গঙ্গাপ্পার বয়স ৮৩। জীবনের সত্তরটা বছর খেতমজুরের কাজ করার পরে তিনি এক নতুন পেশা নেন - পশ্চিম অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর শহরের নানান জনবহুল রাস্তা-মহল্লায় তিনি মহাত্মা গান্ধীর বেশে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই অভিনব উপায়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে পাওয়া উপার্জন জমিতে পরিশ্রম করে করে পাওয়া মজুরির থেকে খানিক বেশিই।
“আমি যখন তোমার বয়সে পৌঁছাব, তখন আমিও তোমার মতোই পোশাক পরব, স্বামী,” গঙ্গাপ্পার দাবি ছোটোবেলায় গান্ধীজি যখন অনন্তপুর সফরে এসেছিলেন, তখন তিনি নাকি ঠিক এই কথাগুলোই তাঁকে বলেছিলেন। “আমার বাবা-মা পেরুরু ট্যাঙ্কে শ্রমিক ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই ছিলাম আমি।” গঙ্গাপ্পার জন্মস্থান চেন্নামপল্লি, পেরুরু থেকে তা খুব একটা দূরে নয়। গান্ধীর অসম্ভবকে অর্জন করার স্পৃহা, স্পর্ধা, ক্ষমতাশালীদের নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা তরুণ গঙ্গাপ্পাকে ভীষণরকম প্রভাবিত করেছিল।
যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে গঙ্গাপ্পার দাবি যাচাই করা বা সেই সাক্ষাতের তারিখ নির্ধারণ করা কঠিন, তবে গান্ধীর সেই স্মৃতিই তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। গঙ্গাপ্পা বেড়াতে ভালোবাসেন। তাঁর বিশ্বাস গান্ধীর মতো হওয়ার জন্য যাত্রা এবং ধৈর্য দুই অপরিহার্য দিক।
গঙ্গাপ্পা (শুধু নামটুকুই ব্যবহার করেন তিনি) জানালেন যে তাঁর নাম এখন গাঙ্গুলাপ্পা কারণ সাধারণ মানুষ ওঁকে এই ভুল নামেই ডাকেন আর সেটাই প্রচলিত হয়ে গেছে। গান্ধীর চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার তাগিদে, তিনি একটি পৈতে জড়িয়ে রাখেন গলায়। কপালে-পায়ে কুমকুম মাখেন এবং গান্ধী বস্ত্র পরিধানের পর মাঝেমধ্যে সন্তের ন্যায় সাধারণ মানুষদের আশীর্বাদ করে থাকেন।
জাতের অনুমিত পরিচয় তাঁর জন্য খুলে দিয়েছে এক স্থানীয় মন্দিরের দরজা। তাঁকে দিনেরবেলা মন্দির চত্বরে পাথরের বেঞ্চে বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই মন্দিরের কলেই রোজ স্নান সারেন, আর সাজসজ্জা ধুয়ে ফেলেন।
স্ত্রী মিদ্দি অঞ্জনাম্মা-সহ নিজের পরিবারের সঙ্গে বিগত এক দশক ধরে গঙ্গাপ্পার সম্পর্ক মধুর নয়। এর শুরুয়াত তাঁদের বড়ো মেয়ের আত্মহত্যার পর থেকে। “আমি জঙ্গলে গর্ত খুঁড়তে কোল্লাপল্লি গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি, মেয়ে মারা গিয়েছে,” মেয়ের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। “আমি এখনও জানি না কেন আমার মেয়ে আত্মহত্যা করল। বাড়ির কেউ আমাকে তার মৃত্যুর কারণ জানায়নি। এই পরিবারের কাছে আমি কেমন করেই বা আর ফিরতে পারি?”
স্বামীর এমন ছন্নছাড়া জীবনযাপন মোটেই অঞ্জনাম্মার পছন্দ নয়। বছর দুই ধরে গঙ্গাপ্পার সঙ্গে কথা বলেননি তিনি, তবুও তাঁর গঙ্গাপ্পাকে মনে পড়ে, তিনি চান স্বামী ফিরে আসুন ঘরে। “দয়া করে ওঁকে ফিরে আসতে বলুন। আমার কাছে মোবাইল ফোন নেই, আর এ মাসে কফি পাউডার কেনার মতো টাকাও নেই। বাচ্চারা (তাঁর ছোটোমেয়ের দুই ছেলে) যে খুচরো পয়সা চায়, সেটুকু পর্যন্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই,” অঞ্জনাম্মা তাঁর ছোটোমেয়ের সঙ্গে অনন্তপুর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে গোরান্টলা গ্রামে থাকেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
গঙ্গাপ্পা বাড়ি ছাড়ার পরেও, খেতে কাজ চালিয়ে গেছেন। মদ্যপানের মাত্রা বেড়েছে আগের চেয়ে। ২০১৬ সালে মাঠে কাজ করার সময় একদিন তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। “মালা পুন্নামির [বাৎসরিক পরব] পরে আমি কৃষিকাজ করা বন্ধ করে দিলাম,” গঙ্গাপ্পা মনে করে বলেন, “তখন কয়েকদিন দড়ি বাঁধার কাজ করেছি কিন্তু আয় হয়নি বিশেষ।”
সেই সময়েই তাঁর মনে আসে গান্ধীর কথা। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেন।
নিত্যব্যবহার্য জিনিস দিয়েই গঙ্গাপ্পা গান্ধী সাজার বন্দোবস্ত করেছিলেন। পন্ডস্-এর দশ টাকা মূল্যের প্লাসটিকের কৌটোর পাউডার গায়ে মাখতেন গান্ধীর জৌলুস আনার চেষ্টায়। গান্ধী সাজার উপকরণ বলতে ছিল ফুটপাথের দোকান থেকে কেনা সস্তার চশমা আর স্থানীয় বাজার থেকে কেনা দশ টাকার লাঠি। কোথা থেকে যেন জুটিয়ে নিয়েছিলেন মোটরবাইকের রিয়ারভিউ আয়নার মতো দেখতে একখানি আয়না – এতেই তিনি নিজের মেকআপ এবং সাজসজ্জা যাচাই করে নিতেন।
গঙ্গাপ্পা যখন মাঠে কাজ করতেন তখন বেশিরভাগ সময়ই হাফপ্যান্ট পরতেন। তিনি জানালেন, “এখন আমি ধুতি পরি এবং তিন-চার দিনে একবার করে মাথা কামাই।” ধূমপান ও মদ্যপান করা সত্ত্বেও, একবার গান্ধীর মতো পোশাক পরে নিলে, নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি আশেপাশের গ্রাম ও শহরগুলির মেলা, বাজার আর হাটে চক্কর দেন। এই করে তাঁর আয় প্রায় ১৫০-৬০০ টাকা থাকে। “আমি সম্প্রতি একটি পার্শায় (গ্রামের মেলা) একদিনে প্রায় ১০০০ টাকা উপার্জন করেছি,” সগর্বে জানালেন গঙ্গাপ্পা।
তিনি আরও বললেন, “আমি আজ টানা ছয় ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম কারণ এখন কাদিরি পুন্নমি।” এই পরবটি অনন্তপুর জেলার কাদিরি এলাকার গ্রামগুলিতে বছরে একবার পালিত হয়, যখন পূর্ণিমার চাঁদ তার উজ্জ্বলতম দীপ্তিতে ছেয়ে ফেলে আকাশ।
কয়েক মাস আগে, নিকটবর্তী শহর পুট্টপার্থি যাওয়ার সময়, গঙ্গাপ্পার সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব বিধবা কুরুবা পূজাম্মার দেখা হয়। পূজাম্মা পুট্টপার্থি এবং পেনুকোন্ডার মধ্যে প্রসারিত ৩৫ কিলোমিটার রাস্তায় ভিক্ষে করতেন। বৃদ্ধা জানালেন “এক সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরছি, দেখি ও একা একা বসে আছে। সে কি করে আমি তা জিজ্ঞেস করলাম। ও জানালো নিজের কথা, আর আমাকে জিজ্ঞেস করল ওর সঙ্গে আমি যেতে চাই কি না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ও বলল, ‘তবে এসো। আমরা যেখানেই যাই, আমি তোমাকে চারপাশ ঘুরিয়ে দেখাব’।” পূজাম্মা গঙ্গাপ্পার সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি গঙ্গাপ্পাকে গান্ধীর সাজ পরিধানে সাহায্য করেন, পিঠে পাউডার গুঁড়ো লাগিয়ে দেন এবং জামাকাপড় ধুয়ে রাখেন।
গঙ্গাপ্পার সঙ্গে পূজাম্মার সম্পর্ক সহজ ছিল না। পূজাম্মার কথায়, “এক রাতে ও বেরিয়েছিল, তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে, অথচ ওর ফেরার নাম নেই। আমি তখন ছিলাম একা। বড্ড ভয় পেয়েছিলাম। আশপাশে কয়েকজন লোক ছিল, আমি টিনের শেডের তলায় বসেছিলাম। কি যে করব ভেবে পাচ্ছিলাম না! কান্না পাচ্ছিল কারণ তখন আমার আর তো কেউ ছিল না। অবশেষে ও ফিরে এল, রাতের খাবার হাতে করে।”
গঙ্গাপ্পা এবং পূজাম্মা অনন্তপুর শহরের একপ্রান্তে হাইওয়ের ধারে থাকেন। রাতে তাঁরা ঘুমান এক রেস্তোরাঁর বাইরে। রেস্তোরাঁ মালিক নিজে গান্ধীর ভক্ত। গঙ্গাপ্পা সাধারণত সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েন আর রাত নটা নাগাদ শুয়ে পড়েন। মাঠে চাষের কাজ করার সময়ও এই নিয়মই পালন করতেন তিনি।
কখনও কখনও গঙ্গাপ্পা যে রেস্তোরাঁর বাইরে ঘুমোন, তারাই রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করে দেয়। সকালের নাস্তা কিনে নেন রাস্তার ধারের দোকান থেকে আর দুপুরের খাবারটা সাধারণত এড়িয়ে যান। পূজাম্মারও খাওয়া যেন ঠিকঠাক সেটাও গঙ্গাপ্পা নিশ্চিত করেন। মাঝেসাঝে যদি তাঁর মনে হয় স্বাস্থ্যকর কিছু খাওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি রাগি, চাল ও মুরগি কিনে আনেন, আর পূজাম্মা রাস্তার ধারে অস্থায়ী চুলায় মুদ্দে [রাগি এবং চালের বল, রায়ালসীমা অঞ্চলের প্রধান খাবার] এবং মুরগির ঝোল রান্না করেন।
সোজাসাপটা জীবন এখন। আগের চেয়ে ভালোই। গান্ধী হয়ে ওঠা মানে তাঁকে আর তাঁর খাবার কিংবা আশ্রয় নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। গঙ্গাপ্পার অবশ্য খুব দুঃখ যে আজকাল সবাই আর গান্ধীকে শ্রদ্ধা করে না। এটাও সম্ভব হতে পারে? “কিছু অল্পবয়সি ছেলেছোকরা গান্ধীর মতো পোশাক পরা বন্ধ করতে বলছিল আমাকে,” তিনি স্মৃতি হাতড়ে বললেন। “ওদের বক্তব্য সরকার নিজেই যখন গান্ধীর ছবি টাকার নোট থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন আপনি কেন খামোখা তাঁর মতো সাজতে চাইছেন?”
পুনশ্চ: কয়েকদিন আগে পূজাম্মা দেশের বাড়ি যাবেন বলে গঙ্গাপ্পার সঙ্গ ছেড়েছেন। তাঁর কথায়, “উগাড়ি উৎসবের সময় ও চলে গেল, ফিরবে না আর। ওখানেই ভিক্ষে করে দিন কাটিয়ে দেবে। যাওয়ার আগে আমি ওকে ৪০০ টাকা দিয়েছি। এবার আমাকে একাই থাকতে হবে।”
অনুবাদ: অর্ঘ্য দেবনাথ