“আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল যে মৃত্যুর পর আমাদের বাবার বুঝি সৎকারই হবে না ঠিক করে।”
পঞ্চনাথন সুব্রহ্মণ্যমের মৃত্যুর দুমাস পরেও তাঁর পুত্র এস রমেশ দুঃখ করেন এই বলে, “তাঞ্জাভুর সরকারি হাসপাতালে যখন তাঁকে কোভিড-১৯-এর লক্ষণ সহ ভর্তি করলাম তখন ভাবতেও পারিনি যে ফেরত নিয়ে যেতে হবে তাঁর মৃতদেহ।”
আক্ষেপ এই কারণেও যে ৬৮ বছর বয়সী সুব্রহ্মণ্যম, বহু বছর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর করণিকের পদ থেকে অবসর নিলেও তাঁর শরীর ছিল মোটামুটি নীরোগ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তাঁর খুব গর্ব ছিল এবং “নিজের শরীরের যত্ন নিতেন। রোজ হাঁটতে যেতেন, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে ভীষণ নিয়ম মেনে চলতেন,” বুঝিয়ে বললেন, কুম্বাকোনাম শহরের ৪০ বছর বয়সী বাসিন্দা রমেশ। “হাসপাতালে ভর্তির সময়েও আমরা ভেবেছিলাম বাবা সেরে উঠবেন।”
কিন্তু ১৪ই অগস্ট যখন সুব্রহ্মণ্যম মারা গেলেন তখন রমেশ ও তাঁর পরিবার যে একেবারে ভেঙে পড়লেন তা কেবল তাঁকে হারিয়েছেন বলেই নয় — তাঁরা আগেই দেখেছেন যে কোভিড-১৯ সংক্রমিত মৃতদেহ নিয়ে সারা রাজ্যে কতো কুসংস্কার ছড়িয়েছে ফলে এরপর কী করবেন তা-ই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। “আত্মীয় বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায় কোনও সাহায্য সহযোগিতা পাইনি,” বললেন রমেশ। “আমি মনে করি না যে এটা অস্বাভাবিক কিছু, কারণ করোনায় মৃত্যু খুবই চিন্তার একটি বিষয়।”
সেই সময়ে খুব কার্যকরি সহায়তা মিলেছিল তামিলনাডু মুসলিম মুন্নেত্রা (টিএমএমকে) কঝাগম নামের একটি বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে। সুব্রহ্মণ্যমের মৃত্যুর কিছুক্ষণের মধ্যে টিএমএমকের স্বেচ্ছাসেবীরা সাহায্য করতে চলে আসেন — হাসপাতালে এসে মৃতদেহ সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে তাঁদের সাকিন কুম্বাকোনামে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে কবরের ব্যবস্থা করা (হিন্দুদের মধ্যে কিছু কিছু গোষ্ঠী দাহ করার বদলে মৃতদেহ কবরস্থ করে থাকে) — সব তাঁরাই করেন।
তাঁদের পরিবারের পক্ষে এটি ছিল অভুতপূর্ব সৌভাগ্যের বিষয়। টিএমএমকের কাছে অবশ্য সুব্রহ্মণ্যমের শেষকৃত্য ছিল পুদুচেরি এবং তামিলনাডু জুড়ে মার্চ থেকে যে ১,১০০টি শেষকৃত্য তাঁরা সম্পন্ন করেছেন তারই একটি। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য শেষকৃত্যের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ধর্মীয় প্রথা ও পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী। নিশ্চিতভাবে কোভিড ১৯ সংক্রমণেই মৃত্যু হয়ে থাকলে টিএমএমকে স্থানীয় বিধি মেনে সেক্ষেত্রে মাটির আট ফুট গভীরে দেহ কবরস্থ করেছে।
এই ভাইরাসকে কেন্দ্র করে ভীতি এবং লকডাউন ঘিরে অচলাবস্থার কারণে শ্মশান ও কবরস্থানে কর্মীর অমিল হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল, ফলে শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলি অতিরিক্ত খরচের পাল্লায় পড়া ছাড়াও কুসংস্কার ও হয়রানির শিকার হচ্ছিল। সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাটি ঘটে ৫৫ বছর বয়সী স্নায়ু শল্যবিদ সাইমন হরকিউলিসকে কেন্দ্র করে — তিনিই সম্ভবত তামিলনাডুর প্রথম চিকিৎসক যাঁর মৃত্যু হয় কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে।
চেন্নাইয়ের কিলপৌক এলাকার কবরস্থানে প্রায় ১০০ জন মানুষ সমবেত হয়ে তাঁর মৃতদেহ সেখান থেকে ফিরিয়ে দেন। এরপর তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ছয় কিলোমিটার দূরে আন্না নগরে ভেলাঙ্গাডু কবরস্থানে। সেখানেও একদল মানুষ অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সাফাইকর্মী সহ গাড়িটিকে পাথর ও লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে। অতঃপর ডঃ সাইমনের বন্ধু ডঃ প্রদীপ কুমার ও আরও দুজন মিলে পরেরদিন ভোরে একেবারে গোপনে তাঁকে কবর দেন — সে সময়ে নিজেদের প্রাণের ভয়ে তাঁর পরিবারের একজন সদস্যও সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
এমন বিষাক্ত পরিবেশে টিএমএমকের হস্তক্ষেপ ওই ১,১০০টি পরিবারের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
“আমরা চরম হতাশা ও অস্থিরতা নিয়ে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া নম্বরে ফোন করে টিএমএমকের সঙ্গে যোগাযোগ করি,” বললেন রমেশ।
“আমরা কেবল একটি অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলাম কিন্তু ওঁরা সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নেন। মৃত্যুর পর আমাদের বাবার কোনও অবমাননা ঘটুক আমরা তা চাইনি। তিনি নিজেও খুবই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আমরা কৃতজ্ঞ যে টিএমএমকে তা যথাযথভাবে রক্ষা করতে পেরেছে।
চমকপ্রদ ব্যাপার হল, যে ১,১০০টি শেষকৃত্য তাঁরা সম্পন্ন করছেন — যার মধ্যে কোভিড বহির্ভূত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০০টি —তার একটি ঘিরেও কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেনি।
“টিএমএমকের সঙ্গে ছয় বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত থাকার পর আমি এতে আশ্চর্য হচ্ছি না মোটে,” বললেন শ্রী বালাজী ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক তথা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, ডঃ এন অরবিন্দ বাবু। বহু ক্যানসার রোগীর অস্ত্রপোচারের জন্য তাঁরা অর্থ সংগ্রহ তথা রক্তদান করেছেন। শহরের অদম্বক্কম অঞ্চলের বাসিন্দা ডঃ বাবু জানালেন যে টিএমএমকের কাজের এই দিকটির কথা তিনি জানতে পারেন তাঁর এলাকায় “এপ্রিল মাসে লকডাউনের তুঙ্গ অবস্থায় যখন পরিত্যক্ত এক বৃদ্ধা মারা যান, সম্ভবত অনাহারে।”
“আমি খুবই মর্মাহত ছিলাম, ভাবছিলাম তাঁর অন্তত ঠিকভাবে সৎকার হওয়া জরুরি,” বললেন ডঃ বাবু। টিএমএমকের স্বেচ্ছাসেবীরা এসে তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত তথা সৎকারের ব্যবস্থা করেন এবং মৃত্যুর শংসাপত্র হাতে পাওয়া অবধি যা দরকার সব করেন। এটি খুবই জরুরি ছিল “কারণ, এই মৃত্যুটি যে কোভিডজনিত কারণে নয় সেই মর্মে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন থেকে শংসাপত্র পাওয়া দরকার ছিল। খুবই সুচিন্তিত পদক্ষেপ ছিল এটা।”
এই সময়েই ডঃ বাবু জানতে পারেন যে এই সংগঠন বিগত আট বছর ধরে পরিত্যক্ত ও দাবিহীন মৃতদেহের যথাযথ মর্যাদায় সৎকার করে চলেছে। “একটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতকুলশীল মানুষের মৃত্যুর পরও তাঁর সম্মানের কথা এঁরা ভাবেন — এটি সত্যিই একটি বিস্ময়কর ব্যাপার।”
শুরুর দিকে আমরা কয়েকজন কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত মানুষের সৎকারের ব্যবস্থা করি,” বললেন, প্রাক্তন বিধায়ক ও টিএমএমকের রাজ্য সভাপতি, এম এচ জওয়াহিরউল্লাহ। ডঃ সাইমনের মৃত্যু ও তারপর তাঁর পরিবারের উপর আক্রমণের ঘটনার কথা জানার আগে অবধি আমাদের এ নিয়ে বিশেষ কোনও পরিকল্পনা ছিল না।” কোভিডজনিত মৃত্যু নিয়ে মানুষের ভয় ও কুসংস্কার ছিল বলে আমাদের পক্ষেও কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।”
তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে সৎকার করবেন “মৃত মানুষটির ধর্মের প্রথা অনুসারে। তাঁদের সসম্মানে বিদায় জানানোই ছিল উদ্দেশ্য। তাঁদের বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে না পারলে তা কেমন করেই বা সম্ভব হবে?” প্রশ্ন তুললেন জওয়াহিরউল্লাহ।
টিএমএমকের স্বেচ্ছাসেবীরা সবাই ২২ থেকে ৪০ বছর বয়সের অতি সাধারণ মানুষ। তাঁরা প্রচার আশাও করেন না তাতে স্বস্তিও পান না — কোভিড-১৯ রোগী ও সেই কারণে মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করছেন এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে মানুষের যা মনোভাব তাতে এই তো স্বাভাবিক। প্রায় ১,০০০ জন এমন স্বেছাসেবী রাজ্য জুড়ে এই কাজ করছেন। টিএমএমকের চিকিৎসা বিভাগের দায়িত্বে থাকা, চেন্নাইয়ের খলিল রহমান জানালেন যে স্বেচ্ছাসেবীদের বেশিরভাগই হকার বা তাঁরই মতো ছোটো দোকানদার।
“আমাদের সবারই টানাটানির সংসার,” বললেন রহমান। “খুব সামান্য কয়েকজন আছে যাঁদের অবস্থা হয়তো খানিকটা ভালো।”
তাঁদের কাজকে অনেকেই যথেষ্ট সম্মান করেন। “এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর শেষকৃত্যের ভিডিওটি আপনি দেখেছেন? ইরোদ জেলার গোবিচেট্টিপালায়াম শহরের জি ভি আধ্যিয়ামান জানতে চাইলেন। “তিনি আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ (ডিএমকের বিরোধী) হলেও যেভাবে তাঁর মৃতদেহটি ছুঁড়ে গর্তে ফেলার পর একজন সেখানে নেমে সেটিকে সোজা করে দেয় — তা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।” অধ্যিয়ামানের পিতা, প্রাক্তন ডিএমকে বিধায়ক এবং ৬০-এর দশকে হিন্দি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৮৬ বছর বয়সী জিভি ভেঙ্কিটুর মৃত্যুও হয় কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর।
“আমি এই চিকিৎসা দলের সঙ্গে আট বছর ধরে আছি। কোভিডের কারণে আমাদের পরিশ্রম খুব বেড়েছে কিন্তু মানুষ যখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তখন আর কিছুই গায়ে লাগে না”
সরকারিভাবে যখন জানানো হয় যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাবার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে না তখন তাঁর পরিবার খুব অসুবিধায় পড়ে। “আমার বাবা, কোয়েম্বাটোর হাসপাতালে ছিলেন আর তাঁকে আমাদের গোবিচেট্টিপালায়ামে ফেরত নিয়ে যেতে হত,” বললেন অধ্যিয়ামান। “সেইসময় টিএমএমকে এগিয়ে এসে, আত্মীয়ের মতো সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নেয়।”
প্রতিটি সৎকারের পিছনে থাকে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তা সত্ত্বেও, টিএমএমকে, হাসপাতালে এসে নথিপত্র সংক্রান্ত সমস্ত কাজ থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সৎকারের পূর্ণ ব্যবস্থা ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে সেরে ফেলে। “প্রশাসনিক কাজের জন্য আমরা ধরে নিই যে তামিলনাডুতে ৫৬টি জেলা আছে (সরকারিভাবে অবশ্য জেলার সংখ্যা ৩৮) — এর প্রতিটিতে আমাদের চিকিৎসা সহায়ক দল আছে আর এর প্রত্যেকটির একজন সচিব আছেন। প্রতিটি জেলায় আছে ৬-৮ জনের ৩-৪টি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী,” বললেন খলিল রহমান।
“এটি মানব সেবার কাজ আর এই কাজ সম্পন্ন করতে, স্বেচ্ছাসেবীরা সমস্ত বিধি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন,” বললেন তিরুপাত্তুর জেলার পুলিশ সুপার পি বিজয়কুমার। “যেমন মৃতদেহ কবর দিতে ওঁরা আট ফুট গভীর গর্ত খোঁড়েন এবং প্রতিক্ষেত্রেই যথাযথ পিপিই পোশাক পরে নেন। আমাদের জেলায় অন্তত ১০০ জনের কোভিডে মৃত্যু হয়েছে আর এর ৪০ শতাংশ মৃতদেহেরই সৎকার করেছে টিএমএমকে।” যদিও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি তবু বলা যায়, যে ১,১০০ জনের সৎকার তাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ইত্যাদি সব ধর্মের মানুষই ছিলেন।
যে সমস্ত অঞ্চলে এই স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন সেই সব অঞ্চলে মানুষের মধ্যে এই রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বেড়েছে এবং আতঙ্ক কমেছে।
“মৃতদেহ থেকে রোগ ছড়ায়, এই ধারণা থেকেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু রোগ এইভাবে ছড়ায় না,” বললেন কলকাতার এক মলিকিউলার বায়োলজিস্ট ও শিক্ষক, ডঃ অনির্বাণ মিত্র। “এটি একটি জৈবরাসায়নিক সত্য যে মৃতদেহ নতুন ভাইরাস তৈরি করতে পারে না, বিশেষত যে মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর ৪-৫ ঘন্টা পরে ছাড়া হয়েছে। যেহেতু মৃতব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস চলে না সেহেতু মৃত মানুষের ড্রপলেট (লালাবিন্দু) থেকে রোগ সংক্রমিত হওয়ার কোনও সম্ভবনাই থাকে না। যদি কোনও দেহ থেকে রক্ত, লালা বা কফের মতো জৈবতরল নিঃসৃত হতে থাকে তবেই একমাত্র তার থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে। সেই কারণেই মৃত্যুর অব্যবহিতকালের মধ্যেই মৃতদেহের বিধিবদ্ধ নিয়মে সৎকার হওয়া একান্তই জরুরি।
“রোগগ্রস্ত মানুষটির মৃত্যু যদি বাড়িতে হয়ে থাকে তবে সেই বাড়িতে ভাইরাস তখনও সক্রিয় থাকতে পারে এবং সেই কারণে ওই পরিবারকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে থাকতে হয়। এই ব্যাপারটিকে যোগ্যতার সঙ্গে সমাধা করতে পারঙ্গম কর্তৃপক্ষকে সৎকারের বন্দোবস্ত দেখতে হবে” বললেন ডঃ মিত্র।
বলাই বাহুল্য, টিএমএমকে ক্লান্ত কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকেও খানিক নিস্তার দিয়েছে।
“এই সৎকারগুলি করতে খরচ কেমন হয়? “পারলৌকিক ক্রিয়া, গর্ত খোঁড়ার জন্য জেসিবি যন্ত্রের ভাড়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে খরচ পড়ে ১,০০০ থেকে ১১,০০০ টাকার মধ্যে,” রহমান বললেন। “কোভিডজনিত মৃত্যুর পর যে পরিবারগুলি এই খরচ করতে পারে তাদের বেলায় আমরা কেবল কাজটিই করে দিই। কোনও পরিবার যদি এই খরচ বহন করতে না পারে তাহলে আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে কাজটি সম্পন্ন করি।” পিপিই কিটগুলি স্থানীয় প্রশাসন থেকে দেওয়া হয় অথবা হিতৈষী মানুষেরা দান করেন।
এই সংগঠনটি জানে যে কোভিডজনিত মৃত্যুতে অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। “দলের সব সদস্য পিপিই পোশাক পরেন এবং সৎকারের কাজ করেন সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে — কোনও দল একসঙ্গে একটির বেশি সৎকারের কাজ করে না। সৎকারের পর দলের সদস্যরা নিজেদের বাড়ি ফেরার আগে কিছুদিন নিজেরা আপন পরিবার থেকে পৃথক থাকেন।” তাঁদের সবাইকে বাড়তি রোগ প্রতিষেধক দেওয়া হয় এবং তাঁরা বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। “অবশ্যই কারও কোভিড পজিটিভ থাকলে তাঁকে এই কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়,” জানালেন জওয়াহিরউল্লাহ।
স্থানীয় স্বাস্থ্য পরিদর্শক অথবা হাসপাতালগুলির কাছ থেকে বিপদগ্রস্ত পরিবারগুলি সম্বন্ধে জানতে পারেন এই স্বেচ্ছাসেবক দলগুলি। রানীপেট জেলার আরাক্ষোনাম ব্লকের বনভরম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সভাপতি এন মণি একটি উদাহরণ দিলেন - “আমাদের গ্রামের, পুষ্পা নামের এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মহিলা কোভিড সংক্রমণে মারা যান এবং তাঁর পরিবার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না। সেইসময়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শক আমাকে টিএমএমকের কথা বলেন। স্বেচ্ছাসেবীরা এক ঘন্টার মধ্যে এসে সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নেন। তাঁরা যতটা সাহসী ততটাই সাবধানী।”
“তাছাড়া,” বললেন রহমান, “প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে আমাদের ফোন নম্বর আছে, ফলে কোনও পরিত্যক্ত মৃতদেহের খবর থাকলে সেখান থেকেই আমাদের জানিয়ে দেয়।”
তাঁদের কাজের সঙ্গে জড়িত আছে অনেকখানি ঝুঁকি এবং ব্যয়ভার। ৪১ বছর বয়সী আব্দুল রহিম, পার্শ্ববর্তী কেন্দ্র শাসিত পুদুচেরির ২৭টি কোভিড-১৯ সৎকার সম্পন্নকারী দলের মধ্যে ২৫টির সদস্য হওয়ায় নিজের ছয় বছর বয়সী পুত্রের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন। “আমি আট বছর ধরে এই চিকিৎসা সহায়ক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। কোভিডের কারণে আমাদের কাজের চাপ বেড়েছে কিন্তু মানুষ যখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তখন আর কিছুই গায়ে লাগে না। প্রতিটি সৎকারের কাজ সম্পন্ন করার পর আমার পরিবার থেকে অন্তত সাতদিন করে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়। এতে ওদের খারাপ লাগে বটে কিন্তু আমি তো ওদের বিপদের কারণ হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারি না।”
কিন্তু টিএমএমকের স্বেচ্ছাকর্মীরা কেনই বা করেন এই কাজ?
জওয়াহিরউল্লাহের কথায় এ হল ফর্দ কিফায়া (আরবী ভাষার এই কথার অর্থ বাধ্যতামূলক ব্যক্তিগত কর্তব্য)। “ইসলাম ধর্মমতে মৃতদেহের সৎকার একটি বাধ্যতামূলক সামাজিক কর্তব্য। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি এই কাজ করে তার মানে গোটা সমাজই নিজের কর্তব্য সম্পাদন করল। কেউই যদি এই কাজ করতে এগিয়ে না আসে তাহলে গোটা সমাজের উপর সেই পাপের দায় বর্তায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সৎকারসাধনকে আমরা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি।”
তিনি জানালেন যে ১৯৯৫ সালে টিএমএমকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা বিভিন্ন মানবিক কাজ করে চলেছেন। “নিয়মিত রক্তদান করেন এবং যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের নিখরচায় অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা প্রদান করেন। সুনামি ও চেন্নাইয়ের বন্যা সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।”
মনিথান্যা মক্কাল কাতচি নামের একটি একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি হিসাবে জওয়াহিরউল্লাহ জানালেন, “তামিল হিসেবেই আমরা এই কাজ করি; আমরা মনে করি অপরের বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা উচিত। তামিলনাডুর মানুষ আমাদের কাজকে সাধারণভাবে সমর্থন করে এসেছেন।” বেশ খানিক্ষণ থেমে থেকে তিনি বললেন, “অবশ্যই আপনার পরিচয় যদি সংখ্যালঘু হয় তাহলে এই কাজ করার বাড়তি বাধ্যতা এবং দায়িত্ব এসেই যায়। কিন্তু অপরের দরকারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসাই আমাদের মূলতম উদ্দেশ্য।”
ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে কবিতা মুরলীধরন জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি
বাংলা অনুবাদ : চিলকা