কৃষ্ণজি ভারিত সেন্টারে অলস বসে থাকার জো নেই।

সে মধ্যাহ্নভোজ হোক বা রাতের খাবার, কিংবা জলগাঁও স্টেশনে দূরপাল্লার সব গাড়ি দাঁড়াবার আগে, ঘণ্টাকয়েক হাতে রেখেই শুরু হয়ে যায় রান্নাবান্না — এভাবেই রোজ রোজ প্রায় ৩০০ কেজি বেগুন রেঁধে, বেড়ে, প্যাক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জলগাঁও নগরের ওল্ড বিজি মার্কেট চত্বরের এই দোকানটি আপাত দৃষ্টিতে ছোট্ট সাদামাটা এক খুপরি, তবে খদ্দেরের মধ্যে শিল্পপতি থেকে মজুর, উঠতি সাংসদ থেকে শ্রান্ত পার্টিকর্মী, সব্বাই আছেন।

গরমকালের তপ্ত কোনও সন্ধ্যায়, সায়াহ্নভোজনের ঠিক আগে যদি কৃষ্ণজি ভারিতে পা রাখেন, সাফ-সাফাই, কুটনো কাটা, বাটনাবাটা, খোসা ছাড়ানো, স্যাঁকা, ভাজা, নাড়া, পরিবেশন আর প্যাকিংয়ের চরম ব্যস্ততা দেখে তাজ্জব বনে যাবেন। রেস্তোরাঁর বাইরে, ইস্পাতের তিনখানা রেলিং বরাবর খদ্দেরের লাইন — সাবেক যুগের সিনেমাহলে টিকিটঘরের বাইরে যেভাবে ভিড় এড়ানোর জন্য রেলিং বাঁধা থাকত, অনেকটা সেরকম।

এই রঙ্গমঞ্চের তারকা অবশ্য ১৪ জন মহিলা।

PHOTO • Courtesy: District Information Officer, Jalgaon

এপ্রিল ২০২৪-এর অন্তিম সপ্তাহে কৃষ্ণজি ভারিত রেস্তোরাঁর ভিতর একটি নির্বাচন সচেতনতা ভিডিও তৈরি করেন জলগাঁওয়ের জেলা কালেক্টর আয়ুশ প্রসাদ। জেলার তথ্য আধিকারিক জানিয়েছেন, ভিডিওটি ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ মানুষ ডাউনলোড করে দেখে ফেলেছেন

তাঁরাই এখানকার এই এলাহি কাণ্ডকারখানার মেরুদণ্ড। তাঁদের মেহনতেই প্রতিদিন তিন কুইন্টাল বেগুন রূপান্তরিত হয় বেগুন ভারিতে, দেশের অন্যত্র যে পদটি ব্যাঙ্গন কা ভর্তা নামে পরিচিত। জলগাঁওয়ের জেলা প্রশাসন এই জনপ্রিয় দোকানটির অন্দরে নির্বাচন সচেনতা ঘিরে একটি ভিডিও বানানোর পর থেকে ওই ১৪ জন এখন সব্বার মুখচেনা।

জলগাঁও লোকসভা কেন্দ্রে ১৩ মে ভোট হয়েছিল, এই ভিডিওটির উদ্দেশ্য ছিল মহিলা ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল কৃষ্ণজি ভারিতের মেয়েরা তাঁদের অধিকার এবং ভোটদান প্রক্রিয়ার বিষয়ে সেদিন যা কিছু শিখেছেন, সে সব নিয়ে আলোচনা করছেন।

“জেলা কালেক্টরের কাছে জেনেছি যে ভোট-মেশিনের সামনে আঙুলে কালি মেখে দাঁড়িয়ে থাকার ওই একটা মুহূর্তেই আমরা সত্যিকারের আজাদ হতে পারি,” মীরাবাই নারাল কোন্দে বললেন, তাঁর পরিবার একটি ছোট্ট দর্জিখানা চালায়। এই রেস্তোরাঁ থেকে যেটুকু রোজগার হয়, সেটা না থাকলে সংসার টানা যাবে না। “ওই যন্তরটার সামনে আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতন যাকে খুশি বাছতে পারি, তার জন্য আমাদের বর, মা-বাবা, মনিব বা কোনও নেতামন্ত্রীকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।”

অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় বাজারহাট ছেয়ে যায় শীতকালীন টাটকা বেগুনে, তখন কৃষ্ণজি ভারিতের ব্যবসা তুঙ্গে ওঠে — ওই মরসুমে ৫০০ কেজি অবধি ভারিত রান্না হয়। মহিলাদের মতে দুটো জিনিসের সম্মোহনী টানে খদ্দেররা ভিড় জমান — এক ওই টাটকা টাটকা পেষাই করা ভাজা লঙ্কা, ধনে, চিনেবাদাম, রসুন আর নারকেলের স্বাদ, দুই এখানকার রান্না করা পদের সস্তা দাম। ৩০০ টাকারও কমে আপনি এই দোকান থেকে এক কেজি ভারিত আর তার সঙ্গে টুকটাক জিনিস কিনে নিয়ে যেতে পারবেন।

১০ বাই ১৫ ফুটের রান্নাঘরে চুল্লির সংখ্যা চার, সবকটায় একসঙ্গে আগুন জ্বললে মোট ৩৪টি নিরামিষ পদ রান্না হয় — যেমন ডালভাজা, পনির-মটর ইত্যাদি। তবে মেনুর সেরা আকর্ষণ অবশ্যই বেগুন ভারিত ও সেও ভাজি, অর্থাৎ কড়া করে ভাজা ছোলার বেসনের সেও সহকারে রাঁধা তরকারি।

PHOTO • Kavitha Iyer
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: ফি দিন ৩-৫ কুইন্টাল বেগুন ভর্তা বানাতে স্থানীয় বাজার ও চাষিদের থেকে সবচাইতে ভালোমানের বেগুন কেনে কৃষ্ণজি ভারিত। ডানদিকে: সন্ধে ৭.৩০টা বাজে, কুচোনোর ইন্তেজারে পড়ে আছে পেঁয়াজ। একটু পরেই রাতের খাবারের হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে, তাই আরেক দফা তরকারি আর ভারিত রান্না করা প্রয়োজন

PHOTO • Kavitha Iyer
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: কৃষ্ণজি ভারিতের ছোট্ট হেঁশেলের অন্দরে চারখানা চুলা রয়েছে, তারই একটার পাশে সাজানো আছে মটর, একখণ্ড পনীর ও সদ্য রাঁধা ডালভর্তি দুটো ক্যান। ডানদিকে: হামানদিস্তায় পেষার আগে শুকনো নারকেল কুচিয়ে রাখছেন রাজিয়া প্যাটেল। প্রতিদিন খান চল্লিশেক নারকেল একাহাতে সামলান তিনি

কথোপকথনটা মূল্যবৃদ্ধির দিকে মোড় নিতেই জড়তা কাটিয়ে উঠলেন সেই ১৪ জন মহিলা। পুষ্পা রাওসাহেব পাতিল (৪৬) প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনার আওতায় ভর্তুকি সমেত রান্নার গ্যাস পাননি। নথিপত্রে কীসব নাকি গণ্ডগোল ছিল, তিনি জানাচ্ছেন।

৬০ বছর পেরোনো ঊষা রমা সুতারের নিজের বলতে কোনও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বেশ কয়েকবছর আগে, স্বামীকে হারিয়ে দেশগাঁয়ে ফিরে আসা এই বিধবার প্রশ্ন: “লোকান্না মূলভূত সুবিধা মিলয়ালা হভ্যেত, নাহি [মৌলিক সুযোগ-সুবিধে তো মানুষের পাওয়া উচিত, তাই না]?” সঙ্গে এটাও বললেন যে, “প্রতিটা নাগরিকের একটা করে বাড়ি থাকা উচিত।”

এখানকার সিংহভাগ মহিলাই ভাড়াবাড়িতে থাকেন। রাজিয়া প্যাটেল জানাচ্ছেন যে মাস গেলে ভাড়া বাবদ তাঁকে ৩,৫০০ টাকা গুনতে হয়, অর্থাৎ নামমাত্র যেটুকু বেতন পান তার এক-তৃতীয়াংশ। “একের পর এক নির্বাচনে আমরা মেহেঙ্গাই [মুদ্রাস্ফীতি] নিয়ে প্রতিশ্রুতি শুনছি। অথচ ভোট মিটলেই সবকিছুর দাম চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে।”

মহিলারা বলছেন কাজটা তাঁরা নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে করে চলেছেন, উপরন্তু এছাড়া আর কোনও উপায়ও যে নেই। অনেকেই এই রেস্তোরাঁয় বহুবছর ধরে ঘাম ঝরিয়ে আসছেন — ঊষা রমা সুতার ২১, সংগীতা নারায়ণ শিন্ডে ২০, মালুবাই দেবীদাস মাহালে ১৭ এবং ঊষা ভীমরাও ধাঙড় ১৪ বছর ধরে কাজ করছেন।

৪০-৫০ কেজি বেগুন দিয়ে শুরু হয় তাঁদের দিন। এই পরিমাণ বেগুন তাঁরা সারাদিনে অনেকবার রান্না করেন। বেগুন ভাপিয়ে, পুড়িয়ে, খোসা ছাড়িয়ে, সন্তর্পণে ভিতরের নরম শাঁস বার করে হাতে করে মাখতে হয়। তারপর রসুন আর চিনেবাদামের সঙ্গে কেজি কেজি কাঁচালঙ্কা হাতে করে ছিঁচতে হয়। গরম তেলে পেঁয়াজ আর বেগুন পড়ার আগে এই থেচা-টি (কাঁচালঙ্কাবাটা আর বাদামের শুকনো-শুকনো চাটনি) ছাড়তে হয়, সঙ্গে থাকে কুচিয়ে রাখা ধনেপাতা। এখানকার মেয়েরা হররোজ কয়েক ডজন কিলো পেঁয়াজও কাটেন।

PHOTO • Kavitha Iyer
PHOTO • Kavitha Iyer

বাঁদিকে: কৃষ্ণজি ভারিতের মহিলাদল প্রতিদিন ২,০০০টি পোলি বা চাপাতি বানান, সঙ্গে ১,৫০০টা বাজরার ভাকরিও থাকে। ডানদিকে: রেস্তোরাঁর পার্সেল-চালান খুপরির বাইরে অপেক্ষারত তরকারিভর্তি প্লাস্টিকের থলি

কৃষ্ণজি ভারিতের জনপ্রিয় কেবল স্থানীয়দের মধ্যেই আটকে নেই কিন্তু, এখানে দূর-দূরান্তের শহর-তেহসিলের মানুষও এসে উপস্থিত হন। ভিতরের ন’টা প্লাস্টিকের টেবিলে বসে যেকজন আজ সাততাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সারছেন, তাঁদের কয়েকজন সুদূর পাচোরা আর ভুসাওয়াল থেকে এসেছেন — যথাক্রমে ২৫ ও ৫০ কিমি দূর।

কৃষ্ণজি ভারিত থেকে প্রতিদিন ট্রেনে চেপে ১০০০টা পার্সেল রওনা দেয় ৪৫০ কিমি দূর ডোম্বিভলি, থানে, পুণে ও নাসিকের উদ্দেশে।

২০০৩ সালে অশোক মোতিরাম ভোলে এই দোকানটি চালু করেন। স্থানীয় এক সাধুবাবা তাঁকে বলেছিলেন যে খাবারদাবারের দোকান খুললে লাভবান হবেন, সেজন্য তাঁর নামেই এই রেস্তোরাঁর নাম কৃষ্ণজি ভারিত। ম্যানেজার দেবেন্দ্র কিশোর ভোলে জানাচ্ছেন, তাঁদের দোকানের ভারিতটা খাঁটি ঘরোয়া উপায়ে তৈরি হয়, যেটা কিনা লেভা-পাতিল জাতির লোকেরাই সবচাইতে ভালোভাবে বানান।

উত্তর মহারাষ্ট্রের খান্দেশ এলাকায় বসবাসকারী লেভা-পাতিল সম্প্রদায়টি আর্থসামাজিক রূপে বেশ প্রভাবশালী। এই কৃষিজীবী জাতিটির ভাষা, রান্নাবান্নার আদবকায়দা ও সাংস্কৃতিক ধারা সবই অনন্য।

বেগুন ভর্তার সুবাসে ম-ম করছে গোটা রেস্তোরাঁ, ওদিকে ডিনারের হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে বলে একের পর এক পোলি ও ভাকরি ছাড়তে লাগলেন কৃষ্ণজি ভারিতের নারীবাহিনী। হররোজ তাঁরা হাজার দুয়েক পোলি (গমের স্যাঁকারুটি) আর দেড় হাজারখানা ভাকরি (বাজরার স্যাঁকারুটি, কৃষ্ণজি ভারিতে মূলত বাদরি বা পার্ল মিলেট ইস্তেমাল হয়) বানিয়ে থাকেন।

রাতের খাবারের সময় আসন্ন, সারাদিনের খাটাখাটনির পালা প্রায় সাঙ্গ হয়ে এল, একটা একটা করে ভারিতের পার্সেল বেঁধে ঘরের দিকে এগোবেন মহিলারা।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Kavitha Iyer

कविता अय्यर गेल्या २० वर्षांपासून पत्रकारिता करत आहेत. लॅण्डस्केप्स ऑफ लॉसः द स्टोरी ऑफ ॲन इंडियन ड्राउट (हार्परकॉलिन्स, २०२१) हे त्यांचे पुस्तक प्रकाशित झाले आहे.

यांचे इतर लिखाण Kavitha Iyer
Editor : Priti David

प्रीती डेव्हिड पारीची वार्ताहर व शिक्षण विभागाची संपादक आहे. ग्रामीण भागांचे प्रश्न शाळा आणि महाविद्यालयांच्या वर्गांमध्ये आणि अभ्यासक्रमांमध्ये यावेत यासाठी ती काम करते.

यांचे इतर लिखाण Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra