পুণে জেলার দাপোডি গ্রামের সারুবাই কাদু ৫০০০-এরও বেশি দোহা গেয়ে আমাদের জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলন গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রকল্পটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। দুই খণ্ডে বলা গল্পের এটি দ্বিতীয় কিস্তি, এখানে উনি ১১টি ওভি গেয়েছেন যেখানে ফুটে উঠেছে তাঁর অতীত জুড়ে ছেয়ে থাকা আনন্দ এবং নাছোড়বান্দা কিছু দুঃখ
“বয়সের ব্যাপার নয়। আসলে মনে শান্তি নেই আমার, মগজ জুড়ে দুশ্চিন্তা। তাই কোন গানই মনে থাকে না আর,” এমনটাই জানালেন সারুবাই কাদু। ২০১৭ সালের জুলাই মাস, আমরা দৌন্ড তালুকের দাপোডি গ্রামে এসেছি এমন একজনকে খুঁজতে গ্রাইন্ডমিল সংগস্-এর ডেটাবেস জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলনে যাঁর অবদান সবার চেয়ে বেশি। সারুবাই ৫০২৭টি পদ গেয়েছিলেন যেগুলো গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রজেক্টের আদি দলটি লিখিত আকারে নথিবদ্ধ করেছিল ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে।
তখন উনি পুণে জেলার মুলশি তালুকের ওয়াডাভালি গ্রামে থাকতেন। তারপর মোসে নদীর উপর যখন ওয়াসারগাঁও বাঁধ তৈরি হয় তখন ১৯৯৩-৯৪ সালে ওয়াডাভালি এবং মুলশির অন্যান্য গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই জলের তলায় তলিয়ে যায়। অসংখ্য পরিবারের পাশাপাশি সারুবাইয়ের পরিবারও ভিটেমাটি হারিয়ে পুণে শহর থেকে আনুমানিক ৮০ কিমি দূরত্বে দৌন্ড তালুকের বিভিন্ন গ্রাম ও জনপদে অবস্থিত পুনর্বাসন স্থলে চলে যায়।
দাপোডি গ্রামে
সারুবাইয়ের সঙ্গে যখন দেখা করতে যাই তখন উনি একটি কুঁড়েঘরের বাইরে বসেছিলেন।
তারপর তিনি আমাদের তাঁর ছেলে দিলীপের ইট আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো পাকা বাড়িতে
নিয়ে গেলেন। (আমরা ওই বাড়ির বারান্দায় বসে তাঁর গাওয়া ওভি রেকর্ড করলাম। এইগুলি
একধরনের দোহা যা গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের মহিলারা জাঁতাকলে শস্য ভাংতে ভাঙতে গেয়ে
থাকেন; গল্পটির প্রথম কিস্তি পড়ুন:
সারুবাই: ৫০০০ গান, তবু অবিরত তাঁর কন্ঠ
)।
সারুবাই বলছিলেন, “ওয়াডাভালিতে জীবন ছিল সাচ্ছন্দ্যের। তারপর বাঁধটা বানানো হ'ল আর আমাদের জীবন একেবারে ওলটপালট হয়ে গেল।" যে যে পরিবারের খেতখামার ছিল ওয়াডাভালিতে তাঁদের কথা দেওয়া হয় যে যথাযথ পরিমাণে জমি তাঁরা পাবেন পুনর্বাসন-স্থলে, কিন্তু অনেকেই ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা পেলেন তা প্রাপ্য পরিমাণের চেয়ে অনেকটাই কম। কোনও কোনও পরিবারকে একচিলতে করে জায়গা দেওয়া হয় যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই জোটে। উপরন্তু দাপোডিতে যে জমি তাঁরা পান তা ঊষর। “আমাদের আবার সবকিছু গোড়া থেকে শুরু করতে হয়,” দিলীপ জানালেন, “বহুকষ্টে আমরা জমিটাকে চাষযোগ্য করে তুলি, কিন্তু তাও যা রোজগার হয় তা দিয়ে আমাদের ২৫ শতাংশ চাহিদা মেটে টেনেটুনে। বাকি ৭৫ শতাংশের জন্য কৃষিশ্রমিকের কাজ বা এটাসেটা করতে বাধ্য হই।”
দিলীপ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন আর তাঁর স্ত্রী ওঁদের ছোট্ট মুদিখানাটা চালান। সারুবাই বলেন যে পুনর্বাসনের পর থেকে মোটামুটি একমাস আগে অবধি তিনি ছেলে আর পুত্রবধুর সঙ্গেই থাকছিলেন। কিন্তু তারপর একটা পারিবারিক কলহ হয়, আর তখন থেকেই উনি বাধ্য হয়েছেন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।
দিলীপের বাড়ি
থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে, ইট, কাঠের থাম, মাটির দেওয়াল আর টিনের চালা
দিয়ে তৈরি একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর যা এখন সারুবাইয়ের “বাসা।” একটিই দরজা তার,
কোনও জানলা নেই যদিও। এটি সারুবাইয়ের অধুনা মৃত এক পুত্রের বাসস্থান ছিল, বর্তমানে
এটারও মালিক দিলীপই। সারুবাই এখন এখানেই থাকেন, একা একা। ঢোকার মুখে রাখা আছে একটা
জাঁতাকলের নিচের অংশটি; উপরের আর্ধেকটা কোনওমতে হেলান দিয়ে রাখা আছে কুঁড়ের
ভিতরে একটা তাকে।
২০ বছর আগে জাঁতা পেষাইয়ের গানের সংকলন নিয়ে তৈরি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রকল্পকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সারুবাই ৫০০০-এরও বেশি গান গেয়ে; ওঁর নিজের জীবনটা যদিও দারিদ্রে জর্জরিত। এই ৭০ বছর বয়সেও কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন, অন্যের জমিতে আগাছা উপড়ে দিনে ১৫০ টাকা পান। তাঁর স্বামী মারুতি কাদু মারা গেছেন ২০১৫ সালে। চার পুত্রসন্তানের মধ্যে মোটে দুজন বেঁচে আছেন বর্তমানে।
উনি এ যাবৎ যা যা গান বেঁধেছেন তা সবই হয় নিজের জীবন থেকে নেওয়া, নিজের অতীত অথবা ঘটমান বর্তমানের কথা। এখানে প্রকাশিত ওভিগুলিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা – ছেলের বিয়ের মতো আনন্দের স্মৃতি, তার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের হরেক কলহবিবাদের তিক্ততা। তবে এই দোহাগুলিকে মনে করার কাজটা খুব একটা সহজ বিষয় নয় ওঁর কাছে। “ওভির মূল যে শব্দটা, সেটা মনে করতে পারলেই বাকিটা আপনাআপনি চলে আসবে। আগে আগে হাজার একটা গান মনে গেঁথে রাখা ছিল, ঝর্ণার মতো তারা বেরিয়ে আসতো... ঝরঝর করে।”
কপালে আঙুল বোলাতে বোলাতে উনি শূন্যের দিকে তাকিয়ে যেন হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলো খুঁজেছিলেন, আর হঠাৎই যেন তাদের খুঁজে পেয়ে তাঁর চোখ দুটি ঝলসে উঠলো। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডিং শুরু করে দিলাম – নিবন্ধের সঙ্গে এখানে যে ভিডিওটি আছে তাতে সারুবাই ১১টি পদ গেয়েছেন।
প্রথম তিনটি ওভিতে ফুটে উঠেছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রসন্তান কীভাবে তাঁর বৃদ্ধা মায়ের উপর অত্যাচার করেন। ছেলেকে একথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁকে জন্ম দেওয়ার সময় তাঁর মা নিদারুণ প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন একদিন।
গানের মাধ্যমে সারুবাই তাঁর ছেলেকে বলেন যে তিনি যেন তাঁকে গালিগালাজ না করে, যেন হিংসুটি, শয়তান, বোকা, এইসব না বলেন, কারণ জন্মকালে নাড়ির যোগ ছিন্ন করাটা একজন মায়ের কাছে নরকযন্ত্রণার চেয়েও বেশি কষ্টকর। গানের মাধ্যমে এটাও জিজ্ঞেস করেন যে ছেলের বৌ সে সময় কোথায় ছিলেন?
পরবর্তী চারটি ওভি এক বোন আর তার ভাইকে নিয়ে, যারা একটি কমলা গাছের দুটি ফলের মতন ছিল। কিন্তু যখন “পরদুয়ারের ঝি” অর্থাৎ পরের ঘরের একজন মেয়ে সেই ছেলেটির স্ত্রী হয়ে সংসারে আসে সে শেষমেশ একদিন ভাইবোনের একদা অটুট সম্পর্কে ফাটল ধরায়। ভাইবোন যখন রাস্তাঘাটে, মাঠে, খেতের আল দিয়ে হাঁটে তখন অচেনা কেউ তাদের সাথে অভব্য আচরণ করে। মা তখন এই ওভির মধ্যে দিয়ে মেয়েকে বলেন সেই পিশাচদের এড়িয়ে চলতে। মায়ের হৃদয় এটা ভেবেও অস্থির হয় যে বোন তার ভাইয়ের সাথে হাঁটলে গ্রামের লোক সেটাকেও “মন্দ” বলবে, তাই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষায় প্রহর গোনেন যে তাঁর সন্তানেরা কখন ঘরে ফিরে আসবে।
এর পরের চারটি দোহা সেই ছেলের বিয়ে এবং তার নবোঢ়া স্ত্রীকে নিয়ে। জাঁতাকল এখানে ঈশ্বর বা ‘দেওতা’, তার অঙ্গে সুপারি (শুভকর্মের প্রারম্ভে মাঙ্গলিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত) জড়িয়ে দেন মা, তারপর সেই চাকীতেই হলুদ বেটে বরের গায়ে-হলুদ হয়। বিয়ের প্যান্ডেলের সামনে মা প্রাণপ্রিয় ছেলেকে সাতরাজার মানিক বলে সম্বোধন করেন, তাঁর শাড়ির কুঁচি হলুদ, সিঁদুর, ইত্যাদির রঙে হয়ে ওঠে মাঙ্গলিক। মা এবার শাশুড়ির ভূমিকায়, কিন্তু নতুন বৌমাকে শাশুড়ি বেশি কিছু বলতে পারেন না, কারণ সে তাঁর আপন ভাইঝি। তাই মা তাঁর ছেলের বৌকে কেবলমাত্র সংসারের ছোটখাট কিছু কাজ, যেমন দুধ নিয়ে দই পাতা ইত্যাদি করার কথাই বলতে পারেন। তাই শেষমেশ দুঃখ করে তিনি বলেন যে ভাল হতো ছেলে যদি পরিবারের একদম বাইরের কাউকে বিয়ে করে ঘরে আনতো।
গান শেষ করতেই জিতেন্দ্র মেইদ, যিনি গ্রাইন্ডমিল সংগস্ প্রকল্পের মূল দলটিতে ছিলেন এবং এখন পারির সঙ্গে এই অভিযানে আছেন, সারুবাইকে জিজ্ঞেস করলেন যে উনি সত্যি সত্যিই তামাক খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন কিনা। সারুবাই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন। অবাক হয়ে জিতেন্দ্র মেইদ আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যিই?” সারুবাই এতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললেন, “সত্যিই আমি ছেড়ে দিয়েছি।” এক লহমার জন্য হলেও যেন এই হাসির লাবণ্য তাঁর জীবনের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা মুছে দিল।
আঁতুড়কালে
যমের তালে বাঁধলো যে জন গান
সেই মায়েরেই বললি খ্যাপা “আঁটকুড়ি
শয়তান”?
কোন মায়েরে বললি পাগল “ডাইনি
রে তুই মর”?
জন্মসাঁঝে জঠর মাঝে নাড়ির স্বয়ম্বর।
এই মায়েরে বললি রে তুই “হিংসুটি
চল্ ভাগ!”
বউ কি জানে সিঁদুরদানে
জলছড়ানির দাগ?
খুকির নথে খোকার পথে
কমলাবনীর টি,
আসছে বছর ভাঙবে সে ঘর
পরদুয়ারের ঝি।
খেতের কাঁখে পিশাচ ডাকে
হ্যাংলা দুচোখ তার,
শোন্ রে মেয়ে, সে বাঁক
দিয়ে, যাসনে রে তুই আর।
ভাইবোনে সই আঁধার কুড়োয়
ভীম নদীটির তীরে,
গাঁয়ের লোকে মন্দ হাঁকে
মায়ের পাঁজর ঘিরে।
স্নেহের চূড়ায় বোনকে
জড়ায় একলাখি তার ভাই,
ঝাঁঝরা ঘরে আঙার ঝরে মায়ের
অপেক্ষায়।
জল সুপারির কল্কা শরীর দেওতা
চাকির লাজ,
হলদে বেলায় বাজলো সানাই, মোর
খোকা যুবরাজ।
হলদে আলোর প্যান্ডেলে মোর
ইষ্টিকুটুম সাধ,
কুচির খাঁজে সিঁদুর সাজে,
টুকটুকে অবসাদ।
খোকার বিয়ে, ঝাঁঝর নিয়ে
সাঁঝলা মোদের গাঁ,
সাতরাজা তার মানিক আমার হলুদ
মেখে যা।
হায় রে কপাল, সুখের কাঙাল,
ভাইঝি হলে বৌ -
কাজ করে না, হাত নাড়ে না,
বলতে নারে কেউ।
শোন্ রে সখী, এই যে চাকি,
বাঁধছি এতেই হাল,
সুদূর গাঁয়ে দিস্ রে বিয়ে
তোর খোকারে কাল।
একটি সে ভাই, হইল বেয়াই,
বৌমা এলো ঘর -
চাকির টানে আগুন জানে আপন সে
হয় পর।
কীই যে বলি, আঁধারতলি, ভেবেই
না পাই সই,
একাজ সেকাজ, উড়কি আনাজ,
পাতিস রে তুই দই।
পরিবেশক/গায়িকা: সারুবাই কাদু
গ্রাম:
দাপোডি
তালুক:
দৌন্ড
জেলা:
পুণে
জাতি:
মারাঠা
বয়স:
৭০
সন্তান:
৪
পুত্র (২ জন জীবিত)
পেশা:
কৃষক,
কৃষিশ্রমিক
তারিখ:
এই গানগুলির প্রতিলিপি তৈরি হয়েছিল ১৯৯৬ আর ২০০৯ সালের মধ্যে। পরের দফায়, ২০১৭ সালের ২৪শে জুলাই অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিংয়ের কাজটি সম্পন্ন হয়।
আলোকচিত্র: বিনাইফার ভারুচা এবং সময়ুক্তা
শাস্ত্রী
পোস্টার: শ্রেয়া কাত্যায়নী
বাংলা অনুবাদ - জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)