একতলার ঘরটা তালা মারা, নিশ্চুপ। যদিও এতো তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। পাশেই যে টিনের ছাউনি আর কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো খুপরিটি রয়েছে সেটাও জনমানবশূন্য, শুধু ডাঁই করা আছে কিছু চেয়ার-টেবিল, লোহার একটা বেঞ্চি, আয়রন সিরাপ আর ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের কিছু প্যাকিং বাক্স আর ছেঁড়াখোড়া কাগজপত্র। এছাড়াও পড়ে রয়েছে একটা পুরোনো জং-ধরা সাইনবোর্ড। নতুন সাইনবোর্ডটা অবশ্য সদর্পে জ্বলজ্বল করছে সেই তালা মারা দরজটার উপরে। সেখানে লেখা আছে: 'নতুন ধরনের সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শাবরি মহল্লা, ডাল এসজিআর [শ্রীনগর]।'
এখান থেকে নৌকায় গেলে মিনিট দশেক দূরত্বেই রয়েছে নাজির আহমেদ ভাটের 'ডাক্তারখানা'। সেটা সাধারণত সবসময়ই খোলা থাকে আর বেশ ভালোই ভিড় হয়। হাড়কাঁপানো এই শীতের বিকালে নিজাম এবেলার মতো তাঁর শেষ খরিদ্দার ও রোগীর 'চিকিৎসা' করছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় অবশ্য তাঁকে আবার আসতে হবে ওবেলার রোগীদের দেখতে। কাঠের খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা পাটাতন দিয়ে বানানো এই যে ছোট্টোখাট্টো দোকানটি, এখানে দ্বিতীয় একটি কামরাও আছে ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল 'ভাট মেডিকেট কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট'।
ষাট ছুঁই ছুঁই হাফীজা দর একটা বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি নৌকাতে করে নাজির 'ডাক্তারকে' নিয়ে যেতে এসেছেন। কাছেই মিনিট দশেক দূরত্বে তাঁর মহল্লা। "আমার শাশুড়িকে কিছু ইঞ্জেকশন নিতে হয় সুগারের জন্য। বুড়ি মানুষ তো, এখানে আসতে পারেন না, তাই নাজির সাহেব দয়া করে আমাদের বাড়িতে এসে ইঞ্জেকশনগুলো দেন," হাফীজার কৃতজ্ঞতায় যেন তৌসীফের মেঘ ঝরে পড়ছিল নাজিরের উপর। "ওখানে [স্বাস্থ্যকেন্দ্রে] কোনও ডাক্তারই থাকে না," বলছিলেন দর। হাফীজা একাধারে গৃহকর্ত্রী ও কৃষক, তাঁর শোহর নিজেও একজন কৃষক, এছাড়াও তিনি ডাল হ্রদে একটি শিকারা চালান। "ওরা শুধু বাচ্চাদের পোলিওর টিকা খাওয়ায়, তাছাড়া বিকেল ৪টের পর থেকে ওটা এমনিতেও তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে।"
২০১৯ সালের অগস্ট থেকে কাশ্মীরে টানা লকডাউন আর কারফিউ শুরু হওয়ার পর থেকে হ্রদের দ্বীপগুলিতে বসবাসকারী মানুষজন আজ দুবছর হতে চললো ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে (এনটিপিএইচসি) ডাক্তারের টিকিটিও দেখেননি। "কয়েকবছর আগে অবধি ওখানে একজন ডাক্তার থাকতেন, খুবই ভালো পরিষেবা দিতেন তিনি। তবে ২০১৯ সালে তাঁর বদলি হয়ে যায় আর তারপর থেকে ওখানে কোনও ডাক্তারকে আমরা পাইনি," বললেন কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা ৪০ বছরের টুরিস্ট ফটোগ্রাফার মহম্মদ রফিক মল্ল। "তাঁরা (স্বাস্থ্যকর্মীরা) প্রতিদিন আসেনও না, আর এলেও ঘন্টা কয়েকের বেশি মোটেই থাকেন না।"
শ্রীনগরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর প্ল্যানিং অফ দ্য চিফ মেডিক্যাল অফিসারের দফতরের বক্তব্য অনুযায়ী প্রতিটি 'নতুন ধরনের সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে' (যেগুলি আদতে স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ছিল) ডিরেক্টরেট অফ হেল্থ সার্ভিসের অধীনে ন্যূনতম একজন করে এমবিবিএস ডাক্তার (স্বাস্থ্য আধিকারিকের ভূমিকায়), একজন ফার্মাসিস্ট, একজন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী (ফিমেল মাল্টিপারপাস হেলথ ওয়ার্কার, এফএমপিএইচডাব্লিউ) এবং একজন নার্সিং কর্মীর উপস্থিতি জরুরি।
"শুধুমাত্র (পোলিও) টিকাকরণের সময় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটা জ্যান্ত হয়ে ওঠে, তখন মাইকে ঘোষণা করা হয়," জানালেন ২৫ বছরের ওয়াসিম রাজা যিনি পর্যটকদের জন্য ফটোগ্রাফারের কাজ করেন একটি নৌকায়। এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি যেখানে অবস্থিত সেই মহল্লাতেই তিনি থাকেন (অর্থাৎ কুলি মহল্লা; স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাইনবোর্ডে যদিও ভুলবশত পাশের মহল্লার নাম লেখা আছে)। "ফার্মাসিস্ট যখন যখন পারেন তখন বাড়িতে এসে আমার বাবাকে স্যালাইন দেন, কিন্তু যখনই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর হয়ে ওঠে তখনই দেখি যে এটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। আমরা বাধ্য হই নাজির কিংবা বিলালের [নাজিরের মতোই আরেকজন কম্পাউন্ডার যিনি ডাক্তারের ভূমিকা পালন করছেন বাধ্য হয়ে] কাছে যেতে। অথবা জাতীয় সড়কে পৌঁছনোর চেষ্টা করি হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য। সময় নষ্ট তো হয়ই, তাছাড়া বিপদ আপদের সময় ভোগান্তির কূলকিনারা পাওয়া যায় না।"
নিকটবর্তী সরকারি জেনারেল হাসপাতাল, অর্থাৎ শ্রীনগরের রাইনাওয়ারিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে পোঁছাতে হলে, কুলি মহল্লা থেকে নৌকায় ১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে বুলেভার্ড রোডে উঠতে হবে, তারপর সেখান থেকে দুইবার বাস বদল। অথবা নৌকায় ৪০ মিনিট পাড়ি দিয়ে অন্য একটা স্থানে পৌঁছে সেখান থেকে ১৫ মিনিট হাঁটতে হবে। কাশ্মীরের হাড়কাঁপানো শীতে হ্রদের বাসিন্দাদের পক্ষে এভাবে যাতায়াত করাটা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে।
১৮-২০ বর্গ কিলোমিটারের ডাল হ্রদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দ্বীপ, সেখানে বসবাসকারী ৫০,০০০-৬০,০০০ মানুষের জন্য এই তালাবন্ধ এনটিপিএইচসিটি আর একটিমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, যেটি আদতে নন্দপোরায় অবস্থিত একটি আইএসএম (ইন্ডিয়ান সিস্টেম অফ মেডিসিনস্)। এটি এই বিশালাকার হ্রদের একপ্রান্তে অবস্থিত এবং এখানেও স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা মেলে না সচরাচর। এছাড়াও আরেকটি উপকেন্দ্র আছে বুলেভার্ড রোডে হ্রদের তীরে (দ্বীসসমুহের বাসিন্দাদের জন্য কোভিড-১৯এর টিকা নেওয়া বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর এটিই নিকটতম কেন্দ্র)।
সুতরাং হ্রদের দ্বীপসমুহে যাঁরা থাকেন, বিশেষ করে একেবারে প্রত্যন্ত দ্বীপগুলিতে, তাঁদের হাতের নাগালে থাকা স্বাস্থ্য পরিষেবা বলতে ওই নাজির এবং তাঁর মতো আরও তিনজন (তাঁদের প্রত্যেকেই ওষুধের দোকান চালান এবং তারই পাশাপাশি ডাক্তারের ভূমিকাও পালন করেন) যা প্রদান করে থাকেন তার বাইরে আর কিছুই নেই।
নাজির আহমেদ ভাট ডাল হ্রদের এই অঞ্চলে আজ ১৫-২০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় ৫০ বছরের এই মানুষটি সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা অবধি রোগীদের দেখভাল করেন, মাঝে শুধু বিকেল নাগাদ অল্প একটু বিশ্রাম করার সময় পান। গড়ে ১৫-২০ রোগী আসে তাঁর কাছে। হরেক কিসিমের চিকিৎসা মেলে নাজিরের এই 'ডাক্তারখানায়' – ঠান্ডা লাগা, সর্দিকাশি, জ্বর, রক্তচাপ, ব্যথাবেদনা কিংবা ছোটোখাটো ক্ষত যা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন তিনি। (আমায় কিন্তু তিনি হার্গিস বললেন না যে চিকিৎসাবিদ্যা অথবা ফার্মাসিতে তাঁর আদৌ যোগ্যতা আছে কিনা)। চিকিৎসা বাবদ নাজির টাকাপয়সা নেন না। সাধারণত মানুষের যা যা ওষুধপত্র লাগে উনি সবকিছুই দোকানে রাখেন এবং তা নায্য মূল্যেই বিক্রি করেন, রোজগার বলতে এটুকুই।
কাছেই অন্য আরেকটি ওষুধের দোকান তথা 'ডাক্তারখানায়' নিজের রক্তচাপ পরীক্ষা করাচ্ছিলেন ৬৫ বছরের মহম্মদ সিদিক্ব চাচূ, পর্যটকদের কাছে চামড়ার জিনিস বিক্রি করা তাঁর পেশা। সম্প্রতি শ্রীনগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর গল ব্লাডারটি অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয়েছে। "ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটা (এনটিপিএইচসি) ফালতু। ওখানে কেউ যায় নয়া। এই দোকানগুলিই আমাদের ভরসা কারণ এগুলি হাতের কাছে অবস্থিত, তাছাড়া এখানে সমস্ত ওষুধ পাওয়াও যায়," বললেন তিনি।
যে ক্লিনিকটিতে চাচূ এসেছেন সেটি বিলাল আহমেদ ভাটের। বিলাল থাকেন শ্রীনগরের দক্ষিণপ্রান্তে নওগ্রামে। তিনি একজন লাইসেন্স প্রাপ্ত কেমিস্ট এবং ড্রাগিস্ট। প্রমাণস্বরূপ তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের ফার্মাসি কাউন্সিল থেকে পাওয়া শংসাপত্রটি বার করে আমায় দেখালেন।
তাঁর দোকানে গিয়ে দেখলাম যে প্লাইউডের তাকে যত্ন করে সাজানো আছে ওষুধপত্র। এছাড়াও রোগীদের জন্য রাখা আছে একটি খাট। ভাট জানালেন যে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা অবধি তিনি ১০-২৫ জন রোগী দেখেন, তাঁদের বেশিরভাগই টুকটাক অসুখবিসুখ নিয়ে আসেন। নাজিরের মতো তিনিও চিকিৎসা বাবদ কোনও টাকা নেন না, নায্য মূল্যে ওষুধ বিক্রি করাটাই তাঁর রোজগারের একমাত্র পন্থা।
তিনি বারবার বলছিলেন যে ডাল হ্রদ অঞ্চলে একটি হাসপাতাল তৈরি করা উচিত। "নিদেনপক্ষে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং প্রসূতিদের জন্য একটি ছোটো হাসপাতাল দরকার যেখানে মহিলারা প্রয়োজনীয় পরিষেবা পান। এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষজন তাঁদের রক্তে সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করাতে পারবেন, যেখানে সিবিসি'র মতো অত্যাবশ্যকীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এখানকার অধিকাংশ মানুষই হতদরিদ্র শ্রমিক। ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে যদি সবরকমের ব্যবস্থাপনা থাকত, তাহলে তাঁরা শীতকালে আমার কাছে এসে ঠান্ডা লাগার ৫ টাকার ট্যাবলেট চাইতেন না।"
সেদিন সকালে বিলাল একজন ক্যান্সার রোগীর সেবা করতে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। "এসকেআইএমএসের অধীনে তাঁর চিকিৎসা চলছে, আমি গিয়েছিলাম তাঁর স্যালাইনের ব্যবস্থা করে দিতে," জানালেন তিনি। বিলাল শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের কথা বলছিলেন যেটি হ্রদের পূর্ব তটের নেহেরু পার্ক ঘাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। "আমাকে ওই সময়টায় দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। মানুষটা বড্ড গরিব, এককালে শিকারা বাইতেন, তাঁর থেকে টাকা চাইতে মন করল না।"
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ৪টে নাগাদ সময় বন্ধ হয়ে যায় এনটিপিএইচসিটি, ফলত ডালের দ্বীপনিবাসীরা আরোই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এই কেমিস্ট 'ডাক্তারদের' উপর। "বাড়িতে যখন থাকি তখন মাঝরাতেও আমার কাছে ফোন আসে," বলছিলেন বিলাল। একজন বয়স্ক মহিলা তাঁকে ফোন করেছিলেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাঁর। মধুমেহ এবং হৃদযন্ত্রের গণ্ডগোলে ভোগা এই মহিলা শ্রীনগরের একটি হাসপাতাল থেকে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। "ওরা যখন ভোররাতে আমায় ফোন করে আমার সন্দেহ হয়েছিল যে মহিলার হৃদযন্ত্র বোধহয় বিকল হতে বসেছে, তাই আমি ফোনেই পরামর্শ দিই তাঁকে সাত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ওরা তাই-ই করে এবং ধরা পড়ে যে মহিলার স্ট্রোক হয়েছে। নসীব ভালো ছিল, তাই সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন।"
হ্রদের প্রত্যন্ত দ্বীপগুলি, যেখানে পর্যটকের ক্যামেরা বা সংবাদমাধ্যমের নজর পৌঁছয় না, সেখানে এই সমস্যাটি আরোই জটিল। শীতকালে ছয় ইঞ্চি বরফের পরত ভেঙে নৌকা বাইতে হয় ধীরে ধীরে। গরমকালে যে দূরত্ব আধঘন্টায় পাড়ি দেওয়া যায় সেটাই তিন ঘন্টা ছাড়িয়ে যায় হ্রদের জল ঠান্ডায় জমে গেলে।
"আমাদের এমন একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রয়োজন যেখানে দিনরাত ডাক্তার থাকবে," বলছিলেন ২৪ বছরের হাদিসা ভাট। উনি ওই প্রান্তিক দ্বীপসমুহের তিন্ড মহল্লায় থাকেন। "রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষারও ব্যবস্থা থাকা দরকার। দিনের বেলা, এমনকি সন্ধ্যার সময়েও আমরা নাজিরের দোকানে যাই। কিন্তু রাত্রে যদি কারও শরীর খারাপ হয় তাহলে খুব বিপদ! নৌকা, দাঁড় ইত্যাদি সব জোগাড় করে রাইনাওয়ারি যেতে হয় আমাদের। রোগী প্রাপ্তবয়স্ক হলে না হয় ভোরের অপেক্ষা করা যায়, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তো সেটা সম্ভব নয়," জানালেন হাদিসা। তিনি ঘরের কাজ সামলান, তাঁর চার ভাই মরশুম অনুযায়ী কৃষিকাজ করেন কিংবা ডাল হ্রদে শিকারা চালান।
২০২১ সালের মার্চ মাসে তাঁর আম্মিজান পড়ে গিয়ে যখন হাড়ে আঘাত পান তখন নেহেরু পার্ক থেকে প্রায় ৮ কিমি দূরে দক্ষিণ শ্রীনগরের বারজুল্লায় অবস্থিত সরকারি বোন অ্যান্ড জয়েন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। "খোদার বরকতে আঘাতটা খুব একটা মারাত্মক কিছু ছিল না, তবে ওখানে পৌঁছতে আমাদের দুই ঘন্টা লেগেছিল (তার সঙ্গে লেগেছিল অটোরিক্সা আর ট্যাক্সির ভাড়া)," বললেন হাদিসার ভাই আবিদ হুসেন ভাট। "যেহেতু কাছাকাছি আর কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, তাই পরে আমাদের আরও দু'বার যেতে হয়েছিল ওই হাসপাতালটায়।"
দ্বীপের মানুষদের হাসপাতালে যেতে আসতে ভোগান্তির শেষ থাকে না, তাই ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তারিক্ব আহমেদ পাতলু তাঁর একটি শিকারাকে জলবাহিত অ্যাম্বুল্যান্সে রূপান্তরিত করেন (তাঁর একটি হাউস-বোটও আছে)। সংবাদমাধ্যমের তৎকালীন প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে এর পিছনে লুকিয়ে আছে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে তাঁর ফুফুর মৃত্যু। তিনি নিজেও কোভিড-১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এটাও একটা কারণ বটে এই অভিনব প্রচেষ্টার পিছনে। একটি ট্রাস্টের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার ফলে তাঁর এই জলবাহিত অ্যাম্বুল্যান্সে আজ রয়েছে একটি স্ট্রেচার, একটি হুইলচেয়ার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা, মাস্ক, গ্লুকোমিটার এবং রক্তচাপ মাপার একটি মনিটার। ৫০ বছর বয়েসের পাতলু আশা করছেন যে খুব শীঘ্রই তিনি এই অ্যাম্বুল্যান্সে একজন স্থায়ী ডাক্তার এবং একজন প্যারামেডিককে রাখার ইন্তেজাম করতে পারবেন। আন্দাজ করে বলেন আজ অবধি তিনি ৩০ জন রোগীকে হ্রদ পার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। উপরন্তু কেউ মারা গেলে তাঁর জানাজা বরদার হয় তাঁর এই অ্যাম্বুল্যান্স।
তবে হ্যাঁ, শ্রীনগরের স্বাস্থ্য আধিকারিকরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন এ সমস্যা লাঘব করার জন্য। ডাল হ্রদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেহাল অবস্থা সম্বন্ধে একজন বরিষ্ঠ আধিকারিককে জিজ্ঞেস করায় তিনি আমায় জানালেন শ্রীনগরের খানিয়ারে স্থিত তাঁর হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবের কথা। জেলার সদর হাসপাতালটি (রাইনাওয়ারিতে স্থিত জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল হাসপাতাল) ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড-১৯ হাসপাতালে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে যাঁদের কোভিড হয়নি এরকম বহু রোগী তাঁর হাসপাতালে আসতে শুরু করেছেন, যদিও এই অতিরিক্ত চাপ সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মীর কোনওরকম ব্যবস্থা করা হয়নি। "আগে সাধারণত দিনে ৩০০ রোগী আসতেন আমাদের এখানে, সেটা বেড়ে এখন ৮০০-৯০০ হয়ে গেছে, এমনকি এক একদিন ১,৫০০ রোগীও আসেন," এবছর জানুয়ারিতে আমাকে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি।
প্রশাসনের দৃষ্টিতে হ্রদবাসীদের ছোটোখাটো সমস্যা সামলানোর চেয়েও অন্যান্য দুরূহ অসুখবিসুখের চিকিৎসা করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, উক্ত আধিকারিকের মতে সেইজন্যই এনটিপিএইচসি এবং উপকেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেকে পাঠানো হয় রাত জেগে কাজ করতে, কখনও কখনও সেটা একটানা একাধিক রাতের জন্যও হয়। তাই কুলি মহল্লার এই এনটিপিএইচসিটি মাঝেমাঝেই কর্মীহীন হয়ে পড়ে থাকে। অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের (সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির সন্ধান), ফলত তাঁরাও কাজের চাপে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন।
৫০ বছরের ইফতিখার আহমেদ ওয়াফাই আজ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুলি মহল্লার এনটিপিএইচসিতে ফার্মাসিস্টের কাজ করছেন। তিনি বললেন যে প্রতি মাসে বার পাঁচেক তাঁকে খানিয়ারের হাসপাতালে রাত জেগে কাজ করতে যেতে হয়, আর সেই কারণেই তিনি তার পরেরদিন সকালবেলায় ডাল হ্রদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আর আসতে পারেন না। "আমদের এর জন্য কোনও অতিরিক্ত মাইনে দেওয়া হয় না, তবুও আমরা আমাদের দ্বায়িত্ব পালন করে যাই। আমি জানি যে প্রতিটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই পর্যাপ্ত সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীর বড্ড অভাব, আর গোটাটাই দিনে দিনে আরও শোচনীয় হয়ে উঠেছে এই অতিমারির কারণে," বললেন ইফতিখার।
তিনি জানালেন যে তিন বছর হতে চলল এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে কোনও ডাক্তার নিয়োগ করা হয়নি। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের এই ব্যাপারে আপিল করেছিলেন বটে, তবে তার জবাবে তাঁকে কিছু একটা করে মানিয়ে চলতে বলা হয়েছে। "এনটিপিএইচসিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজটাও আমিই করি। মাঝেমাঝে ইঞ্জেকশনগুলোও আমি দিই, এমনকি কোনও রোগী অনুরোধ করলে তাঁর রক্তচাপটাও আমিই মাপি।" খাতায় কলমে ওয়াফাইয়ের কাজের যে পরিধি, এসব সম্পূর্ণভাবে তার বাইরে, ওয়াফাই এটাই বোঝাচ্ছিলেন আমাকে। "কিন্তু রোগীরা তো সাধারণত সেসব কথা বুঝতে পারেন না, তাছাড়া আমি নিজেও চাই সাধ্যমতো তাঁদের সেবা করতে।"
এ হেন যত্নবান মানুষটিকে যখন দ্বায়িত্ব সামলাতে বাইরে যেতে হয় তখন ডাল হ্রদের দ্বীপনিবাসীরা এনটিপিএইচসির তালাবন্ধ দরজাটা পাশ কাটিয়ে পৌঁছে যান সেই ওষুধের দোকানগুলিতে যেগুলি তাঁদের বিপদ আপদে চব্বিশ ঘণ্টাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
তৌসীফ
: দোয়া
জানাজা
বরদার
: শবদেহ বয়ে
নিয়ে যায় যারা
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)