২০২১ সালের জুলাই মাস, ঘরে বানের জল ঢুকতেই যাবতীয় জিনিসপত্র ছেড়েছুড়ে পালিয়েছিলেন শুভাঙ্গী কাম্বলে। তবে হ্যাঁ, চৌকাঠ ডিঙোনোর সময় চটজলদি নোটবই দুটি তুলে নিতে ভোলেননি কিন্তু।
এরপর কেটে যায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, ১৭২ পাতার এই দুটি নোটবইয়ের সাহায্যে অগুনতি প্রাণ রক্ষা পায় শুভাঙ্গীর দৌলতে।
কারণ ততদিনে মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার অর্জুনওয়াড়, অর্থাৎ শুভাঙ্গীর নিজের গ্রামখানি জেরবার হয়ে উঠেছিল অন্য একটি দুর্যোগের প্রকোপে। হুহু করে বেড়ে চলেছিল কোভিড-১৯ সংক্রমণ। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য তাঁর নোটবইয়ের পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছিলেন শুভাঙ্গী — রোগীর ফোন নম্বর, ঠিকানা, রোগীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিবরণ, তাঁদের মেডিক্যাল হিস্ট্রি, স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ইত্যাদি।
এই ৩৩ বছর বয়সি স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মীটি (আশা) জানালেন: “কোভিডের [গ্রামে হওয়া আরটি-পিসিআর পরীক্ষার] রিপোর্টগুলো প্রথমে আমার কাছে আসত।” ২০০৫ সালে ভারতের জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় ওঁর মতো আরও ১০ লাখ মহিলা নিযুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী রূপে। গাঁয়ের এক কোভিড-সংক্রমিত ব্যক্তি যে শিরোল তালুকের বন্যাত্রাণ শিবিরে গিয়ে উঠেছেন, এবং তাঁর থেকে ন্যূনতম আরও ৫০০০ জন মানুষও যে কোভিডে আক্রান্ত হতে পারে, শুভাঙ্গীর নোটবই থেকেই তাঁর হদিশ মিলেছিল।
“বানের ফলে প্রচুর লোকের ফোন বন্ধ, কিংবা সংযোগের বাইরে,” বললেন তিনি। ততদিনে ১৫ কিলোমিটার দূর তেরওয়াড়ে নিজের মায়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন শুভাঙ্গী। সাত তাড়াতাড়ি নিজের হাতে-লেখা তথ্য ঘেঁটে এমন কয়েকজনের ফোন নম্বর বার করেন, যাঁরা উপরোক্ত রোগীটির সঙ্গে সেই শিবিরেই আশ্রয় নিয়েছেন। “যেনতেনপ্রকারেণ ওই রোগীটির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।”
এছাড়াও তিনি কাছের আগার গ্রামের একটি কোভিড কেন্দ্রে একখান বেডের ইন্তেজাম করেন, রোগীটিকে সত্ত্বর নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। “নোটবইটা না আনতে পারলে, হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়ত,” জানালেন শুভাঙ্গী।
তবে এর আগেও যে শুভাঙ্গীর দৌলতে তাঁর গ্রাম কোনও মারাত্মক বিপদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, এমনটা ভুলেও ভাববেন না যেন! এর আগেও নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের (অগস্ট) বন্যার পর নিজের ভেঙে পড়া মাটির বাড়িটার দিকে না তাকিয়ে হাজির হয়েছিলেন কাজে। তাঁর কথায়: “গ্রাম পঞ্চায়েতের হুকুম মাফিক গ্রাম জুড়ে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটাই ঘুরে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।”
তারপর, তিন-তিনটে মাস ধরে গ্রামের এ প্রান্ত হতে সে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে বন্যাক্রান্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন শুভাঙ্গী, স্বচক্ষে দেখেছিলেন প্লাবনের তাণ্ডব। এসব দেখা ও শোনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ১,১০০টিরও অধিক তছনছ হয়ে যাওয়া গেরস্থালি নিরীক্ষণ করতে গিয়ে জেঁকে ধরে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ।
“নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারতাম না,” বললেন তিনি, “কিন্তু, আর কোনও উপায় আদৌ ছিল?”
সেই বছর বন্যা থেকে সৃষ্ট মানসিক ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই ২০২০ সালের কোভিড মোকাবিলায় নেমে পড়েন শুভাঙ্গী। তারপর আসে ২০২১ সালের জুলাই মাসের বান, আবারও জুটে যান ত্রাণকার্যে, ওদিকে অতিমারির তাণ্ডব তখনও অব্যাহত। তাঁর কথায়: “বন্যা ও কোভিডের দ্বৈরথে এমন একটা বিপর্যয়ের জন্ম হয়, যেটা আমরা কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি।”
দিনের পর দিন অবহেলা সয়ে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের ভঙ্গুর অবস্থাটা অচিরেই দেখা দেয় একাধিক উপসর্গের মাধ্যমে।
এপ্রিল ২০২২, পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে একই সঙ্গে তিনি নিউমোনিয়া ও মাঝারি মাত্রার রক্তাল্পতার শিকার: “টানা আটদিন জ্বর-জ্বর ভাব নিয়ে কাটল, কিন্তু কাজের এমনই চাপ যে উপসর্গগুলোর দিকে পাত্তা দিতে পারিনি।” রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে কমতে ৭.৯-এ এসে ঠেকে, অর্থাৎ নারীদেহে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেকখানি কম। তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।
দুমাস পর, উনি যখন ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন, আবারও তাঁর গাঁয়ে নেমে আসে অতিবর্ষণের করাল ছায়া — পানির স্তরের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে শুভাঙ্গীর মানসিক চাপ। “এককালে চাতক পাখির মতো বৃষ্টির জন্য হাঁ করে থাকতাম, আর এখন বৃষ্টি নামলেই বানের ভয়ে অস্থির হয়ে যাই,” জানালেন তিনি, “এবছর অগস্টে এত তাড়াতাড়ি জলের স্তর বাড়ছিল যে বেশ কয়েকদিন দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। [পড়ুন: উদ্বেগ ও অবসাদে দিশাহারা কোলাপুরের খেলোয়াড়েরা ]
নিরন্তর চিকিৎসা সত্ত্বেও শুভাঙ্গীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব একটা বাড়েনি, এছাড়াও মাথা ঘোরা ও ক্লান্তির উপসর্গের কথা জানালেন তিনি। তা সত্ত্বেও বিশ্রাম বা সুস্থ হওয়ার কোনও অবকাশ চোখে পড়ছে না: “আশাকর্মী হওয়ায় নিজেদের নাভিশ্বাস উঠে গেলেও সহায়ক ব্যবস্থা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের।”
*****
২০২১ সালের সেই প্লাবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মনে রেখেছেন শিরোলের গণেশওয়াড়ি গ্রামের আশাকর্মী ছায়া কাম্বলে (৩৪): “ত্রাণের নৌকাটা তো আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে ভাসছিল।”
বানের পানি নামতে না নামতেই, শুভাঙ্গীর মতো তিনিও কাজে ফিরে যান, নিজের ঘরদোরের কথা ভাববার সময়টুকুও ছিল না। ছায়ার কথায়: “আমরা সব্বাই [গণেশওয়াড়ির ছয়জন আশাকর্মী] প্রথমে উপকেন্দ্রে গিয়ে উঠলাম।” আসল উপকেন্দ্রটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই এক গ্রামবাসীর ঘরেই অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করেন তাঁরা।
“প্রতিদিনই নিউমোনিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, চর্মরোগ, জ্বর, আরও নানান অসুখ নিয়ে লোকে আসত [উপকেন্দ্রে]।” আস্ত একটা মাস জুড়ে চলেছিল এই কর্মযজ্ঞ, মাঝে একদিনও ছুটি পাননি কেউ।
“সব্বার চোখে জল দেখলে মনের উপর বড্ড চাপ পড়ে,” বলে উঠলেন ছায়া, “দুঃখের কথা এইটাই যে আমাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার নামগন্ধও নেই কোথাও। বলুন দেখি, আমরা কেমন করে সুস্থ হব?” শেষমেশ সেটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।
মানসিক উৎকণ্ঠার মাত্রা বাড়তে বাড়তে কদিন পরেই শ্বাসকষ্ট হয়ে দেখা দিল। “আমি পাত্তা দিতাম না, মনে হত ওসব শুধুই কাজের চাপ থেকে হচ্ছে।” মাস কয়েকের মধ্যেই হাঁপানি ধরা পড়ল ছায়ার। “ডাক্তারবাবু বললেন যে অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকেই এটা হয়েছে,” জানালেন তিনি। চাপ ও শ্বাসকষ্টের মধ্যে যে সত্যিই যোগসূত্র রয়েছে, অসংখ্য গবেষণায় উঠে এসেছে সে কথা।
ওষুধে খানিক কাজ দিচ্ছে ঠিকই, তবে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তা লেগেই আছে তাঁর। যেমন এই বছর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ উষ্ণ প্রবাহের সময় থেকে থেকে মাথা ঘুরতো ছায়ার, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হত।
“ওই সময়টা কাজে বেরিয়ে সবচাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছি। মনে হত গায়ের চামড়াটা যেন জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে,” মনে করে বললেন ছায়া। গবেষণায় পাওয়া গেছে, তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে তার প্রভাব এসে পড়ে আমাদের মননে , এমনকি আত্মহত্যার হার, হিংসা এবং তিরিক্ষি মেজাজ — এগুলিও বেড়ে যায়।
আশাকর্মীদের মধ্যে ছায়ার মতো উপসর্গের কথা আরও অনেকেই জানালেন। কোলাপুর-ভিত্তিক ক্লিনিকাল মনোবিজ্ঞানী শাল্মলী রানমালে-কাকাডের কথায়: “এটা মোটেও এমন কিছু বিরল নয়। এগুলো সিজন্যাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের [এসএডি] উপসর্গ।”
এসএডি রোগটি একপ্রকারের অবসাদ, যা ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে এসে হাজির হয়। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে এর উপসর্গগুলি মূলত উচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত দেশগুলিতেই লক্ষ্য করা যায়, এবং সেটাও শীতকালে, তবে ভারতের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশেও এটি বিদ্যমান — বর্তমানে এই ব্যাপারে সচেতনতাও বেড়েছে।
“আবহাওয়া বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার উদ্বেগও শুরু হয়ে যায়; মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে। আতা মালা আজিবত সহন হোইনা ঝালাই [আর সহ্য করতে পারছি না],” বলে উঠলেন শুভাঙ্গী। “বন্যায় আক্রান্ত প্রত্যেক আশাকর্মীই কোনও না কোনও ধরনের মানসিক চাপ নিয়ে ঘর করছে, যেটার থেকে জন্ম নিচ্ছে গুরুতর সব রোগজ্বালা। আমরা এতো মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছি, অথচ সরকার আমাদের জন্য কুটোটাও নাড়ে না।”
স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যে একেবারেই এ সমস্যাটার তোয়াক্কা করেন না, তা নয় হয়তো, তবে এই বিষয়ে তাঁরা যে কতটা নড়েচড়ে বসেছেন, বা সেটা আদৌ কার্যকর কিনা, এ বিষয়ে হাজার একটা প্রশ্ন রয়েই যায়।
পাশেই বন্যা বিধ্বস্ত হাটকানঙ্গলে তালুকের স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ প্রসাদ দাতার জানালেন যে প্লাবন ও কোভিডের যুগ্ম আঘাতে এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর্মীদের “অতিরিক্ত খাটতে হচ্ছে এবং তাঁরা মানসিক রূপে উদ্বিগ্ন।” সঙ্গে একথাও বললেন: “এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে ফি বছর আশাকর্মীদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি।”
তবে কোলাপুরের শিরোল তালুকে কর্মরত আশাকর্মীদের সংগঠনের নেত্রী নেত্রদীপা পাতিলের বিশ্বাস, এই জাতীয় অনুষ্ঠান কোনও কম্মের নয়। তাঁর কথায়: “কর্তৃপক্ষের কাছে মানসিক বিপদ-আপদের কথা জানাতে গেলে তাঁরা এইটা বলেই উড়িয়ে দিলেন যে এসব পরিস্থিতি কেমনভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেটা নাকি আমাদেরকেই শিখতে হবে।”
রানমালে-কাকাডের বক্তব্য, নিরন্তর মানসিক চাপ কাটাতে থেরাপি ও কাউন্সিলিং দরকার আশাকর্মীদের: “অন্যের তরে যে হাত এগিয়ে আসে, তার নিজেরও তো সাহায্যের দরকার। দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে ওমনটা কক্ষনো হয় না।” উপরন্তু সামনের সারির বেশ কিছু স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ‘সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে’ এতটাই উদগ্রীব যে নিজেদের ক্লান্তি, হতাশা ও আবেগজাত চাপের কথা তাঁদের নিজেদেরই অগোচরে রয়ে যায়।
তড়িৎগতিতে পাল্টাতে থাকা স্থানীয় জলবায়ুর নকশার মতো বেশ কয়েকটি জিনিস রয়েছে যার ফলে ঘুরেফিরে প্রকট হয় মানসিক চাপ। তাঁর মতে হস্তক্ষেপের মাত্রা ও পরিমাণ না বাড়ালে এটার সঙ্গে মোকাবিলা করা যাবে না।
*****
দ্রুত অবনতি ঘটছে কোলাপুরের আশাকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের, এবং এটার পিছনে একাধিক ভূমিকা পালন করে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তন।
কাজের মারাত্মক চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক আশাকর্মী গ্রাম-পিছু ১০০০ জন মানুষের জন্য ৭০টিরও বেশি প্রকারের স্বাস্থ্যসেবা সামলান — যেমন নিরাপদ গর্ভাবস্থা এবং সর্বজনীন টিকাদান নিশ্চিত করা। অথচ এই জাতীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মজুরিও খুব অল্প, পদে পদে শোষিতও হন তাঁরা।
নেত্রদীপা জানালেন, মহারাষ্ট্রে আশাকর্মীদের মোটে ৩,৫০০-৫,০০০ টাকা দেওয়া হয় প্রতি মাসে, উপরন্তু বেতন পেতে পেতে মাস তিনেক দেরি তো হয়ই: “আজও আমাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেই গণ্য করা হয়, যে কারণে ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত কোনও সুযোগ-সুবিধাই পাই না।” সরকারি কথায় আশাকর্মীদের যেটা দেওয়া হয় সেটা কেবলই ‘কাজভিত্তিক ইনসেন্টিভ’, অর্থাৎ নিজ নিজ সমাজে বিশেষ কিছু দ্বায়িত্ব সামলালে তবেই মজুরি মেলে। বাঁধাধরা কোনও পারিশ্রমিক নেই, এবং সেটাও একেক রাজ্যে একেক রকম।
শুধুমাত্র নিজ নিজ সমাজের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা মিটিয়ে যেটুকু মজুরি মেলে, অসংখ্য আশাকর্মীদের পক্ষে ওইটুকুর ভরসায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ শুভাঙ্গীর কথাটাই ভাবুন, নুন আনতে যাতে পান্তা না ফুরোয়, বাধ্য হয়ে সেজন্য তিনি খেতমজুরিও করেন।
“২০১৯ আর ২০২১ সালের বন্যার পর তিনমাস কোনও কামকাজ জোটেনি, খেতগুলো সব তছনছ হয়ে গেছিল,” বললেন তিনি। “জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিটাও খাপছাড়া হয়ে গেছে। অল্প একটুক্ষণের জন্য বৃষ্টি পড়লেও সবকিছুর বারোটা বাজে, খেতমজুরির কাজ পাওয়ার আশাটুকুও ধুয়েমুয়ে সাফ হয়ে যায়।” জুলাই ২০২১-এর ভারি বর্ষণ ও প্লাবনের ফলে কোলাপুর সহ মহারাষ্ট্রের ২৪টি জেলা জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৪.৪৩ লাখ হেক্টর জমি, ছারখার হয়ে যায় ফসল।
২০১৯ থেকে ঘনঘন বন্যা, নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পত্তি ও কৃষিকাজে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির ফলে একাধিক মহাজনের থেকে চড়া-সুদে অল্প অল্প করে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন শুভাঙ্গী — এ অবধি তাঁর কর্জের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ১,০০,০০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। যেটুকু সোনাদানা ছিল সেসব তো বন্ধক রেখেইছেন, উপরন্তু ঘরদোর সারানোর মতো ট্যাঁকের জোর না থাকায় বাধ্য হয়েছেন ১০ হাত বাই ১৫ হাতের একখান টিনের ঝুপড়িতে এসে মাথা গুঁজতে।
তাঁর স্বামী সঞ্জয়ের কথায়: “২০১৯ আর ২০২১, দুবারই ৩০ ঘণ্টার মধ্যে বানের পানি ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতর। একটা কুটোও বাঁচাতে পারলাম না।” খেতমজুরির বাজারে বড়ো মন্দা, তাই রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করতে বাধ্য হয়েছেন ৩৭ বছর বয়সি সঞ্জয়।
নিজের যতই ক্ষতয়ক্ষতি হোক না কেন, সে যতই কষ্ট হোক, শুভাঙ্গীর বেশিরভাগ সময়টাই বেরিয়ে যেত আশাকর্মীর দায়-দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে।
প্লাবনের ফলে কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা খতিয়ে তো দেখেইছেন, এছাড়াও যাতে জলবাহিত রোগজ্বালা না ছড়াতে পারে, তার জন্য পানীয় জলের উৎসগুলিকে জীবাণুমুক্ত করার দায়িত্বটা সেই আশাকর্মীদের ঘাড়েই এসে পড়ে। নেত্রদীপার কথায়, এ জাতীয় কাজগুলির অধিকাংশই ছিল বেগার খাটনি: “বন্যার পর ত্রাণকার্যে নেমে নানান মানসিক জটিলতার মুখোমুখি হয়েছি আমরা, অথচ একটা কড়িও মেলেনি। পুরোটাই বিনিপয়সাও মেহনত।”
শুভাঙ্গীর কথায়, “প্রতিটা ঘরে ঢুঁ মারতে হত, কারও শরীরে জলবাহিত বা কীটবাহিত (ভেক্টর-বোর্ন) রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে কিনা, সেসব লিখে রাখতাম। সময়মতো চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন আশাকর্মীরা।”
অথচ এবছর এপ্রিলে তিনি নিজে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, প্রশাসনের তরফ থেকে সাহায্য মেলেনি বললেই চলে: “জনস্বাস্থ্যসেবী কর্মী হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য ২২,০০০ টাকা খুইয়ে বেসরকারি হাসপাতালের চৌকাঠ ডিঙোতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ তক্ষুনি ভর্তি করতে হত আমায়, আর সরকারি হাসপাতালে শুধু ওষুধপত্র লিখে দিয়েই হাত ধুয়ে ফেলছিল।” জন উপকেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট পান বটে, কিন্তু মাস-গেলে ওষুধপাতির পিছনে অতিরিক্ত ৫০০ করে টাকা না খসিয়ে উপায় নেই তাঁর।
আশাকর্মীর কাজে মাসিক ৪,০০০ টাকা পান ছায়া, তবে শুধু ওষুধের পিছনেই বেরিয়ে ৪০০ টাকা, যেটা কিনা তাঁর পক্ষে অসম্ভবের সামিল। অসহায় এই স্বাস্থ্যকর্মীর কথায়: “শেষমেশ এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি যে আমরা সমাজকর্মী। তাই জন্যই বোধহয় এমন জ্বলেপুড়ে মরতে হচ্ছে।”
পাণ্ডববর্জিত এলাকার জনসমাজের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সংযোগ ঘটিয়ে তাঁরা স্বাস্থ্যসেবা এনে দেন হাতের মুঠোয় — তাই ২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেল্থ লিডার অ্যাওয়ার্ডের দ্বারা সম্মানিত করে আশাকর্মীদের। “গর্বটা আমাদের প্রত্যেকেরই,” বলে উঠলেন ছায়া, “কিন্তু যখনই দেরি করে পাওয়া নামমাত্র মজুরির নালিশ ঠুকি ঊর্ধ্বতনদের কাছে, তাঁরা বলেন যে আমরা নাকি মানবসমাজের জন্য মারাত্মক একখান মহৎ কর্ম করছি — পেমেন্ট চাঙ্গরা নহি মিলত, পন তুমহালা পুণ্য মিলতে [ঠিকঠাক পারিশ্রমিক মিলছে না বটে, তবে মানুষের আশীর্বাদ পাচ্ছ],’ এসব বলেই ক্ষান্ত থাকেন তাঁরা।”
তবে হ্যাঁ, জলবায়ু পরিবর্তন কেমনভাবে সামনের সারির এই সকল কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে, একটি সংক্ষিপ্ত নীতির দ্বারা তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ডাব্লিউএইচও: “বিধ্বংসী আবহাওয়াজনিত ঘটনার পর অবসাদ, উদ্বেগ ও মানসিক চাপের মতো অসুখ দেখা দেয় — এই বিষয়টি উঠে এসেছে রিপোর্টে।”
খামখেয়ালি আবহাওয়া, কাজের পরিবেশে ক্রমশ অবনতি এবং তাঁদের অবস্থার প্রতি প্রশাসনিক অবহেলার ফলে আশাকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে — একথা স্পষ্ট হয়ে উঠল নেত্রদীপার কথায়: “এবছরের উষ্ণ প্রবাহগুলি জরিপ করতে গিয়ে আমাদের অনেকেই ত্বকের অসুখ, জ্বালা-জ্বালা ভাব ও ক্লান্তির অভিযোগ এনেছেন। আমাদের কাউকেই কোনও সুরক্ষা সরঞ্জাম দেয়নি।”
পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিকাল মেটিরিওলজিতে (আইআইটিএম) কর্মরত জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি কোল জোর দিলেন ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ বা ‘জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনার’ প্রয়োজনীয়তার উপর, যেখানে এটা স্পষ্টভাবে বলা থাকবে যে দিনের ঠিক কোন সময়টায় উষ্ণ প্রবাহ ও দুর্যোগের প্রভাব সবচাইতে অধিক। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের আন্তঃসরকারি প্যানেল যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে, সেখানেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর বক্তব্য: “আগামী বেশ কয়েক বছর তথা দশক জুড়ে মরসুমি পূর্বাভাস রয়েছে আমাদের কাছে। সুতরাং কোন এলাকায় আর দিনের কোন সময়ে খোলা রোদে কর্মীদের বেরোনো অনুচিত, সেটা সঠিক করা বলা অবশ্যই সম্ভব। এই কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। যাবতীয় তথ্য সব ইতিমধ্যেই আছে আমাদের কাছে।”
তবে, এই বিষয়ে কোনও সরকারি নীতি বা প্রচেষ্টার নামগন্ধও নেই, অগত্যা নিজেরাই নিজেদের মতো করে এই জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বাধ্য হচ্ছেন আশাকর্মীরা। শুভাঙ্গীর দিনগুলো তাই শুরুই হয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে। তাঁর কথায়: “দায়-দায়িত্ব তো আর এড়াতে পারব না, অন্তত সারাদিনের রোদ-জল-ঝড়-ঝাপ্টার মুখোমুখি হওয়ার জন্য যেন নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি।”
ইন্টারনিউজের আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক সমর্থিত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সহায়তায় রচিত একটি সিরিজের অংশ হিসেবে প্রতিবেদক এই নিবন্ধটি লিখেছেন।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)