কখনও ভোজপুরি তো কখনও বাংলা বা হিন্দি বলতে বলতে খদ্দের সামলাচ্ছিলেন মীনা যাদব, তাল মিলিয়ে চলছিল বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন আর পথচলতি অচেনা মানুষদের রাস্তা বাতলানোর পালা। এই দৃশ্য দক্ষিণ কলকাতার বহু ভাষাভাষী আর সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র লেক মার্কেটের। দেশান্তরি জীবনের রোজনামচায় যে সকল সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়, সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মীনা বলছিলেন: “কলকাতায় এটা [ভাষা] কোনও ব্যাপারই নয়।”

“ইয়ে সির্ফ কেহনে কি বাত হ্যায় কি বিহারি লোগ বিহার মেঁ রহেগা [এটা কথার কথা ছাড়া আর কিছুই না যে বিহারি মানুষজন কেবল বিহারেই থাকবে]। গতর খাটিয়ে কঠিন পরিশ্রমের কাজগুলো আমরাই করি, এটাই বাস্তব। মুটে, মজুর, ভিস্তি আর কুলি প্রত্যেকেই বিহারি। বাঙালির পক্ষে এভাবে গতর খাটানো অসম্ভব। নিউ মার্কেট, হাওড়া, শিয়ালদা, সে যেখানেই যাবেন, দেখবেন সেই বিহারিরাই ওজনদার লটবহর বইছে। কিন্তু এভাবে ঘাম ঝরানো সত্ত্বেও কেউ বিন্দুমাত্র ইজ্জত করে না আমাদের। বিহারিরা সব্বাইকেই ‘বাবু’ বলে ডাকে...কিন্তু আমাদের ছোটলোক বলে ভাবে সবাই। আম খাবে বাঙালি বাবু, আর আঁটি চুষবে বিহারি,” গড়গড় করে বলে গেলেন মীনা।

অবলীলাক্রমে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা হয়ে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে পৌঁছে গেলেন তিনি।

“এক দেশে গিয়েছিলাম, চেন্নাই… সেখানে বেশ কষ্ট হয়েছিল [বার্তালাপ চালাতে],” বলছিলেন আদতে বিহারের ছাপরার এই ৪৫ বছরের ভুট্টা বিক্রেতা। “না হিন্দি না ভোজপুরি — ওরা কিছুতেই সাড়া দেয় না। শুধু নিজেদের ভাষায় কথা বলে, যেটা কিনা আমরা জানি না। কিন্তু এখানে ওসব নেই। দেখুন, বিহারি নামে কোনও একটা বিশেষ ভাষা নেই। বাড়িতে আমরা ৩-৪টে ভাষায় কথা বলি। কখনও ভোজপুরি, কখনও হিন্দি, আর মাঝেসাঝে দারভাঙ্গিয়া (মৈথিলী) আর বাংলা। তবে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি মেলে দারভাঙ্গিয়াতে কথা বলে।”

“এছাড়াও আরা আর ছাপরার বুলিও চলে। কোত্থাও কোনও সমস্যা-টমস্যা নেই, যখন যে ভাষায় কথা বলতে ইচ্ছে করে, সেটাই বলি।” আর পাঁচজন বহুভাষীর মতো ওঁর কথাতেও ফুটে উঠছিল অবাক-করা স্বাচ্ছন্দ্য। তবে তাঁর কর্মদক্ষতার সঙ্গে যে এতগুলো ভাষা জানার আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধোঁয়াশা নেই মীনার।

PHOTO • Smita Khator

বিহারি অভিবাসী মীনা যাদব ভুট্টা বিক্রি করেন দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেট অঞ্চলে। ব্যবসা সামলাতে গিয়ে অবলীলাক্রমে ভোজপুরি, বাংলা, মৈথিলী ও হিন্দি ভাষায় বার্তালাপ চালান তিনি, তার সঙ্গেই আবার আরা ও ছাপরার বুলিতেও দিব্যি সুন্দর কথা বলতে পারেন

“উদযাপিত হোক বিশ্বচরাচরকে বহুত্বের অবয়বে প্রকাশ করার যাবতীয় পথ” — এসব গালভরা জটিল বুলি না হয় ইউনেস্কোর (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজক) প্রধান অধিকর্তার জন্যই তোলা থাকুক। মীনার দুনিয়াটা বেশ সোজাসাপটা। মালিক, মনিব, খদ্দের, চারপাশের সমাজ — তেনাদের বুলি না শিখে কোনও উপায় নেই। “এত্তগুলো ভাষা জানা, হয় তো বেশ ভালোই, কিন্তু আসলে পেটের দায়ে শিখেছি,” স্পষ্ট কথা তাঁর।

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে, মীনার মতো আরও বেশ কয়েকজন প্রান্তবাসী দরিদ্র অভিবাসী মানুষজনের কাছে পৌঁছেছিল পারি — বহুক্ষেত্রে যাঁরা নিজের দেশেই অচিন, নিজের জন্মভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে ভাষাভিত্তিক জগতসমূহে তাঁরা থাকেন, যে ভাষার দুনিয়া তাঁর সৃষ্টি করেন, বা তাকে লালন করেন যতনে – ভাষার সেই মহাজাগতিক অবয়বকে বুঝতে প্রয়াসী হয়েছিলাম আমরা।

পুণে থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে এক বিচিত্র সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন দেশান্তরি শ্রমিক শঙ্কর দাস। আদতে আসামের কাছার জেলার বরখোলা ব্লকের মানুষ তিনি। জরাইতলা গাঁয়ে কেটেছিল ছেলেবেলা, আশপাশে সবাই বাংলাতেই কথা বলত। তাই এ রাজ্যের সরকারি ভাষা, অসমিয়া আর শেখা হয়ে ওঠেনি কোনওদিন। বছর কুড়ি বয়স থেকেই অভিবাসী জীবন, দেড় দশক পুণেয় থাকার সুবাদে হিন্দিটা ঝালিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাঠি ভাষাটাও রপ্ত করে নিয়েছিলেন।

“মারাঠি খুব ভালোই জানি। পুণের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ঘুরেছি। কিন্তু অসমিয়ায় বাতচিত করতেই পারি না। বুঝি ঠিকই, তবে কইতে গেলে আটকায়,” বক্তব্য ৪০ বছর বয়সি এই মানুষটির। পুণে শহরের যন্ত্রপাতির কর্মশালার চাকরিটা কোভিড অতিমারির সময় খোয়া গেলে রুজিরুটির তাগিদে ফিরে আসেন আসামে। জরাইতলায় কোনও কাজ না খুঁজে পেয়ে হাজির হন গুয়াহাটিতে, কিন্তু অসমিয়া না জানায় কাজকাম আর জোটেনি তাঁর।

মীনার বাস্তবটা বেশ সোজাসাপটা। তাঁর কথায়, ‘এত্ত সব ভাষা জানাটা হয়তো বেশ ভালোই, কিন্তু না শিখলে তো পেটের ভাতও জুটবে না, তাই শিখেছি’

ভিডিওটি দেখুন: নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন বিহারের মীনা যাদব এবং ঝাড়খণ্ডের প্রফুল সুরিন

“মনিবের সঙ্গে কথা বলা তো দূর অস্ত, বাসে উঠতেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়,” বলছিলেন শঙ্কর, “ভাবছি পুণেতেই ফিরে যাব। একটা না একটা কাজ তো পাবই, আর শহরের ভাষা নিয়েও কোনও ঝুটঝামেলা থাকবে না।” ভিটে আর হেঁশেলের মাঝে যে বিস্তর দূরত্ব তাঁর।

গুয়াহাটি থেকে প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার দূর এ দেশের রাজধানীতে হিন্দি শিখতে গিয়ে দিশেহারা ১৩ বছরের কিশোর প্রফুল সুরিন। হিন্দি না শিখলে ইস্কুলে থাকা যাবে না। দেশ তার ঝাড়খণ্ডের গুমলায়, জনপদের নাম পাহানটোলি। একটি দুর্ঘটনায় বাবাকে হারিয়ে ১,৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পিসির কাছে নয়াদিল্লির মুনিরকা গ্রামে এসে উঠেছে প্রফুল। তার কথায়, “এখানে আসার পর বড্ড একলা-একলা লাগত। এখানে কেউ মুন্ডারি জানে না। সব্বাই হিন্দিতে কথা বলে।”

এই মহানগরে আসার আগে তার গাঁয়ের ইস্কুলে খানকতক হিন্দি আর ইংরেজি হরফ শিখেছিল সে। তবে ও দিয়ে কিছু বোঝা বা নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দিল্লিতে দুবছর পড়াশোনা আর পিসির ইন্তেজাম করা কিছু বিশেষ টিউশনির সাহায্যে “ইস্কুলে বা বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলা করার সময় ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে পারি। তবে বাড়িতে কিন্তু মুন্ডারিতেই কথা বলি পিসির সঙ্গে। ওটাই আমার মাতৃভাষা।”

দিল্লি থেকে ১,১০০ কিলোমিটার পেরিয়ে ছত্তিশগড়ে ১০ বছরের প্রীতি অবশ্য নিজের ইস্কুলে আর যেতেই চায় না। মা-বাবার সঙ্গে থাকে ঠিকই, কিন্তু নিজের ভিটেমাটিসম ভাষার থেকে প্রীতির দূরত্বটা যে বড্ড বেশি।

লতা ভোই, ৪০ ও তাঁর স্বামী সুরেন্দ্র ভোই, ৬০ দুজনে মালুয়া কোন্ধ আদিবাসী জনজাতির মানুষ। ওড়িশার কালাহান্ডির কেন্দুপাড়া গ্রাম ছেড়ে বেসরকারি একটি খামারের দেখভালের কাজে রায়পুরে এসেছিলেন তাঁরা। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ছত্তিশগড়ি জানেন, তাই খামারে কর্মরত স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে কোনও অসুবিধা হয় না। “২০ বছর আগে রোজি-রোটির [জীবিকা] সন্ধানে এসেছিলাম এখানে,” জানালেন লতা, “আত্মীয়স্বজন সব ওড়িশায় থাকে। ওড়িয়াতেই কথা বলে সব্বাই। তবে আমার বাচ্চাগুলো না পারে ওড়িয়া পড়তে, না পারে লিখতে। শুধু বলতে শিখেছে। ঘরে তো আমরা প্রত্যেকেই ওড়িয়ায় কথা বলি। আমি নিজেও তো ওড়িয়ায় লিখতে-পড়তে জানি না। কথা বলতে পারি, ওটুকুই যা।” ছোটো মেয়ে প্রীতি হিন্দি ছড়া-কবিতা ভালোবাসে বটে, তবে ইস্কুলে যেতে একফোঁটাও ইচ্ছে করে না তার।

PHOTO • Pankaj Das
PHOTO • Nirmal Kumar Sahu
PHOTO • Nirmal Kumar Sahu

পুণেতে দেড় দশক কাটিয়ে মারাঠি শিখে গেলেও অসমীয়া না জানার ফলে নিজের রাজ্যেই কাজ পাচ্ছেন না শঙ্কর দাস (বাঁয়ে)। কন্যা প্রীতি ভোইয়ের (মাঝখানে) সঙ্গে ছত্তিশগড়ে বসবাস করেন ওড়িশা থেকে আগত লতা ভোই (ডানদিকে)। সহপাঠীরা উত্যক্ত করে মারছে, তাই ইস্কুলে যেতে আর মন চায় না প্রীতির

তার বক্তব্য, “ইস্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে ছত্তিশগড়িতে কথা বলি ঠিকই, কিন্তু আর ক্লাসে যেতে মন চাইছে না। কারণ ওরা সবাই ‘ওড়িয়া-ঢোড়িয়া’ বলে আমায় খ্যাপায়।” ছত্তিশগড়ি ভাষায় ‘ঢোড়িয়া’ শব্দটির অর্থ এক প্রজাতির নির্বিষ ভীতু সাপ। তাই প্রীতির মা-বাবা ঠিক করেছেন, তফসিলি জনজাতি রূপে সংরক্ষণের আওতায় সিট পেলে ওড়িশার একটি সরকারি আবাসিক ইস্কুলে পাঠিয়ে দেবেন প্রীতিকে।

ছোট্ট বয়স থেকে মা-বাবা, দেশগাঁর ভিটেমাটি আর নিজের ভাষা থেকে দূরে দূরে থাকা — এ বোধহয় পরিযায়ী জীবনেরই আরেক নাম।

মোটে আট বছর বয়সে রোজগারের তাগিদে ঘর ছেড়েছিলেন ২১ বছর বয়সি নগেন্দ্র সিং, সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন একটি ক্রেন অপারেটিং পরিষেবা সংস্থায়। বাড়ি তাঁর উত্তরপ্রদেশের কুশিনগর জেলার জগদীশপুর গ্রামে, মাতৃভাষা ভোজপুরি। “হিন্দির থেকে এ ভাষা এক্কেবারে আলাদা,” বোঝালেন তিনি, “আমরা যদি ভোজপুরিতে কথা বলা শুরু করি, আপনি একবর্ণও বুঝবেন না।” ‘আমরা’ বলতে তাঁর তিনজন বাসা-বন্ধু তথা সহকর্মীর কথা বলতে চাইছেন নগেন্দ্র। প্রত্যেকেই তাঁরা রংশ্রমিক, কাজ করেন উত্তর বেঙ্গালুরুর একটি নির্মাণস্থলে। ২৬ বছর বয়সি আলি, ১৮ বছরের মণীশ ও নগেন্দ্রর বয়স, সাকিন, ধর্ম আর জাতপাত আলাদা হতে পারে, তবে মাতৃভাষা ভোজপুরির সূত্রে তাঁরা একতারে বাঁধা।

উঠতি বয়সে ঘরদোর আর মাতৃভাষা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এঁদের প্রত্যেকেই। “দক্ষতা থাকলে কোনও মুসিবত হয় না,” বললেন আলি, “দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, মায় সৌদি আরবেও গিয়েছি আমি। চাইলে পাসপোর্ট দেখাতে পারি। ওখানে গিয়েই তো হিন্দি আর ইংরেজি শিখেছি।” প্রক্রিয়াটি যে আদতে বেশ সহজ, সেটা বোঝাতেই আমাদের কথোপকথনে যোগ দিলেন নগেন্দ্র, “যেখানে কাজ আছে, আমরা সেখানেই গিয়ে উঠি। গাঁও কা কোই লড়কা বুলা লেতা হ্যায়, হম আ জাতে হ্যায় [গাঁয়ের কোনও একটা ছেলে ডাক পাঠায়, আর আমরা গিয়ে হাজির হই]।”

“এই কাকুর মতো লোকও আছে,” মাদুরাই থেকে আসা ৫৭ বছর বয়সি সুব্রাহ্মণ্যমের দিকে ইঙ্গিত করলেন নগেন্দ্র। এই মানুষটি তামিল বই আর কিছুই জানেন না। “ইশারায় কথা বলি। ওনাকে কিছু বলতে হলে ছুতোরকে গিয়ে জানাই, তখন উনি সেটা কাকুকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আমরা ভোজপুরিতেই কথাবার্তা বলি। সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে রান্না চাপিয়ে ভোজপুরি গান শুনি,” এটা বলেই ফোন বার করে তাঁর প্রিয় একখান গান চালিয়ে দিলেন নগেন্দ্র।

PHOTO • Pratishtha Pandya
PHOTO • Pratishtha Pandya

উত্তর বেঙ্গালুরুর একটি নির্মাণস্থলে কর্মরত রংশ্রমিক নগেন্দ্র সিং (বাঁদিকে) ও আব্বাস আলির (ডানদিকে) বয়স, দেশগাঁ আর ধর্ম আলাদা হলেও মাতৃভাষা ভোজপুরি দিয়েই একসূত্রে বাঁধা আছেন তাঁরা দুজন

PHOTO • Pratishtha Pandya
PHOTO • Pratishtha Pandya

বাঁদিকে: একসাথে একটি নির্মাণস্থলে রঙের কাজ করেন তামিলনাড়ুর সুব্রাহ্মণ্যম ও উত্তরপ্রদেশের মণীশ। একে অপরের সাথে কথা বলেন ইশারায়। ডানদিকে: নিজের হাতে বানানো খাবার খেতে বসেছেন নগেন্দ্র সিং। তবে এ দিয়ে কি আর গাঁয়ের রান্নার স্বাদ ভোলা যায়?

চেনা খাবার, চেনা সুর, পরিচিত পালাপার্বণ আর ভাসা-ভাসা বিশ্বাসের যে গুচ্ছ দিয়ে আমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে চিনি, সেই অভিজ্ঞতার সিংহভাগটাই কিন্তু ভাষাভিত্তিক। তাই মাতৃভাষা নিয়ে পারি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁদের অনেকেই সংস্কৃতির কথায় ফিরে গিয়েছেন।

দুই দশক পেরিয়ে গেছে, বিহারের পারতাপুর গ্রাম ছেড়ে গৃহকর্মের কাজে মুম্বইয়ে এসেছেন ৩৯ বছর বয়সি বসন্ত মুখিয়া। মৈথিলী ভাষার কথা বললেই বাড়ির খাবারের স্বাদ আর গানবাজনার স্মৃতি উজাগর হয়ে ওঠে তাঁর মনে: “সাত্তু [ছোলার ছাতু] খেতে বড্ড ভাল্লাগে, চুড়া আর পোহাও খুব পছন্দের।” এসবের কিছু কিছু মুম্বইয়ে মেলে বটে, তবে “গাঁয়ের ওই স্বাদটা পাই না,” বলেই রসনার দরিয়ায় তরী ভাসালেন বসন্ত। “আমাদের গাঁয়ে তো ফি শনিবারে খিচুড়ি হয় দুপুরে, আর সন্ধে হলেই ভুজা খাই। ভুজা বানাতে লাগে চিঁড়ে, বাদামভাজা আর ভাজা কালো ছোলা। তারপর সেটা পেঁয়াজ, টমেটো, কাঁচালঙ্কা, নুন, সর্ষের তেল আর মশলা-টশলা দিয়ে মাখানো হয়। মুম্বইয়ে তো টেরই পাই না কখন শনিবার আসে আর চলে যায়,” মুখে তাঁর বিষণ্ন হাসি।

খাবারদাবার ছাড়াও গাঁয়ে হোলি খেলার চিত্র ভেসে ওঠে তাঁর মনে। “ওইদিন বিনা বলে কয়ে একদল বন্ধু ঢুকে পড়ে বাড়িতে। খুব করে রং নিয়ে খেলি আমরা। তাছাড়া গোগ্রাসে মালপোয়া (সুজি, ময়দা, চিনি আর দুধ দিয়ে বানানো বসন্তোৎসবের মিষ্টান্ন) তো খাই-ই। ফাগুয়া (হোলির গান) গাই সবাই মিলে।” ভিনদেশী ভাষায় কথা বলছিলেন ঠিকই, তবে চোখদুটি তাঁর ভরে উঠেছিল দেশগাঁয়ের স্মৃতিতে।

“নিজের দেশের লোকের সঙ্গে উৎসবে মেতে ওঠা আর মাতৃভাষায় কথা বলার মতো সুখ আর কোত্থাও নেই,” দুঃখ করছিলেন বসন্ত।

এই কথায় পূর্ণ সহমতি মিলল এলাহাবাদের অমিলৌটি গ্রামের রাজুর কাছে। গত ৩০ বছর ধরে রুজিরুটির তাগিদে পঞ্জাবে পড়ে আছেন তিনি। আহির জাতির এই মানুষটি বাড়িতে আওয়ধি ভাষায় কথা বলতেন। অমৃতসরে আসার পর প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হত। রাজুর কথায়, “তবে আজ আমি স্বচ্ছন্দে পঞ্জাবি বলতে পারি, এখানে সব্বাই আমায় ভালোবাসে।”

PHOTO • Swarn Kanta
PHOTO • Swarn Kanta

গৃহকর্মী রূপে মুম্বইয়ে আজ দুই দশক পার করেছেন বসন্ত মুখিয়া। দেশগাঁয়ের সুর, শব্দ, গানবাজনার জন্য বড্ড মন-কেমন করে তাঁর। মাতৃভাষা মৈথিলীর কথা উল্লেখ করলেই মনে জুড়ে আসে বাড়ির খানাপিনার হাজারো স্মৃতি

PHOTO • Kamaljit Kaur
PHOTO • Kamaljit Kaur

এলাহাবাদের অমিলৌটি থেকে আগত রাজু পঞ্জাবের পাট্টি শহরে ফল বেচেন। নিখুঁত পঞ্জাবি বলেন বটে, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামে ফেলে আসা পালাপার্বণে

তা সত্ত্বেও দেশগাঁয়ে প্রচলিত পার্বণের জন্য বড্ড মন-কেমন করে তাঁর। পঞ্জাবের তরন তারন জেলার পাট্টি শহরে ঠেলাগাড়ি লাগিয়ে ফল বেচেন রাজু। একে তো কাজের এমনই চাপ যে হামেশাই ঘরে ফেরা হয় না, উপরন্তু “নিজের পালাপার্বণ যে এখানে পালন করব, তারও জো নেই। একশোটা লোক অনুষ্ঠান করলে সেটায় যোগ দেওয়া সহজ, কিন্তু আপনিই বলুন, মোটে দু-চারজন মিলে যদি পরব করি তাতে আর কে-ই বা যোগ দেবে?”

দেশের আরেক প্রান্তে একই সওয়ালের প্রতিধ্বনি শোনা গেল ৩৮ বছর বয়সি শাবানা শেখের কণ্ঠে, কাজের সন্ধানে তাঁর শোহরের সঙ্গে রাজস্থান ছেড়ে কেরালায় এসেছেন তিনি। “দেশগাঁয়ে নিজস্ব পরব পালন করি, তাতে তো কোনও শরম নেই। কিন্তু এখানে কেরালায় সেসব পালন করি কেমনে বলুন? দিওয়ালির সময় এখানে তেমন আলো-টালো জ্বালে না কেউ। অথচ রাজস্থানে আমরা সবাই মাটির প্রদীপ জ্বালি। কেমন সুন্দর ঝলমল করে।” স্মৃতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল শাবানার আঁখিদুটি।

যতজন দেশান্তরি মানুষেরর সঙ্গে কথা বলেছি, লক্ষ্য করেছি যে প্রত্যেকের ভিতর ভাষা, সংস্কৃতি আর স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে আছে। ভিটেমাটি ছেড়ে দূর-দূরান্তে পড়ে আছেন বটে, তবে নিজ নিজ মাটির ধারা বাঁচিয়ে রাখার আলাদা আলাদা উপায় খুঁজে নিয়েছেন সব্বাই।

ষাটের কোঠায় পা রাখা মাশরুভাই রাবারির অবশ্য স্থায়ী ঠিকানা বলতে কিছুই নেই। নাগপুর, ওয়ার্ধা, চন্দ্রপুর কিংবা ইয়াবতমালের কোনও না কোনও মাঠে দেখা মেলে তাঁর। মধ্য বিদর্ভের এই পশুপালক যাযাবর মানুষটি আদতে গুজরাতের কচ্ছ থেকে এসেছেন। প্রথাগত শ্বেতবর্ণ রাবারি সাজ: কুঁচি দেওয়া পিরান, ধুতি আর সাদা পাগড়ি পরিহিত মাশরুভাই জানালেন: “একদিক থেকে আমি ভরহাড়িই বটি।” বিদর্ভের স্থানীয় সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত এই মানুষটি দরকার হলে চলতি ভাষায় কিছু গালিগালাজও দিতে পারেন বৈকি! তা সত্ত্বেও কচ্ছের পরম্পরা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর আজও নাড়ির যোগ। মাঠ থেকে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় তাঁর উটের দল, কুঁজের উপর ডাঁই করে রাখা লোককথা, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রজ্ঞা, গান, প্রাণীজগত তথা জৈবতন্ত্র ঘিরে জমানো প্রথাগত জ্ঞান, না জানি আরও কত কিছু।

PHOTO • Jaideep Hardikar
PHOTO • Rajeeve Chelanat

বাঁদিকে: কচ্ছের মাশরুভাই রাবারির ঠিকানা বিদর্ভের তুলোখেতে, নিজেকে ভরহাড়ি হিসেবেই পরিচয় দেন।  ডানদিকে: স্বামী মোহাম্মদ আলওয়ার (ডানদিকে) এবং মেয়ে সানিয়া শেখের (মাঝখানে) সঙ্গে কেরালায় বসত পেতেছেন রাজস্থানের শাবানা শেখ (বাঁদিকে একেবারে শেষে)। দীপাবলির সময় আলোয় আলোয় ভরে ওঠে দেশগাঁ, সেসব ভেবে বড্ড মন-কেমন করে শাবানার

ঝাড়খণ্ডের শানাউল্লা আলম, ২৫ আজ খোদাইযন্ত্র (এক্সকাভেটর) চালান কর্ণাটকের উড়ুপি জেলায়। তাঁর কর্মস্থলে তাঁকে ছাড়া এমন ঝরঝরে হিন্দি আর কেউ বলতে পারে না। বাড়ির লোকজন আর মাতৃভাষার সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র মোবাইল ফোন। আত্মীয়স্বজন আর ইয়ার-দোস্তদের ফোন করলে হিন্দি বা খোরথা ভাষাতেই কথা বলেন। খোরথা মূলত উত্তর ছোটানাগপুর তথা ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনায় প্রচলিত।

একই ভাবে মোবাইলের দ্বারা চেনা দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন ঝাড়খণ্ডের ২৩ বছর বয়সি পরিযায়ী শ্রমিক সোবিন যাদব। মাজগাঁওয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে, “ক্রিকেট খেলোয়াড় ধোনির বাড়ি প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর।” বছর কয়েক আগে চেন্নাইয়ে আসেন সোবিন, আজ এখানেই একটি খাবারের দোকানে কাজ করেন, হিন্দিতে কথা বলা আর হয় না বললেই চলে। তবে হ্যাঁ, হররোজ সন্ধেয় যখন স্ত্রীকে ফোন করেন, তখন মাতৃভাষাতেই চলে বার্তালাপ। তামিল ভাষায় বলেছিলেন: “তাছাড়া হিন্দিতে ডাব করা তামিল ছায়াছবিও দেখি মোবাইলে। সুরিয়া আমার প্রিয় অভিনেতা।”

“হিন্দি, উর্দু, ভোজপুরি...কোনও ভাষাই খাটবে না এখানে। নাহ, ইংরেজিও নয়। একমাত্র হৃদয়ের ভাষাই এখানে কাজ করে,” জানিয়েছিলেন বিনোদ কুমার। বিহারের মোতিহারীর এই রাজমিস্ত্রি আপাতত সাজিদ গনির রান্নাঘরে বসে মধ্যাহ্নভোজ সারছেন কাশ্মীরের বারামুলা জেলার পট্টন ব্লকে। এখানে তাঁর মনিব বলতে সাজিদই। “বাড়ির মালিক খেতে বসেছে মজুরের পাশে — এমনটা দেখেছেন আর কোথাও?” সাজিদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন বিনোদ। “মনে তো হয় না উনি আদৌ আমার জাতপাত জানেন বলে। দেশগাঁয়ে আমি ছুঁয়ে দিলে লোকে তো জল অবধি খাবে না। আর এখানে দেখুন নিজের হেঁশেলে আমায় খাওয়াচ্ছেন, আর নিজেও পাত পেড়েছেন আমারই পাশে।”

আজ ৩০ বছর হয়ে গেল মজুরির খোঁজে কাশ্মীরে এসেছেন বিনোদ। তাঁর কথায়: “সেই ১৯৯৩ সালে প্রথমবার কাশ্মীরে এসেছিলাম মজদুর হয়ে। এখানকার বিশেষ কিছুই জানতাম না। সে যুগের মিডিয়া থোড়াই না এখনকার মতো ছিল! তাছাড়া খবরের কাগজে কিছু ছাপলেই বা কী? আমি কেমন করে জানব? না পারি লিখতে, না পারি পড়তে। ঠিকেদারের ডাক পেলেই রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি।”

PHOTO • Shankar N. Kenchanuru
PHOTO • Rajasangeethan

বাঁদিকে: উড়ুপি, কর্ণাটকে খোদাইযন্ত্র (এক্সকাভেটর) পরিচালনা করেন ঝাড়খণ্ডের শানাউল্লা আলম। ফোন মারফত বাড়ির লোক আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হিন্দি কিংবা খোরথা ভাষায় কথা বলেন তিনি। ডানদিকে: সোবিন যাদবও ঝাড়খণ্ডের মানুষ, কাজ করেন চেন্নাইয়ের একটি খাবারের দোকানে। কর্মক্ষেত্রে তামিল ভাষা ইস্তেমাল করলেও, ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কিন্তু হিন্দিতেই কথা বলেন সোবিন

“তখন অনন্তনাগ জেলায় একটা কাজ পেয়েছিলাম,” শ্রমিক জীবনের গোড়ার কথা মনে পড়ছিল তাঁর, “যেদিন পৌঁছলাম, সেদিন হঠাৎ দেখি নাকাবন্দি জারি করেছে, সবকিছু বন্ধ। তবে এখানকার গাঁয়ের লোক খুব সাহায্য করেছিল, আমাদের সবাইকেই। একসঙ্গে ১২ জন মিলে এসেছিলাম এ বিভুঁয়ে। সব্বার খানা-পিনার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। আপনিই বলুন, কোনও কারণ ছাড়া খামোকা কে-ই বা অন্যের এমন সাহায্য করে?” সওয়াল বিনোদের। ওপাশ থেকে বিনোদের থালায় আরও এক টুকরো মাংস তুলে দিলেন সাজিদ। বিনোদ খানিক গাঁইগুঁই করছিলেন ঠিকই, তবে সাজিদ বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দেননি।

“কাশ্মীরি একবর্ণও বুঝি না। এখানে অবশ্য প্রত্যেকেই হিন্দি বোঝে। আজ অবধি তো কখনও অসুবিধে হয়নি,” জানালেন বিনোদ।

“আর ভোজপুরি [তাঁর মাতৃভাষা]?” জিজ্ঞেস করলাম আমরা।

“ভোজপুরি?” চটজলদি জবাব এল, “দেশওয়ালি লোকজন এলে ভোজপুরিতেই কথা বলি। কিন্তু আর কে-ই বা ও ভাষা জানে? আপনি নিজেই বলুন...?” তারপর ফিক করে হেসে উঠে জানালেন, “সাজিদ ভাইকে খানিক খানিক শিখিয়েছি আমার মাতৃভাষা। কা হো সাজিদভাই? কৈসন বানি? [বলো হে সাজিদভাই? কেমন আছ?]”

“ঠিক বা [দিব্যি আছি],” উত্তর দিলেন সাজিদ।

“এক-আধটু ভুলচুক হয় বটে কখনও কখনও। কিন্তু পরেরবার আসুন, আমার এই ভাই আপনাকে ঋতেশের [জনৈক ভোজপুরি অভিনেতা] গান গেয়ে শোনাবে!”

দিল্লি থেকে মহম্মদ কমর তবরেজ , পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্মিতা খাটোর , কর্ণাটক থেকে প্রতিষ্ঠা পাণ্ডিয়া শংকর এন. কেঞ্চানুড়ু , কাশ্মীর থেকে দেবেশ , তামিলনাড়ু থেকে রাজাসংগীতন , ছত্তিশগড় থেকে নির্মল কুমার সাহু , আসাম থেকে পংকজ দাস , কেরালা থেকে রাজীব চেলানাত , মহারাষ্ট্র থেকে জয়দীপ হার্ডিকার স্বর্ণ কান্তা , এবং পঞ্জাব থেকে কমলজিৎ কৌর যৌথভাবে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন। মেধা কালে , স্মিতা খাটোর , জশুয়া বোধিনেত্র সম্বিতি আইয়ারের সহায়তায় এটির সম্পাদনা করেছেন প্রতিষ্ঠা পাণ্ডিয়া। আলোকচিত্র সম্পাদনায় বিনাইফার ভারুচা এবং ভিডিও সম্পাদনায় রয়েছেন শ্রেয়া কাত্যায়নী

প্রচ্ছদচিত্র: লাবনী জঙ্গী

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra