পাঁচমসের অন্তঃসত্ত্বা, পল্লবী গাভিত, তিনঘন্টার উপর খাটে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। পাঁচমাসের একটি মৃত পুরুষ ভ্রুণসহ তাঁর জরায়ু যখন যোনি মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর ননদ, ৪৫ বছর বয়সী, স্বপ্না গরেল তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ঘরের মেঝেতে পল্লবীর রক্ত ও অন্যান্য দেহরস গড়িয়ে পড়ছিল, আর অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি জ্ঞান হারালেন।
দিনটা ছিল ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই। সাতপুরা পর্বতমালায় হেঙ্গলাপানি নামের, ৫৫টি ঘরের এক ভিল আদিবাসী অধ্যুষিত জনপদে পল্লবীর ঘরের খড়ের চালায় মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। উত্তরপশ্চিম মহারাষ্ট্রের নন্দুরবার জেলার এই দুর্গম অঞ্চলে না আছে পাকা রাস্তা না মোবাইল পরিষেবা। “বিপদ তো আর জানিয়ে আসে না। যে কোনও সময়ে তা আসতে পারে,” বললেন পল্লবীর স্বামী গিরীশ (সব নাম পরিবর্তিত)। “মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকলে একটা অ্যাম্বুলেন্স বা কোনও ডাক্তার ডাকবই বা কেমন করে?”
৩০ বছর বয়সী গিরীশ বলে চলেন, “আমি সাঙ্ঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। “আমি তো ওকে মরতে দিতে চাইনি।” ভোর ৪টে নাগাদ, অন্ধকার আর অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে গিরীশ আর তাঁর এক প্রতিবেশী পল্লবীকে বাঁশ আর বিছানার চাদর দিয়ে বানানো একটা জোড়াতালি স্ট্রেচারে করে সাতপুরা পর্বতমালার কাদামাখা পথ ভেঙে নিয়ে গিয়েছিলেন ১০৫ কিলোমিটার দূরে, ধাড়গাঁওয়ে।
হেঙ্গলাপানি জনপদটি আক্রানি তালুকের তোরনমল গ্রাম পঞ্চায়েত অঞ্চলে অবস্থিত। তোরনমল হাসপাতাল কাছে হতো বটে কিন্তু রাতে ওই পথ নিরাপদ নয়। খালি পায়ে (ভিজে মাটির পথে চটি পরে হাঁটা যায় না) গিরীশ আর তাঁর প্রতিবেশী কোনওরকমে কাদামাটির রাস্তা আঁকড়ে ধরে হাঁটছিলেন। প্লাস্টিকের চাদরে ঢাকা পল্লবী ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন।
তিনঘন্টার পথ বেয়ে উপরে উঠে তবে তাঁরা তোরনমল ঘাট রোড পৌঁছালেন। পাহাড় বেয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ,” বললেন গিরীশ। সেখানে ১,০০০ টাকা ভাড়ায় একটা জিপ গাড়ি করে তাঁরা যান ধাড়গাঁও গ্রামের দিকে। পাঁচঘন্টার পথ অতিক্রম করে ওঁরা পল্লবীকে একটা বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করলেন — গ্রামীণ হাসপাতালটি আরও ১০ কিলোমিটার দূরে। “প্রথম যে ওষুধের দোকানটি (স্বাস্থ্যকেন্দ্র) পাই সেখানেই আমি ওকে নিয়ে যাই। জায়গাটা একটু বেশি দামী ছিল বটে, কিন্তু পল্লবীকে ওরা সারিয়ে তোলে,” তিনি বললেন। ডাক্তার তাঁদের কাছ থেকে ৩,০০০ টাকা নিয়ে পরদিন তাঁকে ছেড়ে দেন। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন অধিক রক্তপাতের কারণে ও মরেও যেতে পারত”, গিরীশ মনে করে বললেন।
এতগুলো মাস পরেও পল্লবী ব্যথা আর অস্বস্তি অনুভব করেন। “ভারী কিছু তুললে বা ঝুঁকলেই আমার জরায়ুটা যোনিমুখ থেকে বেরিয়ে আসে,” তিনি বললেন। পল্লবীর বয়স ২৩, খুশি নামের একটি একবছরের কন্যাসন্তান আছে পল্লবীর। খুশি হেঙ্গলাপানির এক আশা-কর্মীর হাতে বাড়িতেই নিরাপদে জন্মেছিল। কিন্তু তাঁর ঝুলে পড়া জরায়ুর যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ার কারণে তিনি নিজের সন্তানের দেখাশুনা ঠিকমতো করতে পারেন না।
পল্লবী বলছিলেন, “খুশিকে আমার চান করাতে হয়, খাওয়াতে হয়, দিনের মধ্যে অনেকবার কোলে তুলতে হয়, ওর সঙ্গে খেলা করতে হয়। এতো শারীরিক পরিশ্রম করে আমার এক একসময়ে পেটের মধ্যে কেমন জ্বালা করে, বুকে ব্যথা করে, তাছাড়া উঠতে বসতেও কষ্ট হয়।”
গিরীশ যেমন তাঁদের গরু দুটোকে চরাতে নিয়ে যান, তেমনই পল্লবীও পাহাড়ের নীচের ঝর্ণা থেকে জল নিয়ে আসেন প্রতিদিন। “ঝর্ণাটা পাহাড় থেকে দুই কিলোমিটার নীচে কিন্তু ওটাই জল পাওয়ার একমাত্র উপায়,” পল্লবী বললেন। এপ্রিল-মে মাস নাগাদ সেই ঝর্ণাও শুকিয়ে যায় বলে পল্লবী ও অন্যান্য মহিলাদের পাহাড় বেয়ে আরও নীচে নামতে হয় জলের সন্ধানে।
বর্ষাকালে পল্লবী আর গিরীশ তাঁদের দুএকর জমিতে জোয়ার আর বাজরা চাষ করেন। গিরীশ জানালেন যে এই খাড়া পাহাড়ের গায়ে ফলন খুব ভালো হয় না। “আমরা চার-পাঁচ কুইন্টাল (৪০০-৫০০ কিলোগ্রাম) ফসল পাই, যার মধ্যে আমি তোরনমলের মুদি দোকানে ১-২ কুইন্টাল বিক্রি করি, ১৫ টাকা কিলো দরে।” ফসল তোলা হয়ে গেলে, গিরীশ চলে যান পড়শি রাজ্য গুজরাটের নভসারি জেলায় আখখেতে কাজের সন্ধানে। ওই সময়ে তিনি ১৫০ দিন কাজ করে দৈনিক ২৫০ টাকা রোজগার করেন।
মাঝে মাঝেই জ্বর আসে, মাথা ঘোরে, এমনকি জ্ঞানও হারান, তবু ঘরের আর খেতের এতোরকম কাজ করে পল্লবীর আর ৩৫ কিলোমিটার দূরে, জাপি গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার শক্তি থাকে না। তিনি বলছিলেন, আশা-কর্মীটি তাঁকে কিছু ওষুধ দিয়ে দেন। “আমি চাই ডাক্তারের কাছে যেতে, কিন্তু কেমন করে যাবো? খুবই দুর্বল আমি,” জানালেন পল্লবী। ঝুলে পরা জরায়ু নিয়ে পাহাড়ি পথে এতটা হাঁটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
(জনৈক পঞ্চায়েত সদস্যের হিসাব মতো) ১৪টি গ্রাম ও ৬০টি জনপদ নিয়ে গঠিত তোরনমল পঞ্চায়েত এলাকার জনসংখ্যা ২০,০০০। এঁদের সবাইকে পরিষেবা দেয় জাপিতে অবস্থিত একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছয়টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩০ শয্যাবিশিষ্ট তোরনমল জুন (পুরানো) গ্রামে অবস্থিত একটি গ্রামীণ হাসপাতাল, যেখানে পাওয়া যায় কন্ডোম, গর্ভনিরোধক বড়ি, আইইউডি ও অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত, এবং শিশুজন্মের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিষেবা।
“আদিবাসী মহিলারা পাহাড়ের উপরদিকে থাকেন বলে তাঁদের দিনের মধ্যে একাধিকবার, এমনকি গর্ভাবস্থাতেও, জলের জন্য পাহাড় বেয়ে ওঠানামা করতে হয়, ফলে তোরনমলে বাধাগ্রস্ত, বিলম্বিত ইত্যাদি প্রসবের ঘটনা খুব বেশি ঘটে। এই কারণে, প্রসবকালে নানা জটিলতা দেখা দেয় এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশু জন্মানোর ঘটনা ঘটে,” জানালেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসক। দুজন চিকিৎসক, দুজন নার্স এবং একজন ওয়ার্ড সহায়ক সম্বলিত জাপি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সবে ২০১৬ সালে খোলা হয়েছে এবং এখানে দিনে চার-পাঁচজনের চিকিৎসা হয়। “অবস্থা খুব খারাপ হলে বা ভগতের (প্রথাগত আরোগ্যকারী) দ্বারা কাজ না হলে তবেই মানুষ এখানে আসেন,” তিনি বললেন।
এপ্রিল ২০১৯ ও মার্চ ২০২০ – এই সময়কালের মধ্যে উক্ত চিকিৎসক পাঁচটি ঝুলে পড়া জরায়ুর ঘটনা দেখেছেন। এঁদের প্রত্যেকের সম্পূর্ণ অস্ত্রোপচার দরকার ছিল। ফলে, আমরা তাঁদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম নন্দুরবার সাধারণ হাসপাতালে। এমন দীর্ঘকালীন স্ত্রীরোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে নেই,” তিনিই জানালেন।
শ্রোণী তলের মাংস পেশি ও সন্ধিবন্ধনী দুর্বল হয়ে গেলে বা তার অতি প্রসারণ ঘটলে তা আর জরায়ুকে ধারণ করতে পারে না — তখনই জরায়ু ঝুলে পড়ে। “জরায়ু মাংস পেশি দ্বারা গঠিত এবং বিভিন্ন মাংস পেশী, কলা ও সন্ধিবন্ধিনী তাকে শ্রোণী অঞ্চলে ধরে রাখে,” মুম্বইয়ে অবস্থিত ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সমিতি সমূহের সঙ্ঘ-পরিচালক, ডঃ কোমল চভন, আমাদের বুঝিয়ে বললেন। “গর্ভধারণ, একাধিক সন্তান প্রসব, দীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণা, অথবা অপটু হাতে প্রসব হলে কোনও কোনও মহিলার এই পেশিগুলি দুর্বল হয়ে যায়, তার ফলেই তাঁদের জরায়ু ঝুলে পড়ে।” অবস্থার বাড়াবাড়ি হলে অস্ত্রোপচার করে শ্রোণী তলের কলাকে সারিয়ে তুলতে হয় বা হিস্টেরেকটমি (অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দেওয়া) করে জননাঙ্গ বাদ দিতে হয় — কোনটা করা হবে তা নির্ভর করে সেই মহিলার বয়স এবং সমস্যার প্রাবল্যের উপর।
২০১৫-তে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকল রিসার্চ -এ প্রকাশিত ২০০৬-০৭ সালে করা, দীর্ঘকালীন প্রসূতি রোগ বিষয়ক একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার যে ১৩৬ জন মহিলা দীর্ঘকালীন প্রসূতি রোগ আছে বলে জানিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ঝুলে যাওয়া জরায়ুর সমস্যাই সর্বাধিক (৬২ শতাংশ)। রিপোর্টটি আরও জানাচ্ছে, “বয়স ও দৈহিক স্থূলতা ছাড়াও অন্যান্য কারণ, যেমন গর্ভধারণের সংখ্যাধিক্য এবং প্রথাগত ধাত্রীদের হাতে প্রসব হওয়া ইত্যাদি কারণও জরায়ু ঝুলে পড়ার জন্য যথেষ্ট দায়ী।”
নন্দুরবারের সাধারণ হাসপাতালে পল্লবী তাঁর ঝুলে যাওয়া জরায়ুর শল্য চিকিৎসা বিনা খরচে করাতে পারতেন কিন্তু সেটি তাঁদের হেঙ্গলাপানি জনপদ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পৌঁছাতে সেই তিন-চারঘন্টা পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠে তারপর আবার চারঘন্টার বাস যাত্রা। “বসলেই মনে হয় আমি যেন কিছু একটার উপর চেপে বসেছি, আর তখন খুব ব্যথা লাগে,” বললেন পল্লবী। “এক জায়গায় আমি বেশিক্ষণ বসে থাকতেও পারিনা।” রাজ্য পরিবহণের সরকারি বাস এই রাস্তায়, তোরনমল থেকে দুপুর ১ টায় সারাদিনে একবারই যায়। “ডাক্তাররা কি এখানে আসতে পারে না?” তাঁর প্রশ্ন।
ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিট মানুষের ঘরের দোরগোড়ায় চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিলেও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তোরনমলের মানুষ তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন না বলে জানালেন ওই চিকিৎসক। আক্রানি ব্লকের ৩১টি গ্রাম ও আরও বহু জনপদ সড়ক যোগাযোগ বৃত্তের বাইরেই থেকে গেছে। মহারাষ্ট্রের আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগের বার্ষিক জনজাতি ঘটক যোজনা সমূহের ২০১৮-১৯ সালের রিপোর্ট অনুসারে, মহারাষ্ট্র সরকারের যে নবসঞ্জীবনী যোজনা দুর্গম স্থানে, ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিটের মাধ্যমে চিকিৎসা পৌঁছে দেয়, তার দুটি ইউনিট আক্রানি ব্লকে কাজ করে — এতে থাকেন একজন চিকিৎসা আধিকারিক, এবং একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স। কিন্তু সেগুলি পল্লবীর জনপদ অবধি পৌঁছাতেই পারে না।
জাপি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই “বিদ্যুৎ সংযোগ, জল এবং কর্মচারিদের থাকার বন্দোবস্ত নেই,” সেখানকার চিকিৎসক জানালেন। “আমি স্বাস্থ্যবিভাগে বহু লেখালিখি করেছি কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।” নন্দুরবার থেকে প্রতিদিন জাপি যেতে স্বাস্থ্যকর্মীদের খুবই অসুবিধা বোধ হয়। “সে কারণে আমরা সারা সপ্তাহ কোনও আশা-কর্মীর বাড়িতে থেকে এখানে কাজ করে সপ্তাহের শেষে নন্দুরবারে নিজেদের বাড়ি ফিরি,” বললেন এই চিকিৎসক।
এইজন্যেই আশা-কর্মীদের ভূমিকা এই অঞ্চলে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সীমিত পরিমাণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব এঁদের কাজকে কঠিন করে তোলে। “আমাদের কাছে প্রসূতিদের দেওয়ার মতো আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিডের বড়ি অথবা সুরক্ষা-মাস্ক দস্তানা কাঁচি ইত্যাদি সহ ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া যাবে এমন প্রসব-সরঞ্জামই থাকে না,” ১০টি জনপদের ১০ জন আশা-কর্মীর তত্ত্বাবধানকারী হেঙ্গলাপানির বিদ্যা নায়েক (নাম পরিবর্তিত) জানালেন।
কোনও কোনও আশা-কর্মীর প্রসব করানোর প্রশিক্ষণ থাকলেও জটিল প্রসব তাঁরা সামলাতে পারেন না। প্রতি মাসে, নিরাপদ প্রসব ব্যবস্থার অভাবজনিত কারণে দুই থেকে তিনটি শিশু ও এক থেকে দুজন প্রসূতির মৃত্যু হয় বলে বিদ্যার জানা আছে। “আমাদের আর কিছু চাই না — নিরাপদে প্রসব করাতে আমাদের নিরাপদ সড়ক পথের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক,” তিনি বললেন।
“যেখানে মেয়েদের দৈনন্দিন কাজে ঝুঁকি অনেক বেশি সেইসব দুর্গম ভৌগলিক এলাকায়, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জন্ম পুর্ববর্তী পোক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়াও জটিল অবস্থা সামাল দিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের আশু প্রয়োজন,” বললেন ডঃ চভন।
ভারত সরকারের গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৮-১৯ সালে একজন শল্য চিকিৎসক, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন সাধারণ চিকিৎসক ও একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞসহ মহারাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে ১,৪৫৬ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন তার মধ্যে ৩১ মার্চ ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪৮৫ জন পদে বহাল ছিলেন, অর্থাৎ পূর্ণ না হওয়া পদের সংখ্যা ছিল ৯৭১ বা ৬৭ শতাংশ।
জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৪ (এনএফেইচএস-৪, ২০১৫-১৬) জানাচ্ছে যে নন্দুরবারের গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৬.৫ শতাংশ মহিলা প্রসব পূর্ববর্তী সম্পূর্ণ চিকিৎসা লাভ করেন, মাত্র ৫২.৫ শতাংশের কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব হয় এবং যাঁদের বাড়িতে প্রসব হয় তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০.৪ শতাংশের প্রসব করান কোনও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী।
প্রধানত ভিল এবং পাওরা সহ অপর আদিবাসী সম্প্রদায় অধ্যুষিত নন্দুরবার জেলার অবস্থান মহারাষ্ট্রের ২০১২ সালের জনউন্নয়ন সূচক -এ সবচেয়ে নীচে - অপুষ্টি এবং রুগ্ন শিশু ও প্রসূতি-স্বাস্থ্য নিয়ে জেরবার।
পল্লবীর বাড়ি থেকে আন্দাজ, ৪০ কিলোমিটার দূরে আর একটি পাহাড়ে তোরনমল জঙ্গলের ভিতর লেগাপানি জনপদ। সেখনে খড়ের চালার অন্ধকার ঘরে সারিকা ওয়াসাভে (নাম পরিবর্তিত) জলে পলাশ ফুল সিদ্ধ করছিলেন। ভিল সম্প্রদায়ের, ৩০ বছর বয়সী সারিকা, বললেন, “আমার মেয়ের জ্বর হয়েছে। এই জলে ওকে স্নান করালে ও আরাম পাবে। ছমাসের অন্তঃসত্ত্বা সারিকার দীর্ঘক্ষণ পাথরের চুলার সামনে বসতে কষ্ট হয়। “আমার চোখ জ্বালা করে। [কুঁচকির দিকে ইঙ্গিত করে] আর এইখানে ব্যথা করে,” তিনি বললেন।
ক্লান্ত দুর্বল সারিকারও ঝুলে পড়া জরায়ুর সমস্যা আছে। কিন্তু তিনি তো বাধ্য তাঁর নিত্যদিনের গৃহকর্ম করতে। প্রতিবার প্রস্রাব তথা মলত্যাগের সময়ে সামান্য চাপ পড়লেই যোনিমুখ থেকে তাঁর জরায়ু বেরিয়ে আসে। “শাড়ির কোণ দিয়ে আমি আবার ঠেলে ভিতরে পাঠিয়ে দেই, তখন ব্যথা লাগে,” হাঁপাতে হাঁপাতে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে তিনি বললেন। উনান থেকে এক দলা ধোঁয়া তাঁর মুখের উপর আছড়ে পড়ামাত্র তিনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
তিনি ঝুলে পড়া জরায়ুর সমস্যায় ভুগছেন তিনবছর ধরে। ২০১৫ সালে আটমাসের গর্ভাবস্থায় সারিকার রাত ১টা নাগাদ প্রসববেদনা ওঠে। তাঁর শাশুড়ি প্রসব করান এবং ছঘন্টার প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করার পর তাঁর জরায়ুটি যোনিমুখ থেকে পিছলে বেরিয়ে আসে। “আমার মনে হয়েছিল যেন আমার শরীরের একটা অংশ কেউ হিঁচড়ে বার করে আনছে,” তাঁর মনে পড়ে।
“ঝুলে পড়া জরায়ুর চিকিৎসা না হলে, অন্যান্য শারীরিক সমস্যা যেমন মূত্রনালীর সংক্রমণ, ঘর্ষণজনিত কারণে রক্তপাত, সংক্রমণ ও যন্ত্রণা হতে পারে — এর সবগুলিই নিত্যদিনের জীবনযাপনে অস্বস্তি ঘটায়,” বললেন ডঃ চভন। তিনি আরও বললেন যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
যে কোনও পর্যায়েই ঝুলে পড়া জরায়ুর সমস্যায় যাঁরা ভোগেন, তাঁদের ভারী ওজন তুলতে বারণ করা হয় আর কোষ্টকাঠিন্য এড়াতে, বলা হয়, উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাদ্যগ্রহণ করতে ও জল পরিমাণে বেশি খেতে। কিন্তু সারিকা তো একবেলার খাবার আর এক পাত্র জল জোগাড় করতেই হয়রান। গর্ভ থাক বা না থাক, এক পাত্র জল ভরতে তাঁর তো আট কিলোমিটার উৎরাই বেয়ে নীচে নামা বাঁধা কাজ। ফেরার জন্য খাড়াই বেয়ে উপরে উঠতে হয় মন্থর গতিতে এবং তা আরও কষ্টসাধ্য। উরুর সঙ্গে জরায়ুর ঘষা লাগলে জ্বালা করে। কখনও কখনও রক্ত পড়ে,” তিনি আমাকে বললেন। বাড়ি ফিরেই বাইরে বেরিয়ে আসা জরায়ু তিনি ঠেলে শরীরের ভিতরে ঢোকান।
শারীরিক দুর্ভোগ ছাড়াও এই অবস্থার জন্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। একটি ঝুলে পড়া জরায়ু বৈবাহিক সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, ফলস্বরূপ মহিলারা স্বামী-পরিত্যক্ত অথবা প্রত্যাখ্যানের শিকার হন, যেমনটা ঘটেছিল সারিকার সঙ্গে।
সারিকার জরায়ু ঝুলে যাওয়ার পর তাঁর স্বামী সঞ্জয় (নাম পরিবর্তিত) আবার বিয়ে করেন। সঞ্জয়, ধাড়গাঁওয়ের হোটেলে সপ্তাহে চারপাঁচ দিন কাজ করে দিনে ৩০০ টাকা করে আয় করেন। “আয় ওর দ্বিতীয় স্ত্রী আর ছেলের পিছনেই ও খরচ করে,” বললেন সারিকা। জমিতে ও কাজ প্রায় করেই না বলে ২০১৯ সালে সারিকা নিজেই তাঁদের দুই একর জমিতে এক কুইন্টাল ভুট্টা ফলিয়েছেন। “আমার স্বামী তার থেকে ৫০ কিলোগ্রাম ওর দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তানের জন্য নিয়ে যায় আর বাকিটা আমি পিষে রেখেছি ভখরি (স্থানীয় রুটি) বানানোর জন্য।”
আয়ের আর কোনও পথ না থাকায় সারিকাকে প্রায়ই চাল-ডালের জন্য আশা-কর্মী এবং প্রতিবেশীদের উপর নির্ভর করতে হয়। কখনও কখনও তিনি টাকাও ধার করেন। “গ্রামের একজন আমাকে ২০১৯ সালে যে ৮০০ টাকা ধার দিয়েছিলেন খোরাকি আর বীজ কিনতে তা-ও শোধ দিতে হবে,” তিনি বললেন।
কখনও আবার তাঁর স্বামী তাঁকে গায়ের জোরে যৌন-সঙ্গমে বাধ্য করেন। “আমার অবস্থা (ঝুলে পড়া জরায়ু) ওর ভালো লাগে না বলেই তো ও আবার বিয়ে করেছে। কিন্তু মদ খেলেই ও এখানে আসে। [যৌন সঙ্গমের সময়ে] আমি যন্ত্রণায় কেঁদে উঠলে ও আমাকে ধরে পেটায়,” তিনি বললেন।
আমার সঙ্গে যেদিন তাঁর দেখা হয় সেদিন উনানের পাশে একপাত্র ভাত রাখা ছিল। তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে করুণা আর তাঁর সারাদিনের খাবার বলতে এটুকুই। “মাত্র এক কিলো চাল বাড়িতে পড়ে আছে,” তিনি বললেন। দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থানকারী মানুষের (বিপিএল) জন্য নির্ধারিত রেশন কার্ডে যে তিন কিলো চাল আর আট কিলো গম পেয়েছিলেন তার মাত্র ওটুকুই পড়েছিল। পুষ্টির উৎস বলতে কেবল তিনটি পোষ্য ছাগল। “একটা ছাগল প্রতিদিন এক গেলাস দুধ দেয়,” তিনি জানালেন। সেই দুধটুকু তিনি সমান ভাগ করে দেন তাঁর নিজের মেয়ে আর দুই কিলোমিটার দূরে নিজের মায়ের সঙ্গে থাকা চার বছরের সৎছেলে সুধীরের মধ্যে।
তোরনমল গ্রামীণ হাসপাতালটি সারিকার বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আর উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যেতে খাড়াই বেয়ে উঠতে হয়। একাধিক যাত্রী নিয়ে যে জিপ গাড়িটি যায় তা ঘন ঘন পাওয়া যায় না বলে তাঁকে এই পথ হেঁটেই যেতে হয়। “আমি বেশি হাঁটতে পারিনে। অল্পেই হাঁপিয়ে যাই,” বললেন তিনি। সন্তান প্রসবের আগে যখন সারিকা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতেন তখনই তাঁর ধরা পড়ে সিকল সেল বা বক্র-কোষ রক্তাল্পতা নামের এক বংশানুক্রমিক রক্তের রোগ যা রক্তকণিকার উপর ক্রিয়া করে রক্তাল্পতা ঘটায়।
২০১৬ সালে স্থাপিত তোরনমল গ্রামীণ হাসপাতালটি ৩০ শয্যা বিশিষ্ট। ডঃ সুহাস পাতিল জানালেন যে হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখা হয়। চারপাশের ২৫টি গ্রাম থেকে মাসে বড়জোর এক থেকে দুজন আসেন সন্তান প্রসব করাতে। হাসপাতালে, দুজন চিকিৎসা আধিকারিক আছেন, আছেন সাত জন নার্স, একটি পরীক্ষাগার (কিন্তু নেই কোনও প্রযুক্তিবিদ) এবং একজন পরীক্ষাগার সহায়ক। সারিকার মতো গুরুতর অবস্থার চিকিৎসা করার মতো স্ত্রীরোগ বা ধাত্রীবিদ্যার জ্ঞান সম্বলিত চিকিৎসকের কোনও পদ সৃষ্টিই করাই হয়নি।
“আমরা ঝুলা পড়া জরায়ুর রোগী পাই না। শ্রোণী থেকে রক্তক্ষরণ আর বক্র-কোষ রক্তাল্পতার (সিকল সেল অ্যানিমিয়া) রোগীই বেশি আসেন। আর যদি তেমন রোগী পাইও তার চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত বা অভিজ্ঞতা আমাদের নেই,” বললেন ডঃ পাটিল, তিনি এই হাসপাতালে কাজ করছেন ২০১৬ থেকে আর থাকেনও হাসপাতালের কর্মী আবাসনেই।
অবশ্য, পরিকাঠামো এবং অভিজ্ঞতা থাকলেও সারিকা হয়তো চিকিৎসককে তাঁর ঝুলে পড়া জরায়ুর কথা বলতেন না। “সে তো একজন পুরুষ ডাক্তার। তাকে আমি কী করে বলব যে আমার জরায়ু বেরিয়ে আসছে?” তাঁর প্রশ্ন।
প্রচ্ছদ চিত্র: নিউ - মিডিয়া শিল্পী প্রিয়াঙ্কা বোরার নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ভাব এবং অভিব্যক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত আছেন । তিনি শেখা তথা খেলার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি করছেন ; ইন্টারেক্টিভ মিডিয়ায় তাঁর সমান বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কলম আর কাগজের চিরাচরিত মাধ্যমেও তিনি একই রকম দক্ষ ।
ছবি: জিশান এ লতিফ মুম্বই ভিত্তিক স্বতন্ত্র ফটোগ্রাফার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিশ্বব্যাপী নানান সংকলন, প্রদর্শনী এবং প্রকাশনায় তাঁর কাজ স্থান পেয়েছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা: https://zishaanalatif.com/
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা