এই বছর জানুয়ারি মাসে শান্তি মাঞ্ঝি ৩৬ বছর বয়সে প্রথমবার দিদা হলেন। এই শক্তপোক্ত চেহারার মহিলা যিনি কিনা কোনও ডাক্তার বা নার্সের সহায়তা ছাড়াই বিগত দুই দশকে নিজেদের বাড়িতে নিভৃতে, সাতটি সন্তান প্রসব করেছেন, তিনি সেই রাতে অবশেষে প্রথমবারের মতো হাসপাতালে গেলেন।
ঘরে নিজের বড়ো মেয়ের প্রসব বেদনা ওঠার দিনটির কথা মনে করে তিনি বললেন, “সেদিন, ব্যথা ওঠার কয়েক ঘন্টা পরেও আমার মেয়ের বাচ্চা যখন বের হল না, তখন একটা টেম্পো ডাকতেই হল।” তিন চাকার একটি যাত্রীবাহী গাড়ি যেটা মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিওহর টাউন থেকে সন্ধে গড়িয়ে এসে পৌঁছাতে নিয়েছিল পাক্কা একটি ঘন্টা, ‘টেম্পো’ বলতে সেটিই। মমতাকে দ্রুত শিওহরের জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েক ঘন্টা পর তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।
“৮০০ টাকা নিয়ে নিল,” গজগজ করছিলেন শান্তি — টেম্পো চালকের উপর রাগ তাঁর এখনও যায়নি। “আমাদের পাড়ায় কেউ হাসপাতালে যায় না, তাই জানবই বা কেমন করে যে এখানে কোনও অ্যাম্বুলেন্স আছে কি নেই!”
নিজের কনিষ্ঠ সন্তান, চার বছরের কাজল, রাতে ঘুমানোর আগে কিছু খেলো কিনা দেখতে শান্তিকে আবার সেই রাতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। “আমি দিদা হয়েছি বটে কিন্তু আমার তো মায়ের কর্তব্যও কিছু আছে,” তিনি বললেন। মমতা আর কাজল ছাড়াও তাঁর আরও তিন কন্যা ও দুই পুত্র আছে।
উত্তর বিহারের শিওহর ব্লক তথা জেলার মাধোপুর অনন্ত গ্রামের বাইরে আন্দাজ এক কিলোমিটার দূরে বেশ কয়েক ঘর সম্বলিত মুসহর টোলায় থাকে এই মাঞ্ঝি পরিবার। মাটি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ৪০টি কুঁড়ে ঘরে ৩০০-৪০০ জনের বাস এখানে। সবাই বিহারে মহাদলিত গোষ্ঠী হিসাবে নথিভুক্ত মুসহর জাতির সদস্য। এটি বিহারের প্রান্তিকতম গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম। অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিসরের ঘরগুলির এক-একটির কোণে বিভাজন তৈরি করে কয়েকটি গরু ছাগলও বাঁধা থাকে।
সর্বসাধারণের জন্য, টোলার এক প্রান্তে যে হ্যান্ড-পাম্প বা চাপা কল আছে, সেখান থেকে শান্তি সবে প্লাস্টিকের একটি লাল বালতিতে জল ভরে এনেছেন। সকাল ৯টা নাগাদ নিজের বাড়ির সামনের সরু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, পথেই সিমেন্টে গাঁথা একটি ডাবা থেকে ঘোঁত ঘোঁত করে জল খাচ্ছিল তাঁর এক পড়শির মোষ। স্থানীয় ভাষায় তিনি জানালেন যে “সাতখানা” তিনি বাড়িতেই প্রসব করেছেন প্রায় কোনও ঝঞ্ঝাট ছাড়াই।
নাড়ি কে কেটেছে জিজ্ঞেস করায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “আমার জা।” কী দিয়ে কাটা হয়েছিল জানতে চাওয়ায় তিনি মাথা নাড়ালেন, অর্থাৎ তিনি জানেন না। পাড়ার যে ১০-১২ জন মহিলা সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা জানালেন যে বাড়ির সাধারণ ছুরি ধুয়ে মুছে ব্যবহার করা হয় এই কাজে — কেউ এই নিয়ে আলাদা করে কখনও কিছু ভাবেননি বলেই মনে হল।
মাধোপুর অনন্তের মুসহর টোলার বেশিরভাগ মহিলা এভাবেই নিজেদের ঝুপড়ি ঘরেই সন্তান প্রসব করেছেন, অবশ্য জটিলতা দেখা দিলে কাউকে কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে তাঁরা জানালেন। ওই পাড়ায় কোনও অভিজ্ঞ প্রসব সহায়িকা নেই। বেশিরভাগ মহিলার অন্তত চার পাঁচটি সন্তান আছে, এবং সেখানে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে কিনা যেখানে সন্তান প্রসব করার ব্যবস্থা আছে কি না তা কারোরই জানা নেই।
গ্রামে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা সরকারি চিকিৎসালয় আছে কিনা জানতে চাওয়ায় শান্তি বললেন, “আমি ঠিক বলতে পারব না।” ৬৮ বছর বয়সী ভাগুলানিয়া দেবী জানালেন যে তিনি শুনেছেন যে একটি নতুন ডাক্তারখানা খুলেছে মাধোপুর অনন্তে, “কিন্তু আমি কখনও সেখানে যাইনি। জানি না সেখানে কোনও মেয়ে ডাক্তার আছে কিনা।” ৭০ বছরের শান্তি চুলাই মাঞ্ঝি বললেন কেউ কখনও এই ব্যাপারে টোলার মহিলাদের কিছু জানায়নি, “কাজেই, কোনও ডাক্তারখানা থাকলেই বা আমরা জানব কেমন করে?”
মাধোপুর অনন্তে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, তবে একটি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে বটে। আমরা যেদিন দুপুরে সেখানে গিয়েছিলাম সেদিনের মতোই অধিকাংশ দিনই সেটি বন্ধ থাকে বলে গ্রামবাসীরা জানালেন। ২০১১-১২ সালের জেলা স্বাস্থ্য কর্ম পরিকল্পনা জানাচ্ছে শিওহর ব্লকে ২৪টি উপকেন্দ্র দরকার অথচ ছিল মাত্র ১০টি।
শান্তি জানালেন যে গর্ভাবস্থায়, তিনি বা তাঁর মেয়ে অঙ্গনওয়াড়ি থেকে আয়রন বা ক্যালসিয়াম কোনওটার বড়িই পাননি। তাছাড়া তিনি নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেও সেইসময়ে কোথাও যাননি।
তার উপর আবার প্রসবের দিন অবধি তিনি সব কাজকর্মও করেছেন। “প্রত্যেকবারই আমি প্রসবের ১০ দিন পর থেকেই আবার কাজকর্ম করাও শুরু করে দিয়েছি,” তিনি জানালেন।
সরকারের সমন্বিত শিশু বিকাশ পরিষেবা প্রকল্পে (আইসিডিএস) গর্ভবতী মা, স্তন্যপান করাচ্ছেন এমন মা, এবং শিশুদের সকলকে পুষ্টির সম্পূরক হিসাবে কাঁচা অথবা গরম রান্না করা খাদ্য দেওয়ার কথা অঙ্গনওয়াড়ি থেকে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের অন্তত ১৮০ দিন, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের বড়ি ও ক্যালসিয়ামের সম্পূরক পাওয়ার কথা। শান্তির সাতটি সন্তান ও এখন একটি নাতি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এমন কোনও পরিষেবার কথা কস্মিনকালেও শোনেননি বলে জানালেন।
একেবারে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মালি পোখার ভিন্দা গ্রামের আশা-কর্মী কলাবতী দেবী জানালেন যে মুসহর টোলার মহিলারা অঙ্গনওয়াড়িতে এসে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে যাননি। “এখানে দুটি অঙ্গনওয়াড়ি আছে, একটি মালি পোখার ভিন্দা গ্রামে ও অপরটি, পঞ্চায়েত গ্রাম, খৈরোয়া দরপে। ওই মহিলারা কোনটিতে গিয়ে নাম লেখাবেন বুঝতে না পেরে শেষ অবধি কোনওটিতেই নাম নথিভুক্ত করতে যান না।” দুটি গ্রামই মুসহর টোলা থেকে মোটামুটি আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এমনিতেই মুসহর টোলার ভূমিহীন পরিবারের মহিলাদের খেতে বা ইটভাটায় কাজে যেতে ৪-৫ কিলোমিটার পথ রোজ হাঁটতে হয়, তার উপর আবার এতটা পথ হাঁটা শান্তি সহ এই ভূমিহীন পরিবারের মহিলাদের পক্ষে চরম শ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
শান্তিকে ঘিরে যত মহিলা রাস্তায় জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের সবাই জানালেন যে তাঁরা এই সম্পূরকগুলি কখনও পানওনি আর কেউ তাঁদের কখনও বলেওনি যে অঙ্গনওয়াড়িতে গিয়ে নিজেদের এই অধিকার আদায় করতে হয়।
বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা অভিযোগের সুরে জানালেন যে অন্যান্য সরকারি সুবিধাদি পাওয়াও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ৭১ বছরের ধোগারি দেবী জানালেন যে তিনি কোনওদিন বিধবা ভাতাই পাননি। ভাগুলানিয়া দেবী, বিধবা নন, অথচ প্রতি মাসে তাঁর ব্যাঙ্কের খাতায় ৪০০ টাকা করে জমা পড়ে — কেন তা তিনি নিজেও জানেন না।
এই মহিলারা যে গর্ভাবস্থায় ও সন্তান জন্মের পরে তাঁদের প্রাপ্য অধিকারগুলি বিষয়ে কিছুই জানেন না, আশা-কর্মী কলাবতী তার সব দায় এই মহিলাদের অজ্ঞানতা ও অশিক্ষার উপরেই চাপিয়ে দিলেন। তাঁর কথায়, “প্রত্যেকের পাঁচ ছয় সাতটি করে বাচ্চা। সারাদিন বাচ্চাগুলো চারদিকে দৌড়ে বেড়ায়। আমি কতবার এদের বলেছি খৈরোয়া দরপ অঙ্গনওয়াড়িতে গিয়ে নিজেদের নাম লেখাতে, কিন্তু এরা শোনেই না।”
কী দিয়ে নাড়ি কাটা হয়েছিল জানতে চাওয়ায় তিনি মাথা নাড়ালেন, অর্থাৎ তিনি জানেন না। পাড়ার যে ১০-১২ জন মহিলা সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা জানালেন যে বাড়ির সাধারণ ছুরি ধুয়ে মুছে ব্যবহার করা হয় এই কাজে — কেউ এই নিয়ে আলাদা করে কখনও কিছু ভাবেননি বলেই মনে হল
মাধোপুর অনন্ত গ্রামে মুসহর টোলার কাছেই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বটে, কিন্তু মুসহর টোলার সামান্য কয়েকটি শিশুই সেখানে পড়তে যায়। শান্তি ও তাঁর স্বামী যেমন নিরক্ষর তেমনই তাঁদের সাত সন্তান। বরিষ্ঠ নাগরিক ধোগারি দেবী বললেন, “যাই করুক না কেন, সেই তো ওদের দিন মজুরিই করতে হবে।”
বিহারের তফসিলি জাতির মধ্যে সাক্ষরতার হার খুব কম। সারা ভরতবর্ষে তফসিলি জাতির মধ্যে সাক্ষরতার হার যেখানে ৫৪.৭ শতাংশ (২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে) সেখানে বিহারে এই হার প্রায় অর্ধেক — ২৮.৫ শতাংশ। এই গোষ্ঠীর মধ্যে আবার মুসহরদের মধ্যে সাক্ষরতার হার সর্বনিম্ন, মাত্র ৯ শতাংশ।
সুদূর অতীতকাল থেকেই মুসহরদের কোনও কৃষি সম্পদ নেই। বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি এবং জনজাতির বিকাশের উপর নীতি আয়োগের করা একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে বিহারের মুসহরদের মাত্র ১০.১ শতাংশ মানুষের দুধেল গাই আছে — তফসিলি জাতির মধ্যে এই পরিসংখ্যান সর্বনিম্ন। মাত্র ১.৪ শতাংশ মুসাহার পরিবারের কাছে বলদ আছে, এই ব্যাপারেও তাদের স্থান সর্বনিম্নে।
কোনও কোনও মুসহর পরিবার চিরাচরিত পেশা হিসাবে শূকর পালন করে এবং নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুসারে, এই কারণেও অন্যান্য জাতির মানুষ মুসহরদের নোংরা বলে বিবেচনা করে। ওই সমীক্ষায় প্রকাশ, অন্যান্য তফসিলি পরিবারের কাছে যেখানে সাইকেল, রিকশা, স্কুটার বা মোটর সাইকেল অবধি আছে, মুসহর পরিবারগুলিতে এর একটিও নেই।
শান্তির পরিবার শূকর পালন করে না। তাঁদের কয়েকটি ছাগল আর কিছু হাঁস মুরগি আছে কিন্তু এর দুধ ডিম তাঁরা নিজেরাই খান, বিক্রি করেন না। “আমরা চিরকাল খেটেই উপার্জন করেছি। বিহারের নানা প্রান্তে তো বটেই এমনকি অন্য রাজ্যেও আমরা কাজ করে এসেছি,” স্বামী-স্ত্রী যখন বিহারের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করতে যান তখন তাঁদের বাচ্চারাও তাঁদের সঙ্গে কাজ হাত লাগায়, জানালেন শান্তি।
“আমরা টানা কয়েক মাস, কখনও বা ছয় মাস একটানা সেখানেই থাকি। একবার কাশ্মীরে একটা গোটা বছর থেকে একটা ইটভাটায় কাজ করেছিলাম,” বললেন শান্তি। তখন তিনি পোয়াতি ছিলেন, যদিও গর্ভে কোন বাচ্চাটা ছিল তা তিনি মনে করতে পারেননি। “এটা ছয় বছর আগের কথা।” জায়গাটা কাশ্মীরের কোন অঞ্চলে সে কথাও তিনি বলতে পারেননি, তিনি কেবল জানেন যে সেটি ছিল এক বিশাল ইটভাটা যেটির সব শ্রমিকরা ছিলেন বিহারের মানুষ।
বিহারে ১,০০০ ইট বাবদ মেলে ৪৫০ টাকা আর কাশ্মীরে মিলত ৬০০-৬৫০ টাকা, অর্থাৎ বেশ খানিকটা বেশি। যেহেতু শান্তির স্বামী ও সন্তানরাও তাঁর সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করতেন সেহেতু তাঁরা দিনে ইট ১০০০ এর বেশি ইট তৈরি করতেন, যদিও তাঁর মনে নেই সে বছর তাঁরা মোট কত টাকা আয় করেছিলেন। শুধু মনে আছে, “আমরা বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলাম, কম টাকা নিয়েও ফিরতে চেয়েছিলাম।”
বর্তমানে তাঁর স্বামী, ৩৮ বছর বয়সী ডোরিক মাঞ্ঝি, পঞ্জাবে কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাজ করে মাস গেলে বাড়িতে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা পাঠাচ্ছেন। অতিমারি ও লকডাউনের কারণে এখন কাজ বাড়ন্ত, ঠিকাদাররা এখন কেবল পুরুষ শ্রমিকদেরই নিয়োগ করতে চাইছে — কেন তিনি ধান খেতে কাজ করছেন তা ব্যাখ্যা করতে এই কথাই জানালেন শান্তি। “কিন্তু মজুরি হাতে পাওয়াই তো একটা ঝক্কির ব্যাপার। কবে মজুরি দেবে সেই দিন স্থির করার জন্য মালিক অপেক্ষা করে থাকে,” অভিযোগের সুর শান্তির গলায় স্পষ্ট — কারণ তাঁকে এই কারণে একই কৃষকের বাড়ি, নিজের বনিহারি (মজুরি) আদায় করতে একাধিক বার যেতে হয়। কিন্তু তাও তিনি বললেন, “তবু এখন তো আমরা বাড়িতেই আছি।”
পাড়ার আর সব বাচ্চাদের সঙ্গে, তাঁর মেয়ে কাজলও বৃষ্টি ভেজা দিনে পথের ধারে খেলা করছিল। আমরা ছবি তোলার আগে, ওর যে দুটো ভালো ফ্রক আছে, তার একটা শান্তি কাজলকে পরে নিতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি আবার ভালো জামাটা খুলে রেখে আর সব বাচ্চার সঙ্গে খেলতে চলে গেল ওই কাদা ভরা রাস্তাটায় — লাঠি দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া - এই ওদের খেলা।
১৯৯৪ সালে সীতামঢ়ী জেলাকে কেটে যে নতুন শিওহর জেলা তৈরি করা হয়েছিল তা ভৌগোলিক পরিমাপ ও জনসংখ্যার দিক থেকে বিহারের ক্ষুদ্রতম জেলা। শিওহরের জেলা সদরটিই তার একমাত্র শহর। জেলার প্রধান নদী, গঙ্গার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখানদী বাগমতী তার উৎসস্থল নেপাল থেকে লাফিয়ে নামার পর বর্ষাকালে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠে, গোটা উত্তর বিহারকে বর্ষাকালে বেশ কয়েকবার প্লাবিত করে। এই জলস্ফিতির আরেকটা কারণ এই যে কোশী ও তার শাখা নদীগুলিও তখন বিপদ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই অঞ্চলের দুটি প্রধান ফসল, ধান আর আখ, দুটোই জলখেকো শস্য।
মুসহর টোলা-মাধোপুর অনন্তের মানুষ, স্থানীয় ধানের জমি অথবা, অন্য জেলার নির্মাণ ক্ষেত্র বা ইটভাটায় কাজ করেন। কারও কারও আত্মীয় স্বজনের এক-দুই কাঠা জমি থাকলেও এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে কারও জমি নেই।
শান্তির জট পাকানো চুল ছাপিয়ে উপচে থাকে তাঁর ঝকঝকে হাসিটাই। জটার বিষয়ে প্রশ্ন করায় সেখানে উপস্থিত আরও কয়েকজন মহিলা ঘোমটা সরিয়ে নিজের নিজের জটা দেখালেন। “এটা অঘোরী শিবের জন্য,” জানালেন শান্তি। সেইসঙ্গে তিনি একথাও বললেন যে এই জটা কেটে উৎসর্গ করার জন্য রাখা হয় না। তাঁর দাবি, এটা “রাতারাতিই গজিয়ে যায়।”
কলাবতী তাঁদের সব কথা উড়িয়ে দিয়ে জানালেন যে মুসহর টোলার মহিলারা নিজেদের স্বাস্থ্যের যত্ন মোটেই নেন না। কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সন্তান প্রসব করিয়ে আনলে প্রসব পিছু আশা-কর্মীরা ৬০০ টাকা করে পান কিন্তু কলাবতী জানালেন যে অতিমারির সময়ে সেই প্রাপ্য টাকার একটা অংশমাত্রই দেওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, “মানুষকে হাসপাতালে যেতে রাজি করানোই এক কঠিন কাজ, আর তার উপর আবার টাকাও পুরো আসে না।”
শান্তি তাঁদের সমাজের বিধিনিয়ম ও আচার-আচরণের বিষয়ে কথা বলার সময় খুব সাবধান ছিলেন। তিনি বোধহয় জানেন যে অন্যান্য জাতের মানুষেরা মুসহরদের অনমনীয় গোঁড়া বলে মনে করে। পুষ্টি বিষয়ে কথা তিনি কথা বলতে চাননি। মুসহরদের সম্বন্ধে চালু ও চিরাচরিত ধারণার বিষয়ে জানতে চাইলে কেবল তিনি বলেন, “না, আমরা ইঁদুর খাই না।”
কলাবতীও এই বিষয়ে একমত হয়ে জানালেন যে মুসহর টোলায় মানুষের খাদ্য সাধারণত ভাত আর আলু। “সবুজ তরি তরকারি এখানে কেউই খায় না,” একথা জানিয়ে তিনি এই জনপদের মহিলা ও শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতার প্রকোপের কথাও উল্লেখ করলেন।
শান্তি, প্রতি মাসে রেশন দোকান থেকে ২৭ কিলো চাল আর গম ভরতুকি মূল্যে পান। “সব বাচ্চাদের নাম রেশন কার্ডে ঢোকান নেই বলে ছোটো বাচ্চাগুলোর ভাগের আনাজ পাই না,” তিনি বললেন। তিনি জানালেন যে তাঁদের সেদিনের দুপুরের খাবার ভাত, আলু আর মুগের ডাল। রাতে রুটি হবে। দুধ, ডিম, সবজি এ বাড়িতে খুব কমই খাওয়া হয়, আর ফল আরোই কম।
তাঁর মেয়েরও এতগুলোই বাচ্চা হবে কি না জিজ্ঞেস করায় শান্তি হেসে ফেললেন। মমতার শ্বশুরবাড়ি সীমান্তের ঠিক ওপারে, নেপালে। “সে কথা আর আমি কেমন করে বলি! তবে হ্যাঁ, ওর হাসপাতালের দরকার পড়লে ও হয়তো এখানেই আসবে।”
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তনিবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে
অনুবাদ: চিলকা