পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরা কষ্টকর। এক রাত ভাতবেদাতে কাটিয়ে পরের দিন সকালে রওনা হয়ে পাহাড়ের ওপর ছোট্ট রাজনাইরি জনপদে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে যায়। হাট সেরে তাঁদের গ্রামে ফিরতে গোটা দুটো দিন লাগে, একইভাবে ওরছার সাপ্তাহিক বাজারে আসতে হলেও তাঁদের চড়াই-উতরাই পথে দুদিন ধরে পায়ে হাঁটতে হয়।
ফলে এই অবধি পৌঁছতে মধ্য ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের জঙ্গলাকীর্ণ নারায়ণপুর জেলার ধূলিধূসরিত মাটির রাস্তায় পায়ে হেঁটে অবুঝ মারিয়া তফশিলি জনজাতির মহিলাদের ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আসতে হয়। ৪,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তাঁদের আবাসভূমি অবুঝমাড় মূলত মাওবাদী গেরিলা আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই কারণবশত এলাকার মানুষের মনের ভেতর সন্দেহ আর ভয় এমনভাবে গেঁথে আছে যে আমরা তাঁদের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য উদ্ঘাটন করা থেকে বিরত থেকেছি।
শুরুর দিকে আমরা ওরছার সাপ্তাহিক জমজমাট হাটের ভেতর বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। পরনে তাঁদের অনন্য পোশাক - গামছার মতো কাপড় ব্লাউজের ওপর জড়িয়ে রাখা আর লুঙ্গির মতো কাপড় পেঁচিয়ে পরা। রূপো অথবা সাদা ঘাতুর গয়না পরেছিলেন তাঁরা। অনেকেই আবার গায়ে থলের মতো করে বাঁধা কাপড়ে বাচ্চাও নিয়েছেন। বেশিরভাগ পুরুষের গায়ে শার্ট আর কোমরে বাঁধা লুঙ্গি। আর যাঁরা জামা-প্যান্ট পরে আছেন তাঁরা হয় এখানকার কোনও সরকারি চাকুরে, নয়ত বা বহিরাগত, ব্যবসায়ী বা সাদা পোশাকে টহলদারি করা নিরাপত্তাকর্মী।
মহিলারা আমাদের সঙ্গে প্রথমে খুব দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় কথা বলছিলেন গোণ্ডী ভাষায়। দুজন গোণ্ড তফশিলি জনজাতির ছেলে, যারা আমদের সঙ্গ দিয়ে চলেছে, তাঁরা সাহায্য করছিলেন হিন্দি তর্জমার মাধ্যমে কথপোকথন এগিয়ে নিয়ে যেতে। মহিলারা জানালেন যে তাঁদের ঘরের কাছের বন থেকে পাওয়া বাঁশের ঝাঁটা, চারোলির দানা, তেঁতুল, বিভিন্ন রকমের স্থানীয় কলা, টমেটো ইত্যাদি জিনিস এই হাটে এনে বিক্রি করে থাকেন - সবই পরিমাণে অল্প।
এঁরা সঙ্গে করে রেশমগুটিও এনেছেন বিক্রি করতে। অবুঝমাড়ে প্রচুর পরিমাণে রেশমগুটি পাওয়া যায়; ছত্তিশগড়ের উত্তরদিকের সমতল অঞ্চলে বিলাসপুর, রায়গড় বা কোরবাতে যে বিখ্যাত কোসা সিল্কের শাড়ি তৈরি হয় তার কাঁচামাল হিসেবে এই গুটি ব্যবহার করা হয়।
এসব বেচে মহিলারা সাকুল্যে যে ৫০ টাকা মতো উপার্জন করেন তাই দিয়ে তাঁরা তেল, সাবান, লঙ্কা, নুন, আলু, পেঁয়াজ আর অন্যান্য দকারি জিনিসপত্র কেনেন। বিক্রি করতে নিয়ে আসা জিনিসের মতোই, এসব জিনিসও তাঁরা অল্প পরিমাণে কেনেন যাতে তাঁদের সাধারণ থলেয় সবটুকু ধরে যায়।
ওরছার এই হাটে শুধু মরশুমের সবুজ শাকপাতা, বুনোফল, মূল-কন্দই আসে না, এখানে সস্তার মোবাইল হ্যান্ডসেট, সৌর ল্যাম্প, ব্যাটারি চালিত আলো, টেবিল ল্যাম্প, সার্চ লাইট এবং মাঝেসাঝে মিনি-ইনভার্টারও বিক্রি হয়। তার কারণ অবুঝমাড়ের বহু গ্রামেই এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি।
ওই অঞ্চলের এক স্থানীয় বিক্রেতার কাছ থেকে জানা গেল যে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলিতে সেলুলার নেটওয়ার্ক না থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীরা মোবাইল কেনেন গান শুনতে, ছবি তুলতে অথবা ভিডিও বানাতে আর টর্চ লাইট হিসেবে ব্যবহার করতে।
অবুঝমাড় - যার অর্থ অজানা বা রহস্যময় পাহাড় - পশ্চিমে মহারাষ্ট্রের গডচিরোলি জেলা, দক্ষিণে ছত্তিশগড়ের বীজাপুর জেলা আর পূর্বদিকে বস্তার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চল ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসীদের আবাসভূমি, এদের মধ্যে আছেন গোণ্ড, মুরিয়া, অবুঝ মারিয়া, হালবা প্রমুখ। সরকারি ও বেসরকারি হিসেব মোতাবেক আভূজ মারিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ঝরনা আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি এলাকা এটা, মানুষজন খুব আন্তরিক এবং অতিথিপরায়ণ। কিন্তু এই প্রকৃতির নিবিড়তায় ঢেকে থাকা স্থানে বাস করা আর যাতায়াত করা কিন্ত খুব অনায়াস নয়। শুভজিৎ বাগচী, বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে যিনি বার কয়েক অবুঝমাড় গিয়েছেন, তিনি জানাচ্ছেন, “চার মাস এই এলাকা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে বৃষ্টির জন্য। আর কত জন যে এই সময়ে ডায়রিয়ার প্রকোপে মারা যান তার কোনও হিসেব আমরা জানি না ... আর সারা বছর ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া লেগেই আছে। আমি কোনও চালু স্কুল দেখিনি যেখানে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন; কোনও স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, কখনসখনও প্রাথমিক চিকিৎসা যা হয় তা ওই মাওবাদী মোবাইল স্কোয়াড আর এলাকার হাতুড়ে ডাক্তার দিয়েই।”
বাগচী জানালেন, “বিশেষত প্রত্যন্ত প্রান্তিক এলাকাতে পুলিশি কার্যকলাপের জন্য প্রত্যেকেই ভয়েভয়ে দিন কাটান। বড়োই সুন্দর, মনোরম হিসেবে গ্রামগুলির বর্ণনা কেবলমাত্র নৃতাত্ত্বিকদের পুরোনো ডায়রিতেই পাওয়া যাবে, বাস্তবে তেমনটা আদৌ নয়।”
অবুঝমাড়ের রাস্তা শেষ হয়েছে ওরছা এসে। এলাকার স্থানীয় মানুষেরা প্রায়শই ৭০ কিলোমিটার হেঁটে তবে হাটে পৌঁছাতে পারেন। এই বিশাল অঞ্চলের বাজার বলতে একমাত্র এই হাট। এমনকি আদিবাসী মানুষদের এই হাটে এসেই জনসাধারণের জন্য বণ্টন করা রেশনের জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে হয় আর স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারাও তাদের মিড ডে মিলের চাল-ডাল নিতে আসে এখানে।
এককালে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বেচ্ছাকর্মীদের এই অঞ্চলে চলাফেরার কিছু স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু সরকার থেকে এখন তাঁদেরকেও আদিবাসীদের মধ্যে দানাশস্য বিতরণে বিরত করা হয়েছে।
এই বাজারে আসা বেশিরভাগ শিশুকে দেখেই অপুষ্টিতে আক্রান্ত বলে মনে হয়। আমরা দেখলাম আঞ্চলিক আদিবাসী আশ্রমের বালিকারা এই হাট থেকে শাকসবজি কিনতে এসেছে। ইউনিসেফের স্বেচ্ছাকর্মীদের দেখা গেল শিশুদের সঙ্গে যারা অবুঝমাড়ের প্রত্যন্ত জনপদগুলি থেকে তাদের মা-বাবাদের সঙ্গে এসেছে। মহিলারাও, বিশেষত মায়েরাও অপুষ্টিতে আক্রান্ত। ইউনিসেফের কর্মীরা জানালেন এই হাটটা আছে বলেই সপ্তাহে অন্তত একটা দিন তাঁরা বিনামূল্যে স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করবার সুযোগ পান, নচেৎ গ্রামে প্রবেশ করা অসম্ভব ব্যাপার।
ওরছা হাটের আরও একটা আকর্ষণ আছে: হাঁড়িয়া ( লোণ্ডা ), সুলফি, তাড়ি, মহুয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক মদ বিক্রি হয় হাটের একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, তার নাম লোণ্ডা-বাজার।
দিনের শেষে এই হাটে বসেই সবাই মদ খেতে খেতে জিরিয়ে নেন। এখানে অল্পবয়সী আর বয়োজ্যেষ্ঠ - সবাই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে পানীয় সেবন করেন আর নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা আদান-প্রদান করেন।
আমার মতো সাংবাদিকেরা এই হাট থেকেই অনেক কিছু জানতে পারেন , যা এখানকার গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে জানা সম্ভব নয় – জানতে পারি চাষ তথা ফসলের হালচাল, আমদানি করা পণ্যের কথা; মানুষের ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময় এবং সর্বোপরি বেঁচে থাকার মতো নানান ভূমিকায় নিরন্তর সংগ্রামের কথা।
অনুবাদ
: শৌভিক পান্তি