২০১৭ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত , বিদর্ভের কার্পাসপ্রধান কৃষিক্ষেত্র সম্বলিত জেলাগুলিতে, বিশেষত ইয়াবতমালে হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে মাথা ঘোরা, স্নায়বিক দুর্বলতা , দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া , পেটে ব্যাথা ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসার ঘটনায় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি দেখা যায় । সকলেই কার্পাস চাষি অথবা খেতমজুর , প্রত্যেকেই নিজেদের খেতের ফসলে কীটনাশক ছড়ানোর সময় এই কীটনাশকের সংস্পর্শ জনিত বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়েছিলেন । এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন মারা গেছেন , হাজারেরও বেশি অসুস্থ হয়েছেন , কেউ কেউ কয়েকমাস ধরে ভুগেছেন।
তিন ভাগে বিভক্ত সিরিজের এই দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে , পারি সেই সময়কালে এই অঞ্চলে ঠিক কী কী ঘটেছে এবং মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম ঠিক কী খুঁজে পেয়েছে তা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছে ।
এর পরবর্তীতে, এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অন্য আরেকটি কিস্তিতে , কেন বিদর্ভ অঞ্চলে কীটনাশকের এত বেশি ব্যবহার , সেই বৃহত্তর প্রেক্ষিতটি আমরা বোঝার চেষ্টা করব । এবং কেন বিটি - তুলো – যা এমন একটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড প্রজাতি বা জীনপ্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট ‘ উন্নততর ’ প্রজাতি যেটির ক্ষেত্রে দাবি করা হয়েছিল যে তার গোলাপি বোলওয়ার্ম কীটের বিরুদ্ধে জন্মগত প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে , সেই ফসল কেন এই পুরানো একটি কীটের আক্রমণে বিনষ্ট হয়ে গেল । প্রকৃত পক্ষে দেখা যাচ্ছে , গোলাপি বোলওয়ার্ম কীট যেন স্বমহিমায় ফিরে এসেছে । যে ভয়টা ছিল , সেটাই বাস্তব হয়েছে , এই কীটের আক্রমণে মানুষ ব্যাপক ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছেন ।
*****
সঞ্জয় বোরখাডে এখনও বিষক্রিয়ার আতঙ্ক এবং ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। তাঁর কথায়, “আমি প্রায় অন্ধ হয়ে নিজের দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছিলাম। খুব জোর এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। এখনও আমার চোখের সমস্যা পুরোপুরি যায় নি। সেই সঙ্গে সারাক্ষণই ক্লান্তি অনুভব করি।”
আন্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত ৩৫ বছর বয়সী সঞ্জয় বিগত ১৫ বছর যাবৎ কৃষি শ্রমিকের পেশায় নিযুক্ত আছেন; তাঁর নিজের কোনও জমি নেই। তিনি জানান, তাঁর এত দিনের কাজের অভিজ্ঞতায় কীটনাশক ছড়ানোর ফলে তিনি কখনও এইরকম বিধ্বংসী মারাত্মক প্রভাব দেখেন নি।
যে দিনটিতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেদিন তিনি প্রায় ৫/৬ ঘন্টা ধরে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করেছিলেন। সেটা ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস, মোটামুটি এক সপ্তাহ জুড়ে তিনি তাঁদের গ্রামে বার্ষিক চুক্তিতে ইজারা নেওয়া দশ একর জমির কার্পাস ফসলে রকমারি কীটনাশকের মিশ্রণ ছড়ানোর কাজ করছিলেন। ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে ইজারা নেওয়ার এই ব্যবস্থাকে সালদারী বলা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থা থেকে সঞ্জয়ের গড়পড়তা ৭০,০০০ টাকা বার্ষিক উপার্জন হয়। ইয়াবতমালের নের তহসিলের চিখলী (কানহোবা) গ্রামের মানুষ সঞ্জয়। গ্রামের প্রায় ১,৬০০ জন অধিবাসীর মধ্যে শতকরা ১১ শতাংশ গ্রামবাসী আন্ধ তথা অন্যান্য তফসিলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত আদিবাসী।
সঞ্জয়ের স্ত্রী তুলসা জানান, “গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে আমি কীটনাশক ছড়ানোর ফলে অসুস্থ হওয়ার এমনকি মৃত্যুর খবরও শুনেছিলাম।” স্বাভাবিকভাবেই, সঞ্জয় অসুস্থ হওয়ার পর তুলসা চূড়ান্ত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন পাছে সঞ্জয়ও নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বসেন। যে কটা দিন তিনি হাসপাতালে কাটিয়েছিলেন, সেটা পরিবারের জন্য খুব কঠিন সময় ছিল। তুলসা বলেন, “আমাদের ভাগ্য ভালো যে তিনি প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন। নইলে আমি আমার সন্তানদের মানুষ করতাম কেমন করে ভাবতে পারি না।”
পরিবারের (প্রতিবেদনের শুরুতে কভার ছবিতে সঞ্জয়ের পরিবারটি রয়েছে) একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য বলতে সঞ্জয় নিজেই – পরিবারে আছেন তাঁর স্ত্রী তুলসা, তাঁদের তিন কন্যা, এক পুত্র এবং তাঁর বৃদ্ধা মা। কাঠের খুঁটি এবং মাটির দেওয়াল দিয়ে তৈরি খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি চালাঘরে তাঁরা সবাই থাকেন। ঘরের ভেতর জায়গার বড্ড অভাব – অল্প বাসনপত্র, একটা খাট রয়েছে - কিন্তু বাচ্চাদের প্রাণখোলা হাসিতে ঘরখানি ভরপুর।
পশ্চিম
বিদর্ভের কার্পাসপ্রধান অঞ্চলগুলির মধ্যে প্রধানত
ইয়াবতমাল জেলার ৫০ জন কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকের মৃত্যুর ভয়াবহ পর্বটির কথা মনে
করতেও সঞ্জয় ভীষণরকম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। (পড়ুন:
মারণ কীট, প্রাণঘাতী কীটনাশক
)। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে
নভেম্বর মাসের মধ্যে কীটনাশকের দূষিত
ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করার জন্য বিষক্রিয়ায় তাঁদের মৃত্যু হয়। হাজারেরও বেশি কৃষিজীবী মানুষ অসুস্থ হয়েছেন, কেউ কেউ কয়েকমাস ধরে ভুগেছেন। (সরকারি এবং
বেসরকারি হাসপাতালগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাজ্যসরকার হতাহতের
পরিসংখ্যান প্রস্তুত করেছে।)
কৃষক আত্মহত্যার জন্য খবরের শিরোনামে থাকা এই অঞ্চলে এই দফায় কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনাগুলি ছিল স্বভাবতই অন্যরকম।
গ্রামের কৃষক তথা সরপঞ্চ বা মোড়ল উদ্ধবরাও ভালেরাও যাঁর জমিতে সঞ্জয় কৃষিকাজ করেন, তিনি জানান, “সেদিন বিকেলে প্রতিবছরের মতো আমরা আমাদের জমির ফসলে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ মোটামুটি শেষ করে এনেছিলাম।” সেদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ সঞ্জয় তাঁর মালিকের বাড়িতে এসে পৌঁছলেন যখন, তখন তাঁর দুই চোখ ফুলে ঢোল। উদ্ধবরাও সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জয়কে নিজের মোটরবাইকে বসিয়ে তাঁদের গ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত আরণী শহরে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে আবার ৪০ কিলোমিটার দূরে ইয়াবতমাল জেলার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। উদ্ধবরাওয়ের কথায়, “কীটনাশকের ফলে বিষক্রিয়ার খবর আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু সেটা যে আমাদের উপরেও আছড়ে পরবে তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না।” তিনি বলেন, পুরো হাসপাতাল জুড়েই অনিচ্ছাকৃত বিষক্রিয়াজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত কৃষিজীবীদের ভিড়।
ঘটনাটা বড় অদ্ভুত এবং ভয়াবহ ছিল। ভালেরাওয়ের মতে, “বহু বছর ধরে যেসব রাসায়নিক আমরা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করছিলাম, সেগুলিই এবারও ব্যবহার করেছিলাম – নন-লোকালাইজড প্ল্যান্ট পয়জন এবং সরাসরি কাজ করতে সক্ষম এমন কিছু রাসায়নিক ।” ভালেরাওয়ের কথা মত, অন্যান্যবারের তুলনায় একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে, আবহাওয়ায় ব্যাপক আর্দ্রতা এবং কার্পাস ফসলের অতি দ্রুত বৃদ্ধি।
জানুয়ারি মাসে আমি যখন চিখলী কানহোবা গ্রামে যাই, তখনও সেখানকার কৃষিজীবীরা ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া কার্পাসতুলোর ফসলে গোলাপি বোলওয়ার্ম পোকার আক্রমণের ঘটনায় ত্রস্ত হয়েছিলেন। অনিচ্ছাকৃত বিষক্রিয়ায় দুষিত ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করার জন্য অসুস্থ কৃষি শ্রমিকেরা তখনও এর জের কাটিয়ে উঠতে পারেন সক্ষম হননি।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে কার্পাস গাছগুলির মধ্যে যেগুলি অস্বাভাবিক লম্বা, ঝাঁকড়া এবং মোটা হয়ে উঠেছিল সেগুলিতে কীটনাশক ছেটাবার পর গ্রামের পাঁচজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে সঞ্জয়সহ চারজন সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যান। তবে, আন্ধ সম্প্রদায়ের প্রান্তিক কৃষক ৪৫ বছরের ধ্যানেশ্বর তালে দুই মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর অবশেষে জীবনযুদ্ধে পরাস্ত হন। তাঁকে প্রথমে ২০১৭ সালের ১লা অক্টোবর আরনীর উপ-জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরের দিন তাঁকে ইয়াবতমাল জেলার সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর তাঁকে নাগপুরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, অবশেষে সেখানেই তিনি মারা যান।“কোনোদিন তাঁর শারীরিক অবস্থায় একটু উন্নতি হচ্ছিল, তো ঠিক তারপরেই আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম তিনি প্রাণে বেঁচে যাবেন, কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে তিনি ফিরতে পারেন নি।” এসব কথা আমাদের জানান পেশায় কৃষি শ্রমিক ধ্যানেশ্বরের সবচেয়ে ছোট ভাই গজানন; তিনি এই পুরো সময়টাই দাদার সঙ্গে হাসপাতালে ছিলেন। তাঁদের আরেক ভাই বান্ডুকেও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল সাময়িক অন্ধত্বের সমস্যা নিয়ে; তিনি কীটনাশকের বিষক্রিয়া থেকে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন।
সঞ্জয়ের মত ধ্যানেশ্বরের শারীরিক কষ্টও চোখের জ্বালা থেকেই শুরু হয় - এবং তারপর তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, কীটনাশকের মারাত্মক প্রভাবে তাঁর রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি চূড়ান্তরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেই সঙ্গে সারা শরীরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। কাগজে কলমে, তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল ‘সেপ্টিসিমিয়া’ নামক রোগ।
তাঁর তিন সন্তান পিতার মৃত্যুর পর এখন নিজেদের পড়াশোনা বজায় রাখতে গিয়ে চূড়ান্ত প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। আরণী শহরের একটি স্কুলে, ১৯ বছরের কোমল দ্বাদশ শ্রেণিতে, ১৭ বছর বয়সী কৈলাশ দশম শ্রেণিতে এবং সবচেয়ে ছোটজন, ১৫ বছরের শীতল নবম শ্রেণিতে পড়ে। ধ্যানেশ্বরের স্বপ্ন ছিল, জীবনে নিজে যা করে উঠতে পারেন নি, তাঁর সন্তানেরা যেন সেসব করতে সক্ষম হয় – তারা বিদ্যালয়ের পড়া শেষে শিক্ষিত হয়ে জীবনে উন্নতি করুক, এটাই ছিল তাঁর বাসনা।
ধ্যানেশ্বরের বিধবা স্ত্রী অনিতা কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। তাঁর বৃদ্ধা মা চন্দ্রকলার সারাটা জীবন অন্যদের জমিতে কাজ করেই কেটে গেছে। অনিতা বলেন, “সমস্ত গ্রাম আমাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ করেছে, অবশ্য, আমাদের যা কিছু সামান্য সোনাদানা ছিল সেটাও বিক্রি করতে আমরা বাধ্য হয়েছি, এছাড়াও আমাদের প্রায় ৬০-৬৫,০০০ টাকা [প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে] তাঁর চিকিত্সা এবং অন্যান্য খরচ বাবদ ধার করতে হয়েছে।”চিখলী কানহোবা গ্রামে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ উদ্ধবরাও ভালেরাওয়ের কথায়, “সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের সময়টি আমাদের গ্রামের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল, আমরা চারজনকে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও ধ্যানেশ্বরকে বাঁচাতে পারি নি।”
এই কঠিন সময়ের আগমনের
পূর্বে অবশ্য ফসল ভালো হওয়ায় (জুলাই ২০১৭ - মার্চ
২০১৮) কার্পাস তুলোর জন্য বেশ ভালো বছর বলে মানুষ আশা করছিলেন; কিন্তু বাস্তবে, ভয়াবহ কীটপতঙ্গের
হামলায় সময়টা বিধ্বংসী চেহারা নিল। ভালেরাওয়ের জমিতেও পুরোনো গোলাপি বোলওয়ার্ম কীট, প্রায় কয়েক দশক পরে স্বমহিমায় ফিরে এলো। ১৯৮০এর দশকে
এই কীট সর্বশেষ দেখা যায়। ১৯৯০এর
দশকে, সিনথেটিক
বা কৃত্রিম পাইরেথ্রয়েড ব্যবহার এবং ২০০১ সালের পরে বিটি-তুলোর আগমনের ফলে এই
কীটপতঙ্গের প্রতিরোধ সম্ভব হয়। কিন্তু এখন এই পতঙ্গটি - কীটনাশক এবং বিটি - উভয়ের
থেকেই প্রতিরোধমুক্ত
হয়ে গেছে। (এই সিরিজের পরবর্তী কিস্তিতে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা থাকবে।)
বিষক্রিয়ার পর্বটি খতিয়ে দেখতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয়ের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের সুপারিশ করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে মহারাষ্ট্র সরকার একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করে; এই বিশেষ তদন্তকারী দলটি ইতিমধ্যে নিজের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাদের সুপারিশ করা বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে, একটি হল, জনপ্রিয় অথচ অত্যন্ত বিপজ্জনক কীটনাশক মোনোক্রোটোফস নিষিদ্ধ করা। ( এই সিরিজের পরবর্তী কিস্তিতে এসআইটির রিপোর্টটির বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।
ভালেরাওয়ের মতে, এই দুর্যোগের ফলে অঞ্চলের কৃষিজ অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। তাঁর জমির মোট উৎপাদিত তুলোর পরিমাণ এই বছরে শতকরা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে – কুয়োর জলে সিঞ্চিত তাঁর ৮ একর জমির প্রতি একরে যেখানে ১২ থেকে ১৫ কুইন্টাল ফসল উৎপাদিত হত, সেখান থেকে ২০১৭-২০১৮ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় একর প্রতি মাত্র ৫ থেকে ৬ কুইন্টাল ফসলে। শুধু তাই নয়, পতঙ্গের আক্রমণের জন্য ফসলের গুণমানও পড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই, উৎপাদন এতখানি হ্রাস পাওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থের যোগানে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। স্থানীয় অর্থনীতিতে এইরকম আঁটোসাঁটো অর্থ প্রবাহের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ মজুরিতে হ্রাস এবং মোটের উপর কৃষি মজুরদের কাজে ব্যাপক সংকোচন দেখা যায়। সরকার থেকে এইসময় যদি এমজিএনআরইজিএ-এর মতো প্রকল্পগুলির খাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে, এই সঙ্কটের ফলে কেনাকাটা, বিবাহ, পরিকাঠামো তথা অন্যান্য খাতে ব্যয় বিঘ্নিত হবে - এবং গ্রামের রুগ্ন অর্থনীতি আরও বিপর্যয়গ্রস্ত হয়ে পড়বে।
ভালেরাও আরও সংযোজন করে বলছেন যে, মৃত্যু এবং অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনাগুলির জেরে জমির মালিক এবং কৃষি শ্রমিকদের পারস্পরিক সম্পর্কে গভীর প্রভাব পড়বে। কীটনাশক ছড়ানোর কাজ – যা কিনা ফসল উত্পাদন প্রক্রিয়ায় এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ - বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষি শ্রমিকেরা করে থাকেন; এই দুর্ঘটনার জেরে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা কীটনাশক ছড়ানোর কাজ নেওয়ার ব্যাপারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকবেন। ইয়াবতমালে বিষক্রিয়ার ঘটনার মোটামুটি শুরুর সময় থেকেই খেতে খামারে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করানোর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের ব্যবস্থা করা কৃষকদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠেছিল, শ্রমিকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে কিছুতেই এই কাজে সম্মত করানো যাচ্ছিল না। কাজেই, কীটনাশক স্প্রে করার কাজ বন্ধ থাকায় কীটপতঙ্গের উপদ্রবে ফসলের আরও ক্ষতি হচ্ছিল।
ভালেরাও মনে করেন, “আমাদের জমির কাজে সহায়তাকারী খেতমজুরদের বিশ্বাস এবং আস্থা আমাদের পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি ঠিকই, কিন্তু এই যে এতগুলো জীবন ঝরে গেল, সেই ক্ষতি অপূরণীয়। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা অন্তত চারজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পেরেছি, কিন্তু আফসোস যে, আমরা ধ্যানেশ্বরকে বাঁচাতে পারিনি...”
সঞ্জয়ও ধ্যানেশ্বরকে বাঁচানো যায় নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন; তাঁর কথায় “একমাত্র আশার কথা এই যে, এই সঙ্কট আমাদের সমাজের সব মানুষকে একত্রে আনতে পেরেছে।” এই চরম বিপদের দিনে গ্রামের সকলেই একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জমির মালিকেরাও খেতমজুরদের পরিবারগুলিকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি নৈতিক সমর্থনও প্রদান করেন। সঞ্জয় এখনও কাজ শুরু করে উঠতে পারেন নি, এবং ভালেরাও নিজেও সঞ্জয়কে কাজে ফিরে আসার ব্যাপারে চাপ দেন নি। এই দুর্ঘটনার জেরে সঞ্জয়ের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে, কীটনাশক স্প্রে করার কাজ দূরে থাক, চাষের কাজেই তিনি আর ফিরবেন কিনা সে বিষয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। পরক্ষণেই আবার শপথ নিয়ে বলেন, “আগামী বছর কীটনাশক স্প্রে করার কাজ করার সময় আমি সম্পূর্ণ সতর্কতা গ্রহণ করেই কাজ করব।”
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর