২০২০ সালের জানুয়ারি মাস, ঈষৎ হিমেল এক বিকেল। জ্বালানি কাঠ কুড়োতে ঘারাপুরিতে নিজেদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে জঙ্গলে গিয়েছিলেন জয়শ্রী মহাত্রে, আর ঠিক তখনই কিছু একটা কামড়ায় তাঁকে। দুই মেয়ের এই মা প্রথমটায় অত গা করেননি, ভেবেছিলেন কাঠকুটো কিছু ফুটেছে বুঝি। খানিক পরেই কুড়িয়ে বাড়িয়ে জোগাড় করা কাঠ নিয়ে ঘরের দিকে রওনা দেন তিনি।

অনতিকাল পর বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। আশেপাশে যাঁরা ছিলেন, প্রথমটায় তাঁরা ভেবেছিলেন এ বুঝি কেবলই দুর্বলতার লক্ষণ, আসলে জয়শ্রী উপোস করছিলেন কিনা।

বড়ো মেয়ে ভাবিকা (২০) মনে করে বললেন: “সবাই আমাকে জানাল যে আই নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে।” বোন গৌরীর (১৪) সঙ্গে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন বলে ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখতে পারেননি তিনি। অকুস্থলে উপস্থিত পড়শি এবং আত্মীয়রা মেয়েদের জানালেন যে খানিক পরে জয়শ্রীর জ্ঞান ফিরলেও তাঁর নাকি হাত-পা কাঁপছিল। ভাবিকার কথায়: “কী যে হয়েছে, কেউ তো কিছুই বলতে পারল না।”

কেউ একটা তড়িঘড়ি গিয়ে খবর দেয় জয়শ্রীর স্বামী মধুকর মহাত্রেকে (৫৩), তিনি তখন ঘারাপুরি দ্বীপে তাঁর গুমটিতে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে এই খাবারদাবারের দোকানটি চালাতেন তিনি। মুম্বইয়ের কাছেই আরব সাগরের তীরে ঘারাপুরি দ্বীপটি এলিফ্যান্টা গুহার জন্য বিখ্যাত। ইউনেস্কো বিশ্ব হেরিটেজ সাইট রূপে স্বীকৃত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ পর্যটক এসে ভিড় জমান এই গুহায়। খ্রিস্টোত্তর ৬ষ্ঠ ও ৮ষ্টম শতাব্দীতে পাথর কেটে নির্মিত এখানকার স্থাপত্যশিল্প। পর্যটন শিল্পের ভরসায় বেঁচে আছেন এই দ্বীপের বাসিন্দারা – টুপি, রোদচশমা, স্মারকবস্তু, খাবারদাবার ইত্যাদি বেচে পেট চালান তাঁরা, কয়েকজন পর্যটকদের জন্য গাইডের ভূমিকাও পালন করেন।

পর্যটন মানচিত্রে জ্বলজ্বল করছে ঘারাপুরি গ্রাম, অথচ প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থার চিহ্নটুকুও নেই কোথাও, নিদেনপক্ষে একখানা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও জোটেনি। বছর দুই আগে একটা বানানো হয়েছিল বটে, তবে সেটা পরিত্যক্ত। এ গ্রামের মোট জনসংখ্যা ১,১০০। রাজবন্দর, শ্বেতবন্দর ও মোরাবন্দর নামে তিনটি জনপদ জুড়ে বসত তাঁদের। চিকিৎসা ব্যবস্থার এমনই দুর্দশা যে নৌকায় চেপে গাঁ ছেড়ে বাইরে না গিয়ে উপায় নেই। অনেকটা টাকা তো খসেই, উপরন্তু দরকারের সময় ডাক্তারবদ্যি পেতে দেরি হলে তার জেরে রোগীর প্রাণসংশয় দেখা দেয়।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: প্রয়াত জয়শ্রীর গুমটিতে তাঁর মেয়ে গৌরী মহাত্রে (১৪), এলিফ্যান্টা গুহা দেখতে আসা পর্যটকদের গয়নাগাঁটি তথা নানান স্মারক বিক্রি করছে। ডানদিকে: ঘারাপুরি গ্রামের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি বছর দুয়েক আগে তৈরি হলেও পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে আছে

ফেরি ধরে উরান শহরে যাবেন বলে সাততাড়াতাড়ি জয়শ্রীকে নিয়ে জেটিতে ছুটে যান মধুকর। কিন্তু নৌকা ছাড়ার আগেই জয়শ্রী মারা যান। শেষের দিকে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছিল, যা দেখে সাপে-কাটার কথাটাই মাথায় আসে। আশেপাশের লোকজন তাঁর ডান হাতের মধ্যমায় বিষদাঁতের দাগ স্পষ্ট দেখতে পান।

ভাবিকার জানাল যে এ অঞ্চলে সাপের দংশন, কাঁকড়াবিছের হুল, পোকার কামড় ইত্যাদি রোজকার ঘটনা। এই জাতীয় ছোবল বা কামড়ের পর সময়মতো প্রাথমিক চিকিৎসা না মেলায় জান গেছে, এমন বহু ঘটনার কথা স্মরণ করলেন মহারাষ্ট্রের রাইগড় জেলার উরান তালুকের এই গ্রামের মানুষজন।

অমিল স্বাস্থ্য পরিষেরার জেরে গত দশকে এমন অনেকেই মারা গেছেন যাঁরা হয়তো ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে বেঁচে যেতেন। গোটা দ্বীপে একখানা ওষুধের দোকানও না থাকাই প্রমণ করে অবস্থাটা কতটা খারাপ। ফলত গ্রামবাসীরা মূল ভূখণ্ডে গিয়ে যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে আনতে বাধ্য হন। ঘারাপুরি ছেড়ে বেরোনোর কেবল দুটি রাস্তা আছে: হয় দক্ষিণগামী নৌকায় চড়ে উরান তালুকের মোরা বন্দরে যেতে হবে, কিংবা পূর্বগামী ফেরি ধরে নবি মুম্বইয়ের নাহভা গ্রামে। তবে যেদিকেই যান, পাক্কা আধা ঘণ্টা তো লাগবেই। দ্বীপের পশ্চিম দিকে দক্ষিণ মুম্বইয়ের কোলাবা যাওয়ার আরেকটা জলপথ আছে, তবে সেই পথে পাক্কা একঘণ্টা লেগে যায়।

গুহাদর্শনে আসা ট্যুরিস্টদের জন্য গাইডেরকাজে নিযুক্ত দৈবত পাতিল (৩৩) জানালেন: “গাঁয়ে বসে কোনও ডাক্তার বা নার্সকে গিয়ে দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। ঘরোয়া টোটকা কিংবা হাতের কাছে [বাড়িতে মজুত করা] যা কিছু ওষুধপত্তর আছে তা দিয়েই কাজ চালাই।” মনুমেন্টের কাছেই একটি জোড়াতালি দিয়ে বানানো গুমটিতে বসে টুপি বিক্রি করতেন তাঁর মা বৎসলা পাতিল, মাস গেলে মেরেকেটে ৬,০০০ টাকা রোজগার হত। মে ২০২১, করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ চলছে তখন, হঠাৎই একদিন বৎসলার শরীরে একে একে ফুটে উঠতে থাকে কোভিডের উপসর্গ। ওষুধ বলতে ব্যথা কমার কিছু বড়ি ছিল, তা খেয়েই বাড়িতে পড়েছিলেন তিনি, আশা করেছিলেন যে ওতেই কাজ হবে। কিন্তু দিনকতক বাদে দেখলেন যে ব্যথা-বেদনা কমার নামই নিচ্ছে না, তখন ছেলের সঙ্গে নৌকায় চড়ে বসেন তিনি। “মাথায় একেবারে আসমান না ভেঙে পড়লে চট করে আমরা এ দ্বীপ ছেড়ে বেরোই না,” বলে উঠলেন দৈবত।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: এলিফ্যান্টা গুহার সন্নিকটে খাবারের দোকানে ভাবিকা ও গৌরী মহাত্রে। ২০২১ সালের গোড়ায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে দুই বোন মিলে দোকানটি সামলাচ্ছেন। ডানদিকে: প্রয়াত মধুকর (বাঁয়ে) ও জয়শ্রীর দুটি আলোকচিত্র

ঘর থেকে বেরিয়ে রাইগড় পানভেল তালুকের গাভহান গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে উঠতে পুরো এক ঘণ্টা লেগেছিল। ওখানে তাঁর রক্তপরীক্ষা করে দেখা যায় যে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেশ কম। বাড়ি ফিরে আসেন বৎসলা। পরদিন তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। শুরু হয় বমি, তখন আবারও তাড়াহুড়ো করে গাভহানের সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এবার পরীক্ষা করে দেখা যায় যে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা হুহু করে কমছে, ধরা পড়ে কোভিড-১৯। চিকিৎসার জন্য পানভেল শহরের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার ১০ দিন পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বৎসলা। দৈবতের কথায়: “ডাক্তারবাবু বলেছিলেন যে মায়ের ফুসফুস দুটো নাকি অকেজো হয়ে গিয়েছে।”

গ্রামে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং নাগালের মধ্যে দরকারি ওষুধপত্র থাকলে হয়ত বৎসলা এবং জয়শ্রীকে বেঘোরে মরতে হত না।

জয়শ্রী মারা যাওয়ার একমাস পর মারা যান মধুকর, অনাথ হয়ে যায় ভাবিকা ও গৌরী। দুই বোনের দৃঢ় বিশ্বাস সহধর্মিনীকে হারানোর দুঃখ নাকি সইতে পারেননি তিনি। মধুমেহ রোগে ভুগতেন মধুকর, নিয়মিত ওষুধ চলত, একদিন সকালে উঠে ভাবিকা দেখেন যে তাঁর বাবা রক্তবমি করছেন বাড়ির বাইরে। অপেক্ষায় কেটে যায় সারাটা সকাল, তারপর সাগর পেরিয়ে নেরুলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মধুকরকে। নৌকায় করে মোরা পৌঁছে, সেখান থেকে স্থলপথে নেরুল যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। ২০ দিন পর ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে মারা যান তিনি।

মহাত্রেরা আগ্রি কোলি জাতির মানুষ, মহারাষ্ট্রে তাঁরা অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের (ওবিসি) তালিকাভুক্ত। ভাবিকা ও গৌরী – দুই বোনে মিলে পেটের দায়ে এখন মা-বাবার ফেলে যাওয়া দোকানটি চালাচ্ছেন।

*****

এলিফ্যান্টা গুহা দেখতে আসা পর্যটকের দল ঘারাপুরির জেটিতে পা রাখার আগে অসংখ্য গুমটি পেরিয়ে এগোন, সেগুলিতে তাঁদের জন্য সজ্জিত রয়েছে খাবারদাবার তথা স্মারক সামগ্রী। এরই মধ্যে একটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে পাত্রে সাজানো কাঁচা আম, শশা এবং চকলেট। এটির দ্বায়িত্বে রয়েছেন শৈলেশ মহাত্রে (৪০)। তাঁর পরিবারে আছেন চার সদস্য, কারও শরীর খারাপ হলেই দোকানপাট সব মাথায় তুলে একছুটে বেরিয়ে পড়েন, হাতছাড়া হয়ে যায় সেদিনের উপার্জন। এই কদিন আগেই এমনটা হয়েছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর, ভেজা পাথরে পা হড়কে পড়ে যান তাঁর মা হীরাবাই মহাত্রে, পায়ের হাড় ভাঙে। ব্যথা কমার কোনও ওষুধ ছিল না বাড়িতে, ফলে সারারাত যন্ত্রণায় কষ্ট পান তিনি। তার পরদিন মাকে কোলে তুলে উরানগামী নৌকায় চড়ে বসেন শৈলেশ।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: শৈলেশ মহাত্রে এই ফলের দোকানটিতেই কাজ করেন, এলিফ্যান্টা গুহায় ঘুরতে আসা পর্যটকের দল এসে নামেন পাশের জেটিতে। ডানদিকে: শৈলেশের মা হীরাবাই মহাত্রে, পিচ্ছিল পাথরে পা হড়কে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছিলেন। সাগর পেরিয়ে ওষুধপত্র এবং চিকিৎসার জন্য গোটা একটা দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে

“[উরানের] হাসপাতালের লোকজন বলল যে আমার পায়ে অপারেশন করতে ৭০,০০০ টাকা লাগবে,” জানালেন হীরাবাই, “পয়সাকড়ি অত ছিল না, অগত্যা পানভেলে যেতে হল [এক ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে], কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি ওরাও ঠিক অতটাই টাকা চাইছে। শেষমেশ জে.জে. হাসপাতালে [মুম্বইয়ে] গিয়ে হাজির হলাম, ওরা বিনেপয়সায় চিকিৎসা করল। এই প্লাস্টারটা তো ওখান থেকেই করিয়েছি।” চিকিৎসাটা বিনামূল্যে হয়েছিল ঠিকই, তবে যাবতীয় ওষুধপত্র সব তাঁর পরিবারকেই কিনে দিতে হয়েছিল, উপরন্তু যোগ হয় যাতায়াতের খরচা। সব মিলিয়ে মোট ১০,০০০ টাকা খসে যায় তাঁদের।

ব্যাংক বা এটিএম - কিচ্ছুটি নেই এই দ্বীপে। তাই বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়েছিলেন শৈলেশ। একে তো বাড়িতে একা তিনিই রোজগেরে, তার উপর গুমটিতে কাজ করে বিশেষ পয়সাকড়ি আসে না হাতে। উপরন্তু কোভিড-১৯ অতিমারির ধাক্কায় পরিবারটি আগে থেকেই ৩০,০০০ টাকার দেনায় ডুবে আছে।

প্লাস্টার করা পা নিয়ে হাঁটতে পারছেন না বলে মন খারাপ করে বসেছিলেন হীরাবাই। তাঁর কথায়: “প্লাস্টারের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম, না জানি কেমন করে এটা দেখাতে মুম্বই যাব, না গেলে তো এটা কাটাও যাবে না। জঙ্গল সমঝ কর ছোড় দিয়া হ্যায় [বনজঙ্গল ভেবে আমাদের এখানে ছেড়ে দিয়েছে, কারও কোনও হেলদোল নেই]।”

সরপঞ্চ (গ্রাম-প্রধান) বালিরাম ঠাকুর-সহ গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষই এই কথা মনে করেন। ২০১৭ থেকে তিনি উরান জেলা পরিষদের দরবারে আবেদন জানিয়ে আসছেন, যাতে একখানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানানো হয় এখানে। “শেষমেশ ২০২০ সালে শ্বেতবন্দরে একটা বানিয়ে দিল বটে, তবে এখানে থাকতে রাজি হবে এমন একজন ডাক্তার আজ অবধি জোগাড় করতে পারিনি আমরা,” জানালেন তিনি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মরত ডাক্তারের নিরিখে মহারাষ্ট্রের নাম সবার নিচে – এ রাজ্যে মোট যতজন চিকিৎসক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল ৮.৬ শতাংশ কাজ করেন গ্রামাঞ্চলে। ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মীদের ঘিরে যুগ্মভাবে ২০১৮ সালে একটি নথি প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এবং পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া, উক্ত পরিসংখ্যানটি সেখান থেকেই পাওয়া গেছে।

গ্রামে অন্তত একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে মোতায়েন করার জন্য পিড়াপিড়ি করে চলেছেন বালিরাম, কিন্তু “এখানে তো কেউ থাকতেই চায় না। আরে বাবা, শুধু আমাদের নিজেদের জন্য বলছি না, চিকিৎসা পরিষেবা তো পর্যটকদেরও দরকার, তাই না? একজন পর্যটক তো ট্রেক করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, সাত তাড়াতাড়ি তাকে মুম্বই নিয়ে যেতে হল।”

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: ঘারাপুরির সরপঞ্চ বালিরাম ঠাকুর, গ্রামে যাতে একখানা স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র বানানো হয় সেজন্য উরান জেলা পরিষদের কাছে আবেদন করেছেন তিনি। ‘আজ অবধি  এমন একটা ডাক্তারও জুটল না যে কিনা এখানে এসে থাকতে চায়।’ ডানদিকে: যেখানেই যাবেন, গ্রামবাসীদের একমাত্র ভরসা নৌকা

ঘারাপুরির স্বাস্থ্য আপাতত ডাঃ রাজারাম ভোঁসলের হাতে, ২০১৫ থেকে তিনি কোপরোলি গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে (পিএইচসি) মোতায়েন আছেন। তাঁর ভরসায় দিন গুজরান করে ৫৫টি গ্রাম, তবে ঘারাপুরি থেকে তাঁর পিএইচসিতে যেতে দেড় ঘণ্টার রাস্তা পেরোতে হয় (স্থলপথ ও জলপথ দুটোই)। “আমাদের নার্সরা তো মাসে বারদুয়েক ওখানে যান, এছাড়া বিপদকালীন কোনও পরিস্থিতি হলে আমাকে জানানো হয়,” জানালেন তিনি, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বললেন যে তাঁর মেয়াদ চলাকালীন আদৌ কোনও জরুরি অবস্থা হয়েছিল বলে তাঁর জানা নেই।

কোপরোলি পিএইচসির নার্সরা রোগী দেখতে হয় ঘারাপুরির অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র কিংবা গ্রাম পঞ্চায়েতের দফতরে এসে ওঠেন। ২০১৬ থেকে এই গ্রামটির দেখভালের দ্বায়িত্বে রয়েছেন সারিকা থালে। একাধারে নার্স ও আরোগ্য সেবিকা সারিকা মাসে দুইবার করে এখানে এসে যুবতী মায়েদের সঙ্গে দেখা করেন এবং পোলিওর খোরাক দেন বাচ্চাদের।

তাঁর কথায়: “বর্ষাকালে এখানে আসতে জান বেরিয়ে যায়, জোয়ারের সময় তো কোনও নৌকাই চলে না।” অথচ ঘারাপুরিতে যে বাসা বাঁধবেন সেটাও অসম্ভব তাঁর পক্ষে, কারণ: “আমার তো নিজেরও [ছোট] বাচ্চাকাচ্চা আছে। ওরা কোথায় পড়াশোনা করবে? আর এখান থেকে অন্যান্য গ্রামে যাব কেমন করে কাজের জন্য?”

জল এবং বিদ্যুতের মতো অত্যাবশ্যক জিনিসগুলোও ঘারাপুরিতে সবেমাত্র এসে পৌঁছেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তো বিদ্যুৎ বলতে কেবল মহারাষ্ট্র পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশনের (এমটিডিসি) দেওয়া কয়েকটি জেনারেটর ছিল, সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা চলার পর বন্ধ হয়ে যেত সেগুলি। জলের লাইন এসেছে ২০১৯ সালে। মোটে একখানা ইস্কুল ছিল এই দ্বীপে, আজ সেটির ফটকেও তালা ঝুলছে।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: দ্বীপ থেকে মুম্বই যাওয়ার পথেই টালমাটাল নৌকায় সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, একথা আজও ভোলেননি সন্ধ্যা ভৈর। ডানদিকে: ঘারাপুরির জেলা পরিষদ ইস্কুল, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এটি বন্ধ হয়ে যায়

স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর এমনই তথৈবচ অবস্থা যে সন্তান প্রসব করার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান পোয়াতি মহিলারা, সাধ করে আর কে-ই ঝুঁকি নেবে? অনেকেই তাঁদের গর্ভাবস্থার শেষের কয়েক মাস দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান, কিংবা একটা কোনও কামরা ভাড়া করে থাকেন – অর্থাৎ, অতিরিক্ত খরচার হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই। এমনকি যাঁরা দ্বীপেই রয়ে যান, তাঁদের জীবনটাও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সারাটাক্ষণ ওষুধপত্র, তাজা শাকসবজি, ডাল ইত্যাদির খোঁজ করতে করতে – গর্ভবতী হলে, এসব ছাড়া যে চলবেই না।

২০২০ সালের লকডাউন চলাকালীন বন্ধ হয়ে যায় ফেরিঘাট, ফলে হাসপাতালে যাওয়া শিকেয় ওঠে হবু মায়েদের। মার্চে যখন লকডাউন ঘোষিত হয়, ক্রান্তি ঘারাত (২৬) তখন মাস তিনেকের গর্ভবতী। গাড়ি-ঘোড়া থেকে নৌকা, থমকে যায় সবকিছু, একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় নিয়মিত ডাক্তার দেখানোর পালা। গর্ভাবস্থা সংক্রান্ত সমস্যায় নাজেহাল হয়ে ওঠেন বেচারি ক্রান্তি। কণ্ঠভরা বিরক্তি নিয়ে তিনি বলে উঠলেন: “বাধ্য হলাম ডাক্তারকে ফোন করে নিজের সমস্যার কথা বলতে।”

সন্ধ্যা ভৈরের মনে আছে, মুম্বইয়ে একটি হাসপাতালে যাওয়ার পথে নৌকাতেই কেমন করে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল। সে আজ ৩০ বছর আগের কথা, বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ে নাজেহাল হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় দাইমা (জন্মধাত্রী)। “সবকিছু ঈশ্বরের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম,” উত্তাল ডিঙিতে প্রসব করার কথা মনে করে হেসে উঠলেন তিনি। বছর দশেক আগে পর্যন্ত দুইজন দাইমা ছিলেন ঘারাপুরিতে, তবে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও রাজ্য সরকার থেকে প্রদত্ত আর্থিক অনুদানের ফলে দিনকে দিন তাঁদের চাহিদা কমে এসেছে।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: শিশু হিয়াংশকে কোলে নিয়ে ক্রান্তি ঘারাত, স্বামীর সঙ্গে এই ছোট্ট মুদিখানাটি চালান তিনি। ডানদিকে: মূল ভূখণ্ডে যেতে হলে এই জেটি থেকেই ফেরি ধরেন দ্বীপবাসীরা

গ্রামের ত্রিসীমানায় কোনও ওষুধের দোকান না থাকায় আগে থাকতে ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য হন গ্রামবাসীরা। “আমি তো একমাসের জন্য ওষুধপত্র মজুত করে রাখি বাড়িতে - এমনকি ডাক্তার দিনকয়েকের জন্য ওষুধ লিখে দিলেও। আবার কবে দাওয়াই কিনতে হাসপাতালে যেতে পারব তার তো কোনও ঠিকঠিকানা নেই," বললেন সন্ধ্যা। ক্রান্তি এবং তাঁর স্বামী সূরয দুজনেই আগ্রি কোলি জাতির মানুষ, ঘারাপুরিতে একটি মুদিখানার দোকান চালান তাঁরা। কোভিড-১৯ লকডাউনের আগে মাস গেলে ১২,০০০ টাকা রোজগার হত তাঁদের।

গর্ভাবস্থার ষষ্ঠ মাসে উরান তালুকের নবীন শেভা গ্রামে নিজের ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান ক্রান্তি। তাঁর কথায়: “বিমারি [কোভিড-১৯] নিয়ে দুশ্চিন্তা হত, তাই আগেভাগে যাইনি ওখানে। মনে হত যেন ঘারাপুরিতেই সুরক্ষিত আছি, তাছাড়া ভাইয়ের সংসারে বোঝা হতে চাইনি আমি।”

শেষমেশ পাড়ি যখন দিলেন, কড়কড়ে ৩০০টা টাকা গচ্চা গেল নৌকায়, যেটা কিনা অন্য সময়ের চেয়ে দশগুণ বেশি [কোভিড-১৯ অতিমারির আগে ৩০ টাকা ভাড়া লাগত]। সেই সময় কোভিড-১৯-এর রোগীতে উপচে পড়ছিল সরকারি হাসপাতালগুলো, ভয়ে তাই বেসরকারি হাসপাতালেই যাবেন বলে মনস্থির করে তাঁর পরিবার। ওষুধপত্র এবং সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে মোট খরচ হয় ৮০,০০০ টাকা। ক্রান্তির কথায়: “ডাক্তারের দক্ষিণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপাতি, এসবেই বেরিয়ে গেল টাকাটা।” আজীবন খেটেখুটে যতটুকু টাকা সঞ্চয় করেছিলেন এই দম্পতি, ততদিনে পুরোটাই নিঃশেষ হয়ে যায়।

খাতায় কলমে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনার (পিএমএমভিওয়াই) আওতায় পড়ছেন ক্রান্তি। গর্ভবতী এবং স্তন্যদায়ী মহিলাদের শরীরস্বাস্থ্যের যাতে উন্নতি হয়, তারই জন্য কেন্দ্রীয় সরকার উক্ত ম্যাটারনিটি বেনেফিট যোজনাটি শুরু করেছে। ৫,০০০ টাকা হাতে পাওয়ার কথা, ২০২০ সালে আবেদনও করেছেন ক্রান্তি, অথচ আজ অবধি একটা টাকাও পাননি। সুতরাং ঘারাপুরির মানুষদের প্রতি সরকারের ঔদাসীন্য যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে আটকে নেই, সেটা সহজেই প্রমাণ হয়ে যায়।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Aakanksha

Aakanksha is a reporter and photographer with the People’s Archive of Rural India. A Content Editor with the Education Team, she trains students in rural areas to document things around them.

यांचे इतर लिखाण Aakanksha
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra