মাটি হোক বা জল, সোহন সিং টিটার নাছোড়বান্দা মনোভাবের ফলে কত যে প্রাণ রক্ষা পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ভুলে চক গাঁয়ের অলিগলি হোক বা তার আশেপাশে, ধুলো-ধোঁয়ার দেওয়াল ভেদ করে হামেশাই তিনি হাজির হন ভগবানের মতো, বাহন বলতে একটি মোটরসাইকেল, পেশা বলতে পুষ্টিকর শাকসবজি বেচা। তবে সোহনের যে এত নামডাক, সেটা অবশ্য তাঁর ডুবসাঁতারের দক্ষতার জন্যই। পঞ্জাবের গুরদাসপুর জেলায় তাঁর গ্রামের কাছেই যে সেচখালগুলি রয়েছে, সেখানে কেউ পড়ে গেলে ঝাঁপ দিয়ে তাদের উদ্ধার করে পাড়ে টেনে আনা তাঁর হররোজের কাম।

গত দুই দশক ধরে এই কাজ করে চলেছেন ৪২ বছর বয়সি সোহন। তাঁর কথায়: “নাহ্, ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করা আমার পেশা নয়। আমি তো এমনিই করি। আপনারা ভাবেন, ‘জলই জীবন’। কিন্তু জল যে মরণও হতে পারে, সেটা নয় নয় করেও হাজারবার দেখেছি।” বিগত দুই দশক ধরে কত মানুষের মরদেহ যে স্বহস্তে তিনি উদ্ধার করেছেন খাল থেকে, সেটা জানা গেল।

সে গুরদাসপুর হোক বা তার পড়শি জেলা পাঠানকোট — খালের জলে কেউ পড়ে গেলে বা জল থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করতে হলে যাঁদের ডাক পড়ে, তাঁদের মধ্যে সোহন অন্যতম। উক্ত ব্যক্তিটি দুর্ঘটনাবশত জলে পড়েছেন, নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, সেটার তোয়াক্কা না করে “কেউ পানিতে পড়েছে খবর পেলেই আমি ঝাঁপ মারি। চেষ্টা একটাই, মানুষটাকে যেন জ্যান্ত উদ্ধার করা যায়,” জানালেন সোহন।” কিন্তু সে লোকটি মারা গিয়ে থাকলে, “আমি চাই, আত্মীয়স্বজন যেন তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্তত শেষবারের মতো দেখতে পায়,” ধীরস্থির কণ্ঠে বলে উঠলেন সোহন, অসময়ে ঝরে যাওয়া হাজারটি প্রাণের ভারে বিষাদময় হয়ে উঠল বাক্যটি।

গড় হিসেবে, মাস গেলে খালের জল থেকে নিদেনপক্ষে ২-৩টি শবদেহ তো উদ্ধার করেনই। এ হেন অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা কমাতে সোহন আশ্রয় নেন জীবনদর্শনের: “জিন্দেগিটা ঠিক ঘুর্ণির মতো। যে মুহূর্তে শুরু, সে মুহূর্তেই খতম হয়ে যায় চক্রটা।”

PHOTO • Amir Malik

মোটরসাইকেলের পিছনে ঠ্যালাগাড়ি জুড়ে গুরদাসপুর জেলার ভুলে চক তথা আশেপাশের গাঁয়ে শাকসবজি ফেরি করেন সোহন সিং টিটা

ভুলে চকের পাশ দিয়ে শাখা-প্রশাখা সম যে খালগুলি বইছে, সেগুলি আপার বারি দোয়াব ক্যানালের (ইউবিডিসি) ২৪৭টি উপশাখার অন্তর্গত — যার দ্বারা রবি নদের পানি পৌঁছে যায় গুরদাসপুর ও পাঠানকোট সহ পঞ্জাবের একাধিক জেলায়। এটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম, রবি ও বিপাশার মধ্যবর্তী বারি দোয়াব (‘দোয়াব’ শব্দটির অর্থ দুটি নদীর মধ্যবর্তী স্থলভাগ) অঞ্চলে জল সরবরাহ করার জন্যই তৈরি হয়েছিল এই জলপ্রণালীগুলি।

১৭ শতাব্দীতে আজকের এই খালটির গোড়াপত্তন হয়েছিল মুঘল শাহেনশাহ শাহ জাহানের আমলে। পরে মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সময় সেটি আরও প্রলম্বিত করা হয়, শেষে ব্রিটিশ আমলে ১৯ শতকে এটি রূপান্তরিত হয় সেচখালে। আজ দোয়াবে স্থিত জেলাগুলির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ইউবিডিসি, এর জলে পুষ্ট ৫.৭৩ লাখ হেক্টর জমি।

ভুলে চকের লোক অবশ্য বড়ি নাহর্ (বড়ো খাল) নামেই চেনে তাকে। এ প্রণালীর ধারেই বড় হয়েছেন সোহন, তাই বেশিরভাগ সময় যে খালের আশপাশেই পড়ে থাকতেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তিনি বলছেন, “ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে যেতাম। ছোটোবেলায় থোড়াই না ভেবেছি যে এই খালের পানি চাইলে কেমন প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে!”

২০০২ সালে প্রথমবার কারও মরদেহের খোঁজে খালের জলে নামেন সোহন। কেউ একটা ডুবে গিয়েছিল, তার দেহ খুঁজে বার করতে নির্দেশ দেন গাঁয়ের সরপঞ্চ বা গ্রামপ্রধান। “দেহটা খুঁজে পেতে পাড়ের কাছে নিয়ে এলাম। নিতান্তই বাচ্চা একটি ছেলে ছিল। নিথর সেই দেহটা হাতে তুলে নিতেই পানির সঙ্গে আমার সম্পর্ক চিরটাকালের জন্য পাল্টে গেল। জলের সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ডটাও কেমন যেন ভারি হয়ে গেছিল। সেদিন একখানা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম, সে নদী হোক বা খাল, সমুদ্র কিংবা মহাসাগর — জলমাত্রই বলি চায়। তরতাজা জীবন গিলে খেতে চায়। তাই না, বলুন?”

ভুলে চক থেকে ৫০ কিলোমিটার দূর, এমন অনেক জায়গা থেকে ডাক আসে সোহনের জন্য — যেমন বটালা, মুকেরিয়াঁ, পাঠানকোট আর তিবড়ি। এত্তেলা এলেই তাঁর বাহন, অর্থাৎ পিছনে সবজির ঠ্যালাগাড়ি যুক্ত মোটরসাইকেলে চেপে রওনা দেন। তবে তার চাইতেও দূর-দূরান্ত থেকে খবর এলে কোনও না কোনও দুচাকার গাড়ির বন্দোবস্ত করতে হয় তাঁকে।

PHOTO • Amir Malik
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: সবজি বেচাটাই সোহনের অন্নসংস্থান। ডানদিকে: ভুলে চকের থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে তিবড়ির আপার বারি দোয়াব ক্যানাল

সে জীবন্ত হোক বা মৃত, জল থেকে উদ্ধার করা মানুষের বাড়ির লোক মাঝেসাঝে ৫-৭ হাজার টাকা তুলে দিতে চায় সোহনের হাতে, তবে ও টাকা ছুঁতেও ইচ্ছে করে না তাঁর। দিন গেলে সবজি বেচে যে দু-চারশো টাকা রোজগার হয়, ওটুকুই সোহনের সম্বল। নিজের বলতে একছটাক জমিও নেই। আট বছর হয়ে গেল, বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে ৬২ বছরের মা আর ১৩ বছর বয়সি কন্যার দায়-দায়িত্ব সব একাহাতেই সামলাচ্ছেন তিনি।

একেক সময় বেশ অপ্রত্যাশিত ভাবেই বিপদে পড়তে হয় তাঁকে। সোহনের মনে আছে, তিন বছর আগে এক মহিলাকে তিবড়ি (ভুলে চক থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে) খালে ঝাঁপাতে দেখেই ডুবসাঁতার দিয়ে খালে নেমে পড়েছিলেন। “বছর চল্লিশেক বয়স। কিছুতেই আমাকে বাঁচাতে দেবে না। উল্টো আমাকেই জাপটে ধরে পানির নিচে টানতে লাগল।” ১৫-২০ মিনিট ধরে চলেছিল সে মরণ-বাঁচন খেলা, কিন্তু হাল ছাড়েননি সোহন, চুলির মুঠি ধরে শক্ত হাতে টেনে তুলেছিলেন ওই মহিলাকে। “ততক্ষণে অবশ্য অজ্ঞান হয়ে গেছিল।”

জলে তলায় ডুবকি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারাটাই তাঁর দক্ষতার চাবিকাঠি। “বছর কুড়ি বয়স ছিল যখন, জলের নিচে চার মিনিটেরও বেশি দম ছাড়তাম না। তবে এখন সেটা কমতে কমতে তিন মিনিটে এসে ঠেকেছে।” অক্সিজেন সিলিন্ডারের কোনও বালাই নেই। “ওসব কোত্থেকে পাব? বিশেষ করে এমন বিপদ-আপদের সময়,” সওয়াল সোহনের।

জেলার ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর দ্বায়িত্বে থাকা সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর রজিন্দর কুমার জানাচ্ছেন: ২০২০ সালে গুরদাসপুরের আপার বারি দোয়াব ক্যানাল থেকে চারজন মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করতে ডুবসাঁতারুদের সাহায্য নিয়েছিল পুলিশ। ২০২১ সালে সেই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচে। প্রতিবারই ফৌজদারি কার্যবিধির (কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসেডিয়র, সিআরপিসি) ১৭৪ নং ধারার আওতায় মামলা রুজু করা হয়েছিল। এর ফলে মৃত্যুটির পিছনে আত্মহত্যা, খুন, দুর্ঘটনা কিংবা কোনও সন্দেহজনক কার্যকলাপ লুকিয়ে আছে কিনা — সে বিষয়ে তদন্ত করা সম্ভব হয় পুলিশের পক্ষে।

সাব-ইন্সপেক্টরের কথায়, “লোকে আত্মহত্যা করতে নদী বা খালের জলে ঝাঁপায়। অনেক সময়, সাঁতার না-জানা সত্ত্বেও লোকে চান করতে গিয়ে ডুবে মরে। কেউ কেউ আবার পা হড়কে তলিয়েও যায়। সাম্প্রতিক কালের মধ্যে জলে ডুবিয়ে খুন করা হয়েছে এমন কোনও ঘটনার কথা আমাদের রেকর্ডে নেই।”

PHOTO • Amir Malik

হিন্দিভাষী একটি খবরের কাগজে সোহন সিং টিটার উপর ছাপা প্রতিবেদন। তাঁর কর্মকাণ্ডটি খ্যাতি পেয়েছে ঠিকই, তবে সোহনের মতে এ অবধি ডুবসাঁতারুদের জন্য সরকার কুটোটিও নাড়েনি

২০২০ সালে গুরদাসপুরের আপার বারি দোয়াব ক্যানাল থেকে চারজন মানুষের শবদেহ উদ্ধার করতে ডুবসাঁতারুদের সাহায্য নিয়েছিল পুলিশ

খালের জলে ঘটা অপঘাতজনিত মৃত্যুরা ভিড় করে গ্রীষ্মকালে, বুঝিয়ে বললেন সোহন। “কাঠফাটা রোদের থেকে বাঁচতে গাঁয়ের লোক জলের পানে ধায়, আর দুর্ঘটনার জেরে ডুবে মরে,” বলেছিলেন তিনি, “দেহগুলো ভেসে ওঠে ঠিকই, তবে খালের পানিতে তাদের ঠাহর করা মুশকিল। তাই জলের ধার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে ফিরি বিভিন্ন জায়গায়। বড্ড ঝুঁকির কাজ, নিজেই নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিই।”

হাজারো ঝুঁকি সত্ত্বেও একটিবারের জন্যও এ কাজে দাঁড়ি টানেননি সোহন। “লাশ ঢুঁড়তে ডুবকি লাগিয়েছি অথচ [মৃত] দেহ খুঁজে পাইনি, এমনটা কক্ষনো হয়নি। জলের গেরাস থেকে যারা লোককে উদ্ধার করে আনে, আশা করি সরকার থেকে তাদের চাকরি দেবে। ওমনটা হলে, আমার মতো মানুষেরা খানিক সাহায্য পেত।”

সোহন বলে চলেছিলেন, “ডুবসাঁতার দিতে পারে, এমন লোকের সংখ্যা এ গাঁয়ে এক ডজনেরও বেশি।” তিনি লবানা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ, পঞ্জাবে এটি অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের তালিকাভুক্ত। “সরকার তো এটাকে কাজ বলেই মানতে চায় না, মাইনে দেওয়া তো দূরের কথা,” ক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলেন তিনি।

কখনও কখনও শবদেহ খুঁজে পেতে মুশকিল হয়, তখন চার-পাঁচজন ডুবসাঁতারু সঙ্গ নেন সোহনের। তাঁদেরই একজন ২৩ বছর বয়সি গগনদীপ সিং। তিনিও লবানা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। সোহনের সঙ্গে প্রথমবার যখন জল থেকে শবদেহ উদ্ধার করতে নামেন, সালটা ছিল ২০১৯। “প্রথম যখন লাশ খুঁজতে জলে নামি, ভয় পেয়ে গেছিলাম। সে ভয় কাটাতে ওয়াহেগুরু [প্রার্থনা] মন্ত্র জপেছিলাম।”

PHOTO • Amir Malik
PHOTO • Amir Malik

বাঁদিকে: গত ২০ বছর ধরে গুরদাসপুর ও পাঠানকোটের খালে-খালে ডুবসাঁতার দিচ্ছেন সোহন। ডানদিকে: ২০১৯ থেকে সোহনের কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গগনদীপ সিং

বুকের ভিতর আজও ১০ বছরের একটি বাচ্চার মরদেহ উদ্ধার করার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন গগনদীপ। তাঁর কথায়, “ঘোট পোখরে থাকত ছেলেটা, গাঁ-টা বেশ কাছেই। বসেবসে পাব-জি খেলছিল পড়াশোনা শিকেয় তুলে, ওর মা তাই চড়চাপড় মেরে খানিক বকেছিল। গাজিকোটের কাছেই খালের পানিতে ঝাঁপ দিল।”

গগনদীপের সঙ্গে আরও দুজন ডুবসাঁতারু ছিল। এঁদের একজন (ভুলে চক থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে) ধারিওয়াল গ্রাম থেকে একখান অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিলেন। “সিলিন্ডারটা আমার হাতে তুলে দিতে ওটা নিয়েই জলে নামলাম। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম সেখানে। শেষমেশ, সারাটা দিন চিরুনি তল্লাশি চালানোর পর সাঁকোর নিচে লাশটা পেলাম, ফুলেফেঁপে উঠেছিল... বড্ড মিষ্টি ছিল ছেলেটা। মা-বাবা আর দু-দুটো বোনকে ফেলে রেখে চলে গেল,” জানালেন গগনদীপ। অনলাইন সেই খেলাটির নেশা তাঁরও ছিল বটে, তবে এ ঘটনাটির পর থেকে আর কোনদিন ছুঁয়েও দেখেননি। “ফোনে পাব-জি আছে, কিন্তু ওটা আর খেলি না।”

এ অবধি খালের জল থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করেছেন গগনদীপ। “এসবের জন্য একটা পয়সাও নিই না।” সেনাদলে যোগ দেবেন বলে খোয়াব দেখেন, থাকেন মা-বাবার সঙ্গে একটি দুই-কামরার বাড়িতে, পেশা বলতে স্থানীয় একটি গ্যাস সরবরাহ সংস্থার হয়ে বাড়ি-বাড়ি সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া, মাস-মাইনে ৬,০০০ টাকা। এক একর জমিতে গম ও ঘাষ ফলানোর পাশাপাশি খানকতক ছাগল পোষে তাঁর পরিবার। এছাড়াও একটি অটো-রিকশা আছে তাঁর ৬০ বছর বয়সি বাবার, মাঝেসাঝে যেটা গগনদীপ নিজেও চালান।

খালে ভাসতে থাকা টন-টন আবর্জনা সরিয়ে লাশ খুঁজতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলে পড়ে থাকতে বাধ্য হন ডুবসাঁতারুরা।

২০২০ সাল, ধারিওয়াল গ্রামে খাল পেরোতে গিয়ে তলিয়ে যায় একটি ১৯ বছরের ছেলে। সত্বর গগনদীপকে তলব করে পুলিশ। “শরীরটা ডুবে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অকুস্থলে পৌঁছই,” মনে করে বললেন গগনদীপ, “সকাল ১০টায় থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে শেষে সন্ধ্যা ৪টে নাগাদ লাশটা পেলাম।” খালের এ পাড় থেকে ও পাড় অবধি একগাছি দড়ি বেঁধে তিনজন মিলে একটি মানববন্ধন তৈরি করেছিলেন গগনদীপ। একত্রে তিনজন মিলে ডুবকি লাগিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছিলেন। “আজ অবধি সবচাইতে কঠিন ছিল ওই ছেলেটার মরদেহ খুঁজে পাওয়া, কারণ জলে বড্ড বেশি জঞ্জাল ছিল। তার উপর একটা বিশাল পাথরে আটকে ছিল দেহটা, নড়তে চড়তে পারছিল না,” জানালেন গগনদীপ।

PHOTO • Amir Malik

তিবড়ি খালের উপর সাঁকোয় চড়ে দাঁড়িয়ে আছেন গগনদীপ। ‘মাঝেসাঝে নিজেই নিজেকে সওয়াল করি, এসব কেন যে করছি...কিন্তু হাল ছাড়ার কথা একটিবারের জন্যও মাথায় আসে না’

কাজের মধ্যে দিয়েই পদার্থবিদ্যার মারপ্যাঁচ সব আয়ত্ত করে ফেলেছেন এই মানুষটি। ২০২১ সালে তিবড়ি ক্যানালে একটি ১৬ বছর বয়সি ছেলের শবদেহ খুঁজতে গিয়ে কতখানি বেগ পেতে হয়েছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলে উঠলেন, “৭২ ঘণ্টা কাটলে তবেই পানির উপর লাশ ভেসে ওঠে। উপরন্তু মৃতদেহগুলো জলে স্থির থাকে না। ধরে নিন ওমুক জায়গায় কেউ ঝাঁপ মারল, তার দেহটা কিন্তু হারগিস ওখানে খুঁজে পাবেন না। ছেলেটা যেখানে ঝাঁপিয়েছিল ওখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিস্যু পেলাম না। তারপর নাকে একটা নল গুঁজে তাতে একখান পাইপ আটকে দিলাম, যাতে জলের তলায় থাকার সময় দম না হারাই।”

দেহখানি পেতে পেতে সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছিল সেদিন। “খালের এক্কেবারে অপর প্রান্তে ছিল লাশটা, প্রায় ২৫ হাত গভীর পানিতে। সোহন আর আমি দুজন মিলেই তল্লাশি চালাচ্ছিলাম,” একথা আজও ভোলেননি গগনদীপ, “সোহন বলেছিলেন, পরের দিন এসে দেহটা টেনে বার করব। কিন্তু তার পরদিন গিয়ে দেখি শবদেহটা আর নেই ওখানে। ভাসতে ভাসতে উল্টোদিকের পাড়ের কাছে খালের এক্কেবারে তলায় গিয়ে ঠেকেছে।” ডুবসাঁতারুর দল তিন ঘণ্টার প্রচেষ্টায় উদ্ধার করে মরদেহটি। গগনদীপের কথায়, “কমসে কম ২০০ বার ডুবকি লাগিয়েছিলাম আমরা। মাঝেসাঝে নিজেই নিজেকে সওয়াল করি, এসব কেন যে করছি...কিন্তু হাল ছাড়ার কথা একটিবারের জন্যও মাথায় আসে না। কপালে লেখা আছে, মানুষের সেওয়া [নিঃস্বার্থ সেবা] করে যেতে হবে, সেটা খণ্ডানো আমার নাগালের বাইরে।”

তবে জলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন যে কতখানি জটিল, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সোহনের জন্য। ঠিক এই কারণেই রোজ সন্ধেবেলায় কিংবা যখনই একটু ফুরসৎ পান, বারেবারে ফিরে যান তিবড়ি সাঁকোর টানে। “সাঁতার কাটতে আর আগের মতো ভাল্লাগে না। বুকের ভিতর থেকে প্রতিটা [খারাপ] ঘটনার স্মৃতি আমি মুছে দিই। যখনই কারও মৃতদেহ উদ্ধার করে আনি, স্বচক্ষে দেখি সেই মানুষটার আত্মীয়রা কেমনভাবে তিলে তিলে মরে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে দেহটা নিয়ে যায়, পিছু নেয় একটাই আফসোস — এভাবে প্রাণ হারানোর কোনও মানেই যে নেই।”

সোহনের মননে এ খাল ও তার সর্বগ্রাসী পানির নাব্যতা মাপে কার সাধ্যি? ২০০৪ সালে মরক্কোয় গিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অতলান্তিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগর ঘেরা উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে থেকেও ফেলে আসা সেই খালের টানে জেরবার হয়ে উঠেছিলেন। চারটে বছর কাটার আগেই দেশে ফিরে আসেন, এটা-সেটা করে পেট চালানো আর পোষাচ্ছিল না। কথা শেষে কাজের দিকে মন দিতে দিতে বলে উঠলেন: “মনে আছে, ওখানে থাকাকালীন তিবড়ির জন্য মন-কেমন করত খুব। আজও দু দণ্ড ফাঁকা পেলেই খালের ধারে চলে আসি, জলের দিকে চেয়ে থাকি শুধু।” মোটরসাইকেলের পিছনে ঠ্যালাগাড়ি লাগানো তাঁর বাহনটিতে চেপে পাড়ি দিলেন রাস্তার বাঁকে পথচলতি খদ্দেরদের দিকে।

এই কাহিনি তুলে ধরতে সাহায্য করেছেন সুমেধা মিত্তল, তাঁর প্রতি লেখকের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আপনি যদি আত্মহত্যা-প্রবণ হন , কিংবা এমন কাউকে চেনেন যিনি মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন , তাহলে জাতীয় হেল্পলাইন কিরণ -এ সত্বর ফোন করুন এই নম্বরে - ১৮০০-৫৯৯-০০১৯ ( ২৪ ঘণ্টা, টোল-ফ্রি) , অথবা আপনার এলাকার অনুরূপ কোনও হেল্পলাইনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তথা পরিষেবা-মূলক তথ্যাদির জন্য দয়া করে এসপিআইএফের মানসিক স্বাস্থ্য নির্দে শিকাটি দেখুন।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Amir Malik

आमिर मलिक मुक्त पत्रकार असून २०२२ या वर्षासाठी ते पारी फेलो होते.

यांचे इतर लिखाण Amir Malik
Editor : S. Senthalir

एस. सेन्थलीर चेन्नईस्थित मुक्त पत्रकार असून पारीची २०२० सालाची फेलो आहे. इंडियन इन्स्टिट्यूट ऑफ ह्यूमन सेटलमेंट्ससोबत ती सल्लागार आहे.

यांचे इतर लिखाण S. Senthalir
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र यांनी जादवपूर विद्यापीठातून तुलनात्मक साहित्य या विषयात एमफिल केले आहे. एक कवी, कलांविषयीचे लेखक व समीक्षक आणि सामाजिक कार्यकर्ते असणारे जोशुआ पारीसाठी अनुवादही करतात.

यांचे इतर लिखाण Joshua Bodhinetra