নারীর জন্মলগ্ন থেকে প্রাপ্তবয়স অবধি জীবনের পালাবদল এবং অন্তহীন কামকাজ, কেউ যার মূল্য দেয় না – এসব ঘিরেই গান গেয়েছেন পুণে জেলার এক ৭২ বছর বয়সী চাষি কুসুম সোনাওয়ানে

আঙারে আঙার গুঁজে ভেজা কাঠও জ্বলবে,
আর কত খাটব? আর কত খাটব? বাপের বাড়িতে তবু পাত্তা না মিলবে

আঙারে আঙার বিঁধে ভেজা কাঠও জ্বললো,
যতই খাটিস রে মা, যতই খাটিস রে মা, পাইবি নে মূল্য

২০ বছর আগে গাওয়া কুসুম সোনাওয়ানের এই দোহাগুলি শুনলেই চোখের সামনে ভাসে এক নারীর বিরামহীন অশেষ মেহনতের কথা – খেতিবাড়ির কাজ, ঘরকন্না কিংবা পরিবারের দেখভাল – কোনওদিনই কেউ যার মূল্য দেয় না।

“পুরুষরা মাঠেঘাটে কাজ করে বটে, তবে মহিলা চাষিদের খাটাখাটনি অনেক বেশি,” জানালেন ৭২ পার করা কুসুমতাই, জীবনের সিংহভাগটাই যাঁর কৃষিকাজে কেটেছে। “চাষের জমি যে আজও উর্বর আছে, তা মেয়েদের কৃপাতেই। অথচ আজ কিছু পুরুষ জোট বেঁধে সব ধ্বংস করে দিতে চাইছে।”

এই বয়সেও মহারাষ্ট্রের নন্দগাঁও গ্রামে পরিবারের ২.৫ একর জমির উপর চাষবাস করেন তিনি। “অড়হর কলাইগুলো পেকে গেছে। ওগুলো কাটব বলেই মাঠে এসেছি,” পুণে জেলার মুলশি তালুক থেকে মার্চের এক ভ্যাপসা বিকেলে ফোন করে জানিয়েছিলেন কুসুমতাই। অড়হর ছাড়াও নিজের জমিতে ধান ও হরভরা (ছোলা) চাষ করেন তিনি।

নিজে তো উদয়াস্ত খাটেনই, সেইসঙ্গে চাষের কাজ সামাল দিতে জনাকয় খেতমজুরও (পুরুষ ও মহিলা দুই-ই) নিযুক্ত করেন কুসুমতাই। তাঁর কথায়, “সবকিছু তো আর একা-হাতে সামলাতে পারি না।” কয়েকবছর আগে স্বামী মুকুন্দ সোনাওয়ানেকে হারিয়েছেন। চার সন্তানের মধ্যে মোটে একমাত্র ঊষাই চাষবাস করেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, নিবাস মুলশির জামগাঁও গ্রামে। কুসুমতাইয়ের অন্য তিন সন্তান, দুই ছেলে এবং এক মেয়ের কেউই কৃষির দুনিয়ায় পা রাখেননি।

১৯৮০ থেকে গরিব ডোঙ্গরি সংগঠনের এক করিৎকর্মা সদস্য কসুমতাই। মুলশির পাহাড়ি এলাকার গ্রামে গ্রামে যে হতদরিদ্র মানুষেরা রয়েছেন, তাঁদের অধিকারের জন্য আজও তিনি লড়াই চালাচ্ছেন দলের অন্যান্যদের সঙ্গে। কথায় কথায় নয়া কৃষি-আইনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক-আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি জানালেন, চাষবাসের প্রথা ও মানুষের রুজিরুটি, ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে দুটোই। “এমনটা হলে চাষির বাচ্চারা কী করবে বলুন তো? চাষিরা যে দিল্লি ও দেশের অন্যান্য প্রান্তে আন্দোলন করছেন, সেটা তো খুবই ভালো কথা।”

জাঁতাপেষাইয়ের গানের এই কিস্তিতে প্রকাশিত ১২টি ওভি (দোহা) সেই ১৯৯৯ সালে গেয়েছিলেন কুসুমতাই। বিদ্বান সমাজকর্মী হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁর নেতৃত্বে সেগুলি রেকর্ড করেছিল জিএসপির আদি দলটি।

PHOTO • Samyukta Shastri

পড়শি মহিলাদের সঙ্গে নন্দগাঁও গ্রামে নিজের বাড়িতে বসে গান গাইছেন কুসুম সোনাওয়ানে (চশমা পরিহিতা)

জাঁতাপেষাইয়ের গান নিয়ে কথা বলতে সর্বদা উৎসুক কুসুমতাই প্রথম দুটি ওভি বিশ্লেষণ করলেন, যার মধ্যে দিয়ে উঠে এল এক নারীর অসন্তুষ্টি। “মহিলারা যতই খাটুক না কেন, সারাদিন প্রতিদিন, অথচ মা-বাবার ঘরেও এই মেহনতের দাম পান না তাঁরা,” জানিয়েছিলেন কুসুমতাই, “কাঁচা কাঠ বা রসালো গাছের পাতা যেমন আঙারে গুঁজলে শেষমেশ জ্বলে উঠবেই, ঠিক তেমনই মূল্য না পাওয়া ও হররোজ অবহেলা সইতে থাকা এক নারীর খাটাখাটনি একদিন না একদিন রাগে-দুঃখে ফেটে পড়বেই।”

পরবর্তী ১০টি ওভিতে এক নারীর জন্মলগ্ন থেকে বয়স হওয়া অবধি জীবন ও সম্পর্কের অসংখ্য পালাবদলের কথা তুলে ধরেছেন কুসুমতাই।

দোহার কথক বলছেন, মেয়ে জন্ম নিলে মা-বাবার শিরে যেন বজ্রাঘাত হয়, আসলে যে পুত্রসন্তানের আশায় মুখিয়ে ছিলেন তাঁরা। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বন্ধু জুটলেও জুটতে পারে, যাদের কাছে বলা যায় সুখ-দুঃখের গোপন কথা। অথচ পড়শি মহিলারা কিন্তু সে মেয়ের কোনও কথাই শুনতে চান না। এক নারী কখন সবচাইতে খুশি হয়? যখন মা-মেয়ে একে অপরের কাছে উজাড় করে দিতে পারে গোপনতম কথাবার্তা। এমনটা হতেই পারে যে কথা বলতে বলতে কখন যে রাত কেটে ভোর হয়ে এল, দুজনের কেউই তা টের পেল না।

আরেকটি দোহায় উঠে আসে এক মহিলা ও তার ভাইয়ের সম্পর্ক — নারী সযত্নে তাঁর হৃদয়ে সাজিয়ে রাখে ভাইয়ের স্নেহ। ভাইয়ের থেকে টাকাপয়সা বা উপহার পেতে মন চায় না, “ঘরকে ডাকিস শুধু,” এটুকুই যা দাবি। অন্য একটি দোহায় ভাইয়ের সঙ্গে আরশির তুলনা টেনেছেন কথক — তাঁর ভাই যে কতখানি সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য, সেটাই প্রমাণ হয়ে যায়।

আত্মবিশ্বাসী হওয়াটা খুবই জরুরি মেয়েদের জন্য, অন্য কারও উপর নির্ভর করে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়। নইলে তার দেওর বাবাজী সেই দূর্বলতার সুযোগ নিতে পারে। এই ওভিটিতে এক নারীর (বিশেষ করে বিবাহিত মহিলা) জীবনের সঙ্গে সর্পসম রজ্জুতে বাঁধা এক নৌকার উপমা টানা হয়েছে।

অশান্ত দরিয়া মাঝে টালমাটাল নৌকা, যে কোনও মুহূর্তে ভরাডুবি হতে পারে — এই রূপকের মাধ্যমে কথক বলছেন, নারীর জীবন যতই সুখদায়ক হোক না কেন, সে ব্যাপারে গর্ব করা উচিত নয়। চারিপাশে যারা রয়েছে, তাদের যে-কেউই ক্ষতি করতে পারে, সুতরাং তক্কে তক্কে থাকাটাই কাম্য। এই দোহাগুলিতে ফুটে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অনিশ্চয়তায় ভরা নারীজীবনের কাহিনি।

PHOTO • Samyukta Shastri

জীবনের সিংহভাগটাই চাষবাস করে কাটিয়েছেন কুসুমতাই। তাঁর কথায়, ‘মহিলা চাষিদের খাটাখাটনি অনেক বেশি’

শাশুড়িদের নিন্দে করতে সমাজ সিদ্ধহস্ত, কথায় কথায় “খিটখিটে” বলা হয় তাঁদের। পরবর্তী ওভিতে উঠে এসেছে তাঁদের প্রতি গায়কের সহানুভূতি। তাঁর শাশুড়ি যে মুক্তা ও প্রবালের ন্যায় অমূল্য এক মেয়েকে বড়ো করেছেন — গানে গানে সেকথাই জানাচ্ছেন কথক।

১১ নম্বর দোহায় গাঁথা আছে নারীর আনন্দের কথা — বোনপোর থেকে উপহার স্বরূপ একটি কালোরঙের চন্দ্রকলা শাড়ি পেয়েছেন, সাধারণত জানুয়ারি মাসে মকর সংক্রান্তি চলাকালীন এই শাড়ি পরে থাকেন মহিলারা। শাড়িটা পেয়েই তাঁর বোনকে (বোনপোর মা) গিয়ে বলছেন: “হাল ফ্যাশনের ধার, বম্বে ছাঁদের পাড়।”

এই কিস্তির অন্তিম ওভিতে কথক তাঁর বন্ধুকে জানান দিচ্ছেন, “বহু বহু দিন ধরে যুগের যুগান্তরে বেঁধেছি দোস্তি মোরা বড়ই মধুর।” তবে বন্ধুত্বের মাঝে উটকো কোনও কুচুটে ব্যক্তি এসে পড়লে অচিরেই যে সম্পর্কে ছেদ পড়তে পারে, এ নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

“রক্তমাংসে গড়া মেয়েদের কথা বলা হয়েছে এই ওভিগুলোতে,” বোঝালেন কুসুমতাই, “এসব তো আর খোলাখুলি সবার সামনে কইতে পারি না, তাই সুখ-দুঃখের সমস্ত কথা জাঁতাকেই শোনাই।” তাঁর কথায় উঠে এল জাঁতাকলের সঙ্গে নারীর নিবিড় সখ্যতার দাস্তান।

ফোনে বিদায় জানানোর আগে কুসুমতাই বলেছিলেন, “যখনই কোনও প্রশ্ন জাগবে মনে, কিংবা ধরুন জাট্যাভার্চ্যা ওভ্যা (জাঁতা পেষাইয়ের গান) নিয়ে কথা বলতে চান, ইচ্ছেমতো ফোন করে নেবেন আমাকে।”

কুসুম সোনাওয়ানের কণ্ঠে ১২টি ওভি শুনুন

আঙারে আঙার গুঁজে ভেজা কাঠও জ্বলবে,
আর কত খাটব? আর কত খাটব? বাপের বাড়িতে তবু পাত্তা না মিলবে।

আঙারে আঙার বিঁধে ভেজা কাঠও জ্বললো,
যতই খাটিস রে মা, যতই খাটিস রে মা, পাইবিনে মূল্য।

কাঠকুটো হোক যতই ভেজা গুঁজলে আঙার জ্বলবে ঢের,
জন্ম নিলে মাইয়ামানুষ কপাল পোড়ে বাপ-মায়ের।

মনের ফ্যাসাদ কইতে গেলে চুপটি করে শোনে, বন্ধু এমন হাজার হাজার রইছে মোদের সনে,
পড়শি সে’জন নামেই যদি পড়শি কেবল হয়, একটি কথাও শুনতে না চায়, দূর-দূরেতেই রয়।

মা-বিটি ওই গপ্পো বোনে, সুখ-দুঃখের সঙ্গোপনে,
কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, টের নাহি পায় দোঁহে।

কিনতে না চাস কিনিস না ছাই, দু’কান খুলে শোন্ দেখি ভাই,
হাজার দাবি ঠুকরে দিলেও ঘরকে ডাকিস শুধু।

দেওর করিবে রক্ষা তোরে, এমন কথা বলিস না রে,
মাঝদরিয়ার নৌকা রে সই, সাপের মতন কাছি।

নাওখানি ভাসালি, কত লোক হাসালি, যা ইচ্ছা তাই সখী করিসনে আর,
মাঝনদী ডিঙা তুই, দুলবি দুলবি হুই, আজ না হলেও কাল পাইবিনে পার।

শোন রে ননদ, কুঙ্কু দিয়া সাজাস দুয়ারখানি,
চৌকাঠে মোর আইল রে ভাই, আয়না সে’জন জানি।

দোহাই তোদের, ছেলের মা-কে খিটখিটে কেউ বলিসনে,
শকুন্তলা আমার বালা, মুক্তো-পলার মতোই সে।

হাল ফ্যাশনের ধার, বম্বে ছাঁদের পাড়, কালচে চন্দ্রকলা শাড়িখানি হায়,
রোসো দেখি এইবেলা, কিনে দিছে তোর পোলা, বোন রে আমার শোন্ মিঠে তারুবাই।

বহু বহু দিন ধরে যুগের যুগান্তরে বেঁধেছি দোস্তি মোরা বড়ই মধুর,
কিন্তু কুচুটে কেহ বিষিয়ে দিলেই স্নেহ, পলকে এ ঘর ভেঙে হবে চুরচুর।


Kusumtai, photographed in 1999 (left) and in 2018
PHOTO • Bernard Bel
PHOTO • Namita Waikar

১৯৯৯ (বাঁদিকে) ও ২০১৮ সালে কুসুম সোনাওয়ানে

পরিবেশক/গায়ক : কুসুম সোনাওয়ানে

গ্রাম : নন্দগাঁও

তালুক : মুলশি

জেলা : পুণে

জাতি : নববৌদ্ধ

বয়স : ৭২

সন্তান : দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে

পেশা : চাষি

তারিখ : ১৯৯৯ সালের ৫ই অক্টোবর এই গানগুলি রেকর্ড করা হয়েছিল

পোস্টার: সিঞ্চিতা মাজি

হেমা রাইরকর ও গি পইটভাঁ'র হাতে তৈরি জাঁতাপেষাইয়ের গানের আদি প্রকল্পটির সম্বন্ধে পড়ুন

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

नमिता वाईकर लेखक, अनुवादक आणि पारीच्या व्यवस्थापकीय संपादक आहेत. त्यांची ‘द लाँग मार्च’ ही कादंबरी २०१८ मध्ये प्रकाशित झाली आहे.

यांचे इतर लिखाण नमिता वाईकर
PARI GSP Team

पारी-जात्यावरच्या ओव्या गटः आशा ओगले (अनुवाद), बर्नार्ड बेल (डिजिटायझेशन, डेटाबेस डिझाइन, विकास, व्यवस्थापन), जितेंद्र मैड (अनुलेखन, अनुवाद सहाय्य), नमिता वाईकर (प्रकल्प प्रमुख, क्युरेशन), रजनी खळदकर (डेटा एन्ट्री)

यांचे इतर लिखाण PARI GSP Team
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra