অবিভক্ত কালাহান্ডি জেলায় জন্ম আমার, সে এমন এক জেলা যেখানে খরা, অনটন, খাদ্যাভাবে মৃত্যু এবং আতান্তরে পড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে দূর দূরান্তে পাড়ি দেওয়ার অপর নাম জনজীবন। কিশোর বয়স থেকে বড়ো হয়ে সাংবাদিকতার জগতে পা-রাখা অবধি স্বচক্ষে দেখা এ যন্ত্রণার কথাই আমি তুলে ধরেছি প্রাণপণে। মানুষ কেন পরিযায়ী হয়, কারাই বা আটকে পড়ে পরিযানের শেকলে, কতটা কোণঠাসা হলে তবেই না কেউ দেশগাঁ ছেড়ে বেরোয় দুমুঠো ভাতের সন্ধানে, রক্ত-মাংস-পেশিও নাগাল পাবে না এমন হাড়ভাঙা খাটুনি কীভাবে জন্ম নেয়, রুজিরুটির তাগিদে কোন সে পথের খোঁজে হারায় মানুষ - এসব কথা উপলব্ধি করেছি আমি।
সরকারি সাহায্য যখন সবচাইতে বেশি দরকার, ঠিক তখনই অবহেলায় ডুবে মরলেন তাঁরা – ব্যাপারটা কিন্তু নিতান্তই 'সাধারণ'। খাবার নেই, জল নেই, গাড়িঘোড়া নেই, শয়ে শয়ে কিলোমিটার পেরিয়ে যান, তবু পথ আর ফুরোয় না – অধিকাংশই খালিপায়ে তাঁরা, একজোড়া চপ্পল অবধি জোটেনি।
প্রচন্ড কষ্ট হয় জানেন? আবেগের সুতোয় জড়িয়ে গেছি ওই মানুষগুলোর সঙ্গে – আমি যে ওঁদেরই একজন। বুক ঠুকে বলছি, ওঁরা আমারই আপনজন। তাই যখন দেখলাম যে সেই একই মানুষগুলো, সেই একই জনজাতি, আবারও আবারও ধাক্কা খেয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভিতরটা যেন চুরমার হয়ে গেল। বড্ডো অসহায় লাগছে জানেন? আমি কবি-টবি কিসুই নই – না জানি তাও কীভাবে শব্দগুলো ছন্দে গেঁথে বেরিয়ে এলো পাঁজর ফেটে।
গান বাঁধা মোর মুরদে নাই রে
আমি যে শুধুই ছবি তুলে মরি।
জোয়ান সে ছেলে, মাথায় পাগড়ি,
পায়ে তোড়া তার, গলায় মাল্য
ছবি আহামরি। এমনও দেখেছি
কাল যে সড়কে সাইকেলে চড়ে
ফুর্তি ফুর্তি ছেলেটার মুখে, আজ সে
পথিক
আঙার জড়ায়ে ফিরিতেছে একই রাস্তা
জ্বালায়ে।
আধপেটা ছাই
পায়ের তলায় আগুন আগুন, দুচোখে তাহার
উনুনের খিদে নেভে না যে আর
ফোস্কা পড়েছে পথের ছায়ায়।
আমি তাও শুধু ছবি তুলে যাই।
ছবি তুলেছিনু ছোট্ট খুকির
কেশরাশি তার পুষ্পগন্ধা
ঝিকিমিকি চোখে জলের কিনার
পুঁচকে সে মেয়ে হয়ত আমার –
আজ যারা ওই কেঁদেকেটে বলে
হাসিহাসি মুখ ডোবে আঁখিজলে
তেষ্টা সে তার মেটেনা তো আর
এরাই কি তবে কন্যা আমার?
খিড়কি ডিঙিয়ে সড়কের বাঁকে
গুঙিয়ে গুঙিয়ে কারা যেন ডাকে,
আমারই বাড়ির উঠোন পেরিয়ে
বুঝিতে না পারি, মরেছে জামলো?
খালিপায়ে ওই লঙ্কার খেতে, লালচে সবুজে
কিৎকিৎ খেলা, তুলছে, গুনছে, সংখ্যার
মতো,
জানি না রে ভাই, ওটা কি জামলো?
রাস্তা পেরিয়ে পিচের মতন
লাশগুলো যার, গলে গেছে হাড়,
এ শিশু কাদের? শুধু কি আমার?
ক্যামেরাবন্দি করেছি যাদের,
ষোড়শী সাতাশি, ডোঙরিয়া কোন্ধ্,
বানজারা কেহ,
মাথায় তুলেছে পেতলের ঘড়া
দুই পায়ে তার আহ্লাদী ছড়া
এ মেয়ে সে মেয়ে নয় –
জীবনের বোঝা, ঝুঁকে গেছে কাঁধ,
মাথায় পাহাড়, কাঠকুটো জরা,
হাইওয়ে জানে দিন শেষে ফেরা,
এরা কি গোন্ডি নয়?
আধমরা মেয়ে, আধপেটা মেয়ে,
কাঁখে তার শিশু কেঁদেকেটে সার,
আশাহীন পায়ে হাঁটছে তাহার
ওই দেখি ঠিক পাশে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি, জানি, ওরাই আমার
মা-বোন দুজন।
খুদকুঁড়ো পেটে, শরীর নীরাগ
গুটিগুটি দিন গুনছে মরণ।
ক্যামেরাবন্দী করেছি যাদের
এরা যে তাদেরই মতোই,
তবু জানি জানি, এরা তো আলাদা
ছবি সে তুলেছি যতই।
মরদেরও ছবি তুলিয়াছি আমি
একগুঁয়ে, জেদি, নাছোড়বান্দা,
জেলে কেউ, কেহ ধিনকিয়াতে
মজদুর সেতো বেঁধেছিল গান
কর্পোরেটের জ্যান্ত শ্মশান, কাঁদে
কেবা তাই?
সে জন তো নয়? ওই যে জোয়ান,
ওই যে বৃদ্ধ, আদৌ কি আমি চিনেছি এদের?
হাঁটে যারা এঁটো গরিবি ছড়ায়ে
মাইলের পর মাইল কুড়ায়ে
পিছুডাকে ভয়, খিদে খিদে রয়,
একলা সে জন চেনা বড়ো দায়।
অশ্রু লুকায়ে কেবা কোথা যায়?
এরা কি আমারই কেউ?
একি দেগু নাকি? ইটভাটা ফাঁকি,
ডাকে বাড়ি তার, ফিরিছে আবার
একা বোকা পথে সেও?
বল রে ক্যামেরা, কী ছবি তুলিব?
এদেরকে কি তবে গাহিতে বলিব?
না না, কবি নই,
গান বাঁধা মোর মুরদে নাই রে,
নেহাতই পাগলা ক্যামেরা তাই রে,
শাটারেই কাম সারা।
কিন্তু যাদের তুলিয়াছি ছবি
এরা কি আদৌ তারা?
কবিতা সম্পাদক রূপে প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়ার ভূমিকা অমূল্য, তার প্রতি লেখকের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
অডিও: সুধন্য দেশপাণ্ডে, জন নাট্য মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা ও পরিচালক এবং একই সঙ্গে লেফ্টওয়ার্ড বুকস্-এর একজন সম্পাদক।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)