরিমিত শব্দে অনুভূতির প্রকাশ, সাবলীল গায়কি, সুর ও বাদ্যযন্ত্রের অনন্য সম্ভার, এবং কাদুবাই খারাতের তাক লাগানো জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। সরল সাদাসিধা এই মানুষটি কালারস্ চ্যানেলের জলসা মহারাষ্ট্রচ এবং জি টিভির সুবাদে জনসম্মুখে আসেন। তবে ওই অবধি আসতে তাঁকে যে কতখানি ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়েছিল, সে বিষয়ে খুবই কম জানি আমরা। কাদুবাইয়ের জীবনখানি তাঁর নামের মতই তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। (মারাঠি ভাষায় ‘কাদু’ শব্দের অর্থ ‘তেতো’, মারাঠওয়াড়ার মেয়েদের মধ্যে এই নামটি বহুল প্রচলিত। স্থানীয় বিশ্বাস, এই নামটির দৌলতে ‘কুনজর’ এড়ানো যায়।)

প্রয়াত তুকারাম কাম্বলে ছিলেন কাদুবাইয়ের বাবা...

ছোট্টবেলা থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়েছেন। ১৬ বছরে বিয়ে হয়, তার বছর দুয়েকের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী মারা যান। নিজের আর তিন সন্তান, দুই ছেলে ও এক মেয়ের সকল দায়দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কাদুবাই। বাবার একতারি নিয়ে প্রথাগত ভজন-কীর্তন [ভক্তিমূলক গান] গেয়ে দরজায়-দরজায় ফিরতেন। শ্রুতিশাস্ত্র অনুযায়ী বৈদিক যুগে গার্গী ও মৈত্রেয়ী [দুই বিদুষী মহিলা] ধর্মরক্ষকদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতেন। একইভাবে এই যুগে আধ্যাত্মিকতার যাঁরা জিম্মাদার, আলান্দির মন্দিরপ্রাঙ্গণে একদা তাঁদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন কাদুবাই। বছরের পর বছর নানান ভক্তিমূলক গান গেয়েও দিনে দুমুঠো ভাত জুটত না। শেষে [মহারাষ্ট্রের] জালনা জেলায় তাঁর গাঁ ছেড়ে ঔরঙ্গাবাদে যাবেন বলে মনস্থির করেন তিনি।

PHOTO • Imaad ul Hasan
PHOTO • Imaad ul Hasan

ঔরঙ্গাবাদ-বীড বাইপাস সড়কের কাছে একচিলতে গৈরান জমির উপর ছোট্ট একখান টিনের ঝুপড়ি বেঁধেছিলেন কাদুবাই। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর বক্তব্য: আজ তিনি বাবাসাহেবের প্রেম, করুণা, অনুপ্রেরণা ও শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এ দুনিয়ার মোকাবিলা করছেন

কিন্তু ঔরঙ্গাবাদে মাথা গুঁজবেন কোথায়? ঔরঙ্গাবাদ-বীড বাইপাস সড়কের কাছে একচিলতে গৈরান [সরকারি চারণভূমি] জমির উপর ছোট্ট একখান টিনের ঝুপড়ি বেঁধে জল কিংবা বিদ্যুতের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই বসত পাতেন কাদুবাই। আজও তিনি সেখানেই থাকেন। গোড়ার দিকে কাদুবাইকে তাঁর গানবাজনার দলে নিয়েছিলেন মীরা উমাপ। তবে যেটুকু পারিশ্রমিক মিলত, তা দিয়ে তিন-তিনটে ছেলেমেয়ের দেখভাল করা সম্ভব ছিল না। কাদুবাইয়ের কথায়, “তখন বর্ষাকাল, প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল সূর্যের দেখা নেই। কামকাজের জন্য বাড়ি থেকে বেরোতেই পারছিলাম না। তিনটে বাচ্চাই খিদের জ্বালায় অস্থির। দরজায়-দরজায় ভজন গেয়ে ভিক্ষে করতে লাগলাম। তখন এক মহিলা আমায় বলেছিলেন, ‘ডঃ আম্বেদকরকে নিয়ে গান করো তো দেখি।’ একখান গান গাইলাম, বাচ্চাগুলো যে পেটে কিল মেরে পড়ে আছে, সেটাও বললাম তাঁকে। সেসব শুনেই হেঁশেলে ঢুকে নিজের গৃহস্থালির রসদ এনে দিলেন আমাকে, ও দিয়ে হেসেখেলে একমাস চালানো যায়। আসলে আমার বাচ্চাগুলো যে খিদের জ্বালায় কতখানি কষ্ট পাচ্ছে, তা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন।”

“আম্বেদকরের গানই ওদের পেট ভরালো শেষমেশ। আমার গোটা জিন্দেগিটাই পাল্টে গেল। ওসব ভজন-কীর্তন ছেড়ে ডঃ আম্বেদকরের দেখানো রাস্তায় নেমে পড়লাম। ঠিক করেছিলাম, মরে গেলেও এ রাস্তা আমি ছাড়ব না, তাই ২০১৬ সালে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করলাম, আমার মাতঙ্গ জাতের ছাপটাও আর রইল না। দীক্ষিত হলাম বুদ্ধের ধম্মে!”

স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাবাকেও হারিয়েছেন কাদুবাই। তাঁর হাজার সংগ্রাম সাক্ষী থেকেছে একতারি আর সুরেলা কণ্ঠখানি। স্বামী ও পিতার বিয়োগ সত্ত্বেও তিনি ভেঙে পড়েননি।

নিজের একতারি ও কণ্ঠভরা সুরের বলে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আগুয়ান হয়েছেন কাদুবাই। বাবাসাহেবের প্রেম, করুণা, অনুপ্রেরণা ও শক্তির ভরসায় এ দুনিয়ার মোকাবিলা করেছেন তিনি।

এই যে দুয়ারে-দুয়ারে গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করে ফেরা থেকে আজ মহারাষ্ট্র জুড়ে এত নামডাক — এ যাত্রাটি আপাতদৃষ্টিতে চমকপ্রদ বলে মনে হয়। ৩০ বছরের এই যাত্রায় কাদুবাইয়ের একনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে থেকেছে তাঁর একতারিটি।

ভিডিওটি দেখুন: ‘বাবাসাহেবের গান গেয়েই সন্তানদের মানুষ করতে পেরেছি’

*****

একতারির প্রথম উল্লেখ মেলে অজন্তার [ঔরঙ্গাবাদ জেলা, মহারাষ্ট্র] ১৭ নং গুহায়। গুহাগাত্রে এই বাদ্যযন্ত্রটির একখান ছবি আঁকা আছে। মহারাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন জাতির আলাদা আলাদা বাদ্যযন্ত্র। আচার-উপাচার তথা সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে ব্যবহার হয় এগুলি। মাঙ্গ জাতি বাজায় হালগি , দাক্কালওয়ার বাজায় কিঙ্গরি , ধাঙড়দের বাজনা গাজি ঢোল , দেবী ইয়ালাম্মার উপাসকেরা বাজান চৌণ্ডক , ডাভ্রু বাজান গোসাভি জাতির মানুষ আর মাহার সম্প্রদায়ের ঢোলকি টুনটুনে।

মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নারায়ণ ভোসলের মতে প্রথাগতভাবে ডাভ্রু বাজায় বলেই গোসাভি সম্প্রদায়ের আরেক নাম ডাভ্রু-গোস্বামী। টুনটুনে আর সাম্বাল বাজিয়ে মাতৃতন্ত্রমূলক ভজন গান ভাট জাতির চারণকবিরা।

একতারি ও টুনটুনের মধ্যে আকারগত মিল রয়েছে বটে, কিন্তু দুটির ধ্বনি, বাজানোর কায়দা এবং বানানোর তরিকা আলাদা। এই যে মাহার ও মাঙ্গ জাতির মানুষজন একতারি বাজিয়ে ভজন গান, এটা তথাকথিত উঁচু জাতির ভিতর হয় একেবারেই অনুপস্থিত, কিংবা কস্মিনকালে দেখা মেলে। উক্ত জাতিগুলির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই বাদ্যযন্ত্রগুলি। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের নানান মুহূর্তে এগুলি বাজানো হয়।

একতারির ব্যাপারে জনপ্রিয় শাহির সাম্ভাজি ভগত বলেন: “এর শব্দ ও সুরের সঙ্গে বিষাদের নাড়ির যোগ রয়েছে। ‘দিং নাগ্, দিং নাগ্...’ ধ্বনির সঙ্গে বেরিয়ে আসে যাতনা। সুরগুলি ভৈরবী থেকে আসছে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারার এটি একটি রাগবিশেষ যেটিতে প্রকাশ ঘটে দুঃখের। একতারি শুনলে ভৈরবীর প্রতিটি সুর অনুভব করা যায়। একতারির সঙ্গে যে ভজনগুলো গাওয়া হয়, প্রায় প্রত্যেকটাই ভৈরবী রাগে গাঁথা। শুরু ও শেষ, দুটোই হয় ভৈরবী দিয়ে।”

হিন্দুধর্মের ভক্তিধারার দুটি শাখা আছে: সগুণ [ঈশ্বর যেথা সাকার] ও নির্গুণ [ঈশ্বর যেথা নিরাকার]। সগুণ ধারার কেন্দ্রে রয়েছে দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির। অন্যদিকে নির্গুণ ধারায় মূর্তি বা মন্দিরের কোনও স্থান নেই। এই শাখার অনুগামীরা ভজন গান। তাঁদের কাছে সংগীতই উপাসনা, তাই গান গেয়ে দেবদেবীর আরাধনা করেন, নিজেদের ভক্তিরস পৌঁছে দেন মানুষের কাছে। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে অবধি মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়ের মানুষজন কবীর আর ধাগোজি-মেঘোজির অনুগামী ছিলেন।

आकाश पांघरुनी
जग शांत झोपलेले
घेऊन एकतारी
गातो कबीर दोहे

আসমান তলে আজি
জগৎ ঘুমায়,
একতারে দোহা বেঁধে
কবীরা সে গায়

ধীরে ধীরে কবীরের সমস্ত দোহাই একতারি সহকারে গাওয়া হতে লাগল। তাঁর মেহনত, জীবনের অভিজ্ঞতা, দর্শন ও বিশ্ববীক্ষা — সবকিছুই মেলে তাঁর গানে।

ভিডিওটি দেখুন: ‘একতারি সহকারে যে কোনও গান গাইতে পারবেন’

নিপীড়িত ও প্রান্তবাসী মানুষের কাছে সন্ত কবীর আধ্যাত্মিক ও সাংগীতিক অনুপ্রেরণা। একতারি হাতে দেশের নানান প্রান্তে তাঁর বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যাযাবর সম্প্রদায় ও চারণকবিরা। কবীর-বিশেষজ্ঞ পুরুষোত্তম আগরওয়ালের কথায়: কবীরের প্রভাব কিন্তু শুধুমাত্র পঞ্জাব ও হিন্দিভাষী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, ওড়িয়া ও তেলুগুভাষী এলাকা সহ গুজরাত ও মহারাষ্ট্র অবধি ছড়িয়ে গেছে তাঁর জীবনদর্শন।

১৯৫৬ সালের আগে অবধি মহারাষ্ট্র তথা রাজ্যের সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশে মাহার তথা অন্যান্য তথাকথিত ‘অস্পৃশ্য’ জাতির প্রত্যেকেই কবীরের অনুগামী ছিলেন। তাই কবীরপন্থী বলা হত তাঁদের। কবীরের প্রভাব ছিল মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত সন্ত তুকারামের উপরেও। ধরা হয় যে কবীর ও কবীরপন্থার প্রভাবেই উক্ত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একতারির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে।

একতারি বাজিয়ে গান গাওয়ার প্রথা লক্ষ্য করা যায় দলিত পরিবারগুলিতে — বিশেষত মাহার তথা অন্যান্য জাতি, ঐতিহাসিক রূপে যাঁদের অচ্ছুৎ বলে গণ্য করা হয়ে এসেছে। এ বাজনাটির ব্যবহার আজও বজায় আছে। বাড়িতে কেউ মারা গেলে একতারি বাজিয়ে ভজন গাওয়া হয়। ভজনের মধ্যে দিয়ে কবীরের দর্শন ব্যাখা করতেন মাহার সম্প্রদায়ের মানুষজন। জীবনের ফলপ্রসূতা ও তার অভিব্যক্তি, সুকর্মের গুরুত্ব ও মৃত্যুর নিশ্চয়তাই কবীরের বিশ্বদর্শনের বুনিয়াদ — এসব ঘিরেই দোহা ও ভজন লিখেছেন তিনি। কবীর, নাথপন্থা ও ওয়ারকারি ধারার [ভক্তিযুগের] শয়ে-শয়ে গান কাদুবাইয়ের জানা আছে।

কবীরের ‘গগন মেঁ আগ লগি হ্যায় ভারি’ (‘গগনে গগনে আগুন লেগেছে লেলিহান’) গেয়ে উঠলেন কাদুবাই।
একই সঙ্গে গাইলেন তুকারামের একটি অভঙ্গ:

विठ्ठला तुझे धन अपार
करीन नामाचा या गजर
धन चोरला दिसत नाही

डोळे असून ही शोधत राही

বিট্ঠল বিট্ঠল, মহিমা তোমার নামে অনন্ত জানি,
নাম তব ঠোঁটে মোর...
বৃথাই খুঁজিছে চোর...
অন্ধ অন্ধ নহে, হাজার খুঁজেও তবু পাইবে না জানি।

কাদুবাইয়ের মতো অনেকেই এমন সব গান গাইতেন বটে, তবে ডঃ আম্বেদকরের সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের প্রভাব বাড়তে থাকলে সেসব ছেড়ে অন্য গানের দিকে ঝুঁকেছেন।

একতারি বাজিয়ে দূর-দূরান্তে কবীরের ভজন ছড়িয়ে দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের খ্যাতনামা গায়ক প্রহ্লাদ সিং টিপানিয়া। তিনি বালাই জাতির মানুষ। মধ্যপ্রদেশের সমাজে বালাই জাতির আর মহারাষ্ট্রে মাহারদের মোটামুটি সমস্থান। এ রাজ্যের বুরহানপুর, মালওয়া ও খাণ্ডোয়া অঞ্চল সহ মহারাষ্ট্র-সীমান্তে বসবাস করেন বালাইরা। দলিত সমাজের উপর জাতিগত হিংসার বিস্তারিত বর্ণনা করার সময় বালাই সম্প্রদায়ের উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন বাবাসাহেব। গ্রামে গ্রামে গিয়ে খাজনার রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে যে প্রায় একশ বছর আগে গ্রামবাসীদের পাহারা, জরিপে সহায়তা তথা আত্মীয়স্বজনের কাছে মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজে বহাল করা হত মাহারদের। তৎকালীন সমাজে এটাই ছিল তাঁদের স্থান।

মধ্যপ্রদেশে এই একই কাজে মোতায়েন করা হত বালাইদের — গাঁয়ের চৌকিদারকে ‘বালাই’ বলে ডাকা হত। অথচ ব্রিটিশ আমলে এই জাতিটির উল্লেখ মেলে ‘মাহার’ নামে। এই রূপান্তর ঘটল কেমনভাবে? খাণ্ডোয়া ও বুরহানপুরের ব্রিটিশ প্রশাসন লক্ষ্য করেছিল যে মধ্যপ্রদেশের বালাই ও মহারাষ্ট্রের মাহারদের ভিতর কোন ফারাক নেই বললেই চলে — দুই গোষ্ঠীর যাপনরীতি, আচার-বিচার, সামাজিক উপাচার এবং পেশা প্রায় এক। অগত্যা, মধ্যপ্রদেশের মাহারদের গায়ে এঁটে দেওয়া হল বালাই-এর তকমা। তারপর ১৯৪২-৪৩ সালে ঘটল উল্টোপুরাণ, খাতায়-কলমে তাঁরা আবার ফিরে পেলেন মাহার-পরিচয়। এটাই বালাই জাতির দাস্তান।

*****

PHOTO • Imaad ul Hasan

মহারাষ্ট্রে আজ কাদুবাইয়ের বিস্তর নামডাক। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একতারি তাঁর দোসর

একতারি সহকারে কবীরের ভজন পরিবেশন করেন প্রহ্লাদ সিং টিপানিয়া ও শবনম ভিরমানি [ কবীর প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত]।

সারা দেশ জুড়েই ভজন গায়ক ও চারণশিল্পীদের হাতে একতারির দেখা মিলবে। ১০০-১২০ সেন্টিমিটার লম্বা এই বাজনাটির একাধিক নাম রয়েছে — কর্ণাটকে একনাদ , পঞ্জাবে তুম্বি , বাংলায় একতারা , নাগাল্যান্ডে টাটি ও তেলেঙ্গানা তথা অন্ধ্রপ্রদেশে বুর্রা বীণা। এছাড়া ছত্তিশগড়ের আদিবাসীরাও নাচ-গানের সময় একতারি ব্যবহার করেন।

কুমড়ো শুকিয়ে, তার ভিতরের শাঁস বাদ দিয়ে শেষে চ্যাপ্টা করে বানানো হয় একতারির অনুরণক বা অনুনাদক (রেজোনেটর)। অনুরণকের সংকীর্ণ মুখগহ্বর বন্ধ করা হয় একফালি চামড়া দিয়ে। এবার অনুরণকের ভিতর একখান ফাঁপা ভেলু [এক প্রকারের বাঁশ] ঢোকানোর পালা। ভেলুর নিম্নাংশটি কুমড়োর খোল ভেদ করে বেরিয়ে থাকে, এতে একটি সুতো আটকানো হয়। এই সুতোর একটি ধার ব্রিজের সঙ্গে যুক্ত করে অন্য ধারটি ভেলুর ডগায় একটি খুঁটির সাহায্যে বাঁধা হয়। বাজানোর সময় তর্জনী কিংবা মধ্যমা ব্যবহৃত হয়।

অন্যান্য তারবাদ্যের আকার এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ার তুলনায় একতারির [একতন্ত্রী ল্যূট-জাতীয় বাজনা] গল্পটা বেশ সহজসরল। কুমড়ো, কাঠ, বাঁশ, সুতো — খুব সহজেই পাওয়া যায় সবকিছু। অনুরণক রূপে কুমড়োর জুড়ি মেলা ভার, আফ্রিকার বাদ্যযন্ত্রেও এর বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। খাদের সুর ও বুনিয়াদি তাল — দুটোই সরবরাহ করে একতারি। একতারির গুঞ্জনের সঙ্গে গলার স্বর ও লয় মিলিয়ে গাইতে পারেন শিল্পীরা। এই বাদ্যযন্ত্রটি একাধারে প্রাচীন ও দেশজ। এককালে সুতোর বদলে চামড়া ইস্তেমাল হত, পশুত্বকের ভিতরের অংশটি। কর্ণাটক আজও ইয়ালাম্মার পুজোয় চামড়ার সুতো দিয়ে বানানো একতারি বাজানো হয়, এটির নাম জুম্বারুক। চামড়ার চাকতির গায়ে চামড়ার সুতোর অনুরণনের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল জগতের আদিতম সুর ও তাল — এমনটা বললে বোধহয় ভুল হবে না। এভাবেই জন্ম নেয় প্রথম বাদ্যযন্ত্র। কৃষিনির্ভর সমাজে ধাতুর উদ্ভাবন হওয়ার পর ধাতুব তার ব্যবহার হতে লাগে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য একতন্ত্রী বাজনার সৃষ্টি হয়েছে যুগে যুগে। ভ্রাম্যমাণ তথা যাযাবর সংগীতশিল্পীরা যে ধরনের বাদ্যযন্ত্র বানান বা ব্যবহার করে থাকেন, সেগুলির সঙ্গে তাঁদের জীবনশৈলীর নিবিড় সংযোগ রয়েছে।

ভক্তিযুগে ভারতের সন্ত তথা কবিদের মধ্য একতারির ব্যাপক প্রচলন ছিল — এটা অনেকেই বিশ্বাস করেন বটে, তবে এর ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না বিশেষ। কবীর, মীরাবাই সহ বেশ কিছু সুফি সন্তরা একতারি বাজিয়ে গাইতেন ঠিকই, কিন্তু মহারাষ্ট্রে নামদেব থেকে তুকারামের মতো অসংখ্য কবি-সন্ত তাল (করতাল), চিপলি (ধাতব পাতযুক্ত কাঠের খঞ্জনি) আর মৃদঙ্গ (পাখোয়াজ জাতীয় বাদ্য) ব্যবহার করতেন। এছাড়াও অসংখ্য ছবিতে দেখা যায় যে সন্তদের হাতে বীণা রয়েছে।

মারাঠি বিশ্বকোষ বলছে: “ভারতীয় সংগীতে বীণার ব্যবহার সুপ্রাচীন। বৈদিক মন্ত্র পড়ার সময় এটির মাধ্যমেই স্বর গোনা হত।” অথচ নামদেব ও তুকারামের মতো সন্তদের ছবিতে বীণার দেখা মিললেও তুকারামের অভঙ্গে এই যন্ত্রের কোনও উল্লেখ নেই। বরং বেশ কিছু জায়গায় উল্লিখিত হয়েছে তাল, চিপলি মৃদঙ্গের মতো বাজনার কথা।

ফলত একথা বলাই যায় যে বীণাহস্তে তুকারামের ছবিগুলি আদতে ব্রাহ্মণ্যবাদী উপস্থাপনা।

ভিডিওটি দেখুন: ‘ওয়ামনদাদার মতো প্রতিভাধর আর কেউ নেই’

জনসাধারণের রোজকার জীবনের খুঁটিনাটি অনেককিছুই লুঠ করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারা। দেবদেবী, সংস্কৃতি সহ জনজীবনের বহু সূক্ষ্ম অনুভূতি আত্মস্থ করে তার মূল আকার ও চরিত্র বদলে দিয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য কায়েম হওয়ার পর পেশোয়াদের পতন ঘটলে নির্বিষ হয়ে পড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। সমাজের মাথায় চড়ে বসা বন্ধ হয়ে গেলে সুকৌশলে এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবন কুক্ষিগত করতে থাকে ব্রাহ্মণের দল। এভাবেই খেটে খাওয়া শ্রেণির শিল্পরূপ তথা বাদ্যযন্ত্রের দখল নেয় উঠতি সাংস্কৃতিক শক্তি-কেন্দ্রগুলি।

এই সকল শিল্পরূপ ও যন্ত্রের উপর তার স্বত্ব ও ন্যায্য অধিকার হারায় শ্রমজীবী শ্রেণি। শেষমেশ যাঁদের হাতে জন্ম হয় এগুলির, তাঁরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন শিল্প ও সংগীতের ক্ষেত্র থেকে।

ওয়ারকারি প্রথায় ব্যবহৃত হয় মৃদঙ্গ, এটি চামড়া দিয়ে প্রস্তুত একপ্রকারের হস্তচালিত দ্রাবিড়ীয় ঢোল-জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। দক্ষিণ ভারতের অস্পৃশ্য জাতির কারিগরেরা এটি বানান। অন্যদিকে বীণা ভাগবত ধারার সঙ্গে যুক্ত, এই ধারাটি মূলত উত্তর ভারতীয়। সম্ভবত এই গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমেই ওয়ারকারিদের কাছে বীণা এসে পৌঁছয়।

একতারি, সাম্বাল, টিমকি, টুনটুনে, কিংরি — প্রতিটা বাদ্যযন্ত্রই ভারতের শোষিত, নিপীড়িত সমাজের হাতেই সৃষ্টি। অন্যদিকে বীণা, সন্তুর ও সারেঙ্গির মতো বাজনার উৎস প্রাচীন পারস্য। রেশমপথ হয়ে এগুলি এসে পৌঁছেছিল ভারতে। খ্যাতনামা বীণাশিল্পীদের নিবাস পাকিস্তানে, এবং তাঁদের নিরাপদ হস্তেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের বিরাসত গচ্ছিত রয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রীয় সংগীতে ব্যবহৃত বীণা ও সন্তুরের মতো বাদ্যযন্ত্র বানাতে সক্ষম, এমন বহু কারিগর রয়েছেন পাকিস্তানের কোয়েট্টায়। ভারতের মাটিতে এগুলি যাঁরা বানান, তাঁরাও মুসলিম — ছড়িয়ে রয়েছেন কানপুর, আজমের ও মিরাজ জুড়ে।

গোড়ার দিকে এ দেশের শোষিত ও প্রান্তবাসী সম্প্রদায়গুলি চামড়া ও তারযুক্ত বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র বানাতেন। এগুলিই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগীত ও শিল্পধারার সাংস্কৃতিক বিকল্প। ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রে ছিল শাস্ত্রীয় সংগীত আর নৃত্যকলা।

*****

একতারি সহকারে কাদুবাইয়ের গানগুলি অপূর্ব শোনায়। তাঁর গায়কিতে নিহিত স্বচ্ছতা ও অনুভূতির গভীরতা এই বাদ্যযন্ত্রটির মাধ্যমে আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

‘এসো এসো, এই গল্পটা শোনো!’ — এভাবেই একতারির বোলে আম্বেদকরী গান বেঁধে অলিগলি, রাজপথে, দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরেন বিলাস ঘোগারে, প্রহ্লাদ শিন্ডে, বিষ্ণু শিন্ডে ও কাদুবাই খারাতের মতো আম্বেদকরী শাহিরেরা। দুনিয়াভর যাযাবর মানুষের সহায় এ বাদ্যযন্ত্র — দুই দণ্ড স্থির হয়ে থাকা চরৈবেতি একতারির ধাতে নেই।

ভিডিওটি দেখুন: ‘সমস্ত কুসংস্কার ঝেড়ে ফেললাম’

অচ্ছুৎ জাতিসমূহের সংগীতের পৃথিবী এবং তাঁদের আধ্যাত্মিক বিবর্তনের যাত্রা — দুটোরই অবিচ্ছেদ্য অংশ একতারি। বিজ্ঞানের উন্নতি তথা নিত্যনতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে প্রতিস্থাপিত হয়েছে লোকপ্রথা ও লোকসংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র — যেমন একতারি। হাতে একতারি নিয়ে গান করেন, এমন শিল্পী কাদুবাইয়ের পর আর কেউ থাকবেন বলে তো মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা গেছে, একতারি ছেড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা আধুনিক সংগীতেই দিকেই বেশি বেশি করে ঝুঁকছেন আম্বেদকরপন্থী গাইয়েরা।

বাবাসাহেবকে ঘিরে রচিত নতুন গানগুলি ‘ওয়াট মাঝি বাঘতোই রিকশাওয়ালা’ -র [‘আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে রিকশাওয়ালা’] মতো জনপ্রিয় মারাঠি গানের সুরে বাঁধা হচ্ছে। আমি এটা বলছি না যে আধুনিক সংগীত বা বাজনা ইস্তেমাল করা খারাপ, কিন্তু আপনাদের ধারার সঙ্গে এই বাদ্যযন্ত্রগুলি আদৌ খাপ খায়? গানের অন্তর্নিহিত বার্তা কী প্রকাশ পাচ্ছে? সেটা আমজনতা অবধি পৌঁছতে সক্ষম হচ্ছে? যেটা গাইছেন, তার অর্থের সঙ্গে সুর বা গায়কির কোনও সামঞ্জস্য রয়েছে কি? এগুলোই আসল প্রশ্ন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আধুনিক বাজনার সৃষ্টিও এই মানবসমাজেই, এভাবেই আমাদের সাংগীতিক ধারার বিবর্তন ঘটবে। কিন্তু ছায়াছবির চটকদার ‘ফিল্মি’ সুরে আম্বেদকরী গান বাঁধলে সেগুলো শুধুই স্থূল আর কোলাহলমুখর হয়ে রয়ে যায়, কান ফেটে যায় শুনতে গেলে। অত্যন্ত কদর্য। অন্ধভক্তি ও পরিচয়ের দাবি জানানোটুকুই রয়েছে আজ, এসকল গানে আম্বেদকরের গভীর দর্শনের ছিটেফোঁটাও নেই। চেতনারহিত থেকে এবং দর্শন না বুঝে কেবলই নিত্যনতুন চটকদারিত্বের পিছনে ছুটলে এ গান শুধু লোক-নাচানোর কল হয়েই রয়ে যাবে, শাশ্বত হবে না কখনও, স্থান পাবে না মানুষের হৃদয়ে, আমজনতার সামগ্রিক স্মৃতি অধরাই থেকে যাবে।

আবহমান কাল থেকে প্রবাহিত গোলামির বিরুদ্ধে বজ্রনাদ হয়ে গর্জে উঠেছে কাদুবাইয়ের কণ্ঠ। এই গণশিল্পী দারিদ্র ও শত প্রতিকূলতার জঠর থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর গান জাতপাত ও ধর্ম বিষয়ে আমাদের সচেতন করে, আমরা বুঝতে শিখি অস্পৃশ্যতা ও দাসত্ব কতখানি নিষ্ঠুর ও অমানবিক। কাদুবাইয়ের একতারি তাঁর পরিবার ও সম্প্রদায়ের মহামূল্যবান বিরাসত বয়ে নিয়ে চলেছে। একতারের এই বাজনার মূর্চ্ছনায় জারিত হয়ে ওঠে আমাদের হৃদয়।

मह्या भिमाने माय सोन्याने भरली ओटी
किंवा
माझ्या भीमाच्या नावाचं
कुंकू लावील रमाने
अशी मधुर, मंजुळ वाणी
माझ्या रमाईची कहाणी

ভীমের তরেই পূর্ণ জীবন স্বর্ণসোহাগ দিয়া...
কিংবা
আমার ভীমের নামে,
সিঁথির পরে কুঙ্কু চড়ায় সুন্দরী রমা ওই —
মিঠে মিঠে সুর কণ্ঠে আহা
রমাই, ও তার গল্প এমন, শোন্ রে দেখি সই।

এই গান শুনলে বাবাসাহেবের দর্শন যে কেউ চট করে ধরে ফেলতে পারবে। আম্বেদকর, নিত্যদিনের সংগ্রাম, যাপনের কষ্ট ও সুগভীর আধ্যাত্মিকতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে এই গানের মধ্যে দিয়ে। এই গানে লুকিয়ে আছে জীবনের গভীরতম উপলব্ধি। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র নিজের কণ্ঠরূপী অস্ত্র শানিয়ে এভাবে ঘুরে ঘুরে সামাজিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। একদিকে থাকে সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, অন্যদিকে আমাদের ইতিহাসের স্মৃতি অক্ষয় হয়ে ওঠে তাঁদের স্বরে ও বাজনায়। কাদুবাই খারাত এঁদেরই একজন।

মূল প্রতিবেদনটি মারাঠিতে লেখা।

এই মাল্টিমিডিয়া প্রতিবেদনটি ‘ইনফ্লুয়েনশিয়াল শাহিরস্, ন্যারেটিভস্ ফ্রম মারাঠওয়াড়া’ নামক একটি সংকলনের অংশ। পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার সহযোগিতায় এবং আর্কাইভস্ অ্যান্ড মিউজিয়াম প্রোগ্রামের আওতায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করেছে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দি আর্টস্। নয়াদিল্লির গ্যোটে ইনস্টিটিউট/ম্যাক্স ম্যুলার ভবনের আংশিক সহযোগিতা ছাড়া এটি সম্ভবপর হয়ে উঠত না।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Keshav Waghmare

କେଶବ ୱାଘମାରେ ମହାରାଷ୍ଟ୍ରର ପୁଣେଠାରେ ଅବସ୍ଥାପିତ ଜଣେ ଲେଖକ ଓ ଗବେଷକ। ସେ ୨୦୧୨ରେ ଗଠିତ ହୋଇଥିବା ଦଳିତ ଆଦିବାସୀ ଅଧିକାର ଆନ୍ଦୋଳନ (ଡିଏଏଏ)ର ଜଣେ ପ୍ରତିଷ୍ଠାତା ସଦସ୍ୟ ଏବଂ ବହୁ ବର୍ଷ ଧରି ମରାଠୱାଡ଼ା ସମ୍ପ୍ରଦାୟକୁ ନେଇ ଅଧ୍ୟୟନ ଜାରି ରଖିଛନ୍ତି।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Keshav Waghmare
Illustration : Labani Jangi

ଲାବଣୀ ଜାଙ୍ଗୀ ୨୦୨୦ର ଜଣେ ପରୀ ଫେଲୋ ଏବଂ ପଶ୍ଚିମବଙ୍ଗ ନଦିଆରେ ରହୁଥିବା ଜଣେ ସ୍ୱ-ପ୍ରଶିକ୍ଷିତ ଚିତ୍ରକର। ସେ କୋଲକାତାସ୍ଥିତ ସେଣ୍ଟର ଫର ଷ୍ଟଡିଜ୍‌ ଇନ୍‌ ସୋସିଆଲ ସାଇନ୍ସେସ୍‌ରେ ଶ୍ରମିକ ପ୍ରବାସ ଉପରେ ପିଏଚଡି କରୁଛନ୍ତି।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Labani Jangi
Editor : Vinutha Mallya

ବିନୁତା ମାଲ୍ୟା ଜଣେ ସାମ୍ବାଦିକା ଓ ସମ୍ପାଦିକା। ପୂର୍ବରୁ ସେ ପିପୁଲ୍ସ ଆର୍କାଇଭ୍‌ ଅଫ ରୁରଲ ଇଣ୍ଡିଆର ସମ୍ପାଦକୀୟ ମୁଖ୍ୟ ଥିଲେ।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Vinutha Mallya
Translator : Joshua Bodhinetra

ପିପୁଲ୍ସ ଆର୍କାଇଭ୍ ଅଫ୍ ରୁରାଲ ଇଣ୍ଡିଆ (ପରୀ) ରେ ଭାରତୀୟ ଭାଷା କାର୍ଯ୍ୟକ୍ରମ, ପରୀଭାଷାର ବିଷୟବସ୍ତୁ ପରିଚାଳକ ଜୋଶୁଆ ବୋଧିନେତ୍ର। ସେ କୋଲକାତାର ଯାଦବପୁର ବିଶ୍ୱବିଦ୍ୟାଳୟରୁ ତୁଳନାତ୍ମକ ସାହିତ୍ୟରେ ଏମଫିଲ କରିଛନ୍ତି ଏବଂ ଜଣେ ବହୁଭାଷୀ କବି, ଅନୁବାଦକ, କଳା ସମାଲୋଚକ ଏବଂ ସାମାଜିକ କର୍ମୀ ଅଟନ୍ତି।

ଏହାଙ୍କ ଲିଖିତ ଅନ୍ୟ ବିଷୟଗୁଡିକ Joshua Bodhinetra