হাতের নখের চেয়ে বড়ো হবে না মোটেই। প্রতিটা কুঁড়িই শ্বেতশুভ্র, পাণ্ডুর ও সুন্দর। মাঠ জুড়ে ঝলমল করছে প্রস্কূটিত ফুলের দল, সম্পূর্ণ ফুটে ওঠা ফুলের সুবাসে ম-ম করছে চারিদিক। জুঁইফুল বস্তুটা উপহার বই সত্যিই আর কিছু নয় যেন। ধুলোয় ঢাকা ধরাতল, স্থূলকায় গাছ, মেঘে মেঘে আহত আসমান।

তবে এ ফুলের বাহারে সে যতই নস্টালজিয়া থাক না কেন, এখানকার মজুরদের জন্য তার প্রেমে মজে যাওয়া সম্ভব নয়। ফোটার আগেই মল্লি (জ্যাসমিন বা জুঁই) নিয়ে যেতে হবে পুকাডাইয়ে (পুষ্পবাজার)। আর চারদিন পরেই গণেশের জন্মদিন, বিনায়ক চতুর্থী, অর্থাৎ বেশ ভালোই দর মিলবে।

নারী-পুরুষ, সমস্ত মজুরেরা বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর চাপে চটজলদি ছিঁড়ে নিচ্ছিলেন কুঁড়িগুলি। মুঠো ভরে উঠলেই সে ফুল গিয়ে জমা হচ্ছিল শাড়ি বা ধুতির ভাঁজে, অন্তিম গন্তব্য অবশ্য বস্তা। গাছের উচ্চতা তিন বছরের বাচ্চার মতো। ধাপে ধাপে চলা এই কাজে খুঁত থেকে যাওয়ার অবকাশ নেই। ডালপালা সরাও রে (খসখস, খসখস), কুঁড়ি ছিঁড়ে নাও রে (পটাপট, চটপট), হেঁটে হেঁটে পরের গাছে যাও রে, আরও ফুল পাড়ো রে — আর ফাঁকতালে চলতে থাকুক আড্ডা। এছাড়া জনপ্রিয় তামিল গানের সম্ভার নিয়ে বেতারযন্ত্র তো রয়েইছে। ওদিকে পূব আকাশে আড়মোড়া ভাঙছে সূর্য...

খুব শিগগির মাদুরাইয়ে মাট্টুঠাভনি বাজার হয়ে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন শহরে পাড়ি দেবে এ পুষ্পরাজি। কখনও কখনও তারা সাত সাগর পেরিয়ে অন্য দেশেও গিয়ে পৌঁছায়।

২০২১, ২০২২ আর ২০২৩ সালে মাদুরাই জেলার থিরুমঙ্গলম ও উসিলমপট্টি তালুকে গিয়েছিল পারি। মল্লিফুলের মাঠ থেকে গাড়ি চেপে মাদুরাই যেতে মোটে একঘণ্টা লাগে, যেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে জগৎখ্যাত মীনাক্ষী আম্মান মন্দির ও জমজমাট ফুলের বাজার — মুঠো মুঠো জুঁই, রাশি রাশি জুঁই, চলছে বিকিকিনি

PHOTO • M. Palani Kumar

মাদুরাইয়ের থিরুমঙ্গলম তালুকে অবস্থিত মেলাউপ্পিলিগুন্দু জনপদ, তাঁর খেতের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গণপতি। সবেমাত্র শেষ হয়েছে জুঁইয়ের মরসুম, এখন তাই দিন গেলে কিলো খানেকের বেশি ফুল মেলে না

PHOTO • M. Palani Kumar

একমুঠো সুবাসিত মল্লিকুঁড়ি

থিরুমঙ্গলম তালুকের মেলাউপ্পিলিগুন্দু জনপদ-নিবাসী, ৫১ বছর বয়সি পি. গণপতি শোনালেন জুঁইফুলের কিসসা, এই ফুল আর মাদুরাই একে অপরের নামে পরিচিত। “সুগন্ধি মল্লির জন্য এই এলাকার বিশাল নামডাক। আরে বাবা, বাড়ির ভিতর আধা কিলো জুঁইফুল রেখে দেখুন, এক সপ্তাহ ধরে গন্ধে ম-ম করবে!”

গায়ে নিষ্কলুষ সাদা জামা, নীল লুঙ্গি, পকেটে গোঁজা কয়েকটি নোট — সহজ হাসি হেসে হড়বড়িয়ে মাদুরাইয়ের আগমার্কা টানে তামিল ভাষায় কথা বলছিলেন গণপতি। “একবছর না হওয়া পর্যন্ত গাছগুলো সদ্যোজাত শিশুর মতন,” বুঝিয়ে বললেন তিনি, “খুব যত্ন নিয়ে দেখভাল করতে হয়।” আড়াই একর জমি আছে তাঁর, যার মধ্যে থেকে এক একরে মল্লি চাষ করেন।

মাস ছয়েক গেলে পরে ফুল ফোটা আরম্ভ হলেও, সেটা কিন্তু নিয়মিত নয়। দরদামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওঠা-নামা করে এ ফুলের উৎপাদন। একেক দিন তো এক একর জমি থেকে এক কেজি জুঁইও পান না গণপতি। “বিয়ে-শাদি আর পালাপার্বণের সময় বেশ ভালো দর ওঠে: এক কেজি জুঁই তখন এক হাজার, দুহাজার, তিনহাজার টাকায় বেচি... অথচ ফুলের মরসুমে, প্রত্যেকের গাছ যখন ফুলে-ফুলে ভরে উঠেছে, তখন বাজারে মন্দার জোয়ার।” এ চাষে মুনাফার কোনও নিশ্চয়তা নেই, আছে শুধু খরচার।

আর আছে মজুরির। এমনও সকাল গেছে তখন ভীটুকারাম্মার — স্ত্রী পিচাইয়াম্মাকে আদর করে যে নামে ডাকেন গণপতি — সঙ্গে মিলে আট কেজি অবধি ফুল পেড়েছেন। “দুজনেরই পিঠ ছিঁড়ে যায় যন্ত্রণায়, অসহ্য কষ্ট হয়।” তবে বাড়তে থাকা খরচাপাতির কষ্টটা কিন্তু এর চাইতেও বেশি। সার, কীটনাশক, মজুরি, জ্বালানি — হুহু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সবকিছুরই। “ভদ্রস্থ মুনাফার আশাটাই বা করি কেমনে?” সেটা ছিল ২০২১-এর সেপ্টেম্বর।

জুঁই — যার দেখা মেলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, যে কিনা তামিল সংস্কৃতির প্রতীক, যার নামে শহর, একধরনের ইডলি ও এক প্রজাতির সুগন্ধি চালের নাম রাখা হয়েছে; জুঁই — যার সুবাসে সিক্ত নয় এমন দেউল, বিয়েবাড়ি বা বাজার মেলা ভার, যার সুরভিতে মাতাল হয়ে ওঠে ভিড়ভাট্টা, বাস আর শয়নকক্ষ — এ রোজকার ফুলটি কিন্তু চাষ করা চাট্টিখানি কথা নয়।

*****

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

গণপতির খেতে সদ্য গজানো জুঁইয়ের চারা ও কুঁড়ি (ডানদিকে)

PHOTO • M. Palani Kumar

খেতমজুরদের সঙ্গে জুঁইয়ের জমি সাফ করছেন পিচিয়াম্মা

অগস্ট ২০২২-এ দ্বিতীয়বার যখন যাই, তখন সেই এক একর জুড়ে নতুন একপ্রস্থ জুঁইয়ের চারা লাগিয়েছিলেন গণপতি। ৯,০০০টি চারা, প্রতিটির সাতমাস বয়স। চারাগাছগুলি ঠিক কতখানি লম্বা, সেটা বোঝাতে আঙুল দিয়ে নিজের কনুই ছুঁয়েছিলেন। রামনাথপুরম জেলার রামেশ্বরমের সন্নিকটে থাঙ্গাচিমাদমের নার্সারি থেকে চার টাকা করে এই গাছগুলি কিনেছিলেন গণপতি। কেনার সময় নিজের হাতে বাছেন, যাতে ভুলবশত দূর্বল কোনও চারা না চলে আসে। মাটি যদি ভালো হয় — উর্বর, ঝুরঝুরে, লালচে — “চারহাত তফাতে পুঁততে পারবেন। গাছগুলো দিব্যি বড়ো হবে,” এইটা বলেই টানটান করা হাতে বৃত্ত কেটেছিলেন শূন্যে, “কিন্তু এ তল্লাটের মাটি ঝামা ইটের জন্যই বেশি ভালো।” অর্থাৎ এঁটেল মাটি।

মল্লিচাষের জন্য ৫০,০০০ টাকা দিয়ে এক একর জমি তৈরি করেন গণপতি। “ঠিকমতন করতে গেলে প্রচুর টাকা খসে, জানেনই তো।” গরমকালে তাঁর খেত জুড়ে ঝলমল করতে থাকে রাশি রাশি জুঁই। তামিলে বললেন: “পালিচিন্নু পূকুম।” দুচোখ ভরা আকাঙ্খা আর কণ্ঠভরা উত্তেজনা নিয়ে সেই দিনটির কথা বলেছিলেন, যেদিন ১০ কেজি ফুল পাড়া হয়েছিল তাঁর খেতে — কোনও গাছ থেকে ১০০ গ্রাম মল্লি, তো কোনওটা থেকে ২০০ গ্রাম। তাঁর হাসিতে চলকে উঠছিল দুর্নিবার আশা — খুব শিগগিরই যেন ওরকম আরেকটি দিন আসে।

কাকভোর থেকেই কাজে লেগে যান মানুষটি। এককালে তারও এক-দুঘণ্টা আগে থেকেই কামকাজ শুরু হত বটে, তবে আজকাল “মজুররা বড্ড দেরি করে আসেন,” জানালেন তিনি। কুঁড়ি তুলতে দিনমজুর ভাড়া করেন আনেন — পারিশ্রমিক হয় ঘণ্টায় ৫০, কিংবা “ডাব্বা” -পিছু ৩৫-৫০ টাকা — প্রথাগত এই ওজনের এককে মোটামুটি এক কেজি ফুল ধরে তাঁর মতে।

শেষবারের মতো পারি যখন গিয়েছিল, তারপর থেকে কেটে গেছে ১২টা মাস, মল্লির দরও বেড়েছে। ‘সেন্ট’ বা আতর কারখানা থেকে বেঁধে দেওয়া হয় দরদাম। জুঁইয়ের সরবরাহ যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন এই প্রসেসিং ইউনিটগুলি ব্যাপক পরিমাণে ফুল কিনে নেয় — সাধারণত কিলো-পিছু ১২০ থেকে ২২০ টাকার ভিতর ঘোরাফেরা করে দর। গণপতির বক্তব্য, প্রতি কিলোয় অন্তত শ-দুয়েক টাকা না পেলে মুনাফার কথা ভাবাও যাবে না।

তবে চাহিদা যখন আসমান ছোঁয়, আর উৎপাদন পাতালে গিয়ে ঠেকে, তখন দর বাড়তে বাড়তে উপরোক্ত মূল্যের বহুগুণ বেশিতে গিয়ে ঠেকে। উৎসবের ঋতু এলে তো ১০০০ টাকা দিয়েও এক কিলো জুঁই মেলে না। কিন্তু হায়, গাছপালা যে পাঁজি-টাঁজি কিসুই মানেই না! ‘মুহূর্থ নাল’ বা ‘কাড়ি নাল’ , অর্থাৎ পূণ্য তিথি বা অশুভ দিনক্ষণের হিসেব রাখতে বয়েই গেছে তাদের।

তারা যে শুধু প্রকৃতির কথামতন চলে। একঝলক রোদ্দুর মেখে যদি মুষলধারে বৃষ্টি নামে, পুষ্পে পুষ্পে পুণ্যভূমি হয়ে ওঠে পৃথিবী। “যেদিকে দুচোখ যাবে, শুধু মল্লি আর মল্লি। হাজার চেষ্টা করলেও ফুল ফোটা আটকাতে পারবেন না, কী বলেন?” মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন গণপতি।

PHOTO • M. Palani Kumar

গাছ থেকে শাঁসালো পেয়ারা পেড়ে আমাদের খেতে দিলেন গণপতি

বর্ষার ফুলগুলিকে আদর করে বাদলপুষ্প বলে ডাকেন তিনি। ওই সময়, মাদুরাইয়ের আশেপাশের সমস্ত বাজারে জুঁইফুলের বান ডাকে। “টন-টন জুঁই এসে ওঠে আড়তে। পাঁচ টন, ছয় টন, সাত টন, আরে বাবা, একেকদিন তো দশ টন ফুলও এসেছে!” এর সিংহভাগটাই চলে যায় আতর কারখানাগুলিতে, জানালেন গণপতি।

মালা-টালার জন্য বিকিকিনি হয় যে ফুলের, তার দর ৩০০ টাকা কিলোরও বেশি। “কিন্তু মল্লির মরসুম পেরিয়ে গেলে তখন সারাদিনে এক কিলো ফুলও জোটে না, তখন সরবরাহ কম থাকার ফলে দাম হয় আকাশছোঁয়া। চাহিদায় ওরকম আগুন যখন লাগে, তখন দিন গেলে মোটে কিলো দশেক ফুল বেচলেও হাতে ১৫,০০০ টাকা আসবে হেসেখেলে। আপনিই বলুন, সেটা বিশাল রোজগার নয়?” কোঁচকানো চোখমুখে ঝকঝকে হাসি নিয়ে বললেন তিনি: “আর কী চাই? চেয়ার-টেয়ার পেতে, ভুরিভুজের বন্দোবস্ত করে গ্যাঁট হয়ে বসে বসে আপনাকে সাক্ষাৎকার দেব!”

তবে কিনা ওরকমটা তিনি কখনওই করতে পারবেন না। এটা তাঁর স্ত্রীর পক্ষেও অসম্ভব। কাজ এমনই বালাই। অশেষ আদরযত্ন না করলে বসুন্ধরা এমন সুরভিত ফসল দেবেই না। বাকি দেড় একর জমিতে পেয়ারা চাষ করেন গণপতি। “আজ সকালেই ৫০ কিলো ফল নিয়ে বাজারে গেছিলাম। মোটে ২০ টাকা কিলোয় বেচতে পারলাম, জ্বালানির রাহাখরচ বাদে ৮০০ টাকার মতো পড়ে থাকে হাতে। আগে যখন এ তল্লাটে পেয়ারা তেমন মিলত-টিলত না, তখন খদ্দেররা নিজেরাই আমার খেতে এসে পেয়ারা পেড়ে নিয়ে যেত, কিলো-পিছু ২৫ টাকা করে পেতাম। সেই দিনগুলো আর ফিরবে না...”

জুঁইচাষের জন্য একর জমি তৈরি করতে এবং চারা কিনতে প্রায় লাখ টাকা নিয়োগ করেন গণপতি। একপ্রস্থ বিনিয়োগের ফল মেলে ১০ বছর ধরে। ফি বছর মার্চ থেকে নভেম্বর অবধি, অর্থাৎ আট মাস ধরে চলে মল্লির মরসুম। প্রতি মরসুমেই কয়েকটা দিন এমন আসে যখন বিশাল পরিমাণে ফুল ফোটে, কোনও কোনও দিন তো আরোই বেশি, তবে এমনও সময় আসে যখন দিনের পর দিন রিক্তশাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে জুঁইগাছের সারি। গড়পড়তা হিসেবে, প্রতি মরসুমে একর-পিছু মাসিক ৩০,০০০ অবধি মুনাফা (গ্রস প্রফিট) হয় তাঁর।

এসব শুনে যতটা তাঁকে যতটা ধনবান বলে মনে হচ্ছে বাস্তবে কিন্তু এক্কেবারে তার উল্টোটা, বাজনার চেয়ে খাজনাই বরং বেশি। আর পাঁচজন কৃষকের মতো তাঁরও চাষবাসের হালখাতায় কিন্তু মজুরিহীন পারিবারিক শ্রমের কথা লেখা নেই, অর্থাৎ স্ত্রীর সঙ্গে মিলে যে মেহনতটা তিনি করেন। এটা মাথায় রেখে অঙ্ক কষলে মোট কতটা মজুরি লাগবে শুনি? তাঁর আন্দাজ: “দিন গেলে আমার নিজের জন্য ৫০০ টাকা, আর ভীটুকারাম্মার ৩০০।” সুতরাং একটু আগেই যে ৩০,০০০ টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটা কমতে কমতে মোটে ৬ হাজারে এসে ঠেকবে।

অথচ এটুকুর জন্যও “নসিবের জোর দরকার,” বললেন গণপতি। তবে নসিবের সঙ্গে সঙ্গে খানিক রাসায়নিকও যে জরুরি, সেটা একটু পরেই বুঝেছিলাম তাঁর মোটর শেডের ভিতর ঢুকে।

*****

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

গণপতির খামারে মোটরশেড। কীটনাশকের ফুরিয়ে যাওয়া বোতল আর ক্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মেঝের উপর (ডানদিকে)

মোটরশেডটি আদতে ক্ষুদ্র একখান কামরা, দুপুরবেলায় গণপতির পোষা কুকুর দুটি এখানেই ঘুমোয়। খানকতক মুরগিও রয়েছে এককোনায়, চালাঘরে পা রাখতেই চোখে পড়ল একটি ডিম — একগাল হেসে, সন্তর্পণে সেটি হাতের তালুর উপর রেখে দেখালেন গণপতি। মেঝের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কীটনাশকের ফাঁকা বোতল আর ক্যান। ঠিক যেন ফুরিয়ে যাওয়া রাসায়নিকের প্রদর্শনী। তাঁর গাছে গাছে ফুল ফোটার জন্য এগুলো যে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ধৈর্য্য ধরে সেকথা বোঝালেন গণপতি। “পালিচু,” শুক্লবর্ণ জুঁই-কুঁড়ি – পোক্ত, ভারি, সুদৃঢ় বোঁটাযুক্ত।

“এটায় ইংরেজিতে কী লেখা আছে বলুন না?” বলেই কয়েকটি ক্যান তুলে ধরলেন আমার সামনে। একেক করে নামগুলো পড়লাম। “এটায় লাল চেলোপোকা (রেড লাইস) মরে, ওটা কৃমির জন্য। এর এই যে, এটাই সবরকমের পোকামাকড় মরে। মল্লিগাছে হাজার গণ্ডা কীট এসে হানা দেয়,” গজগজ করছিলেন তিনি।

গণপতির উপদেষ্টা তাঁর নিজের ছেলে। “ও একটা ‘মারুন্ডু কাড়াই’ -এ কাজ করে, কীটনাশকের দোকানে,” বলতে বলতে চালাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, বাইরে তখন চড়া রোদ্দুর – মাথার উপর মল্লির মতন সাদাটে সূর্য। একচিলতে ভেজা মাটির উপর মহানন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি ছোট্ট কুকুরছানা, ক্রমেই লালচে হয়ে উঠছে তার সাদা-সাদা লোম। মোটরশেডেই কাছেই দেখলাম আরেকটি কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইনি আবার বাদামি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওদের নাম কী?” ফিক করে হেসে উঠে জবাব দিলেন, “আমি ‘কারুপ্পু’ বলে হাঁক পাড়লেই ওরা দৌড়ে আসে।” তামিলে ‘কারুপ্পু’ মানে কালো। কিন্তু কুকুরদুটি তো কালো নয়, অবাক হয়ে বললাম।

“তো কী হয়েছে? ডাকলেই তো আসে,” হাসতে হাতে আরেকটি বড়ো চালাঘরে গিয়ে ঢুকলেন গণপতি। ভিতরে ডাঁই করে রাখা আছে নারকেল, আর বালতি ভরা পাকা টুসটুসে পেয়ারা। “আমার গরুটা খাবে এসব। ওই যে, বাইরের মাঠে চরে বেড়াচ্ছে এখন,” সঙ্গে খানকতন দেশি মুরগিও রয়েছেন দেখলাম, কোঁকর-কোঁ করতে করতে ছুটে বেড়াচ্ছে তারা, খুঁটে খাচ্ছে এটা-সেটা।

এরপর মজুত করে রাখা বিভিন্ন ধরনের সার দেখালেন আমায়। ৮০০ টাকা দিয়ে দোকান থেকে কেনা প্রকাণ্ড একখান সাদা বালতি ভরা ‘সয়েল কন্ডিশনার’, গন্ধকের দানা আর জৈবসার। “আমি চাই কার্থিগাই মাসমে [কার্তিক মাস, অর্থাৎ ১৫ই নভেম্বর থেকে ১৫ই ডিসেম্বর] যেন ভালো ফসল ফলে। ওটা বিয়ে-শাদির মরসুম তো, খুব ভালো দর পাব।” চালাঘরের ভিতর একটি গ্রানাইটের থাম রয়েছে, সেটায় হেলান দিয়ে সদাহাস্য এই মানুষটি আমার কানে তুলে দিলেন কৃষিকাজের গোপন মন্ত্র, “গাছপালার সম্মান করতে হবে। সেটা যদি করেন, তো ওরাও আপনাকে ইজ্জত দেবে।”

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

উঠোনে বসে পোষা সারমেয়দ্বয়ের সঙ্গে খেলছেন গণপতি — দুটি কুকুরেরই নাম কারুপ্পু (কালো)। ডানদিকে: খুঁটে খেতে ব্যস্ত একটি মুরগি

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: কীটনাশকের ক্যান। ডানদিকে: জুঁইগাছের ঠিক কোনখানে পোকামাকড় এসে হামলা করে, সেটাই দেখাচ্ছেন গণপতি

গপ্পগাছার আসর জমাতে গণপতির জুড়ি মেলা ভার। এই যে মাঠঘাট খেত-খামার, তাঁর চোখে এগুলি রঙ্গমঞ্চ, হররোজ এখানে কোনও না কোনও যাত্রাপালা লেগেই আছে। “গতকাল, রাত ওই ৯.৪৫ নাগাদ ওইদিক থেকে চারটে শুয়োর এসে হানা দিয়েছিল। কারুপ্পু এখানেই ছিল, শুয়োরগুলো ওর নজরে পড়ে যায়, ব্যাটারা পাকা পেয়ারার গন্ধে গন্ধে এসেছিল। তিনটে শুয়োরকে কারুপ্পু তাড়া করে, আর চার নম্বরটা ওই যে ওইদিক দিয়ে পালিয়ে যায়,” এটা বলেই হাত নেড়ে ইশারা করলেন প্রধান সড়ক, রাস্তা পেরিয়ে মন্দির আর দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠের দিকে। “কী করবেন বলুন? অনেককাল আগে তো হিংস্র জন্তু-জানোয়ার হামলা করত — যেমন ধরুন শেয়াল — এখন অবশ্য ওসবের কোনও বালাই নেই।”

শুয়োর যদি আপদ হয়, কীটপতঙ্গও কিন্তু কোনও অংশে কম যায় না। সদ্য ফোটা ফুল কীভাবে চোখের নিমেষে পোকামাকড়ের আক্রমণে ছারখার হয়ে যায়, জুঁইখেতের চারিধারে হাঁটতে হাঁটতে সেটাই বর্ণনা করলেন গণপতি। এরপর আঙুল তুলে বাতাসের গায়ে বৃত্ত আর চৌকোনা দাগ কেটে বোঝালেন, দুটো গাছের মধ্যে ঠিক কতখানি ফারাক থাকা উচিত। খানকতক মুক্তোসম পুষ্পকুঁড়ি ছিঁড়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন প্রাণভরে গন্ধ নিতে: “মাদুরাই মল্লির গন্ধটাই সবচাইতে ভালো।”

তাঁর এই দাবি না মেনে সত্যিই উপায় নেই। জুঁইয়ে জুঁইয়ে নেশাধরা সুরভি। এই যে তাঁর নিজের হাতে খোঁড়া কুয়োর চারপাশে হাঁটছি, পায়ের তলায় মর্চেরঙা বসুধা, কাঁকরের কলতান, এই যে কৃষিকাজের কথায় প্রকাশিত হচ্ছে গণপতির জ্ঞান, এই যে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছেন স্ত্রী পিচাইয়াম্মার কথা — নিজেকে সত্যিই খুব ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। “আমরা থোড়াই না বড় জোতদার, নেহাতই চিন্না সংসারী [ক্ষুদ্রচাষি] আমরা, তাই বাবু হয়ে বসে শুধু অন্যদের হুকুম দেব, সেটির জো নেই। মজুরদের সঙ্গে আমার বউটাও খেটে মরে, এভাবেই তো টিকে আছি, বুঝলেন?”

*****

এ মুলুকে নয় নয় করেও আজ ২,০০০ বছর ধরে বেঁচে আছে জুঁইফুল, অনন্য তার ইতিহাস। যেভাবে সুতোর পরে একটি একটি করে মল্লি গেঁথে জন্ম নেয় অনিন্দ্য সুন্দর মালা, সেভাবেই এ তামিলভূমির অতীত জুঁইফুলে বোনা। মল্লির বিরাসতে আকার ও সুগন্ধ পেয়েছে এ মাটি। হাওয়াই-নিবাসী তামিল বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক বৈদেহী হার্বার্টের কথায়: মুল্লাই (বিগত যুগে এই নামেই পরিচিত ছিল জুঁই) সহ জুঁইয়ের অন্যান্য প্রজাতির ১০০টিরও বেশি উল্লেখ রয়েছে প্রাচীন সঙ্গম সাহিত্যে। সঙ্গম যুগে ৩০০ পূর্বাব্দ থেকে ২৫০ অব্দ পর্যন্ত মোট ১৮টি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল, তার সবকটাই ইংরেজিতে তর্জমা করে সর্বসাধারণের জন্য অনলাইনে প্রকাশ করেছেন বৈদেহী।

তাঁর মতে ‘মুল্লাই’ থেকেই ‘মল্লিগাই’ শব্দটির উৎপত্তি, যাকে কিনা আজ আমরা ‘মল্লি’ বলে ডাকি। সঙ্গম কবিতায় পাঁচটি ‘আকম থিন্নাইস’ , অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ স্থলভাগের কথা বলা আছে, যার একটির নাম ‘মুল্লাই’ — এটির দ্বারা বনজঙ্গল তথা অরণ্যবর্তী এলাকার কথা বোঝানো হত। বাকি যে চার প্রকারের অভ্যন্তরীণ স্থলভাগ রয়েছে, সেগুলিও কোনও না কোনও পুষ্প বা বৃক্ষের নামে নামাঙ্কিত: কুরিঞ্জি (পর্বত), মারুথাম (মাঠ), নেইথল (উপকূল) ও পাড়ই (রুক্ষ বনভূমি)।

PHOTO • M. Palani Kumar

মাদুরাই জেলার উসিলামপট্টি তালুকে অবস্থিত নাড়ুমুদালাইকুলম জনপদ, পান্ডির মাঠে ফুটে আছে জুঁইফুল ও আধফোটা কুঁড়ি

বৈদেহী তাঁর ব্লগে লিখেছেন যে সঙ্গম যুগের কবিরা “কাব্যিক অলংকার রূপে আকম থিন্নাইস ব্যবহার করেছেন।” উপমা ও রূপকগুলি “স্থলভাগের বিভিন্ন নৈসর্গের আধারে সৃষ্ট। কবিতায় যে যে চরিত্র রয়েছে, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে গাছপালা, পশুপাখি ও খোদ ভূদৃশ্যের।” মুল্লাই পটভূমিকায় যে আখ্যানবস্তু আমরা দেখতে পাই, সেটি হচ্ছে “অধীর অপেক্ষা,” অর্থাৎ কাব্যের নায়ক কবে ফিরবে, তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছে নায়িকা।

এই ২,০০০ বছর প্রাচীন আইনকুরুনূরু কবিতাটিতে অবশ্য নায়ক নিজেই কাহিল হয়ে উঠেছে তার প্রেমিকার রূপ-লাবণ্যের বিরহে:

নাচিছে ময়ূর তোমারই ছন্দে
থোকা থোকা জুঁই, ফুটেছে রে হুই
তব কপালের মায়াবী গন্ধে,
শান্ত হরিণী তোমার চাহনি,
মনে মোর শুধু তোমার ভাবনা, ছুটে ছুটে বাড়ি যাই...
প্রিয়তমা মোর, শ্রাবণ অঘোর, পিছু রহে মেঘ তাই...

অনুরূপ আরও একটি পদ পেয়েছিলাম সঙ্গম-কাব্যের খ্যাতনামা অনুবাদক চেন্থিল নাথনের দৌলতে, যিনি ওল্ডতামিলপোয়েট্রি.কম ওয়েবসাইটটির পরিচালক। জনস্মৃতি তথা এই পদটির কেন্দ্রে বিরাজমান দলপতি পারি, যিনি সঙ্গম-কাব্যে উল্লেখিত সাত মহান পৃষ্ঠপোষকের অন্যতম। কবিতাটি দীর্ঘ, তবে চেন্থিলের মতে নিম্নোক্ত চারটি পংক্তি যেমন অপূর্ব, তেমন প্রাসঙ্গিকও বটে।

গাঁয়ে-গাঁয়ে, দেশে-দেশে নামডাক ভারী, খ্যাতনামা রাজা সে তো দলপতি পারি,
রাজকীয় রথে তার ঘুঙরুর গান, কার তরে পারি রাজা করে দিনু দান?
দুবলা সে জুঁই-লতা, ফুলে ফুলে কথকতা, আছড়িয়া পড়েছিল, কেহ ধরে নাই...
যদিও সে কোনদিনও, গাইবে না ওগো জেনো, পারির সুনাম-গান সুরভি দোলায়...

পুরানানূরু ২০০, পংক্তি ৯-১২

জুঁইয়ের যে প্রজাতিটি আজ ব্যাপক ভাবে চাষ করা হয় তামিলনাড়ুতে, তার বৈজ্ঞানিক নাম জ্যাসমিনুম সাম্বাক। এ দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে লুজ ফ্লাওয়ার (বৃন্তহীন ফুল, অর্থাৎ কাট্ ফ্লাওয়ার বা বৃন্তযুক্ত ফুল নয়) উৎপাদনে পয়লা নম্বরে রয়েছে তামিলনাড়ু। মল্লিচাষেও সব্বার আগে রয়েছে এ রাজ্যের নাম — ভারতে উৎপাদিত মোট ২৪০,০০০ টনের মধ্যে ১৮০,০০০ টন চাষ হয় তামিলনাড়ুতে।

জিআই ট্যাগ ( ভৌগলিক শংসাপত্র ) যুক্ত মাদুরাই মল্লি বিশেষ কিছু গুণমানের অধিকারী, যথা: ‘মন-মাতানো সুগন্ধ, মোটা পাপড়ি, সবচাইতে দীর্ঘ বৃন্ত, দেরি করে ফোটা কুঁড়ি, পাপড়ির বিলম্বিত বিবর্ণতা ও দীর্ঘদিন তরতাজা ভাব বজায় রাখতে পারা (সুদীর্ঘ শেল্ফ-লাইফ)।’

PHOTO • M. Palani Kumar

জুঁইফুলের উপর বসে তার মধু পান করছে একটি প্রজাপতি

জুঁইয়ের অন্যান্য প্রজাতির নামগুলিও বেশ মজাদার। মাদুরাই মল্লি ছাড়াও রয়েছে গুন্দু মল্লি , নাম্মা ঊরু মল্লি , অম্বু মল্লি , রামাবনম, মধনবনম , ইরুভৎচি , ইরুভৎচিপ্পূ , কস্থুরি মল্লি , ঊসি মল্লি সিঙ্গল মোগরা

তবে মাদুরাই মল্লি শুধু মাদুরাইয়েই চাষ হয় এমনটা ভাবা ভুল। এ অঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় দেখা মেলে তার, যেমন ভিরুধুনগর, থেনাই, দিন্দিগুল ও শিবগঙ্গাই। তামিলনাড়ুর মোট শালিজমির মধ্যে কেবল ২.৪ শতাংশে ফুলচাষ হয় বটে, কিন্তু সে জমির ৪০ শতাংশই তার একার দখলে রেখেছে বিভিন্ন প্রজাতির জুঁই। এ রাজ্যে মোট ১৩,৭১৯ হেক্টর জমিতে মল্লিচাষ হয়, তার ছয়ভাগের একভাগ, অর্থাৎ ১,৬৬৬ হেক্টর রয়েছে শুধু মাদুরাই জেলাতেই।

খাতায়-কলমে এসকল পরিসংখ্যান যতই চমৎকার লাগুক না কেন, দরদাম উঠা-নামা করার ফলে নাভিশ্বাস ওঠে চাষিদের। অন্যভাবে যদি বলি, বাস্তবটা বেশ খ্যাপাটে। নিলাক্কোট্টাই বাজারে সুগন্ধির জন্য মোটে ১২০ টাকা কেজিতে বিকোয় যে ফুল, মাট্টুথাভনি পুষ্পবাজারে তারই দাম ৩-৪ হাজার টাকা (সেপ্টেম্বর ২০২২ ও ডিসেম্বর ২০২১-এর দর) — এ দর এতটাই লাগামছাড়া যে অযৌক্তিক তো বটেই, উপরন্তু এটা টিকিয়ে রাখা না-মুমকিন।

*****

ফুলচাষ করা তো নয়, এ হল লটারি কেনা, পুরোটাই সময়ের উপর নির্ভরশীল। “পালাপার্বণের সময় আপনার গাছে ফুল ফুটলে মুনাফা হবে। অন্যথা আপনার বাচ্চাকাচ্চারা এ পেশায় পা রাখার আগে বারবার ভাববে, তাই না? ওরা তো শুধু মা-বাবার কষ্টটাই দেখছে, বলুন?” জবাবের অপেক্ষা না করে গণপতি বলে চললেন, “বড়ো চাষির সঙ্গে রেষারেষি করে ছোটো চাষি টিকতে পারবে না। কারও ধরুন তেপান্তরের মতো খেত রয়েছে, সে ৫০ কেজি ফুল পাড়ার জন্য ১০ টাকা করে বেশি দেবে মজুরদের, এছাড়া তাদের যাতায়াতের জন্য গাড়িরও বন্দোবস্ত করবে, আবার জলখাবারও দেবে। আমাদের বুঝি সাধ্যি আছে ওসব করার?”

অন্যান্য ক্ষুদ্র চাষির মতো ইনিও বড়ো বেনিয়াদের “আদইকলম” বা সাহায্য নেন। গণপতির কথায়, “ফুলচাষ যখন তুঙ্গে ওঠে, আমি ফুলের বস্তা নিয়ে বারবার বাজারে যাই — সকাল, বিকেল, রাত। বেনিয়াদের ছাড়া ফসলটুকু বেচা অসম্ভব আমার পক্ষে।” জুঁই বেচে একটাকা কামালে তার থেকে কমিশন বাবদ ১০ পয়সা দিতে হয় বেনিয়াদের।

পাঁচ বছর আগে, মাদুরাইয়ের এক ধনবান ফুল-ব্যবসায়ীর থেকে কয়েক লাখ টাকা ধার করেছিলেন গণপতি। এই ব্যবসায়ীর নাম পূকাডাই রামাচন্দ্রন, ইনি মাদুরাই ফ্লাওয়ার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও বটেন। সরাসরি পূকাডাইকে ফুল বেচে ধার মিটিয়েছিলেন গণপতি। এমন লেনদেনের ক্ষেত্রে লাফিয়ে লাফিয়ে ১০-১২.৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে কমিশনের হার।

কীটনাশক তথা কৃষিকাজে ব্যবহৃত আরও নানান সরঞ্জাম কেনার সময়েও স্বল্প-মেয়াদী ঋণ নেন ক্ষুদ্র চাষিরা। উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের এ সংঘাত কিন্তু চিরাচরিত। দুঃখটা কোথায় জানেন? মায় রাগির মতো শক্তপোক্ত ফসল হলেও বিপদ কাটে না, হাতির মতো দৈত্যাকার প্রাণীরা এসে হানা দেয় খেতে। রাগির খেত বাঁচাতে গিয়ে রাতদিন হন্যে হয়ে মাথা খাটান কৃষকেরা। সবসময় সফলও হন না, আর তাই অনেকেই রাগি ছেড়ে ফুলচাষের দিকে ঝুঁকেছেন। অন্যদিকে, মাদুরাইয়ের যে এলাকাগুলি পুষ্প-উৎপাদনে বিখ্যাত, সেখানে চাষিরা লড়ছেন ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র প্রাণীর সঙ্গে — হরেক প্রজাতির মথের শূককীট (বাড্ ওয়ার্ম, লিফ ওয়েবার প্রভৃতি), পুষ্প ডাঁশ (ব্লসম মিজেস্) ও চেলোপোকার (মাইট) দল — যাদের হামলা শেষে পড়ে থাকে বিবর্ণ ফুল, আধমরা গাছ ও দেউলিয়া চাষি।

PHOTO • M. Palani Kumar

মাদুরাই জেলার থিরুমল গাঁ, বিভিন্ন প্রজাতির কীটের হামলায় জেরবার তাঁর জুঁই-খেতে কাজ করছেন চিন্নামা

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

ফুল তুলতে হাত লাগায় অল্পবয়সি থেকে বয়স্ক - সব্বাই। ডানদিকে: থিরুমল গাঁয়ে মল্লি খেতের পাশেই চলছে কাবাডি খেলা

গণপতির বাড়ি থেকে মোটর-পথে একটু দূরেই থিরুমল গ্রাম, সেখানে দেখা পেলাম কীট-হামলায় বিধ্বস্ত একটি জুঁই খেতের। ফুলের সঙ্গে সঙ্গে মুছে গেছে খোয়াবও। এই মল্লি থোট্টামটি (জুঁই-খেত) ৫০ বছর বয়সি আর. চিন্নামা ও তাঁর স্বামী রামারের। দুই বছর বয়সের পুরোনো গাছগুলি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে ঠিকই, তবে এগুলি নিতান্তই “দ্বিতীয় স্তরের ফুল, খুবই অল্প দর উঠবে,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন চিন্নামা। ফুলগুলি রোগগ্রস্ত। মানুষটি যে কতখানি কাতর হয়ে পড়েছেন, সেটা তাঁর ঘনঘন মাথা নাড়া আর জিভের চুক-চুক শব্দে টের পেয়েছিলাম। “ফুলগুলো আর পাপড়ি মেলবে না, বাড়বেও হবে না।”

তবে মজুরির ভাগ কিন্তু এক আনাও কমেনি। বৃদ্ধ মহিলা, বাচ্চা, কলেজ-পড়ুয়া মেয়ে – ফুল তোলার কাজে রত সবাই। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সস্নেহে ডালপালা সরিয়ে কুঁড়ি খুঁজছিলেন চিন্নামা। পেড়ে নেওয়া কুঁড়ি এসে জমা হচ্ছিল তাঁর কান্ডাঙ্গি ছাঁদে জড়ানো শাড়ির ভাঁজে। মাঠে হরেক রকমের কীটনাশক ছড়িয়েও ব্যর্থ হয়েছেন রামার। “মানুষটা অনেক ধরনের ‘ওজনদার ওষুধ’ ইস্তেমাল করেছে, ওসব কিন্তু আতি-পাতি ওষুধ নয় মোটেও। লিটার পিছু ৪৫০ টাকা খসেছে। কিন্তু কিছুতেই কাজ দিল না! শেষমেশ দোকানদার নিজেই আমাদের টাকা নষ্ট করতে বারণ করেছে।” রামার তখন চিন্নামাকে বলেছিলেন, “গাছগুলো উপড়ে ফেলো, আর উপায় নেই। ১.৫ লাখ টাকা জলে গেছে।”

এই কারণেই খেতে তাঁর স্বামীর দেখা পাইনি। চিন্নামার কথায়: “ভায়িথেরিচল।” এই তামিল শব্দটির আক্ষরিক অর্থ পেট জ্বালা করা — এটি তিক্ততা ও ঈর্ষার ইঙ্গিতবাহী। “অন্যরা যখন এক কেজি মল্লি বেচে ৬০০ টাকা পাচ্ছে, আমাদের ঝুলিতে ১০০ টাকার বেশি জুটছেই না।” তবে ওঁর এই ক্রোধ ও বিরক্তি কিন্তু গাছের প্রতি নয়। শাখার তলে লুকিয়ে আছে কুঁড়ির দল, তাদের পাড়তে খেলে ডালপালা যতটুকু মোচড়ানো দরকার, আলতো হাতে ঠিক ততটাই মোচড় দেন তিনি। “ফসল ভালো হলে একেকটা গাছে ফুল পাড়তেই কয়েক মিনিট বেরিয়ে যায়। কিন্তু এখন...” চকিতে একটি গাছ নিঃশেষ করে আরেকটির দিকে হাত বাড়ালেন চিন্নামা।

ফসলের পরিমাণ অনেককিছুর উপর নির্ভর করে — কাঁধের উপর তোয়ালে চাপিয়ে চিন্নামার খেতে হাত লাগাতে লাগাতে বললেন গণপতি: “মাটি, গাছের বৃদ্ধি, চাষির হাত কতটা পাকা, এসবের উপর নির্ভর করে। বাচ্চা মানুষ করার মতোই গাছের তোয়াজ করতে হয়। একটা শিশু ঠিক কী কী চায়, সেটা তো সে আর মুখ ফুটে আপনাকে কইতে পারবে না, তাই না? আপনাকে সেটা নিজে-নিজেই বুঝতে হবে, আর সজ্ঞাতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সদ্যোজাত শিশু কেঁদে কঁকিয়ে ওঠে, গাছপালা তো সেটুকুও পারে না। তবে হ্যাঁ, আপনার যদি অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে নিজেই সমঝে যাবেন...গাছটা অসুস্থ, রোগগ্রস্ত, নাকি মরতে বসেছে।”

অধিকাংশ রোগেরই ‘পথ্য’ বিভিন্ন রাসায়নিকের খিচুড়ি। জৈব প্রক্রিয়ায় মল্লিচাষের কথা জিজ্ঞেস করলাম। গণপতির উত্তরে ধরা পড়ল ক্ষুদ্র-চাষির চিরন্তন দ্বিধা। “সে করাই যায়, কিন্তু আরও বেশি ঝুঁকি রয়েছে তাতে।” এটা বলেই এক সুতীক্ষ্ণ সওয়াল ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে: “জৈবচাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমি, কিন্তু ওভাবে যদিও বা চাষ করি, বেশি দর কে-ই বা দেবে?”

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: তরতাজা জুঁইগাছের দ্বারা বেষ্ঠিত একটি মৃত গাছ। ডানদিকে: বালতির ভিতর মল্লিকুঁড়ি ও একখানা পাড়ি (মাপকাঠি), এটির দ্বারা মাপা হয় কোন মজুর কতটা ফুল পেড়েছেন — যা দিয়ে নির্ধারিত হয় তাঁর মজুরি

PHOTO • M. Palani Kumar

খেতের মালিক আর মজুর, জুঁই পাড়েন সবাই মিলে, গল্পগুজব আর গান শোনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে কুঁড়ি ফোটার আগেই তড়িঘড়ি তাদের বাজারে নিয়ে যাওয়ার পালা

“রাসায়নিক সার দিলে উৎপাদন ভালো হবে। ওভাবে চাষ করাটা সহজও। জৈব প্রক্রিয়াটা বেশ ফঙবেনে, অগোছালোও বটে — সবরকমের মাল-মশলা একটা গামলায় ভিজিয়ে সেটা সন্তর্পণে ছিটোতে হয়, তারপর বাজারে নিয়ে গিয়ে দেখি যে সেই আগের মতোই দর মিলছে! খুবই দুঃখজনক, কারণ জৈব মল্লি আকারেও বড়ো, আর বেশ উজ্জ্বলবর্ণ। কিন্তু বেশি দর না পেলে — এই ধরুন দুগুণ — এত্ত সময় দেওয়া আর খাটাখাটনি করা, কোনটাই সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

গেরস্থালির জন্য জৈব সবজি চাষ করেন গণপতি। “ওসব কেবলই নিজেদের আর আমার মেয়ের জন্য, ও বিয়ে-থা করে পাশের গাঁয়ে সংসার পেতেছে। এসব রাসায়নিকের থেকে আমিও দূরে যেতে চাই। লোকে বলে যে এর নাকি অনেক ধরনের পার্শ্বপতিক্রিয়া আছে। কড়া কড়া কীটনাশক ইস্তেমাল করলে, স্বাস্থ্য খারাপ তো হবেই। কিন্তু, আর উপায়ই কিছু আছে, বলুন তো?”

*****

একইরকম নিরুপায় গণপতির স্ত্রী পিচাইয়াম্মা। সারাটাদিন খেটে মরেন। হররোজ। হাসিটাই তাঁর টিকে থাকার একমাত্র কৌশল। একমুখ হাসি, সারাটাক্ষণ লেগে থাকে ঠোঁটে। ২০২২-এর অগস্টের শেষে, দ্বিতীয়বারের জন্য ওঁদের বাড়িতে গিয়েছিল পারি। উঠোনে একখান নিমগাছের শীতল ছায়ায় খাটিয়া পেতে আমাদের শুনিয়েছিলেন তাঁর কর্মদিনের বৃত্তান্ত।

“আড়া পাকা, মাড়া পাকা, মল্লিগাপু থোট্টাম পাকা, পূভা পারিকা, সময়কা, পুল্লাইগালা আন্নুপিভিদা... [গরু-ছাগল আর জুঁই-খেতের পরিচর্যা, মল্লি পাড়া, রান্নাবান্না, বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠানো...]।” অনন্ত এ তালিকার ঠেলায় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়!

সন্তানদের জন্যই তাঁর এই অবিরাম পরিশ্রম, জানালেন ৪৫ বছরের পিচাইয়াম্মা: “আমার ছেলে আর মেয়ে উচ্চ-শিক্ষিত, দুজনেরই ডিগ্রি আছে।” নিজে অবশ্য ইস্কুলের গণ্ডি পেরোনোর সুযোগ পাননি কোনদিনও। বাচ্চা বয়সে মা-বাবার জমিতে ঘাম ঝরাতেন, আর আজ নিজের খেতে মেহনত করেন। তাঁর কানে আর নাকে কিঞ্চিৎ গয়না আছে খেয়াল করলাম, গলায় দুলছে হলুদ-মাখা সুতোয় বাঁধা থালি (মঙ্গলসূত্র)।

যেদিন আমাদের দেখা হয়েছিল, উনি মল্লিখেতে আগাছা নিড়োচ্ছিলেন। সারাটাক্ষণ নুয়ে নুয়ে থাকা, কাঠফাটা রোদ সয়ে দাঁতে দাঁত চিপে ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে হেঁটে যাওয়া — কাজ না শাস্তি তা বোঝা দায়। তবে আপাতত ওসবের নিয়ে ভাবার ফুরসৎ নেই তাঁর — অতিথি, অর্থাৎ আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। “দয়া করে একটু কিছু মুখে দিন,” বললেন পিচাইয়াম্মা। আমাদের জন্য শাঁসালো সুগন্ধি পেয়ারা পেড়ে আনলেন গণপতি, সঙ্গে কচি ডাবের জল। আমাদের খেতে দিয়ে তিনি বোঝাতে লাগলেন যে কেমনভাবে শিক্ষিত যুবসমাজ গাঁ ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে। এ তল্লাটে জমির দাম একর-পিছু ন্যূনতম ১০ লাখ। তবে প্রধান সড়কের কাছে হলে, জমির দাম এর চারগুণ ওঠে। “তারপর বাড়ি বানানোর ‘প্লট’ হিসেবে বিক্রি হয়ে যায়।”

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

গাঁ থেকে ভাড়া করে আনা একজন মজুরের (ডানদিকে) সঙ্গে জুঁই-খেতের আগাছা নিড়োতে নিড়োতে নিজের কর্মদিনের কথা শোনাচ্ছেন পিচাইয়াম্মা

বাড়ির লোকজন বিনেপয়সায় মেহনত না করলে যে মুনাফার মুখদর্শন করা যায় না, এই কথাটা ভূমিহীন পরিবারগুলির ক্ষেত্রেও সমানভাবে খাটে। তবে এই মজুরিহীন শ্রমের সিংহভাগটা যে মহিলারাই বইছেন, সেকথা স্বীকার করলেন গণপতি। পিচাইয়াম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, অন্য কারও হয়ে এই পরিমাণ খাটলে কতটা মজুরি পেতেন? জবাব এল, “৩০০ টাকা।” তবে ঘর-সংসারের যাবতীয় কামকাজ বা গবাদি পশুর দেখভালটা কিন্তু এই হিসেবের বাইরে।

“যদি বলি, মাস গেলে আপনার জন্য ১৫,০০০ টাকা বাঁচছে আপনার পরিবারের, খুব একটা ভুল হবে না, তাই তো?” সওয়াল করেছিলাম আমি। পিচাইয়াম্মা ও গণপতি দুজনেই মেনে নিয়েছিলেন এককথায়। তারপর খানিক রসিকতা করে বলেছিলাম, এটা তো আপনার হকের টাকা, মজুরিটা তবে দেওয়া হোক। হেসে উঠেছিলেন সবাই, পিচাইয়াম্মার হাসি থামতেই চাইছিল না।

এরপর খানিক মৃদু হেসে, তীক্ষ্ণ চোখে আমার মেয়ের কথা শুধালেন আমায়। মেয়ের বিয়েতে কতটা সোনা দেব, সেটাও জিজ্ঞেস করতে ছাড়লেন না পিচাইয়াম্মা। তাঁর কথায়: “এখানে আমরা ৫০ সভেরেইনের [১ সভেরেইন সমান ৭.৯ গ্রাম] কম দিই না। তারপর, নাতি-নাতনি জন্মালে সোনার হার আর রুপোর তোড়া দিই; কান ফুটো করার সময় দাওয়াতে গোটা পাঁঠা চড়াই; এ ফিরিস্তির কোনও শেষ নেই। সবই তো আমাদের নিজেদের রোজগারে। এবার বলুন দেখি, মাইনে চাই কোন মুখে?”

*****

তবে মাইনে নামক বস্তুটি যে কতটা ভালো আর কতখানি জরুরি, ওই সন্ধ্যাতেই একথা জেনেছিলাম এক তরুণ জুঁই-চাষির কাছে। চাষবাসের যোগ্য পরিপূরক, হাতের পাঁচ, খাটনি দুগুণ হলেও রুজিরুটির নিশ্চয়তা — সবই আসে এই ‘মাইনে’ থেকে। ছয় বছর আগে এই একই যুক্তি শুনেছিলাম মাদুরাই জেলার উসিলামপট্টি তালুকের নাড়ুমুদালাইকুলম জনপদে, জেয়াবল ও পোধুমণি নামের দুই ধানচাষির থেকে। এইবারে, অর্থাৎ অগস্ট ২০২২-এ তাঁর ছোটবেলার ইয়ার তথা মল্লি-চাষি এম. পাণ্ডির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন জেয়াবল। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাণ্ডি, কৃষিকাজ ছাড়াও তামিলনাড়ুর রাজ্য বিপণন কর্পোরেশন লিমিটেডে (টিএএসএমএসি, TASMAC) পাকা চাকরি আছে তাঁর। টিএএসএমএসি বাদে এই রাজ্যে ভারতে-প্রস্তুত বিদেশি সুরা (আইএমএফএল) বেচার অধিকার কারও নেই।

তবে বছর ৪০-এর পাণ্ডি কিন্তু আজন্মকাল কৃষক ছিলেন না। গাঁ থেকে মোটর-পথে ১০ দূর তাঁর খেত, সেখানে যেতে যেতে নিজের জীবনের কিসসা শুনিয়েছিলেন পাণ্ডি। যেদিকে দুচোখ যায়, মাইলে পর মাইল শুধু পান্নাসবুজ ক্যানভাস, পাহাড়, জলরাশি আর মুক্তোর মতো ঝলসে ওঠা সাদা সাদা জুঁইয়ের কুঁড়ি।

PHOTO • M. Palani Kumar

নয়নাভিরাম নাড়ুমুদালাইকুলম জনপদে নিজের জুঁই-খেতে এম. পাণ্ডি, এখানকার বহু চাষি ধানচাষও করেন

“১৮ বছর টিএএসএমএসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, পড়াশোনার পাট চুকিয়েই। এখনও কাজ করি ওখানে, আর সকালগুলো কাটে মল্লিখেত পরিচর্যায়।” ২০১৬ সালে, সদ্য সদ্য নির্বাচিত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা এআইএডিএমকের প্রধান জে. জয়ললিতা টিএএসএমএসির কাজের সময় ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ১০ ঘণ্টা করে দেন। জয়ললিতার প্রসঙ্গ উঠলেই ভক্তিভরে তাঁকে ‘মানবুমিগু পুরাতচি থালাইভা আম্মা আভারগল’ (শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নেত্রী, আম্মা) বলে ডাকেন পাণ্ডি। এ উপাধি যতটা আনুষ্ঠানিক, ততটাই সম্মানজনক। উক্ত পদক্ষেপের ফলে পাণ্ডির সকালগুলো ফাঁকা হয়ে যায়, কারণ ১০টার বদলে দুপুর ১২টায় অফিস গেলেই হত। সেদিন থেকে ফুরসতের ওই ২টি ঘণ্টা নিজের জমিনের প্রতি উৎসর্গ করেছেন এই মানুষটি।

জুঁই-খেতে কীটনাশক ছড়াতে ছড়াতে, কণ্ঠভরা স্বচ্ছতা ও প্রত্যয় নিয়ে নিজের দুটি পেশার বিষয়ে বলছিলেন পাণ্ডি: “দেখুন, আমি নিজে যেমন চাকুরিজীবী, তেমনই চাষের কাজে ১০ জন মজুরকেও নিয়োগ করেছি।” কথার পরতে পরতে গর্ব সাজানো থাকলেও সেটা ছিল বাস্তবের আঁচে তাতানো। “আবার এটাও সত্যি যে নিজের জমিজমা থাকলে তবেই চাষ করা যায়। কয়েকশো টাকার কীটনাশক, একেকটার তো হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হয়। আমি মাইনে পাই বলেই সবকিছু সামলাতে পারি। নতুবা চাষবাস করা খুবই কঠিন, বেশ কঠিন।”

আর সেই কঠিনেরও এককাঠি উপরে মল্লিচাষ, জানালেন তিনি। উপরন্তু গোটা জীবনটাই গাছ ঘিরে সাজাতে হয়। “কোত্থাও যেতে-টেতে পারবেন না, সকালগুলো বরাদ্দ থাকে ফুল পেড়ে বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া আজ হয়ত এক কেজি ফুল পেলেন। আগামী সপ্তাহে সেটা ৫০ কেজি হয়ে যেতে পারে। যা খুশি হতে পারে, আপনাকে তৈরি হয়ে থাকতেই হবে।”

এক একর জমিনে চাষ করেন পাণ্ডি, ধীরে ধীরে একটি-দুটি করে গাছ লাগিয়ে লাগিয়ে জমিটুকু ভরিয়ে তুলেছেন। তাঁর কথায়: ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুঁইগাছ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে বাধ্য হন চাষিরা, “কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত্তির হয়ে যায়। ভোর ৫টা বাজলেই উঠে পড়ি, এসে হাজির হয় খেতে। বাচ্চাদুটোকে ইস্কুলে পাঠিয়ে আমার স্ত্রীও কাজে এসে জোটে আমার সঙ্গে। যদি আলসেমি করি, সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাই, তাহলে উন্নতি করবটা কেমন করে? আর সেটা না হলে ১০টা মানুষকে কাজই বা দেব কেমনে?”

এক একরের গোটাটা জুড়ে ফুল ফুটলে “২০-৩০ জন মজুর তো লাগেই,” এটা বলে দুহাত ছড়িয়ে মানসচক্ষে পূর্ণপুষ্পিত মাঠের ছবি তুলে ধরলেন পাণ্ডি। সকাল ৬টা থেকে ১০টা, অর্থাৎ চার ঘণ্টা মজুরির জন্য ১৫০ টাকা করে পান প্রত্যেকে। ফুলের মরসুম কাটলে উৎপাদনে মন্দা লাগে, এক কিলোর বেশি মল্লি পাওয়া যায় না, তখন স্ত্রী শিবাগামি ও দুই সন্তানের সঙ্গে নিজেই ফুল পাড়েন পাণ্ডি। “অন্যান্য জায়গায় উৎপাদনের হার কম হলেও এই এলাকাটা বেশ উর্বর, অসংখ্য ধানখেত রয়েছে। মজুরদের চাহিদা বিশাল। ঠিকমতন মজুরি না দিয়ে পার পাবেন না, তার সঙ্গে ওদের চা আর ভড়াইও [বড়া] দিতে হয়...”

গ্রীষ্মের দুটো মাস (এপ্রিল ও মে) মল্লির বাজার থাকে সরগরম, তুঙ্গে ওঠে উৎপাদন। “৪০-৫০ কেজি ফুল তো মেলেই। আগে আগে একদম দাম পেতাম না, একেক সময় তো মোটে ৭০ টাকা কিলোতেও বেচেছি। তবে হ্যাঁ, ঈশ্বরের কৃপায় ‘সেন্ট’ কোম্পানিরা দর বাড়িয়েছে, এক কেজি জুঁই ২২০ টাকায় কেনে ওরা।” বাজারে টন-টন ফুল এসে উঠলে তবেই সর্বোচ্চ মূল্যে বেচতে সক্ষম হন কৃষকেরা। পাণ্ডির মতে, ওই দরে মুনাফা না হলেও অন্তত ক্ষতির মুখ দেখতে হয় না।

PHOTO • M. Palani Kumar

কীটনাশকের সঙ্গে সার মিশিয়ে জুঁইগাছে ছড়াচ্ছেন পাণ্ডি

PHOTO • M. Palani Kumar
PHOTO • M. Palani Kumar

সারি সারি মল্লিচারার ফাঁক দিয়ে হেঁটে চলেছেন গণপতি। ডানদিকে: তাঁদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পিচাইয়াম্মা

বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূর, পড়শি জেলা দিন্দিগুলের নিলাক্কোট্টাই বাজারে তাঁর খেতের ফুল নিয়ে যান তিনি। “মাট্টুঠাভানি বাজারটা খারাপ বলছি না কিন্তু, ওটাও খুব ভালো। কিন্তু কিলোর দরে বেচতে হয়, যেখানে নিলাক্কোট্টাই গেলে বস্তাভরে বেচতে পারি। উপরন্তু বেনিয়াও ঠিক পাশে বসে থাকেন। সবকিছুর হিসেব তো রাখেনই, তার উপর অপ্রত্যাশিত খরচাপাতি, পালাপার্বণ আর ফুলে স্প্রে করার রাসায়নিকের জন্য আগাম টাকাও দেন আমাদের।”

তাঁর কথায়, এই স্প্রে করাটাই সফল জুঁই-চাষের চাবিকাঠি। চটজলদি চালাঘরে ঢুকে কাপড়জামা বদলে হাফপ্যান্ট আর ডোরাকাটা একখান টিশার্ট পরে বেরিয়ে এলেন পাণ্ডি। গণপতির ছেলে কীটনাশক বিশেষজ্ঞ, কিন্তু পাণ্ডির জীবনে অমন কেউ নেই, তাই বাছাই করা রাসায়নিক কিনতে হলে বাধ্য হয়ে দোকানদারের স্মরণাপন্ন হন। চালাঘরের ভিতর থেকে বার করা ও মেঝের উপর ছড়ানো ফাঁকা ক্যান আর বোতলের দিকে ইঙ্গিত করলেন, তারপর একটি ট্যাঙ্কি আর স্প্রে করার যন্ত্র এনে তাতে জলে সঙ্গে রোগোর (এক প্রকার কীটনাশক) আর আস্থা (একধরনের সার) মেশাতে লাগলেন। এক একর জমি স্প্রে করতে ৫০০ টাকা খরচা হয়, আর এটি চার-পাঁচদিনের তফাতে একবার করে করতেই হয়। “ফুলের মরসুম হোক বা মন্দা, এটা করতে বাধ্য। আর উপায় নেই...”

শুধুমাত্র একখান কাপড়ের মাস্ক দিয়ে নাকমুখ ঢেকে, প্রায় ২৫ মিনিট ধরে গাছে গাছে সার ও কীটনাশক মিশ্রিত জল ছিটিয়ে গেলেন পাণ্ডি। ভারি যন্তরখানা পিঠে ঝুলিয়ে ঘন ঝোপের ফাঁক দিয়ে হাঁটছিলেন মানুষটি। প্রতিটা পাতা, প্রতিটা ফুল ঢেকে যাচ্ছিল রাসায়নিকের কুয়াশা সম ছিটেয়। জুঁইগাছগুলো তাঁর কোমর সমান, তাই রাসায়নিকের মেঘ তাঁর মুখ অবধি উঠে আসছিল। যন্ত্রটার বিকট আওয়াজ, বাতাসে ভারি হয়ে এসেছে রাসায়নিক ধোঁয়াশায়, স্প্রে করতে করতে হাঁটছিলেন পাণ্ডি। পিঠের ট্যাঙ্কি ফুরিয়ে গেলে সেটা ভর্তি করতে একবার করে থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন, তারপর আবার চরৈবেতি চরৈবেতি...

খানিক পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এভাবে রাসায়নিক গায়ে-মুখে লাগলে কোনও অসুবিধা হয় না? ততক্ষণে স্নান-টান সেরে আবারও সেই সাদা জামা আর নীল লুঙ্গি চাপিয়ে নিয়েছিলেন গায়ে। শান্ত স্বরে জবাব দিয়েছিলেন: “মল্লিচাষে পা রাখলে, যখন যেটা দরকার তখন সেটা করতেই হবে। [স্প্রে] না করতে চাইলে ঘরে বসে থাকুন হাত-পা গুটিয়ে।” কথা বলতে বলতে ইবাদতের ভঙ্গিতে হাতদুটো জড়ো করে রেখেছিলেন পাণ্ডি।

বিদায় নেওয়ার সময় একই কথা জানিয়েছিলেন গণপতি। হাতব্যাগে পেয়ারা ভরে, শুভযাত্রা জানিয়ে, আবারও আসার কথা বলেছিলেন। তারপর পিছন ঘুরে পলেস্তারাহীন ইটের বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন: “পরেরবার এসে দেখবেন, ঘরটা তৈরি হয়ে গেছে। সব্বাই মিলে বসে ভোজ খাব।”

হাজার হাজার মল্লিচাষির মতো পাণ্ডি ও গণপতিও তাঁদের আশা-ভরসা, খোয়াব, সবকিছু অর্পণ করেছেন ছোট্ট ছোট্ট ওই মন-মাতানো গন্ধওয়ালা ফুলের পদতলে। এ পুষ্পের ইতিহাস যতটা প্রাচীন, ঠিক ততটাই ব্যস্ততা ও অনিশ্চয়তায় ভরা তার বাজার। হাজার হাজার টাকা, টন-টন জুঁই — হাতফেরতা হতে মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে না সেথা।

তবে সে গপ্পটা না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাকুক।

২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Aparna Karthikeyan

अपर्णा कार्थिकेयन स्वतंत्र मल्टीमीडिया पत्रकार आहेत. ग्रामीण तामिळनाडूतील नष्ट होत चाललेल्या उपजीविकांचे त्या दस्तऐवजीकरण करतात आणि पीपल्स अर्काइव्ह ऑफ रूरल इंडियासाठी स्वयंसेवक म्हणूनही कार्य करतात.

यांचे इतर लिखाण अपर्णा कार्थिकेयन
Photographs : M. Palani Kumar

एम. पलनी कुमार २०१९ सालचे पारी फेलो आणि वंचितांचं जिणं टिपणारे छायाचित्रकार आहेत. तमिळ नाडूतील हाताने मैला साफ करणाऱ्या कामगारांवरील 'काकूस' या दिव्या भारती दिग्दर्शित चित्रपटाचं छायांकन त्यांनी केलं आहे.

यांचे इतर लिखाण M. Palani Kumar
Editor : P. Sainath

पी. साईनाथ पीपल्स अर्काईव्ह ऑफ रुरल इंडिया - पारीचे संस्थापक संपादक आहेत. गेली अनेक दशकं त्यांनी ग्रामीण वार्ताहर म्हणून काम केलं आहे. 'एव्हरीबडी लव्ज अ गुड ड्राउट' (दुष्काळ आवडे सर्वांना) आणि 'द लास्ट हीरोजः फूट सोल्जर्स ऑफ इंडियन फ्रीडम' (अखेरचे शिलेदार: भारतीय स्वातंत्र्यलढ्याचं पायदळ) ही दोन लोकप्रिय पुस्तकं त्यांनी लिहिली आहेत.

यांचे इतर लिखाण साइनाथ पी.
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra