নাগি রেড্ডি তামিলনাড়ুতে থাকেন ঠিকই, তবে কথা বলেন কন্নড়ে, আর তেলুগুতেও দিব্যি সড়গড়। ডিসেম্বরের এক হিমধরা সকাল, কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করায় উনি বেশ আলগাভাবেই বলে দিলেন বটে, "ওই তো ওখানে," কিন্তু সেখানে পৌঁছতে গেলে একখানা টইটুম্বুর হ্রদ পেরিয়ে, ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ ছাড়িয়ে, ইউকেলিপটাসে ঢাকা পাহাড় ডিঙিয়ে, আমবাগান ঠেঙিয়ে যেতে হবে। বাড়ির গায়েই গোয়ালঘর, পাহারাদার কুকুর আর তেনার কুঁইকুঁই করতে থাকা ছানা।
যে যে সমস্যায় এ দেশের চাষিরা জেরবার হয়ে যান সেসবের মোকাবিলা তো নাগি রেড্ডি করেনই, উপরন্তু আরও একখানা এমন আপদ রয়েছে যে এবার বোধহয় অন্য কিছু একটা চাষ করতে হবে তাঁকে। তিন-তিনটে ষণ্ডার পাল্লায় পড়েছেন তিনি: মোট্টাই ভাল, মাখনা ও গিরি।
এখানকার চাষিরা একটা কথা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, ওই তিনজনকে হালকাভাবে নেওয়াটা ঠিক নয়। 'হালকা' শব্দটি যতটা না আলঙ্কারিক, ঠিক ততটাই আক্ষরিক, কারণ একেকটা ষণ্ডার ওজন ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ কিলো। কাঁটায় কাঁটায় তেনাদের ওজন বা উচ্চতা যে কতখানি সেটা আজ অবধি তাঁরা মেপে উঠতে পারেননি। অবশ্য দোষও দেওয়া যায় না। আরে বাবা, কেই বা আর সখ করে খ্যাপা হাতির সামনে দাঁড়াবে?
আমরা এখন তামিলনাড়ু আর কর্ণাটকের সীমান্তবর্তী কৃষ্ণগিরি জেলায় রয়েছি। দেংকানিকোট্টাই তালুকের যে জনপদে নাগি রেড্ডির বাড়ি, সেই ভদ্র পালায়াম থেকে জঙ্গল খুব একটা দূরে নয়, অর্থাৎ হাতিমামারা আশেপাশেই রয়েছেন। নাগির সিমেন্টে বাঁধানো বারান্দায় বসেছিলাম আমরা, মিটারখানেকের দূরত্বেই তাঁর খেত। এই ৮৬ বছর বয়সী মানুষটিকে এখানকার লোকে আদর করে নাগান্না বলে ডাকে। রাগি (ফিংগার মিলেট) নামে একধরনের পৌষ্টিক গুণমান সম্পন্ন শস্য ফলান তিনি। শুভ, অশুভ, ভয়াবহ – কৃষি জগতের সকল রকম চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী নাগি রেড্ডি।
"যখন জোয়ান ছিলাম, তখন চাষের মরসুমে রাগির গন্ধে ছুটে আসত আনৈয়ের (হাতি) দল, তবে দিনকতকের বেশি থাকত না।" আর এখন? "হামেশাই এসে হানা দেয়, সে শস্যই বলুন বা ফলমূল, সবকিছু খেয়ে শেষ করে দেওয়াটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে ওদের।"
এর পিছনে দুটো কারণ রয়েছে, তামিলে বুঝিয়ে বললেন নাগান্না: "১৯৯০ সালের পর থেকে জঙ্গল ছোট হয়ে এসেছে, গাছপালার অবস্থাও খারাপ হয়েছে দিনকে-দিন, অথচ হাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই পেটের জ্বালা মেটাতে ওরা গাঁয়ে ঢুকে পড়ে। আর আপনি যেমন ভালো কোনও হোটেলে যাওয়ার সময় ইয়ার-দোস্তদের ডাকেন, ওরাও ঠিক তেমনই করে," মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা। হাসিমুখে এমন একখান ব্যঙ্গাত্মক উপমা টানলেন, চমকে না উঠে যাই কোথায়?
কীভাবে তাঁরা হাতিদের তাড়িয়ে জঙ্গলে ফেরান শুনি? "কুচাল (বিকট আওয়াজ) করি। ব্যাটারি জ্বালাই," এই বলেই বনদপ্তর থেকে দেওয়া একটি এলইডি টর্চের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। সেটা জ্বালিয়ে দেখালেন নাগির ছেলে আনন্দরামু, ডাকনাম আনন্দ। বেশ উজ্জ্বল সাদা আলো, অনেকদূর অবধি ছড়াচ্ছেও বটে। "তিন ষণ্ডার মধ্যে কেবল দুটিকেই তাড়াতে পারি," জানালেন নাগান্না।
"মোট্টাই ভাল মুখ ঘুরিয়ে, চোখ দুটো খানিক আড়াল করে দিব্যি খেতে থাকে," উঠে বারান্দায় এক কোণে গিয়ে আলোর দিকে পিঠ রেখে দেখালেন আনন্দ। "পেট না ভরা পর্যন্ত মোট্টাই ভাল যাবেই না। কী জানি, সে ব্যাটা মনে মনে ভাবে বোধহয়: তোরা তোদের কাজ কর – আলো-ফালো জ্বালা, আর আমি আমার কাজ করি – পেটটা না ভরা ইস্তক ভূরিভোজ চালিয়ে যাই।"
সে এক প্রকাণ্ড উদরের মালিক মোট্টাই ভাল, যা পায় তাই গিলে খায়। সবচেয়ে প্রিয় যদিও রাগি আর কাঁঠাল। মগডাল অবধি নাগাল না পেলে সামনের দুটো পা গুঁড়িতে ঠেকিয়ে আরামসে শুঁড় বাগিয়ে ফল পেড়ে খায়। তাতেও না কুলোলে চাপ নেই, পুরো গাছটাই উপড়ে দিতে ওস্তাদ তিনি। কিছুতেই উদরপূর্তি থামে না তার। "মোট্টাই ভাল ১০ ফুট উঁচু," জানালেন নাগান্না। "আর পিছনের দুই ঠ্যাঙে ভর দিয়ে দাঁড়ালে আরও ছয় কি আট ফুট নাগাল পেয়ে যায়," ফুট কাটলেন আনন্দ।
"তবে মোট্টাই ভাল কিন্তু মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। জনার, আম, সব খেয়ে মাঠের বাকি ফসল পায়ে পিষে দিয়ে যায়, আর হাতির তাণ্ডব শেষে যেটুকু পড়ে থাকে তা বাঁদর আর বন শুয়োর মিলে সাফ করে দেয়," বললেন নাগান্না, "সবসময় তক্কে তক্কে থাকি, নয়তো হেঁশেলের দুধ-দই কিসুই থাকবে না, হনুমানের দল এসে লুটপাট চালাবে।"
"তাতেও রেহাই নেই গো, বুনো কুকুর এসে আমাদের মুরগি খেয়ে পালায়। ওদিকে জঙ্গল থেকে চিতাবাঘ আসে, পাহারাদার কুকুরগুলোও বাঁচে না। এই তো গেল হপ্তায়..." তর্জনী তুলে বাঘমামার শিকার করতে আসার রাস্তাটা দেখালেন তিনি, এক লহমায় যেন হিমশীতল এক স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে। সকালটা ঠান্ডা ছিল ঠিকই, তবে অনিশ্চয়তার সীমানায় এভাবে টিকে থাকার যে বাস্তব, সেটা আরও হাড় হিম করা ব্যাপার।
কীভাবে বেঁচে থাকেন তাঁরা? জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। "বাড়িতে খাওয়ার মতো রাগি ফলাই আধা একর জমিতে," বুঝিয়ে বললেন আনন্দ, "একেকটা ৮০ কিলোর বস্তায় মেরেকেটে ২,২০০ টাকার মুনাফা হয়, বড্ডো কম। এছাড়াও আছে সৃষ্টিছাড়া বেমরসুমের বৃষ্টি। যেটুকু পড়ে থাকে, সেটা জন্তু জানোয়ারের পেটে যায়। একটা খেতে তো শুধুই ইউক্যালিপটাস লাগাচ্ছি এখন। এখানকার অনেকেই তো রাগি ছেড়ে গোলাপ চাষে নেমেছে।"
তবে ওসব ফুল-টুলে হাতিদের কোনও লোভ নেই আপাতত। ভবিষ্যতে কী হবে জানা নেই যদিও...
*****
হুই
যেথা সই তাড়াই তোতা মাড়োয়া* খেতের ধারে
দোলনা
দোদুল রইলা গোধূল একলা তাহার তরে।
আইল
কিরাত
,
বাড়িয়ে
দুহাত বইলা দিলাম "ওগো
,
দোদুল
দোলাও দোলনা আমার
,"
কইলা সে জন
, "
হ্যাঁ গো!"
এই
না বলে ঝুলত ঝুলে যেই দিয়েছে ঠেলা
ওমনি
তাহার বুকের পরে ঝাঁপ দেয়ানির খেলা।
ভাবখানি
মোর চালাক চকোর
,
ফসকে গেছে দড়ি
,
অবুঝ
সে জন ভাবল মরণ
,
আঁকড়ে নাহয় ধরি।
চুপটি
করে বুকের পরে ঝিম মেরে তাই থাকি
,
বুঝলি
রে সই এইটারে কই প্রেম পিরিতির ফাঁকি।
* মাড়োয়া: রাগি (এই নামটি রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত)
শৃঙ্গার রসে পরিপূর্ণ উপরোক্ত পংক্তিগুলি ২,০০০ বছর পুরোনো, সঙ্গম যুগের কবি কাপিলারের লেখা ' কলিত্থোকাই ' কবিতার অংশ। ওল্ডতামিলপোয়েট্রি.কম নামে একটি ব্লগ চালান চেন্থিল নাথন, তাঁর কলমে সঙ্গম সাহিত্যের ইংরেজি তর্জমা রয়েছে সেখানে। কাব্যধারায় শামাধানের (মিলেট) অনুষঙ্গ যে খুব একটা বিরল নয় সেকথা জানালেন তিনি।
চেন্থিল নাথনের কথায়: "সঙ্গম সাহিত্যধারার প্রেমমূলক কবিতায় পটভূমি হয়ে বারবার ঘুরেফিরে আসে শামাধানের খেত। একবার চোখ বোলালেই দেখতে পাবেন যে মিলেটের উল্লেখ রয়েছে ১২৫ বার, অর্থাৎ ধানের কথা যতবার বলা হয়েছে তার চেয়ে খানিকটা বেশি। সুতরাং এটা ভাবা খুব একটা ভুল নয় যে সঙ্গম যুগের (আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ) জনজীবনে শামাধানের ভূমিকা ছিল অনেকখানি। এই জাতীয় শস্যের মধ্যে সবচাইতে বেশিবার আসে থিনাই-য়ের (কাওন/কাউন বা ফক্সটেইল মিলেট) নাম, তারপর রয়েছে ভারাগু (হয় রাগি কিংবা কদো শামাধান)।"
রাগির উৎপত্তি পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডায়, 'ভারতীয় খাদ্য: একটি ঐতিহাসিক সহায়িকা' বইয়ে এই কথা বলছেন কে.টি. আচায়া। হাজার হাজার বছর আগে ভারতের দাক্ষিণাত্যে এসে পৌঁছয় রাগি, "কর্ণাটকের তুঙ্গভদ্রার তীরে হাল্লুর প্রত্নস্থল (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)" এবং "তামিলনাড়ুর পাইয়ামপাল্লিতে (১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ)" পাওয়া গেছে এ শস্যের দানা। নাগান্নার বাড়ি থেকে এই জায়গাগুলি মোটে ২০০ কিমি দূরে।
ভারতে মিলেট উৎপাদনে শীর্ষে থাকা কর্ণাটকের পরেই তামিলনাড়ুর স্থান , বাৎসরিক ২.৭৪৫ লাখ মেট্রিক টন শামাধান ফলে এ রাজ্যে। তামিলনাড়ুর মোট রাগি উৎপাদনের ৪২ শতাংশ তার একার দখলে রেখেছে কৃষ্ণগিরি জেলা, অর্থাৎ নাগি রেড্ডির গ্রামটি যেখানে অবস্থিত।
রাগি বা মাড়োয়ার অসংখ্য 'বিশেষ গুণাগুণের' খতিয়ান দিচ্ছে রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংগঠন (এফএও)। কৃষিক্ষেত্রে আয় বাড়াতে শুঁটি জাতীয় ফসলের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি চাষ করা যায় ফিংগার মিলেট। যে মাটি অপেক্ষাকৃত অনুর্বর, সেখানেও মোটামুটি ভালো পরিমাণে রাগি ফলানো যায়, বিশেষ খাটাখাটনিরও প্রয়োজন পড়ে না।
তা সত্ত্বেও দিনকে-দিন কমে এসেছে রাগির উৎপাদন ও জনপ্রিয়তা। স্বাভাবিক ভাবেই এর পিছনে লুকিয়ে আছে সবুজ বিপ্লবের ফলে বাড়তে থাকা ধান ও গমের চাহিদা – আর তার সঙ্গেই বৃদ্ধি পেয়েছে জন-সরবরাহ ব্যবস্থার (পিডিএস বা রেশন ব্যবস্থা) মাধ্যমে উক্ত দুটি শস্যের সহজলভ্যতা।
গত কয়েক বছর ধরে খারিফের মরসুমে সারা ভারত জুড়ে রাগির উৎপাদন তার স্থিরতা হারিয়েছে, তা সত্ত্বেও ২০২১ সালে প্রায় ২০ লক্ষ টন মাড়োয়া চাষ হয়েছিল। তবে ২০২২ সালের আগাম আন্দাজ অনুযায়ী উৎপাদন ব্যাপক হারে কমতে চলেছে। পরিসংখ্যানটি ২০১০ সালে ছিল ১৮.৯ লক্ষ টন। অথচ আগাম সেই আন্দাজ বলছে যে ২০২২ সালের আর্থিক বছরে এটি ১৫.২ লক্ষ টনে এসে ঠেকবে।
শামাধান নিয়ে কর্মরত ধান প্রতিষ্ঠান বলছে যে: "পৌষ্টিক গুণমান সম্পন্ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভারতে ফিংগার মিলেটের ব্যবহার ৪৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে , এছাড়াও গত পাঁচ দশকে অন্যান্য ক্ষুদ্র দানাওয়ালা শামাধানের চল কমে গেছে ৮৩ শতাংশ।"
ভারতবর্ষে সর্বাধিক রাগি চাষ হয় পাশের রাজ্য কর্ণাটকে, সেখানে "গ্রামীণ ক্ষেত্রে গড় হিসেবে পরিবার-পিছু মাড়োয়ার মাসিক ব্যবহার ২০০৪-০৫ সালে ছিল ১.৮ কেজি, সেটা ২০১১-১২ সালে ১.২ কেজিতে এসে দাঁড়িয়েছে।"
কিছু কৌম তথা ভৌগলিক অঞ্চল রাগির উৎপাদন তথা ভক্ষণ ধরে না রাখলে এতদিনে বোধহয় খাদ্য-মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যেত রাগির নাম। এদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কৃষ্ণগিরি জেলা।
*****
যত বেশি রাগি চাষ করবেন, ততই দেখবেন বেশি বেশি গবাদি পশু পালতে পারছেন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে সাপ্তাহিক রোজগারটাও। খড়বিচালি সেরকম জুটছে না বলেই তো লোকজন বাধ্য হচ্ছে গরু-ছাগল সব বেচে দিতে।
গোপাকুমার
মেনন, লেখক
ও চাষি
নাগান্নার বাড়ি যাওয়ার আগের রাতে ওই অঞ্চলে যাঁর আতিথ্য ভোগ করেছিলাম তিনি হলেন গোপাকুমার মেনন, হাতিদের নিয়ে বেশ রোমহর্ষক একখান গল্প শুনলাম তাঁর কাছে। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে গোল্লাপাল্লি গ্রামে তাঁর বাড়ির ছাদে বসেছিলাম আমরা। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু কালচে-ধূসর, তুষারশীতল ও গা-ছমছমে সৌন্দর্য। রাতচরাদের ক্ষুদ্র সেপাইরা জেগে আছে কেবল, কেউ বা গান জুড়েছে, কেউ বা শুধু গুনগুনিয়েই খান্ত। যতটা নজর-কাড়া, ঠিক ততটাই যেন ভরসাজনক।
"মোট্টাই ভাল এসেছিল এখানে," অনতিদূরের একটি আমগাছের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। "আম খেতে বড্ডো সাধ হয়েছিল তেনার, কিন্তু ফলগুলো অবধি নাগাল পায়নি। তাই শিকড়সুদ্ধ গোটা গাছাটাকেই উপড়ে ফেলল।" ভয়ে ভয়ে ইতিউতি চাইতে লাগলাম, যা দেখছি সবই যেন হাতির মতো ঠেকছে। এটা দেখে আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন গোপা: "আরে ঘাবড়াবেন না, ও ব্যাটা এখন যদি এখানে আসত, ঠিক টের পেয়ে যেতেন।"
তারপর একঘণ্টা জুড়ে নানান গপ্পো জুড়েছিলেন তিনি। বিহেভিয়ারাল ইকনমির জগতে একজন আকর হওয়ার পাশাপাশি উনি একজন লেখক ও কর্পোরেট সাহায্যকারীও বটেন। বছর ১৫ আগে গোল্লাপাল্লি গ্রামে খানিকটা জমি কেনেন। চাষবাস করাটা যে মুখের কথা নয়, এটা জমি কেনার আগে টের পাননি। দুই একর জমিতে লেবু আর কুলত্থ চাষ করেই খান্ত হয়েছেন। তবে কৃষিকাজটাই যাঁদের একমাত্র সম্বল, সেই পেশাদার চাষিরা কিন্তু এত সহজে রেহাই পান না। তিনি জানিয়েছিলেন যে পরিপন্থী সরকারি নীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, ফসলের পড়তি দাম এবং মানুষ ও জীবজগতের মধ্যে সংঘাতের ফলে প্রথাগত ভাবে চাষ হওয়া রাগি আজ দুর্দশাগ্রস্ত।
"ওই যে কৃষি-আইন তিনটে প্রথমে পাশ হয়ে শেষে রদ হয়ে গেল, ওগুলো টিকে গেলেও যে ঘোড়ার ডিম কাজে লাগত, সেটা বুঝতে হলে মাড়োয়ার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না," বুঝিয়েছিলেন গোপা, "যাকে খুশি ফসল বেচা যাবে, আইন বাবাজি এমনটা বলেছিল বটে, কিন্তু তামিলনাড়ুর কথাই ভাবুন না হয়। এমনটা সত্যি হলে তো চাষিরা আরও বেশি বেশি করে রাগি ফলাতেন, তাই না? উপরন্তু সেটা হলে তাঁরা কী আর কুইন্টাল-পিছু ৩,৩৭৭ টাকার আশায় খেতের ফসল চোরাপথে কর্ণাটক গিয়ে বেচতেন আদৌ?" [তামিলনাড়ুতে রাগির দাম যে কতখানি কম সেটা জেনেছিলাম আনন্দরামুর কাছে]।
তাহলে এটাই দেখা যাচ্ছে যে তামিলনাড়ুর এই অঞ্চলে ফসলের সহায়ক মূল্য কেউই পান না। গোপা মেননের মতে ঠিক এই কারণেই অনেকে চোরাপথে সীমান্ত পেরিয়ে পাশের রাজ্যে যেতে বাধ্য হন।
মাড়োয়ার দর জানতে চাইলে আনন্দ বললেন যে ঠিক এই মুহূর্তে তামিলনাড়ুর হোসুর জেলায় "সবচাইতে ভালো মানের রাগির দাম ২,২০০ টাকা প্রতি ৮০ কিলো, আর তার চেয়ে খানিকটা কমা কোয়ালিটির দাম ২,০০০ টাকা। হিসেব করে দেখলে এটা কিলো-পিছু ২৫-২৭ টাকায় এসে ঠেকে।"
এখানে একটা কথা বলা জরুরি, বাড়িতে বসেই দস্তুরি দালালদের (কমিশন এজেন্ট) থেকে উক্ত মূল্যটা হাতে পান চাষিরা। এরপর রাগি হাত-ফেরতা হওয়ার সময় বেশ খানিকটা মুনাফা লোটেন সেই দালালরা – আনন্দের আন্দাজ প্রতি বস্তায় ২০০ টাকার মতো। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সরাসরি মাণ্ডিতে গিয়ে বেচলে সবচাইতে উচ্চমানের ফসলে (একেকটা ৮০ কিলোর বস্তায়) ২,৩৫০ টাকা পাওয়া যায়, তবে এমনটা করতে গেলে আনন্দের মতে লাভের গুড় পিঁপড়েতে এসে খেয়ে যাবে। "টেম্পোর ভাড়া, মাল তোলা-নামার মজুরি, এতসব দিয়েও শেষে দেখব যে মাণ্ডির দরজায় কমিশন না দিয়ে রেহাই নেই..."
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) নিরিখে তামিলনাড়ুর চেয়ে কর্ণাটকের হালত কিছুটা ভালো। কিন্তু ফসল বেচতে অহেতুক দেরি হওয়ার ফলে সেখানেও একাধিক চাষি সহায়ক মূল্যের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কমে শস্যাদি বেচতে বাধ্য হচ্ছেন।
"প্রতিটা জায়গায় সঠিকভাবে এমএসপি চালু হোক," জোরগলায় জানালেন গোপা মেনন, "সরকার ৩৫ টাকা কিলো-পিছু কিনলে তবেই না লোকে চাষ করবে। নয়ত এখানে যেটা হচ্ছে – লোকজন শামাধান ছেড়ে ফুলচাষ, টমেটো আর বিন কলাইয়ের (ফ্রেঞ্চ বিন) পিছনে ছুটছে – সেটাই স্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে।"
মেননের পড়শি সীনাপ্পা একজন ক্ষুদ্র চাষি, তিনি আজ বেশি বেশি করে টমেটো চাষ করতে আগ্রহী। তাঁর বক্তব্য: "পুরোটাই তো লটারির মতন গো। একজন চাষি ধরুন টমেটো লাগিয়ে লাখ তিনেক টাকা কামালো, ব্যস, তাকে দেখে বাদবাকি সব চাষিরাও টমেটো ফলাতে চাইবে। কিন্তু এ চাষের গোড়াতেই যে এককাঁড়ি টাকা ঢালতে হয়। আর দরদামের বাড়া-কমা শুনে তো কান-মাথা সব ভোঁভোঁ করবে। আজ ১২০ টাকা কিলো তো কাল মন্দার বাজারে এক টাকা।"
তবে নায্য মূল্য পেলে আজকেই টমেটো ছেড়ে ফিংগার মিলেট চাষ করতে একপায়ে খাড়া হয়ে আছেন সীনাপ্পা। "যত বেশি করে রাগি চাষ করবেন, ততই দেখবেন বেশি বেশি গবাদি পশু পালতে পারছেন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে সাপ্তাহিক রোজগারটাও। খড়বিচালি সেরকম জুটছে না বলেই তো লোকজন বাধ্য হচ্ছে গরু-ছাগল সব বেচে দিতে।"
গোপা মেননের থেকে জানা গেল যে এখানে এমন কেউই নেই যাঁর প্রধান খাদ্যশস্য রাগি নয়। "শুধুমাত্র টাকার দরকার পড়লে রাগি বেচি আমরা। দুবছর অবধি মজুত করে রাখা যায়, প্রয়োজন মতো গুঁড়িয়ে খাওয়া হয়। অন্য কোনও শস্যদানা এত সহজে মজুত করা যায় না। ভাগ্যটা সেক্ষেত্রে লটারি জেতার মতন চমৎকার না হলে বাস্তু ঘুঘু চরবে উঠোনে।"
এই অঞ্চলে লেগে থাকা সংঘাতের সংখ্যা যেমন অগুনতি, তেমনই জটিল তাদের রকমসকম। "সাজানোর জন্য কাটছাঁট করা ফুল মূলত চেন্নাইয়ের বাজারে চলে যায়," জানালেন তিনি, "খেতের দোরগোড়া অবধি গাড়ি চলে আসে, টাকাটাও হাতেনাতে দিয়ে দেয়। অথচ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শস্য যেটা, সেই রাগির ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা বলে কিস্যুটি নেই, উপরন্তু সে দেশি হোক বা সংকর, সোনা আর মাটির একই দর।"
"বড়লোক চাষিরা তাঁদের খামারের চারিধারে পাঁচিল আর বৈদ্যুতিক বেড়াজাল লাগিয়েছে, ফলে হাতিরা শেষমেশ গরিব চাষির খেতেই গিয়ে ঢোকে। মালদার চাষিরা অন্য জিনিস চাষ করে, আর গরিবের আশা ভরসা সবই সেই মাড়োয়া।" অথচ, "হাতিদের প্রতি এখানকার চাষিরা আশ্চর্য রকম সহিষ্ণু। তাঁদের নালিশ একটাই, হাতিমামা যা না খায় তার দশগুণ ছারখার করে। স্বচক্ষে মোট্টাই ভালকে দেখেছি আমি, ওই ধরুন ২৫ ফুট দূর থেকে," এটা বলতে বলতে আবারও হাতিদের ঘিরে সেই রংবেরঙের গপ্পে ফিরে গেলেন মানুষটা। "গাঁয়ের লোকজনের মতো মোট্টাই ভালও দু-দুটো রাজ্যের নাগরিক। ভিটেমাটি তামিলনাড়ু তো কী হয়েছে? সাম্মানিক নাগরিকত্ব বলে কন্নডিগাও বটে। তেনার লেজুড় হচ্ছেন মাখনা বাবাজি। মোট্টাই ভাল দ্বায়িত্ব নিয়ে বৈদ্যুতিক বেড়াজাল ডিঙোনোর হাতেখড়ি দিয়েছে মাখনাকে।"
হুট করে মনে হল যেন মোট্টাই মামা ছাদের ঠিক পাশেই ঘাপটি মেরে আড়ি পাতছে আমাদের উপর। "আমি বোধহয় গাড়ির ভিতরেই ঘুমাবো হোসুর ফিরে গিয়ে," কোনোমতে হাসি দিয়ে উৎকণ্ঠা চেপে জানালাম আমি। এটা বলাতে গোপাও দেখলাম বেশ মজা পেয়েছেন, "মোট্টাই ভালের চেহারাটা বেশ জাঁদরেল, দৈত্য বললেও কম বলা হয়," কথাটার গুরুত্ব বোঝাতে ব্যঞ্জনবর্ণগুলো টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন। "তবে বড্ডো নিরীহ ও।" মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন এ যাত্রা মোট্টাই ভাল বা অন্য কোনও হাতির মুখোমুখি না হতে হয়। তবে অদৃষ্ট বোধহয় মুচকি অন্য কিছু একটা ভেবে রেখেছিল আমার জন্য...
*****
আদিতে যে দেশি প্রজাতির রাগি চাষ হতো তার ফলন কম ছিল ঠিকই, তবে তার স্বাদ বলুন বা পৌষ্টিক গুণাগুণ, দুটোই তাতে ভরপুর ছিল।
নাগি রেড্ডি, কৃষ্ণগিরির রাগি-চাষি
নাগান্নার জোয়ান বয়সে রাগির বৃন্তগুলি তাঁর বুক ছুঁয়ে যেত। মানুষটা নিজেও কম লম্বা নন, প্রায় ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির ছিপছিপে রোগা শরীর। পরণে ধুতি আর গেঞ্জি, কাঁধে জড়ানো তোয়ালে। কুশল-মঙ্গলের জন্য বেরোলে ধবধবে সাদা একটা জামা চড়িয়ে নেন গায়ে, হাতে থাকে লাঠি।
"পাঁচটা প্রজাতির রাগির কথা মনে আছে আমার," বারান্দায় বসে বসে নিজের বাড়ি, উঠোন, গ্রাম, একসাথে সবকিছুর উপর নজর রাখছিলেন নাগি। আদিতে নাটু (দেশি) রাগির মোটে চার-পাঁচটা করে শিষ হত। ফলন কম ছিল ঠিকই, তবে তার স্বাদ বলুন বা পৌষ্টিক গুণাগুণ, দুটোই তাতে ভরপুর ছিল।"
তারপর ১৯৮০ সালে এসে উদয় হয় রকমারি হাইব্রিড প্রজাতি, মনে করে বললেন তিনি। নামের বদলে শুধু আদ্যাক্ষর ব্যবহার মতো – যেমন এইচআর, এমআর ইত্যাদি। শিষের সংখ্যাও বেশি ছিল। একলাফে অনেকটা বেড়ে যায় উৎপাদন, ৮০ কিলোর ৫টা বস্তার বদলে ১৮টা। তবে ফলন বাড়লেই যে চাষিরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবেন, এমন ভাবাটা নিতান্তই বালখিল্য ব্যাপার – দুই পয়সা বেশি আয় হবে ভেবে যে বেশি করে চাষ করবেন, সে গুড়ে বালি, কারণ নামতে নামতে তলানিতে এসে ঠেকেছে বাজারদর।
৭৪ বছরের কৃষক-জীবনে অজস্র শস্য ফলিয়েছেন নাগান্না, শুরু করেছিলেন ১২ বছর বয়েসে। "খেতে-পরতে যা যা লাগে তার সবকিছুই ফলাতো আমার পরিবার। মাঠের আখ থেকে নিজেরাই গুড় বানিয়ে নিতাম। তিল চাষ করে সেটা ঘানিতে পিষে তেল বার করে নিতাম। রাগি, ধান, কুলত্থ, লঙ্কা, রসুন, পেঁয়াজ... কী ছিল না আমাদের?"
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোনওদিনই হাতের নাগালে ছিল না তাঁর, তাই খেত-খামারটাকেই নিজের ইস্কুল বানিয়ে নিয়েছিলেন নাগি। এছাড়াও নিজেদের যাবতীয় গবাদি পশুর (গরু ও ছাগল) দেখভাল একাহাতে করতেন তিনি। সময় ছিল না একদণ্ড জিরোনোর। সব্বার জন্য কাজ ছিল তখন দেশগাঁয়ে।
একখানা বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হয়েছেন নাগান্না। গুনে গুনে ৪৫ জন সদস্যের কথা জানালেন তিনি, ঠাকুরদার তৈরি পেল্লায় একখান বাড়িতে মিলেমিশে থাকতেন সব্বাই। একশো বছর পুরোনো সেই বাড়িটা গলির ঠিক উল্টো দিকেই মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। লাগোয়া গোয়ালঘরের পাশে ঝিম মেরে রয়েছে প্রাচীন একখানা গরুর গাড়ি। সারবছর যেটুকু মাড়োয়া ফলে, বারান্দার সঙ্গে একদেহে বিরাজমান গোলায় মজুত রাখা হয় সেটা।
তাঁর একান্নবর্তী পরিবার যেদিন ভাগ-বাটোঁয়ারার হাতে পড়ে খণ্ডিত হয়ে যায়, তখন ১৫ বছর বয়স ছিল নাগান্নার। একভাগ চাষজমি ছাড়া হাতে পেয়েছিলেন যা, সেটা তখন গোয়ালঘর ছিল। নিজের হাতে সাফসুতরো করে বাড়ি বানিয়েছিলেন তিনি। "তখনকার দিনে এক বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৮ টাকা – মানে আকাশছোঁয়া আর কি। বাড়িটা বানানোর জন্য এক রাজমিস্ত্রির সঙ্গে ১,০০০ টাকার উপ্পান্দম (চুক্তি) করেছিলাম।"
ঘরদোর বানাতে বানাতে কেটে যায় বহু বছর। একেকটা দেওয়াল তুলতে ১০০টা চাঁই গুড় আর একটা করে ছাগল বেচতে হয়েছিল। মালমশলা সব মাটু ভন্ডি (গরুর গাড়ি) করে আসত। অনটনের সংসার, এক পাডি (এ রাজ্যে ব্যবহৃত ওজনের একটা মাপবিশেষ, ৬০ পাডিতে একশো কিলো হয়) রাগি বেচলে ৮ আনার বেশি জুটত না তখন।
১৯৭০ সালে তাঁর বিয়ের কয়েক বছর আগে গৃহপ্রবেশ করেন নাগি। সেদিন থেকে আজ অবধি আধুনিকতার কোনও ছাপ পড়তে দেননি বাড়িতে, ওই আর কি "এখানে সেখানে টুকিটাকি" বাদে। ওঁর নাতির কথা অবশ্য আলাদা। ধারালো একখান যন্ত্র দিয়ে নাম সহ ভবিষ্যতের পেশার কথা আঁচড় কেটে লিখে রেখেছে পেরাইয়ের (পিদিম রাখার কুলুঙ্গি) মাথায়: 'আমি দীনেশ মস্তান।' ১৩ বছর বয়সী ওই 'মস্তানের' সঙ্গে সেদিন সকালেই দেখা হয়েছিল – দাগী গুণ্ডা তো দূর অস্ত, বরং বেশ সুবোধের বালকের মতোই ইস্কুলে যাচ্ছিল সে। লাজুক স্বরে 'হ্যালো' বলেই এক ছুট্টে পালাল।
আমাদের আড্ডায় চা নিয়ে এলেন সেই উঠতি মস্তানের মা প্রভা। নাগান্না তাঁকে বললেন কুলত্থ কলাই নিয়ে আসতে। টিনের একটা ডাব্বায় ভরা কলাই নাড়তে নাড়তে আনছিলেন প্রভা, অদ্ভুত সে এক ঝুনুর-ঝুনুর শব্দ হচ্ছিল, ঠিক যেন মাটির তালে ধুলোর সুর। নাগির কাছে জানতে পারলাম যে কুলত্থ দিয়ে কোরাম্বু (ক্বাথ) রাঁধা তো হয়-ই, এমনকি কাঁচা খেলেও "পারাভায়িল্লা [অসুবিধা হয় না]।" সব্বাই একমুঠো করে কলাই তুলে নিলাম। কুড়মুড়ে বাদামের মতো, বেশ সুস্বাদু। "ভেজে-টেজে খানিক নুন ছড়িয়ে দিলে দারুণ লাগে," বলে উঠলেন নাগান্না। কথাটা যে সত্যি তা আর বুঝতে বাকি ছিল না।
কৃষির জগতে কী কী পরিবর্তন এসেছে, সে কথা জিজ্ঞেস করাতে মুখের উপর বলে দিলেন: "সবকিছু। খানকতক বদল ভালোর জন্যই হয়েছে, অথচ লোকে তো আজকাল আর গতর খাটাতেই চায় না।" মাথা ঝাঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন তিনি। ৮৬ বয়েস হলে কী হবে? মানুষটা এখনও মাঠে ঘাম ঝরান রোজ, দৈনন্দিন যে হাজারো সমস্যায় জেরবার হয়ে যাচ্ছেন, সেগুলোর ব্যাপারে ওঁর ধ্যানধারণা বেশ স্পষ্ট। "মস্ত একটা গেরোয় পড়া গেছে আজকাল, আপনার নিজের জমিজমা যা-ই থাকুক না কেন, শতসহস্রবার মাথা কুটে মরলেও একজন খেত-মজুর পাবেন না।"
"লোকে বলে যে রাগি ঝাড়াইয়ের যন্ত্র আছে," আনন্দ বলছিলেন, "কিন্তু বিভিন্ন ধরনের শিষের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, সেটা কোনও যন্ত্র থোড়াই বোঝে! একেকটা কাদিরে [ডাঁটা] হরেক কিসিমের শিষ হয়, কোনওটা ধরুন পাকা, কোনওটা শুকনো, কোনওটা আবার এমন কাঁচা যে ঝাড়তে গেলে দুধ-দুধ রস বেরোবে। যন্ত্রে দিলে সব একসাথে পিণ্ডি চটকে যাবে। বস্তায় ভরলে দেখবেন কদিন পরেই ছাতা পড়ে গিয়ে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।" হাতে করে ঝাড়াই করাটা খুবই শ্রমসাধ্য ঠিকই, "কিন্তু সেটা করলে দানাগুলো অনেকদিন মজুত করে রাখা যায়।"
শিব কুমারনের ইজারায় নেওয়া জমিতে হাতে করে ফসল কাটছিলেন ১৫ জন মহিলা। ঠিক তার পাশেই বগলে কাস্তে গুঁজে, 'সুপারড্রাই ইন্টারন্যাশনাল' লেখা টি-শার্টের উপর তোয়ালে জড়িয়ে আবেগ জড়ানো কণ্ঠে রাগির গুণগান করছিলেন শিব।
গোল্লাপাল্লির সীমানার ঠিক বাইরেই তাঁর খেত, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক পরিমাণে ঝড়বৃষ্টি সহ্য করেছে এই মাঠটি। ২৫ বছর বয়সী শিব বেশ চটপটে মানুষ, বৃষ্টিমুখর দিনগুলো কীভাবে তাঁর ফসলের বারোটা বাজায় সেকথা বলছিলেন আমায়। এদিক সেদিক হেলে পড়েছে রাগির ডাঁটাগুলো, উবু হয়ে বসে হাঁসুয়া চালিয়ে সেগুলো বাণ্ডিলে বাঁধছিলেন মহিলা মজদুরের দল। ফলত একদিকে যেমন উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে তেমনই ফসল কাটার জন্য একদিনের বদলে দুদিন ধরে খাটতে বাধ্য হচ্ছেন মহিলা খেত-মজুরেরা। অথচ এ জমি ইজারায় নেওয়ার দর যে কি সেই রয়ে গেছে।
"এই মাঠটা দুই একরও নয় – সাত বস্তা রাগি দিয়ে ইজারা মেটাতে হবে। বাকি যে ১২-১৩ বস্তা পড়ে থাকবে সেটুকুনি আমার, রাখতেও পারি আবার বেচেও দিতে পারি। কিন্তু," জোরগলায় বলতে লাগলেন এবার, "কর্ণাটকের দর না পেলে মুনফার কথা ভাবাও পাপ। তামিলনাড়ুর বাজারে ৩৫ টাকা কিলো না পেলে চলবে না আমাদের। লিখে রাখুন এই কথাটা..." অক্ষরে অক্ষরে তাঁর এই নির্দেশ পালন করলাম আমি।
নাগান্নার উঠোনে একটা পুরোনো জাঁতাকল পড়ে আছে, ওঁর বাড়িতে ফেরার পর সেটাই দেখাতে নিয়ে গেলেন তিনি। দৈত্যকার এই পাথরের বেলনটি কেটে আনা রাগির উপর বলদ জুতে ঘোরানো হতো, তার আগে অবশ্য নিচের শক্ত মাটিটা বেশ যত্ন করে তৈরি করা হতো গোবরছড়া দিয়ে। পুরো প্রক্রিয়াটি শম্বুকগতিতে হতো বটে, তবে বেশ ফলপ্রদ ছিল। একে একে গুঁড়িয়ে যেতো শস্যমঞ্জরী, ডাঁটা আর রাগির দানাগুলো আলাদা আলাদা করে তুলে রাখতেন এঁরা। এবার পালা কুলো দিয়ে চেলে বাড়ির ঠিক সামনেই গর্ত খুঁড়ে মাড়োয়া-দানা মজুত করে রাখার। এককালে যেটা পাটের বস্তায় ভরা হতো, আজ তার স্থান দখল করেছে সাদাটে প্লাস্টিক।
"এবার ভিতরে চলুন তো দেখি," সাদর অভ্যর্থনা জানালেন নাগি, "আসুন, খাওয়াটা সেরে ফেলা যাক..." চটজলদি প্রভার পিছু পিছু রওনা দিলাম, হেঁশেলের গল্প শোনার বড্ডো সখ জেগেছিল মনে।
*****
এইসা নধর মাড়োয়া দানা য্যামনে ঘুঘুর ডিম,
লাগাইলা সই বাদলা মাঠে মেঘলা ঝিমির ঝিম।
আঙার পরে রাগির দানা, রাঁধছি আবাল বুড়া,
দুধের সাথে মধুর পানা, খাইবা শশক পুড়া।
'পুরণানূরু ৩৪', আলাথুর কিঝারের লেখা সঙ্গম কবিতা
তর্জমা করেছেন চেন্থিল নাথন
ক্যালসিয়াম ও আয়রনে ভরপুর, সম্পূর্ণ রূপে গ্লুটেন মুক্ত, দুই বছর অবধি মজুত করে রাখা যায় – স্বাস্থ্যকর শস্যের দুনিয়ায় রাগির জুড়ি মেলা ভার। ২,০০০ বছর আগেও মাংস, দুধ ও মধু সহযোগে রাগি রান্নায় পারদর্শী ছিলেন তামিল মানুষজন, এ হেন পদের কথা শুনলেও অবাক লাগে। আজকের যুগে মাড়োয়ার ব্যবহার নানাবিধ – খাদ্যশস্য তো বটেই, এছাড়াও রাগি দিয়ে মুখরোচক পদ তথা শিশুখাদ্য বানানো হয়। তামিলনাড়ুর একেক প্রান্তে রাগি রান্নার পদ্ধতি একেক রকমের, কৃষ্ণগিরিতে যেমন রাগি মুদ্দে (নাড়ু), যেটা কিনা কলি নামেও পরিচিত। তা এই রাগি মুদ্দে কীভাবে বানাতে হয়, সেটা হাতেনাতে করে দেখালেন প্রভা।
আমরা আপাতত তাঁর রান্নাঘরে পা রেখেছি, সিমেন্টের একটা বেদির উপর বিরাজমান ইস্পাতের চুল্লি। অ্যালুমিনিয়ামের একটা কড়াইয়ে খানিক জল ঢেলে নিলেন প্রভা। এবার এক হাতে কাঠের ডান্ডা, আরেক হাতে রাগির ময়দা নিয়ে অপেক্ষা করার পালা।
উনিও কি তামিল ভাষা জানেন? আড্ডা জমাতে হবে, তাই এ প্রশ্নটা দিয়েই শুরু করলাম। পরণে সালোয়ার কামিজ, অঙ্গে নামমাত্র গয়নাগাঁটি, অধরে একচিলতে হাসি নিয়ে মাথা নেড়ে না বললেন তিনি। তবে হ্যাঁ, বলতে না পারলেও বুঝতে ঠিকই পারেন, এবং খানিক থেমে থেমে হলেও অল্প তামিল মেশানো কন্নড়ে দিব্যি উত্তর দিচ্ছিলেন। "গত ১৬ বছর ধরে এটাই রাঁধছি আমি," জানালেন তিনি। অর্থাৎ ১৫ বছর বয়েস থেকেই।
মানুষটা যে কতটা অভিজ্ঞ, সেটা এক লহমায় ধরে ফেললাম জলটা ফুটতে না ফুটতেই। চট করে একটা বড়োসড়ো এক পেয়ালা রাগির ময়দা ঢেলে দিলেন। কড়াইয়ের মধ্যে তখন চিটচিটে ধূসর রঙ। সাঁড়াশি দিয়ে ধরে সেই মিশ্রনটি এবার ঘনঘন নাড়তে লাগলেন কাঠের ডান্ডা দিয়ে। কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমের – দম ও দক্ষতা, দুটোই সমান তালে থাকতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাড়োয়া রান্না হয়ে গেল, খুন্তির গায়ে গোল্লা পাকিয়ে লেগেছিল মিশ্রণটি।
ওঁকে দেখতে দেখতে ভাবছি, ব্যাপারটা সত্যিই তাক লাগানোর মতো, তাই না? সম্ভবত এই পদটি আজ দু হাজার বছর ধরে রেঁধে আসছেন এখানকার মহিলারা।
"জোয়ান বয়সে দেখতাম, এই রান্নাটাই হত, কিন্তু মাটির পাত্রে আর কাঠের আঙারে," বুঝিয়ে বললেন নাগান্না। হলফ করে জানালেন যে তার স্বাদও ছিল এককাঠি উপরে। তবে আনন্দের মতে এমনটা হতো কারণ আগেকার দিনে দেশি প্রজাতির রাগি খাওয়ার চল ছিল। তাঁর কথায়: "গন্ধে ম ম করতো, বাড়ির বাইরে থেকেই টের পাওয়া যেতো। গম গম ভাসনই।" দেশি রাগির সুগন্ধ যে কতখানি অপার্থিব ছিল, সেটা বেশ জোরগলাতেই জানালেন তিনি, "এই হাইব্রিড প্রজাতিগুলোর কোনও ছিরিছাঁদ নেইকো, গন্ধটা পাশের ঘর অবধিও পৌঁছয় না।"
মনে হয় কাছেপিঠে শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছে বলেই প্রভা অমন চুপটি মেরে থাকেন। রান্নাঘরের এক কোণে রাখা আছে চৌকোনা একটি গ্রানাইটের টুকরো, কড়াই তুলে নিয়ে গিয়ে জ্বলন্ত রাগির মিশ্রণটি সেটার উপরেই ঢেলে দিলেন। দেখতে না দেখতে অবাক করা কায়দায় তাঁর তালুর ভাঁজে ধোঁয়া ওঠা মাড়োয়া পরিণত হল লেচিতে। এবার পালা হাতদুটি আলতো করে জলে ভিজিয়ে লেচি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বড়োসড়ো মণ্ড পাকানোর, তারপর হাতের তালু আর পাথরের মাঝে পড়ে নিমেষের মধ্যে সে মণ্ড রূপান্তরিত হল গোল্লায়।
বেশ কয়েকটি বানানো হয়ে গেলে পাত্রে করে সাজিয়ে দিলেন আমাদের। "এই দেখুন, এভাবে খেতে হয়," এটা বলে নাগি আমার পাত্র থেকে একটা নাড়ুর খানিকটা ভেঙে কুলত্থ কলাইয়ের ক্বাথে চুবিয়ে দিলেন। ওদিকে পেয়ালায় ভরা সবজি ভাজা নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রভা। এমন সুস্বাদু খাবার ভরপেট খেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর খিদে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কৃষ্ণগিরি জেলার বারগুর গ্রামটি নাগির বাড়ি থেকে বেশ কাছে, ওখানকার লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের মানুষ আবার মাড়োয়া দিয়ে রুটি বানিয়ে খান। বহুযুগ আগে সেখানে গিয়েছিলাম, পার্বতী সিদ্ধাইয়া নিজের হাতে সে রুটি বানিয়ে খাইয়েছিলেন। পেশায় চাষি এই মানুষটির উনুনখানাও ছিল হাতে বানানো, এবড়োখেবড়ো, বাড়ির বাইরে রাখা। মোটাসোটা স্বাদু সেই রুটিগুলো বহুদিন তাজা থাকে, ওঁর বাড়ির লোকজন পশু চরাতে জঙ্গলে গেলে এই রুটির ভরসাতেই বেঁচে থাকতেন।
চেন্নাই নিবাসী খাদ্য-ইতিহাসবিদ তথা সঞ্চালক রাকেশ রঘুনাথন গপ্পোগুজবে ওস্তাদ, কথায় কথায় পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি খাদ্য প্রণালীর কথা জানালেন তিনি: রাগি ভেল্লা আডাই। মিষ্টি পিঠে জাতীয় এই খাবারটি বানাতে লাগে রাগির গুঁড়ো, গুড়, নারকেলের দুধ, এক চিমটি এলাচ এবং শুকনো আদার গুঁড়ো। "নিজের ঠাম্মার থেকে এই আডাইটি শিখেছিল মা। এটা তাঞ্জাভুর এলাকার খাবার, প্রথাগত ভাবে কার্থিগাই দীপমের [দাক্ষিণাত্যের একটি দীপদান উৎসব] দিন উপোস ভাঙতে খাওয়া হতো এটি।" অল্প একটু ঘি সহযোগে বানানো এই মোটাসোটা পিঠে যেমন পুষ্টিকর, খেতে তেমনই আরামদায়ক। সুতরাং উপোস ভাঙার ক্ষণে এরকম উত্তম ভোজ আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ।
ভিলেজ কুকিং চ্যানেলে দেখলাম যে পুদুকোট্টাই জেলার চিন্না বীরমঙ্গলম গ্রামের বিখ্যাত কয়েকজন বাবুর্চি মিলে কি সুন্দর ফিংগার মিলেট দিয়ে অদ্ভুত একটা জিনিস রান্না করছেন: কলি সহযোগে কারুভাডু (শুঁটকি মাছ)। ওঁদের ইউটিউব চ্যানেলটির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে প্রথাগত রান্নাবান্নার প্রণালী ফিরিয়ে আনা। "রান্নাবান্না তথা খাদ্যাভাসে রাগির স্থান যে কতটা উপরে ছিল সেটা সাত-আট বছর বয়স অবধি স্বচক্ষে দেখেছি। ধান এসে একদিন হুট করে সেই জায়গাটা নিয়ে নিল, আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল মাড়োয়া," দূরাভাসের মাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এমনটাই জানালেন ওই চ্যানেলটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা সুব্রাহ্মণ্যম (৩৩)।
দুবছর পুরোনো এই ভিডিওটি এখনও অবধি প্রায় ৮০ লাখ মানুষ দেখেছেন, তবে চ্যানেলটির গ্রাহক সংখ্যা যেহেতু ১.৫ কোটি, তাই এমনটা হওয়া বোধহয় অতখানিও আশ্চর্যের নয়। গ্রানাইট পাথর দিয়ে রাগি গুঁড়ানো থেকে তাল পাতার ডোঙায় সেটা খাওয়া অবধি রান্নার প্রতিটি ধাপ বেশ সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে সেখানে।
তবে রাগি মুদ্দে রান্না করার ধাপটাই সবচাইতে মজাদার। সুব্রাহ্মণ্যমের ৭৫ বছর বয়সী ঠাকুরদা পেরিয়াতাম্বির তদারকিতে একমুঠো ভাতের সঙ্গে মাড়োয়া মিশিয়ে লাড্ডু পাকানো হয়, তারপর নোনতা আমানির (ভাত-ভিজানো) জলে ফেলে রাখা হয় সেই লাড্ডুগুলো। পাশাপাশি কাঠের আগুনে ধীরে ধীরে রাঁধা হয় শুঁটকি মাছ, যতক্ষণ না ছালটা পুড়ে মুচমুচে না হয়ে যাচ্ছে। শেষে একত্রে খাওয়া হয় সব। "গেরস্থাবাড়ির পাতে এর সঙ্গে শুধু ছাঁচি পেঁয়াজ (শ্যালট) আর কাঁচালঙ্কা থাকে," বুঝিয়ে বললেন তিনি।
আবেগ জড়ানো গলায় দেশি প্রজাতির ধান এবং রাগির পুষ্টির বিবরণ পেলাম সুব্রাহ্মণ্যমের থেকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তামিলনাড়ুতে এসেছিলেন রাহুল গান্ধী, তখন নিজে তথা তুতো ভাইয়েরা মিলে তাঁর নজর কেড়েছিলেন সুব্রাহ্মণ্যম। রান্নার যে পদগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে, একের পর এক ভিডিওর মাধ্যমে সেগুলির উপর আলোকপাত করে তাঁদের চ্যানেলটি, যাতে সেগুলি আবার ফিরিয়ে আনা যায়।
*****
যে চাষিরা রাসায়নিক স্প্রে করেন, মোটের উপর তাঁদের মুনাফা-টুনাফা সব হাসপাতালের ভোগেই চলে যায়।
আনন্দরামু, কৃষ্ণগিরির মাড়োয়া-চাষি
নাগান্নার জনপদের চারিধারে যে খেতগুলি রয়েছে, আজ প্রধানত তিনটি কারণে সেখান থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে রাগি: অর্থনীতির মারপ্যাঁচ, হাতি এবং সাম্প্রতিক কালে ভয়াবহ হয়ে ওঠা জলবায়ু পরিবর্তন। প্রথমটি সমগ্র তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রেই সত্যি। রাগি চাষ করতে একর-পিছু খরচা হয় ১৬,০০০-১৮,০০০ টাকা। "অকাল বৃষ্টি বা হাতি এসে হানা দিলে ফসল কাটার সময় খেত-মজুরের খোঁজ করে সব্বাই, ফলত খরচের খাতায় আরও ২,০০০ টাকা যোগ হয়," বুঝিয়ে বললেন আনন্দ।
"তামিলনাড়ুতে বেচতে গেলে একেকটা ৮০ কিলোর বস্তায় মেরেকেটে ২,২০০ টাকা জোটে। অর্থাৎ কিলো-পিছু ২৭ টাকা ৫০ পয়সা। বছরটা ভালো গেলে ১৫ বস্তার মতন রাগি ফসল – বেশি বেশি ফলন হয় এমন বীজ পুঁতলে সেটা ১৮ বস্তা হয়। কিন্তু," সতর্কতার সুর শোনা গেল আনন্দের গলায়, "গরু-ছাগলের মুখে ওই হাইব্রিড রাগির খড় রোচে না। একমাত্র দেশি প্রজাতির খড় খেতেই ভালোবাসে ওরা।"
বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এক বোঝা রাগির খড় ১৫,০০০ টাকায় বিক্রি হয়। আর একর-পিছু দুই বোঝা উঠে আসে আরামসে। যেসব চাষিরা গরু-ছাগল পোষেন তাঁরা বিচালি রূপে কিনে নেন সেটা। স্তূপাকারে রাখলে এক বছর অবধি পচন-টচন কিছুই ধরে না। আনন্দের কথায়: "তবে পরের বছর ভালো ফসল না হওয়া অবধি রাগিটা আমরা কিন্তু বেচি না। শুধু আমরাই নই গো, আমাদের পোষা কুকুর আর মুরগিগুলোও শামাধান খেয়ে বেঁচে থাকে। সব্বার পেট যাতে ভরে সে খেয়াল তো রাখতেই হবে আমাদের।"
মোটের উপর একটি চিরাচরিত সত্যকেই তুলে ধরলেন আনন্দরামু: শুধুমাত্র প্রাচীন বলেই যে এ মাটি, এ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে রাগি বিরাজমান তা নয়। এ ফসল অত্যন্ত খরা-সহিষ্ণু তথা "ঝুঁকিহীন," জানালেন আনন্দ, "দু সপ্তাহ ধরে একফোঁটা বৃষ্টি না হলেও অসুবিধে নেই। পোকামাকড়ের উৎপাতও নেই বললেই চলে, তাই ফ্যাঁসফ্যাঁস করে গুচ্ছের রাসায়নিক ছিটাতে হয় না, যেটা কিনা টমেটো বা বিনের ক্ষেত্রে না করলেই নয়। যে চাষিরা রাসায়নিক স্প্রে করেন, মোটের উপর তাঁদের মুনাফা-টুনাফা সব হাসপাতালের ভোগেই চলে যায়।"
সাম্প্রতিক কালে তামিলনাড়ু সরকার একটি পদক্ষেপ নিয়েছে যার ফলে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও সচ্ছল হতে পারে। চেন্নাই এবং কোয়েম্বাটোরের গণ-সরবরাহ ব্যবস্থা কেন্দ্রের মাধ্যমে তারা শামাধান বিলোতে শুরু করেছে। এছাড়াও ২০২২ সালের কৃষি বাজেটের ভাষণে মিলেটের কথা ১৬ বার উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী এম.আর.কে. পনীরসেলভম (একত্রে ৩৩ বার উল্লেখিত হয়েছিল ধান ও চালের কথা)। শামাধান জনপ্রিয় করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার মধ্যে দুটি বিশেষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা ও রাজ্য তথা জেলা-স্তরে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখযোগ্য – ৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই খাতে, যাতে "শামাধানের পুষ্টি সম্পর্কে মানুষ ওয়াকিবহাল হয়।"
এছাড়াও ২০২৩ সালটি আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এফএও, সম্ভবত ভারতের অনুরোধেই – যাতে রাগি-সহ অন্যান্য 'নিউট্রি সিরিয়েলের' (পুষ্টিকর খাদ্যশস্য) উপর আলোকপাত করা যায়।
তবে নাগান্নার পরিবারের জন্য এ বছরটা খুব একটা সহজ হবে না। যে আধা একর জমিতে তাঁরা মিলেট লাগিয়েছিলেন, সেখানে তিন বস্তার বেশি রাগি ফলেনি এবার। বাকিটা ভাগাভাগি করে গিলে খেয়েছে অতিবৃষ্টি ও বন্যপ্রাণীর দল। "রাগির মরসুম এলে রাতগুলো আমরা মাচানেই [গাছের উপর বেঁধে রাখা মাচা] কাটাই, যাতে নজর রাখতে পারি," আনন্দ বলছিলেন।
আনন্দরামুর ভাইবোনেরা (তিন ভাই ও এক বোন) কেউই কৃষির পথ মাড়াননি, পাশের থাল্লি শহরে চাকরিবাকরি করেন তাঁরা। তবে আনন্দের জীবনে ধ্যানজ্ঞান সব কৃষিই। "ইস্কুলে আর গেলামটা কখন? ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমগাছে চড়ে বসে থাকতাম, ছুটি হলে বাদবাকি বাচ্চাদের সঙ্গে ফিরে আসতাম বাড়িতে। আজীবন এটাই করতে চেয়েছি," শস্য শ্যামলা খেতের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলেন তিনি। মাঠ জুড়ে কুলত্থ ফলেছে, সেটাই পরিদর্শন করছিলেন আনন্দ।
খেতের আনাচে কানাচে ফুটে আছে অতিবৃষ্টির ক্ষত – আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। "৮৬ বছরের জীবনে এমন অলুক্ষুনে বৃষ্টি দেখিনি এর আগে," নাগির কণ্ঠে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। এবছর যে বৃষ্টিটা হল, পঞ্চাঙ্গের মতে তার নাম ছিল 'বিশাখা', পাঁজি-পুঁথির উপর ষোল আনা ভরসা রাখা মানুষটা জানালেন যে নক্ষত্রের নামেই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বৃষ্টি-বাদলার নাম রাখা হয়। "ওরু মাসম, মারৈ, মারৈ, মারৈ।" অর্থাৎ সারা মাস জুড়ে শুধু বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। "শুধু আজকেই কি ভাগ্যে সুয্যিমামা উঁকি মেরেছেন একটু।" তাঁর এই কথাটি খবরের কাগজ উল্টালেই প্রমাণ হয়ে যায়, সেখানে বলা আছে যে ২০২১ সালে ৫৭ শতাংশ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সাক্ষী থেকেছে তামিলনাড়ু।
হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিলাম গোপার খামারের দিকে, হঠাৎই ছাতা হাতে দুই বৃদ্ধ চাষির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুজনেরই গায়ে শাল, মাথায় টুপি। শুদ্ধ কন্নড়ে বুঝিয়ে দিলেন রাগির উৎপাদন কীভাবে কমে আসছে দিনকে-দিন। আমি যাতে বুঝতে পারি তাই চটজলদি তর্জমা করে দিলেন গোপা।
বিগত কয়েক দশকের তুলনায় আজ মোটে "আধা খেত জুড়ে" রাগি চাষ হয়, জোরগলায় বললেন ৭৪ বছর বয়সী কে. রাম রেড্ডি। "পরিবার পিছু দুই একর। ব্যাস, আজকাল এটুকুই চাষ করি আমরা।" খেত-খামারের বাকিটায় ফলে আছে টমেটো আর বিন কলাই। উপরন্তু যেটুকুও বা মাড়োয়া চাষ হচ্ছে, সেটাও কেবল "হাইব্রিড, হাইব্রিড, হাইব্রিড।" শব্দের প্রতিধ্বনিতে এভাবেই চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তব তুলে ধরলেন কৃষ্ণ রেড্ডি (৬৩)।
"নাটু রাগি শক্তি যাস্তি [দেশি রাগি অনেক বেশি পোক্ত হয়]," এটা বলে নিজের পেশিবহুল দুই বাহু মেলে ধরলেন রাম রেড্ডি। তাঁর মতে কম বয়েসে দেশি রাগি খেতেন বলেই আজও এমন সুস্থসবল আছেন।
তবে এবছরের বৃষ্টিটা তাঁকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। "বীভৎস বীভৎস," বিড়বিড় করে উঠলেন রাম।
কোনও ক্ষতিপূরণ পাবেন বলে ভরসা নেই তাঁর। "যে কারণেই ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন, মোটা টাকা ঘুষ না খাওয়ালে একটা নয়াপয়সাও জোটে না আমাদের। তাছাড়া জমির পাট্টা নিজের নামে না থাকলে কাঁচকলা বই কিস্যুটি পাব না।" অর্থাৎ ভাগচাষি আর ক্ষতিপূরণের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ হতভাগা দেশের আইন।
পাট্টার এই প্যাঁচটা আরও গভীর, শুকনো মুখে জানালেন আনন্দ। নিজের ভাইয়ের হাতে ঠকেছিলেন তাঁর বাবা। ত্রস্ত পায়ে সেই বিশ্বাসঘাতকা অভিনয় করে দেখালেন আনন্দ। এদিকে চার পা হেঁটে তার পরক্ষণেই উল্টোদিকে হেঁটে গেলেন আরও চার পা। "কাকা এভাবেই জমিটা দিয়েছিল আমাদের, বলেছিল যে এতগুলো ফুট আমাদের আর বাকিটা ওনার। আমার বাবা পড়াশোনা করেননি কখনও, সরল মনে সম্মত হয়ে যান। তাই মোটে চার একর জমির রেজিস্ট্রি করা কাগজ আছে আমাদের।" বাস্তবে আরও অনেকটাই জমির উপর চাষ করেন তাঁরা, অথচ খাতায়-কলমে রয়েছে কেবল চার একরের কথা। ফলত বাদবাকি জমিটা ক্ষতিপূরণের আওতায় পড়ছে না, তাই আবেদন জানানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
ততক্ষণে সেই বারান্দাটায় ফিরে গেছি, অজস্র ফটো আর নথি বার করে এনেছেন আনন্দ। কোথাও হাতিদের হামলার স্মৃতি, কোথাও বা তোলা আছে বনশুয়োরের অত্যাচার। উপড়ে যাওয়া তরুবর। পিষে যাওয়া ফসল। ভেঙে পড়া কাঁঠাল গাছের সামনে আছেন নাগান্না, শালপ্রাংশু দেহে তাঁর অসহায়তার ছাপ।
"চাষবাস করে বড়োলোক থোড়াই না হওয়া যায়? আপনিই বলুন, এ কাজ করে দামি গাড়িঘোড়া কিনতে পারবেন? নিদেনপক্ষে শৌখিন জামাকাপড়? আমার তো তাও নিজের জমিজমা আছে গো, তা সত্ত্বেও হলফ করে বলছি, রুজিরুটির স্থিরতা নেই কোনও," উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন নাগান্না। দেখলাম যে ইতিমধ্যে বেশভূষা সব পাল্টে ফেলেছেন তিনি: দুধসাদা জামা, পাটভাঙা নতুন ধুতি, টুপি, মাস্ক, রুমাল। "আসুন, আমার সঙ্গে মন্দিরে যাবেন," সানন্দে চললাম আমরা। যে উৎসবে যাচ্ছেন সেটাও এই দেংকানিকোট্টাই তালুকে পড়ে, একটা 'স্টার' (উন্নতমানের) সড়ক ধরে আধা ঘণ্টার পথ।
নিঁখুত দিকনির্দেশ দিতে পারেন নাগান্না। এলাকাটা কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা ছিল তাঁর ধারাভাষ্যে। বিশাল বিশাল অঙ্কের ঋণ তুলে বসে আছেন গোলাপচাষিরা। প্রতি কিলোয় ৫০ থেকে ১৫০ টাকার মুনাফা হয় তাঁদের, পালা-পার্বণের মাসগুলোয় সেটা অবশ্য কিছুটা হলেও বাড়ে। এছাড়াও বিচিত্র একটা বাস্তবের কথা জানতে পারলাম তাঁর কাছে। না রঙ, না সুরভি, দুটোর একটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় গোলাপের ক্ষেত্রে। বরং হাতির পাল যেহেতু গোলাপ খেতে পছন্দ করে না, সেই কারণেই ফুলচাষের এমন হিড়িক পড়ে গেছে এখানে।
মন্দিরের যত কাছে যাচ্ছি ততই যেন বাড়ছে ভক্তের ভিড়। এঁকেবেঁকে দিগন্ত ছুঁয়েছে শোভাযাত্রা, ও বাবা, এ যে দেখি এখানেও এক হাতি! নাগান্না অবশ্য আগে থেকেই বলে দিয়েছিলেন, "আনৈয়ের সঙ্গে মোলাকাত হবে।" মন্দিরের ভোগশালায় কিঞ্চিৎ জলখাবারের জন্য স্বাগতম জানালেন আমায়। না গেলে ঠকে যেতাম, খিচুড়ি আর বাজ্জি (ভাজাভুজি) দুটোই অপার্থিব ছিল। দেখতে না দেখতে তামিলনাড়ুর আরেক প্রান্তের একটি মন্দির থেকে পুরোহিত সমেত এসে উপস্থিত হল এক হস্তিনী, পিঠে মাহুত। নাগি বলে উঠলেন, "পারুথা আনৈ।" অর্থাৎ বুড়ি হাতি। গদাইলস্কর চালে হেলেদুলে চলেছিল সে। তাকে দেখামাত্র উঠে এলো শয়ে শয়ে মোবাইল, খচাখচ তোলা হয়ে গেল ছবি। জঙ্গল থেকে মোটে আধাঘণ্টার দূরত্বেই যেন চিরতরে বদলে গেল হাতির গল্পটা।
তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল বারান্দায় পা-মুড়ে বসে ঘাড়ে তোয়ালে জড়িয়ে আনন্দ যেটা বলেছিলেন: "একটা দুটো হাতি এলে আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না। তবে জোয়ান ছেলে হাতিগুলো বিশাল একগুঁয়ে, কোনকিছুতেই ডরায় না। বেড়া-টেড়া দিয়েও লাভ নেই, ঝপাং করে টপকে এসে ফসল খেয়ে ফ্যালে।"
তবে ওদের খিদের সাকিন হদিস তিনি রাখেন। "আধা কেজি খাবারের জন্য দিনরাত লড়াই করি আমরা। হাতিরাই বা যাবেটা কোথায়? দিন গেলে ২৫০ কেজি খাবার না হলে ওদের চলে না! এমনিতে একেকটা কাঁঠাল গাছ থেকে হাজার তিনেক টাকা রোজগার করি। কিন্তু যে বছর হাতিরা এসে সব মুড়িয়ে খায়, আমরা ধরে নিই যে স্বয়ং ঈশ্বর এসে পায়ের ধুলো দিয়ে গেছেন," মুচকি হেসে বললেন আনন্দ।
তথাপি একটা ইচ্ছে তাঁকে তাড়া করে ফেরে: একদিন না একদিন ৩০-৪০ বস্তা রাগি ফলবেই তাঁর খেতে। "সৈয়নম ম্যাডাম, করতে আমাকে হবেই।"
ওই আর কি, মোট্টাই ভাল সদয় হলে তবেই...
২০২০ সালের রিসার্চ ফান্ডিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গবেষণামূলক এই প্রতিবেদনটি রূপায়িত করতে আর্থিক অনুদান জুগিয়েছে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত আলোকচিত্র: এম. পালানি কুমার
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)