কমলাবাই গুঢ়ের বয়স এখন ষাটের কোঠার মাঝমাঝি। তবু বর্ষীয়ান এই কৃষক যখনই পারেন শ্রমিকের কাজে লেগে পড়েন। নগদ টাকার বদলে তিনি শ্রম দেন শস্যের বিনিময়ে। এই একটা জিনিসই কোনওমতে জুটিয়ে উঠতে পারেন তিনি। সুতরাং কখনও কখনও ২৫ টাকার জোয়ারের জন্য ১২ ঘণ্টা ধরেও পরিশ্রম করতে হয় তাঁকে। তাও তো এসব তাঁর নিজের সাড়ে চার একর জমির খাটাখাটনির বাইরের কাজ। তাঁর খেতটা জঙ্গলের প্রান্তে হওয়ায় ভালো ফলন হয় বটে, তবে জংলি পশুদের দৌরাত্ম্যেই সব ছারখার হয়ে যায়। তাঁর তুলো আর সোয়াবিনের ফলন যত ভালো হয়, ততই বেশি করে বুনো শুয়োর আর নীলগাইদের নজরে পড়ে সেসব। এদিকে খেতে বেড়া দিতে গেলে সেও প্রায় ১ লক্ষ টাকার ধাক্কা। সেই পরিমাণ অর্থের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তিনি।

গত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের কৃষিক্ষেত্রে নেমে আসা সংকটকালে, চাষিদের লাগাতার আত্মহত্যার ঘটনায় স্বামীহারা এক লক্ষেরও বেশি মহিলার মধ্যে কমলাবাই একজন। যে অঞ্চলকে এসব ঘটনার জের পোহাতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি, সেই বিদর্ভেরই বাসিন্দা তিনি। তাঁর গ্রাম লোনসাওলা ওয়ার্ধা জেলায় পড়ে, যা আবার এই অঞ্চলের এমন ছয়টা জেলার মধ্যে অন্যতম যেখানে ২০০১ সাল থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ৬,০০০-এরও বেশি কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন।

ঋণে জর্জরিত তাঁর স্বামী পলাশরাম এক বছর আগে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাও তিনি হার মানেননি। খেত চালানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণ, থাকছেন এমন একটা বাড়িতে যার অর্ধেক ছাদ উধাও, দুই দেওয়াল ধ্বসে পড়ার মুখে। এই ছোট্ট লড়ঝরে আস্তানায় পাঁচ-পাঁচটা মানুষের বাস। তাঁকে ছাড়া বাকি সদস্য বলতে তাঁর ছেলে, পুত্রবধূ আর দুই নাতি-নাতনি। সমাজের চোখে কমলাবাই একজন ‘বিধবা’। আদতে তিনি একজন ক্ষুদ্রচাষি যিনি প্রাণপাত করে জীবিকানির্বাহ করছেন যাতে করে সংসারটা চালানো যায়।

PHOTO • P. Sainath

লোনসাওলায় নিজের বাড়িতে কমলাবাই গুঢ়ে। হাতে কাজ জুটলে পারিশ্রমিক বাবদ শুধু শস্য পান তিনি। সাধারণত, একদিনের কাজের বিনিময়ে ২৫ টাকার জোয়ার মেলে

একজন ভূমিহীন দলিত কেমনভাবে একটা গোটা জমির মালিক হলেন? ঠিক যেভাবে তিনি তাঁর সংসার টেনে চলেছেন এখন। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে লড়ে যেতে হয়েছে কমলাবাইকে। দিনপ্রতি ১০-১২ টাকা মজুরিতে কৃষিশ্রমিকের কাজ শুরু করেন তিনি। প্রায় চার দশক আগের সেই সময়টার কথা বলতে গিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন, “তখন এই টাকায় আরও অনেক কিছু কেনা যেত।” এছাড়া পশুখাদ্য সংগ্রহ করে সেসব কৃষকদের কাছে বেচেও বাড়তি কটা টাকা আসত।

খেতজমি বাঁচিয়ে রাখতে কমলাবাইয়ের এই নাছোড় চেষ্টা মূলত যাঁর জন্য, সেই মানুষটা অর্থাৎ তাঁর ছেলে ভাস্কর বলেন, “আমার মনে আছে কেমন করে আমার মা চারা [পশুখাদ্য] জোগাড় করে সেগুলো প্রায় জলের দরে বিক্রি করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতেন।" কমলাবাই হেসে বললেন, পেন্ডা (একমুঠো) পিছু চারার বদলে দশ পয়সা করে পেতাম, কিন্তু এর জন্য যেমন অনেক ঘুরেছি, তেমনি প্রতিদিন চারা বেচে ১০ টাকা পর্যন্ত কামিয়েছি।” অর্থাৎ, প্রতিদিন ১০০ পেন্ডা চারা আনতে আর বিক্রি করতে যে কত কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে তাঁকে, তার কোনও হিসেব নেই। তাঁর এই ১৬-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রমের ফল অবশ্য তিনি পেয়েছেন। এই যৎসামান্য রোজগার থেকে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে তিনি এবং তাঁর স্বামী এমন এক টুকরো জমি খরিদ করতে পেরেছেন, জঙ্গলঘেঁষা যে জমি অন্য কেউ হলে কিনতেন না। প্রায় ৪০ বছর আগেকার কথা সেসব। তখন ১২ হাজার টাকায় ৪.৫ একর জমি পাওয়া গেছিল। এই পরিবারটি তারপর গাধার খাটনি খেটে নিজেদের এই নাছোড় জমিখানায় আবাদ করত। “আমার আরেক ছেলে ছিল, কিন্তু সে মারা গেছে,” বললেন কমলাবাই।

মধ্য-ষাটের কমলাবাই আজও অনেক দূর হাঁটেন। “কি করব? খেতটা আমাদের গাঁ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে। মজুরের কাজ জুটলে তবেই রোজগার হয়। তারপর ভাস্কর আর বনিতার কাজে হাত লাগাই খেতে গিয়ে।” সরকারি প্রকল্পস্থলে কাজ করার পক্ষে তাঁর বয়স অনেকটাই বেশি। আর তার ওপর আছে একা মহিলা, বিশেষ করে বিধবাদের নিয়ে পাহাড়প্রমাণ কুসংস্কার। অগত্যা, যা জোটে সেই কাজই করেন।

PHOTO • P. Sainath

পুত্রবধূর সঙ্গে কমলাবাই। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার লোনসাওলায় তাঁদের বাড়িতে

নিজেদের মতো করে খেত দেখভালের ভার নিয়েছে এই পরিবারটি। বেশ দেখায় তাঁদের খেতটাকে, ফলনও হয় দিব্যি। “এই কুয়োটা দেখুন,” পারিবারিক শ্রমের ফসল এই বেশ বড়ো কুয়োর দিকে ইঙ্গিত করলেন কমলাবাই। “শুধু যদি এটাকে সাফসুতরো আর মেরামত করিয়ে নিতে পারতাম, তাহলে আজ আরও অনেক বেশি জল থাকত আমাদের হাতে।” কিন্তু সেজন্যেও তো অন্ততপক্ষে হাজার পনেরো টাকার প্রয়োজন। আর জমিতে বেড়া দিতে যে ১ লক্ষ টাকা দরকার তার কথা তো ছেড়েই দিলাম। জমির ঢালের নিচে এক একর জমিতে জলাশয় তৈরি করতে পারলেও মন্দ হত না। কিন্তু তাতে প্রচুর টাকা দরকার। ব্যাঙ্ক ঋণের বন্দোবস্ত করা এখন অসম্ভব। ওদিকে তাঁদের ভেঙে পড়া বাড়িটা ঠিকমতো মেরামতি করতে গেলে সে আরও হাজার পঁচিশেক টাকার ধাক্কা। তাঁর কথায়, “ফসলের ক্ষতির জেরে ১.৫ লক্ষ টাকা দেনা হয়ে গেছে বলেই তো আমার বর নিজের জীবনটা নিজেই শেষ করে দিল।” তাঁরা কিছু কিছু করে এই ঋণ শোধ করেছেন বটে। তবে রাজ্য সরকার থেকে যে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ পেয়েছেন কমলা, তার পুরোটাই প্রায় সংসার চালাতে খরচ হয়ে গিয়েছে। পাওনাদারেরা এখনও তাঁকে উত্যক্ত করে চলেছে। “আমাদের তো ভালোই চলছিল। কিন্তু তারপর কয়েক বছর ধরে চাষাবাদের অবস্থা সত্যিসত্যিই পড়ে গিয়ে আমাদের অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল।”

লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো তাঁর পরিবারকেও কয়েক দশকের সবচেয়ে ব্যাপক কৃষি সংকটের ফল ভুগতে হয়েছিল। ক্রমবর্ধমান পুঁজি, উৎপাদিত শস্যের পড়তি দ্রব্যমূল্য, অমিল ঋণ, সরকারি সহায়তা ব্যবস্থার প্রত্যাহার – সমস্যা নেহাত কম ছিল না। তিনি বললেন, “গ্রামের সবকটা লোকেরই এই এক দশা।” গত বছরও ফসলের বিপর্যয় ঘটেছিল। ভাস্কর বিটি-তুলোর ওপর ভরসা করে ক্ষতিগ্রস্ত হল তখন। আক্ষেপের সুরে কমলাবাই বলে ওঠেন, “আমাদের ভাগ্যে মোটে কুইন্টাল দুয়েক জুটেছিল।”

সরকার এরপর কার্যত লোকসান আরও বাড়িয়ে দেয়। গত বছরের শেষের দিকে, তাঁকে একটি “ত্রাণ প্যাকেজ” -এর “সুবিধাভোগী” করে দেওয়া হয় আর একটা মহার্ঘ্য “আধা জার্সি” গরু কিনতে বাধ্য করা হয়, যেটা আদৌ তিনি চাননি। ভর্তুকি অনেকটা দেওয়া হলেও তাঁকে গরুর মূল্য বাবদ ৫,৫০০ টাকার মধ্যে নিজের ভাগটুকু তো মিটিয়ে দিতেই হয়েছিল। তাঁর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে, “আমরা সকলে মিলে যা খাই, ও ব্যাটা একাই তার চেয়ে বেশি সাবাড় করে দিত। গিলত আমাদের সকলের চেয়ে বেশি, আর দুধের বেলায় এক ছটাক। (দ্য হিন্দু, ২৩ নভেম্বর ২০০৬)

উলট ভাড়া

তারপর থেকে, “আমি দুইবার গরুটা লোকজনকে দিয়ে দিয়েছি, কিন্তু ওরা ঠিক শেষমেশ তাকে ফেরত দিয়ে গেছে,” একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো সুরে বললেন তিনি। যাকেই জন্তুটা উপহার দেন সেই বলে, “আমরা বাবা এর খোরাক জোটাতে পারব না।” তাই এখন, “আমি একজন প্রতিবেশীকে গরুর দেখাশোনা করার জন্য উল্টে মাসে মাসে ৫০ টাকা দিচ্ছি।” একে একরকম উলট ভাড়া বলা চলে। চুক্তি হল গরুটা যদি ঠিকঠাক দুধ দিতে শুরু করে তবে সেই দুধের অর্ধেক ভাগ তাঁর। অবশ্য, এসবই কেবল আশাবাদী ভবিষ্যতের কথা। বর্তমান পরিস্থিতি এই যে: উল্টে কমলাবাইকেই গরুর দেখাশোনা করার জন্য গাঁটের কড়ি খসাতে হচ্ছে। যেখানে কিনা সরকারের প্রতিশ্রুতি মতো গরুটার জন্যই তাঁর খানিকটা আর্থিক সুরাহা হওয়ার কথা।

কিন্তু এখনও অটুট তাঁর স্পৃহা। অন্য কোনও কাজ না জুটলে তিনি এখনও প্রতিদিন খেতের দিকে পায়ে হেঁটেই পাড়ি দেন লম্বা পথ। আজ যখন তাঁর ক্ষুদে ছটফটে নাতি-নাতনিরা তাঁর পায়ে পায়ে হাঁটে, দেখতে কি মজাই না লাগে। ওরা যাতে দুধেভাতে থাকে, একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ সামনে থাকে যাতে ওদের – সেই লক্ষ্যেই অদম্য জেদে এখনও কাজ করে চলেন কমলাবাই। বরাবরের মতোই আজও মাথা উঁচু তাঁর, কিন্তু বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না। কমলাবাই বেশ বুঝতে পেরেছেন যে আত্মহত্যা আদতে মৃতের নয়, বরং অনন্ত যাতনা নিয়ে পড়ে থাকা পরিজনের বাস্তব। আর তাই সেই মানুষগুলোর জন্যই লড়াই জারি রেখেছেন তিনি।

এই নিবন্ধটি ২১ মে ২০০৭ সালে ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদপত্রে প্রথমবার প্রকাশিত হয়েছিল।

অনুবাদ: পারি-ভাষা, বাংলা বিভাগ
অনুবাদ সম্পাদনা: রম্যাণি ব্যানার্জী

पी. साईनाथ, पीपल्स ऑर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया के संस्थापक संपादक हैं. वह दशकों से ग्रामीण भारत की समस्याओं की रिपोर्टिंग करते रहे हैं और उन्होंने ‘एवरीबडी लव्स अ गुड ड्रॉट’ तथा 'द लास्ट हीरोज़: फ़ुट सोल्ज़र्स ऑफ़ इंडियन फ़्रीडम' नामक किताबें भी लिखी हैं.

की अन्य स्टोरी पी. साईनाथ
Translator : PARI Translations, Bangla