“তুমি ঠিক উৎসবে ফূর্তি করেছ। কিন্তু আমাদের কী হবে? এখানে কোনও কাজই নেই। টাকা আসবে কোথা থেকে?” আমাকে লক্ষ্য করে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ৬০ বছর বয়সি সোনি ওয়াঘ নিজের দাওয়ায় বসে বললেন। তাঁর আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকজন ইশারায় এইসব কথা বলতে বারণ করছিলেন। কিন্তু সোনির কথাটা শুধু তাঁর একার ছিল না। সেই ছোটো জনপদের এটাই বাস্তব এবং কেউ সেটা আড়াল করতে পারবে না। সবে দীপাবলি কেটেছে, অথচ গোটা পাড়ার একটি ঘরেও কোনও লণ্ঠন নেই। নেই কোনও ঘর সাজানোর মতো আলো। শহরের বাড়িগুলির মতো বোট্যাচি ওয়াড়ির কোনও বাড়িই ফুল দিয়ে সাজানো হয়নি এই দীপাবলিতে।

পাড়া (ওয়াড়ি) শুনশান। একমাত্র যে শব্দটি ভেসে আসছে তা উঠোনে বাচ্চাদের খেলার আওয়াজ। তাদের পা ধুলোয় মাখা। জামাকাপড় ছেঁড়া ফাটা। বোতাম ছেঁড়া জামায় তাদের বেশিরভাগেরই শরীরের কিছুমাত্র অংশ ঢেকেছে। উঠোনের একপ্রান্তে ৮-৯ বছরের জনা পাঁচ-ছয়েক বাচ্চা নিজেদের ঘর থেকে আনা কিছু অ্যালুমিনিয়াম আর স্টিলের বাসন সাজিয়ে ‘বাড়ি-বাড়ি’ খেলছে। মাটিতে পোঁতা চারটে লাঠিতে একটা ছেঁড়া কাপড়ের ফালি আটকে তারা আবার শিশুর দোলনাও বানিয়েছে।

একটি মেয়ে কয়েক মাসের একটি শিশুকে কোলে নিয়ে বসে বসে অন্যদের খেলা দেখছে। একটি ছেলে তার ঠিক পাশেই বসে আছে। আমি এগোতেই তারা উঠে পড়ল। কিন্তু আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি, এই আভাস পেয়ে মেয়েটি ফিরে তাকালো। “তোমরা স্কুলে যাও?” উত্তর এল, না। ৯ বছরের অনিতা দিভে প্রথম শ্রেণির পরে স্কুলছুট হয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন? “আমায় বাচ্চাটাকে দেখতে হয়। আমি কেমন করে স্কুলে যাব? আমার বাড়ির লোকেরা তো ইটভাটায় যায় কাজ করতে।”

PHOTO • Mamta Pared

বোট্যাচি ওয়াড়ির বেশিরভাগ বাচ্চাই কালু ভালভির (ওপরে ডানদিকে) মতো স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়িতে (নিচে ডানদিকে) কিছুদিন যাওয়ার পরে, প্রাথমিক স্কুলে এক দুইবছর কাটিয়েই স্কুলছুট হয়ে যায়। এর মূল কারণ দারিদ্র ও অভিবাসন

তার পাশের ছেলেটি, কালু সাভারার গল্পও একইরকম। সে-ও প্রথম শ্রেণিটুকু পড়েই স্কুল ছেড়েছে। আরেকটি মেয়ে এসে কাছেই বসল, তার নাম কালু ভালভি। সে জানাল, “আমি বর্ষায় ইস্কুলে যাই, গরমকালে আমাকে বাড়ির লোকের সঙ্গে ইটভাটায় যেতে হয়।”

মহারাষ্ট্রের পালঘর জেলার মোখাদা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের গোমঘর গ্রাম থেকে কালু ভালভির পরিবারের মতো ৩০-৩৫টি কাতকারি আদিবাসী পরিবারকে প্রতিবছরই কাজের খোঁজে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হয়।

স্কুলের কথা বলতেই, বছর পঁয়ষট্টির বুধা ওয়াঘ নামে জনৈক পড়শি বেজায় রেগে গিয়ে বললেন, “আমাদের কিছু টাকাপয়সা দাও অথবা কাজকাম খুঁজে দাও। আমাদের খিদের কিছু সুরাহা কর।”

“এখানে চাষবাস নেই। অন্য কোনও কাজের উপায়ও নেই। আমাদের পেট চালাতে অন্য জায়গায় কাজের খোঁজে যেতেই হয়,” ৫৫ বছর বয়সি কাশীনাথ বারফ বুধাকে শান্ত করতে করতে বললেন। প্রতিবছর বর্ষায়, জুলাই মাসে তিনি নিজেও শিরডিতে পাথর ভাঙার খাদানে কাজ করতে যান। দীপাবলির পরে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মে মাস পর্যন্ত তিনি থানে জেলার ভিওয়ান্ডি তালুকের খারবভ শহরের ইটভাটাগুলোয় কাজ করতে যান।

এই গ্রামের সেসকল বাসিন্দারা বাইরে কাজ করতে যান, তাঁদের প্রায় সকলের ঘাড়েই ঋণের বোঝা থাকে। সেই দেনা শোধের চক্করে তাঁদের ফি বছরই ঘর ছাড়তে হয় কাজের খোঁজে। অনেকেই জানেন না সারাবছরে কতখানি আয় থাকবে। ৫০ বছরের লীলা ভালভি বললেন, “আমরা তিনবছর ধরে নিজেদের কোনও হিসেব করিনি। এখানে (উল্লাসনগর) বহু বছর ধরে কাজ করছি। ইটভাটার মালিকের থেকে ৩০,০০০ টাকা আগাম টাকা নিয়েছিলাম মেয়ের বিয়ের জন্য। সেটা এখনও শোধ করা হয়নি। অনেক সময়েই আমাদের পেট ভরাতে হয়েছে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার দেওয়া খাবারে। টাকাপয়সার হিসেবের কথা বললে আমাদের মার খেতে হয়।”

PHOTO • Mamta Pared

ওপরে বাঁদিকে: ‘টাকাপয়সার হিসেবের কথা বললে আমাদের মার খেতে হয়,’ লীলা ভালভি বলছেন। ওপরে ডানদিকে: সরকারি আবাসন প্রকল্পের সুবাদে পাওয়া খানকতক পাকা ঘর বাদে বোট্যাচি ওয়াড়ির সব ঘরই ভাঙা ছাদওয়ালা, জরাজীর্ণ। নিচে বাঁদিকে: ভিকা দিভে তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখের কথা জানালেন। নিচে ডানদিকে: গোরখ ভালভির কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম

লীলা নিজের বাড়ি দেখাচ্ছিলেন, সিমেন্ট ও ইট দিয়ে বানানো, একটি ঘরে পার্টিশন দিয়ে দুইভাগ করা (এটি প্রধান মন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনার আওতায় নির্মিত। সরকারি আবাসন প্রকল্পের সুবাদে পাওয়া খানকতক পাকা ঘর বাদে বোট্যাচি ওয়াড়ির সব ঘরই ভাঙা ছাদওয়ালা, জরাজীর্ণ। “আমাদের একটা চালাঘরও আছে,” খড়, মাটি আর কাঠ দিয়ে তৈরি জানালাবিহীন ঘরখানা দেখিয়ে বললেন লীলা, ভরদুপুরেও ঘরখানি অন্ধকার। উনুনের আশেপাশে জিনিসপত্র ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। “এই চালটুকু বাদে ঘরে আর কণামাত্র অবশিষ্ট নেই,” ঘরের কোণে রাখা একটি ড্রাম হাতে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে তিনি বললেন। সত্যিই চাল একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়সি ভিকা রাজা দিভেরও ১৩,০০০ টাকা দেনা আছে। “আমি এই টাকা নিয়েছিলাম ছেলের বিয়ের জন্য,” জানালেন তিনি। দশেরার সময়ে, অক্টোবরের শুরুতে শেঠ তাদের গোটা পরিবারকে উল্লাসনগরে ইটভাটায় নিয়ে গেল। কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কাজ বন্ধ রইল। তাই শেঠ তার চেনা এক মালিকের ধানের জমিতে পাঠালো কাজ করতে। সে তাঁদের দৈনিক ৪০০ টাকার একটা অংশ রেখে দিত। দীপাবলির সময়ে বোট্যাচি ওয়াড়িতে ফিরতে ভিকার পরিবারের যাতায়াত বাবদ কিছু টাকা দরকার ছিল, শেঠ তাদের সেই টাকাটাও দেয়নি। যেটুকু কাজ কাজ করতে পেরেছিলেন, তা থেকে কিছু টাকা তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আর দীপাবলি শেষ হতেই শেঠ আবার গ্রামে হাজির হল [তাদের আবার কাজে নিয়ে যেতে]।

তখন সবে আবাসন প্রকল্পের দৌলতে একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে তাঁদের পরিবারের জন্য। তাই বাড়ি তৈরির কাজ সামলাতে তাঁদের গ্রামে থাকাটা দরকার ছিল। কিন্তু দেনার দায়ে তাঁরা চূড়ান্ত অসহায় অবস্থার মধ্যে ছিলেন। “শেঠ চাইছিল আমি তার ধার শোধ করি। কিন্তু বাড়ি তৈরির জন্য এখানে থাকতেই হত। তাই শেঠ আমার বউ লীলা, দুই মেয়ে আর [২১ বছরের] ছেলেকে নিয়ে চলে গেল,” ভিকা নিজের ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে মনের দুঃখে কথাগুলো বললেন। তাঁর বড়ো মেয়েটির বয়স ১২ আর ছোটোটির মাত্র ৮।

Young girls in this hamlet are passing their days caring for their younger siblings.
PHOTO • Mamta Pared
There is no farming. There are no other work options' , say the adults
PHOTO • Mamta Pared

বাঁদিকে: এই গ্রামের কমবয়সি মেয়েরা তাদের ছোটো ভাইবোনদের দেখভাল করে দিন কাটায়। ডানদিকে: ‘এখানে চাষবাস নেই, আর অন্য কোনও আয়ের উপায়ও নেই,’ গ্রামের বড়োরা জানালেন

আমি গোরখ ভালভির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। একবার এক ইটভাটার মালিকের একখানা মোষ মারা গেল। সমস্ত মজুরদের মাথা কামিয়ে ফেলতে হবে এই মর্মে শেঠ নির্দেশ দেয়। কারও সেটা অগ্রাহ্য করার সাহস ছিল না। এমনই ভাটার মালিকদের ক্ষমতা। ভালভি আরও বলেছিলেন যদি হঠাৎ অসময়ের বৃষ্টিতে ইট ভিজে যায় তাহলে মজুরেরা সেই ইট তৈরির জন্য কোনও মজুরি পান না। “আমরা হাড়ভাঙা খাটনি খেটেও মরি আর তারপর মজুরি না পেয়েও মরি,” তাঁর বক্তব্য। এমন কঠিন অবস্থা সত্ত্বেও গোরখ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে গেছিলেন। তারপরে অবশ্য আর সবার মতোই তাঁকেও ইটভাটার কাজে ঢুকতে হয়।

গোরখের মতোই লতা দিভে আর সুনীল মুকনেও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারপর আর আমরা কেমন করে পড়ব, তাঁদের প্রশ্ন। উচ্চশিক্ষা তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে আর যেটুকু শিক্ষা লাভ করতে পেরেছেন, সেটা কোনও চাকরি পাওয়ার জন্যই যথেষ্ট নয়। এই গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই এক-দুই বছর পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রধান কারণ অবশ্যই নিদারুণ দারিদ্র ও অভিবাসন।

গ্রামের বেশিরভাগ ঘরই আঁধারে ডুবে থাকে, সামান্য চাল বাদে থাকে না অন্য কোনও খাবার। এই পরিস্থিতিতে অপুষ্টি খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কমবয়সি মেয়েরা বাড়িতেই থাকে আর নিজেদের ছোটো ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। বিয়ের পর নিজেদের নতুন পরিবারের সঙ্গে অন্য জায়গায় চলে যেতে তারা বাধ্য হয়। এই প্রতিযোগিতায় ভরা পৃথিবীতে জীবনধারণের মৌলিক শর্তগুলি পূরণ করতেই যখন এখানে সবাই হিমশিম খাচ্ছেন, অন্য কোনও স্বপ্ন দেখার ফুরসৎ কোথায় তাঁদের? আশা ভরসার রশ্মিরেখা এঁদের অন্ধকার জীবনে এখনও অধরা। কখন আসবে? এই প্রশ্নটা পাক খেতে থাকে।

মূল মারাঠি লেখা থেকে ইংরেজি ভাষায় তর্জমা করেছেন মেধা কালে।

অনুবাদ: তর্পণ সরকার

Mamta Pared

पत्रकार ममता परेड (१९९८-२०२२) हिने २०१८ साली पारीसोबत इंटर्नशिप केली होती. पुण्याच्या आबासाहेब गरवारे महाविद्यालयातून तिने पत्रकारिता आणि जनसंवाद विषयात पदव्युत्तर पदवी घेतली होती. आदिवासींच्या, खास करून आपल्या वारली समुदायाचे प्रश्न, उपजीविका आणि संघर्ष हा तिच्या कामाचा गाभा होता.

यांचे इतर लिखाण Mamta Pared
Editor : Sharmila Joshi

शर्मिला जोशी पारीच्या प्रमुख संपादक आहेत, लेखिका आहेत आणि त्या अधून मधून शिक्षिकेची भूमिकाही निभावतात.

यांचे इतर लिखाण शर्मिला जोशी
Translator : Tarpan Sarkar

Tarpan Sarkar is a writer, translator and graphic designer. He has a Master’s degree in Comparative Literature from Jadavpur University.

यांचे इतर लिखाण Tarpan Sarkar