মুম্বইগামী বাষ্পচালিত রেলগাড়ি, ট্রেনযাত্রা ও বড়ো শহরে অপেক্ষা করে থাকা অচিন জীবন — গানে গানে সেসব নিয়ে মশগুল হলেন পুণের কোলাভাডে গাঁয়ের দুই নারী

রেলগাড়ির ওই ইঞ্জিনে সই পিতল-পানা গলা [চিমনি]
আসছে রে ট্রেন ছেড়ে বোরিবন্দর, বাইকুল্লা

এই ওভিটিতে “পিতল-পানা গলা” যুক্ত একটি রেলগাড়ির কথা বলছেন গায়ক বাহাত্তুরে রাধা সকপাল, দৃশ্যকল্পে ফুটে উঠছে বাষ্পচালিত শকটের ধোঁয়া ওঠা চিমনি। সৌন্দর্য ও শক্তি ছাড়াও চিমনির গর্জনে রেলগাড়ি খুঁজে পাচ্ছে ছন্দ — ভক্ক্‌ ভক্ক্‌, ভক্ক্‌ ভক্ক্‌।

১৩টি দোহার এই গুচ্ছটি গেয়েছেন কোলাভাডে গ্রামের রাধা সকপাল ও রাধা উভে। জাঁতাকল ঘোরাতে ঘোরাতে বাষ্পচালিত রেলগাড়ি, ট্রেনযাত্রী ও মুম্বইগামী যাত্রার কথা তুলে ধরছেন তাঁরা। কামকাজ ও রুজিরুটির সন্ধানে যাঁরা দেশগাঁ এই নগরে গিয়ে ওঠেন, এই ওভিটি তাঁদের জীবনের এক অপূর্ব রূপক।

একটি দোহায় ট্রেনে চড়ার আগে স্বামীর থেকে সোয়াদচিঠ্ঠি বা বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ চাইছেন এক মহিলা। দম্পতির একজন মুম্বইয়ে কাজে যাওয়ার ফলে ফিকে হয়ে আসছে যৌথ জীবন, এটা কি তারই ফলাফল? নাকি বড়ো শহরে দীর্ঘ সময় ধরে হাড়ভাঙা মজদুরির কবলে জেরবার হয়েছে জিন্দেগি? নাকি, লম্পট বরের সঙ্গে ঘর করতে আর একফোঁটাও ইচ্ছে নেই মহিলার?

ওভির পংক্তি বেয়ে কুঝিকঝিক করে ছুটে চলে রেলগাড়ি, ভাষ্য মাঝে এক নারী তাঁর সহযাত্রীদের শুধান, “কোন বগিতে আছে ভাই, বল না হে বল না?” কিংবা, “বল্ দেখি সই, কোন কামরায় খোকা আছে বটে?” দোহায় তিনি হয় ভাইয়ের সঙ্গে যাত্রা করছেন, কিংবা ছেলের সঙ্গে, বা সঙ্গে দুজনেই রয়েছে। গীতিভাষ্যে ফুটে উঠেছে সরগরম এক ট্রেনের রূপরেখা, ওদিকে যাত্রাসঙ্গীদের থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে মহিলার।

PHOTO • Swadesha Sharma

‘এই এসেছে ট্রেন, ভক্ক্‌ ভক্ক্‌ ধোঁয়া ছেড়ে!’

পরের কয়েকটি ওভির দৃশ্যকল্প বেশ চমকপ্রদ। ট্রেনের চিমনি থেকে পাক খেয়ে উঠছে “নীল-কালো ধোঁয়া”, ট্রেনের “ঝমাঝম”, তীব্র হুইসল। ভয়ে-দুশ্চিন্তায় কাহিল হয়ে পড়েছেন সেই নারী, সেটাই যেন প্রকাশ পেয়েছে “হেঁকেডেকে” রংঙবেরঙের উপমায়। বিচ্ছেদ এখানে দ্বিমাত্রিক — চেনা দেশগাঁ, যাত্রার সঙ্গী, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে উভয়ের সঙ্গে। পদে পদে বেড়েই চলেছে মহিলার আতঙ্ক।

মারাঠি ভাষায় প্রতিটি শব্দের লিঙ্গ আলাদা। মজার ব্যাপার, রেলগাড়ি কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গ। তাই ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকেও রেলযাত্রার চরম বিশৃঙ্খলা আর সাথী-হারা মহিলার উদ্বিগ্ন সন্ধান যেন একে অপরের দোসর।

গায়কদ্বয়ের কথায়, রেলগাড়িটির মা-বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দুটোই বোরিবন্দর (অধুনা ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস)। অন্তিম স্টেশনে পৌঁছে কামরা খালি করে নেমে যায় যাত্রীর দল, খানিক জিরিয়ে নেয় রেলগাড়িটা।

দেখতে দেখতে নতুন একদল যাত্রী এসে চাপবে। তখন, দায়িত্ব সহকারে তাদের সব্বাইকে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দেবে ট্রেন — এ এক নিরন্তর রোজনামচা। ঠিক যেমন কাকভোর থেকে গভীর রাত অবধি হররোজ খেটে মরেন একজন নারী।

PHOTO • Samyukta Shastri

ফিকে বেগুনি শাড়ি গায়ে রাধা সকপাল। ফুলেল নকশাওয়ালা শাড়ি পরিহিত বয়স্ক মহিলাটি তাঁর শাশুড়ি। তাঁদের পিছনে, দেওয়ালে টাঙানো দুটি ছবিতে রয়েছেন রাধাবাইয়ের প্রয়াত স্বামী ও তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী

অন্য একটি দোহায় গায়ক বলছেন, রেলগাড়ি বানাতে নিশ্চয় প্রচুর পরিমাণে লোহা গলাতে হয়েছিল। তাঁর মতে এক “মেয়েহীন দুখি মা” এটা দেখে তাজ্জব বনে যাবেন। এই রূপকে নিহিত আছে একটি ধ্রুবসত্য — কন্যাসন্তানকে মানুষ করা মানে পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে নিরন্তর বোঝাপড়া। মেয়েকে মানুষ করে, যথাযথ ঘরে বিয়ে দিতে গিয়ে নাজেহাল হন বাবা-মা, যাঁর কন্যাসন্তান নেই, তাঁর পক্ষে একথা বোঝা অসম্ভব।

এরপর আরেকধাপ এগিয়ে যায় ওভির ধারাভাষ্য। বর্ণিত হয় মুম্বইয়ে কাজে আসা মহিলার জীবনযাপন। শেষ পাঁচটি ওভিতে রয়েছে তাঁর উত্তেজনা ও উদ্বেগের কথা। “মুম্বই যাবে বলে সেজেটেজে বসেছিল মেয়েটা,” বলা হয়েছে ওভিতে। খান্ডালা ঘাটের পার্বত্য অঞ্চল ভেদ করে ছুটে চলেছে ট্রেন, এদিকে মা-বাবার জন্য বড্ড মন-কেমন করছে তাঁর। বিপদসঙ্কুল রেলপথ যেন বাবা-মায়ের থেকে দূরে দূরে কাটানো আসন্ন জীবনেরই অশনি সংকেত।

মুম্বইয়ে যেসব মাছ পাওয়া যায়, সেসব তাঁর মুখে রোচে না। দেশগাঁয়ের কথা মনে পড়ে, দিব্যি কেমন চিলা (পিগ উইড বা নটেশাক) খেতে পারতেন সেখানে। মহিলা গ্রামে ফিরলেই চেনা মাঠঘাটে নটেশাক খুঁজতেন বলে জানালেন গায়ক।

মুম্বইয়ে এসে সে নারীর জীবন কীভাবে পাল্টে গেল, তার বিবরণ রয়েছে দোহায়। একটি খাবারের হোটেল রয়েছে তাঁর, সারাটাদিন রেঁধেবেড়ে খদ্দেরদের খাইয়েই কেটে যায়। অধিকাংশ ক্রেতাই অভিবাসী পুরুষ মজুর। গোড়ার দিকে বড়ো শহরে জীবনধারার সঙ্গে কষ্টেসৃষ্টে খাপ খাওয়াচ্ছিলেন — চুলে তেল মেখে পরিপাটি করে আঁচড়াতেন, তথাকথিত গেঁয়ো কায়দায় মেঝেতে বসতেন না। খুব শীঘ্রই কাজের পাকে এমন জড়িয়ে পড়েন যে চুল-টুল বাঁধা বা বসার সময়টুকুও আর পান না। হোটেলের কাজ সামলে ওঠা দায়, স্বামীর দিকে নজর দেওয়াটাও আস্তে আস্তে আর হয়ে ওঠে না। “হোটেলে ক্রেতার করে খিদমত, অভাগা বরের ভাগে হেলা,” জাঁতার তালে তালে গেয়ে ওঠেন মহিলারা। শেষ দোহায় ধরা পড়ে অসুখী দাম্পত্যের কথা, মনে পড়ে ওভিগুচ্ছের শুরুর দিকে লেখা সেই ডিভোর্স চিঠির কথা।

ভারতীয় রেলের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

চলুন, জীবনপথে ছুটে চলা রেলগাড়ির কুঝিকঝিক গান শোনা যাক এবার।

ওভিগুলি শুনুন...

बाई आगीनगाडीचा, हिचा पितळंचा गळा
पितळंचा गळा, बोरीबंदर बाई, भाईखळा

बाई आगीनगाडीला हिची पितळीची पट्टी
पितळंची बाई पट्टी, नार मागती बाई सोडचिठ्ठी

बाई आगीनगाडीचा धूर, निघतो बाई भकभका
धूर निघतो भकभका, कंच्या डब्यात बाई माझा सखा

अशी आगीनगाडी हिचं बोरीबंदर बाई माहेयरु
बाई आता नं माझं बाळ, तिकीट काढून तयायरु

बाई आगीनगाडीचं, बोरीबंदर बाई सासयरु
बाई आता ना माझं बाळ,  तिकीट काढून हुशायरु

आगीनगाडी बाईला बहु लोखंड बाई आटयिलं
बाई जिला नाही लेक, तिला नवल बाई वाटयिलं

बाई आगीनगाडी कशी करती बाई आउबाउ
आता माझं बाळ, कंच्या डब्यात बाई माझा भाऊ

बाई आगीनगाडीचा धूर निघतो बाई काळा निळा
आत्ता ना बाई माझं बाळ, कंच्या डब्यात माझं बाळ

बाई ममईला जाया नार मोठी नटयली
खंडाळ्याच्या बाई घाटामधी बाबाबये आठवली

नार ममईला गेली नार, खाईना बाई म्हावयिरं
बाई चिलाच्या भाजीयिला, नार हिंडती बाई वावयिरं

नार ममईला गेली नार करिती बाई तेल-फणी
बाई नवऱ्यापरास खानावळी ना बाई तिचा धनी

नार ममईला गेली नार बसंना बाई भोईला
बाई खोबऱ्याचं तेल, तिच्या मिळंना बाई डोईला

नार ममईला गेली नार खाईना बाई चपायती
असं नवऱ्यापरास खाणावळ्याला बाई जपयती


রেলগাড়ির ওই ইঞ্জিনে সই পিতল-পানা গলা।
আসছে রে ট্রেন ছেড়ে বোরিবন্দর, বাইকুল্লা।

পিতলের পাত্তি আঁটা রেলগাড়িটার পাশে,
ওই মেয়েটা চাইল ডিভোর্স তাহার বরের কাছে।

এই এসেছে ট্রেন, ভক্ক্‌ ভক্ক্‌ উড়িয়ে ধোঁয়া!
কোন বগিতে আছে ভাই, বল্ না রে বল্ না?

রেলগাড়িটার দেশের বাড়ি বোরিবন্দর জানি,
খোকা এবার রওনা দেবে, কিনছে টিকিটখানি।

রেলগাড়িটার শ্বশুরবাড়ি বোরিবন্দর জানি,
খোকা আমার রওনা দেবে, হাতে টিকিটখানি।

তৈরি হল ট্রেন, গলিয়ে প্রচুর প্রচুর লোহা,
এসব দেখে তাজ্জব বনে মেয়েহীন দুখি মা।

সই রে, হেঁকেডেকে ঝমাঝম রেলগাড়ি ছোটে,
বল দেখি তাই, কোন কামরায় ভাইটা আছে বটে?

দেখ্ দেখি ওই, নীল-কালো ধোঁয়া ছেড়ে রেলগাড়ি ছোটে,
বল্ দেখি সই, কোন কামরায় খোকা আছে বটে?

মুম্বই যাবে বলে সেজেটেজে বসেছিল মেয়েটা,
খান্ডালা ঘাটে গিয়ে মনে পড়ে মা-বাপের কথাটা।

মুম্বই গিয়ে পরে মাছ নাহি খায় সেই মেয়েটা,
নটে শাকের তরে মন কেমন করে, খোঁজে মাঠেঘাটে।

মুম্বই গিয়ে মেয়ে আঁচড়িয়ে কেশরাশি আহা তেল মাখে,
খদ্দের নারায়ণ, ফাঁকি পড়ে রয় শুধু সোয়ামির ভাগে।

মুম্বই গিয়ে মেয়ে মেঝের উপর সিধে বসতে না চায়
সই, চুলে নারকোল তেল দেবে, সে সময়ও যে নাই।

মুম্বই গেল মেয়ে, রুটি খাওয়ারও সময় নাহি জোটে,
হোটেলে ক্রেতার করে খিদমত, হেলায় বরের কপাল কাটে।


PHOTO • Samyukta Shastri

পরিবেশক/গায়ক : রাধাবাই সকপাল, রাধা উভে

গ্রাম : কোলাভাডে

জনপদ : খড়কওয়াড়ি

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : মারাঠা

তারিখ : এই গান ও তথ্যের একাংশ রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ৬ জানুয়ারি। গায়কের আলোকচিত্রটি তোলা হয় ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল। সে সময় রাধা উভের কোনও খোঁজ পাইনি আমরা।

পোস্টার: উর্জা

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ’র হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

नमिता वाईकर लेखक, अनुवादक आणि पारीच्या व्यवस्थापकीय संपादक आहेत. त्यांची ‘द लाँग मार्च’ ही कादंबरी २०१८ मध्ये प्रकाशित झाली आहे.

यांचे इतर लिखाण नमिता वाईकर
PARI GSP Team

पारी-जात्यावरच्या ओव्या गटः आशा ओगले (अनुवाद), बर्नार्ड बेल (डिजिटायझेशन, डेटाबेस डिझाइन, विकास, व्यवस्थापन), जितेंद्र मैड (अनुलेखन, अनुवाद सहाय्य), नमिता वाईकर (प्रकल्प प्रमुख, क्युरेशन), रजनी खळदकर (डेटा एन्ट्री)

यांचे इतर लिखाण PARI GSP Team
Illustrations : Swadesha Sharma

Swadesha Sharma is a researcher and Content Editor at the People's Archive of Rural India. She also works with volunteers to curate resources for the PARI Library.

यांचे इतर लिखाण Swadesha Sharma
Editor : Dipanjali Singh

Dipanjali Singh is an Assistant Editor at the People's Archive of Rural India. She also researches and curates documents for the PARI Library.

यांचे इतर लिखाण Dipanjali Singh
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra