আপ্পার মৃত্যুবার্ষিকীতে থিরু মূর্তি যে নৈবেদ্যটি সাজিয়েছিলেন, সেটি সত্যিই অভূতপূর্ব: দশ রকম সাবান, নানা প্রকার নারকেল তেল এবং মধ্যমণি তাঁর খেতের হলুদ গুঁড়ো। এছাড়াও সুন্দরমূর্তির মালায় ঢাকা আবক্ষ ছবির সামনে সাজানো ছিল একছড়া লালচে কলা, ফুল, নারকেল এবং জ্বলন্ত কর্পূর।

"আপ্পার প্রতি এর চাইতে ভালো শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কীই বা হতে পারে?" একটি ফেসবুক পোস্টে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি। তাঁর আপ্পা (বাবা) হলুদ চাষে ইতি টেনেছিলেন। আপামর দুনিয়া বারণ করা সত্ত্বেও সেটা আবার শুরু করেছিলেন থিরু। "সবাই বলেছিল মল্লি (জুঁই) চাষ করতে, কারণ ফুলের কারবারে রুজিরোজগারের নিশ্চয়তা আছে। যখন জমিতে মাঞ্জল লাগাই, সব্বাই হাসাহাসি করেছিল," মুচকি হেসে জানালেন তিনি। অচিরেই সবাইকে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন থিরু। তবে তাঁর এই হলুদ যুদ্ধজয়ের কাহিনিটা কিন্তু সত্যি সত্যিই অভূতপূর্ব!

তামিলনাড়ুর ইরোড জেলার ভবানীসাগর ব্লকের উপ্পুপাল্লাম জনপদে বড়োদাদার সঙ্গে একত্রে ১২ একর জমিতে চাষবাস করেন থিরু মূর্তি (৪৩)। হলুদ, কলা এবং নারকেল – মূলত এই তিনটি ফসল ফলান তাঁরা। তবে তিনি পাইকারি দরে এসব বিক্রি করেন না। তা নাকি নিতান্তই অর্থহীন কারণ সেক্ষেত্রে দরদামের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকবে না তাঁর, জানালেন তিনি। স্থানীয়, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক – যে স্তরেই ব্যাপারটা হোক না কেন, বাজার-দরের চাবিকাঠি কিন্তু সেই সরকার এবং কর্পোরেটের মতো রাঘব-বোয়ালদেরই কুক্ষিগত।

হলুদের জাঁকালো বিশ্ববাজারে প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতবর্ষ। ২০১৯ সালে আমরা ১৯০ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের হলুদ রপ্তানি করেছিলাম – তা ছিল মোট বিশ্ববাণিজ্যের ৬২.৬ শতাংশ। তবে একটা গ্যাঁড়াকলও রয়েছে: হলুদ আমদানির খাতাতেও ভারতের নাম রয়েছে। স্থান হিসেবে দ্বিতীয় – পরিসংখ্যানে ১১.৩ শতাংশ। বিগত কয়েক বছরে আমদানির বাড়বাড়ন্ত হওয়াতে আমাদের হলুদ-চাষিরা বিপদে পড়েছেন

ইরোডের মাণ্ডিগুলির মতো দেশীয় বাজারে ইতিমধ্যেই নাভিশ্বাস উঠেছে চাষিদের। বড়ো ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের রমরমা এখানে। জৈব ফসলে দরদামের কোনও মাথামুণ্ডু নেই, এবছর থেকে সে বছর রীতিমত হাডুডু খেলে বেড়ায় বাজার-দর। ২০১১ সালে যে ফসলের দাম ছিল ১৭,০০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল, ২০১২ সালে সেটার এক-চতুর্থাংশও পাননি চাষিরা। ২০২১ সালের গড় হিসেবে সেটা ছিল মোটে ৭,০০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল।

তবে মাথা খাটিয়ে, জেদে বুক বেঁধে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একটা সোজাসাপ্টা পদ্ধতি বার করেছেন থিরু: মূল্য সংযোজন (ভাল্যু অ্যাডিশন্)। এই ফন্দিটা হয়তো বড়ো করে প্রচার করা সম্ভব নয়, তবে এটা যে মস্ত বড়ো একটা কীর্তি, এ কথা না মেনে উপায় কী? "মাণ্ডিতে যে নারকেল বেচে ১০টা টাকার বেশি জোটে না, সেই নারকেলটাই বিক্রি করে তার তিনগুণ আয় করি। কারণটা কী জানেন? সেটার তেলটুকু বার করে সাবান বানিয়ে ফেলি আমি। ব্যাপারটা হলুদের ক্ষেত্রেও খাটে," বোঝাচ্ছিলেন তিনি, "১.৫ একর জুড়ে হলুদ ফলাই। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা ৩,০০০ কিলো হলুদ মাণ্ডিতে ধরে দিয়ে এলে কিলো-পিছু ৫০ টাকা লোকসান হয়ে যাবে আমার।"

Two types of turmeric grow in Thiru Murthy's fields at the foothills of the Sathyamangalam hills in Erode.
PHOTO • M. Palani Kumar
Thiru at home with his children and a relative’s son
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: ইরোডের সত্যমঙ্গলম পাহাড়ের পাদদেশে দুই ধরনের হলুদ চাষ করেন থিরু মূর্তি। ডানদিকে: এক আত্মীয়ের পুত্রসন্তান ও নিজের দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাড়িতে বসে আছেন থিরু

জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করার ফলে চাষবাসের খরচ বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে রাসায়নিক নির্ভর চাষের তুলনায়, তবে তাঁর লাভের পরিমাণও আশপাশের চাষিদের থেকে অনেকটা বেশি।

ইরোডের সত্যমঙ্গলম পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর খামারটি যেন রাখালিয়া জীবনের জীবন্ত উপমা: সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনি টিলার সারি, চূড়ায় মুকুটসম বজ্রগর্ভ মেঘ, সামনে ঢেউ খেলানো পান্নাসবুজ মাঠ। থিরুর সাধের হলুদ গাছগুলি বেশ বড়োসড়ো, চওড়া পাতায় লুকোচুরি খেলছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর অক্টোবরের মিঠে রোদ্দুর। খেতের চারিধারে সারি দিয়ে রয়েছে যে নারকেল গাছ সেগুলি বাবুই পাখির বাসায় ছয়লাপ; শনশনিয়ে বাতাস কেটে উড়তে থাকে তারা, কিচিরমিচিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নারকেলের জটাজুট সংসার। দৃশ্যটা এতটাই মায়াবি যে থিরুর কৃষিজীবনের দুঃখকষ্ট থেকে নজর হটে যায় চকিতে। গোলাপি দেওয়ালে মোড়া বাড়ির ধূসর সিমেন্টের মেঝেতে বসে সে কথাটাই সাবধানে ধীরেসুস্থে তুলে ধরলেন তিনি খানিক পরে, কোলে তাঁর চার বছরের ছোট্ট শিশুকন্যা, পায়ে তার রুপোলি নূপুরের রিনিঝিনি।

"আধা কিলো আর এক কিলোর প্যাকেট বানিয়ে খদ্দেরদের না বেচলে মুনাফার মুখদর্শন করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে রয়েছে সাবান, তেল আর দুধ-মেশানো পানীয়।" অর্থাৎ কাঁচা ফসলের সঙ্গে মূল্য সংযোজন। অন্যান্য হলুদ-চাষিদের মতো তিনিও ধৈর্য ধরে ফসল তুলে, সেদ্ধ করে, শুকিয়ে, শেষে পালিশ করেন। তবে অন্যরা যখন ভালো দামের আশায় সেটা মজুত করে রাখেন বা মাণ্ডিতে গিয়ে বেচে দেন – থিরু তখন সেটা নিয়ে গিয়ে নিজের গুদামঘরে তোলেন।

এবার পালা হলুদের 'গেঁড়' এবং 'শুঁটি' ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে গুঁড়ো করার। এই মালমশলা দিয়ে যখন তিনি প্রসাধন সামগ্রী এবং সীরাজাত (মল্টেড) পানীয় বানান, তাতেই ফুটে ওঠে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি – কিলো-পিছু অতিরিক্ত ১৫০ টাকা রোজগার হয় এসব থেকে।

"পুরো টাকাটা কিন্তু জমিয়ে রাখি না," বলে উঠলেন থিরু। বরং প্রাণপ্রিয় এ মাটিতেই সেটা ফেরত যায় লাঙলের মেহনতে। এই ১২ একরের ভরসায় শুধু যে তাঁর পরিবারটাই বেঁচে আছে তা নয়, স্থানীয় এলাকার কর্মসংস্থানের পিছনে বড়ো ভূমিকা তাঁর। "চাষের মরসুমে প্রতিদিনই পাঁচজন পুরুষ আর তিনজন মহিলার পেটের ভাত জোগায় এই খেতটা। মাথাপিছু তাদের মজুরি যথাক্রমে ৪০০ আর ৩০০ টাকা, এছাড়া চা আর বোন্ডা [একধরনের মুখরোচক তেলেভাজা] বাবদ জলখাবারের খরচা-পানি তো রয়েইছে। চাষ করতে এখন একর-পিছু ৪০,০০০ টাকা লাগলেও আমার মনে আছে এককালে এর দশ ভাগের একভাগও খরচা হত না। মজুরদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন যে পেট্রোল তো ১০০ টাকা লিটার, আর এক নিপ [১৮০ এমএল] মদের দাম ১৪০ টাকা..." এটা বলেই হেসে উঠলেন। তবে এতো কিছু সত্ত্বেও হলুদের দাম কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে।

*****

কোন সে মেয়ে সুর সাজিয়ে ঝাড়ছে শামাধান ,
হলুদ পাতায় মাদল নাচায় মরদ চাষির মান ,
কন্দ রবে আইলো তবে বনবরাহের দল...
হ্যাট্ হ্যাট্ হুররর! ভাগাও সুদূর , পাহাড় পাবত তল
কাঁপে দ্রিমি দ্রিম্ শব্দ পিদিম ঘাম ঝরানোর শেষে ,
কোন সে মেয়ে সুর সাজিয়ে রাখছে ভালোবেসে।

সঙ্গম-যুগের কবিতা 'মালাইপাডু কডাম' থেকে নেওয়া

Trays with the lots of turmeric fingers and bulbs displayed at an auction in the regulated market in Perundurai, near Erode
PHOTO • M. Palani Kumar
Trays with the lots of turmeric fingers and bulbs displayed at an auction in the regulated market in Perundurai, near Erode
PHOTO • M. Palani Kumar

ইরোডের কাছে পেরুন্দুরাইয়ের বাঁধা-দরের বাজার, নিলামের জন্য প্রদর্শিত বারকোশ ভরা হলুদের গেঁড় ও শুঁটি

হলুদের সঙ্গে তামিলনাড়ুর নাড়ির যোগ সেই ২,০০০ বছরের, জানালেন সাহিত্যিক সেন্থিল নাথন, উপরোক্ত পংক্তিগুলির ইংরেজি অনুবাদ তাঁর ব্লগ OldTamilPoetry.com -এ রয়েছে। সেন্থিলের মতে ' মালাইপাডু কডাম ' কবিতাটি "সঙ্গম সাহিত্য আকরের ১০টি দীর্ঘ-কবিতার মধ্যে অন্যতম।"

ভারতীয় হেঁশেলে হলুদের (লাতিন নাম 'কুর্কুমা লোঙ্গা') জুড়ি মেলা ভার। তার জুড়িদার হল আদা। মাটির তলায় গজানো কন্দের মূলে রয়েছে একটি গেঁড়, যেটা থেকে অজস্র শুঁটি ছড়িয়ে পড়ে এদিক সেদিক – বাণিজ্যিকভাবে ফসলের পুরোটাই কাজে লাগে। ফসল তোলার সময় গেঁড় থেকে শুঁটিগুলো ছাড়ানো হয়। তারপর একে একে আসে সেদ্ধ, শুকানো, সাফসুতরো এবং শেষে পালিশ করে বিক্রিবাটার পালা। তবে বরাবর নিলামে শুঁটির দামটাই বেশি ওঠে।

'ইন্ডিয়ান ফুড: এ হিস্টোরিকাল কমপ্যানিয়ন' বইটিতে কে. টি. আচার্য বলেছেন যে হলুদ সম্ভবত খাঁটি দেশজ একটি মশলা। তিনি লিখছেন: "তার এমনই তাক লাগানো রং, যা দিয়ে খুব সহজেই অন্যান্য জিনিস রাঙিয়ে নেওয়া যায়। ফলত তুকতাক ও মন্ত্রতন্ত্রে হরিদ্রার [হলুদের সংস্কৃত নাম] স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ" আমাদের দেশে। সারা ভারত জুড়ে রান্নাবান্নায় এই মশলাটির বহুল ব্যবহার দেখা যায়। অল্প এক চিমটি হলুদ দিলেই রান্নায় লাগে রং, আসে আলতো স্বাদ, শরীরে বৃদ্ধি পায় প্রতিরোধ ক্ষমতা। মূলত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রূপে এবং জ্বালা-যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে চিকিৎসা-ক্ষেত্রে এর মূল্য অপরিসীম, এই কারণেই হলুদের শুঁটি পরিশোধন করে কুর্কুমিন-নামক উজ্জ্বল হরিৎ রংটি ছেঁকে নেওয়া হয়।

তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের অনেক আগে থেকেই দিদিমা-ঠাকুমারা ধরে ফেলেছিলেন হলুদের ক্ষমতা। সর্দি লেগে বাড়িতে কেউ নাক টানলেই তাঁরা হলুদ আর গোলমরিচ গরম করে (যাতে কুর্কুমিনের জৈব-লভ্যতা বৃদ্ধি পায়) দুধে মিশিয়ে খেতে দিতেন। স্টারবাকস্‌ আজকাল ওই যে 'গোল্ডেন টার্মারিক ল্যাতে' নামক আজব বস্তুটি বেচছে না? আমার ঠাম্মা বেঁচে থাকলে হয়ত ওসব দেখে নাক সিঁটকোতেন। ভ্যানিলা আর ওটের দুধ একটা বাহারি ফ্যানা-বানানো যন্ত্রে ফেলে আচ্ছাসে ঘেঁটেঘুটে বানানো হয় এই বিজাতীয় পানীয়টি।

হলুদ মাঙ্গলিক উপাদানও বটে। দক্ষিণ ভারতের বিবাহিত মহিলারা হলুদে ছোপানো একটা করে সুতো পরেন গলায়। মেয়েরা রজঃস্বলা হলে মাঞ্জল নীরাতু ভিয়া (হলুদে স্নান করানো) নামে একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয় বাড়িতে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বিশাল বিশাল ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছে, জনসমাগমও হয়েছে ব্যাপক। হলুদের জীবানুনাশক ক্ষমতা কারোরই অজানা নয়, দগদগে ক্ষত বা দাদ-হাজা দেখা দিলে হলুদ বাটা লাগান অনেকেই। পোষা কুকুরবেড়ালের জন্য ব্যবহৃত নানা ধরনের ওষুধ ঠিক সেই কারণেই হলুদ দিয়ে বানানো হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা হলুদকে তাঁদের পেটেন্টের আওতায় আনলে ভারতের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কেন্দ্র (সিএসআইআর) ১৯৯৭ সালে ১৫,০০০ ডলার খরচ করে একজন উকিল নিযুক্ত করে। তাঁর বক্তব্য ছিল যেহেতু ক্ষত, দাদ, ঘা ইত্যাদির চিকিৎসায় এ দেশে হাজার হাজার বছর ধরে হলুদ ব্যবহার করা হয়েছে, সেহেতু "পেটেন্টের জন্য যে 'অভিনবত্বের' প্রয়োজন , সেটা এতে নেই।" সিএসআইআরের এ প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অফিস বাধ্য হয় উক্ত "বিতর্কিত পেটেন্টটি" খারিজ করতে।

শিবাজি গণেশন জানলে খুশি হতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী ভীরাপান্ডিয়া কাট্টাবোম্মানের জীবন ঘিরে নির্মিত ১৯৫৯ সালের ছায়াছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গণেশন – শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে তামিল সিনেমার ইতিহাসে সর্বপ্রথম একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিল এটি। ব্রিটিশদের চাপানো খাজনার বিরুদ্ধে কাট্টাবোম্মানের সেই বিখ্যাত উক্তিটি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: "কেন? তোরা কি আমাদের বেরাদরির মহিলাদের হলুদ বাটতে সাহায্য করেছিস?"

*****

" বাবার হাড়ভাঙা খাটুনির ফসলটাই তো ঘরে তুলছি আমি।"
থিরু মূর্তি, ইরোডের হলুদ-চাষি

Thiru inspecting the turmeric plants in his farm, in Uppupallam hamlet of Erode's Bhavanisagar block
PHOTO • M. Palani Kumar

ইরোডের ভবানীসাগর ব্লকের উপ্পুপাল্লাম জনপদ, নিজের খেতে ফলন্ত হলুদ গাছগুলি খুঁটিয়ে দেখছেন থিরু

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে সত্যমঙ্গলমে তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয়বারের জন্য দেখা করতে যায় পারি। একটানা না হলেও সেই ১৮ বছর বয়েস থেকে চাষ করে আসছেন, এমনটাই বলেছিলেন তিনি। সে বছরই মার্চ মাসে প্রথমবার যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেটা ছিল হলুদের ফসল তোলার মরসুম। একহাতে সাদা ধুতির খুঁট ধরে, হাওয়ায় দুলতে থাকা হলুদ গাছের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের কথা।

"উপ্পুপাল্লাম - যা আদতে আমার আম্মার দেশ, সেখানে এসে সংসার পাতে আমার আপ্পা; ৭০-এর দশকে মানুষটা যখন জমিজমা কেনে, তখন এক একরের দাম ছিল মোটে দশ-কুড়ি হাজার টাকা। এখন সেটা ৪০ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা কুটে মরলেও আপনি দশ একর জমি কিনতে পারবেন না!" ক্লাস টেন অবধি পড়াশোনা করে স্কুলের পাট চুকানো থিরু ২০০৯ সালে পাকাপাকিভাবে জৈব-চাষি বনে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১।

তবে তাঁর যে বরাবর এটাই করার ইচ্ছে ছিল, এমনটা বলা চলে না। এর আগে হাজারটা কাজ বদলেছেন তিনি। শুরুতে একটা মালিগাই কাড়াই, অর্থাৎ মুদিখানা খুলেছিলেন বাড়িতে। ইয়ালান্দা ভাড়াই (টকমিষ্টি টোপাকুলের বড়া), থিনপান্ডম (মুখরোচক ভাজাভুজি), চাল, সিগারেট, বিড়ি ইত্যাদির পাশাপাশি দিওয়ালির সময় আতসবাজিও বিক্রি করতেন সে দোকানে। ব্যবসার প্রতি আসক্তি তাঁকে নিয়ে যায় হাজারো কাজের মধ্যে দিয়ে – এককালে কেবল টিভির কারবার ছিল তাঁর, দুধও বিক্রি করেছেন, তারপর গিয়ে ওঠেন বেঙ্গালুরুতে যেখানে তাঁর বড়োদিদি থাকতেন। সেখানে দুচাকার গাড়ি সারাইয়ের গ্যারাজ খোলেন একটা, তারপর সুদে টাকা ধার দেওয়া ফাইন্যান্স কোম্পানিতে কাজ করেন কিছু সময়ের জন্য, শেষে গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায় নামেন। "১৪ বছরে ছয়খানা কারবার সামলেছি এক এক করে। প্রচণ্ড কঠিন ছিল সেই দিনগুলো; দিনরাত কষ্ট করতে হত, আঙুল-টাঙুল পুড়ে একাকার হয়ে যেত।"

বেঙ্গালুরুতে কাটানো সময়টার সঙ্গে কুকুরের তুলনা টানলেন থিরু: "নাই পাদাধা পারু," অর্থাৎ রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো খাটতে হতো তাঁকে। আয় ছিল যৎসামান্য, এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতেন ৬ ফুট বাই ১০ ফুটের একটা অপরিসর কামরায়, ঘিঞ্জি সে ঘরের পিছনে মাস গেলে আড়াই হাজার টাকা গচ্চা যেত।

"২০০৯ সালের মার্চে সত্যমঙ্গলমে ফিরে আসি, মাথায় তখন চাষের ভুত চেপেছে।" শুরু করেন আখ চাষ দিয়ে – ঠিক তাঁর বাবার মতো – তারপর চাষ করেন সাবু, এবং একচিলতে জমিতে পেঁয়াজ।

"জীবনে ভুলও যেমন করেছি, তেমন শিখেওছি সে ভুলগুলো থেকে। ২০১০ সালে পেঁয়াজ বীজের দাম ছিল কিলো প্রতি ৮০ টাকা। ফসল তোলার সময় দামটা পড়ে ১১ টাকায় এসে ঠেকে। মারানা আডি [মারণ ঘা]," দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন। জমিতে অন্যান্য ফসল না ফলালে এই লোকসানটা হয়ত সামলাতে পারতেন না। বাবা মারা যাওয়ার ২ বছর পর এবং তাঁর পরিবার হলুদ-চাষে ইতি টানার ৯ বছর পর ২০১৪ সালে, জীবনে প্রথমবার মাঞ্জলের বীজ বোনেন থিরু।

*****

হলুদের মুনাফা তো কেউ না কেউ লুটবেই। সবসময় যে সেটা চাষিদের কপালে থাকে তা কিন্তু নয়...
ইরোডের হলুদ-চাষিরা

In his banana field, Thiru has planted the red variety this time.
PHOTO • M. Palani Kumar
The wooden chekku in which coconut oil is cold-pressed to make fragrant hair oils
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: কলার বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন থিরু, এবার লালচে প্রজাতির কলা-চাষ করেছেন তিনি। ডানদিকে: কাঠের তৈরি এই চেক্কুতে ঠান্ডা অবস্থায় নারকেল তেল পিষে চুলে মাখার সুগন্ধি তেল বানানো হয়

দেশের ভিতর চতুর্থ স্থান অধিকার করা তামিলনাড়ুতে হলুদ চাষ হয় ৫১ হাজার একর জুড়ে, মোট উৎপাদন ৮৬,০০০ টন। জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে এগিয়ে আছে ইরোড, এখানে মোট ১২,৫৭০ একর জমিতে উৎপাদিত হয় মাঞ্জল।

সেই মহাসমুদ্রের মাঝে থিরুর ১.৫ একরের হলুদ-খেত একটি বিন্দু বই কিছুই নয়। ২০১৪ সালের জুন মাসে আধ একরের একফালি জমিতে হলুদ গাছ লাগিয়ে পথ চলা শুরু হয় তাঁর, বাকি জমিটা জুড়ে চাষ করেছিলেন নারকেল আর কলা। মোট এক টন হলুদ ফলেছিল সেবার, বিক্রিও হয়ে গিয়েছিল চট করে, নয়ত দ্বিতীয়বার হলুদে হাত দেওয়ার সাহস পেতেন না। এর এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৩০০ কিলো তো দশদিনের ভিতর শুকিয়ে গুঁড়ো করে বেচেছিলেন ফেসবুকের মাধ্যমে। নিজের এই প্রয়াসটির নাম রেখেছিলেন 'ইয়ের মুনাই', অর্থাৎ লাঙল, কারণ "এই যন্তরটির কোনও জুড়ি নেই।" লোগোটাও ছিলো চমৎকার: এক চাষি, একটি লাঙল, দুটি বলদ। সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন থিরু।

পরের বছর সাহস করে আড়াই একর জমিতে হলুদ চাষ করেন, ফলন হয় পাঁচ টন, কিন্তু মোট উৎপাদনের পাঁচ ভাগের চার ভাগ পড়ে থাকে মাসের পর মাস। জৈব-ফসলের স্বীকৃতি পেতে নাভিশ্বাস উঠে যায়, একাধারে ব্যয়বহুল ও বিরক্তিকর ছিল পদ্ধতিটা। শেষে বাধ্য হলেন ইরোডের একটা বড়োসড়ো মশলা-কোম্পানির হাতে সবটা তুলে দিতে। টাকাপয়সা তো দূর অস্ত, সে ব্যাটারা কেবল হিসেবনিকেশ লেখা একটা থুন্ড চীটু, অর্থাৎ চিরকুট ধরিয়ে দেয় তাঁর হাতে: প্রতি কুইন্টালে ৮,১০০ টাকার কথা লেখা ছিল তাতে। সপ্তাহ ঘুরে গেলে একখান চেক যদিও বা জোটে, কিন্তু সেটাও ছিল অন্য রাজ্যের, উপরন্তু তারিখ ছিল ১৫ দিন পরের।

হপ্তার পর হপ্তা কেটে যায় সেই চেকটা ভাঙাতে। সেটা ছিল নোটবন্দির বছর। থিরুর জবানিতে: "২০১৭ সালের পর থেকে খুব সাবধান হয়ে গেছি, এক-দেড় একরের বেশি জমিতে হলুদ লাগাই না। আর এক বছর বাদে বাদে জমিটা ফেলে রেখে দিই, যাতে মাটিটা রেহাই পায় খানিক।"

জানুয়ারি এলেই জমির কাজে লেগে পড়েন তিনি, দু'দফা যব (মিলেট) চাষ হবে, একেক দফায় ৪৫ দিন। মাটি যাতে নাইট্রোজেন তথা অন্যান্য ধরনের পুষ্টি পায়, সেজন্য লাঙল চালিয়ে পুরোটা মাটিতে মিশিয়ে দেন। মোট খরচা হয় ১৫,০০০ টাকা। আরও ১৫ হাজার খরচা হয় ক্ষরণ-জাতীয় (ড্রিপ) সেচের ব্যবস্থা করতে, নয়ত হলুদের গেঁড় লাগানো যাবে না জমিতে। একর-পিছু ৮০০ কিলো করে গেঁড় লাগে, ৪০ টাকা প্রতি কিলো, অর্থাৎ মোট ২৪,০০০ টাকা। এরপর রয়েছে খেতমজুরি, যেটা একর-পিছু ৫,০০০ টাকা। একমাস পর বীজপত্র দেখা দিলে ১৪,০০০ টাকা দিয়ে কেনা ছাগলের লাদি ছড়াতে হয় – হলুদ-চাষে এটা সার হিসেবে গোবরের চাইতে ঢের ভালো, হলফ করে বললেন তিনি।

এবার আসে আগাছা নিড়ানোর পালা, মোট ছয়বার, একেক দফায় লাগে হাজার দশেক টাকা (একর-পিছু ৩০-৩৫ জন মহিলা মজুর কাজ করেন, দৈনিক ৩০০ টাকা পান তাঁরা)। মার্চ মাস এলে শুরু হয় ফসল তোলা, যেটার পিছনে আরও ৪০,০০০ টাকা বেরিয়ে যায় তাঁর। তবে এটা কিন্তু "বাঁধাধরা বন্দোবস্ত। সাধারণত ২০ জন পুরুষ আর ৫০ জন মহিলারা আসেন দল বেঁধে। একদিনেই মিটে যায় পুরোটা। অন্যান্য বছরের চাইতে ফসল অপেক্ষাকৃত ভালো হলে হাজার পাঁচেক টাকা বকশিস চান তাঁরা।"

Fresh turmeric fingers, which are processed by Thiru Murthy to make beauty products and malted drinks.
PHOTO • Aparna Karthikeyan
The purpose-built pit for boiling the turmeric
PHOTO • Aparna Karthikeyan

বাঁদিকে: হলুদের টাটকা শুঁটি, এগুলো দিয়ে প্রসাধন সামগ্রী এবং সীরাজাত (মল্টেড) পানীয় বানাবেন থিরু। ডানদিকে: হলুদ সেদ্ধ করার জন্য এই গর্তটি খোঁড়া হয়েছে

টাটকা তোলা সে হলুদ এবার সেদ্ধ করে, গুঁড়িয়ে পালিশ করা হবে। লেখকের কলমে এটা কেবলই একটা ছোট্ট পংক্তি হলেও থিরুর জন্য এটা ৬৫,০০০ টাকার ধাক্কা। দিনের পর দিন ধরে দক্ষ হাতে ঘাম ঝরাতে হয় এ কাজে। একদিকে উঠতে থাকে খরচার পাল্লা, অন্যদিকে হলুদের ওজন কমতে কমতে আধায় এসে ঠেকে।

দশ মাস, এন্তার খাটাখাটনি আর ২৩৮,০০০ টাকার শেষে হাতে আসে (একর-পিছু) ২ টন হলুদ গুঁড়ো। অর্থাৎ প্রতি কিলো হলুদ উৎপাদনের খরচা হয় ১১৯ টাকা। (কম সময়ে, কম মেহনতে ফসলের পরিমাণ বেশি হবে এমন প্রজাতির হলুদ লাগানোর ফলে কদুমুডির কে. এন. সেল্লামুথুর মতো অন্যান্য জৈব-চাষিদের খরচা হয় কিলো-পিছু ৮০ টাকা।)

মাথা খাটিয়ে হলুদ গুঁড়োর দাম নির্ধারণ করেন থিরু। প্রতি কিলো হলুদ গুঁড়ো করতে খরচ করেন ৪০ টাকা, ওদিকে প্যাকেটজাত করতে আর ক্যুরিয়ার খরচ বাবদ যুক্ত হয় আরও ৪০ টাকা।

পাইকারি দরে কেনে যে দোকানগুলো, অর্থাৎ ন্যূনতম ২০ কিলো করে, তাদের জন্য কিলো-পিছু ৩০০ টাকা দাম বেঁধে দেন থিরু। খেতের দোরগোড়ায় বিক্রি করেন ৪০০ টাকা কিলোয়, ভারতের অন্যান্য প্রান্তে পাঠাতে হলে সেটা বেড়ে ৫০০ টাকায় এসে ঠেকে। অন্যান্য ব্রান্ডের জৈব-মাঞ্জলের দাম ৩৭৫-১,০০০ টাকা প্রতি কিলো। ইরোড মাণ্ডিতে এসে মোটে ৭০ টাকার বিনিময়ে এক কিলো করে শুকনো হলুদ (গুঁড়ো করার পর যেটা কমে ৯৫০ গ্রাম হয়ে যায়) নিয়ে যায় ব্যবসায়ীর দল। অথচ সেটাই তারপর তিনগুণ মুনাফা রেখে বিক্রি করে তারা।

*****

“কাস্তে , বন্দুক বা লাঠি ছাড়াই চাষিদের মেরে থেঁতলে দিয়েছে কর্পোরেটের দল।"
পি. কে. দৈভসিগামণি, সভাপতি, ভারতীয় হলুদ-চাষি সংগঠন

"প্রাণপণে চেষ্টা করেছি, হাজার যুদ্ধ করেও হলুদের ন্যায্যমূল্য বেঁধে দিতে পারিনি," জানালেন ভারতীয় হলুদ-চাষি সংগঠন (টিএফএআই) সভাপতি দৈভসিগামণি। অক্টোবরের এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় ইরোডের কাছেই তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিল পারি। তাঁর কথায়: "সরকার ছুটছে কর্পোরেটের দরবারে, ওদিকে কর্পোরেট ঠিক করে দিচ্ছে সরকারে কারা থাকবে। কথাটা শুধু ক্ষুদ্র হলুদ-চাষিদের নয়, এটা না বদলানো অবধি কোনও কৃষকেরই হাল ফিরবে না... আমেরিকায় গিয়ে দেখুন, ব্যাপারটা হরেদরে একই। কৃষিকাজে লাভের মুখ দেখাটা আজব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওখানে গেলে যে কথাটা ইংরেজিতে শুনতে পাবেন, সেটা না হয় এখানে তামিলেই বলছি আমরা।"

Inside the storage yard of the Perundurai regulated market.
PHOTO • M. Palani Kumar
Buyers at the auction inspect the turmeric lots
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: পেরুন্দুরাইয়ের বাঁধা-দরের বাজার, গুদামঘরের ভিতরে। ডানদিকে: প্লাস্টিকের বারকোশে রাখা হলুদ খুঁটিয়ে দেখছেন নিলামে আসা খদ্দেরের দল

"সামন্ত্রপ্রথা বদলে কর্পোরেট-রাজ এসেছে, এরাই আজকালকার নবাব-জমিদার। ব্যাপকতা ও ক্ষমতা, দুটোর নিরিখেই এরা চূড়ায় বসে আছে, শত শত টন হলুদ প্রক্রিয়াজাত করতে এরাই পারে শুধু। ছোট চাষি যারা, গুটিকয় টনের বেশি সাধ্যি নেই, দামের প্রতিযোগিতায় তারা কেমন করে নামবে বলুন তো?"

ইরোডের সন্নিকটে পেরুন্দুরাইয়ের বাঁধা-দরের বাজার, এখানে নিলামে ভাগ্য নির্ধারিত হয় হলুদ-চাষিদের। শুধুমাত্র হলুদের বিকিকিনির জন্য নির্ধারিত এই বাজারে রয়েছে একাধিক গুদামঘর। রাখা থাকে হাজার হাজার বস্তা হলুদ। এছাড়াও রয়েছে একটা চালাঘর, নিলামটা হয় যেখানে। ১১ই অক্টোবর যেদিন পারি গিয়েছিল, সেদিন এক কুইন্টাল হলুদের শুঁটির 'সর্বোচ্চ' দাম উঠেছিল ৭,৪৪৯ টাকা এবং গেঁড়ের দাম ছিল ৬,৬৬৯ টাকা। নিলামে হাঁকা দর সবসময়ই '৯' দিয়ে শেষ হয়। সংখ্যাজ্যোতিষে অটুট বিশ্বাস যে তাঁদের, বুঝিয়ে বলেছিলেন বাজারের কর্মকর্তা অরবিন্দ পালানিসামি।

৫০টি আলাদা আলাদা চাষের হলুদের অল্প অল্প নমুনা রাখা ছিল প্লাস্টিকের বারকোশে। ব্যবসায়ীরা এসে ঘেঁটে দেখেন বারকোশগুলি, হলুদের শুঁটি ভেঙে, শুঁকে, এমনকি মেঝেতে আছাড় খাইয়ে চলে তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নোটবইয়ে লিখে রাখা হিজিবিজির ভিত্তিতে দাম হাঁকেন তাঁরা। তিনি শুধু "প্রথম সারির" হলুদই কেনেন, জানিয়েছিলেন বৃহৎ একটি মশলা কোম্পানির ক্রয় বিভাগে কর্মরত সি. আনন্দকুমার। প্রদর্শিত নমুনা যাচাই করে আজ তিনি ৪৫৯ বস্তার মধ্যে ২৩ বস্তা হলুদ তুলে নিয়েছেন।

মাণ্ডির পাশেই তাঁর অফিসঘরে বসে অরবিন্দ বলেছিলেন যে প্রতিবছর ৪০ কোটি টাকার মাল কেনাবেচা হয় এই বাজারে। চালাঘরের লাগোয়া সিমেন্টের সিঁড়িতে বসেছিলেন কদুমুডির এল. রাসিনা। ৩০ কুইন্টাল হলুদ এনেছিলেন বটে, তবে কুইন্টাল-পিছু ৫,৪৮৯ টাকার বেশি দর ওঠেনি হতভাগ্য এই মহিলা চাষির আনা হলুদের।

নিজস্ব কোনও গুদামঘর না থাকায় প্রতিদিন কুইন্টাল-পিছু ২০ পয়সা গচ্চা দিয়ে খেতের ফসল সরকারি গুদামঘরে নিয়ে আসতে বাধ্য হন তিনি। কখনও কখনও তো ভালো দামের আশায় ফসল তুলে চার বছর অবধি অপেক্ষা করতে বাধ্য হন চাষিরা। তবে সাত মাসের অপেক্ষা এবং পাঁচ-পাঁচবার বাজারের ধুলো মাড়িয়ে আর টানতে পারলেন না রাসিনা, ঠিক করলেন যে লোকসান রেখেই বেচে দেবেন কষ্টের ফসল।

কোঙ্গু বলয়, অর্থাৎ ইরোড, কোয়েম্বাটোর এবং সালেম জেলার অধিকাংশ চাষিদের জন্য কৃষিকাজ কেবলই একটি অতিরিক্ত পেশা, জানালেন দৈভসিগামণি। "শুধু চাষের ভরসায় থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।"

P.K. Deivasigamani, president of the turmeric farmers' association.
PHOTO • M. Palani Kumar
Labels on the samples exhibited at the turmeric auction
PHOTO • M. Palani Kumar
Labels on the samples exhibited at the turmeric auction
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: হলুদ-চাষিদের সংগঠনের সভাপতি পি. কে. দৈভসিগামণি। মাঝখানে ও ডানদিকে: হলুদের নিলামে প্রদর্শিত নমুনায় সাঁটা রয়েছে চিরকুট

তাঁর আন্দাজ, তামিলনাড়ুতে ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ চাষি হলুদ গাছ লাগান, সংখ্যাটা নির্ভর করে দরদামের উপর। এক কুইন্টালের দাম ১৭,০০০ টাকা (সত্যিই এককালে যেটা ছিল) হলে হলুদ-চাষির সংখ্যা "৫ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে", একমুখ হাসি নিয়ে জানালেন দৈভসিগামণি। "আর দরটা পড়তে পড়তে ৫,০০০ প্রতি কুইন্টালে এসে ঠেকলে হলুদ-চাষে হাজার দশেকের বেশি লোক দেখতে পাবেন না।"

এ ব্যাপারে একটাই উপদেশ রয়েছে তাঁর: বিবিধকরণ। "ব্যাপক পরিমাণে হলুদ চাষ করা বন্ধ হোক," বোঝাচ্ছিলেন তিনি, "উৎপাদন কমলে দামটাও বাড়বে বৈকি।"

*****

"অতিরিক্ত উৎপাদনের লোভে হাইব্রিড প্রজাতি চাষ করার বদলে দেশি হলুদ লাগানো উচিত।"
থিরু মূর্তি, ইরোডের হলুদ-চাষি

গতবছর মার্চ মাসের কথা – খেতমজুরের দল এসে কখন তাকে সেদ্ধ করে শুকোবে, সে আশায় দিন গুনছিল কুঁকড়ে যাওয়া হলুদপাতায় ঢাকা তামাটে কন্দের পাহাড়, সবমিলিয়ে দুই টন। থিরু কিন্তু আধুনিকতার বিরোধী নন মোটেও: সৌরশক্তি ব্যবহারও করেন, প্রচারও করেন। তবে এর পাশাপাশি ঐতিহ্যময় দেশীয় ফসলের উপর অগাধ বিশ্বাস তাঁর, 'স্থানীয় ইরোড প্রজাতির' হলুদ ভৌগলিক নির্দেশিকা লাভ করাতে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছেন তিনি।

তামাম গবেষণাগার যে শুধু উৎপাদনের পিছনেই পড়ে আছে, এ ব্যাপারটাকে তিরস্কার করেন থিরু। ফসলের পরিমাণ বাড়াতে গিয়ে রাসায়নিক সার কিনতে নাজেহাল হয়ে যান চাষিরা। "আমরা যাতে ন্যায্যমূল্যে ফসল বেচতে পারি, এ ব্যাপারে সরকারের কোনও হেলদোল নেই কেন শুনি?" নীতি-নির্ধারকদের উচিত হাতেনাতে চাষ করতে শেখা, জোর গলায় জানালেন তিনি। এ ব্যাপারে সহমত তাঁর স্ত্রী ও ব্যবসার অংশীদার গোমতি। দম্পতির কথায়: "কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এসে আমাদের খেত-খামারে কাজ করুক। বাস্তব দুনিয়ায় কী কী সমস্যা রয়েছে এগুলো না বুঝলে লোকে কেবল ওই হাইব্রিডের পিছনেই ছুটে মরবে।" তাঁদের এই রাগটা কিন্তু অমূলক নয়। ঝাঁ-চকচকে হাইব্রিড প্রজাতি চাষ করলে কুইন্টাল-পিছু অতিরিক্ত ২০০ টাকা আসে বটে – কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক না ঢাললে সেসব চাষ করা সম্ভব নয়।

শুরুর দিকে টাকাপয়সার নগদ লেনদেন খুব একটা সহজ ছিল না। হলুদ এমনই জিনিস যে এই বছর চাষ করলে বেচতে বেচতে গোটা একটা বছর ঘুরে যায়। ওদিকে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করাও সম্ভব নয় থিরুর পক্ষে, কারণ ছেলেকে জামানত রেখে তাঁর আপ্পা ১৪ লাখ টাকার ঋণ তুলেছিলেন এককালে। সে টাকা আজও শোধ করে যাচ্ছেন থিরু। আর সেটা করতে গিয়ে বেসরকারি সূত্রে অতিরিক্ত টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। সুদের হার "রেন্ডু রুপা ভাট্টি" (প্রতিমাসে একশো টাকায় ২ টাকা), অর্থাৎ বছরে ২৪ শতাংশ।

The harvested turmeric is covered with dried leaves, waiting to be boiled, dried and polished.
PHOTO • Aparna Karthikeyan
Thiru uses solar power and champions it
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: কবে তাকে সেদ্ধ করে, শুকিয়ে-টুকিয়ে পালিশ করা হবে সে আশায় দিন গুনছে শুকনো পাতায় ঢাকা হলুদ। ডানদিকে: সৌরশক্তির ব্যবহার ও প্রচার, দুটোই করেন থিরু

"ফেসবুকের কয়েকজন বন্ধু টাকা ধার দিয়েছিল, একপয়সাও সুদ নেয়নি ছয়মাস ধরে। হ্যাঁ, ধার করার আর দরকার পড়ে না বটে, কিন্তু আপ্পার নেওয়া সেই ব্যাংকের লোনটা আজও শোধ করে যাচ্ছি।" মাস গেলে আজ তিনি ৫০,০০০ টাকা রোজগার করেন ঠিকই, কিন্তু দিনে ১২ ঘণ্টা করে এই যে তিন-তিনটে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (থিরু, তাঁর আম্মা এবং গোমতি) খেটে চলেছেন অবিরাম – তাঁর পরিবারের এই কায়িক পরিশ্রম বাবদ মজুরির হিসেব মোট উৎপাদন মূল্যের মধ্যে ধরা হয় না।

মাঞ্জল গুঁড়ো করার কামরায় একমুঠো গেঁড় হাতে তুলে দেখালেন থিরু। সূর্যের মতো ঝকঝকে কমলা, পাথরের মতো কঠিন। এতই কঠিন যে পেষাইযন্ত্রে দেওয়ার আগে গ্র্যানাইটের হামানদিস্তায় হাতে করে থেঁতো করতে হয় তাদের। নয়তো পেষাইযন্ত্রের ধাতব দাঁত ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

অদ্ভুত একটা মেঠো সুগন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই কামরাটা জুড়ে, টাটকা গুঁড়ো করা হলুদের ঘ্রাণ সত্যিই বড়ো আরামদায়ক। বিদ্যুৎচালিত পেষাইযন্ত্র, সুইচবোর্ড, চারিদিকে থিকথিক করছিল সোনালি ধুলো, রেহাই পায়নি মাকড়সার জালগুলোও, হলুদ গুঁড়োর বনমালে যেন সেজে উঠেছিল তারা।

কমলায় ছোপানো থিরুর তালুদুটোর মাঝে শোভা পাচ্ছিল মারুধানি (হেনা) রাঙা মস্ত একটা চক্র, চারিধার ঘিরে যার ছোট ছোট ফোঁটা। চাবুকের মতো হাতদুটো তাঁর দিনরাত ঘাম ঝরানোর হলফনামা। তবে ফসলের সঙ্গে মূল্য সংযোজন করতে যে কী পরিমাণে খাটতে হয়, বা এর পিছনে যে কত খরচা-সাপেক্ষ ব্যর্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা লুকিয়ে আছে, সে কথা থাকে নেপথ্যে। এই যেমন এবছর আদা-চাষ করতে গিয়ে ভরাডুবি হয়েছে। তবে ৪০,০০০ টাকার সে লোকসানটা তিনি "একটা শিক্ষা পেলাম" বলে মেনে নিয়েছেন হাসিমুখে। থিরুর কাছে এসব গল্প শুনছি যখন, ততক্ষণে গোমতি আমাদের জন্য গরম গরম বাজ্জি আর চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

*****

" হলুদের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে এটা ঠিক করেছি যে ইরোড জেলার ভবানীসাগরে ১০০ একর জমির উপর হলুদের জন্য একটা নতুন গবেষণা কেন্দ্র বানানো হবে।"
এম. আর. কে. পনীরসেলভম, তামিলনাড়ুর কৃষিমন্ত্রী

যে দেশে সর্বোচ্চ মানের হলুদ কিলো-পিছু ৯৩.৫ টাকায় রপ্তানি আর ৮৬ টাকায় আমদানি করা হয়, সে দেশের চাষিরা কেমন করে সাফল্যের মুখ দেখবেন এটা বলতে পারবেন? ৭ টাকার এই ফারাকটা শুধু যে চাষিদের গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলছে তা নয়, ভবিষ্যতে তাঁরা যে ন্যায্যমূল্যের আশা করবেন, আমদানির এ বাড়বাড়ন্ত (চার বছর আগে যতটা ছিল আজ তার দ্বিগুণ) সে আশাতেও জল ঢেলে দিয়েছে।

A small batch of turmeric waiting to be cleaned
PHOTO • M. Palani Kumar
Thiru Murthy and T. Gomathy with their electric grinding mill
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: ঝাড়াইয়ের অপেক্ষায় পড়ে আছে একগোছা হলুদ। ডানদিকে: বিজলি-চালিত সেই পেষাইযন্ত্রটার পাশে থিরু মূর্তি ও টি. গোমতি

হলুদ উৎপাদনে ভারতবর্ষ এক নম্বরে থাকলেও "বেশি পরিমাণে কুর্কুমিন আছে এমন প্রজাতির" আশায় আমরা অন্যান্য দেশের থেকে হলুদ আমদানি করে চলেছি, একটি সরকারি আদেশ দ্বারা এ কথাটা যে তামিলনাড়ু সরকার স্বীকার করেছে, কৃষিমন্ত্রী পনীররসেলভম জানালেন সেটা।

গত অগস্টে কৃষিক্ষেত্রে আলাদা করে বাজেট ঘোষণা করার সময় পনীরসেলভম জানিয়েছেন যে হলুদের জন্য নতুন একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হতে চলেছে, এবং এই খাতে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার। "চাষিরা যাতে হলুদ-চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসলের পিছনে না ছোটেন", সেজন্য উচ্চমানের হলুদের প্রজাতি, মূল্য সংযোজনের পন্থা ও হাতেনাতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকার বদ্ধপরিকর।

থিরুর নিজস্ব জীবনদর্শনখানি অবশ্য খুবই সোজাসাপ্টা: সবচাইতে ভালো জিনিসটা তুলে দিতে হবে খদ্দেরের হাতে। "মালপত্তর ভালো হলে ৩০০টা লোক যেমন কিনবে, তেমনই তারা আবার ৩,০০০ জনকে গিয়ে বলে আসবে। অথচ মালটা যদি নিচুমানের হয়, সেই ৩০০ জনই গিয়ে দেখবেন ৩০,০০০ লোকের কাছে গিয়ে নিন্দে করছে।" একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া, অন্যদিকে মুখে মুখে প্রচার, এই দুই হাতিয়ারের ভরসায় ৩ টন মাঞ্জল ১০ মাস ধরে একটু একটু করে বিক্রি করেন তিনি, গড় হিসেবে মাসিক ৩০০ কিলো। তবে এ যাবৎ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু শিখতেও পেরেছেন। এক, পাইকারি বাজারে জৈব প্রক্রিয়ায় চাষ করা হলুদের মূল্য নির্ধারণে কোনও অগ্রাধিকার নেই। দুই, সরাসরি খদ্দেরকে গিয়ে না বেচা অবধি ন্যায্যমূল্যের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

খদ্দেরের জন্য খেতের হলুদ দুইভাবে প্রস্তুত করেন থিরু। প্রথম উপায়টি চিরাচরিত: কন্দগুলি সেদ্ধ করে, শুকিয়ে গুঁড়ো করা। গবেষণাগার হতে প্রাপ্ত পরীক্ষার ফলাফল দেখালেন আমায় – এভাবে প্রস্তুত করলে কুর্কুমিনের মাত্রা থাকে ৩.৬। দ্বিতীয় উপায়টি অভিনব। কন্দগুলি গুঁড়ো করার আগে ফালা-ফালা করে কেটে রোদে শুকিয়ে নেন। এক্ষেত্রে কুর্কুমিনের মাত্রা থাকে ৮.৬। তবে কুর্কুমিন নিয়ে সাধারণ মানুষের এ হেন মাথাব্যথা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন থিরু: "ওষুধের কোম্পানিগুলো কুর্কুমিন নিয়ে লাফালাফি করে সেটা নাহয় বুঝলুম, কিন্তু রান্নাবান্নায় দেওয়া হলুদে কতটা কুর্কুমিন আছে সেটায় কি যায় আসে বলুন তো?"

ফসল তোলার পর টাটকা তাজা হলুদও বিক্রি করেন তিনি। সেটার দাম ৪০ টাকা প্রতি কিলো (বাঁধাছাঁদা করে ডাকের মাধ্যমে পাঠাতে গেলে ৭০ টাকা হয়ে যায় দামটা)। এছাড়াও স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রতিমাসে ৩,০০০টা করে সাবান তৈরি করেন। মোট নয় রকমের সাবান বানান তাঁরা, হরেক কিসিমের জড়িবুটি জোগাড় করে এনে চেলে-টেলে মেশান তাতে। এর মধ্যে রয়েছে হলুদ, ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা), বেনা বা বিন্না ঘাস (ভেটিভার), হরিৎমঞ্জরী (কুপ্পামেনি), কৃষ্ণ শিরিষ (আরাপু), শিকাকাই এবং নিম।

স্বামীকে নিয়ে মশকরা করছিলেন গোমতি: "কী কী মেশাচ্ছি না মেশাচ্ছি, এসব কেউ বলে? বারণ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে লোকে, কিন্তু কে কার কথা শোনে? ওকে সব বলতেই হবে! এমনকি সাবান তৈরির পদ্ধতিটাও।" হলুদ দিয়ে যে কী করে চুলের রঙ বানাতে হয়, এটাও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন থিরু। তবে এ ব্যাপারে খুব একটা গা করতে নারাজ তিনি: "করুক না চেষ্টা অন্য লোকে, দেখব কেমন পারে। আরে বাবা, প্রথম প্রথম উৎসাহ পেলেও শেষ অবধি সেটা ধরে রাখা চাপ।"

*****

" একজন চাষি কখনই নিজের সবচেয়ে ভালো ফসলটা ভোগ করেন না। বিক্রিবাটার পর যা পড়ে থাকে , সেটাই তাঁর ভোজ্য। অন্যান্য সবকিছুর ক্ষেত্রেই এটা খাটে। কেবল বাঁকাচোরা কলাগুলোই আমরা নিজেরা খাই ; ভাঙাচোরা না হলে সে সাবান রাখি না নিজেদের জন্য..."
টি. গোমতি, ইরোডের হলুদ-চাষি

Thiru and Gomathy with their children in the workshop, behind their living room.
PHOTO • M. Palani Kumar
Gomathy and her daughter shelving soaps in the workshop
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: থিরু ও গোমতি, বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে গেরস্থালির পিছনে তাঁদের কর্মশালায়। ডানদিকে: মেয়ের সঙ্গে কর্মশালায় সাবান বানাচ্ছেন গোমতি

থিরু মূর্তি আর গোমতির বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে, ২০১১ সালে। ততদিনে জৈব-চাষ শুরু করে দিলেও মূল্য সংযোজনের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না থিরু। ফেসবুকে যোগ দেন ২০১৩ সালে। সেখানে একটা পোস্ট শেয়ার করার পর একে একে অনেক কিছুই মাথায় আসতে থাকে তাঁর – সোশ্যাল মিডিয়ার কতখানি ক্ষমতা, গ্রাম ও শহরের মাঝে রয়ে যাওয়া অসংযোগ, এমনতর নানান জিনিস।

কিছুই না, নিজের প্রাতঃরাশের ছবি শেয়ার করেছিলেন কেবল, সেখান থেকেই শুরু হয় এসব। যে খাবারটাকে নিতান্তই সাদামাটা ভেবেছিলেন থিরু, সেই রাগি কলি (মিলেটের পিণ্ড) ছাপ রেখে যায় মানুষের মনে, আসতে থাকে অসংখ্য লাইক ও কমেন্ট। এসব দেখে সাহস পেয়ে কৃষিজীবনের খুঁটিনাটি পোস্ট করতে শুরু করেন প্রতিদিন। আগাছা নিড়ানো, জৈব-সার ছড়ানো, সবকিছুরই দলিল হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়া।

প্রথম হলুদ-চাষের ফসলটাও অনলাইন বেচেছিলেন তিনি। অচিরেই এ কাজে জড়িয়ে পড়েন গোমতিও। "সাবান, তেল, হলুদ গুঁড়ো, এসবের বরাতগুলো আমার ফোনের মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে আসত, আর আমি সেগুলো ওকে পাঠিয়ে দিতাম।" সংসারের সমস্ত কাজকর্ম, ছেলে নিথুলান (১০) ও মেয়ে নিজাঝিনির (৪) দেখভাল করার পাশাপাশি মালপত্র বেঁধেছেঁদে ডাক-মারফত পাঠানো, সবকিছু গোমতিই সামলান।

এরই মাঝে শুরু হয় কোভিড-লকডাউন, ছেলের অনলাইন পড়াশোনার জেরে নাজেহাল হয়ে পড়েন তিনি। একবার দেখা করতে গিয়ে দেখি যে ছানাপোনারা কাঁচের বয়ামে ব্যাঙাচি ধরে খেলতে ব্যস্ত, আর তাদের পোষা কুকুরটা অবাক হয়ে জুলজুল করে দেখছে শিশির ভিতর। আরেকবার গিয়ে দেখি যে তারা একটা স্টিলের পাইপ বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। "শেষমেশ এটাই শিখলো বুঝলেন? বাঁদরের মতো কেমনভাবে পাইপ বেয়ে উঠতে হয়," দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন গোমতি।

সাহায্য করার জন্য মোটে একজনই আছে, তাঁদেরই গ্রামের এক মহিলা। "২২ রকমের জিনিসপত্র তৈরি করি আমরা, খদ্দেররা সেটার তালিকা থেকে বেছে বেছে একটা করে জিনিসের বরাত পাঠায়। হিসেব রাখা কঠিন," জানালেন গোমতি। বাড়ির চাবি, ব্যবসার চাবি – দুটোই তাঁর আঁচলে বাঁধা। যত না কথা বলেন, হাসেন তার চেয়েও বেশি।

স্থানীয় বাজারের চাইতে দশগুণ দামে কেন গুঁড়ো হলুদ বেচছেন, প্রতিদিন জনা দশেক খদ্দেরকে এ কথা বোঝাতে বোঝাতেই দিন কেটে যায় থিরুর। "প্রতিদিন নিদেনপক্ষে ঘণ্টা দুই করে জৈব-চাষ, ভেজাল এবং কীটনাশকের বিপদের কথা বোঝাই লোকজনকে।" ফেসবুকে ৩০,০০০ জন ফলোয়ার আছে তাঁর, পোস্ট করলে ১,০০০টা লাইক এবং খান দুশো কমেন্ট আসে। হরেক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন মানুষজন। "জবাব না দিলেই তো 'ল্যাজমোটা' হয়ে গেছে বলে দাগিয়ে দেবে লোকে।"

Weighed and packed turmeric powder, which Thiru sells directly through social media.
PHOTO • M. Palani Kumar
Soaps and bottles of hair oil, ready to be sold
PHOTO • M. Palani Kumar
Soaps and bottles of hair oil, ready to be sold
PHOTO • M. Palani Kumar

বাঁদিকে: মেপে রাখা গুঁড়ো হলুদের প্যাকেট, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এগুলি সরাসরি বিক্রি করেন থিরু। মাঝখানে ও ডানদিকে: বিক্রিবাটার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সাবান আর চুলে মাখার তেল

খেতের কাজ আর ই-বিজনেস ("এটাকে যে ই-বিজনেস বলে সেটা এই গতমাসে জেনেছি!") সামলানোর চক্করে পাঁচ-পাঁচটা বছর কেটে গেছে একটা দিনের জন্যও কোথাও ঘুরতে-টুরতে যাননি থিরু। "আরও বেশি বই কম নয়," একগাল হেসে জানালেন গোমতি। "খুব বেশি হলে ঘণ্টা ছয়েকের জন্য ছুটি নিতে পারে মানুষটা। তারপর তো বাড়ি ফিরতেই হবে, গরুছাগল, খেতের ফসল, কাঠের চেক্কু (তেলের ঘানি), এসব মুখিয়ে থাকে ওর জন্য।"

কোথাও বিয়েবাড়িতে ডাক পড়লে থিরুর মা যান, তাঁর বড়োদাদা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান তাঁকে। নিমন্ত্রণ রক্ষার ফুরসৎটুকুও পান না থিরু। "কোভিড-১৯ অতিমারির জন্য কিছুটা হলেও টাকাপয়সা বাঁচছে," ঠাট্টার সুরে জানালেন থিরু, "এমনিতে নেমন্তন্ন পেলে সেই কোয়েম্বাটোর অবধি গাড়ি চালিয়ে যেতে হত। এখন তো কাজের বাড়ি-টাড়ি এসব বন্ধ, তাই জ্বালানির তেলের ১,০০০ টাকা বেঁচে যায়।"

খেতমজুরেরা কাজে এলে "তদারকির কাজ আম্মাই করে। আমার সময়টা তো উপর উপর সবকিছু সামলাতেই কেটে যায়।" দুবারই যখন দেখা করতে গিয়েছি, গোমতি ব্যস্ত ছিলেন হেঁশেলে বা কর্মশালায় – গেরস্থালির ঠিক পিছনেই উঁচুমতো চালায় ঢাকা, তাক থেকে উঁকি দিচ্ছে থরে থরে সাজানো সাবান, কোনটা কী ধরনের বা কবে তৈরি করা, চিরকুটে সবকিছু লেখা রয়েছে গোটা গোটা অক্ষরে। সকাল ৫.৩০ বাজতে না বাজতেই কাজে লেগে পড়েন এই দম্পতি, দিনে ১২ ঘণ্টা করে খাটেন তাঁরা।

কোথায় কোন গাছগাছড়ার কী কী গুণাগুণ সবই ঠোঁটস্থ তাঁদের, সেসবের নাম জিজ্ঞেস করাতে মেলট্রেন ছোটালেন তামিলে। ঠান্ডা অবস্থায় পেষাই করা নারকেল তেলে চুবিয়ে, রোদ খাইয়ে, বিভিন্ন ফুল ও জড়িবুটি থেকে চুলে মাখার সুগন্ধি তেল বানান গোমতি। "খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়ার আগে নিজেরা পরখ করে দেখে নিই সবকিছু," গোমতি বলছিলেন।

ব্যবসার কাজে লেগে পড়েছে গোটা পরিবারটাই, জানালেন থিরু। তাঁদের এই বিনেপয়সার মজুরির কারণেই মালপত্রের দাম এতটা কম।

*****

" আমুল দুধ কিনতে খদ্দের যে টাকাটা দেয় , সেটার প্রায় ৮০ শতাংশই পৌঁছে যায় গোয়ালাদের কাছে। সারা দুনিয়ায় এই কাঠামোর জুড়ি মেলা ভার।"
বালাসুব্রহ্মনিয়ম মুথুস্বামী, সংবাদপত্রের বিভাগীয় লেখক

Thiru spends at least two hours a day educating others about organic farming.
PHOTO • Aparna Karthikeyan
Gomathy and Thiru with an award they received for organic farming
PHOTO • Aparna Karthikeyan

বাঁদিকে: প্রতিদিন ঘণ্টা দুই করে জৈব-চাষ সম্পর্কে অন্যদের শিক্ষা দেন থিরু। ডানদিকে: গোমতি ও থিরু, এই পুরস্কারটি জৈব-চাষের জন্য পেয়েছেন তাঁরা

গড়পড়তা একজন ক্ষুদ্রচাষির (দুই একরেরও কম চাষজমি যাঁর, বা ইজারা নেওয়া জমিতে চাষ করেন যিনি) পক্ষে থিরুর পদানুসরণ করাটা সত্যিই মুশকিল। ওঁর এই সাফল্যের অনুকরণ এককথায় অসম্ভব। তামিল সংবাদ সংস্থা অরুনচলের বিভাগীয় লেখক তথা ইরোডের এক কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ বালাসুব্রহ্মনিয়ম মুথুস্বামীর মতে কার্যকরী উপায় বলতে একমাত্র সমবায়ের পথটাই খোলা রয়েছে।

খদ্দের যে টাকাটা দিচ্ছেন, আদতে সেটার কয় শতাংশ চাষি অবধি গিয়ে পৌঁছয়, সেই হিসেবটা তুলে ধরলেন তিনি। এ ব্যাপারে দুধের টিকিটিও ছোঁওয়া দায়। সমান তালে এগিয়ে রয়েছে সমবায়ের কাঠামোও, উদাহরণস্বরূপ আমুলের কথা মনে করালেন বালাসুব্রহ্মনিয়ম। এক কিলো হলুদ কিনতে খদ্দেরের ২৪০ টাকা খরচা হলে সেটার ২৯ শতাংশ পান চাষিরা। অথচ আমুল দুধের বেলায় চাষিটি পান ৮০ শতাংশ।

চাষিদের ব্যাপকভাবে সংগঠিত করাটাই চাবিকাঠি, বুঝিয়ে বললেন বালাসুব্রহ্মনিয়ম। "ফড়েদের ছেঁটে ফেলে ব্যবসার গোড়া থেকে আগা অবধি চাষিদের হাতের মুঠোয় ভরে রাখতে হবে।" তবে হ্যাঁ, সমবায় তথা কৃষক সংগঠনগুলিতেও যে হরেক রকমের সমস্যা রয়েছে, এটাও স্বীকার করলেন তিনি। "সঠিকভাবে পরিচালনা করা ছাড়া আর উপায় নেই কোনও।"

হলুদ চাষ করেও যে মুনাফা রাখা সম্ভব, এটা জোর গলায় বলেন থিরু – তবে সেটার জন্য মূল্য সংযোজন করাটা আবশ্যকীয়। নারকেল তেল, কলার গুঁড়ো, কুমকুম (হলুদ থেকে বানানো) এবং সাবানের পাশাপাশি গত সাত বছরে ৪,৩০০ কিলো হলুদ গুঁড়ো বিক্রি করেছেন তিনি। তবে নিজস্ব জমিজমা না থাকলে এমনটা করতে পারতেন না। (গড়পড়তা একজন ক্ষুদ্রচাষির পক্ষে যে এমনটা করা অসম্ভব, আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠল সেটা)। "দশ একর জমির দাম ৪ কোটি টাকা! দেবেটা কে শুনি?" তাঁর ব্যবসার প্রায় পুরোটাই ইন্টারনেটের জোরে চলে। নিজস্ব জিএসটি নম্বর আছে থিরুর। গুগল পে, ফোন পে, পেটিএম, ভীম এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মারফত লেনদেন করেন তিনি।

জৈব-চাষ, মূল্য সংযোজন তথা সরাসরি ক্রেতার হাতে জমির ফসল পৌঁছে দেওয়ার জন্য অভিনেতা কার্তিক শিবকুমারের উঝাভন ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে ২০২০ সালে একটি পুরস্কার সমেত এক লাখ পেয়েছেন থিরু। পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন কোঙ্গু অঞ্চলেরই আরেক মানুষ তথা তামিল অভিনেতা সত্যরাজ।

বছর বছর প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট সাফল্য যেন আরো দৃঢ়চেতা করে তোলে থিরুকে। হার মানা ধাতে নেই তাঁর। "মরে গেলেও ওই 'লোকসান' শব্দটা কোনও চাষির মুখ থেকে শুনতে চাই না," জানালেন তিনি, "এ লড়াইটা যে আমাকে জিততেই হবে।"

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সাহায্য ও আতিথেয়তা প্রদান করার জন্য কৃষি জননীর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ঊষা দেবী ভেঙ্কটচালামের প্রতি লেখকের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত আলোকচিত্র: এম. পালানি কুমার

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)

Aparna Karthikeyan

अपर्णा कार्तिकेयन एक स्वतंत्र पत्रकार, लेखक, और पारी की सीनियर फ़ेलो हैं. उनकी नॉन-फिक्शन श्रेणी की किताब 'नाइन रुपीज़ एन आवर', तमिलनाडु में लुप्त होती आजीविकाओं का दस्तावेज़ है. उन्होंने बच्चों के लिए पांच किताबें लिखी हैं. अपर्णा, चेन्नई में परिवार और अपने कुत्तों के साथ रहती हैं.

की अन्य स्टोरी अपर्णा कार्तिकेयन
Photographs : M. Palani Kumar

एम. पलनी कुमार पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया के स्टाफ़ फोटोग्राफर हैं. वह अपनी फ़ोटोग्राफ़ी के माध्यम से मेहनतकश महिलाओं और शोषित समुदायों के जीवन को रेखांकित करने में दिलचस्पी रखते हैं. पलनी को साल 2021 का एम्प्लीफ़ाई ग्रांट और 2020 का सम्यक दृष्टि तथा फ़ोटो साउथ एशिया ग्रांट मिल चुका है. साल 2022 में उन्हें पहले दयानिता सिंह-पारी डॉक्यूमेंट्री फ़ोटोग्राफी पुरस्कार से नवाज़ा गया था. पलनी फ़िल्म-निर्माता दिव्य भारती की तमिल डॉक्यूमेंट्री ‘ककूस (शौचालय)' के सिनेमेटोग्राफ़र भी थे. यह डॉक्यूमेंट्री तमिलनाडु में हाथ से मैला साफ़ करने की प्रथा को उजागर करने के उद्देश्य से बनाई गई थी.

की अन्य स्टोरी M. Palani Kumar
Translator : Joshua Bodhinetra

जोशुआ बोधिनेत्र, पीपल्स आर्काइव ऑफ़ रूरल इंडिया के भारतीय भाषाओं से जुड़े कार्यक्रम - पारी'भाषा के कॉन्टेंट मैनेजर हैं. उन्होंने कोलकाता की जादवपुर यूनिवर्सिटी से तुलनात्मक साहित्य में एमफ़िल किया है. वह एक बहुभाषी कवि, अनुवादक, कला-समीक्षक और सामाजिक कार्यकर्ता भी हैं.

की अन्य स्टोरी Joshua Bodhinetra