২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, সন্ধে ৬টা। ছবির মতো সাজানো খোলদোড়া গ্রামের দিগন্ত ছাড়িয়ে সুয্যিমামা অস্ত যাচ্ছে, এদিকে অনন্ত রাত্রি কাটানোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রামচন্দ্র দোড়াকে। অমিত শক্তিধারী, দূরপাল্লার ‘কমান্ডার’ টর্চখানা একবার খতিয়ে দেখে বিছানা গোছানোয় মন দিলেন।
সাদামাটা গেরস্থবাড়ি, ডাল ও পাঁচমিশালি চচ্চড়ি সহযোগে রাতের খাবার বানাচ্ছেন রামচন্দ্রের স্ত্রী জয়শ্রী। পাশের বাড়িতে রাতের তোড়জোড় করছেন কাকামশাই দাদাজি দোড়াকে, ৭০। কাকিমা শাকুবাইও রান্নায় ব্যস্ত — রুটির পাশাপাশি ভাতও রাঁধছেন তিনি। সুগন্ধী প্রজাতির এই চালটা তাঁরা নিজেদের খেতে চাষ করেন।
“ইন্তেজাম প্রায় সবই হয়ে গেছে,” ৩৫ বর্ষীয় রামচন্দ্র দোড়া জানালেন আমায়, “রাঁধা হয়ে গেলেই রওনা দেব।” কাকা-ভাইপোর রাতের খাবারটুকু জয়শ্রী ও শাকুবাই মিলে ছাঁদা বেঁধে দেবেন বলে জানালেন তিনি।
আজ আমি দোড়াকে পরিবারের দুটি প্রজন্মের অতিথি। দাদাজি, রামচন্দ্র, জয়শ্রী ও শাকুবাই — এঁরা মানা সম্প্রদায়ের (এ রাজ্যের তফসিলি জনজাতি রূপে নিবন্ধিত) মানুষ। প্রথমের জন কীর্তঙ্কর (কীর্তনিয়া), বাবাসাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পেশায় চাষি। দ্বিতীয় জনের বাবা, অর্থাৎ দাদাজির বড়দা ভিকাজি, এতটাই অসুস্থ যে চাষবাস করতে অক্ষম — তাই পারিবারিক ৫ একর জমিজমার দায়-দায়িত্ব সব রামচন্দ্রের একার ঘাড়ে। একদা এি গাঁয়ের ‘পুলিশ পাতিল’ ছিলেন ভিকাজি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ, কারণ গ্রাম ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে উনিই সেতুবন্ধনের কাজটা করতেন।
দোড়াকে পরিবারের জমিটি নাগপুর জেলার ভিওয়াপুর তেহসিলের এই গ্রামটি থেকে মাইল দুয়েক দূরে। জংলি জন্তু-জানোয়ারের থেকে ফলন্ত ফসল রক্ষা করতে হবে, তাই সারারাত জেগে পাহারা দেওয়া একান্তই জরুরি। সেই জাগলি বা রাতপাহারায় যাব বলেই গোছগাছ করছিলাম সবাই। আমাদের সাতজনের দলে রামচন্দ্রের নয় বছর বয়সি বড়ো ছেলে আশুতোষও ছিল।
শহুরে বাবুবিবিদের জন্য এটা নিছক একখান অ্যাডভেঞ্চার ঠিকই, তবে আমার নিমন্ত্রণকর্তাদের কাছে এটা রোজকার ব্যাপার — যা সম্বৎসর না করে উপায় নেই। লংকা, তুর (অড়হর), গম, মাষকলাই — খেতের রবিশস্য গোলায় তোলার সময় হয়ে আসছে, এমন সময় পাহারা যে দিতেই হবে!
এর উল্টোদিকেই দাদাজির খেত, তবে আজকের রাতটা আমরা রামচন্দ্রের জমিতেই কাটাব। রাতের খাওয়াটা খেতেই সারব, হয়তো বা আগুনের চারিধারে বসে। শীতের হাড়কাঁপানি ভাবটা কমে আসছে, আজ বোধহয় ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকবে পারদ। ডিসেম্বর ২০২২ আর জানুয়ারি ২০২৩ — এই সময়কালের মধ্যে ভয়ানক ঠান্ডা পড়েছিল বলে জানালেন রামচন্দ্র, রাত হলেই ৬-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যাচ্ছিল তাপমাত্রা।
এই রাতপাহারার অর্থ পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে সারারাত মাঠেই পড়ে থাকতে হবে। একটানা এভাবে হাড়কাঁপানো হিমে পাহারা দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন গ্রামবাসীদের অনেকেই। অপর্যাপ্ত ঘুম, উদ্বেগ আর ঠান্ডার কোপে জ্বরজ্বালা আর মাথাব্যথা লেগেই থাকে — মুখে মুখে সমস্যার একখানা তালিকা বানিয়ে দিলেন রামচন্দ্র।
বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময় বউকে ডেকে তাঁর ঘাড়ের (সার্ভাইকাল) বেল্টখানা দিতে বললেন দাদাজি। তাঁর কথায়, “এটা হর-বখত পরে থাকতে বলেছেন ডাক্তারবাবু।”
ঘাড়ে ঠেকনা দিতে সার্ভাইকাল বেল্ট লাগবে কেন তাঁর? না শুধিয়ে পারলাম না।
“সওয়ালগুলো এট্টু সামলে রাখুন, সারাটারাত পড়ে আছে এসব নিয়ে কথা বলার জন্য।”
কিন্তু রামচন্দ্র আর থাকতে না পেরে ফিক করে হেসে বলে উঠলেন, “মাসকয়েক আগে, খেতের ৮ হাত উঁচু মাচান থেকে সটান মাটিতে এসে পড়েছিলেন। বুড়োর কপালের জোর আছে বলতে হবে, নইলে আজ আমাদের মাঝে থাকতেন না।”
*****
খোলদোড়া গ্রামটি ভিওয়াপুর তেহসিলের আলেসুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত, এখান থেকে নাগপুরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। গাঁয়ের সীমানা থেকে শুরু হচ্ছে চন্দ্রপুর জেলার চিমুর তেহসিলের বনজঙ্গল — যেটা কিনা তাড়োবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্পের (টিএটিআর) উত্তর-পশ্চিম অংশের মধ্যে পড়ে।
মহারাষ্ট্রের পূর্ব ভাগে, বিদর্ভের অরণ্যাকীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শয়ে শয়ে গ্রাম। এখানকার আর পাঁচটা গাঁয়ের মতো খোলদোড়ার মানুষজনও বন্যপ্রাণীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ। এই হানাদারদের প্রকোপে ফসল, গবাদি পশু, সবই খোওয়া যায়। অধিকাংশ খেতের চারদিকে বেড়াজাল রয়েছে বটে, তবে রাত্রির প্রহরা এখানকার জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার।
দিনভর নিয়মমাফিক খেতিবাড়ি করেন গাঁয়ের বাসিন্দারা, ফসলের দেখভাল ইত্যাদি। তবে রাত নামলেই, বিশেষ করে ফসল-কাটার মরসুমে, বন্য জন্তুর হাত থেকে পাকা ফসল বাঁচাতে ঘরদোর ছেড়েছুড়ে মাঠে গিয়ে জড়ো হন সব্বাই। অগস্ট থেকে মার্চ অবধি, অর্থাৎ কৃষিকাজ তুঙ্গে উঠলে শুরু হয় জাগরণের পালা, অবশ্য বাকি বছরটাতেও কিন্তু থেকে থেকে চলে পাহারা।
সেদিন বিকেল দিকে যখন খোলদোড়ায় এসে পৌঁছই, কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে সাড়াশব্দহীন ছিল চারদিক। জনমানুষহীন খেত-খামার, গজের পর গজ নাইলন শাড়ি দিয়ে ঘেরা প্রতিটা জোত। ৪টে বাজে, অথচ এদিক সেদিক গুটিকয় কুকুর বাদে গ্রামের গলিঘুঁজিতেও কারও দেখা নেই, কেমন যেন পাণ্ডববর্জিত মনে হচ্ছিল।
দাদাজির বাড়ি গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, গাঁ-টা এমন নিশ্চুপ শুনশান কেন? জবাব এল, “রাত্তিরে আদৌ দুচোখের পাতা এক করতে পারব কিনা জানিনে তো, তাই দুপুর ২টো থেকে ৪.৩০টে পর্যন্ত সব্বাই ঘুমোই।”
“ওরা [চাষিরা] দফায় দফায় মাঠের চক্কর কাটে সারাটাদিন। টানা ২৪ ঘণ্টার খাটনি,” ইয়ার্কি করেই বললেন তিনি।
গোধূলি নামলেই কেউ যেন জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে দেয় গ্রামে। ঘরে ঘরে রান্না চাপান মহিলারা, রাত-পাহারার তোড়জোড়ে মাতে মরদের দল, রাখালের পিছু পিছু জঙ্গল ঠেলে গোঠে ফিরে আসে গরুর পাল।
১০৮টির মতো গেরস্থালি (জনগণনা ২০১১) নিয়ে খোলদোড়া গ্রামটি তাড়োবা ভূখণ্ডের অংশ। চতুর্দিকে ঘন বন, সেগুনের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে আরও নানান গাছপালা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই ক্ষুদ্র ও প্রান্তবাসী কৃষক। মূলত মানা আদিবাসী ও মাহার দলিত সম্প্রদায় দুটি ছাড়াও অন্যান্য জাতিভুক্ত কয়েকটি পরিবার থাকে এখানে।
এই গাঁয়ের চাষজমির মোট পরিমাণ ১১০ হেক্টর। মাটি খুবই উর্বর, তবে মোটের উপর বৃষ্টিই ভরসা। সিংহভাগ কৃষক ধান আর ডাল চাষ করেন। কেউ কেউ গম, মিলেট ও শাকসবজিও ফলান। নিজ নিজ জমিতে চাষ করা ছাড়াও তাঁরা অরণ্যজাত গৌণ সামগ্রী ও দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল। খেতিবাড়ি করে পেট চালানো দায়, তাই উঠতি প্রজন্মের অনেক ছেলেই রুজিরুটির সন্ধানে শহর-গঞ্জে পাড়ি দিয়েছে, যেমন দাদাজির পুত্র — ইনি পেশায় পুলিশ হাবিলদার, কর্মরত নাগপুরে। মজুরির খোঁজে অনেকে ভিওয়াপুরেও যান।
*****
রাতের খাবার রাঁধা হচ্ছে, ততক্ষণে গাঁয়ের হালচাল বুঝতে চটজলদি একটা চক্কর লাগালাম আমরা।
বছর পঞ্চাশেকের তিন মহিলার সঙ্গে মোলাকাত হল — শকুন্তলা গোপীচাঁদ নান্নাওয়ারে, শোভা ইন্দ্রপাল পেন্দাম ও পার্বতা তুলসীরাম পেন্দাম। হাতে সময় থাকতে থাকতেই খেতের পথে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিলেন। সঙ্গে একটি কুকুরও ছিল তাঁদের। জিজ্ঞেস না করে পারলাম না — ঘরকন্নার কাজ, খেতিবাড়ি, তার উপর রাতের প্রহরা, এত কিছু সামলান কেমন করে? “ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি আমরা, কিন্তু আর উপায়ই বা কী?” জবাব দিলেন শকুন্তলা। রাত্রে পালা করে পাহারা দেন এই তিনজন, সুরক্ষার জন্য একে অপরের গা ঘেঁষে থাকেন সর্বদা।
দাদাজির বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে, গাঁয়ের প্রধান সড়কে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখলাম গুণবন্ত গায়কোয়াড়কে। “কপাল ভালো থাকলে আজ বাঘের দেখা পেতে পারেন,” বলে উঠলেন তাঁদের একজন। “ফি দিনই দেখি, আমাদের খেত-খামারে বাঘ টহল দিচ্ছে,” জানালেন গুণবন্ত।
গ্রামের উপ-সরপঞ্চ (উপপ্রধান) রাজহংস বঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়ি এসেছি। দিনভর খাটাখাটনির শেষে খামারে যেতে হবে বলে তড়িঘড়ি নৈশভোজ সারছেন মানুষটি। পঞ্চায়েতের যা কিছু প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব সব তিনিই সামলান।
এরপর মোলাকাত হল গাঁয়ের পদস্থ মহিলা ‘পুলিশ পাতিল’ সুষমা ঘুটকের সঙ্গে, স্বামী মহেন্দ্রর বাইকের পিছনে বসে নিজেদের খেতের দিকে যাচ্ছিলেন। রাতের খাবার, একজোড়া কম্বল, লাঠি এবং একখান দূরপাল্লার টর্চ বেঁধে নিয়েছেন সঙ্গে। পথে অনেককেই দেখলাম টর্চ, লাঠি আর কম্বল নিয়ে নিজের নিজের খেতের পানে রওনা দিয়েছেন।
“চলা আমচা বারোবর,” সুষমা একগাল হেসে নিজের খামারে আসতে আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের। “রাত্তিরে অনেক ধরনের আওয়াজ-টাওয়াজ কানে আসবে,” বললেন তিনি, “অন্তত ২.৩০টা অবধি জেগে থাকুন, তবেই এসব শব্দ-টব্দ শুনতে পাবেন।”
রাত নামলে খাবারের সন্ধানে হানা দেয় বুনো শুয়োর, নীলগাই, হরিণ, সম্বর, ময়ূর, খরগোশ। মাঝেমধ্যে বাঘ আর চিতাবাঘও চোখে পড়ে, জানালেন তিনি। “আমাদের জমিগুলো তো পশুখামার,” ঠাট্টার সুরে বলে উঠলেন সুষমা।
কয়েক ঘর বাদেই স্থানীয় রাজনীতিবিদ আত্মারাম সাভসাখালের ভিটে, বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ২৩ একর শালিজমির মালিক এই ৫৫ বছর বয়সি চাষি। রাতপাহারার প্রস্তুতি করতে করতে বললেন, খেতমজুরদের ইতিমধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা, “খামারটা বেশ বড়ো তো, পাহারা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।” স্থানে স্থানে ফলন্ত ফসল — আপাতত গম আর ছোলা চাষ করা হয়েছে — নজরদারির জন্য ছ-সাতটা মাচান তো আছেই।
৮.৩০টা বাজতে না বাজতেই দেখলাম, খোলদোড়ার প্রতিটি পরিবার তাঁদের রাত্রিনিবাস অর্থাৎ নিজ নিজ খেত-খামারে পৌঁছে গেছে।
*****
খেত জুড়ে বেশ কয়েকটি মাচান বানিয়েছেন রামচন্দ্র। একটায় বসলে অন্যগুলো দেখা যায় না বটে, তবে একে অপরের কথাবার্তা শোনা যায়। নিরাপদে ঘুমনোও যায় চাইলে। কাঠের এই মাচাগুলো বেশ উঁচু, মাটি থেকে ৭-৮ হাত উপরে বাঁধা, মাথার উপর খড় কিংবা ত্রিপলের ছাউনি। খানকতক মাচান এমনও আছে যেখানে দুজন মিলে দিব্যি থাকা যায়, তবে অধিকাংশই একজনের জন্য।
সত্যি বলতে, ভিওয়াপুরের এই অরণ্য-সংলগ্নে অঞ্চলে অবাক করা মাচানের সম্ভার দেখা যায় — একেকটার গড়ন একেক রকম। রাত-কাটানো চাষিরা যে স্থাপত্যবিদ্যায় কতখানি দক্ষ, তার প্রমাণ খোলা আসমানের নিচে বিদ্যমান।
“আপনি যে কোনও একটা মাচানে উঠে পড়ুন,” আমায় ডেকে বললেন রামচন্দ্র। খেতের মধ্যিখানে একটা মাচান পছন্দ হল, উপরে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া। এঁর খেতে আপাতত ছোলা ফলেছে, আর কদিন বাদেই কাটতে হবে। কেন জানি না মনে হল, খড়ের ছাউনি দেওয়া মাচাটায় ইঁদুর থাকতে পারে। চড়ার সময় মাচাটা দুলছিল। ৯.৩০ বাজছে, এখনও অবধি রাতের খাবার পেটে পড়েনি আমাদের। সিমেন্ট-নির্মিত গোলাঘরে আগুন জ্বালিয়ে বসে পড়লাম, হুহু করে পড়ছে পারদের মাত্রা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার বটে, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার ঝকঝকে।
খেতে খেতে কোথা বলতে লাগলেন দাদাজি:
“মাস চারেক আগে, হঠাৎ মাঝরাত্তিরে আমার মাচাটা ভেঙে পড়ল, ৭ হাত উপর থেকে মাটিতে এসে পড়লাম আমি। মাথার উপর ভর করে পড়েছিলাম তো, তাই ঘাড় আর পিঠে মারাত্মক চোট পেয়েছিলাম।”
রাত ২.৩০টা নাগাদ ঘটেছিল এটা। যে মাটিটার উপর পড়েছিলেন, সেটা তেমন একটা শক্ত ছিল না বলেই রক্ষে। দাদাজি জানালেন যে নিদেনপক্ষে ঘণ্টাদুই তো পড়েইছিলেন একা একা, অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। আসলে মাটিটা আলগা হয়ে গিয়েছিল, তাই কাঠের যে স্তম্ভগুলোর উপর মাচাটা বাঁধা আছে, তার একখানা ভেঙে পড়ে হুড়মুড় করে।
“নড়ার ক্ষমতা ছিল না, সাহায্য করার মতো কেউ ছিলও না।” আশেপাশে মেলা লোকজন থাকলেও রাত নামলে আপনি একা, কারণ প্রত্যেকেই নিজের নিজের খেত-খামারে প্রহরায় ব্যস্ত। “মনে হয়েছিল, সে যাত্রা বুঝি আর রক্ষে পাব না,” জানালেন দাদাজি।
শেষমেশ ভোররাতের দিকে কোনওমতে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকু জোগাড় করেন দাদাজি, তারপর, ঘাড়ে-পিঠে কালান্তক যন্ত্রণা সয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগান — ২-৩ কিলোমিটারের সুদীর্ঘ পথ। “ঘরে পা ফেলতেই বাড়ির লোক, পাড়াপড়শি হন্যে হয়ে দৌড়ে আসে সবাই।” শাকুবাই তো ভয়েই কাঁটা।
খুড়োমশাইকে নিয়ে ভিওয়াপুর তেহসিল সদরে যান রামচন্দ্র, সেখান থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে নাগপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। দাদাজির ছেলে এসে ভর্তির বন্দোবস্ত করেছিলেন।
এক্স-রে আর এমআরআই স্ক্যানে ধরা পড়ে চোট, তবে ভাগ্যিস হাড়গোড় ভাঙেনি। কিন্তু দুর্ঘটনাটির পর থেকে এই ছিপছিপে মানুষটি একটানা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারেন না, মাথা বনবন করে, তখন বাধ্য হয়ে শুয়ে পড়েন। এছাড়া ভজন-কীর্তন তো আছেই।
“রাতপাহারা দিতে গিয়ে এই মূল্যটা চুকিয়েছি, কিন্তু কেন? কারণ এটা না করলে বুনো জন্তু-জানোয়ার সবকিছু খেয়ে সাফ করে দেবে, ফসলের একটা দানাও পাব না,” আমায় জানালেন তিনি।
তবে জোয়ান বয়সে কিন্তু জাগলির কোনও দরকার হত না, বললেন দাদাজি। গত ২০ বছরে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে বন্যপশুর হানা। জঙ্গল কমে এসেছে, পশুপ্রাণীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারদাবার বা জলও পায় না। উল্টে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে। তাই রাত হলেই খেতভরা ফসল সাবাড় করতে ওঁত পেতে থাকে ওরা, আর রাতের পর রাত জেগে মাঠ পাহারা দেন হাজার হাজার চাষি।
দুর্ঘটনা, মাচা থেকে পড়ে যাওয়া, হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি হওয়া, নিদ্রাহীনতা থেকে জন্ম নেওয়া মানসিক রোগ ও শারীরিক অসুখ-বিসুখ — খোলদোড়ার কৃষকজীবনের জীবনের নতুন বাস্তব এটাই। কথাটা বৃহত্তর বিদর্ভের জন্যও খাটে, যার ফলে কৃষিসংকটজাত সমস্যা গভীর হয়েছে।
বিগত বছর দুই, গ্রামাঞ্চলে ঘোরাঘুরির সুবাদে এমন বহু কৃষকের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে যাঁরা স্লিপ অ্যাপনিয়ার শিকার। এটি একধরনের মারাত্মক নিদ্রারোগ যার ফলে ঘুমানোর সময় নিজের থেকেই বারংবার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এই রোগে আক্রান্তরা জোরে জোরে নাক ডাকেন এবং সারারাত ঘুমানোর পরেও ক্লান্তি কাটে না।
“শরীরটার দফারফা হয়ে যায় এ রোগে — সারাদিন খাটতে বাধ্য, উপরন্তু রাতেও ঠিকমতন ঘুম হয় না,” দুঃখ করছিলেন রামচন্দ্র, “একেক সময় তো এমনও হয় যে একদিনের জন্যও খেত ছেড়ে কোথাও যেতে পারি না।”
এই মাটিতে ফলা চাল বা ডাল যদি খান, তাহলে মনে রাখবেন, পশুপ্রাণীর হামলা থেকে সে আনাজ রক্ষা পেয়েছে কারণ কোনও না কোনও গাঁয়ের কেউ না কেউ রাতে পর রাত জেগে সে শস্য পাহারা দিয়েছিল, কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন রামচন্দ্র।
“সে যতই বিপদঘণ্টি বাজাই, আগুন জ্বালাই আর খেতে বেড়া দিই না কেন, তা সত্ত্বেও রাত্তিরবেলা পাহারা দিতে না গেলে কষ্টের ফসল জলে যেতেই পারে,” বললেন রামচন্দ্র।
*****
নৈশাহারের পর, লাইন দিয়ে রামচন্দ্রের পিছু পিছু খেত-খামারের ভুল-ভুলাইয়া পেরিয়ে অগ্রসর হলাম। নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে ঝলসে উঠল আমাদের টর্চ।
রাত ১১টা বাজে, খানিক থেমে থেমে দূর থেকে ভেসে আসছে “ওই...ওই...ইইইইই” চিৎকার। এভাবেই জংলি জানোয়ারদের ভয় দেখিয়ে মাঠে-মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করেন চাষিরা।
অন্যদিন, যখন একলা থাকেন, তখন প্রতি ঘণ্টায় একবার করে মাঠের চক্কর লাগান রামচন্দ্র। হাতে থাকে ইয়াব্বড় একখান ওজনদার লাঠি। সবচাইতে বেশি করে চোখকান খোলা রাখতে হয় ভোররাত ২টো থেকে ৪টে পর্যন্ত, কারণ ওই সময়টাতেই বন্যপ্রাণীর সক্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। পাহারার ফাঁকে ফাঁকে দুচোখের পাতা এক করার চেষ্টা থাকে ঠিকই, তবে অসতর্ক হওয়ার জো নেই।
মাঝরাত্তির নাগাদ গ্রামের একজন বাইকে চেপে খবর দিয়ে গেলেন, আলেসুরে নাকি রাত্রিভর কাবাডি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ঠিক করলাম, খেলাটা দেখতে যাব। রামচন্দ্রের ছেলে আর দাদাজিকে খেতে রেখে বাকিরা রওনা দিলাম আলেসুরের দিকে, খামার থেকে গাড়িপথে ১০ মিনিট।
আলেসুর গ্রাম পঞ্চায়েতে কাবাডি খেলা চলছে, রাত-পাহারার ফাঁকে তা দেখতে ভিড় করেছেন গ্রামবাসীরা
যেতে যেতে একদল বুনো শুয়োর রাস্তা পারাপার করছে দেখলাম, পিছু পিছু দুটো খ্যাঁকশেয়াল। খানিক পরেই, বিক্ষিপ্ত বনের ধারে নজরে এলো হরিণের পাল। তবে এখনও অবধি কিন্তু বাঘমামার দেখা মেলেনি।
আলেসুরে পৌঁছে দেখি পড়শি গাঁয়ের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল কাবাডি খেলতে নেমেছে। দর্শকে দর্শকে ছয়লাপ, উত্তেজনায় টইটম্বুর। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছে ২০টিরও বেশি দল, শেষ হতে হতে রাত কাবার হয়ে যাবে। চূড়ান্ত ম্যাচটি সকাল ১০টায় হওয়ার কথা। সারারাত ধরে নিজ নিজ খেত আর প্রতিযোগিতাস্থলের মধ্যে যাতায়াত করবেন চাষিরা।
কাছেপিঠে নাকি বাঘ দেখা গেছে, মুখে মুখে ফিরছে সে কথা। “খুব সাবধান কিন্তু,” ওঁদের মধ্যে একজন বললেন রামচন্দ্রকে। সন্ধেবেলায় আলেসুরের এক বাসিন্দা দেখেছেন বাঘটাকে।
বাঘের দর্শন পাওয়াটা কিন্তু বেশ রহস্যময় ব্যাপার।
একটু পরেই রামচন্দ্রের খেতে ফিরে এলাম আমরা। রাত ২টো বেজে গেছে, গোলাঘরের কাছেই একটা খাটিয়ার উপর ঘুমিয়ে পড়েছে আশুতোষ। চুপটি করে বাচ্চাটির উপর নজর রাখছেন দাদাজি, আগুনটা যাতে নিভে না যায় সেদিকেও চোখ রেখেছেন। আমরা ক্লান্ত ঠিকই, তবে ঘুম পায়নি তখনও। খামারটার আরেক চক্কর লাগালাম।
দশম শ্রেণির পর আর বিদ্যালয়মুখো হননি রামচন্দ্র, তবে অন্য কোনও কামকাজ জোটাতে পারলে যে চাষবাসের জগতে পা রাখতেন না, একথা স্পষ্ট জানালেন। দুই সন্তানকে নাগপুরের একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে দাখিল করেছেন, তিনি চান না তারা চাষ করুক। আপাতত বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসেছে ছোট্ট আশুতোষ।
হঠাৎই দিগ্বিদিক ফেটে পড়ল প্রবল শব্দে, কান পাতা দায়! চাষিরা থালি (থালা) বাজাচ্ছেন, তারস্বরে চিৎকার করছেন। এভাবেই থেকে থেকে তাঁরা কোলাহল করে ওঠেন, যাতে জংলি জানোয়ারের দল কাছে ঘেঁষতে না পারে।
আমার হতভম্ব চোখমুখ দেখে হাসি চাপতে পারছেন না দাদাজি। রামচন্দ্রেরও একই দশা। “এসব খুবই অদ্ভুত লাগতে পারে আপনার,” বললেন তিনি, “তবে সারারাত্তির কিন্তু এটাই চলে। কোনও জন্তু যদি এই খামার থেকে অন্য খামারে ঢোকার চেষ্টা করে, তখন চিল্লিয়ে তার উপস্থিতির কথা জানান দেন চাষিরা।” ১৫ মিনিট পর আবার সব চুপচাপ, টুঁ শব্দটি নেই কোত্থাও।
ভোররাত ৩.৩০টে নাগাদ, তারা ঝলমল আকাশ তলে, আমরা যে যার মতো উঠে পড়লাম নিজের নিজের দোদুল্যমান মাচানে। দশদিকে গাঢ় হয়ে উঠল পোকামাকড়ের কলতান। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম, মাচায় কোনওমতে এঁটেছে আমার দেহটা। মাথার উপর ছেঁড়াখোঁড়া সাদা ত্রিপল পৎপৎ করে উড়ছে হাওয়ায়। তারা গুনতে গুনতে খানিক চোখ লেগে গিয়েছিল। থেকে থেকে চাষিদের চিৎকার শুনতে শুনতে আলো ফুটল পুব আকাশে। টঙের অপর থেকে দেখলাম দিগন্ত বিস্তৃত পান্না-সবুজ খেতে বিছানো রয়েছে দুধ-সাদা হিমের আলোয়ান।
কাকা-ভাইপো অবশ্য খানিকক্ষণ আগেই উঠে পড়েছেন। মোটে একখানি কমলালেবুর গাছ রয়েছে খেতে, কয়েকটি ফল পেড়ে আমায় বাড়ি নিয়ে যেতে বললেন দাদাজি।
চটজলদি একবার খেত পরিদর্শন করে ফেললেন রামচন্দ্র, তাঁর পিছু নিলাম আমি। সতর্কতার সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন কোনও জন্তু-জানোয়ার ফসলে হাত দিয়েছে কিনা।
৭টার সময় গাঁয়ে ফিরলাম। রাতে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে নিজের নসিবের উপর বেশ প্রসন্ন ছিলেন তিনি।
তবে গতরাতে অন্য কারও খামারে বুনো পশুপ্রাণী হানা দিয়েছিল কিনা, সেটা বেলা না বাড়ার আগে জানতে পারবেন না।
নিমন্ত্রণকর্তাদের বিদায় জানাতেই মিল থেকে সদ্য ছাঁটাই হয়ে আসা এক প্যাকেট চাল হাতে তুলে দিলেন। এ খুশবুদার শস্য তাঁদেরই খেতের ফসল। রাতের পর রাত অনন্ত প্রহরায় ঘাম ঝরান রামচন্দ্র, যাতে এ আনাজের অকালমৃত্যু না ঘটে।
মাঠঘাট থেকে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরছেন অসংখ্য মেয়ে-মরদ, তাঁদের ছেড়ে রওনা দিলাম গাড়িতে, পিছনে পড়ে রইল খোলদোড়ার রাতজাগা খেত-খামার। আমার অ্যাডভেঞ্চারের নটেগাছটি মুড়োল বটে, তবে ওঁদের মাজাভাঙা খাটনির অনন্ত চক্র এই তো সবে শুরু।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র