অতিমারির তুঙ্গে বসে সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে বিশ্বের বৃহত্তম শান্তিপূর্ণ এই যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনটি সংগঠিত হল আমাদের দেশে, আর শেষে জিতও হাসিল করল, ভুলবশতও তাকে মান্যতা দেবে না মিডিয়া, প্রকাশ্যে তো নৈব নৈব চ।
এই জয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফুটে রয়েছে এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। শ্রেণি নির্বিশেষে কৃষক, সে পুরুষ হোক বা নারী, সে আদিবাসী হোক বা দলিত, এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁরা নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে দিল্লির দুয়ারে সেই কৃষকের রক্তেই আবার রঞ্জিত হল প্রতিরোধের জয়ধ্বনি।
চলতি মাসের ২৯ তারিখ শুরু হতে চলেছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। তিনখানা নয়া কৃষি-আইন নাকি তখনই রদ করা হবে, একথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি নাকি 'চাষিদের একাংশকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন', এমনটা দাবি করেছেন দেশের প্রধান সেবক। এখানে দ্রষ্টব্য বিষয় এই 'একাংশ' শব্দটি। তিনখানা জনবিরোধী কানুন যে আদতে চাষিদের জন্য কতটা ভালো, সেটা সেই একাংশকে বুঝিয়ে ওঠা নাকি তেনার সাধ্যে কুলোয়নি। এটা নাকি শুধুই তাঁর না-বোঝাতে-পারার অক্ষমতা, নয়ত চাষিদের সেই 'একাংশ' দিব্যি বুঝে যেতেন যে কেন এই আইনগুলি মহান ও জনহিতকর! আইনগুলি একান্তই দোষত্রুটি মুক্ত, এমনকি এই যে অতিমারির সুযোগ নিয়ে এগুলি গায়ের জোর প্রয়োগ করতে চেয়েছিল সরকার, এই ব্যাপারটাও নাকি তেমনই নির্ভেজাল।
এই তো কদিন আগেও যাঁরা খালিস্তানি, দেশদ্রোহী, আন্দোলনজীবী ইত্যাদি নানান গালিতে ভূষিত হয়েছিলেন, আজ তাঁরাই হয়ে উঠেছেন সেই 'একাংশ' যাঁদের কাবু করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদিজীর মায়াময় যাদুমন্ত্র। বলেন কি হে? খোদ ফকিরবাবা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন? তা কেমন করে বোঝাতে চেয়েছিলেন শুনি? অভিযোগ জানাতে যখন তাঁরা দিল্লির দরবারে যেতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁদের রাস্তা আটকে? খাল কেটে, কাঁটাতার বেঁধে? জলকামানের গর্জনে? তাঁদের তাঁবুগুলিকে বকলমে কারাগার বানিয়ে দিয়ে? পোষা সংবাদমাধ্যমের দ্বারা প্রাণান্ত পরিশ্রম করে বিধ্বস্ত চাষিদের বাপান্ত করে? নাকি গাড়ির তলায় পিষে? শুনেছি সেই গাড়িটা নাকি কোন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিংবা তেনার সুপুত্তের... 'বোঝানোর' ছিরি যদি এই হয়, তাহলে জোর জবরজস্তি করতে হলে এখনকার সরকার যে কী করত সেটা ভেবেই শিউরে উঠছি।
এই বছর সাত সাতটিবার বিদেশে ঘুরতে গিয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী (শেষবার ছিল সিওপি২৬-এর জন্য), অথচ তাঁর প্রাসাদ থেকে মাইলটাক দূরে যে হাজার হাজার চাষি রোদজলঝঞ্ঝা সয়ে বসে আছেন ধর্নায়, যাঁদের দুঃখে গোটা দেশের বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, একটিবারের জন্যও তাঁদের কাছে যাওয়ার সময় হয়নি তাঁর। যদি সত্যিই তিনি বোঝানোর ইচ্ছে পোষণ করতেন, তাহলে একটিবার তাঁদের কাছে গেলেই তো পারতেন, তাই না?
এই আন্দোলনের গোড়ার থেকে একটা প্রশ্নবাণের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে আমাকে – কতদিন, ঠিক কতদিন ধরে চলতে পারে এ বিক্ষোভ? সে মিডিয়াই বলুন বা অন্যান্য লোক, কৃষকের দল বুক ঠুকে তাদের এ প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন কিন্তু। তবে এই অভূতপূর্ব জয় যে তাঁদের যুগ যুগান্তরের যুদ্ধের কেবলই প্রথম ধাপ, এটা তাঁরা বেশ ভালোভাবেই বোঝেন। আপাতত না হয় চাষিদের গলা থেকে কর্পোরেটের ফাঁস আলগা হয়েছে, কিন্তু ন্যূনতম ক্রয় মূল্য থেকে শুরু করে ফসল বিক্রি করার নিয়মবিধি তথা অর্থনৈতিক কাঠামো শুধরানোর লড়াই – বাকি আছে সেসব।
টিভি খুললেই দেখতে পাবেন যে সঞ্চালকের দল কানে চশমা এঁটে ব্যস্ত ময়নাতদন্তে – আসছে ফেব্রুয়ারিতে ভোট আছে পাঁচখানা রাজ্যে, বোধহয় সেই কারণেই সরকার বাধ্য হয়েছে পিছু হটতে। আহাহা, যেন হঠাৎই দিব্যচক্ষু খুলে গেছে তাঁদের!
৩রা নভেম্বর ২৯টি বিধানসভা আসন এবং ৩টি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল, এটি যে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে কথা মাথায় ঢোকেনি জ্ঞানপাপী সঞ্চালকদের। ওই সময়ের সম্পাদকীয়গুলোই পড়ুন না – দেখতে পাবেন বিশ্লেষণের নামে কোন প্রহসনটাই না চলেছিল তখন! সাধারণত ক্ষমতায় থাকা দলই তো জেতে, মানুষের মনে ক্ষোভ আছে বটে, তবে সেটা শুধু বিজেপির উপর নয়, তাছাড়াও এসব কেবলই আঞ্চলিক ব্যাপারস্যাপার – না জানি আলোচনার নামে এরকম আরও কত মণিমুক্তো নজরে এসেছিল তখন। একদিকে কৃষক আন্দোলন, অন্যদিকে সরকারের অব্যবস্থার কারণে কোভিড-১৯ অতিমারির তাণ্ডব – ভোটের ফলাফলের পিছনে এই দুটিই যে মূল কারণ, সে ব্যাপারে বাক্যব্যয় করার মানসিকতা হাতে গোনা কয়েকটি সম্পাদকীয় ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই কারণ দুটি যে শেষমেশ মোদীবাবুর মগজে বেশ জাঁকিয়ে শিকড় গেড়েছে, সেটা তাঁর ভাষণে ভালোমতোই টের পাওয়া গেল। যে সব রাজ্যে কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে, সেখানে তাঁর দল গোহারা হেরেছে, এই কথাটা তিনি আলবাত জানেন। যেমন ধরুন রাজস্থান এবং হিমাচল প্রদেশ। তবে মিডিয়া যেহেতু এটা বলে জনসাধারণের মগজ-ধোলাইয়ে ব্যস্ত ছিল যে আন্দোলনটি কেবলমাত্র পঞ্জাব ও হরিয়ানার চাষিদের মধ্যেই সীমিত, তাই ব্যাপারটা তাদের নিজেদেরই আলোচনাতে জায়গাই পায়নি।
আচ্ছা, একটা কথা বলুন দেখি, শেষ কবে বিজেপি বা সংঘ পরিবারের অন্য কোন গোষ্ঠী রাজস্থান বিধানসভার দুটি কেন্দ্রে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখল করেই রণে ভঙ্গ দিয়েছিল? কিংবা এই কথাটা – হিমাচলের একটি সাংসদীয় ও তিন-তিনটে বিধানসভা আসনে শেষ কবে বিজেপি এমনভাবে ল্যাজেগোবরে হয়েছিল?
হরিয়ানার আন্দোলনকর্মীদের কথায় "মুখ্যমন্ত্রী থেকে জেলাশাসক, গোটা সরকারটাই" কোমর বেঁধে নেমেছিল বিজেপির প্রচারে। কৃষি-সমস্যার কারণে পদত্যাগ করেছিলেন অভয় চৌতালা, অথচ মূর্খের মতো কংগ্রেস তাঁরই বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। তাবড় তাবড় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা আদা-জল খেয়ে নেমেছিলেন ভোটের প্রচারে। হায় রে, তাও যে শেষরক্ষা হল না, মুখ থুবড়ে পড়ল পদ্ম শিবির। জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া সত্ত্বেও চৌতালার ভোট কিছুটা কাটতে পেরেছিলেন কংগ্রেসের প্রার্থী – তবুও ৬ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়লাভ করেন তিনি।
কৃষি আন্দোলনের হুঙ্কার ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই তিনটি রাজ্যকে – এই কথাটা কর্পোরেটের ধামাধরা বাবুরা না বুঝলেও আমাদের প্রধান সেবক কিন্তু বেশ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। টের না পেয়ে আর যাবেনই বা কোথায়? একদিকে যখন বিদ্রোহে বিক্ষোভে উত্তাল উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল, তখন গাড়ির চাকায় চাষিদের পিষতে গিয়ে নিজেদেরই পায়ে কুড়ুল মেরে বসে আছে তাঁর দল, ওদিকে নব্বই দিন পরেই ভোট আসতে চলেছে সে রাজ্যে।
কারা যেন বলেছিল না ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দুগুণ হয়ে যাবে? বিরোধীপক্ষের সে মুরোদ হবে কিনা জানি না, তবে মাস তিনেকের মধ্যে এই প্রশ্নটির কাঠগড়ায় বিজেপিকে দাঁড় করানো উচিত। দুগুণের কথা ছাড়ুন, কষ্টের ফসল ফলিয়ে চাষিদের পকেট আগের থেকেও হালকা হয়ে গেছে – এনএসএসের (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা জাতীয় নমুনা সমীক্ষা, ২০১৮-১৯) ৭৭তম দফায় উঠে এসেছে এ তথ্য। ফলনশীল কৃষিক্ষেত্রের মোট যে আয়, এমনকি সেটাও রেহাই পায়নি এ মন্দার হাত থেকে।
এতে সকল কৃষি সমস্যার অবসান ঘটল, এটা ভাবাও কিন্তু ভুল। কৃষি সমস্যার বৃহত্তর পটভূমিকায় এটা বরং নতুন এক অধ্যায়ের সূচনামাত্র
মানুষ-মারা আইন রদ করানোটাই কিন্তু শেষ কথা নয়, কৃষক-আন্দোলনের ঢেউ এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে সমগ্র দেশের রাজনীতি, ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০০৪ সালের সাংসদীয় নির্বাচনের আগে।
উপরন্তু, এইবার সকল কৃষি সমস্যার অবসান ঘটল, এমনটা ভাবাও কিন্তু ভুল। কৃষি সমস্যার বৃহত্তর পটভূমিকায় এটা বরং নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। তিনকাল পেরিয়ে এককালে এসে ঠেকেছে কৃষক আন্দোলন। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের আদিবাসী চাষিরা যেদিন নাসিক থেকে মুম্বই ১৮২ কিমি পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন, সেদিন কৃষি আন্দোলন নিয়েছিল পুনর্জন্ম, আচম্বিতে তড়িদাহত হয়েছিল সারাটা দেশ। অবশ্য সেদিনও ধামাধরা ধাপ্পাবাজের দল বলেছিল যে তাঁরা নাকি 'শহুরে নকশাল', আদতে তাঁরা নাকি চাষিই নন। তবে কাদামাখা পায়ের ধুলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সেসব আগডুম বাগডুম কথাবার্তা।
আজ বহু-বিজয়প্রাপ্তির দিন, ঘামঝরানিদের হাতে কর্পোরেট মিডিয়ার পরাজয় সে বিজয়গাথার এক অনুপম অধ্যায়। তবে এমনটা বোধহয় হওয়ারই ছিল। সে কৃষি সমস্যা হোক বা অন্য কিছু, প্রথম থেকেই ট্রিপল এ ব্যাটারির (অ্যামপ্লিফায়েড আম্বানি আদানি +) ভূমিকা পালন করে এসেছে আমাদের তাঁবেদার মিডিয়া।
এই বছর ডিসেম্বর ও আগামী এপ্রিলের মাঝে আমরা এমন দুটি পত্রিকার ২০০তম জন্মবার্ষিকী পালন করতে চলেছি যেগুলিকে প্রকৃত রূপে ভারতীয় (মালিকানা তথা অবস্থানের নিরিখে) সংবাদমাধ্যমের আঁতুড়ঘর বলা চলে। দুটিই শুরু করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এদের মধ্যে একটি – মিরত-উল-আখবার – বেশ দক্ষহস্তে ফাঁস করে দেয় যে কেমনভাবে কুমিল্লার (বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল) এক জজসাহেবের হুকুমে প্রতাপ নারায়ণ দাসের প্রাণ চলে যায় পাশবিক বেত্রাঘাতে। এর জবাবে সম্পাদকীয় বিভাগে কলমরূপী চাবুক চালান রামমোহন রায়, ফলে তৎকালীন সর্বোচ্চ আদালতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বিচার হয়েছিল সেই জজের।
এর ফলে খেপে ওঠে বড়লাট (গভর্নর জেনারেল) জন অ্যাডাম, তার রোষানলে দগ্ধ হয় প্রেস। সদ্য সদ্য জন্ম নেওয়া ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বুটের তলায় পিষে মারতে পাশ করানো হয় দমনমূলক এক অধ্যাদেশ (লাইসেন্সিং রেগুলেশনস্ অ্যাক্ট, ১৮২৩)। তবে হার মানতে অস্বীকার করেন রামমোহন রায়, অপমানজনক সেই আইনের সামনে মাথা ঝোঁকানোর চেয়ে মিরাত-উল-আখবারের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়াটাই শ্রেয় ছিল তাঁর কাছে। (তাই বলে রণে ভঙ্গ কিন্তু দেননি, বরং নতুন পত্রিকার কলমে সুদূরপ্রসারিত করেন তাঁর লড়াই!)
এই সংবাদমাধ্যম ছিল সাহসিকতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। কৃষি আন্দোলনের ক্ষেত্রে আজকের মিডিয়া যে নিকৃষ্টতম তাঁবেদারির পরিচয় দিয়েছে, তার সঙ্গে এর কোনও তুলনাই হয় না। এদিকে সম্পাদকীয় পাতায় যে চাষিদের জন্য বেনামী নাকি-কান্না, ওদিকে মূল পাতাগুলো জুড়ে তাঁদেরকেই 'বড়োলোক চাষি, ওরা ধনীদের জন্য মেকি সমাজতন্ত্র চায়' ইত্যাদি আজেবাজে কথা বলা, এই তো আমাদের সাম্প্রতিককালের সংবাদমাধ্যমের বাস্তব।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া সব্বার মুখে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ছিল সেই এক বুলি – এরা সব গেঁয়ো গোমুখ্যু, একটু বাবা-বাছা করে বুঝিয়ে মাথায় হাত বোলালেই কেল্লা ফতে। স্বাভাবিকভাবেই সম্পাদকীয় পাতায় ছিল খানিক হালকা চালের সুর: তোরা যে যা বলিস ভাই, নয়া কৃষি আইন চাই! উক্ত সুত্রটি নকলনবিশি করেই কেটে গিয়েছিল মিডিয়ার দিনরাত্রি।
কৃষক বনাম কর্পোরেটের এ যুদ্ধে এদের একজনও কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছিল যে আম্বানির একার ট্যাঁকে প্রায় ততটাই টাকা (৮৪.৫ বিলিয়ন ডলার – ফোর্বস ২০২১ অনুযায়ী) আছে যতটা কিনা গোটা পঞ্জাবের জিএসডিপি (৮৫.৫ বিলিয়ন ডলার)? মোসাহেব মিডিয়া কি একটিবারের জন্যও বলেছে যে আম্বানি আর আদানির (৫০.৫ বিলিয়ন ডলার) মোট সম্পত্তি মেলালে পঞ্জাব বা হরিয়ানা রাজ্যের জিএসডিপি ছাড়িয়ে যাবে আরামসে?
এটা ঠিকই যে আজব এক হাঁসজারু মার্কা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আজ। ভারতীয় মিডিয়ার ১২ আনাই আম্বানি সাহেবের পকেটে, বাদবাকি ৪ আনার প্রায় পুরোটাই তাঁরই বিজ্ঞাপনের দয়ায় বেঁচেবর্তে আছে। এই দুই কর্পোরেট সম্রাটের ব্যাপারে লিখতে গেলেই সংবাদমাধ্যমের কলমে সাধারণত ফুটে ওঠে বেশরম চাটুকারিতা। এ হেন সাংবাদিকতাকে ধামাধরা ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর আদৌ কিছু বলা চলে কি?
ইতিমধ্যেই তো গুরুজির মাস্টারস্ট্রোকের গুণগান গাওয়া শুরু করে দিয়েছেন এই চাটুকাররা – পঞ্জাবের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে নাকি বাজিমাত হতে চলেছে। অমরিন্দর সিং বাবাজী নাকি ইহাই নিশ্চিত করিতে মোদীর সঙ্গে ষড় করিয়া পদ্মপানে পরিযান করিয়াছিলেন কংগ্রেসের ছত্রছায়া ত্যাজিয়া। ফলত নির্বাচনের ফল নাকি বেশ চমকপ্রদ হতে চলেছে!
নাহ্, এ জয় যে আদতে কার, সেটা এই রাজ্যের আন্দোলনরত শতসহস্র মানুষ বেশ ভালোভাবেই জানেন। দশকের নিষ্ঠুরতম শৈত্যপ্রবাহ, হাড়পোড়ানি রোদ্দুর, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিবাদলা, প্রধান সেবক ও তাঁর ধামাধরা মিডিয়ার হাতে অকথ্য ভোগান্তি সয়ে যে কৃষকের দল দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন দিল্লির দোরগোড়ায়, পঞ্জাবের আপামর জনতার হৃদয় ধরা তাঁদেরই লাঙলরঙা মুঠোয়।
প্রতিবাদী কণ্ঠের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা বা তাকে জেলে পচিয়ে মারার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এ দেশের সরকার বাহাদুর। প্রতিরোধ করেছেন কি মরেছেন। নাগরিক, বিশেষ করে সেই সাংবাদিক যাঁরা সরকারের মোসাহেবি করেন না, ইউএপিয়ের (UAPA) জাঁতাকলে তাঁদের পিষে মারা বা 'আর্থিক হিসেবনিকেশে নয়ছয়ের' দোহাই দিয়ে স্বতন্ত্র সংবাদমাধ্যমের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা আজ নিতান্তই বাঁ হাতের খেল। এমন একটি পরিস্থিতির মাঝে দাঁড়িয়ে আজ দ্রোহের রাস্তা দেখিয়ে চলেছেন আন্দোলনরত কৃষকের দল; নির্বাক কণ্ঠগুলিকে বজ্রনিনাদ গর্জনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য সাহস যুগিয়েছেন। এই জয় তাই শুধু কৃষকের নয়। এ জয় মানবাধিকারের, এ জয় নাগরিক স্বাধীনতার। সর্বোপরি এই জয় মরেও না মরা ভারতীয় গণতন্ত্রের।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)