গাছের তলায় ছেঁড়াখোড়া একটা প্লাস্টিকের মাদুরে এই সাতসকালেই উস্কোখুস্কো চুল, ফ্যাকাশে চোখমুখ নিয়ে বসেছিলেন অনু । কড়া রোদে ঝিমোচ্ছিল কয়েকটা গরুছাগল, কাছেই শুকোচ্ছিল খড়-বিচালির ঢিবি।
"বৃষ্টি হলেও বাড়ির চৌকাঠ মাড়াই না আমি, ছাতা মাথায় এই গাছতলাতেই বসে থাকি যাতে আমার ছায়াটুকুও কাউকে না মাড়াতে হয়। কী করব? দেওতারা রাগ করবেন তো নাহলে," বলছিলেন অনু।
বাড়ি থেকে মোটামুটি ১০০ মিটারের তফাতে রয়েছে এই গাছটি, তাঁর ঋতুস্রাব শুরু হলে এটিই তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই।
"আমার মেয়ে থালায় করে চাট্টি খেতে দিয়ে যায়," জানালেন অনু (নাম পরিবর্তিত)। বন্দিদশার এই কটাদিন তাঁর ব্যবহারের জন্য আলাদা বাসনকোসন রাখা আছে। "আমি তো আর এখানে শখ করে পড়ে নেই। আমি কাজকাম (গৃহস্থালির কাজকর্ম) করতেই চাই, তবে আমাদের প্রথাকে মান্য করতেই হয়। কাজের চাপ বেশি থাকলে আমি অবশ্য আমাদের জমিতে কাজ করি।” তাঁর পরিবার নিজেদের ১.৫ একর জমিতে রাগি চাষ করে।
ঋতুস্রাবের দিনগুলিতে অনু একলা হলেও, এই প্রথা তিনি একাকী মেনে চলছেন না। তাঁর ১৯ এবং ১৭ বছরের দুই কন্যার কপালেও জোটে এই মাসিক নির্বাসন (তাঁর আরেকটি ২১ বছরের বিবাহিতা কন্যা আছে)। কাডুগোল্লা জনজাতির ২৫টি পরিবারের বাস এই জনপদে, এবং প্রতিটি পরিবারের মহিলাদের এভাবেই বন্দিদশায় দিনযাপন করতে হয়।
নির্মম এই নিয়ম তাঁদের ক্ষেত্রেও খাটে যাঁরা সদ্য সদ্য মা হয়েছেন। যে গাছটির নিচে অনু আশ্রয় নিয়েছেন তার কাছেই পরস্পরের থেকে সমদূরত্বে রয়েছে ৬টি কুঁড়েঘর, নবজাতকের সঙ্গে একা এখানেই দিন কাটান মহিলারা। অন্যান্য সময় অবশ্য এই কুঁড়েগুলি পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে থাকে। রজঃস্বলাদের একমাত্র ঠাঁই ওই গাছতলাতেই।
এই যে গাছগাছালি ও কুঁড়েঘরের জটলা, এটিকে বলা যেতে পারে এই জনপদের খিড়কি আঙিনা। কর্ণাটকের রামনগর জেলার চান্নাপাটনা তালুকে রয়েছে আরালালাসান্দ্রা গ্রাম (জনসংখ্যা ১০৭০), এরই উত্তরভাগে অবস্থিত কাডুগোল্লাদের এই জনপদটি।
এই যে নিবার্সিত রজঃস্বলা মহিলারা, আশেপাশের ঝোপঝাড়গুলোই তাঁদের শৌচকর্মের একচিলতে আব্রু। পানীয় জলটুকু অবশ্য পরিবারের লোকজন গামলা কিংবা বালতিতে করে দিয়ে যান।
মহিলারা মা হওয়ার পর কম সে কম একমাস এই কুঁড়েঘরগুলিতে নবজাতকের সঙ্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পূজা (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে), গৃহস্থালির কাজকর্ম সামলান নিজের সংসারে। বি. কমের শংসাপত্রটি হাতে পাওয়ার আগেই ১৯ বছর বয়েসে তাঁদের বিয়ে হয়ে যায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি শিশুর জন্ম দেন ৭০ কিমি দূরে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে। "অপারেশন [সিজারিয়ান] করে বাচ্চাটাকে বার করতে হয়েছিল। আমার বর আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই এসেছিল বটে, তবে একমাস আমার বাচ্চাটাকে কেউ ছুঁয়েও দেখেনি, এমনতরই নিয়ম আমাদের। মা-বাবার গাঁয়ে [আরালালাসান্দ্রায় কাডুগোল্লাদের জনপদটি, পূজা ও তাঁর স্বামী অবশ্য এই জেলারই অন্য একটি গ্রামে থাকেন] ফেরার পর ১৫ দিন একটা কুঁড়েঘরে আটকে ছিলাম। তারপর এই ঝুপড়িটায় এসে মাথা গুঁজেছি," কথা বলতে বলতে পূজা তাঁর কারাগারসম ঝুপড়িটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। ঠিক তার পিজনেই রয়েছে তাঁর মা-বাবার বাড়ি। এভাবে ৩০ দিন কাটানোর পর অবশেষে পূজা ও তাঁর শিশু গৃহপ্রবেশের অনুমতি পান।
আমাদের কথাবার্তা চলাকালীন শিশুটি হঠাৎই কঁকিয়ে উঠল। মায়ের পুরনো একখানা শাড়ি দিয়ে পূজা একটা দোলনা বানিয়েছিলেন, কান্না ভোলাতে নিজের সন্তানকে আদর করে সেখানেই শুইয়ে রাখলেন তিনি। "ও [পূজা] তো মোটে দিন পনেরো ছিল দূরের ওই ঝুপড়িটায়। আমাদের গাঁয়ের লোকজন অতসত নিয়ম টিয়ম মানে না, বুঝলেন? অন্য গাঁয়ে [কাডুগোল্লারা বসবাস করেন যেখানে] গেলে দেখবেন, বাচ্চা হলে মেয়েদের দু-দুটো মাস আটকে রাখা হয় ঝুপড়িতে, কখনও কখনও তো আরও বেশি," জানালেন পূজার মা গঙ্গাম্মা, বয়স বোধ করি ৪০শের কোঠায়। ভেড়া চরানো ছাড়াও তাঁদের পরিবার নিজেদের এক একরের ছোট্ট এক চিলতে খেতে আম এবং রাগি চাষ করেন।
চুপটি করে পূজা তাঁর মায়ের কথা শুনছিলেন। শিশুটি ততক্ষণে দোল খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। "আমার কোনও রকমের অসুবিধা হচ্ছে না। মা তো সারাক্ষণ রয়েছে আমার পাশে। তবে হ্যাঁ, বাইরে অসম্ভব রোদ তো, একটু কষ্ট হয় তাই," বললেন পূজা। ২২ বছরে পা রাখা পূজা এম কম পড়তে চান। তাঁর স্বামী বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি কলেজে সহায়কের কাজ করেন। "ও-ও তো চায় যে আমি এসব আচার টাচার পালন করি। সব্বাই এমনটাই চায়। আমার নিজের অবশ্য কোনও ইচ্ছে ছিল না এরকমভাবে পড়ে থাকার। তবে বিশেষ জোর জবরদস্তি করিনি। আমাদের এসব রীতি রেওয়াজ মেনে চলতেই হয়," জানালেন তিনি।
*****
স্থানীয় ভাষায় কাডুগোল্লাদের জনপদগুলিকে গোল্লারাডোড্ডি কিংবা গোল্লারাহাট্টি নামে ডাকা হয়। মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাব ঘিরে এই নিয়মটি কিন্তু সমস্ত জনপদেরই বাস্তব। ঐতিহাসিকভাবে কাডুগোল্লা সম্প্রদায়ের যাযাবর মানুষজন পশুপালন করে এসেছেন, আজ তাঁদের নাম রয়েছে কর্ণাটকের অন্যান্য অনগ্রসর জাতির [ওবিসি] তালিকায়। (তবে তফশিলি জাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তাঁদের অনেকদিনের)। কর্ণাটকে তাঁদের জনসংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ৩,০০,০০০ (রামনগরের অনগ্রসর জাতিসমুহ উন্নয়ন বিভাগের সহ-সঞ্চালক পি.বি. বাসবরাজুর হিসেব মতো) থেকে ১ কোটি (জানালেন নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক কর্ণাটকের অনগ্রসর জাতিসমুহ কমিশনের জনৈক সদস্য)। বাসবরাজু জানালেন এই জনগোষ্ঠীটি মূলত রাজ্যের দক্ষিণ এবং মধ্যাঞ্চলেই বসবাস করে।
পূজাদের বাড়ি থেকে ৭৫ কিমি দূরে টুমকুর জেলায় রয়েছে ডি. হোসাহাল্লি গ্রাম, এখানকার কাডুগোল্লা বাসিন্দাদের পাড়ায় থাকেন জয়াম্মা। আজ তাঁর মাসিক ঋতুস্রাবের তৃতীয় দিন, তাই ভর সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে একটি গাছে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল তাঁকে। ঠিক তাঁর পিছনে বয়ে যাচ্ছে একটি দুর্গন্ধে ভরা নর্দমা, স্টিলের একটি থালা আর গেলাস মাটিতে পড়ে আছে। বেশ জোর গলায় জানালেন যে রোদজলঝড়বৃষ্টি সব কিছু উপেক্ষা করে প্রত্যেক মাসের এই তিনটে দিন তিনি এই গাছতলাতেই কাটান। ঘরকন্নার কাজকর্ম তখন করতে পারেন না ঠিকই, তবে বাড়ির ভেড়াগুলো তাঁকেই চরাতে নিয়ে যেতে হয় কাছাকাছি একটা মাঠে।
"সাধ করে আর কে-ই বা মাঠেঘাটে এমন রাত কাটায় বলুন দেখি?" জিজ্ঞেস করলেন তিনি। "তবে করতে এটা হবেই আমাদের। আসলে কি জানেন তো, এ সবই ভগবানের [কাডুগোল্লারা মূলত কৃষ্ণের উপাসক] হুকুম। কপালটা এমনই যে গতকাল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল, কোনও মতে মাথাটা ঢেকে [একফালি ত্রিপল দিয়ে] বসেছিলাম আমি।"
জয়াম্মা এবং তাঁর স্বামী উভয়েই পেশায় পশুপালক, বেশ কয়েকটি ভেড়া আছে তাঁদের। আর আছে দুই ছেলে [দুজনেরই বয়স বিশের কোঠায়], তাঁরা বেঙ্গালুরুর কারখানায় কাজ করেন। "খোকাদের তো একদিন না একদিন বিয়ে হবেই, তখন বৌমারাও মাসিকের সময় বাইরে রাত কাটাবে, অক্ষরে অক্ষরে এই নিয়ম মেনে চলি আমরা," বললেন তিনি, "আমার ভাল্লাগে না এসব, কিন্তু তাই বলে তো আর দেওতার আদেশ অমান্য করা যায় না। তবে আমার বর এবং গাঁয়ের মোড়লরা যদি রাজি হয় এই নিয়ম তুলে দিতে, তাহলে অবশ্যই মাসিকের সময় এভাবে আর বাইরে পড়ে থাকব না, ঘরেই থাকতে পারব।"
কুনিগাল তালুকের ডি. হোসাহাল্লি গ্রামের কাডুগোল্লা মহিলাদের প্রত্যেকেই এই প্রথাটির শিকার। "আমাদের গাঁয়ে মাসিক শুরু হলে তিনটে দিন মেয়েদের বাইরে থাকতে হয়, তারপর চারদিনের দিন আমরা বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে পারি," বললেন ৩৫ বছরের লীলা এম. এন. (পরিচয় গোপন রাখতে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)। ঋতুস্রাব শুরু হলে এই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকেও বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হয় না। "এখন তো এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। নিয়ম ভাঙতে কেউই চায় না, পাছে ভগবান শাপ দেন। রাত্তিরবেলা বাড়ির কোনও একজন পুরুষ, সে ভাই হোক বা বর কিংবা বাপ, সে হয় চৌকাঠের ওপার থেকে কিংবা বাইরে এসে আমাদের উপর নজর রাখে। কাছে আসে না, পাছে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়। যদি চার দিনের দিনও মাসিক চলে তাহলে বাড়িতে আসতে দেওয়া হয় বটে, তবে লোকজনের থেকে দূরে দূরে থাকতে হয়। বৌয়েরা তাদের বরের সঙ্গে শুতেও পারে না। তবে হ্যাঁ, ঘরকন্নার সমস্ত কাজ আমরা করি তখন, তাতে কোনও বাধা নেই," বললেন লীলা।
ঋতুমতি কিংবা সদ্য মা হয়েছেন এমন মহিলাদের সঙ্গে এরকম নির্মম ব্যবহার করাটা আইনের চোখে ক্ষমাহীন অপরাধ হলেও কাডুগোল্লাদের জনপদে এই পৃথক রাখার প্রথাটি রোজকার একটি সহজ স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে কর্ণাটকে বলবৎ হওয়া (২০২০ সালের ৪ঠা জানুয়ারি সরকারি নির্দেশনামা আসে) অমানবিক আচার এবং কালাজাদু প্রতিরোধ ও নির্মূলকারী আইন অনুযায়ী ১৬টি প্রথার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, এই তালিকাটির মধ্যে রয়েছে "মহিলাদের বিরুদ্ধে অমানবিক আচারসমুহ, যেমন তাঁদের গ্রামে ঢুকতে না দেওয়া, একা একা থাকতে বাধ্য করা এবং রজঃস্বলা কিংবা সদ্য মা হয়েছেন এমন মহিলাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা।" এই আইনটির বয়ানে অপরাধীদের ১ থেকে ৭ বছর অবধি কারাবাস এবং জরিমানার নির্দেশও আছে।
তবে নখদন্তহীন এই আইনের চোখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাডুগোল্লা জনজাতির মধ্যে রমরমিয়ে চলছে এই প্রথাটি। এমনকি অঙ্গনওয়াড়ি ও আশাকর্মীরা, যাঁদের উপর রয়েছে সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভার, তাঁরাও পালন করে চলেছেন এই কুসংস্কারটি। ডি. হোসাহাল্লিতে কর্মরত আশাকর্মী ডি. শারদাম্মাও (নাম বদলে দেওয়া হয়েছে) তাঁদের মধ্যে একজন, ঋতুস্রাব চলাকালীন তিনিও খোলা আকাশের নিচে একা একা রাত কাটান।
"এই গাঁয়ের প্রতিটা বাড়িতেই এই নিয়ম পালন করা হয়। আমি বড়ো হয়েছি চিত্রদুর্গায় [পাশের জেলা], ওখানে কিন্তু এমনটা কেউ আর করে না, কারণ লোকজন বুঝতে পেরেছে যে মেয়েদের এভাবে একা একা বাইরে পড়ে থাকাটা এক্কেবারে নিরাপদ নয়। অথচ এখানকার মানুষের বদ্ধমূল ধারণা যে এই নিয়মটা না মেনে চললে ভগবান পাপ দেবেন। আর কী-ই বা বলব বলুন, আমি নিজেও তো এটা পালন করি, হাজার হোক আমি তো এই সমাজেরই একজন। একা একা আদৌ কি কিছু পাল্টানো যায়? তাছাড়া প্রতিমাসেই তো একা পড়ে থাকি বাইরে, কই, কখনও কোনও বিপদ আপদ তো হয়নি আমার!" বললেন ৪০শের কোঠায় পা রাখা শারদাম্মা।
কাডুগোল্লা সমাজ থেকে উঠে আসা সরকারি কর্মচারীদের পরিবারগুলিও এই প্রথার বেড়াজালে আবদ্ধ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৪৩ বছরের মোহন এস. (এটা তাঁর আসল নাম নয়), যিনি ডি. হোসাহাল্লির গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেন। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা, এমএ এবং বিএড দুটোই করেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি মা হওয়ার পর তাঁকে তাঁর বাচ্চার সঙ্গে টানা দুই মাস নির্বাসিত করা হয় বাড়ির বাইরে আলাদা করে বানানো একটি কুঁড়েঘরে। "দু-দুটো মাস কেটে যাওয়ার পরই তাঁদের বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিয়েছিলাম আমরা," বললেন মোহন। পাশ থেকে মাথা নেড়ে সায় দিলেন তাঁর ৩২ বছর বয়সী স্ত্রী ভারতী (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)। "মাসিক হলে আমিও তো বাড়ির কিচ্ছুটি ছুঁই না। সরকার যেন কোনদিনও এসবের মধ্যে নাক না গলায়! তবে বাইরে গাছতলায় পড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয় তো, খুব ভালো হয় সরকার যদি একটা ঠিকঠাক ঘর বানিয়ে দেয় আমাদের জন্য।"
*****
একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছে এরকম কয়েকটি কামরা বানিয়ে দেওয়ার। ২০০৯ সালে জুনের ১০ তারিখে মিডিয়া একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখান থেকে জানতে পারা যায় যে কর্ণাটক সরকারের আদেশানুসারে কাডুগোল্লাদের প্রতিটি জনপদের বাইরে একটি 'মহিলা ভবন' বানানো হবে, সেখানে একসঙ্গে ১০জন করে রজঃস্বলা মহিলাদের থাকার ব্যবস্থা হবে।
তবে রাজ্য সরকার এই প্রকল্পটি নেওয়ার বহুযুগ আগেই ডি. হোসাহাল্লির গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জয়াম্মার পাড়ায় একটি এক-কামরার পাকাবাড়ি বানিয়ে দেয়। এটা হয়েছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে, কুনিগাল তালুকের পঞ্চায়েত সদস্য কৃষ্ণাপ্পা জি. টি. জানালেন আমাদের। ছোটবেলার সেসব কথা স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। গ্রামের মহিলারা গাছতলায় রাত না কাটিয়ে কয়েক বছর ব্যবহার করেছিলেন এই ঘরটি। তবে পাকাপাকিভাবে আজ সেটা ভোগদখল করছে লতাপাতা আগাছার সারি।
আরালালাসান্দ্রার কাডুগোল্লা পাড়াতেও এরকম একটা পরিত্যক্ত আধভাঙা কামরা রয়েছে। স্মৃতিচারণ করছিলেন অনু: "বছর পাঁচেক আগে পঞ্চায়েত আর জেলা প্রশাসনের থেকে কয়েকজন বাবু এসেছিলেন আমাদের গাঁয়ে। মাসিক চলছিল বলে আমরা কয়েকজন ওই কামরাটায় থাকছিলাম তখন। বাবুরা আমাদেরকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিলেন। তাঁরা এটাও বলেছিলেন যে বাড়ির বাইরে থাকলে বিপদ আপদ হতে পারে। আমরা যেই না ওই বাড়িটা ফাঁকা করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম, ওমনি দেখি বাবুরা সব কেটে পড়েছেন। ভাবলাম যে যাক, আপদ বিদেয় হয়েছে, তাই আমরা গুটি গুটি পায়ে আবার সেখানে গিয়ে মাথা গুঁজলাম। কিন্তু হায় হায়, কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই তাঁরা সব ফিরে এসে কামরাটা ভাঙতে শুরু করে দিলেন! হুকুম দিলেন যে মাসিকের সময়ে আমাদের নিজেদের বাড়িতেই থাকতে হবে। বড্ড কাজের জিনিস ছিল ওই ঘরটা, জানেন? আর কিছু হোক না হোক, নিদেনপক্ষে ওটার বাথরুমটা তো ব্যবহার করা যেত!"
২০১৪ সালে কর্ণাটকের তৎকালীন মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী উমাশ্রী কড়া ভাষায় বক্তব্য রাখেন কাডুগোল্লা জনজাতির এইসব অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে। প্রতীকী প্রতিবাদস্বরূপ ডি. হোসাহাল্লির নির্বাসিত রজঃস্বলাদের জন্য নির্মিত এই কামরাটিকে তিনি আংশিকভাবে ভেঙে ফেলেন। "উমাশ্রী ম্যাডাম বারবার অনুরোধ করেছিলেন আমাদের মহিলারা যাতে মাসিক চলাকালীন বাড়ির মধ্যেই থাকেন। তিনি নিজে গাঁয়ে আসাতে কয়েকজন রাজি হয়েছিল বটে, তবে এই প্রথা রদ করার আগ্রহ কারোরই বিশেষ ছিল না। তাঁর সঙ্গে ছিল বিশাল একটা পুলিশবাহিনী, আর ছিল আমাদের গাঁয়ের গোমস্তা। নিজে হাতে তিনি ওই বাড়িটার দরজা আর দেওয়ালের খানিকটা ভেঙে দিয়েছিলেন। আমাদের এই অঞ্চলটার উন্নয়নের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছিলেন বটে, তবে বাস্তবে তার সিকিভাগটুকুও হয়নি," বললেন এই তালুকের পঞ্চায়েত সদস্য কৃষ্ণাপ্পা জি. টি.।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডি. হোসাহাল্লির পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ধনলক্ষ্মী কে. এম. (তবে তিনি কিন্তু কাডুগোল্লা জনজাতির সদস্য নন)। কাডুগোল্লা মহিলাদের জন্য আলাদা করে ঘর বানানোর ব্যাপারে তিনিও সম্মত। ধনলক্ষ্মী বললেন: "এখানে মেয়েদের পোকামাকড়ের স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে, কী যে বলব বুঝতেই পারছি না, সদ্য সদ্য মা হওয়ার পরে কিংবা মাসিকের সময় নির্মমভাবে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া হয় তাঁদের! বসবাসের জন্য আলাদা করে ঘর বানাতেই হবে, এই ব্যাপারে আমি প্রস্তাব রাখব। তবে সবচাইতে দুঃখ কীসে জানেন? অল্পবয়সী শিক্ষিতা মেয়েরাও এসব কুসংস্কার মেনে চলে। কেউ যদি নিজেই নিজের উন্নতি না চায় তাহলে আমরা কী করতে পারি বলুন তো?"
তবে অনেকের মতে এই যে আলাদা ঘর বানানো নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, এটাকে অবিলম্বে শক্ত হাতে দমন করা দরকার। জেলা অনগ্রসর জাতিসমুহ উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত পি. বি. বাসবরাজু জানালেন যে, "হ্যাঁ, এটা এক্কেবারে ঠিক যে আলাদা করে কিছু কামরা বানিয়ে দিলে ওই মহিলাদের খুবই সুবিধা হবে, কিন্তু আমরা এই কুপ্রথাটিকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চাই। আমরা কাডুগোল্লা মহিলাদের সঙ্গে বারবার কথা বলেছি, তাঁদের আন্তরিকভাবে বুঝিয়েছি, বলেছি যে আপনারা দয়া করে এধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হন। সচেতনতার জন্য আগে আগে কত যে প্রচার করেছি তার ইয়ত্তা নেই।"
রজঃস্বলা মহিলাদের জন্য আলাদা কামরা বানিয়ে দেওয়াটা আদতে কোনও সমাধান নয়, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান কে. আরকেশ বেশ জোর গলায় এমনটাই জানালেন। তাঁর আদি নিবাস আরালালাসান্দ্রার কাছেই একটি গ্রামে। "কৃষ্ণ কুটির [ওই কামরাগুলির প্রচলিত নাম] বানানোর অর্থ এই প্রথাটিকে জায়েজ করে দেওয়া। জীবনচক্রের বিশেষ কিছু মুহূর্তে নারী অপবিত্র – এই ধরনের নোংরা ধ্যানধারণাগুলিকে সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এগুলোকে জিইয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না।"
"এই ধরনের গোঁড়ামিগুলি আদতে অসম্ভব নির্মম," বলছিলেন তিনি, "কিন্তু সামাজিক চাপ ও সঙ্কীর্ণতার ফলে মহিলারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে পারছেন না। সতীদাহ প্রথার কথাই ভাবুন, সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া ওটা রদ করা সম্ভবই হত না। আসলে কি জানেন তো, সমাজ সংস্কারের একটা অদম্য ইচ্ছে ছিল তখন মানুষের ভিতর। অথচ এখন দেখুন, ভোটের রাজনীতির ফলে নেতারা এসব ব্যাপারে এক্কেবারে নাক গলাতে চায় না। নেতানেত্রী, সমাজকর্মী, এবং তার সঙ্গে এই জনজাতির মানুষজন – সব্বাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে, নয়তো কিস্যুটি হওয়ার নয়।"
*****
যতদিন না সেটা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন এই প্রথা রমরমিয়ে চলবে সামাজিক কলঙ্ক আর দৈব অভিশাপের ভয়ে।
"আমরা এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে না মেনে চললে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে," আরালালাসান্দ্রার কাডুগোল্লা পাড়ার অনু বললেন। "জানেন একবার কী হয়েছিল? সে বহু বহুযুগ আগেকার কথা, টুমকুরে এক মহিলার মাসিক চলছিল, কিন্তু সে জোর জবরদস্তি বাড়িতেই ছিল। জানেন ওর ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল?"
"আমাদের দেবতারা চান যে এই সংস্কার আমরা পালন করে চলি, নয়তো তাঁরা রেগে গিয়ে অভিশাপ দেবেন," ডি. হোসাহাল্লির পঞ্চায়েত সদস্য মোহন এস. বলছিলেন যে যদি এই প্রথা রদ করে দেওয়া হয় তাহলে "রোগজ্বালায় ছেয়ে যাবে দেশগাঁ, আমাদের ভেড়া-ছাগল সব মরে যাবে। সব্বার ক্ষয়ক্ষতি হবে, কেউ রেহাই পাব না। এই প্রথা তুলে দেওয়ার কথা ভাবাটাও পাপ। আমি চাই না কেউ এটা বন্ধ করুক।"
"মাণ্ডিয়া জেলায় এক মহিলার সঙ্গে কী হয়েছিল জানেন? মাসিক চলছিল, তাও সে বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি। শেষে সাপের ছোবলে মারাই গেল," বললেন গিরিগাম্মা, তাঁর বাড়ি রামনগর জেলার সান্থানুর গ্রামের কাডুগোল্লা পাড়ায়। রজঃস্বলাদের জন্য সরকার থেকে এখানে বাথরুম সমেত একটি পাকাপোক্ত ঘর বানিয়ে দিয়েছিল এককালে, মহিলারা আজও সেটা ব্যবহার করেন। গ্রামের প্রধান সড়ক থেকে একটা সরু কাঁচা রাস্তা বেরিয়েছে, সেটা ধরে বেশ খানিকটা হাঁটলে এই ঘরটিতে পৌঁছানো যায়।
গীতা যাদব আজও ভোলেনি তিন বছর আগেকার সেই দিনটির কথা, জীবনে যেদিন প্রথমবার ঋতুস্রাব হয়েছিল তার। একা একা ওই ঘরটায় ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেছিল গীতা। "কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেছিলাম, মায়ের হাতেপায়ে ধরে বলেছিলাম ওখানে আমায় যেন না পাঠায়। মা কানেই তোলেনি সে কথা। তবে এখন আর একলাটি হয়ে থাকতে হয়না, সঙ্গে কোনও না কোনও কাকিমা কিংবা মাসিমা থাকেনই সবসময়। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি। মাসিক শুরু হলে আমি ক্লাস করে সোজাসুজি ওখানে চলে যাই, ঘরে ঢুকিনা আর। তবে হ্যাঁ, একটা খাট থাকলে ভালো হতো, ওই রকমভাবে মেঝেতে পড়ে থাকতে ভাল্লাগে না।" ১৬ বছরের গীতা একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ও বলছিল, "ভবিষ্যতে কাজ টাজ করতে যদি বড়ো কোনও শহরে যাই তখন না হয় আলাদা কোনও একটা কামরায় থাকব, কিচ্ছুটি ছোঁব না ওই কদিন। অক্ষরে অক্ষরে সব নিয়ম পালন করব। আমাদের গাঁয়ে সব্বাই এটা মেনে চলে।"
একাধারে ১৬ বছরের গীতা যেমন মুখিয়ে আছে এই প্রথাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে, অন্যদিকে ৬৫ বছরের গিরিগাম্মার মতে যেহেতু এই নির্বাসনের কদিন মহিলাদেরকে কোনও কাজকর্ম করতে হয় না সেহেতু তাঁদের আপত্তি জানানোর আদৌ কোনও কারণ নেই। "সে রোদ হোক বা জল, আমাদেরকেও তো বাইরে থাকতে হত। ঝড়বৃষ্টির সময় কতবার যে অন্য জাতের লোকজনের বাড়িতে মাথা গুঁজতে বাধ্য হয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কী করব? আমাদের জাতের কারও বাড়িতে ঢোকাটা তো মহাপাপ," বলছিলেন তিনি, "এমনও দিন গেছে যখন মাটির থেকে পাতা কুড়িয়ে সেই পাতায় খাবার খেয়েছি। এখন তো তাও আলাদা থালাবাসন রাখা থাকে ওখানে। সব্বাই আমরা নন্দলালার ভক্ত তো, মহিলারা তাঁর আদেশ কখনও অমান্যি করতে পারে?"
"এই তিন-চারদিন আমরা বিশ্রাম করি, ঘুমোই আর আরাম করে খাইদাই। অন্য সময় তো রান্নাবান্না, ঝাড়পোঁছ, ছাগল চরানো, হাজার একটা খাটাখাটনির কাজ থাকে, মাসিকের সময় ওসব কিচ্ছুটি করতে হয়না," জানালেন ২৯ বছরের রত্নাম্মা (এটা তাঁর আসল নাম নয়)। তিনি কণকপুরা তালুকের (সান্থানুর গ্রামটি যার অন্তর্গত) কাব্বাল গ্রাম পঞ্চায়েতে কর্মরত একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী।
গিরিগাম্মা এবং রত্নাম্মা এই প্রথাটি থেকে সুবিধা পেলেও মনে রাখতেই হবে যে এর ফলে বহুবার যেমন দুর্ঘটনাও ঘটেছে, তেমন একাধিক মানুষের প্রাণও গেছে। বছর সাতেক আগে টুমকুরের একটি ঝুপড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল এক মা ও তাঁর নবজাতককে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একটি খবরের কাগজে শিশুটির মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়। সারারাত বৃষ্টি হওয়ার ফলে শিশুটির ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। খবরের কাগজ থেকে জানতে পারা যায় মাণ্ডিয়া মাদ্দুর তালুকের কাডুগোল্লা জনপদে ঘটে যাওয়া আরেকটি নৃশংস ঘটনার কথা, ২০১০ সালে একটি ১০ দিনের শিশুকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কুকুরে।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের জন্য মা হয়েছেন ডি. হোসাহাল্লির কাডুগোল্লা পাড়ার ২২ বছরের পল্লবী জি.। বাড়ির কাজকর্ম দেখাই তাঁর কাজ। তিনি এই বিপদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, "যুগ যুগ ধরে এই নিয়মটা মানা হচ্ছে, মোটে এই দু-তিনটে ঘটনার কথা শুনে ভয় পেলে চলবে? এই ঝুপড়িটা খুবই আরামের, বুঝলেন? আর তাছাড়া ভয়ের আছেটাই বা কী? মাসিকের সময় অন্ধকারের মধ্যেই আমি তো বাইরে বাইরেই থাকি, এসব আমার সয়ে গেছে," পরম যত্নে নিজের নবজাতককে দোলাতে দোলাতে জানালেন তিনি।
পল্লবীর স্বামী টুমকুরে একটি গ্যাসের কারখানায় কাজ করেন। মা সন্তানসহ যে ঝুপড়িটায় থাকছেন সেটার মিটারখানেক দূরত্বেই রয়েছে আরেকটি কুঁড়েঘর। সেখানে থাকেন পল্লবীর মা এবং দাদু, প্রয়োজনে যাতে তাঁরা ছুটে আসতে পারেন তাই এই ব্যবস্থা। দুটো ঝুপড়ির মাঝ বরাবর রয়েছে একটি বাল্ব এবং একটি স্ট্যান্ড ফ্যান, এছাড়াও জলটল গরম করার জন্য বাইরেটায় কাঠের গনগনে আঁচের উপর রাখা আছে একটি হাঁড়ি। ঝুপড়ির উপর শুকোচ্ছে মা ও শিশুর যাবতীয় জামাকাপড়। তাঁদের প্রকৃত বাড়িটা এখান থেকে ১০০ মিটার দূরে। এ কারাবাস শেষ হতে বাকি আরও দুই মাস তিন দিন, তার আগে নবজাতকের সঙ্গে বাড়ি ফেরার অনুমতি পাবেন না পল্লবী।
মা ও শিশুর অমানবিক এই যে কারাদণ্ড, কাডুগোল্লাদের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা হয় মেষবলির মাধ্যমে। তবে সিংহভাগ পরিবারে পালিত হয় 'শুদ্ধিকরণ'। মা ও নবজাতকের ব্যবহার্য যাবতীয় জিনিসপত্র, জামাকাপড় ইত্যাদি সবই নাকি অপবিত্র, তাই সেই কুঁড়েঘরটির সঙ্গে সঙ্গে এগুলোরও শুদ্ধিকরণ করা হয়। দম্পতিকে দূর থেকে নির্দেশ দেন গ্রামের মোড়লেরা। তারপর সবাই মিলে যাওয়া হয় গ্রামের মন্দিরে যেখানে শিশুর নামকরণ, প্রার্থনা, প্রসাদভোগ ইত্যাদি সবকিছু হয়ে গেলে তবেই ঘরে ঢোকার অনুমতি পান তাঁরা।
*****
তবে এ হেন অচলায়তনের আনাচে কানাচে প্রতিরোধ যে একেবারেই জন্মায়নি তা কিন্তু মোটেও নয়।
আরালালাসান্দ্রার কাডুগোল্লা পাড়ায় বসবাস করেন ডি. জয়ালক্ষ্মাম্মা, সমাজের হাজার একটা চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে তিনি কিন্তু ঋতুস্রাব চলাকালীন নিজের বাড়িতেই থাকেন। চার চারটি সন্তানের মা এই ৪৫ বছরের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। প্রত্যেকবার প্রসবের পরে তিনি হাসপাতাল থেকে সোজা বাড়ি ফিরে এসেছেন। পাড়াপড়শিরা রেগে ব্যোম হয়ে গেলেও জয়ালক্ষ্মাম্মা একটিবারের জন্যও হোঁচট খাননি।
"বিয়ের পর এখানে এসে দেখলাম যে মহিলারা গাঁয়ের বাইরে ওই ঝুপড়িগুলোয় পড়ে থাকেন, এক একজন তো গাছতলাতেই রাত কাটান। এসব কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী আমার বর। বিয়ের আগে মা-বাবার বাড়িতে আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল বটে এসব নিয়ম টিয়ম পালন করতে, তবে আমার বরাবরই অসহ্য লাগতো এ ধরনের প্রথা। তাই শেষমেশ বন্ধ করে দিলাম। জানেন, পাড়াপড়শিদের থেকে সেজন্য আজও কত গঞ্জনা সইতে হয় আমায়?" বলছিলেন জয়ালক্ষ্মাম্মা। তিনি দশম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেছেন। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে ছোটোটির বয়স ১৯ এবং বড়োটির ২৩, মায়ের মতো ওরাও ঋতুস্রাবের সময় বাড়িতেই থাকে।
জয়ালক্ষ্মাম্মার স্বামী কুল্লা কারিয়াপ্পা জানালেন: "গ্রামের লোকজন সারাক্ষণ বাঁকা বাঁকা কথা বলত, বাজে কথা বলত। আমাদের কোনও বিপদ আপদ ঘটলে ওরা বলত যে যেহেতু আমারা কোনও নিয়ম টিয়ম মানি না, তাই নাকি আমাদের সঙ্গে এসব হচ্ছে। উদয়াস্ত আমাদের ভয় দেখাত, এমনকি একঘরে অবধি করে রেখেছিল আমাদের। তবে কয়েক বছর হতে চলল আর একঘরে করে রাখছে না, আসলে বুঝতেই তো পারছেন, আইনকানুনের ভয় আছে তো ব্যাটাদের!" ৬০ বছর বয়েসের এই মানুষটি অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক, এমএ এবং বিএড ডিগ্রি আছে তাঁর। "গ্রামের লোকজন যখনই আমাকে ডেকে এসব প্রথাটথার ব্যাপারে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমি তক্ষুনি মুখঝামটা দিয়ে বলেছি যে আমি একজন শিক্ষক, এসব আচরণ আমার দ্বারা হবে না। আসলে কী জানেন? আমাদের এই কুশিক্ষিত সমাজ মহিলাদের মাথার ভিতর এটা গেঁথে দিয়েছে যে আত্মত্যাগ করা এবং কষ্ট পাওয়াটাই নারীত্বের একমাত্র পরিচয়," রাগত স্বরে বলছিলেন তিনি।
জয়ালক্ষ্মাম্মার মতন অমৃতাও (নাম পরিবর্তন করা হয়েছে) মনেপ্রাণে প্রথাটির বিরোধী – কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই প্রতিরোধকে বাস্তবায়িত করতে তিনি অক্ষম। আরালালাসান্দ্রাবাসী ৩০ বছরের অমৃতা দুই সন্তানের মা। তিনি জানালেন, "উপরতলা থেকে (আধিকারিক কিংবা রাজনৈতিক নেতানেত্রী) কারও এখানে এসে আমাদের গাঁয়ের মোড়লদের ভালো করে বোঝানো উচিত। নয়তো আমার পাঁচ বছরের মেয়েটাকেও একদিন গাছতলায় দিন কাটাতে হবে [যখন সে বড়ো হবে]। শেষমেশ হয়তো আমিই বাধ্য হব এই রাস্তায় ওকে ঠেলে দিতে। আর কীই বা করতে পারি বলুন? একার দ্বারা তো এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।"
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
অনুবাদ : জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)