“এই জায়গায় বিয়ে করে পস্তাচ্ছি গো।”

২৯ বছরের রোজি তাঁর নববিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন। অবশ্য তিনি একা নন। শ্রীনগরের ডাল হ্রদ এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা বলেন যে কোনও মেয়েই এখানে বিয়ে করে আসতে চায় না। “ইতিমধ্যেই তিনটে বাড়ি থেকে জবাব দিয়ে দিয়েছে,” গুলশন নাজির জানালেন। ছোটোছেলের জন্য হন্যে হয়ে সম্বন্ধ দেখছেন তিনি, “মায় ঘটকরাও এই তল্লাটে আর পা রাখে না।”

কারণটা জানালেন বারূ মহল্লার গুলশন নাজির: রাজ্যের বৃহত্তম মিঠাপানির সরোবরে থাকা সত্ত্বেও তীব্র জলসংকটে নাজেহাল হয়ে উঠেছেন এখানকার বাসিন্দারা।

“ন’বছর আগে, নিজের নিজের নৌকায় চড়ে আমরা ডাল লেকের বিভিন্ন অংশ থেকে পানি জোগাড় করে আনতাম,” বললেন মুশতাক আহমেদ, পেশায় একজন ছুতোর। “একটাও জলের ট্যাংকার ছিল না।”

অথচ এক দশক পেরিয়ে গেছে, হররোজ সকাল ৯টা বাজলেই সরকারি ওয়াটার ট্যাংকারের ইন্তেজারে প্রধান সড়কে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন মুশতাক সাহেব। তাঁর ১০ সদস্যের পরিবারটি গুডূ মহল্লায় থাকে, রোজগেরে বলতে তিনি একা। কষ্টটা খানিক লাঘব করবেন বলে নিজের গাঁট থেকে হাজার কুড়ি-পঁচিশ টাকা খসিয়ে জল-ধরার ট্যাংক কিনেছেন, নলও বসিয়েছেন। “কারেন্ট থাকলে তবেই এটা কাজ করে, শীতকালে যেটা কিনা কাশ্মীরে বড্ড সমস্যার,” বললেন তিনি। এ মাসে (মার্চ) বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার গড়বড় করেছিল, তাই বালতি বালতি পানি বয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা।

Left: Hilal Ahmad, a water tanker driver at Baroo Mohalla, Dalgate says, 'people are facing lot of problems due to water shortage.'
PHOTO • Muzamil Bhat
Right: Mushtaq Ahmad Gudoo checking plastic cans (left) which his family has kept for emergencies
PHOTO • Muzamil Bhat

বাঁদিকে: বারূ মহল্লার ডালগেট পাড়ার হিলাল আহমেদ জলের ট্যাংকার চালান, তাঁর জবানে, ‘পানির ঘাটতি হওয়ায় লোকের মুসিবতের অন্ত নেই।’ ডানদিকে: প্লাস্টিকের জেরিকেন খুঁটিয়ে দেখছেন মুশতাক আহমেদ গুডূ, বিপদ-আপদের কথা ভেবে এগুলো তাঁর বাড়ির লোকে মজুত করে রেখেছে

ওদিকে মুর্শিদাবাদ জেলার বেগুনবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের হিজুলি গাঁয়ের মানুষজনেরও পানীয় জল জোটে সেই ট্যাংকার থেকেই। তবে হ্যাঁ, বেগুনবাড়ি এলাকায় কেবল প্রাইভেট জোগানদাররাই পানি সরবরাহ করে, ২০ লিটারের ক্যান ভরার জন্য খসে যায় ১০ টাকা।

“দেখুন, এ বাদে আমাদের আর কোনও উপায় নেই, এই জলটাই কিনে খাচ্ছি। কোনও কারণে মিস্ হয়ে গেলে খাওয়ার মতো একফোঁটা পানিও থাকবে না,” লালবানু বিবি জানাচ্ছেন।

বোঝাই যাচ্ছে, রোজি, মুশতাক আহমেদ ও লালবানুর মতো মানুষজন কেন্দ্র সরকারের জল জীবন মিশনের (জেজেএম) সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না। জেজেএমের ওয়েবসাইট মোতাবেক ৭৫ শতাংশ (মোট ১৯ কোটি) গ্রামীণ গেরস্থের নাগালে নিরাপদ পানীয় জল পৌঁছে গেছে। একথাও বলা আছে যে ২০১৯ সালে ৩.৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করায় পাঁচ বছরে জলের কলের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে, তাই ৪৬ শতাংশ গ্রামীণ ঘরে আজ ট্যাপ-ওয়াটার সংযোগ বর্তমান।

হ্যাঁ, ২০১৭-১৮ সালে বিহার রাজ্য সরকারের সাত নিশ্চয় যোজনার আওতায় আকবরপুর গাঁয়ে চিন্তা দেবী ও সুশীলা দেবীর বাড়িতে আলবাৎ কল বসেছিল। “৬-৭ বছর হয়ে গেল নল বসেছে। ট্যাংকও বসিয়ে গেছে। তবে আজ অবধি এই কল দিয়ে একটা ফোঁটাও জল বেরোয়নি,” চিন্তা দেবী বললেন।

তার কারণ চিন্তা দেবী আর সুশীলা দেবী দুজনেই দলিত। ৪০টি দলিত গেরস্থালি আজ পর্যন্ত জলের মুখদর্শন করেনি, অথচ তথাকথিত উঁচুজাতির ঘরে ঘরে দিব্যি জল চলে এসেছে। অর্থাৎ নির্জলা কল এখন জাতের পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Left: Women wait to fill water in West Bengal. Here in Hijuli hamlet near Begunbari in Murshidabad district, Rajju on the tempo. Lalbanu Bibi (red blouse) and Roshnara Bibi (yellow blouse) are waiting with two neighbours
PHOTO • Smita Khator
Right: In Bihar's Nalanda district, women wait with their utensils to get water from the only hand pump in the Dalit colony of Akbarpur panchayat
PHOTO • Umesh Kumar Ray

বাঁদিকে: পানির আশায় লাইন, পশ্চিমবঙ্গের চিত্র। এটি মুর্শিদাবাদ জেলার বেগুনবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন হিজুলি জনপদ। টেম্পোতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি রাজ্জু। আরও দুই পড়শির সঙ্গে অপেক্ষারত লালবানু বিবি (লাল ব্লাউজ পরিহিতা) ও রোশনারা বিবি (হলুদ ব্লাউজ গায়ে)। ডানদিকে: বিহারের নালন্দা জেলার আকবরপুর পঞ্চায়েত, এখানকার দলিত বসতিতে মোটে একখানি টিউবওয়েল আছে। জলের আশায় সেখানে ঘটিবাটি নিয়ে লাইন দিয়েছেন মহিলারা

In the Dalit colony of Akbarpur, a tank was installed for tap water but locals say it has always run dry
PHOTO • Umesh Kumar Ray
Right: The tap was erected in front of a Musahar house in Bihar under the central Nal Jal Scheme, but water was never supplied
PHOTO • Umesh Kumar Ray

আকবরপুরের দলিত কলোনিতে নলের পানি আসবে বলে ট্যাংকি বানানো হয়েছে, তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন যে আজ পর্যন্ত একফোঁটাও জল আসেনি কলে। ডানদিকে: কেন্দ্রের নল জল যোজনার আওতায় একটি মুসহর বাড়িতে এই কলটি বসানো হয়েছিল, তবে জল আর চালু হয়নি

আকবরপুরের যে দলিত কলোনিতে তাঁরা থাকেন, সেখানে মোটে একখান টিউবওয়েলের ভরসায় বেঁচে আছে মুসহর ও চামার বেরাদরির সদস্যরা (যথাক্রমে এই রাজ্যের অত্যন্ত অনগ্রসর জাতি ও তফসিলি জাতির তালিকায় নিবন্ধিত)।

হ্যান্ডপাম্পটা মাঝেসাঝেই দেহ রাখে, তখন “নিজেরাই চাঁদা তুলে সারানোর ইন্তেজাম করি,” ৬০ বছর বয়সি চিন্তা দেবী জানালেন। তিনিও নালন্দা জেলার এই দলিত কলোনিতেই থাকেন। উপায় অবশ্য আরেকটা আছে, উচ্চবর্ণের যাদবদের কাছে গিয়ে হাত পাতা, তবে চিন্তা কাকির কথায় বাবুরা হামেশাই জল দিতে মানা করে দেন।

জাতীয় দলিত মানবাধিকার অভিযান (এনসিডিএইচআর) থেকে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, ভারতবর্ষে যত দলিত অধ্যুষিত গ্রাম আছে, তার প্রায় অর্ধেকের নাগালে কোনও জলের উৎস নেই। উপরন্তু ২০ শতাংশেরও বেশি দলিত জনপদের মানুষ নিরাপদ পানীয় জলের অভাব নিয়ে বেঁচে আছেন।

কথাটা আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও খাটে — পালঘর, মহারাষ্ট্রের কে ঠাকুর আদিবাসী রাকু নাগাড়ে জানাচ্ছেন। তাঁদের গোন্ডে খুর্দ গ্রামে “কোনদিনও ট্যাংকার আসে না।” ১,১৩৭ জন বাসিন্দা একখানা কুয়োর দয়ায় টিকে আছেন, যেটা কিনা গরম পড়লেই শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়, তখন, “একটা কলশি (কলসি) মাথায়, আরেকটা হাতে তুলে বনজঙ্গল ঠেঙিয়ে হাঁটতে হয় আমাদের। কোত্থাও কোনও সড়কের নামগন্ধ নেই,” বললেন তিনি।

ঘরসংসারের চাহিদা মেটাতে যতটা জল প্রয়োজন, তা আনতে মোট তিনবার পাড়ি দিতে বাধ্য হন রাকু নাগাড়ে — ন’ঘণ্টায় আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার হাঁটা।

*****

Shivamurti Sathe (right) is an organic farmer from Kakramba and sells his produce daily in the Tuljapur market in Maharashtra. He has seen five droughts in the last six decades, and maintains that the water crisis is man-made
PHOTO • Jaideep Hardikar
Shivamurti Sathe (right) is an organic farmer from Kakramba and sells his produce daily in the Tuljapur market in Maharashtra. He has seen five droughts in the last six decades, and maintains that the water crisis is man-made
PHOTO • Medha Kale

কাকরাম্বা গাঁয়ের জৈবচাষি শিবমূর্তি সাঠে (ডানদিকে) হররোজ তাঁর খেতের ফসল বেচতে আসেন মহারাষ্ট্রের তুলজাপুর হাটে। গত ছয় দশকে পাঁচটি খরার সাক্ষী থেকেছেন সাঠে কাকা, তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, জলসংকট ইনসানের বানানো ব্যাপার বই আর কিছু নয়

কাকরাম্বা গাঁয়ের চাষি শিবামূর্তি সাঠে তাঁর ছয় দশকের জীবনকালে পাঁচ-পাঁচটা খরা দেখেছেন।

তিনি বলেন, এককালে মহারাষ্ট্রের তুলজাপুর অঞ্চলে যে জমি শস্য-শ্যামলা ছিল, গত দুই দশকে তা ঊষর হয়ে গেছে। একফালি ঘাসও আর গজায় না। তাঁর মতে, এর জন্য দায়ী ট্রাক্টর: “যখন ঔট [লাঙল] আর বলদ ছিল, তখন মাটিতে গজানো ঘাস থেকে ওয়াসান [প্রাকৃতিক বাঁধ] সৃষ্টি হত, তাতে জলের প্রবাহ বাধা পেয়ে ধীরে ধীরে চুঁইয়ে ঢুকত। ট্রাক্টর এসে মাটিটা খুলে দিয়েছে, তাতে জলটুকু এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে সরাসরি বয়ে চলে যাচ্ছে।”

১৯৭২ সাদের কথা মনে পড়ে সাঠে কাকা, সেই ন’বছর বয়সে যখন “জীবনের প্রথম আর সবচাইতে ভয়াবহ খরার” সাক্ষী ছিলেন, “পানি ফুরোয়নি বটে, তবে খাবারদাবার সব নিঃশেষ হয়ে যায়। খরা কাটার পর আজও জীবনটা ঠিক আগের মতো হয়নি।” তুলজাপুর শহরে তিনি শাকসবজি আর সফেদা বেচেন রোববারের হাটে। ২০১৪ সালের খরায় তাঁর আম বাগানের এক একর চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। “মাটির তলার পানি বড্ড বেশিই ব্যবহার করে ফেলেছি, আর হরেক কিসিমের বিষাক্ত সব রাসায়নিক ইস্তেমাল করতে গিয়ে জমিনটাও পতিত হয়ে গেছে।”

দেখতে দেখতে মার্চ মাস এসে গেছে, তিনি বলছেন, “উমিদ আছে মে নাগাদ খানিক প্রাক-বর্ষার বৃষ্টি হবে, নইলে এ বছরটা কেমনভাবে যে কাটাব তা বুঝে উঠতে পারছি না।” পানীয় জলের চরম সংকট। “৩০০ টাকায় এক হাজার লিটার পানি কিনছি আমরা। আর শুধু যে মানুষের জন্য তা তো নয়, গবাদি পশুদেরও তো জল খেতে হয়।”

উপরন্তু পশুখাদ্যের অভাবে গরু-ছাগল মারা যাচ্ছে, ফলে চাষিদের পক্ষে আগামী মরসুমের অনিশ্চয়তা সামলানো ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠেছে — স্বামীনাথন কমিশনের প্রথম রিপোর্টে একথা স্পষ্ট বলা আছে: “এভাবে খরা হলে তা আর সাময়িক থাকে না, বরং চিরতরে পঙ্গু করে দেয়।”

Left: Droughts across rural Maharashtra forces many families into cattle camps in the summer
PHOTO • Binaifer Bharucha
Right: Drought makes many in Osmanabad struggle for survival and also boosts a brisk trade that thrives on scarcity
PHOTO • P. Sainath

বাঁদিকে: গরমকাল এলেই, গ্রামীণ মহারাষ্ট্র জুড়ে চলতে থাকা খরায় বহু পরিবার পশু-শিবিরে এসে মাথা গোঁজে। ডানদিকে: খরার তাণ্ডবে নাজেহাল ওসমানাবাদের জনজীবন, তবে অভাবের সুযোগে জলের ব্যবসাও বেশ রমরমিয়ে চলছে

PHOTO • Priyanka Borar

প্রকাশিতব্য কচ্ছি গীতিমালার একটি গানের দু’কলি তুলে ধরেছে জলকষ্ট নিবারণে সরকার বাহাদুরের নেওয়া পদক্ষেপে আম জনতার অবিশ্বাসের কথা। সর্দার সরোবর বাঁধ - কচ্ছের হতদরিদ্র চাষিদের কষ্ট লাঘবের দোহাই দিয়ে যে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো হয়েছিল বটে, জলের সরবরাহ করতে সেটি চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। খাওয়ার জল পাঠানো হচ্ছে উৎপাদনে, কৃষিক্ষেত্র থেকে কলকারখানায়, গরিবের মুখ থেকে বড়োলোকের হাতের মুঠোয়, ফলে চাষির দুর্দশা বেড়েই চলেছে

২০২৩ সালের জুন আর সেপ্টেম্বরের মাঝে তুলজাপুরের ধরাশিব ব্লকে (পুরোনো নাম ওসমানাবাদ) কেবল ৫৭০.৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল (যেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক হার ৬৫৩ মিলিমিটার)। এর অর্ধেক বৃষ্টি তো মোটে ১৬ দিনেই ঝরে পড়েছিল, জুলাইয়ে। জুন, অগস্ট ও অক্টোবর মাসের ৩-৪ সপ্তাহ ধরে শুখা সময় চলায় মাটি পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্দ্রতা পায়নি, জলাশয়গুলোও শুকনো রয়ে যায়।

তাই কাকরাম্বার চাষিদের আজ মাথায় হাত: “যতটা দরকার, [এখন] তার ৫-১০ শতাংশের বেশি পাচ্ছি না। সারাটা গাঁয়ে দেখুন, হান্ডা-কলশির লম্বা লম্বা লাইন পড়ে গেছে,” পারি’র এই সাংবাদিককে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন শিবমূর্তি সাঠে।

তাঁর কথায়, “এ তো [খরা-সম পরিস্থিতি] পুরোটাই মানুষের বানানো।”

ঠিক সেরকমই সংকটে নাভিশ্বাস উঠছে মুর্শিদাবাদ জেলার; একে জলকষ্টে রক্ষে নেই, সঙ্গে দোসর হয়েছে এখানকার ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের দূষণ। পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় সমতলে ভাগীরথীর কোলে অবস্থিত এই জেলায় এককালে মিঠাপানির টিউবওয়েল কম ছিল না, আজ সেগুলো দ্রুতগতিতে শুকিয়ে যাচ্ছে।

বেগুনবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে (জনগণনা ২০১১ মোতাবেক জনসংখ্যা ১০,৯৮৩) আজও পেয় জলের আজও কোনও ট্যাপ নেই, তাই হ্যান্ডপাম্পই একমাত্র ভরসা। রোশনারা বিবি জানাচ্ছেন, “আমরা টিউবওয়েল ব্যবহার করতাম, কিন্তু সবই [২০২৩ থেকে] শুকিয়ে গেছে। বেলডাঙ্গা ১ ব্লকের জলাশয়গুলোরও একই হাল। পুকুর-ডোবার পানি দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে।” তাঁর মতে এর পিছনে দুটি কারণ আছে — প্রথমত অনাবৃষ্টি, দ্বিতীয়ত শ্যালো পাম্পের বাড়বাড়ন্ত, যা দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ভূগর্ভস্থ জল তুলে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।

In Murshidabad, shallow pumps (left) are used to extract ground water for jute cultivation. Community tanks (right) are used for retting of jute, leaving it unusable for any household use
PHOTO • Smita Khator
In Murshidabad, shallow pumps (left) are used to extract ground water for jute cultivation. Community tanks (right) are used for retting of jute, leaving it unusable for any household use
PHOTO • Smita Khator

মুর্শিদাবাদ জেলায়, পাটচাষের জন্য শ্যালো পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলা হচ্ছে। পাট জাগ দেওয়ার জন্য বারোয়ারি পুকুর, নালা, বিলের জল ইস্তেমাল হয়, ফলত গৃহস্থালির প্রয়োজনে আর ওইসব জলাধারের জল ব্যবহার করা যায় না

ভূগর্ভস্থ জল-ই ভারতের কৃষিক্ষেত্র ও গেরস্থালির প্রয়োজনে ব্যবহৃত জলের অন্যতম উৎস। গ্রামীণ জল সরবরাহের ৮৫ শতাংশ আসে এই উৎস থেকেই। জানা যাচ্ছে এই রিপোর্ট থেকে।

লাগাতার বৃষ্টির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বছর বছর বর্ষায়, যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে এ অঞ্চলে, জাহানারা বিবি (৪৫) বোঝালেন আমাদের। হিজুলি জনপদের যে পরিবারে তাঁর নিকাহ হয়, তাঁরা প্রত্যেকেই পাটচাষি। “পর্যাপ্ত জল থাকলে তবেই গিয়ে পাট কাটা হয়, কারণ কাটার পর জলে জাগ দেওয়া হয়, পানির জোগান ছাড়া যে প্রক্রিয়া সম্ভব নয়। পাট কাটার পর ফেলে রাখা চলে না, পচন ধরে বারোটা বেজে যাবে।” অগস্ট  মাসের (২০২৩) শেষে যদি দেখেন যে বেলডাঙ্গা ১ ব্লকের মাঠে মাঠে সারি সারি সম্পূর্ণ তৈরি পাটগাছ তখনও দাঁড়িয়ে আছে, মৌসুমি বৃষ্টির চরম ঘাটতিটা আপনা-আপনিই প্রমাণ হয়ে যায়।

উপরন্তু এ তল্লাটে আর্সেনিকের এমন মুসিবত যে হ্যান্ডপাম্পের উপরেও ভরসা করা যায় না, অধিবাসীরা পারিকে জানালেন। যে কটা জেলার ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক মেলে, তাদের মধ্যে মুর্শিদাবাদ অন্যতম — ত্বক, স্নায়ু ও প্রসূতি স্বাস্থ্যে যার কুপ্রভাব বিদ্যমান।

দিনে দিনে আর্সেনিক দূষণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, মানুষ আর চোখ বন্ধ করে টিউবওয়েলের উপর ভরসা করেন না। এই পরিস্থিতিতেও, মানুষ আজ সম্পূর্ণ রূপে বেসরকারি জল ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভরশীল। তবে আসল প্রহসনটা কোথায় জানেন? ডিলারদের থেকে কেনা জলটা আদৌ নিরাপদ কিনা, সেটাও তো কেউ জানেন না।

পানির ট্যাংকার এসে কিছু বাচ্চাকে ঘরকুনো হওয়ার থেকে আটকেছে। এই যেমন ধরুন রাজ্জু, বেগুনবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে সে, থাকে হিজুলি জনপদে। ট্যাংকার থেকে বাড়ি অবধি জল বয়ে আনে সে। এই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চোখ টিপে রাজ্জু বলে উঠল, “ঘরে বসে পড়াশোনার করার থেকে এটা ঢের ভালো।”

এ এলাকায় ওর মতো খুদে জলবাহী আরও অনেকেই আছে। হিজুলি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূর, কাজিসাহায় দেখলাম ডিলারের নির্দেশ মোতাবেক অত্যন্ত উৎসাহী কিছু ছেলেপুলে ঘড়া আর জলের ক্যান ভরতে বড়োদের হাতে হাতে সাহায্য করছে। বাচ্চাদের কথায় এটা করতে তাদের খুবই ভাল্লাগে, কারণ, “ভ্যানগাড়ির পিছনে বসে বসে দিব্যি গোটা গাঁয়ে চরে বেড়াতে পারি।”

Left: In Hijuli and Kazisaha, residents buy water from private dealers. Children are often seen helping the elders and also hop on to the vans for a ride around the village.
PHOTO • Smita Khator
Right: Residents of Naya Kumdahin village in Dhamtari district of Chhattisgarh have to fetch water from a newly-dug pond nearby or their old village of Gattasilli from where they were displaced when the Dudhawa dam was built across the Mahanadi river
PHOTO • Purusottam Thakur

বাঁদিকে: বেগুনবাড়ি ও কাজিসাহার লোকে বেসরকারি ডিলারদের কাছে জল কিনতে বাধ্য হন। হামেশাই দেখা যায়, বাচ্চারা বড়োদের মদত করছে আর জলের ভ্যানগাড়ি চেপে সারা গাঁয়ে টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডানদিকে: মহানদীর উপর দুধাওয়া বাঁধ নির্মাণের সময় গাট্টাসিলি গ্রামের মানুষজন বাস্তুচ্যুত হয়ে ছত্তিশগড়ের ধামতারি জেলার নয়া কুমদাডিহিনে গিয়ে বাসা বাঁধেন, আজ জল আনতে হয় তাঁরা কাছের একটি সদ্য খোঁড়া পুকুরে যান, কিংবা ফেলে আসা গাঁয়ে

PHOTO • Sanviti Iyer

পুরন্দর তালুকের পোখর গাঁয়ের শাহুবাই পোমান জানাচ্ছেন যে আটা গুঁড়ানো ও আনাজদানা পেষার কাজটা মারাত্মক শ্রমসাধ্য ঠিকই, তবে মাইলে-কে-মাইল পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন জল বয়ে আনার চেয়ে ঢের সহজ। রাজগুরুনগরের দেব তোরণ গ্রামের পার্বতীবাই আওয়ারি বলছেন যে তাঁর গাঁয়ের মেয়েদের নসিব ভালো, কারণ গ্রামের ভিতরেই একটা জলে টইটুম্বুর কুয়ো আছে, সবাই সেখানেই জল আনতে যায়। পরিবারের জন্য জল আনার কাজটা ঘরের মেয়েবউদের উপরেই বর্তায়। তবে দূর-দূর হেঁটে পানি আনার চেয়ে হাতের কাছে একখান কুয়ো থাকা শতসহস্রগুণ ভালো। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি, পুণে জেলায় ঘুরে ঘুরে এই গানগুলি রেকর্ড করেছিল জাঁতাপেষাইয়ের গান প্রকল্পের আদি দলটি। গানগুলি রচিত হয়েছিল আরও আগে – বছর বছর নতুন করে ভরে ওঠা জল নদী আর কুয়ো থেকে তোলা যেত। জল আর অভাব  - শব্দ দুটো আজকের দিনের মতো সমার্থক ছিল না তখন

মুর্শিদাবাদে আর্সেনিক আর পালঘরে অতিসার (ডায়রিয়া) — জায়গাদুটো হাজার হাজার কিলোমিটার তফাতে থেকেও আজ জলসম্পদ ঘিরে সংকটের নিরিখে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

রাকু নাগাড়ের কথায়, তাঁর গাঁয়ের কুয়োটার জলস্তর হুহু করে নামছে। এটি ছাড়া গোন্ডে খুর্দের ২২৭টি পরিবারের কাছে আর কোনও জলের উৎস নেই। “জলের উৎস বলতে আমাদের সবচাইতে কাছে এটাই আছে কেবল, আর একটাও নেই,” জানাচ্ছেন তিনি। মোখাড়া তালুকের এই গ্রামে অধিকাংশ মানুষই কে ঠাকুর জনজাতির সদস্য।

দুবছর আগে, ছেলে দীপক অতিসার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, মনে হয় পানির থেকেই। ২০১৮ সালের একটি স্যাম্পল স্টাডি বলছে, পালঘর জেলার ন’টি গাঁয়ে প্রতি তিনজন শিশুর একজন করে (৩৩.৪ শতাংশ) ডায়রিয়ায় ভোগে। ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রাকু তাই অবশ্য হররোজ পানি ফুটিয়ে খাওয়া চালু করেছেন।

তবে ফোটানোর আগে জলটুকু সেই রাকু তাইকেই বয়ে আনতে হয়। গরমকালে কুয়ো শুকিয়ে গেলে গ্রামের মহিলারা প্রায় নয় কিলোমিটার পেরিয়ে ওয়াঘ নদীতে যান। তিন ঘণ্টার এই যাত্রাটা দিনে দু’তিনবার করে করতে হয়, হয় সাত সকালে, কিংবা সূর্যাস্তের পর যখন তাপমাত্রা খানিকটা হলেও সহ্যসীমার মধ্যে থাকে।

ভারত উপমহাদেশ জুড়ে জল-সংক্রান্ত গৃহস্থালির কাজ নেহাতই অনায্য ভাবে নারীর ঘাড়ে এসে পড়ে। ১৫ বা তার বেশি বয়সের ৭১ শতাংশ মেয়েরা সংসারের প্রয়োজনে লাগা যাবতীয় জল বয়ে আনেন (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৯-২১)।

ইউনিসেফের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৫৪ শতাংশ গ্রামীণ মহিলা রোজ রোজ জল বয়ে আনতে ৩৫ মিনিট করে সময় কাটান, এঁদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক তরুণীরাও আছে। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, জল বইতে গিয়ে বার্ষিক ২৭ দিনের মজুরি খোওয়া যাচ্ছে।

“মরদরা তো কামকাজে [বাইরে] যায়, তাই রান্নাবান্নার পানিটুকু আমাদেরকেই নিয়ে আসতে হয়। সকাল সকাল কলতলায় বেজায় ভিড় জমে,” চিন্তা দেবী বললেন, “বিকেলে চান-টান আর কাপড় কাচার জল লাগে, তারপর সন্ধে নামলেই রাতের খাবার রাঁধার জন্য আরেক দফা পানির প্রয়োজন।”

Left: In Gonde Kh village in Palghar district, a single well serves as the water-source for the entire community, most of whom belong to the K Thakur tribe.
PHOTO • Jyoti Shinoli
Right: When the well dries up in summer, the women have to walk to the Wagh river to fetch water two to three times a day
PHOTO • Jyoti Shinoli

বাঁদিকে: পালঘর জেলার গোন্ডে খুর্দ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কে ঠাকুর আদিবাসী। গ্রামের সবাই এই একটা কুয়োর ভরসাতেই দিন গুজরান করেন। ডানদিকে: গরম পড়লে কুয়োর পানি শুকিয়ে যায়, মেয়েরা তখন প্রতিদিন দু-তিনবার করে ওয়াঘ নদীতে জল আনতে যান

Left: Young girls help their mothers not only to fetch water, but also in other household tasks. Women and girls of the fishing community in Killabandar village, Palghar district, spend hours scraping the bottom of a well for drinking water, and resent that their region’s water is diverted to Mumbai city.
PHOTO • Samyukta Shastri
Right: Gayatri Kumari, who lives in the Dalit colony of Akabarpur panchayat, carrying a water-filled tokna (pot) from the only hand pump in her colony. She says that she has to spend at least one to two hours daily fetching water
PHOTO • Umesh Kumar Ray

বাঁদিকে: ঘরকন্নার কামকাজ ছাড়াও মায়েদের পানি আনতে সাহায্য করে অল্পবয়সি মেয়েরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুয়োর তলা ছেঁচে পানীয় জল জোগাড় করছেন পালঘর জেলার কিল্লাবন্দর গ্রামের মেয়েবউরা। এ অঞ্চলের পানি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুম্বই নগরে, সে নিয়ে এখানকার লোক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ডানদিকে: কলোনির একমাত্র হ্যান্ডপাম্প থেকে টোকনা (কলসি) ভরা জল নিয়ে ঘরে ফিরছেন গায়ত্রী কুমারী, আকবরপুর পঞ্চায়েতের একটি দলিত বসতির বাসিন্দা। তিনি জানাচ্ছেন যে রোজ রোজ এক-দুঘণ্টা শুধু জল আনতেই বেরিয়ে যায়

এই দলিত বসতিতে জলের একমাত্র উৎস সবেধন নীলমণি একখান চাঁপাকল (হ্যান্ডপাম্প), তাই জলের জন্য লম্বা লম্বা লাইন পড়ে যায়। সুশীলা দেবীর (৪৫) কথায়, “এতবড়ো একটা টোলায় [জনপদ] মোটে একখানি চাঁপাকল। টোকনা-বালটি [ঘটিবাটি] নিয়ে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।”

গ্রীষ্মকালে যখন টিউবওয়েলটাও শুকিয়ে যায়, মেয়েরা চাষজমিতে গিয়ে সেচের পানি বয়ে আনেন। “কখনও কখনও তো এক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। জল আনতে বহুত  সময় নষ্ট হয় আমাদের,” সুশীলা দেবী জানালেন।

সন্ধের জলখাবার বানাতে হবে, তার আগে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন “গর্মি বঢ়তি হ্যায় তো হম লোগোঁ কো প্যায়সে মরনে কা নৌবত আ যাতা হ্যায় [গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তেষ্টায় মরার জোগাড় হয় আমাদের]।”

পারির এই বহুস্থানিক প্রতিবেদনটি কাশ্মীর থেকে মুজামিল ভট , পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্মিতা খাটোর , বিহার থেকে উমেশ কুমার রায় , মহারাষ্ট্র থেকে মেধা কালে জ্যোতি শিনোলি এবং ছত্তিশগড় থেকে পুরুষোত্তম ঠাকুর যৌথভাবে লিখেছেন। পারি’র জাঁতাপেষাইয়ের গান প্রকল্প ও কচ্ছগীতি সংকলন থেকে দুটি গান বাছাই করে দিয়েছেন এই প্রকল্পদুটির ব্যবস্থাপক যথাক্রমে নমিতা ওয়াইকর প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়া । গ্রাফিক্সগুলি বানিয়েছেন সম্বিতি আইয়ার

প্রচ্ছদচিত্র: পুরুষোত্তম ঠাকুর

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Editors : Sarbajaya Bhattacharya

सर्वजया भट्टाचार्य, पारी के लिए बतौर सीनियर असिस्टेंट एडिटर काम करती हैं. वह एक अनुभवी बांग्ला अनुवादक हैं. कोलकाता की रहने वाली सर्वजया शहर के इतिहास और यात्रा साहित्य में दिलचस्पी रखती हैं.

की अन्य स्टोरी Sarbajaya Bhattacharya
Editors : Priti David

प्रीति डेविड, पारी की कार्यकारी संपादक हैं. वह मुख्यतः जंगलों, आदिवासियों और आजीविकाओं पर लिखती हैं. वह पारी के एजुकेशन सेक्शन का नेतृत्व भी करती हैं. वह स्कूलों और कॉलेजों के साथ जुड़कर, ग्रामीण इलाक़ों के मुद्दों को कक्षाओं और पाठ्यक्रम में जगह दिलाने की दिशा में काम करती हैं.

की अन्य स्टोरी Priti David
Photo Editor : Binaifer Bharucha

बिनाइफ़र भरूचा, मुंबई की फ़्रीलांस फ़ोटोग्राफ़र हैं, और पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया में बतौर फ़ोटो एडिटर काम करती हैं.

की अन्य स्टोरी बिनायफ़र भरूचा
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र, पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया के भारतीय भाषाओं से जुड़े कार्यक्रम - पारी'भाषा के कॉन्टेंट मैनेजर हैं. उन्होंने कोलकाता की जादवपुर यूनिवर्सिटी से तुलनात्मक साहित्य में एमफ़िल किया है. वह एक बहुभाषी कवि, अनुवादक, कला-समीक्षक और सामाजिक कार्यकर्ता भी हैं.

की अन्य स्टोरी Joshua Bodhinetra