বাঁধের জলাধারে চলাচল করা নৌকায় ঘন্টা দুয়েক সফর করে তবেই সবেধন নীলমণি নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানো যায়। তাছাড়া উপায় হল অর্ধনির্মিত রাস্তা বেয়ে উঁচু পাহাড় অতিক্রম করা।
কিন্তু নয় মাসের গর্ভবতী পর্বা গোলোরি ছিলেন আসন্নপ্রসবা।
আমি যখন দুপুর দুটো নাগাদ কোটাগুড়া জনপদে পৌঁছালাম, বাচ্চাটা বুঝি আর বাঁচবে না ভেবে তখন পর্বার পাড়ার সবাই তাঁর বাড়ি সামনে ভিড় জমিয়েছেন।
৩৫ বছর বয়সী পর্বার প্রথম সন্তানটি তিন মাস বয়সে মারা যায়। তাঁর মেয়ের বয়স এখন আন্দাজ ছয়। দুটি শিশুই স্থানীয় ধাত্রী ও চিরাচরিত জন্ম সহায়িকাদের হাতে বাড়িতেই জন্মেছে বিশেষ কোনও সমস্যা ছাড়াই। জটিলতা আছে আন্দাজ করে ধাত্রীরা এইবার দ্বিধায় ছিলেন।
আমি অন্য একটি সংবাদ সংগ্রহ করতে কাছাকাছি একটি গ্রামে গিয়েছিলাম আর তখনই একটা ফোন আসে। ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার এক বন্ধুর মোটর বাইকে (ওই পাহাড়ি পথ আমার স্কুটি নিয়ে পার হওয়া সম্ভব নয়) মাত্র ৬০ জন মানুষের বসতিওয়ালা ওড়িশার মালকানগিরি জেলার কোটাগুড়া জনপদের পথে রওনা হলাম।
একে দুর্গম পথ, তার উপর মধ্য ভারতের অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের মতো চিত্রকোণ্ডা ব্লকেও নকশালপন্থী জঙ্গিদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই লেগেই থাকে। সড়ক ও অন্যান্য পরিকাঠামো বহু স্থানেই বিরল ও নিম্নমানের।
পরোজা জনজাতিভুক্ত যেসব আদিবাসী মানুষেরা কোটাগুড়ায় বাস করেন তাঁরা হলুদ, আদা, ডাল আর নিজেদের খোরাকির ধান ছাড়া আরও কিছু ফসল চাষ করেন পর্যটকদের কাছে বিক্রির জন্য।
পাঁচ কিলোমিটার দূরে জোদাম্বো পঞ্চায়েতের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের আনাগোনা অনিয়মিত। অগস্ট ২০২০তে পর্বা যখন আসন্নপ্রসবা, তখন লকডাউন চলার কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল বন্ধ। কুদুমুলুগুমা গ্রামের সর্বজনীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি (কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, সিএইচসি) ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এইবার আবার পর্বার প্রয়োজন ছিল অস্ত্রোপচার, যা এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্ভব নয়।
অতএব ৪০ কিলোমিটার দূরে, চিত্রকোণ্ডার মহকুমা হাসপাতালটিই একমাত্র উপায়, কিন্তু চিত্রকোণ্ডা/বালিমেলা জলাধারে নৌকা চলাচল সন্ধের পর বন্ধ হয়ে যায়। উঁচু পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে দরকার পড়ে মোটর বাইক নইলে উপায় হাঁটা — দুটিই নয় মাসের গর্ভবতী পর্বার ক্ষেত্রে ছিল সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।
মালকানগিরি জেলা কেন্দ্রে আমার পরিচিতদের মাধ্যমে আমি সাহায্যের চেষ্টা করি কিন্তু তাঁরা জানান যে ওই খারাপ রাস্তায় অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো কঠিন। জেলা হাসপাতালের একটি জলযান অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও লকডাউন জারি থাকায় সেটিও বন্ধ ছিল।
একটি বেসরকারি ভ্যানের ব্যবস্থা যাতে করা যায় সেই মর্মে আমি স্থানীয় আশা-কর্মীকে (স্বীকৃত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী) রাজি করাই। তার খরচ ১,২০০ টাকা। তিনিও আবার পরদিন সকালের আগে আসতে পারবেন না।
আমরা ভ্যানে করে রওনা হলাম। কিন্তু যে নির্মীয়মাণ পাহাড়ি রাস্তায় পর্বাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছিলাম তার মাঝপথেই ভ্যানটি খারাপ হয়ে গেল। আমরা দেখলাম সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর একটি ট্র্যাক্টর এসেছে জ্বালানি কাঠের খোঁজে, তাঁদের কাছেই আমরা সাহায্য প্রার্থনা করলাম। তাঁরা আমাদের নিয়ে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর শিবিরে। হাতালগুড়া শিবিরের কর্মীরা পর্বাকে চিত্রকোণ্ডা মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
হাসপাতালের কর্মীরা জানালেন যে পর্বাকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মালকানগিরি জেলা সদরে নিয়ে যেতে হবে। তাঁরাই ওখানে নিয়ে যাওয়ার গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমি ছোটাছুটি করে কোটাগুড়া পৌঁছাবার পরের দিন অবশেষে বেলা গড়িয়ে জেলা হাসপাতালে পৌঁছালাম।
সেখানে চিকিৎসকরা তিনদিন ধরে পর্বার প্রসব বেদনা তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া অবধি তাঁর সময় কাটলো নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে। অবশেষে আমাদের জানালো হল যে তাঁর সিজারিয়ান করা দরকার।
১৫ অগস্ট পর্বার শিশুপুত্র ভূমিষ্ঠ হল — তিন কিলো ওজন ছিল সদ্যজাতটির, যা মোটামুটি ভালোই। কিন্তু চিকিৎসকরা বললেন যে শিশুর অবস্থা সঙ্কটজনক। বাচ্চাটি পায়ুছিদ্র ছাড়া জন্মেছিল বলে তৎক্ষণাৎ অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিল। মালকানগিরি জেলা সদর হাসপাতালে সেই অস্ত্রোপচার করার বন্দোবস্তই ছিল না।
শিশুটিকে, ১৫০ কিলোমিটার দূরে কোরাপুটে, শহিদ লক্ষ্মণ নায়ক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সত্বর ভর্তি করা দরকার ছিল কারণ সেখানে আরও আধুনিক ও উন্নততর ব্যবস্থা আছে।
শিশুটির পিতা, পোদু গোলোরি, ততক্ষণে হতাশ হয়ে পড়েছেন আর তার মায়ের তো তখনো জ্ঞানই ফেরেনি। অতএব যে আশা-কর্মী আমাদের সঙ্গে ভ্যানে এসেছিলেন, তিনি আর আমি মিলে শিশুটিকে নিয়ে কোরাপুট ছুটলাম। এসব ১৫ই অগস্ট সন্ধে ৬টার কথা।
যে অ্যাম্বুলেন্সে আমরা রওনা হয়েছিলাম সেটি মাত্র ৩ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই খারাপ হয়ে গেল। দ্বিতীয় যেটি জোগাড় করলাম সেটিও ৩০ কিলোমিটার গিয়ে খারাপ হল। মুষলধারায় পড়তে থাকা বৃষ্টিতে আমরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে অপেক্ষা করে রইলাম আরও একটি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। তখন লকডাউন চলছে, অবশেষে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম কোরাপুটে মাঝরাত পেরিয়ে।
সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য সাতদিন আইসিইউতে রাখলেন। ইতিমধ্যে আমরা পর্বা ও পোদুকে বাসে করে কোরাপুট নিয়ে এলাম যাতে সাতদিন পর প্রথমবার পর্বা নিজের সন্তানকে দেখতে পান। এতসবের পর সেখানকার চিকিৎসকরা আমাদের জানালেন যে সদ্যজাত শিশুদের উপর অস্ত্রোপচার করার মতো ব্যবস্থা ও দক্ষতা তাঁদের নেই।
শিশুটিকে আবার অন্য একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করার প্রয়োজন দেখা দিল। এই হাসপাতালটি ৭০০ কিলোমিটার দূরে বেরহামপুরে (যা ব্রহ্মপুর নামেও পরিচিত) অবস্থিত, নাম এমকেসিজি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। আমরা আবার একটি অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য অপেক্ষা করে দীর্ঘ সফরের জন্য কোমর বাঁধলাম।
অ্যাম্বুল্যান্স সরকারি হলেও এলাকাটি স্পর্শকাতর বলে আমাদের খরচা বাবদ ৫০০ টাকা দিতে হল। (এই সব খরচ আমরা বন্ধুরা মিলেই সামলেছি — এতবার হাসপাতাল যাতায়াত করতে আমরা ৩,০০০—৪,০০০ টাকা ব্যয় করেছিলাম) মনে আছে, বেরহামপুরের হাসপাতালে পৌঁছাতে আমাদের ১২ ঘন্টারও বেশি লেগেছিল।
ততক্ষণে ভ্যান, ট্রাক্টর, একাধিক অ্যাম্বুল্যান্স আর বাসে করে আমাদের কতগুলো হাসপাতাল ঘোরা হয়ে গেছে —চিত্রকোণ্ডা, মালকানগিরি সদর, কোরাপুট ও বেরহামপুর — আর এইভাবে পাড়ি দিয়ে ফেলেছি ১,০০০ কিলোমিটার পথ।
আমাদের জানানো হল যে অস্ত্রোপচারটি যথেষ্ট কঠিন। বলা হল যে শিশুটির ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্ত এবং এর একাংশ অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হবে। ওর পেটে একটি ছিদ্র করে জমে থাকা মল বার করা হল। আর একটি অস্ত্রোপচার করে পায়ুপথ তৈরি করতে হত কিন্তু শিশুর ওজন আট কিলো হওয়ার আগে তা করা সম্ভব না।
পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া শেষ খবরে আমি জানতে পারি যে শিশুটির বয়স আট মাস হয়ে গেলেও ওই প্রয়োজনীয় ওজন তার এখনও হয়ে ওঠেনি, ফলে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার আপাতত স্থগিত আছে।
বিবিধ বিপত্তির মধ্যে শিশুটি জন্মাবার একমাস পর, আমাকে তার নামকরণের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মৃত্যুকে জয় করেছে খোকা, তাই আমি ওর নাম রাখি মৃত্যুঞ্জয়। ১৫ই অগস্ট ২০২০, ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মধ্যরাত্রে ও নিজের ভাগ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জয়ী হয়ে ফিরেছিল, ঠিক তার মায়ের মতোই।
****
পর্বার অবস্থা ভীষণ সঙ্কটজনক বটে, তবে মালকানগিরি জেলার আদিবাসী অঞ্চল, যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামো বিরল, সেখানে সমতুল অবস্থায় মহিলারা মোটের ওপর ঝুঁকি নিয়েই বেঁচে থাকেন।
মালকানগিরির ১,০৫৫টি গ্রামে তফশিলি জনজাতি, বিশেষত পরোজা ও কোয়া জনজাতির মানুষের হার শতকরা ৫৭ শতাংশ। তাঁদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে ফলাও করে বহু স্থানে বহু কথা বলা হলেও তাঁদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি আদতে অবহেলিতই থেকে গেছে। এখানকার ভূপ্রকৃতি — পাহাড়, জঙ্গল, জলাভূমি — ও দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষ, ও সরকারি অবহেলার ফলে এই গ্রাম ও জনপদগুলির জীবনদায়ী বন্দোবস্তগুলি একেবারে তলানিতে রয়েছে।
মালকানগিরি জেলার অন্তত ১৫০টি গ্রামে সড়ক যোগাযোগ নেই (ওড়িশা জুড়ে এমন গ্রামের সংখ্যা ১,২৪২, বলে রাজ্য বিধানসভায়, ১৮ই ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন পঞ্চায়েতি রাজ ও পানীয় জল বিষয়ক মন্ত্রী, প্রতাপ জেনা)।
এই গ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম, কোটাগুড়া থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তেন্তাপলি। “বাবু, আমরা তো এই একটা জল দিয়ে ঘেরা যায়গায় পড়ে থাকি, তাই আমরা বাঁচলাম না মরলাম তাতে কার কী এসে যায়?” বললেন কমলা খিল্লো, যিনি তেন্তাপলিতে ৭০ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করেছেন। “আমরা জীবনের বেশিরভাগ সময়ে কেবল জল দেখেই কাটাই, আর এই জলের জন্য কমবয়স্ক মেয়ে বউদের জীবনে দুঃখের অন্ত নেই।”
অপর কোনও গ্রামে যেতে হলে তেন্তাপলি, কোটাগুড়া সহ জলাশয় সংলগ্ন জোদাম্বো পঞ্চায়েতের আরও তিনটি জনপদের বাসিন্দাদের ৯০ মিনিট থেকে চার ঘন্টা অবধি মোটর চালিত নৌকায় সফর করতে হয়। ৪০ কিলোমিটার দূরে, চিত্রকোণ্ডার স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার নাগাল পেতে নৌকাই সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায়। ১০০ কিলোমিটার দূরের সর্বজনীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে এখানকার অধিবাসীদের প্রথমে নৌকায় ও পরে বাস অথবা জিপ গাড়িতে খেপে খেপে যেতে হয়।
জলসম্পদ বিভাগের নৌকা পরিষেবার উপর মোটে ভরসা করা যায় না কারণ তা প্রায়শই যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া এই নৌকাগুলি দিনে একবার মাত্র যায় আর একবার আসে। টিকিট পিছু ২০ টাকায় – অর্থাৎ সরকারি নৌকার তুলনায় ১০ গুণ ভাড়ায় একটি বেসরকারি মোটরচালিত নৌকা চলে কিন্তু তাও সন্ধের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিপদ আপদে যাতায়াত করাটা পাহাড় ডিঙানোর মতোই দুরূহ ব্যাপার।
“আধার কার্ডের জন্য হোক আর ডাক্তার দেখাতেই হোক আমাদের নির্ভর করতে হয় এই পরিবহণ ব্যবস্থার উপর আর সেইজন্যই বাচ্চা হতে মেয়েরা আর হাসপাতালে যেতে গা করে না,” বললেন তিনটি সন্তানের ২০ বছর বয়সী মা কোটাগুড়ার কুসুমা নারিয়া।
অবশ্য তিনি এ কথাও বললেন যে আশা-কর্মীরা এখন এইসব অঞ্চলে আসেন। কিন্তু আশা দিদিরা ততোটা অভিজ্ঞ নন, তাঁরা তেমন বেশি কিছু জানেনও না আর তাঁরা মাসে একবার আসেন আয়রন আর ফলিক অ্যাসিডের বড়ি আর প্রসূতিদের জন্য বিশেষ শুকনো খাবার দিতে। শিশুদের টিকাকরণের সম্পূর্ণ তথ্য সুসমঞ্জসভাবে গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায় না। যখন প্রসব নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মনে হয় তখন তাঁরা প্রসূতি মায়ের সঙ্গে হাসপাতাল অবধি যান।
গ্রামে নিয়মিত সভা বা সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মশালা হয় না, কিশোরী ও কমবয়সী মহিলাদের সঙ্গে তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও আলোচনাও হয় না। বিদ্যালয় ভবনে আশা-কর্মীদের যে সভা করার কথা সেটাও হয় না কারণ কোটাগুড়ায় কোনও বিদ্যালয়ই নেই (যদিও তেন্তাপলিতে একটি বিদ্যালয় আছে যেখানে শিক্ষকরা কখনই নিয়মিত আসেন না) আর অঙ্গনওয়াড়ি ভবনটিও অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
যমুনা খারা নামের ওই অঞ্চলের এক আশা-কর্মী জানালেন যে যেহেতু জোদাম্বো পঞ্চায়েতের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেবল সাধারণ রোগের চিকিৎসাটুকুই হয়, অতএব সেখানে না আছে প্রসূতিদের জন্য কোনো ব্যবস্থা আর না আছে জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা। ফলে তিনি ও অন্যান্য আশাদিদিরা চিত্রকোণ্ডার সর্বজনীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতেই যাওয়া পছন্দ করেন। “কিন্তু সেটি অনেক দূরে আর সড়ক পথে ঠিকমতো যাওয়া অসম্ভব। আবার নৌকাযাত্রায় ঝুঁকি আছে। সরকারি লঞ্চ সবসময়ে চলে না। সুতরাং আমরা বহুবছর ধরে প্রথাগত দাইমাদের উপরেই ভরসা করে চলেছি।”
তেন্তাপলি এলাকার, পরোজা আদিবাসী সম্প্রদায়ের, সমরি খিল্লোও জানালেন, “আমরা হাসপাতালের চেয়ে বেশি নির্ভর করি দাইমাদের উপর। আমার তিনটি বাচ্চাই তাঁদের হাতে হয়েছে। আমাদের গ্রামে এমন তিন জন দাইমা আছেন।”
বোধাকি ডোকারি নামে দেশি ভাষায় এই নামে পরিচিত চিরাচরিত প্রসব সহায়িকাদের উপর নির্ভরশীল ওই অঞ্চলের ১৫টি জনপদ। সমরির ভাষায়, “তাঁরা আমাদের কাছে আশীর্বাদের মতো, কারণ তাঁদের জন্যই আমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না গিয়েও নিরাপদে মা হতে পারি। আমাদের জন্য তাঁরাই ডাক্তার তাঁরাই ভগবান। মহিলা হিসাবে আমাদের দুশ্চিন্তা তাঁরা বোঝেন — পুরুষমানুষ বোঝেই না যে আমাদেরও মন আছে, আমরাও কষ্ট পাই। তারা তো ভাবে আমরা বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্যই দুনিয়ায় এসেছি।”
এখানকার ধাত্রীরা সন্তান ধারণ করতে না পারলে মহিলাদের স্থানীয় গাছ-গাছড়া থেকে তৈরি ওষুধও দেন, এগুলিতে যদি কাজ না হয় তাহলে তাঁদের স্বামীরা কখনো কখনো পুনরায় বিয়ে করেন।
কুসুমা নারিয়ার বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। ২০ বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর তিনটি সন্তানও হয়ে যায়। কুসুমা আমাকে জানান যে জন্মনিয়ন্ত্রণ দূরে থাক, তিনি মাসিক ঋতুস্রাবের কথাও পর্যন্ত জানতেন না। কুসুমের কথায়, “আমি তো খুব ছোট ছিলাম, কিচ্ছু জানতাম না, কিন্তু যখন ওটা (ঋতুস্রাব) হল, মা আমাকে কাপড় ব্যবহার করতে বলল আর বলল যে আমি বড়ো হয়ে গেছি — তারপর তাড়াতাড়ি আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। আমি শারীরিক সম্পর্কের কথাও কিছু জানতাম না। প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময়ে আমার বর আমাকে একা হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে আসে, বাচ্চাটা বাঁচলো কিনা তাও দেখেনি - কেননা বাচ্চাটা মেয়ে ছিল। কিন্তু আমার মেয়ে বেঁচে যায়।”
কুসুমার অন্য দুটি সন্তান ছেলে। “আমি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার দ্বিতীয় বাচ্চা হোক এটা না চাওয়ায় আমাকে মারধোর করা হয়েছিল কারণ সবাই তখন ছেলের আশায় ছিল। আমি বা আমার স্বামী কেউই ওষুধের (জন্মনিরোধক) কথা জানতাম না। জানলে আমি এত কষ্ট পেতাম না। কিন্তু বাচ্চা হতে বাধা দিলে আমাকে বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দিত।”
কোটাগুড়ায় কুসুমার বাড়ির কাছেই থাকেন পর্বা। সেদিন ও আমাকে বলছিল, “আমি যে বেঁচে আছি তা-ই আমার বিশ্বাস হয় না। যা কিছু তখন হয়েছিল, সেসব যে আমি সহ্য করলাম কেমন করে তা আমি নিজেই জানি না। আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমার অত কষ্ট দেখে আমার ভাইটাও কেঁদে ফেলেছিল। তারপর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল যাওয়া আর তারপরেও এই বাচ্চা এলো, ওকে তো আমি কিছুদিন অবধি দেখতেও পাইনি। কী করে এতসব পার করলাম জানি না। আমি প্রার্থনা করি যেন এমন অবস্থা কারও না হয়। কিন্তু আমাদের মতো পাহাড়ি এলাকার মেয়েদের সবারই এই এক অবস্থা।”
পর্বা যেভাবে মৃত্যুঞ্জয়ের জন্ম দিলেন — এবং ভারতবর্ষের এইসব আদিবাসী অঞ্চলে গ্রামের মেয়েদের জীবনকাহিনি আর যে পরিস্থিতিতে তাঁরা প্রসব করেন, তার সবটাই অবিশ্বাস্য। অবশ্য, আমাদের মালকানগিরিতে কী হয় তা নিয়ে কে-ই বা আর মাথা ঘামায়!
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ: চিলকা