গোটা একটা রাত্তির শান্তিতে ঘুমোতে পারাটা নেহাত অধরা একটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার শীলা ওয়াঘমারের কাছে।
"কত বছর হয়ে গেল...দুচোখের পাতা এক করতে পারি না রাত্তিরে," বললেন শীলা (৩৩), গোধাডি (কাঁথা) পাতা মেঝের উপর পা মুড়ে বসে থাকা মানুষটার চোখ জুড়ে শুধুই যেন অতল যন্ত্রণার লালচে আভা। কান্না চেপে ঘুমহীন রাতের কথা বলতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল শরীরটা। "সারারাত হাপুস নয়নে কাঁদি... মনে হয়... মনে হয় কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে।"
মহারাষ্ট্রের বীড জেলার সদর শহর থেকে ১০ কিমি দূরে রাজুরি ঘোড়কা গ্রামে থাকেন তিনি। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ইটে গাঁথা দু-কামরার একটা বাড়ি। মাঝরাতে তাঁর ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দে ঘুম ছুটে যায় স্বামী মানিক এবং তিন সন্তান - কার্তিক, বাবু, ঋতুজার। "আমার কান্নার চোটে ওদেরও ঘুমের বারোটা বাজে। তারপর চোখ টিপে পড়ে থাকি যদি ঘুম আসে।"
না আসে ঘুম, না থামে চোখের জল।
"দুঃখে দুশ্চিন্তায় জেরবার হয়ে থাকি সারাটা সময়," বলেই খানিক দম নিয়ে নিলেন, কেমন যেন বিরক্ত শোনাচ্ছিল তাঁকে। "আমার পিশভিটা (জরায়ু) কেটে বাদ দেওয়ার পর থেকেই এসব শুরু হয়েছে। জীবনটা কেমন বদলে গেল যেন, চিরকালের জন্য।" ২০০৮ সালে যখন তাঁর হিস্টেরেক্টমি হয়, তখন তাঁর বয়স মোটে কুড়ি। তারপর থেকেই কুঁকড়ে ওঠা দুঃখ আর ঘুমহীন রাতের পাল্লায় পড়েছেন তিনি, আর রয়েছে সারা শরীর জুড়ে ব্যথা, একবার জেঁকে ধরলে চট করে পিছু ছাড়ে না। এছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ মেজাজটা কেমন যেন অকারণে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে।
"মাঝেমধ্যেই অকারণে বাচ্চাদের উপর রেগে যাচ্ছি। ওরা হয়ত আদর করেই কিছু একটা বলল, অথচ না চিল্লিয়ে আমি থাকতেই পারি না," অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলেন শীলা, "চেষ্টা-চরিত্তির কম করি না গো। আপ্রাণ চেষ্টা করি মেজাজটা বেঁধে রাখতে। কেন যে এমন খেপে যাই, ভেবেই পাই না।"
মোটে ১২ বছর বয়েসে মানিকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। ১৮ বছর না হতেই তিন সন্তানের মা হয়ে পড়েন।
ছ'মাস জুড়ে চলতে থাকা আখ কাটার মরসুমে মারাঠওয়াড়া অঞ্চল থেকে শীলা এবং মানিকের মতো আনুমানিক ৮ লাখ উস-তোড় কামগার (আখ-কাটাইকারী মজুর) গিয়ে ওঠেন মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের আখের খেতে, অক্টোবর থেকে মার্চ অবধি সেখানেই বাসা বাঁধেন তাঁরা। নিজের বলতে যেহেতু একচিলতে জমিও নেই, তাই বছরের বাকিটা রাজুরি ঘোড়কা বা তার আশেপাশের গ্রামে খেতমজুরি করেই কাটান এই দম্পতি। দুজনেই নববৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ।
হিস্টেরেক্টমির পর থেকে শীলা উপর দিয়ে যে ঝড়টা বইছে, মহারাষ্ট্রের এই এলাকায় সেটা ব্যতিক্রম নয়। বীডের মহিলা আখ-কাটাইকারীদের মধ্যে হিস্টেরেক্টমির এমন হিড়িক দেখে ২০১৯ সালে সাত-সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজ্য সরকার, তাঁরা আবিষ্কার করেন যে ওই মহিলাদের প্রায় প্রত্যেকেই এই জাতীয় শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগের শিকার।
এই কমিটির শীর্ষে ছিলেন মহারাষ্ট্রের বিধান পরিষদের তৎকালীন স্পিকার ডাঃ নীলম গোর্হে। ২০১৯ সালের জুন-জুলাই মাসে তাঁরা বীড জুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে এমন ৮২,৩০৯ জন মহিলাকে খুঁজে পান যাঁরা একটিবারের জন্য হলেও আখ কাটতে ঘরদোর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন দূর-দূরান্তে। দেখা যায় যে এঁদের মধ্যে ১৩,৮৬১ জনেরই জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, অধিকন্তু ৬,৩১৪ জন, অর্থাৎ ৪৫ শতাংশেরও বেশি মহিলা অস্ত্রোপচারের পর থেকে নিদ্রাহীনতা, অবসাদ, আত্মঘাতী চিন্তাভাবনা, গাঁটে ব্যথা, পিঠের যন্ত্রণা ইত্যাদি নানান মানসিক ও শারীরিক সমস্যার সঙ্গে যুঝছেন।
হিস্টেরেক্টমি নামক প্রক্রিয়াটি যে আদতে কতটা জটিল সেটা জানতে পারলাম ডাঃ কোমল চভনের থেকে। নারীর স্বাস্থ্যের উপর এর বিরূপ প্রভাব একাধারে স্বল্পমেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী। মুম্বই নিবাসী এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ভি.এন. দেসাই পৌর জেনারেল হাসপাতালের সাথে পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত। তাঁর কথায়: "চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা একে সার্জিকাল রজোবন্ধ (মেনোপজ) বলি।"
অস্ত্রোপচার-পরবর্তী বছরগুলোয় ধাপে ধাপে বাড়তে থেকেছে শীলার যন্ত্রণার ফিরিস্তি – গাঁটে ব্যথা, মাথাব্যথা, পিঠব্যথা এবং নাছোড়বান্দা সে এক ক্লান্তি। "দিন দুই-তিন ছাড়া ছাড়া কোনও না কোনও একটা যন্ত্রণা উড়ে এসে জুড়ে বসে," বললেন তিনি।
ব্যথা কমার মলম আর বড়ি খেয়ে রেহাই মেলে বটে, তবে সেটা নিতান্তই সাময়িক। "এই যে, এই মলমটা হাঁটু আর পিঠব্যথা হলে লাগাই। মাসে দু-দুটো টিউব খরচা হয়," ১৬৬ টাকা দামের এক-টিউব ডাইক্লোফেনাক জেল তুলে দেখালেন তিনি। এছাড়াও কিছু বড়ি বাতলেছেন ডাক্তার। ক্লান্তি দূর করার জন্য প্রতিমাসে দুবার করে ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ চালিয়ে গ্লুকোজ ইনফিউশন নিতে হয় শীলাকে।
ডাক্তার দেখানো থেকে ওষুধপত্র, সবকিছুর জন্যই বাড়ি থেকে এক কিমি দূরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে যান তিনি, মাস গেলে ১,০০০-২,০০০ টাকার ধাক্কা। বীডের সরকারি হাসপাতালটা তাঁর গ্রাম থেকে পাক্কা ১০ কিমি দূরে, ফলত বেসরকারি এই ডাক্তারখানাটাই একমাত্র ভরসা। ওঁর কথায়: "[গাড়িঘোড়ার পিছনে] এককাঁড়ি খরচা করে অতদূর পথ ঠেঙিয়ে কে যাবে শুনি?"
তবে এই ওষুধগুলোর একটাও কিন্তু মানসিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কাজে লাগে না। "আসা সাগলা ত্রাস আসলিয়াভর কা মাহনুন জাগাভা ভাতেল? [এতকিছু ঝড়ঝাপ্টা সামলে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় আদৌ?]"
মুম্বই নিবাসী মনোবিজ্ঞানী ডাঃ অবিনাশ ডি সুজার থেকে জানা গে'ল যে হিস্টেরেক্টমির ফলে হরমোন-তন্ত্রে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়, তাই শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াও তৈরি হয় মানসিক অবসাদ ও উৎকণ্ঠা। তবে হিস্টেরেক্টমি কিংবা অকার্যকর ডিম্বাশয়ের সঙ্গে জড়িত অসুস্থতার মাত্রায় তারতম্য লক্ষ্য করা যায়, এটাও জানালেন তিনি: "একেকজন রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেক রকমের হয়। কোনও কোনও মহিলার ক্ষেত্রে উপসর্গ মারাত্মক, আবার কারও হয়ত কিছুই হয় না তেমন।"
অস্ত্রোপচার হয়েছে বটে, তবে মানিকের সঙ্গে আখ কাটতে পশ্চিম মহারাষ্ট্রে যাওয়া কিন্তু বন্ধ হয়নি তাঁর। সাধারণত বীড থেকে ৪৫০ কিমি দূরে কোলহাপুরের একটি আখ-মাড়াই কারখানায় সপরিবারে গিয়ে ওঠেন শীলা।
সার্জারির আগের দিনগুলোর কথা মনে করছিলেন তিনি: "এককালে দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে প্রায় দুই টন আখ কাটতাম।" কেটে বাণ্ডিল বাঁধা আখের প্রতি টনের জন্য 'কোয়টা' পিছু ২৮০ টাকা পেতেন তাঁরা। 'কোয়টা' শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাঁকানো কাস্তে, অর্থাৎ প্রায় ৭ ফুট লম্বা শক্ত আখ কাটতে যে হাতিয়ারটা এঁরা ব্যবহার করেন। তবে চলতি ভাষায় এ শব্দটার মানে আখ-কাটাইকারী দম্পতি। অগ্রিম বাবদ কিছুটা থোক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে এরকমই জোড়ায় জোড়ায় মজুর নিয়োগ করে ঠিকেদারের দল।
"ছয়মাস বাদে দেখা যেত যে ৫০-৭০ হাজার টাকা এসেছে হাতে," বললেন শীলা। তবে জরায়ুটা বাদ যাওয়ার পর থেকে দিনে এক টন আখ কেটে বাণ্ডিল বানাতেও নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন ওয়াঘমারে দম্পতি। "না পারি ওজন বইতে, না পারি আগের মতো ঝটাঝট আখ কাটতে।"
২০১৯ সালে ঘরদোর মেরামত করাবেন বলে বাৎসরিক ৩০ শতাংশ সুদে মোট মজুরির থেকে ৫০,০০০ টাকা অগ্রিম চেয়ে নিয়েছিলেন শীলা ও মানিক। অতএব সেটা যতক্ষণ না শোধ হচ্ছে, কামকাজ থামানো এককথায় অসম্ভব তাঁদের পক্ষে। "যতদূর দুচোখ যায়, শেষ দেখি না কোনও," হতাশ মুখে বলে উঠলেন শীলা।
*****
মহিলাদের পক্ষে মাসিকের সময়টা সবচেয়ে কষ্টের, আখের খেতে হাড়ভাঙা এই খাটুনি যেন আরোই অসহ্য হয়ে ওঠে। মাঠে না আছে কোনও শৌচাগার, না আছে শৌচালয়, থাকার বন্দোবস্তটাও সেরকম নাম-কে-ওয়াস্তে। কখনও কখনও বাচ্চাকাচ্চা সমেত এসে হাজির হন কোয়টারা, তাঁবু গেড়ে থাকেন খেত আর আখ-মাড়াই কলের কাছেই। "পালির [ঋতুস্রাব] সময় কাজ করাটা সবচাইতে কষ্টের," আজও সেকথা ভোলেননি শীলা।
একটা দিন ছুটি নিলেও মাশুল গুনতে হয়, দিনের পুরো মজুরিটাই গিলে খায় মুকাদম (ঠিকেদার)।
পুরোনো সুতির সায়া কেটে, কাপড়ের প্যাড বানিয়ে, সেটাই পরে কাজে যান মহিলা আখ-কাটানির দল, জানালেন শীলা। টানা ১৬ ঘণ্টা খাটতে হয়, প্যাড বদলানোর ফুরসৎটুকুও মেলে না। "দিনের শেষে কাজকম্ম সব সামলে ওটা বদলাতাম। রক্তানে পুর্ণা ভিজুঁ রক্তা টপক্যাচে কাপড়্যাতুঁ [রক্তে ভিজে লেপটে যায়, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়াতে থাকে]।"
না আছে শৌচব্যবস্থার নামগন্ধ, না আছে কাপড়ের প্যাডগুলো ধোওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জল, এমনকি ওগুলো শোকানোর জায়গাটুকুও জোটে না। ফলত উনি বাধ্য হতেন ভিজে প্যাডগুলোই বারবার ব্যবহার করতে। "দুর্গন্ধ বেরোত বটে, কিন্তু চারিদিকে মরদ যে, খোলামেলা রোদের নিচে শুকোতেও তো পারতাম না।" স্যানিটারি প্যাড সম্পর্কে ওঁর কোনও ধারণাই ছিল না। "মেয়ের মাসিক শুরু হওয়ার আগে অবধি ওসবের নাম শুনিনি," বলছিলেন শীলা।
১৫ বছর বয়েসী ঋতুজার জন্য স্যানিটারি প্যাড কিনে দেন তিনি। "আমি চাই না যে আমার মেয়েটা ওর শরীরস্বাস্থ্য নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিক।"
মহিলা চাষিদের অধিকারের জন্য লড়তে থাকা পুণে-কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ মাকামের ২০২০ সালে মহারাষ্ট্রের আটটি জেলায় ঘুরে ঘুরে ১,০৪২ জন আখ-কাটাইকারী মহিলাদের কথা একটি সমীক্ষা রূপে প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে যে এই মহিলাদের ৮৩ শতাংশ মাসিক চলাকালীন কাপড়ের প্যাড ব্যবহার করেন। এই জাতীয় প্যাড ধোওয়ার জন্য যে জলটুকু দরকার, সেটা এঁদের মধ্যে মোটে ৫৯ শতাংশের নাগালে রয়েছে। শেষমেশ তাই ২৪ শতাংশ বাধ্য হন রক্তে ভেজা প্যাড বারংবার ব্যবহারে।
এ হেন চরম অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং যন্ত্রণাদায়ক ঋতুস্রাবের মতো স্ত্রীরোগ দেখা দেয়। "তলপেটে হামেশাই ব্যথা হত, যোনি দিয়ে থিকথিকে সাদাস্রাব বেরোত," বলছিলেন শীলা।
তবে ডাঃ চভনের মতে ঋতুসংক্রান্ত অপরিচ্ছন্নতার ফলে এ ধরনের সংক্রমণ খুব একটা আনকোরা তো নয়ই, বরং সাধারণ ওষুধ দিয়ে সারিয়েও তোলা যায়: "প্রথমেই হিস্টেরেক্টমির কথা ভাবা ঠিক নয়, বরং ক্যান্সার, বেরিয়ে আসা জরায়ু (প্রোল্যাপসড্ ইউটেরাস) এবং ফাইব্রয়েডের মোকাবিলায় এটাই শেষ অস্ত্র।"
মহিলাদের পক্ষে মাসিকের সময়টা সবচেয়ে কষ্টের, আখের খেতে হাড়ভাঙা এই খাটুনি যেন আরোই অসহ্য হয়ে ওঠে। মাঠে না আছে কোনও শৌচাগার, না আছে শৌচালয়, থাকার বন্দোবস্তটাও সেরকম নাম-কে-ওয়াস্তে
শীলার পড়াশোনা বলতে তিনি নিজের নামটা মারাঠিতে লিখতে পারেন, সংক্রমণের চিকিৎসা সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই তাঁর। আর পাঁচজন মহিলা আখ-কাটাইকারীর মতো তিনিও বীড শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। ভেবেছিলেন ওষুধ-টষুধ পড়লে ব্যথাটাও সারবে, মাসিক চলাকালীন দিব্যি কাজও করতে পারবেন, সুতরাং ঠিকাদারকে আর মোটা টাকার জরিমানাও দিতে হবে না।
হাসপাতালে যেতেই সেখানকার এক ডাক্তার ক্যান্সারের ভয় দেখাতে শুরু করে। "না করল রক্তপরীক্ষা, না হল কোনও সোনোগ্রাফি। ফট্ করে বলে দিল যে আমার জরায়ুটা ফুটো ফুটো হয়ে গেছে। পাঁচ-ছ মাসের মধ্যেই আমি নাকি ক্যান্সারে মরে যাবো," স্মৃতিচারণ করছিলেন শীলা। ঘাবড়ে গিয়ে অস্ত্রোপচার করাতে রাজি হয়ে যান তিনি। "সেই দিনই, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওই ডাক্তারবাবু আমার কেটে নেওয়া পিশভিটা বরকে দেখিয়ে বললেন যে, 'দেখো, কেমন ফুটো ফুটো হয়ে আছে'," জানালেন শীলা।
সাত-সাতটা দিন হাসপাতালেই পড়েছিলেন তারপর। ৪০,০০০ টাকা গচ্চা যায় তাঁদের, তিলে তিলে জমানো টাকাপয়সা নিঃশেষ তো হলই, উপরন্তু বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের থেকেও ধার করতে বাধ্য হন।
আখ-কাটাইকারী শ্রমিকদের দুরবস্থা ঘোচাবেন বলে লড়াইয়ে নেমেছেন বীড নিবাসী সমাজকর্মী অশোক টাংড়ে, তিনি জানালেন: "এই ধরনের সার্জারির সিংহভাগটাই বেসরকারি হাসপাতালে হয়ে থাকে। কোনও অসুখবিসুখ নেই, অথচ হিস্টেরেক্টমির মতো এমন মারাত্মক অপারেশন থেকে পিছপা হন না ডাক্তাররা, এটা অত্যন্ত অমানবিক।"
সরকার-নির্ধারিত সেই তদন্ত কমিটি হলফ করে জানিয়েছে যে তাদের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মহিলাদের ৯০ শতাংশেরই সার্জারি হয়েছিল কোনও না কোনও বেসরকারি ক্লিনিকে।
সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে একটিবারের জন্যও জানানো হয়নি শীলাকে। তাঁর কথায়: "মাসিকের চক্কর খতম হল বটে, তবে যেভাবে বেঁচে আছি সেটাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলা যায় না।"
বীড জুড়ে মহিলা আখ-কাটিয়েদের সমবেত কণ্ঠে শোনা অভিজ্ঞতাগুলি যেন একসূত্রে বাঁধা – মাইনে কমার ভয়, ঠিকেদারের শোষণমূলক নিয়মের জ্বালা এবং ধান্দাবাজ বেসরকারি ডাক্তারের অত্যাচার, যারা মুনাফা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
*****
শীলার বাড়ি থেকে ছয় কিমি দূরে কাথোড়া গ্রাম, সেখানকার বাসিন্দা লতা ওয়াঘমারের জীবন-বৃত্তান্ত খুব একটা আলাদা নয়।
"বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করে না," জানালেন লতা (৩২), তাঁর গর্ভাশয়টিও ২০ বছর বয়সেই কেটে বাদ দেওয়া হয়।
"আমাদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসা বলতে কিসুই আর বাকি নেই," স্বামী রমেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা যে কতখানি তিতকুটে, সেটাই বোঝাচ্ছিলেন লতা। অস্ত্রোপচারের বছর খানেক হতে না হতেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সৃষ্টি হয় দূরত্ব, কথায় কথায় খিঁচিয়ে উঠতে থাকেন লতা।
"আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলেই ওকে ঠেলে সরিয়ে দিতাম," বলছিলেন তিনি, "ঝগড়াঝাঁটি, চিল্লামিল্লি লেগেই থাকত হরদম।" সহবাসের প্রতি লতার বাড়তে থাকা বিতৃষ্ণার ফলে চিরতরে ঘুচে যায় রমেশের কামনা-বাসনা। "মানুষটা আমার সঙ্গে আর ঠিক করে কথাও বলে না।"
ঘরকন্নার কাজ সামলে খেত-মজুরি করতে বেরোন লতা, এভাবেই একে একে দিনগুলি কাটে তাঁর। দৈনিক ১৫০ টাকার জন্য অন্যের জমিতে খেটে মরেন, সে নিজের গ্রামে হোক বা কাছেপিঠে কোথাও। হাঁটু আর পিঠের ব্যথায় জেরবার হয়ে থাকেন, থেকে থেকে তার দোসর হয়ে ঘুরেফিরে আসে মাথাব্যথা। ওষুধ বলতে অ্যালোপাথি বড়ি আর ঘরোয়া টোটকা। "আমাকে একটু বলবেন কীভাবে ওর কাছে ফিরে যাব?" কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি।
১৩ বছর বয়েসে বিয়ে করেছিলেন লতা, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মা হয়েছিলেন। সন্তানের নাম রেখেছিলেন আকাশ, সে ছেলে ক্লাস ১২ অবধি পড়েছে ঠিকই, তবে মা-বাবার পিছু পিছু সেও আজ পাড়ি দেয় আখের খেতে।
এরপর আকাশের একটি বোন হয়েছিল, কিন্তু পাঁচ মাস বয়সেই আখের খেতে একটি ট্রাক্টরের চাকায় পিষে মর্মান্তিক ভাবে প্রাণ হারায় সে। বাচ্চাকাচ্চার জন্য আলাদা করে কোনও বন্দোবস্ত থাকে না আখের খেতে, ফলত কোয়টা দম্পতিরা কাজ করার সময় বাধ্য হন খেতের মধ্যে ফাঁক-ফোঁকর দেখে কোলের শিশুকে ছেড়ে রাখতে।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে বীভৎস দুর্ঘটনার কথা মুখে আনতে পারলেন না লতা।
"কাজকম্ম করতে ইচ্ছে করে না গো, খালি মনে হয় গুমরে বসে থাকি," বলে উঠলেন তিনি। এ হেন অনিচ্ছার ফলে টুকিটাকি ভুলভ্রান্তি ঘটে হামেশাই। "একেক সময় স্টোভে দুধ বা সবজি চাপিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, সে উথলে উঠুক বা পুড়ে যাক, ভ্যাবলার মতো বসে থাকি কেবল।"
যে খেত অমন বেঘোরে কেড়ে নিয়েছে তাঁদের মেয়েকে, আখ-কাটার মরসুম এলে সে খেতের পানেই বছর বছর ছুটে যেতে বাধ্য হন লতা ও রমেশ।
একে একে তারপর তিনটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন লতা – অঞ্জলি, নিকিতা ও রোহিনী। মায়ের কোলে চেপে তারাও পাড়ি দিয়েছে আখের খেতে। থমথমে মুখে জানালেন লতা: "আমরা যদি কাজে না যাই, বাচ্চারা না খেয়ে মরবে। আর যদি কাজে যাই, তাহলে ওরা দুর্ঘটনায় মরবে। তফাৎটা কোথায় বলুন দেখি?"
অতিমারি এসে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গেল ইস্কুলের দরজায়, আর বাড়িতে স্মার্টফোন না থাকলে অনলাইন পড়াশোনার বালাই নেই, সুতরাং এক ধাক্কায় লেখাপড়া সব লাটে উঠল তাঁর মেয়েদের। ২০২০ সালে অঞ্জলির বিয়ে হয়ে যায়, এদিকে নিকিতা আর রোহিনীর জন্য ইতিমধ্যেই ছেলে দেখা শুরু হয়ে গেছে।
"সেভেন পর্যন্ত পড়েছি আমি," বলল নিকিতা। ২০২০ সালের মার্চে খেত-মজুরির কাজে হাতেখড়ি হয় এই কিশোরীর, মা-বাবার হাত ধরে শুরু হয় সে আখের খেতে যাওয়া। "পড়াশোনা করতে তো চাই, কিন্তু সেসবের পালা চুকে গেছে এখন। আমার বিয়ে দেবে বলে বাবা-মা উঠে পড়ে লেগেছে।"
আজ তিন বছর হতে চলল নীলম গোর্হের নেতৃত্বে সেই কমিটি তাদের সুপারিশ জানিয়েছে, অথচ সেসব রূপায়িত করতে আঠারো মাসে বছর লাগাচ্ছে সরকার বাহাদুর। পানীয় জল সরবরাহ, আখ-কাটাইয়ের কাজে নিযুক্ত মজুরদের জন্য খেতের ধারে শৌচাগার তথা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আবাসন বানানো – এমনতর হাজারটা নির্দেশ আজও কাগজের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব অবধি এসে পৌঁছতে পারেনি, জানালেন শীলা ও লতা দুজনেই।
"কীসের টয়লেট, কীসের ঘরদোর?" কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ যে আদৌ কোনওদিন বদলাবে, জোরগলায় সেকথা উড়িয়ে দিলেন শীলা। "যা ছিল সব তাই-ই আছে।"
এসব ছাড়াও আরেকটি পংক্তি ছিল সেই নির্দেশিকায় – আশাকর্মী ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নিযুক্তি দরকার যাঁরা আখ খেতের মহিলাদের হাজারটা স্বাস্থ্য-সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেন।
বীড জুড়ে মহিলা আখ-শ্রমিকদের সমবেত কণ্ঠে শোনা অভিজ্ঞতাগুলি যেন একসূত্রে বাঁধা – মাইনে কমার ভয়, ঠিকেদারের শোষণমূলক নিয়মের জ্বালা এবং মুনাফাখোর বেসরকারি ডাক্তারের অত্যাচার
লতাকে জিজ্ঞেস করলাম, গ্রামের আশাকর্মীরা ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন কিনা। "একটিবারের জন্য কারও দেখা পাইনি। দিওয়ালির পর ছ'টা মাস আখের খেতে কাটাই, ঘরদোর সব বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে।" কাথোড়ার একপ্রান্তে ২০টি দলিত পরিবারের বাস, এই নববৌদ্ধ পরিবারটি সেখানেই থাকে। অন্যান্য গ্রামবাসীদের থেকে ভেদাভেদ ছাড়া আর কিছুই পাননি তাঁরা, জানালেন তিনি: "চোখ তুলে দেখারও কেউ নেই।"
বীড নিবাসী সমাজকর্মী টাংড়ের মতে যথাশীঘ্র যে দুটি সমস্যার সমাধান খোঁজা উচিত সেগুলি হল: গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের অভাব ও বাল্যবিবাহ। "গোদের উপর খরা-নামক বিষফোঁড়া তো আছেই, তাছাড়া কামকাজের বড্ডো অভাব এখানে। পরিযান বাদে আরও হাজারটা সমস্যার মুখে পড়েন আখ-শ্রমিকরা।"
আখ-কাটার মরসুম চলছে এখন। শীলা ও লতার মতো আরও হাজার হাজার মহিলারা বাড়ি থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে ঘর বেঁধেছেন দারিদ্র্যপীড়িত তাঁবুর নিচে, শৌচব্যবস্থার নামগন্ধ নেই কোত্থাও, ফলত আজও তাঁদের একমাত্র ভরসা সেই আকাচা কাপড়ের প্যাড।
"এখনও অনেক দিন বাঁচতে হবে," ইতি টানলেন শীলা, "কিন্তু কীভাবে যে বাঁচতে হয়, সেটাই ভুলে গেছি।"
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)