এই বয়সেও রীতিমতো সুপুরুষ লক্ষ্মীকন্ত মাহাতোর সৌম্যকান্তি চেহারা দেখে তাক লাগে। মুখখানা দেখলে এক ঝলকে আপনার সামনে রবি ঠাকুরের চেহারা ভেসে উঠবেই। আর চেহারার সঙ্গে সঙ্গত করার মতো গলাখানাও বটে।

ঠেলু মাহাতোর ঠিক পাশেই চারপাইয়ে বসেছিলেন তাঁর আজীবনের সঙ্গী, ৯৭ বছর বয়সি লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো। ২৬ মার্চ, ২০২২ তারিখে তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আমাদের, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চা ব্লকের পিঁড়রা গ্রামে ঠেলু মাহাতোর টিনের চালে ছাওয়া লড়ঝড়ে, ভগ্নস্তূপ-সম একটা কামরার ঘরে বসে।

ঠিক একবছরের মাথায় বিগত ৬ই এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে, ১০৩ বছর বয়সে নিজের ভিটেয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঠেলু মাহাতো। পড়ুন: হাতে গড়া কুয়ো রেখে গেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ঠেলু মাহাতো।

ঠেলু মাহাতো পুরুলিয়া-সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের অন্তিমতম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন ছিলেন। আজ থেকে ৮০ বছর আগে পুরুলিয়ার মানবাজারের ব্রিটিশ পুলিশ চৌকি আক্রমণের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঠেলু দাদু। তাঁদের এই বিপ্লবী কর্মসূচি ছিল আদতে ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আঞ্চলিক অধ্যায়।

লক্ষ্মীদাদু অবশ্য ১৯৪২-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলীতে অংশগ্রহণ করেননি। তার কারণ খুব সম্ভব তিনি তখনও ১৭ পার করেননি, ওদিকে নেতারা থানা ঘেরাও কর্মসূচির জন্য ন্যূনতম এই বয়স হতে হবে বলে নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন।

ঠেলু বা লক্ষ্মী মাহাতো কিন্তু আগমার্কা স্বাধীনতা সংগ্রামী নন। আর সরকার কিংবা ভদ্র সমাজের সংজ্ঞার নিরিখে তো কোনও মতেই নন। তাঁরা সেই প্রতিরোধ-প্রতিবাদে শুধুই অসংখ্যের মধ্যে এক হয়ে থাকা গতে বাঁধা স্বাধীনতা সংগ্রামীও নন। নিজ নিজ জগৎ ঘিরে অভিজ্ঞতালব্ধ গভীর জ্ঞানের প্রকাশ তাঁদের কথাবার্তা। কৃষি আর স্থানীয় ইতিহাসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঠেলুদাদু। লক্ষ্মীদাদুর আছে গান আর সংস্কৃতির বিরাসত।

ভিডিওটি দেখুন: লক্ষ্মী মাহাতোর মেঠো গান

লক্ষ্মীদাদু মূলত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক দিকটির মধ্যেই নিয়োজিত ছিলেন। কুড়মি, সাঁওতাল, বীরহোড় ইত্যাদি নানান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান বাদ্য ধামসা আর মাদল সহযোগে যে দলগুলি নাচগান করে মানুষের মধ্যে ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রসারে অগ্রণী ছিল, লক্ষ্মীদাদু ভিড়েছিলেন তাদের সঙ্গে। শুনলে মনে হবে সাদামাটা লোকগীতি, কিন্তু সেই বিদ্রোহী সময়ের নিরিখে গানগুলি অন্য এক মাত্রা পেত।

কেমন করে গাইয়েদের দলগুলি ধামসা-মাদল বাজিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিত সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্মীদাদু বলছিলেন, “মাঝেমাঝেই আমরা তারস্বরে বন্দে মাতরম গাইতাম।” থোড়াই তাঁদের এই গানের সঙ্গে নাড়ির যোগ ছিল! “তবে কিনা এইটা গাইলেই গোরা সাহেবগুলো বেজায় চটে যেত,” মুচকি হেসে বললেন তিনি।

সেই ঐতিহাসিক থানা ঘেরাও কর্মসূচির আজ আশি বছর পেরিয়েছে। দুজনের কেউই পাননি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাপ্য পেনশন। বহু আগেই তাঁরা এসবের আশা নিসর্জন দিয়েছেন। হাজার টাকার বার্ধক্য ভাতাটুকুই ঠেলু দাদুর সম্বল। লক্ষ্মীদাদু সাকুল্যে একবারমাত্র পেয়েছিলেন বার্ধক্য ভাতা। তারপর তা বন্ধ হয়ে গেল – এই রহস্যের কিনারা মেলেনি।

Left: Lokkhi Mahato sharing a lighter moment with his dearest friend, Thelu Mahato in Pirra village of West Bengal, in February 2022.
PHOTO • Smita Khator
Right: Lokkhi was a part of the cultural side of the resistance. He performed with troupes that played tribal instruments such as the dhamsa (a large kettle drum) and madol (a hand drum)
PHOTO • P. Sainath

বাঁদিকে: ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরুলিয়ার পিঁড়রা গ্রামে হরিহরাত্মা লক্ষ্মী আর ঠেলু মাহাতো নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে ব্যস্ত। ডানদিকে: লক্ষ্মী মাহাতো মূলত ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক দিকটির মধ্যেই নিয়োজিত ছিলেন। কুড়মি, সাঁওতাল, বীরহোড় ইত্যাদি নানান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান বাদ্য ধামসা আর মাদল সহযোগে যে দলগুলি নাচগান করে মানুষের মধ্যে ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রসারে অগ্রণী ছিল, লক্ষ্মীদাদু ভিড়েছিলেন তাদের সঙ্গে

কতশত গোষ্ঠী আর সম্প্রদায় থেকে ঠেলু আর লক্ষ্মী মাহাতোর মতো মানুষেরা এসে যোগ দিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এই দুই যোদ্ধা আদর্শগত অবস্থানে বামপন্থী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে গান্ধিবাদী। দুজনেই কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যারা সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাদের মধ্যে ভূমিজ তথা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি কুড়মি সম্প্রদায়ও অত্যন্ত সক্রিয় ছিল।

লক্ষ্মীদাদু টুসু গান গেয়ে শোনালেন আমাদের। চাষ, ফসল, কৃষিকর্ম ঘিরে কুড়মিদের টুসু পরবের অবিচ্ছেদ্য অংশ টুসু গান। এ কোনও ধর্মোৎসব নয়। এর লোকায়ত মানবিক দিকটি ধর্মের বাঁধন মানে না। এককালে অবিবাহিত মেয়েরা গাইত টুসু গান, ক্রমশ সবার মধ্যে এবং গোষ্ঠীর সীমা পেরিয়ে বহু মানুষের হয়ে ওঠে এই গানের ধারা। লক্ষ্মী মাহাতোর এই গানে টুসু এক কিশোরী মেয়ের স্বরূপে অধিষ্টিত। গানের শেষ অংশে সম্ভবত পার্বণের সমাপন ঘোষিত হয়েছে।

টুসু নাকি দক্ষিণ যাবে
খিদা লাগলে খাবে কি?
আনো টুসুর গায়ের গামছা
ঘিয়ের মিঠাই বেঁধে দি।

তোদের ঘরে টুসু ছিল
তেই করি আনাগোনা,
এইবার টুসু চলে গেল
করবি গো দুয়ার মানা।


কভারচিত্র ও অনুবাদ: স্মিতা খাটোর

ಪಿ. ಸಾಯಿನಾಥ್ ಅವರು ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾದ ಸ್ಥಾಪಕ ಸಂಪಾದಕರು. ದಶಕಗಳಿಂದ ಗ್ರಾಮೀಣ ವರದಿಗಾರರಾಗಿರುವ ಅವರು 'ಎವೆರಿಬಡಿ ಲವ್ಸ್ ಎ ಗುಡ್ ಡ್ರಾಟ್' ಮತ್ತು 'ದಿ ಲಾಸ್ಟ್ ಹೀರೋಸ್: ಫೂಟ್ ಸೋಲ್ಜರ್ಸ್ ಆಫ್ ಇಂಡಿಯನ್ ಫ್ರೀಡಂ' ಎನ್ನುವ ಕೃತಿಗಳನ್ನು ರಚಿಸಿದ್ದಾರೆ.

Other stories by P. Sainath
Video Editor : Sinchita Parbat

ಸಿಂಚಿತಾ ಪರ್ಬತ್ ಅವರು ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾದ ಹಿರಿಯ ವೀಡಿಯೊ ಸಂಪಾದಕರು ಮತ್ತು ಸ್ವತಂತ್ರ ಛಾಯಾಗ್ರಾಹಕರು ಮತ್ತು ಸಾಕ್ಷ್ಯಚಿತ್ರ ನಿರ್ಮಾಪಕರು. ಅವರ ಹಿಂದಿನ ವರದಿಗಳು ಸಿಂಚಿತಾ ಮಾಜಿ ಎಂಬ ಹೆಸರಿನಲ್ಲಿವೆ.

Other stories by Sinchita Parbat
Translator : Smita Khator

ಸ್ಮಿತಾ ಖಾಟೋರ್ ಪೀಪಲ್ಸ್ ಆರ್ಕೈವ್ ಆಫ್ ರೂರಲ್ ಇಂಡಿಯಾ (ಪರಿ) ನ ಭಾರತೀಯ ಭಾಷೆಗಳ ಕಾರ್ಯಕ್ರಮವಾದ ಪರಿಭಾಷಾ ಯೋಜನೆಯ ಮುಖ್ಯ ಅನುವಾದ ಸಂಪಾದಕರು. ಅನುವಾದ, ಭಾಷೆ ಮತ್ತು ಆರ್ಕೈವಿಂಗ್ ಅವರ ಕೆಲಸದ ಕ್ಷೇತ್ರಗಳು. ಅವರು ಮಹಿಳೆಯರ ಸಮಸ್ಯೆಗಳು ಮತ್ತು ಕಾರ್ಮಿಕರ ಬಗ್ಗೆಯೂ ಬರೆಯುತ್ತಾರೆ.

Other stories by Smita Khator