বেসক্যাম্পে নতুন করে আশা ও উদ্বেগ ফিরে আসে, যেখানে সবুজ পোশাক পরিহিত পুরুষ ও মহিলারা লাগাতার নিজেদের মোবাইল ফোনে মেসেজ, মানচিত্র ও ছবির ওপর নজর রাখছিলেন।
সেদিন ভোরবেলা, সন্ধানকারী দল কাছের জঙ্গলের এক ফালিতে নতুন থাবার দাগ দেখতে পায়।
অন্য একটি দল, ৯০টি ক্যামেরা-ফাঁদের একটি থেকে বাঘের একটি ঝাপসা ছবি পায়, বন দফতরের এক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ক্যামেরা-ফাঁদগুলো বসানো হয়েছিল বিক্ষিপ্ত কার্পাস খেত ও জলাশয় সম্বলিত ৫০ বর্গ কিলোমিটারের পর্ণমোচী গুল্মজাতীয় জঙ্গলে। “গায়ের ডোরা দেখে মনে হচ্ছে মহিলা,” জংলা সবুজ পোশাক পরিহিত এক যুবক জানালেন, তাঁর গলায় চাপা উত্তেজনা। “ছবিটা পরিষ্কার নয়,” তাঁর ঊর্ধ্বতন আধিকারিক বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের আরও স্বচ্ছতা প্রয়োজন।”
এটা কি সেই বাঘিনী হতে পারে? সে কী আশেপাশে থাকতে পারে?
বনরক্ষী, সন্ধানকারী ও তীক্ষ্ণ নিশানাকারীদের দলগুলো আরও একটি শ্রমসাধ্য দিন আরম্ভ করতে এবং বিভিন্ন দিকে যাত্রা শুরু করতে তৈরি ছিল – তাঁদের লক্ষ্য সেই বাঘিনীকে খুঁজে বের করা যে তার দুই শাবক নিয়ে প্রায় দুবছর ধরে ফাঁকি দিচ্ছে।
অন্তত ১৩ জন গ্রামবাসী বাঘের হানায় মারা গেছেন - প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্দেহের তীর তার দিকেই।
বন্যপ্রাণী প্রহরীর আদেশনামা বলছে, বাঘিনীটিকে ‘বন্দি করা বা মেরে ফেলা’র জন্য দুমাস ধরে এক ব্যাপক কর্মকাণ্ড চলছে। কিন্তু দুটোর কোনওটাই সহজ নয়। ২রা অগস্ট, ২০১৮ থেকে বাঘিনীটি কোনও সূত্রই দেয়নি। যে দলগুলি তাকে খুঁজে বের করা ও বন্দি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ক্যামেরার একটি ছোট বিপ শব্দ বা থাবার ছাপই তাদের আশা জাগিয়ে তোলে।
* * * * *
মধ্য অক্টোবরের রবিরারের সকাল, শীতের ঠান্ডা এখনও শুরু হয়নি। আমরা বিচ্ছিন্ন একফালি জঙ্গলে, এখানে আধিকারিকরা একটি অস্থায়ী তাঁবু বানিয়েছেন যেটাকে তাঁরা বলছেন এই অপারেশনের বেস ক্যাম্প, লাগাতার কার্পাস চাষিদের আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত এলাকা পশ্চিম বিদর্ভের ইয়াভাতমল জেলার লোনি ও সারাতি গ্রামের মাঝে এটি অবস্থিত।
এটি রালেগাঁও তহশিল, জাতীয় সড়ক ৪৩ এর উত্তরে,ওয়াদকি ও উমরি গ্রামের মাঝে। এখানকার গ্রামবাসীরা মূলত গোণ্ড আদিবাসী সম্প্রদায়ের, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, চাষ করেন তুলো ও ডাল।
বাঘ সন্ধানকারী দলটিতে রয়েছেন ২০০ জন বনকর্মী - মহারাষ্ট্র বন দফতরের বন্যপ্রাণী শাখা রক্ষী ও রেঞ্জ অফিসার, রাজ্যের বন উন্নয়ন কর্পোরেশন, জেলার বন আধিকারিক, মুখ্য বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী) ও বন্যপ্রাণী শাখার উচ্চপদস্থ আধিকারিক, প্রিন্সিপ্যাল চিফ বনরক্ষক (পিসিসিএফ, বন্যপ্রাণী)। তাঁরা সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারাদিন, মাটিতে আঁকড়ে পড়ে থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাঘিনী ও তার দুই শাবককে।
দলে রয়েছেন হায়দ্রাবাদ থেকে আসা একদল তীক্ষ্ণ নিশানাকারী। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৬০ বছরের নবাব শফথ আলি খান, এক অভিজাত পরিবারের প্রশিক্ষিত শিকারী। নবাবের উপস্থিত আধিকারিক ও স্থানীয় সংরক্ষণবাদীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে, সংরক্ষণবাদীরা তাঁর ভূমিকাতে খুব একটা খুশি নন। কিন্তু বেপরোয়া বন্যপ্রাণীকে ঘুম পাড়ানো বা মারার জন্য ভারত জুড়ে বন্যপ্রাণী কর্তৃপক্ষের জন্য তিনিই ভরসা।
“উনি এটা বহুবার করেছেন,” তাঁর দলের সদস্য সৈয়দ মৈনুদ্দিন খান বলেন। কিছুদিন আগে তাডোবা জাতীয় উদ্যানের কাছে (ভারতের ৫০টি ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কেন্দ্রের একটি) উনি একটি বাঘিনীকে ঘুম পাড়িয়ে বন্দি করেন, বাঘিনীটি দুজনকে মেরেছিল।
বিহার ও ঝাড়খণ্ডে ছয়মাস ধরে ১৫ জন মানুষকে পিষে মারার পর একটি খ্যাপা হাতিকে তীরবিদ্ধ করেন তিনি এবং পশ্চিম মহারাষ্ট্রে একট চিতাবাঘকে গুলি করেন যে সাতজন মানুষকে মেরেছিল।
“কিন্তু এটা আলাদা”, গুলি ও তীর ছোঁড়া যায় এমন সবুজ রাইফেল ঝুলিয়ে চশমা পড়া মৃদুভাষী নিশানাকারী বলেন।
শাফথ আলি সেই রবিবার সকালে পুত্র ও সহকারীদের দল নিয়ে বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছেছেন শিকারীর জংলা পোশাক পরে, সেখানে বসে তিনি বলেন, “বাঘিনী আছে তার শাবকদের সঙ্গে। আমাদের প্রথমে বাঘিনীটিকে ঘুম পাড়াতে হবে, তারপর তার শাবকগুলিকেও বন্দি করতে হবে।”
“বলা অবশ্য সোজা”, তাঁর পুত্র অসগর বলেন, তিনি এই অপারেশনে বাবাকে সাহায্য করছেন। বাঘিনীটিকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া কঠিন, আর সেটাই সমাধানের রাস্তায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাঘিনীটি দ্রুত তার অবস্থান বদলাচ্ছে, কোনও এক জায়গায় আট ঘন্টার বেশি থাকছে না, ২৫০ কিলোমিটার দূরের নাগপুর জেলার পেঞ্চ ব্যাঘ্র সংরক্ষণাগার থেকে একমাস আগে এই অপারেশনে যোগ দিতে আসা ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ বলেন।
দলের কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়েছেন। ধৈর্যই এখানে আসল, তবে তার যেন বা অভাব দেখা দিচ্ছে।
টি১ বা স্থানীয় মানুষেরর কাছে অবনী – রালেগাঁওয়ে দুবছরে ১৩ থেকে ১৫ জন গ্রামবাসীকে মেরেছে বলে মনে করা হয়। বাঘিনীটি এখানেই আছে, তহশিলের ঝোপ ও ঘন জঙ্গলের সবুজের আড়ালে।
দুই বছর ধরে ৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডজনখানেক গ্রামকে আতঙ্ক ও উদ্বেগে ডুবিয়ে রেখেছে সে। গ্রামবাসীরা ভীত, জমিতে তুলো তুলতে যেতে চাইছেন না, যদিও এটা চাষের মরশুম। “আমি গত একবছর আমার খেতে যাইনি,” কলাবাঈ শেন্দ্রে বলেন, তাঁর স্বামী লোনি গ্রামের টি১-এর শিকারদের একজন।
টি১ যে কোনও ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে – যদিও ২৮শে অগস্ট, বেসক্যাম্পের উত্তর দিকে পিম্পলশেন্দা গ্রামে তার শেষ শিকারকে আক্রমণের পর আর কোনও মানুষকে সে আক্রমণ করেনি। যাঁরা তাকে দেখেছেন, তাঁরা বলেন সে আক্রমণাত্মক ও তার সম্বন্ধে আগে থেকে কিছু বলা কঠিন।
বন আধিকারিকরা মরিয়া; আরেকজন মানুষের ওপর আক্রমণ হলে স্থানীয়রা রাগে ফেটে পড়বেন। অন্যদিকে, টি১ কে মেরে ফেলার আদেশকে প্রশ্ন করে বাঘপ্রেমী ও সংরক্ষণবাদীরা আদালতে মামলা করছেন।
মুখ্য বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী), এ.কে. মিশ্র, চার মাসের মধ্যে অবসর গ্রহণ করবেন। তিনি তাঁর সহকারীর সঙ্গে কাছের পান্ধারকাওয়াদাতে শিবির করে রয়েছেন। “স্যার হয়তো এখানেই অবসর নেবেন,” একজন অল্পবয়সী আধিকারিক মজা করে বলেন।
* * * * *
টি১ কে দিয়ে সমস্যার শুরু হয়নি, টি১-এর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষও হবে না, বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্দোলনকর্মীরা বলেন। বাস্তবে এটা আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে – আর ভারতের কোনও ধারণাই নেই কীভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা করবে।
“আমাদের সংরক্ষণের নীতির নতুন করে খসড়া তৈরি করার এটিই সঠিক সময়,” বলেন নাগপুরের নীতিন দেশাই, ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (ডব্ল্যুপিএসআই)-এর মধ্য ভারতের অধিকর্তা। “আমাদের এমন বাঘদের নিয়ে কাজ করতে হয় যারা সংলগ্ন কোনও বনাঞ্চল পায়নি বা পাবে না। বস্তুত, আমরা এমন একদল বন্য বিড়ালকে দেখছি যারা আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
দেশাইয়ের কথাতে সত্যতা আছে: টি১-এর এলাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে, অমরাবতী জেলার ধমনগাঁও রেলওয়ে তহশিলে, ১৯শে অক্টোবর একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাঘ, মঙ্গরুল দস্তগির গ্রামে একজন লোককে তার খেতে ঢুকে মেরে ফেলে, তিন দিন পরে অমরাবতী শহরের কাছে মারে একজন মহিলাকে। বাঘটি তার মায়ের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বন আধিকারিকরা মনে করছেন, বাঘটি চন্দ্রপুর জেলা থেকে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা পেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে, রাস্তার বেশিরভাগটাই জঙ্গলহীন। তাঁরা মনে করেছিলেন, একটি নতুন ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যে আধিকারিকরা বাঘটির গতিপথ পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাঁরা পরে জানান, এটি চন্দ্রপুর থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার হেঁটে মধ্যপ্রদেশে প্রবেশ করে।
টি১ বোধহয়, ইয়াভতমল জেলায়, প্রায় ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত টিপেশ্বর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য থেকে এখানে এসেছে – সে তার মায়ের দুটি শাবকের একটি, বলেন জেলার বন্যপ্রাণী প্রহরী ও বাঘপ্রেমী রামজান ভিরানী। একটি পুরুষ বাঘ টি২, তার দুই শাবকের বাবা, এই একই এলাকায় থাকে।
“২০১৪ সাল নাগাদ বাঘিনীটি এই এলাকায় আসে ও বসবাস শুরু করে,” পান্ধারকাওয়াদার একটি কলেজের একজন অধ্যাপক বলেন। “সেইসময় থেকেই আমরা ওর গতিবিধিতে নজর রাখছি; বহু দশকের মধ্যে এই প্রথমবার এই এলাকাতে কোনও বাঘ এসেছে।”
কাছাকাছি গ্রামে থাকা বাসিন্দারা সহমত। “আমি এই এলাকাতে কোনও বাঘের উপস্থিতির কথা কোনওদিন শুনিনি,” বলেন ৬৩ বছর বয়সী মোহন থেপালে, তাঁর নিবাস সারাতি গ্রামে। এখন বাঘিনী ও তার দুই শাবকের গল্প উড়ে বেড়াচ্ছে।
বিদর্ভের অন্য অনেক এলাকার মতোই এই অঞ্চলেও চাষের জমি ও বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্প - নতুন ও চওড়া রাস্তা, বেম্বলা সেচ প্রকল্পের একটি খাল ইত্যাদির মাঝে রয়েছে ছোটো ছোটো জঙ্গলের ফালি। এগুলি গুরুতরভাবে জঙ্গলের আয়তন কমিয়ে দিয়েছে।
টি১ প্রথম ২০১৬ সালের জুন মাসে বোরাতি গ্রামে সোনাবাঈ ঘোসালেকে মারে, সোনাবাঈয়ের বয়স ছিল ৬০ এর কোঠায়। (পড়ুন: টি১ বাঘিনীর আক্রমণের খতিয়ান ও আতঙ্ক )। বাঘিনীটির তখন শাবক ছিল না। ২০১৭ এর শেষে সে তাদের জন্ম দেয়। ২০১৮ এর অগস্টে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে যখন অভিযোগ অনুযায়ী টি১ দুইজন লোককে মারে। তার সর্বশেষ শিকার ৫৫ বছরের পশুপালক ও কৃষক নাগোরাও জাংঘারে, পিম্পলশেন্দা গ্রামে ২৮শে অগস্ট তিনি মারা যান।
ততদিনে মুখ্য সংরক্ষক বাঘিনীটিকে মারার আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে উচ্চ আদালত ও পরে শীর্ষ আদালতে সিদ্ধান্তটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। শীর্ষ আদালত, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তই জারি রাখে, বাঘিনীটিকে জীবিত বন্দি করা না গেলে মেরে ফেলতে হবে।
এরপর কিছু সংরক্ষণবাদী বাঘিনীটির জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ইতিমধ্যেই বন আধিকারিকরা শ্যুটার শফথ আলি খানকে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু সংরক্ষণবাদীদের প্রতিবাদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর হস্তক্ষেপে তাঁকে ফেরত পাঠাতে হয়।
সেপ্টেম্বরে, মধ্যপ্রদেশ থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দলকে ডেকে পাঠানো হয়। দলটি চারটি হাতি নিয়ে আসে, পঞ্চম দাঁতালটিকে আনা হয় চন্দ্রপুরের তাডোবা আন্ধারি ব্যাঘ্র সংরক্ষণকেন্দ্র থেকে।
অপারেশন বড়সড় ধাক্কা খেলো যখন, চন্দ্রপুর থেকে আনা হাতিটি মত্ত হয়ে উঠে মাঝরাতে শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় ও মধ্য রালেগাঁওয়ের শিবির এলাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চহন্দ ও পোহানা গ্রামে দুজনে মেরে ফেলে।
মহারাষ্ট্রের বনমন্ত্রী সুধীর মুঙ্গনটিওয়ার হস্তক্ষেপ করেন; তিনি শফথ আলি খানকে ফিরিয়ে আনেন ও বন্যপ্রাণী শাখার প্রধান এ.কে.মিশ্র সহ উচ্চপদস্থ বন আধিকারিকদের বলেন যতদিন না বাঘটিকে ধরা বা মারা যাচ্ছে ততদিন তাঁরা যেন পান্ধারকাওয়াতেই থাকেন। এর ফলে নাগপুরের সংরক্ষণবাদীরা আবারও প্রতিবাদে নামেন।
নবাব কাজে ফেরায়, স্থানীয় বাঘ সংরক্ষণবাদী ও কিছু বন আধিকারিকরা প্রতিবাদ স্বরূপ এই কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। তাঁরা শফথ আলির দৃষ্টিভঙ্গীরও বিরোধিতা করেন – জানা যায় তিনি বিশ্বাস করেন বাঘিনীটিকে জীবিত বন্দি করা যাবে না, তাকে মেরে ফেলাই সব থেকে ভাল।
নবাব, হরিয়ানা থেকে বিখ্যাত গলফ্ খেলোয়াড় ও কুকুর প্রজননবিদ জ্যোতি রানধাওয়াকে তাঁর দুটি ইতালিয়ান কেন কর্সো প্রজাতির কুকুর সমেত ডেকে পাঠান – গন্ধ শুঁকে বের করার জন্য।
প্যারাগ্লাইডারদের একটি দল, ড্রোন-চালক ও সন্ধানকারীদেরও যুক্ত করা হয় – সবই ব্যর্থ। ড্রোনগুলো থেকে খুব শব্দ হয়। এলাকার ভূসংস্থান ও ঘন গাছপালার কারণে প্যারাগ্লাইডাররা কোনও কাজে এলেন না।
অন্যান্য পরিকল্পনাও বাতিল হয়- জাল, টোপ, পায়ে হেঁটে নজরদারি ইত্যাদি।
টি১ অধরাই থাকে, গ্রামবাসীদের ভয়ে কাঁটা করে রেখে। পুরো সেপ্টেম্বর মাস ও অক্টোবরের প্রথম ভাগে কিছুই ঘটে না।
* * * * *
তারপর একটি সূত্র পাওয়া গেল যে বাঘিনীটি আশেপাশেই আছে।
১৭ই অক্টোবর একটি সন্ধানকারী দল উত্তেজিত হয়ে ফেরে: টি১ বেসক্যাম্পের কাছাকাছিই ঘুরছে। তাঁরা জানান বাঘিনীটিকে তাঁরা সারাতি গ্রামে দেখেছেন, যেখানে ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে টি১ একজন অল্পবয়স্ক কৃষককে হত্যা করে, বেসক্যাম্প থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে।
সন্ধানকারী দলগুলি লাফিয়ে ওঠে ও সেই নির্দিষ্ট জায়গায় ছুটে যায়। সে এখানেই আছে। ক্রুদ্ধ কোণঠাসা বাঘিনী একটি দলের দিকে ধেয়ে যায়। ঘুমপাড়ানি তীর ছোঁড়ার পরিকল্পনা ছেড়ে বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন শার্প শ্যুটাররা। একটি বাঘিনী যখন আক্রমণাত্মক হয়ে আছে আর তেড়ে আসছে তখন তাকে গুলি করা যায় না।
কিন্তু এটা সুখবর। প্রায় ৪৫ দিন পর টি১ তার গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়েছে। এবারে তার চলাফেরার ওপর নজর রাখা সহজ হবে। কিন্তু তাকে ধরা এখনও কঠিন ও বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।
* * * * *
“এটি একটি কঠিন অপারেশন,” শফথ আলি বলেন। “শাবকগুলি আর ছোটো নেই। বছর খানেক বয়স হয়েছে, ছয়-সাত জন মানুষকে একসাথে মোকাবিলা করার মতো বড়ো হয়ে গেছে তারা।” তাই সন্ধানকারীরা একটি বাঘিনী নয়, তিনটি বাঘের মোকাবিলা করছেন।
যেহেতু মহারাষ্ট্র বন আধিকারিকরা সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করছেন, হায়দ্রাবাদ থেকে আসা শফথ আলি ও তাঁর দলের থেকেই অপারেশনের টুকরোটাকরা খবর পাওয়া যাচ্ছে।
“এরা বড়ো বেশি নাক গলায়,” একজন অল্পবয়সী চশমা পরা রেঞ্জ অফিসার বলেন একটি মারাঠি খবরের চ্যানেলের টিভি কর্মীদের বিষয়ে। শফথ আলির সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলাটা তাঁর পছন্দ নয়।
বন আধিকারিকদের জনগণের চাপ ও রাজনৈতিক চাপানউতোর সামলাতে হচ্ছে, কিন্তু স্পষ্টতই তাঁরা নিজেরাই এর জন্য দায়ী, পান্ধারকাওয়াদার একজন সংরক্ষণবাদী বলেন, শফথ আলি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিবাদে তিনি অপারেশন থেকে সরে গেছেন। “তাঁরাই পরিস্থিতিকে তাঁদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে দিয়েছেন।”
বেসক্যাম্পে একটি কাঠের লাঠি থেকে একটি বড় আঞ্চলিক মানচিত্র ঝুলছে, তার ওপর লাল দাগ দিয়ে গত দুবছরে টি১ এর গতিবিধির পথ চিহ্নিত করা আছে।
“এটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়,” একজন অল্পবয়সী রক্ষী হেঁটে এসে জিরিয়ে নিতে নিতে ব্যাখ্যা করেন, “উঁচু-নীচু পথ, প্রচুর খেত, বুনো ঝোপ, এখানে সেখানে ঘন গাছপালা ও জঙ্গলা জমি, ছোটো ছোটো নদী আর জলাশয় – বেশ কঠিন এটা।”
প্রতি আট ঘন্টায় বাঘিনীটি জায়গা পরিবর্তন করছে, শুধুমাত্র রাতে ঘুরছে।
২১শে অক্টোবর, একজন গ্রামবাসী সন্ধের শেষে বাঘিনী ও তার শাবকদের দেখতে পান। আতঙ্কে তিনি বাড়িতে পালিয়ে আসেন। একটি সন্ধানকারী দল জায়গাটিতে পৌঁছোয়। ততক্ষণে বাঘিনী ও তার দুই শাবক অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।
তবে অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে, অনেকগুলো দল টি১ ও তার শাবকদের গতিবিধি কাছ থেকে লক্ষ্য করে। অক্টোবর ২৫ থেকে ৩১, দুজন গ্রামবাসী অল্পের জন্য রক্ষা পান – একজন বোরাতিতে ও অন্যজন আতমুর্দি গ্রামে। (পড়ুন ‘‘ওকে বাড়িতে ফিরতে দেখলে, আমি বাঘটিকে ধন্যবাদ জানাই’’ )
এর মধ্যে শফথ আলিকে বিহারে একটি বৈঠকের জন্য যেতে হয়। তাঁর ছেলে, আসাগর আলি তাঁর শার্প শ্যুটারদের দল নিয়ে অপারেশনের দায়িত্ব নেন। ভারত জুড়ে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্দোলনকর্মীরা টি১-কে বাঁচানোর জন্য আর্জিপত্র পেশ করতে থাকেন। ঘটনাস্থলে উদ্বেগের বাতাবরণ জারি থাকে। চাষের জন্য কার্পাস তৈরি, কিন্তু রালেগাঁও তহশিল জুড়ে গ্রামবাসীরা আতঙ্কে বাস করতে থাকেন।
২রা নভেম্বর, অনেক গ্রামবাসীই দেখেন, টি১ বোরাতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রালেগাঁও যাওয়ার পিচের রাস্তায়। সে তার শাবকদের সঙ্গে। আসগার ও তাঁর সহকারীদের সঙ্গে একটি নজরদারি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছোয়। ৩রা নভেম্বর, শনিবার, শফথ আলি বেসক্যাম্পে ফেরেন।
৩রা নভেম্বর, মহারাষ্ট্র বন দফতরের বিবৃতি জানায় আগের দিন রাত ১১ টা নাগাদ টি১-কে গুলি করে মারা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ে ধরে চলা এরকম এক অপারেশনের অবশেষে পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাঘিনীটিকে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে ও সে আক্রমণাত্মকভাবে নজরদারি দলের দিকে তেড়ে এলে, খোলা জিপে বসে থাকা আসগর আত্মরক্ষায় গুলি চালান ও একটি গুলিতেই বাঘিনীটিকে হত্যা করেন, সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়।
টি১-এর মৃতদেহ নাগপুরের গোরেওয়াদা চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য।
এ.কে. মিশ্র, মুখ্য বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী), সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা নতুন করে পরিকল্পনা শুরু করেছেন যাতে টি১-এর দুই শাবককে জীবিত অবস্থায় ধরা যায়।
রালেগাঁওয়ের গ্রামবাসীরা স্বস্তি পেয়েছেন, কিন্তু টি১-কে যেভাবে মারা হয়েছে ও যেভাবে নিয়ম ভাঙা হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে বন্যপ্রাণী বিষয়ক আন্দোলনকর্মীরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
একটি বাঘিনী মারা গেছে। কিন্তু মানুষ বনাম বাঘের দ্বন্দ্ব চলছেই।
বাংলা অনুবাদ : সানন্দা