‘স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন এমন এমন সময় এসেছে, যখন সব অসার ঠেকত। আমাদের বলা হয়েছিল তোমরা জিততে পারবে না মোটেই। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যকে একহাত নিয়েছ… সেইসব যাবতীয় হুঁশিয়ারি আর ও হুমকির ঊর্ধ্বে উঠেছি। মাটি কামড়ে লড়েছি। আর তাই-ই আজ আমরা এইখানে এসে পৌঁছেছি।’

আর. নাল্লাকান্নু

*****

“হলুদ বাক্সে ভোট দিন!” অনবরত চলল চিৎকার। “বেছে নিন পয়া হলুদ বাক্স, মঞ্জল পেট্টি!”

১৯৩৭ সাল, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন চলাকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির চিত্র।

ঢোল পেটাতে যারপরনাই ব্যস্ত ছেলেছোকরার একটা দলের মধ্যে থেকে স্লোগানগুলো ভেসে আসছে। অধিকাংশের ভোটদানের বয়সই হয়নি। তাছাড়া বয়স হলেই যে ব্যালটে ছাপ মারার অধিকার মিলে যাবে এমনটাও নয়। প্রাপ্তবয়স্কদেরই সবার ভোটাধিকার ছিল না।

এই সীমিত ভোটাধিকার ব্যবস্থার প্রসাদগুণেই তো জমি আর সম্পত্তির মালিক তথা গ্রামাঞ্চলে বিত্তবান ভূস্বামীদের পোয়াবারো ছিল।

ভোটাধিকার বঞ্চিত যুব সম্প্রদায় সোৎসাহে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে – এই দৃশ্য ঠিক ততটাও বিরল ছিল না।

১৯৩৫ সালের জুলাইয়ের গোড়াতেই জাস্টিস — খবরের কাগজ তথা জাস্টিস পার্টির মুখপত্র — শুধুমাত্র তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ক্ষান্ত দেয়নি, রীতিমতো কড়াভাষায় তিরস্কার করে:

দূরদূরান্তের যে কোনও গ্রামে চলে যান, কংগ্রেসের মার্কামারা খদ্দর জামা আর গান্ধি টুপি পরা তিরঙ্গা ব্যানার উড়িয়ে চলা বখাটে অর্বাচীনদের দর্শন পাবেন নির্ঘাৎ। এইসব ছেলেপুলে, খেটে খাওয়া লোকজন তথা স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় আশি শতাংশই শত শত শহুরে ও গ্রামীণ এলাকা থেকে আগত ভোটাধিকার বঞ্চিত, সম্পত্তিহীন, বেকার…

১৯৩৭ সালে এই ছেলেপিলেদেরই একজন ছিলেন আর. নল্লাকান্নু, তখন সবে ১২ বছর বয়স। আর এখন তাঁর ৯৭ [২০২২ সালে], হাসতে হাসতে আমাদের শোনাচ্ছেন সেইসব নাটকীয় ঘটনার কথা, বলছেন যে তিনিও সেইসব ‘অর্বাচীনদের’-ই একজন ছিলেন। “ভূসম্পত্তির মালিক তথা জমিজমার জন্য দশ টাকা বা তার বেশি খাজনা দিত যারা, একমাত্র তারাই ভোট দিত,” স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের ভোটে ভোটদানের অধিকারের ক্ষেত্রে আরও খানিকটা ব্যাপ্তি হয়েছিল বটে। তবে সে বন্দোবস্তও এমন ছিল যাতে, তাঁর কথায়, “প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৫-২৯ শতাংশের বেশি মানুষ যেন কিছুতেই ভোটদানের অনুমতি না পায়। আর কোনও আসনেই যাতে মোট এক থেকে দুই হাজারের বেশি মানুষ ভোট না দিতে পারে।”

R. Nallakannu's initiation into struggles for justice and freedom began in early childhood when he joined demonstrations of solidarity with the mill workers' strike in Thoothukudi
PHOTO • M. Palani Kumar

শৈশবে থুথুকুড়ির কারখানা শ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে অংশগ্রহণের সময় থেকেই আর. নাল্লাকান্নু ন্যায় ও স্বাধীনতার সংগ্রামে দীক্ষিত হয়ে ওঠেন

নাল্লাকান্নু “জন্ম শ্রীবৈকুণ্ঠমে, তখনকার তিরুনেলভেলি জেলায়।” বর্তমানে শ্রীবৈকুণ্ঠম তালুক তামিলনাড়ুর থুথুকুডি জেলার অধীন (১৯৭৭ সাল পর্যন্ত যেটি তুতিকোরিন নামে পরিচিত ছিল)।

নাল্লাকান্নু অবশ্য খুব অল্পবয়সেই আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

“আমি নেহাতই শিশু তখনও। আমাদের শহরের কাছেই থুথুকুড়ির কারখানা শ্রমিকরা ধর্মঘটে বসেছিলেন। সেটা ছিল হার্ভে মিলস গ্রুপের একটা কারখানা। এটি পরে পাঁচলাই [কাপড়কল] শ্রমিক ধর্মঘট নামে পরিচিত হয়।

“ঠিক হল তাঁদের সমর্থনে আমাদের শহরের সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করা হবে, তারপর বাক্সে ভরে থুথুকুড়িতে ধর্মঘটরত শ্রমিকদের পরিবারগুলির কাছে পাঠানো হবে। আমাদের মতো ছোটো ছেলেপুলেরা চাল জোগাড় করতে যেত।” গরিব মানুষজন, “কিন্তু সব বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু সাহায্য করত। তখন আমার বয়স সবে পাঁচ কি ছয়, তবু শ্রমিকদের সংগ্রামের প্রতি এই সংহতি আমাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যার ফলস্বরূপ, অল্পবয়সেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা আমার জন্য একরকম দস্তুর হয়ে গেল।”

আমরা তাঁকে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে আসি: আচ্ছা, মঞ্জল পেট্টি বা হলুদ বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যাপারটা থেকে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?

“মাদ্রাজে তখন দুটি প্রধান দল,” বলে চলেন তিনি, “কংগ্রেস আর জাস্টিস পার্টি। দলীয় প্রতীকের বদলে কয়েকটি নির্দিষ্ট রঙের ব্যালট বাক্স দিয়ে দলগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কংগ্রেস পার্টি, যার জন্য আমরা তখন প্রচারে নেমেছিলাম, তার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল হলুদ বাক্স। ওদিকে জাস্টিস পার্টির জন্য নির্ধারিত ছিল পাচ্চাই পেট্টি অর্থাৎ সবুজ বাক্স। যে দলটিকে ভোটাররা সমর্থন করবেন তাকে শনাক্ত করার এটাই ছিল মোক্ষম উপায়।”

আর হ্যাঁ, তখনও নির্বাচন ঘিরে রঙিন মেজাজ আর নাটকের অভাব ছিল না। দ্য হিন্দু জানাচ্ছে, “প্রচারে নামা দেবদাসী তাঞ্জাভুর কামুকান্নামল . . সবাইকে “নস্যির কৌটে” ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলেন! তখনকার দিনে নস্যির কৌটো সাধারণত সোনালি বা হলদে রঙের হত। খোদ দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত একটি শিরোনামে পাঠকদের “হলুদ বাক্স ভরিয়ে তুলুন” বলে ডাক দেওয়া হয়।”

“হ্যাঁ, আমি তো আর ১২ বছর বয়সে ভোট দিতে পারিনি,” বলছেন নাল্লাকান্নু, “তবে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আমার সর্বশক্তি দিয়ে অবশ্যই প্রচার করেছি।” আর ঠিক তিন বছর পরেই, তিনি নির্বাচন ছাড়িয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রচারে নামবেন। তার সঙ্গে চলবে “পারাই (ড্রাম জাতীয় বাদ্য) পিটিয়ে স্লোগান দেওয়ার পালা।”

Nallakannu with T. K. Rangarajan, G. Ramakrishnan and P. Sampath of the CPI(M). Known as ‘Comrade RNK’, he emerged as a top leader of the Communist movement in Tamil Nadu at quite a young age
PHOTO • PARI: Speical arrangement

টি. কে. রঙ্গরাজন, জি. রামকৃষ্ণণ এবং সিপিআই(এম)-এর পি. সম্পতের সঙ্গে নাল্লাকান্নু৷ ‘কমরেড আরএনকে’ নামে পরিচিত, নাল্লাকান্নু খুব অল্প বয়সেই তামিলনাড়ুর কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে উঠে আসেন

তখন কিন্তু তিনি আর কংগ্রেস সমর্থক নন। নাল্লাকান্নু জানাচ্ছেন, “১৫ বছর বয়স থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার [সিপিআই] সঙ্গে যুক্ত হলাম,” বলছেন নাল্লাকান্নু, বন্ধুরা যাঁকে চেনেন ‘কমরেড আরএনকে’ ডাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য অবশ্য তাঁকে আরও বড়ো হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। পরবর্তী কয়েক দশকে কমরেড আরএনকে তামিলনাড়ুর কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠবেন। আর মঞ্জল পেট্টি (হলুদ বাক্স) নয়, সমর্থন চাইবেন সেনগোদির (লাল পতাকা) তরে — আর তাতে সফলও হবেন।

*****

“তিরুনেলভেলির যে অংশে আমরা থাকতাম সেখানে সাকুল্যে একটি মাত্র বিদ্যালয় ছিল, যাকে লোকে শুধু ‘স্কুল’ বলেই চিনত। নাম বলতে এটাই সব।”

নাল্লাকান্নু চেন্নাইয়ে তাঁর বাসাবাড়ির ভেতরেই একচিলতে অফিসঘরে বসে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। আর পাশেই, টেবিল লাগোয়া একটি সাইডবোর্ডে বেশ কিছু ছোট্ট ছোট্ট আবক্ষ প্রতিমা এবং মূর্তি রাখা আছে। নাল্লাকান্নুর ঠিক পাশেই লেনিন, মার্কস ও পেরিয়ার। তাঁদের পিছনে আছে আম্বেদকরের একটি বড়ো, সোনালি মূর্তি, যার পিছনে চালচিত্র-সম দাঁড়িয়ে রয়েছে বিপ্লবী তামিল কবি সুব্রমনিয়া ভারতীর একটি বড়ো স্কেচ। পেরিয়ারের ছোট্ট আবক্ষ মূর্তিটির ঠিক পিছনে ভগত সিং, রাজগুরু এবং সুখদেবের ফটোগ্রাফ অনুসরণে আঁকা এই ত্রয়ীর আরেকটি স্কেচ। আর এই সবকিছুর পাশে, একটি ক্যালেন্ডার যা আমাদের ‘কম জল ব্যবহার’ করার নিদান দিচ্ছে।

এই সবকিছুর মধ্যে ধরা থাকে সেই মানুষটার বৌদ্ধিক বিকাশ এবং ইতিহাসের ঝলক, যাঁর সঙ্গে আজ আমাদের তৃতীয় দফার সাক্ষাৎকার চলছে। দিনটা ২৫ জুন ২০২২। প্রথমবার আমরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১৯ সালে।

“ভারথিয়ারই ছিলেন আমার জন্য সর্বাধিক প্রেরণাদায়ক কবি। আকছার তাঁর কবিতা বা গান নিষিদ্ধ করে দেওয়া হত,” বলছিলেন নাল্লাকান্নু। ‘সুতিন্তরা পল্লু’ (‘স্বাধীনতার গান’) নামে খ্যাত কবির এক অসামান্য গানের কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করলেন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী। “আমার যদ্দুর মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯০৯ সালে তিনি এটা লিখেছিলেন। অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আটত্রিশ বছর আগেই তিনি স্বাধীনতা উদযাপন করেন!”

নাচব মোরা, গাইব মোরা
কারণ মোরা ছুঁয়েছি যে ফুর্তি আজাদিরই!

'স্যার' বলে ওই বামুনদেরই ডাকার ছিল বখত, পার করেছি সবাই মোরা পার করেছি আজি!
লালমুখোদের 'সাহেব' বলার সেই যে ছিল বখত, পার করেছি সবাই মোরা পার করেছি আজি!

মোদের থেকে দুহাত পেতে ভিক্ষে নিত যারা, উল্টে তাদের সেলাম ঠোকার সেই যে বখত,
পার করেছি সবাই মোরা পার করেছি আজি!
খিদমতগার ছিলেম যাদের, মোদের দেখে হাসত তারা, পার করেছি বখত সবাই পার করেছি আজি!
সব জায়গায় শুনছি শুধুই স্বাধীনতার কথা...

The busts, statuettes and sketches on Nallakanu’s sideboard tell us this freedom fighter’s intellectual history at a glance
PHOTO • P. Sainath

নাল্লাকান্নুর টেবিল লাগোয়া একটি সাইডবোর্ডে রাখা আবক্ষ প্রতিমা, মূর্তি আর স্কেচগুলি দেখে তাঁর বৌদ্ধিক ইতিহাসের ঝলক মেলে

নাল্লাকান্নুর জন্মের ঠিক চার বছর আগে ১৯২১ সালে ভারতী মারা যান। গানটা তারও বহু আগে রচিত। অথচ এটি এবং এমনই আরও অনেক গান সংগ্রামী বছরগুলিতে তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছিল। ১২ বছরে পা দেওয়ার আগেই ভারতীর বহু গান আর কবিতা আরএনকের কণ্ঠস্থ ছিল। আজও বেশ কিছু কবিতা আর গানের কথা হুবহু মনে করতে পারেন। তাঁর কথায়, “এগুলোর বেশ কয়েকটা আমি হিন্দি পণ্ডিত পল্লবেশম চেট্টিয়ারের কাছ থেকে শিখেছিলাম।” বলাই বাহুল্য, এগুলির কোনওটিই সরকারি পাঠ্যক্রমে ছিল না।

“এস সত্যমূর্তি আমাদের স্কুলে এলে আমি তাঁর কাছ থেকেও ভারথিয়ারের লেখা একটা বই পেয়েছিলাম। সেটা ছিল তাঁর কবিতার সংকলন - তিসিয়া গীতম।” সত্যমূর্তি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ এবং শিল্পপ্রেমী। রাশিয়ার ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের সমর্থনে মুখর অন্যতম প্রথম ভারতীয় ছিলেন কবি ভারথিয়ার, এমনকি তিনি বিপ্লবের তারিফ করে একটি গানও লিখেছিলেন।

ভারতীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি সংগ্রামে তাঁর লাগাতার আট দশকের সক্রিয় ভূমিকার নিরিখেই নাল্লাকান্নুকে বোঝা সম্ভব।

অন্যথায় ‘কমরেড আরএনকে’র গল্প বলাটা বড্ড কঠিন। প্রচারের ব্যাপারে সবচেয়ে নিস্পৃহ মানুষ বলতে আমি যাঁদের চিনি, তিনি তাঁদেরই একজন। যেসব মহতী ঘটনা, হরতাল তথা সংগ্রামের কথা বলছিলেন তিনি আমাদের, সেগুলির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠার তাড়নার প্রতি তাঁর প্রত্যাখ্যান যতখানি সবিনয় ততটাই সুদৃঢ়। বাস্তবিকই এই ঘটনাগুলির বেশ কয়েকটিতে তিনি মুখ্য তথা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই আপনি তাঁকে সেই আলোয় ঘটনাপরম্পরার বর্ণনা বা ব্যাখ্যা দিতে শুনবেন না।

“আমাদের রাজ্যের কৃষক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন কমরেড আরএনকে,” বলছেন জি. রামকৃষ্ণণ৷ সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য হয়েও ‘জিআর’ তাঁর ৯৭ বছর বয়সি সিপিআই নেতার ভূমিকা এবং অবদানকে সেলাম জানান কোনও রাখঢাক না করেই। “সেই কিশোর বয়স থেকে শুরু করে, বহু দশক জুড়ে শ্রীনিবাস রাওয়ের পাশাপাশি তিনিই তো রাজ্য জুড়ে কৃষকসভার ভিতগুলি তৈরি করেছিলেন৷ আজও এগুলিই বামপন্থীদের শক্তির মৌলিক উৎস। তামিলনাড়ু জুড়ে নাল্লাকান্নুর অনলস প্রচার এবং সংগ্রাম  এতসব তৈরি করতে সহায়ক হয়েছিল।”

নাল্লাকান্নুর সংগ্রামের মধ্যে কৃষকদের লড়াইয়ের সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। এবং এছাড়াও ছিল, তৎকালীন তামিলনাড়ুর প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরোধী সংগ্রাম। যে সংগ্রাম ১৯৪৭ সালের পরেও ভীষণভাবে অব্যাহত ছিল। বহু বিস্মৃত মুক্তির জন্য ছিল নাল্লাকান্নুর সংগ্রাম। তাঁর লড়াই শুধু ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশের স্বাধীনতা আদায়ের ছিল না।

Left: Nallakannu with P. Sainath at his home on December 12, 2022 after the release of The Last Heroes where this story was first featured .
PHOTO • Kavitha Muralidharan
Right: Nallakannu with his daughter Dr. Andal
PHOTO • P. Sainath

বাঁদিকে: ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর পি. সাইনাথের সঙ্গে নাল্লাকান্নু, তাঁর বাসাবাড়িতে দ্য লাস্ট হিরোজ প্রকাশিত হওয়ার পর, এই বইয়েই তাঁর কাহিনিটি প্রথমবার প্রকাশিত হয়। ডানদিকে: নাল্লাকান্নু তাঁর মেয়ে ড. অন্ডালের সঙ্গে

“রাতে আমরা ওদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতাম, পাথর ছুঁড়তাম – আমাদের অস্ত্র বলতে সেটাই সম্বল – আর তাই দিয়েই ওদের খেদিয়ে তাড়াতাম। মাঝেসাঝে আবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হত। চল্লিশের দশকে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলাকালীন এমনটা বেশ কয়েকবার ঘটেছিল। তখনও কিন্তু আমরা কিশোর, তাও জান লড়িয়ে দিতাম। দিনরাত এক করে, আমাদের বিশেষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে!”

কাদের সঙ্গে যুদ্ধ? আর তাদের তাড়াতেন-ই বা কোথা থেকে কোথায়?

“আমাদের টাউনের কাছেই ছিল উপ্পলম [লবণ ভাটি]। যাবতীয় লবণ ভাটি ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন। শ্রমিকদের পরিস্থিতি শোচনীয়। হুবহু ওই কারখানা সংলগ্ন জায়গাগুলোর মতো, যেখানে বেশ কয়েক দশক আগেই সংগ্রাম দানা বেঁধেছিল। প্রতিবাদ প্রতিরোধ চলছিল আর মজুরদের প্রতি জনতার সহানুভূতি আর সমর্থনও ছিল।”

“পুলিশের কাজ ছিল লবণ ভাটির মালিকদের হয়ে দালালি করা। একটা সংঘর্ষে জনৈক সাব-ইন্সপেক্টরের মৃত্যু হয়। ওখানে এমনকি পুলিশ থানাতেও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তখন ওরা একটা মোবাইল টহলদারি ইউনিট চালু করে। দিনের বেলা যেত লবণ ভাটিগুলোতে এবং রাতে আমাদের গ্রামের কাছে ক্যাম্পে এসে হাজির হত। সেই সুযোগেই আমরা ওদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলাম।” টানা দু'বছর বছর ধরে এই প্রতিবাদ আর সংঘর্ষ চলতে থাকে, হয়তো আরও বেশি সময় ধরেই চলেছিল। “তবে ঘটনাগুলি ১৯৪২ সালের কাছাকাছি সময়ের, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।”

Despite being one of the founders of the farmer's movement in Tamil Nadu who led agrarian and working class struggles for eight long decades, 97-year-old Nallakannu remains the most self-effacing leader
PHOTO • PARI: Speical arrangement
Despite being one of the founders of the farmer's movement in Tamil Nadu who led agrarian and working class struggles for eight long decades, 97-year-old Nallakannu remains the most self-effacing leader
PHOTO • M. Palani Kumar

তামিলনাড়ুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি সংগ্রামে লাগাতার আট দশক নেতৃত্ব দেওয়ার পরেও ৯৭ বছর বয়সি নাল্লাকান্নু অত্যন্ত প্রচার-নিস্পৃহ মানুষ

এত সবকিছুতে নেহাতই অল্পবয়সি নাল্লাকান্নুর অংশগ্রহণ করার ব্যাপারটা তাঁর পিতা রামাসামি থেভার ঠিক মেনে নিতে পারেননি। পেশায় কৃষক, ছয় সন্তানের পিতা থেভারের প্রায় চার-পাঁচ একর জমি ছিল। কিশোর আরএনকে প্রায়শই বাড়িতে শাস্তি পেতেন, মাঝে মাঝেই তাঁর পিতা ছেলের স্কুলের ফি দেওয়াও বন্ধ করে দিতেন।

“লোকে বাবাকে বলত, ‘তোর ব্যাটার লেখাপড়া নেই? সারাটাক্ষণ ঘরের বাইরে চরকি কাটছে আর চিৎকার করছে। দেখে মনে হয় ঘরবাড়ি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে’।” ‘স্কুল’এর ফি দেওয়ার সময়সীমা ছিল প্রতিমাসের ১৪ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে। “বাবার কাছে ফি-এর টাকা চাইলেই তারস্বরে চেঁচিয়ে বলতেন: ‘তুই বরং লেখাপড়া ছেড়ে তোর কাকাদের খেতের কাজে হাত লাগা’।”

“ওদিকে সময়সীমা ফুরিয়ে এলে, বাবার কাছের কেউ বুঝিয়েশুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতেন। বাবাকে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিতেন যে আমি আর কক্ষনো ওসব কথাবার্তা বলব না, ওসব কাজকর্ম মোটেই করব না। একমাত্র তখনই তিনি ফি-এর টাকা দিতেন।”

যাইহোক, “যত আমার জীবন আর আমার পথের বিরোধিতা করেছেন, ততই গভীর হয়েছে আমাদের মতবিরোধ। আমি মাদুরাইয়ের হিন্দু কলেজে তামিলে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পৌঁছেছি। আদতে কলেজটা ছিল তিরুনেলভেলি জংশনে। কিন্তু হিন্দু কলেজ, মাদুরাই বলেই পরিচিত ছিল। আমি ওখানে দু’বছর মাত্র পড়াশোনা করেছি। তারপর আর এগোতে পারিনি।”

কারণ তিনি যে বিক্ষোভে যোগ দিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে— যে কথা তাঁর মতো প্রচারবিমুখ মানুষ কিছুতেই মুখ ফুটে বলবেন না— আদতে তিনি তখন এই বিক্ষোভগুলি রীতিমতো সংগঠিত করছিলেন। দ্রুত তরুণ নেতা হিসেবে আরএনকে উঠে আসছিলেন। অথচ কোনওদিন তিনি ডাকাবুকো হাই প্রোফাইল হয়ে ওঠার প্রয়াস করেননি বরং সচেতনভাবে তাকে এড়িয়ে গেছেন।

The spirit of this freedom fighter was shaped by the lives and writings of Lenin, Marx, Periyar, Ambedkar, Bhagat Singh and others. Even today Nallakannu recalls lines from songs and poems by the revolutionary Tamil poet Subramania Bharti, which were often banned
PHOTO • PARI: Speical arrangement
The spirit of this freedom fighter was shaped by the lives and writings of Lenin, Marx, Periyar, Ambedkar, Bhagat Singh and others. Even today Nallakannu recalls lines from songs and poems by the revolutionary Tamil poet Subramania Bharti, which were often banned
PHOTO • PARI: Speical arrangement

লেনিন, মার্কস, পেরিয়ার, আম্বেদকর, ভগত সিং-সহ অন্যান্য বৈপ্লবিক ব্যক্তিত্বের জীবন ও লেখনির প্রভাবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর মনন জারিত হয়েছিল। বিপ্লবী তামিল কবি সুব্রমনিয়া ভারতীর গান এবং কবিতার লাইনগুলি আজও নাল্লাকান্নুর কণ্ঠস্থ আছে, এককালে আকছার তাঁর কবিতা আর গানকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হত

যেসব ঘটনা এবং কর্মসূচির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, সেগুলোকে কালানুক্রমে ঠাহর করা খুব কঠিন। ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে ওঠে কারণ ঘটনাগুলি সংখ্যায় অনেক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমান্তরালভাবে ঘটছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরিখে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলিকে তিনি অবশ্য অনায়াস তুলে ধরেন: “ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঘিরেই চলছিল চারপাশের সংগ্রাম।” তখনও ১৭ বছরে পা দেননি, কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রতিবাদে-বিক্ষোভের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠহেছেন। ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেসি থেকে কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন নাল্লাকান্নু।

ঠিক কোন ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত করতে সাহায্য করতেন? কোনগুলিতে অংশগ্রহণ করতেন?

প্রথমদিকে, “আমাদের সঙ্গে থাকত টিনের তৈরি মেগাফোন। গ্রাম বা শহরে গেলে যে কোন একটা টেবিল-চেয়ার জুটিয়ে গান গাইতে শুরু করে দিতাম। টেবিলটা জরুরি কারণ বক্তা তাতে দাঁড়িয়ে মানুষের জমায়েতকে সম্বোধন করবেন। মনে রাখবেন, মানুষের ভিড় ঠিক হাজির হত।” এখানেও, জনতাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা নিয়ে নাল্লাকান্নু রা কাড়লেন না। যদিও এতসব সম্ভব হয়েছিল তাঁর মতো পদাতিক সৈন্যদের জোরেই।

“পরের দিকে, জীবনানন্দমের মতো বক্তারা ওই টেবিলগুলিতে দাঁড়িয়েই বড়ো সংখ্যায় উপস্থিত শ্রোতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন, কোনও মাইক ছাড়াই। তাঁর আর ওসব প্রয়োজন হত না।”

“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভদ্রস্থ মাইক আর লাউডস্পিকার পেতে শুরু করলাম।” তিনি স্মরণ করেন, “সবচেয়ে পছন্দের একটি ছিল যেটি, তার নাম ‘শিকাগো মাইকস’ বা শিকাগো রেডিও সিস্টেম। বলাই বাহুল্য, রোজ রোজ সেটা ব্যবহার করার মতো ট্যাঁকের জোর আমাদের ছিল না।”

RNK has been a low-key foot soldier. Even after playing a huge role as a leader in many of the important battles of farmers and labourers from 1940s to 1960s and beyond, he refrains from drawing attention to his own contributions
PHOTO • M. Palani Kumar
RNK has been a low-key foot soldier. Even after playing a huge role as a leader in many of the important battles of farmers and labourers from 1940s to 1960s and beyond, he refrains from drawing attention to his own contributions
PHOTO • M. Palani Kumar

আরএনকে চিরকাল প্রচার-বিমুখ পদাতিক কর্মী। নাল্লাকান্নু ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যে এবং তারপরেও কৃষক-শ্রমিকদের বহু সংগ্রাম আর আন্দোলনে নেতৃত্ব হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নিজের অবদানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ থেকে বিরত থাকেন

যখন ব্রিটিশরা ধরপাকড় শুরু করত তখন কী হত? কেমন করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতেন?

“এমন পরিস্থিতি কতবার হয়েছে। যেমনটা হয়েছিল রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীর [আরআইএন] বিদ্রোহের ঠিক পরেই [১৯৪৬]। কমিউনিস্টদের উপর বীভৎস দমনপীড়ন নেমে আসে। তবে এর আগেও বহু হামলা হয়েছে। তাছাড়া মাঝে মাঝেই ব্রিটিশরা গ্রামে গ্রামে ঢুকে প্রতিটা পার্টি অফিসে খানাতল্লাশি চালাত। এইটা অবশ্য স্বাধীনতার পরেও বজায় ছিল, পার্টি যখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হল। আমাদের নিজস্ব বুলেটিন এবং পত্রিকা ছিল। এই যেমন ধরুন জনশক্তি । আমাদের অবশ্য যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ও ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি তো আদতে বহু শতাব্দী প্রাচীন সাধারণ সংকেত।

“কাট্টাবোম্মানের [অষ্টাদশ শতাব্দীর কিংবদন্তি ব্রিটিশ বিরোধী যোদ্ধা] সময় থেকেই, লোকজন বাড়ির প্রবেশপথে নিমের ডাল পুঁতে রাখতেন। বাড়ির ভিতরে গুটিবসন্ত বা অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন, তারই সংকেত এটা। একেই আবার গোপন প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হত এটা বোঝাতে যে সেখানে একটি মিটিং চলছে।

“আবার যদি বাড়ির ভিতর থেকে শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসে, তার মানে সেই মিটিং এখনও চলছে। বাড়ির প্রবেশদ্বারের কাছে ভেজা গোবরও সভা চলার সংকেত। আর সেখানে শুকনো গোবর থাকলে তা হুঁশিয়ারির সংকেত, অর্থাৎ সমূহ বিপদ, মানে মানে কেটে পড়ো। আবার মিটিং শেষ হয়েছে, সেটাও বোঝানো হত।”

স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন আরএনকের অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড়ো উৎস কী ছিল?

‘কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড়ো উৎস।’

Nallakannu remained at the forefront of many battles, including the freedom movement, social reform movements and the anti-feudal struggles. Being felicitated (right) by comrades and friends in Chennai
PHOTO • PARI: Speical arrangement
Nallakannu remained at the forefront of many battles, including the freedom movement, social reform movements and the anti-feudal struggles. Being felicitated (right) by comrades and friends in Chennai
PHOTO • PARI: Speical arrangement

স্বাধীনতা সংগ্রাম, সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াই-সহ বহু সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন নাল্লাকান্নু। চেন্নাইয়ে নাল্লাকান্নুকে তাঁর কমরেড এবং বন্ধুদের অভিবাদন (ডানদিকে)

*****

“আমার গ্রেপ্তারির সময় নিজের গোঁফখানা আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম কেন?” হাসতে হাসতে বলে ওঠেন আরএনকে। “ওকাজ আমি মোটেই করিনি। আরে বাবা আমি তো আর নিজের মুখ লুকানোর জন্য গোঁফ রাখিনি। সেটাই যদি হত, তাহলে আমি গোঁফটা আদৌ রাখব কেন?”

“না, ওটা আসলে পুলিশ সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কৃষ্ণমূর্তি নামে মাদ্রাজ শহরের এক ইন্সপেক্টর আমার উপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল, ওটা ছিল তারই অংশ। দুপুর ২টো নাগাদ হাজির হয়ে সে আমার হাতদুটো বেঁধে দিয়েছিল আর খুলেছিল পরদিন সকাল ১০টায়। তারপর অনেকক্ষণ ধরে লাঠিপেটার পর্ব চলে।”

আরও একবার দেখলাম, স্বাধীনতার যুদ্ধে সামিল বাদবাকি সহযোদ্ধার মতো, তিনিও কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছাড়াই ঘটনাটা স্মরণ করলেন। তাঁর নিজের নির্যাতকের প্রতি তিনি কোনও শত্রুতার ভাব পুষে রাখেননি মনে। পরবর্তীতে প্রতিশোধ নেওয়ার তাগিদ থেকে আরএনকে কোনওদিনই এই পুলিশ ইন্সপেক্টরের সন্ধান করেননি। এমনটা করার কথা একবারও তাঁর মনে হয়নি।

“ঘটনাটা আসলে ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে,” ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর, মনে করে বললেন তিনি। “পার্টি তখন মাদ্রাজ-সহ আরও অনেক অঞ্চলেই নিষিদ্ধ ছিল এবং ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই পরিস্থিতি বহাল ছিল।”

Nallakannu remains calm and sanguine about the scary state of politics in the country – 'we've seen worse,' he tells us
PHOTO • M. Palani Kumar

দেশের ভীতি উদ্রেককারী রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যেও নাল্লাকান্নু অবিচল আর অটল। আমাদের তিনি বলেন: ‘আমরা যে আরও দুর্দিন দেখেছি’

“দেখুন, এই কথাটা বুঝুন যে সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইগুলোও লড়ে যেতে হবে। এর জন্য মূল্য চোকাতে হয়েছে আমাদের। তাছাড়া এই সংগ্রামগুলি ১৯৪৭ সালের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, আর তা স্বাধীনতার পরেও পুরোদমে জারি ছিল।”

“স্বাধীনতা, সমাজ সংস্কার, সামন্ততন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম — এইসব আমাদের সংগ্রামে মিলেমিশে আছে। এটাই আমাদের কর্মপন্থা ছিল।”

আমাদের লড়াই ছিল আরও ন্যায়সঙ্গত এবং সমান মজুরির জন্য। আমাদের লড়াই ছিল সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা নির্মূল করার জন্য। মন্দিরে অবাধ প্রবেশাধিকার আন্দোলনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি।

“তামিলনাড়ুতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির প্রচারাভিযান ছিল খুব জোরদার একটি আন্দোলন। রাজ্য জুড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জমিদারি ব্যবস্থা বহাল ছিল। আমরা মিরাসদারি [বংশ বিশেষের অধীনস্থ জমির উত্তরাধিকার] এবং ইনামদারি [শাসক কর্তৃক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনামূল্যে বরাদ্দ জমি] ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। কমিউনিস্টরা এই লড়াইগুলির পুরোভাগে ছিলেন। প্রবল প্রতাপশালী বড়ো বড়ো জমিদার এবং তাদের যত পোষা নিজস্ব সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনী আর ঠ্যাঙাড়েদের মোকাবিলায় নেমেছিলাম আমরা।

“এদের মধ্যে পুন্নিউর সাম্বাশিবা আইয়ার, নেডুমানম সামিয়াপ্পা মুদালিয়ার, পূন্ডি ভান্ডিয়ারের মতো লোকজন ছিল। হাজার হাজার একর উর্বর জমি ছিল তাদের দখলে।

ইতিহাস পাঠের এক চমকপ্রদ আসরে বসে আছি যেন বা আমরা। পাঠ নিচ্ছি এমন একজনের কাছ থেকে যিনি নিজেই সেই ইতিহাস নির্মাণের শরিক ছিলেন।

PHOTO • PARI: Speical arrangement

'স্বাধীনতা, সমাজ সংস্কার, সামন্ততন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম — এইসব আমাদের সংগ্রামে মিলেমিশে আছে। আমাদের লড়াই আরও ন্যায়সঙ্গত এবং সমান মজুরির জন্য। আমাদের লড়াই সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা নির্মূল করার জন্য। মন্দিরে অবাধ প্রবেশাধিকার আন্দোলনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি'

“আর ছিল ব্রহ্মদেয়ম এবং দেবদানমের মতো বহু শতক ধরে চলে আসা প্রাচীন প্রথা।”

“প্রথমটার অধীনে ব্রাহ্মণরা শাসকদের কাছ থেকে নিষ্কর জমি দান বাবদ পেত। নিজেরাই শাসন কায়েম রাখত এবং এই জমি থেকে মুনাফা করত। সরাসরি নিজেরা জমি চাষ না করলেও লাভ তাদের কাছেই যেত। আর দেবদানম প্রথার অধীনে, মন্দিরগুলিকে উপহার বাবদ এমন জমিজিরেত প্রদান করা হত। কখনও কখনও একটা মন্দির গোটা একখানা গ্রামই উপহার পেয়ে যেত। ছোটো ইজারাদার এবং শ্রমিকরা এদের দয়াতেই টিকে থাকতে বাধ্য হত। কেউ এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেই তাকে পত্রপাঠ উৎখাত করা হত।”

“ভালো করে জেনে রাখুন, এইসব প্রতিষ্ঠান, এই মডমগুলি [মঠ] ছয় লাখ একর জমির মালিক ছিল। হয়তো এখনও আছে। কিন্তু মানুষের অদম্য সংগ্রামের জোরে এদের একছত্র ক্ষমতা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে।”

“১৯৪৮ সালে তামিলনাড়ু জমিদারি বিলোপ আইন কার্যকর হয়। অথচ জমিদার এবং বিশাল পরিমাণে ভূসম্পত্তির মালিকদেরই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। যে সকল মানুষজন তাদের জমিতে কাজ করত তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনও বালাই ছিল না। বিত্তবান ইজারাদাররা হয়তো খানিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। কিন্তু খেতখামারে কাজ করা দরিদ্র মানুষজন কিছুই পায়নি। ১৯৪৭-৪৯ সালের মধ্যে, এই মন্দিরগুলির নিয়ন্ত্রণাধীন জমিগুলি থেকে ব্যাপক হারে উচ্ছেদ হয়। এবং আমরা তখন জোরদার প্রতিবাদ শুরু করি এই মর্মে: “চাষিরা ভালোভাবে বাঁচবে একমাত্র জমির মালিকানা পেলেই।”

“এসবই ছিল আমাদের লড়াই — এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রাম চলে। মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে সি. রাজাগোপালাচারী [রাজাজি] জমিদার ও মঠগুলোর পক্ষ নেন। আমাদের দাবি ছিল, “লাঙল যার জমি তার”। রাজাজি বললেন, জমির দলিল যাদের আছে, জমি তাদেরই। কিন্তু আমাদের সংগ্রামের জোরেই আমরা মন্দির এবং মঠগুলির নিরঙ্কুশ শক্তিতে আঘাত হানতে পেরেছিলাম। ফসল কাটার নিয়ম-সহ তাদের বানানো নানান বিধান আমরা অমান্য করি। আমরা ওদের গোলামি করতে অস্বীকার করেছিলাম।”

“আর, অবশ্যই, এই সবকিছুকে সামাজিক সংগ্রাম থেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না।”

“আমার মনে আছে এক রাতে একটা মন্দিরে ঘটে চলা বিক্ষোভের সাক্ষী ছিলাম। তখন সব মন্দিরেই রথ উৎসব পালন করা হত। আর এই রথ দড়ি দিয়ে টেনে চাষিরাই এগিয়ে নিয়ে যেতেন। আমরা ঘোষণা করে দিলাম যে জমি থেকে উৎখাত চলতে থাকলে চাষিদের কেউ কোত্থাও রথ টানতে যাবে না। এছাড়া বীজ বোনার জন্য উৎপাদিত শস্য থেকে খানিকটা ফেরত নেওয়ার চাষির অধিকারকেও আমরা সুনিশ্চিত করেছি।

R. Nallakannu accepted the government of Tamil Nadu's prestigious Thagaisal Thamizhar Award on August 15, 2022, but immediately donated the cash prize of Rs. 10 lakhs to the Chief Minister’s Relief Fund, adding another 5,000 rupees to it
PHOTO • M. Palani Kumar
R. Nallakannu accepted the government of Tamil Nadu's prestigious Thagaisal Thamizhar Award on August 15, 2022, but immediately donated the cash prize of Rs. 10 lakhs to the Chief Minister’s Relief Fund, adding another 5,000 rupees to it
PHOTO • P. Sainath

২০২২ সালের ১৫ অগস্ট আর. নাল্লাকান্নু তামিলনাড়ু সরকার প্রদত্ত থাগাইসাল থামিঝার পুরস্কার গ্রহণ করলেও পরমুহূর্তেই অতিরিক্ত ৫,০০০ টাকা-সহ ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কারমূল্যের পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদান করেন

প্রাক-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনোত্তর সময়ের মধ্যে তাঁর অনবরত যাওয়া আসা চলছে এখন। সত্যি বলতে, একদিকে যেমন একটু ধন্দে পড়ে যাচ্ছিলাম, তেমনি আবার অন্যদিকে ব্যাপারটা আদতে সেই সময়ের জটিল চরিত্রটিকেই তুলে ধরে। কতশত স্বাধীনতাই না আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। কতকগুলির তো সূচনা আর সমাপ্তির নির্দিষ্ট সন-তারিখও ছিল না। আরএনকের মতো মানুষেরা আসলে এইসব স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।

“এছাড়াও, আমরা ওই দশকগুলোতে শ্রমিকদের মারধর ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করেছি।”

“১৯৪৩ সাল, দলিত শ্রমিকদের তখনও চাবুকপেটা করা হত। আর এই চাবুকের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতগুলিতে গোবর মেশানো জল ঢেলে দেওয়া হত। ভোরবেলা যেই না মোরগ ডাকত, চারটে কি পাঁচটা হয়তো, তাদের কাজে লেগে পড়তে হত। মিরাসদারদের খামারে হাজির হয়ে গবাদি পশুকে চান করিয়ে, গোবর কুড়িয়ে, জমিতে জল দিতে যেতে হত। তদানীন্তন তাঞ্জাভুর জেলার তিরুথুরাইপুন্ডির কাছেই একটি গ্রাম ছিল। ওখানে আমরা তাদের নিয়ে প্রতিবাদ করি।

“কৃষক সভার শ্রীনিবাস রাওয়ের নেতৃত্বে বিশাল বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছিল, যার মূল আবেগ ছিল ‘লাল নিশান বওয়ার জন্য ওরা তোমায় আঘাত করলে, পাল্টা ওদের উপর আঘাত কর’। অবশেষে তিরুথুরাইপুন্ডির মিরাসদার এবং মুধালিয়াররা এই চুক্তিস্বাক্ষর করেন যে চাবুক মারা, গোবর জল ব্যবহার এবং অন্যান্য বর্বর প্রথা বন্ধ হবে।”

আরএনকে ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যে এবং তারপরেও বহু বড়ো বড়ো সংগ্রাম-আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শ্রীনিবাস রাওয়ের পর অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভার তামিলনাড়ুর প্রধান হন নাল্লাকান্নু। ১৯৪৭ পরবর্তী দশকগুলিতে এককালের এই মুখচোরা পদাতিক সেপাই কৃষক ও শ্রমিকদের সংগ্রামে অবিসংবাদী সেনাপতির ভূমিকায় উদয় হবেন।

*****

দুজনেই ভীষণ উত্তেজিত আর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। আমরা সিপিআই(এম) নেতা তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী এন শঙ্করাইয়ার সাক্ষাত্কার নিতে এসেছি। স্থান শঙ্করাইয়ার বাসাবাড়ি। অর্থাৎ কিনা, একইসঙ্গে আমরা কমরেড শঙ্করাইয়া এবং নল্লাকান্নুর সঙ্গে কথা বলছি। আট দশকের দুই সহযোদ্ধার পরস্পরকে অভিবাদন জানানোর মুহূর্তের আবেগ ওই ঘরে হাজির আমাদেরও গভীরভাবে স্পর্শ করে।

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

প্রায় ৬০ বছর আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনের সময় আলাদা আলাদা পথে যাত্রা করলেও, বিগত আট দশকের সহযোদ্ধা ৯৭ বছর বয়সি নাল্লাকান্নু এবং ১০১ বছর বয়সি কমরেড শংকরাইয়া, মুক্তি আর ন্যায়ের সংগ্রামে বরাবর ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন

কোনও তিক্ততা নেই, কোনও খেদ নেই? প্রায় ৬০ বছর আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে দুটুকরো  হলে দুজনে আলাদা আলাদা পথে যাত্রা করেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ বিচ্ছেদ ছিল না সেটা।

“তবে তারপরেও আমরা বহু বিষয়ে একসঙ্গে কাজ আর সংগ্রাম করেছি,” নাল্লাকান্নু বলছেন, “পরস্পরের প্রতি সেই পূর্বের মনোভাব নিয়েই।”

“দুজনের দেখা হলে,” এন. শঙ্করাইয়া বলছেন, “আমরা এখনও সেই একটাই দল।”

সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতির সাম্প্রতিককালে যে বাড়বাড়ন্ত, তাকে তাঁরা কীভাবে দেখেন? দেশের অস্তিত্ব নিয়ে কি তাঁরা শঙ্কিত? সেই দেশ যার স্বাধীনতা এসেছিল তাঁদের হাত ধরেই।

“স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন এমন এমন সময় এসেছে, যখন সব অসার ঠেকত,” নাল্লাকান্নু বলেছিলেন। “বলা হয়েছিল জিততে তোমরা পারবে না মোটেই। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যকে একহাত নিয়েছ। আমাদের কারও কারও পরিবারকে শাসানো হয়েছিল যাতে আমরা সংগ্রামে বিরত থাকি। যাবতীয় হুঁশিয়ারি আর ও হুমকির ঊর্ধ্বে উঠেছি আমরা। মাটি কামড়ে লড়েছি। আর তাই-ই আজ আমরা এইখানে এসে পৌঁছেছি।”

তাছাড়া, বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে বলে উভয়েই মনে করতেন। অতীতের মতোই আজ আবার অন্যদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার তথা তাদের থেকে নসিহত নেওয়ার প্রয়োজন আছে। ‘এমনকি আমি যতদূর মনে করতে পারছি, ইএমএস-এর [নাম্বুদিরিপাদ] মতো মানুষের ঘরেও গান্ধির একটি ছবি ছিল,” নাল্লাকান্নু বলছেন।

লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন রাজনীতির হালহকিকত দেখে রীতিমতো ত্রস্ত, তখন এই দু’জন কোন যাদুবলে এতটা অবিচল আর অটল থাকলেন? নাল্লাকান্নু নিরুত্তাপ: “আমরা যে আরও দুর্দিন দেখেছি।”

পোস্টস্ক্রিপ্ট

২০২২ সালের স্বাধীনতা দিবস। ইতিমধ্যেই প্রেসে গিয়েছে ‘দ্য লাস্ট হিরোজ, ফুট সোলজারস অফ ইন্ডিয়া’স ফ্রিডম’। তামিলনাড়ু সরকার নাল্লাকান্নুকে তাগাইসাল তামিজার পুরস্কার প্রদান করেছে। ২০২১ সালে শুরু হওয়া তামিলনাড়ুর এই শীর্ষ পুরস্কার সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করা হয় রাজ্য এবং তামিল সম্প্রদায়ের জন্য যাঁর অবিসংবাদিত অবদান। ১০ লক্ষ টাকা নগদ অর্থমূল্যের এই পুরস্কার, ফোর্ট সেন্ট জর্জের মঞ্চ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন আরএনকের হাতে তুলে দেন।

লেখায় ব্যবহৃত সুব্রমনিয়া ভারতীর ‘সুতিন্তরা পল্লু’ গানের পংক্তিগুলি বাংলা অনুবাদ করেছেন জশুয়া বোধিনেত্র।

অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

पी. साईनाथ पीपल्स अर्काईव्ह ऑफ रुरल इंडिया - पारीचे संस्थापक संपादक आहेत. गेली अनेक दशकं त्यांनी ग्रामीण वार्ताहर म्हणून काम केलं आहे. 'एव्हरीबडी लव्ज अ गुड ड्राउट' (दुष्काळ आवडे सर्वांना) आणि 'द लास्ट हीरोजः फूट सोल्जर्स ऑफ इंडियन फ्रीडम' (अखेरचे शिलेदार: भारतीय स्वातंत्र्यलढ्याचं पायदळ) ही दोन लोकप्रिय पुस्तकं त्यांनी लिहिली आहेत.

यांचे इतर लिखाण साइनाथ पी.
Translator : Smita Khator

स्मिता खटोर कोलकात्यात असतात. त्या पारीच्या अनुवाद समन्वयक आणि बांग्ला अनुवादक आहेत.

यांचे इतर लिखाण स्मिता खटोर