মাজালগাঁওয়ের এক মা-মেয়ের যুগলব ন্দি তরুণ ভীমরাও ও রমাবাইয়ের প্রতি তাঁদের অপার স্নেহ ও অনুরাগ কে ব্যক্ত করেছে , এই দম্পতি হয়ে উঠেছেন তাঁদের গেরস্থালির অবিচ্ছেদ্য অংশ
গোলচে মোমের দাগে সোহাগে কুঙ্কু লাগে, সুখবতী সুন্দরী ওগো রমাবাই,
এমন অবাক দিনে বসিয়া এরোপ্লেনে ভীমবাবা ডাকে তারে, "আয় রমা আয়।"
এই ওভিটির মধ্যে দিয়ে ভীমরাও আম্বেদকর ও রমাবাইয়ের যৌবনের একটি অধ্যায় তুলে ধরলেন পার্বতী ভাদার্গে। এ গানের অন্তরে লুকিয়ে আছে দুটি অর্থ: আপাতদৃষ্টিতে গোচর হয় জোয়ান এক দম্পতির অন্তহীন প্রণয়, তবে অন্তর্নিহিত অর্থটি আরও অনুপম; বছরের পর বছর ধরে বিরহ সহ্য করেছিলেন তাঁরা দুজন, স্বামী বিলেতে পড়তে গেলে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব একা সামলেছিলেন রমাবাই।
কয়েকটি ওভিতে উঠে এসেছে ভীমরাওয়ের বাবা রামজি আম্বেদকরের প্রতিপত্তির কথা। তাঁর কতগুলো ঘোড়া আছে সেটা ঘিরে জল্পনা যেমন রয়েছে, প্রাণীগুলোর তেষ্টা মেটাতে তিনি যে সুমিষ্ট জল-ভর্তি একটি ইঁদারা খনন করিয়েছেন, গানে গানে বলা হয়েছে একথাও। বাবাসাহেব ও রমাবাইকে ঘিরে তাঁদের যে গর্ব, স্নেহ ও শ্রদ্ধা – কল্পনার ডানায় ভর করে কখনও কেমনও এসব হয়তো বাস্তবের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়, তবুও যেন মেটে না কৌতুহল। কেমন করে হয়েছিল ভীমরাও আর রমাবাইয়ের বিয়ে? জাঁকজমকের শেষ ছিল না নিশ্চয়?
সময়টা ১৯০৬, বেশ অল্প বয়সেই গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তাঁরা, তখনকার দিনে এমনটাই চল ছিল কিনা। সদ্য সদ্য ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন ১৪ বছরের ভীমরাও, কনে রামি ভালাঙ্গকরের বয়েস তো মোটে ৯। সম্বন্ধটা পাকা করেছিলেন রামজি সকপাল, অর্থাৎ ভীমরাওয়ের বাবা। কোঙ্কণ অঞ্চলের ভানন্দগাঁওয়ের একটি হতদরিদ্র পরিবারে বড়ো হন রামি, মালবাহী মুটের কাজ করতেন তাঁর বাবা। দিনকতকের তফাতে একে একে মা-বাবা দুজনেই চলে গেলে ছোটো ভাই আর বোনের হাত ধরে মুম্বইয়ের এক কাকার বাড়িতে এসে ওঠেন। বাইকুল্লা সবজি-পট্টির কাছেই একটি চওলে থাকতেন সেই কাকাবাবু। রামির সঙ্গে তাঁর পথ চলাটা এখানেই শুরু করেছিলেন বাবাসাহেব, তবে বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান সবই হয়েছিল রাত নামার পর। কারণ দিনের বেলা বাজারের হই-হট্টগোল আর বিকিকিনির মাঝে ওসবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
শাদির পর রামির নাম পাল্টে রমাবাই রাখা হয়, আদর করে 'রামু' বলে ডাকতেন ভীমরাও। তবে স্ত্রীর কাছে স্বামী বরাবরই ছিলেন 'সাহেব', আক্ষরিক অর্থে যেটা কিনা 'স্যার'। এভাবেই বাবাসাহেবের প্রতি তাঁর প্রণয়, শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা ফুটিয়ে তুলতেন রমাবাই। পড়াশোনার জন্য স্বামী বিলেত গেলে ছোটোবেলায় কাটানো সেই হাড়ভাঙা খাটুনির দিনগুলো ফেরত আসে রমাবাইয়ের। একে একে পাঁচটি সন্তানের জন্ম হয়, তবে শৈশবেই প্রাণ হারায় চারজন। বাবাসাহেবের অবর্তমানে সন্তান হারানোর জ্বালা যন্ত্রণা একাই সয়েছিলেন রামি।
মেয়ে রঙ্গু পোটভরের সঙ্গে এখানে ২২টি ওভি গেয়েছেন বীড জেলার মাজালগাঁও তালুকের ভীমনগর জনপদ-নিবাসী পার্বতী ভাদার্গে, শুরুতেই উঠে এসেছে অপূর্ব এক আবেগ: "গলাখানি তোর বধুঁ সুরখানি মোর, মিলেমিশে পাইব যে দোহার সাগর... গঙ্গা যমুনা যেন একদেহে বয়, মাঝনদী জানে শুধু ওভি কারে কয়।" রমাবাইয়ের সঙ্গে তাঁর অতিথি হয়ে আসছেন খোদ ভীমরাও, সযত্নে পুরনপোলি বানাতে বানাতে একথা পড়শিকে না বলে থাকতে পারছেন না কথক।
সগর্বে রামজির আস্তাবলে থাকা ঘোড়াগুলির কথা জানাচ্ছেন গায়কদ্বয়, বিশেষ করে এক-হাজারী সেই ঘোটকীর কথা, পিঠে যার তিনশো টাকা দামের জিন পেতে চড়ে বসেন ভীমরাও। কথক জানাচ্ছেন, পথের পরে বারবার দাঁড়াতে দাঁড়াতে শেষে ভীমের দালানে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসছেন মা লক্ষ্মী। বাস্তবে কিন্তু সুখ বা সমৃদ্ধি কোনটারই মুখদর্শন করেনি সকপাল পরিবার। রামজি সকপাল ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন সুবেদার, মুম্বইয়ের লোয়ার পারেল মহল্লার দাবাদ চওলে থাকতেন সপরিবারে। গীতিকারের চোখে ভীম যেন প্রষ্ফুটিত গোলাপ, তাঁর বোধিচিত্তে ভেসে আসছে রামজির বাড়িতে হওয়া বিবাহানুষ্ঠানের খণ্ডচিত্র, প্রচলিত কায়দায় যেখানে মাথায় বাশিঙ্গা (একপ্রকারের অলঙ্কার) পরে আছেন রমাবাই ও ভীমরাও।
যৌবনের ১২টি বছর তাঁর বয়ে গেছে জাঁতাকলের স্রোতে, অন্য একখান ওভি সাজিয়ে একথাটা জানাচ্ছেন গায়ক। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে ঘামে। রমাবাই বা রমাই তাঁর আপন মা, আর ছোটোবেলায় সে মায়ের হাতে আফিম মেশানো জায়ফল না খেলে আজ এমন নিরন্তর ভাবে জাঁতা টানতে পারতেন না তিনি।
ভীমরাও প্রবাসে থাকাকালীন ত্যাগ ও স্বাভিমানের হাতে তাঁর জীবনখানি সঁপে দিয়েছিলেন রমাবাই, এই কারণেই রমাই বা "মা রমাবাই" বলে ডাকা হয় তাঁকে। শত অনটন সহ্য করেছেন, তবু একটিবারের জন্যও বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাঙ্খীদের কাছে হাত পাতেননি। মাঝে দিনকতক এক সখীর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন রমাবাই, বাচ্চাদের জন্য আবাসিক একটি স্কুল চালাত ওই পরিবারটি। রমাবাইয়ের নজরে আসে, সরকার থেকে তাদের খাবারদাবার কিসুই সরবরাহ না করার ফলে বেশ কয়েকদিন ধরে পেটে কিল মেরেই পড়ে আছে পড়ুয়ারা। এটা সইতে না পেরে নিজের গয়নাগাঁটি যা ছিল সব দান করে দেন রমাবাই, বলেন যে বিক্রিবাটা বা বন্ধক যাহোক একটা কিছু করে দানাপানির বন্দোবস্ত করতে। স্নেহ ও কৃতজ্ঞতায় ভরা 'রমা আই' বা 'রমাই' নামটা সেই বাচ্চাদেরই দেওয়া। মমতায় লালিত এ নামটি আজ অবধি মুখে মুখে ফিরছে।
আরেকটি দোহায় নবজাতক ভীমের কথা কল্পনা করছেন কথক। খুশির বাঁধ ভেঙেছে তাঁর, দেশের বাড়িতে গিয়ে নিজের হাতে দোলাবেন শিশু-ভীমের দোলনা। অন্য একটি ওভিতে ভীম তাঁর সহোদর ভাই, আর রমাবাই সেই আদরের বৌদি যাঁর উপস্থিতি হাজার একটা মুশকিল আসান হয়ে দেয় তাঁর মা-বাবার বাড়িতে।
এই কিস্তিটির সর্বশেষ দোহায় অতিথিরা ভিড় করে এসেছেন কথকের গৃহে, সশরীরে হাজির আছেন স্বয়ং বাবাসাহেবও। খুশির বান ডেকেছে গায়কের প্রাণে, সদর্পে তাই "জয় ভীম!" রবে স্বাগত জানাচ্ছেন তিনি।
গলাখানি তোর বধুঁ
সুরখানি মোর, মিলেমিশে পাইব যে দোহার সাগর...
গঙ্গা যমুনা যেন
একদেহে বয়, মাঝনদী জানে শুধু ওভি কারে কয়।
আইল কুটুম আমার দোরে,
পড়শি শুধাই ওই, "কোত্থেকে সব আইল রে ভাই, বল দেখি তুই সই?'
চৌকাঠে মোর ভীমবাবা
তার এক্কাগাড়ির সারি, এপার ওপার সড়ক জোড়া কইতে তোমায় নারি।
ঝটসে বেলি পুরনপোলি,
আইছে রমাবাই,
আর এসেছে ভীমবাবা মোর
পুণ্যি আঙিনায়।
গোলচে মোমের দাগে
সোহাগে কুঙ্কু লাগে, সুখবতী সুন্দরী ওগো রমাবাই,
এমন অবাক দিনে বসিয়া
এরোপ্লেনে ভীমবাবা ডাকে তারে, "আয় রমা আয়।"
ঘোড়ার পিঠে চাপল ক’জন? বল রে কাকি বল।
ন্যাংটা পায়েই হাঁটছে কারা, বাইন্ধা সদলবদল?
বাপটি আমার রামজি সেতো
মহৌ গাঁয়ের ধারে, বৌমাকে তাই দেখতে গেল রাতবিরেতের পরে।
ঘোড়ার পিঠে চাপল ছ’জন, শোন্ রে মাসি
শোন্। ন্যাংটা পায়েই হাঁটছে কারা, চোখ খুলে তাই গোন,
বাপটি আমার রামজি সেতো
মাহাড় গাঁয়ের তলে, বৌমাকে তাই দেখতে গেল কালকে সদলবলে।
ঘোড়া চেপে কেবা যায়,
'রাম, রাম' মুখে তাই, নামধাম কীবা তাঁর বল দেখি সই?
বাবা আম্বেদকর,
লক্ষ্মী রমার বর, এসেছে স্বজন বড় দেখ দেখি ওই।
আইল রে বর, বাজল
সানাই, বাশিঙ্গা তার চাপল মাথায়, আসলি সোনার পান
ভীম ভীম তার বাপের ঘরে,
আজকে রে সই বিয়ার তরে, বাঁধল বাসরখান।
লক্ষ্মী আইল ঘরে
থমকিয়ে বারে বারে, পথকে দাঁড়ায়ে রহে এধার ওধার,
বারে বারে পুছিবারে,
থমকে দাঁড়ায়ে পড়ে, ভীমের দালান কোথা জিজ্ঞাসা তার।
হায় লো সখী
সিঁদুরখানি চৌকাঠে তোর দে
লক্ষ্মী মাগো মিষ্টি
রমা, নেই যে বাড়িতে।
ডাক দেখি সোহাগীরে, না
জানি ক’দিন পরে মাইল মাইল
হেঁটে আইল কুটুম
লণ্ঠন বাগিয়ে, খোঁজ দেখি
আগিয়ে, রানি সে ভীমের কোথা? পড়ে
গেছে ধুম।
বুঝলি রে সই গাঁয়ের
পারে, টইটুম্বুর হাটবাজারে, হাজার হাজার দুর্গ হতে আইল সেপাই কত
ভীমরায়েরে চিনতে
নারি, অঙ্গে তাহার ঝিলকি জরি, শাল-দোশালায় ঢাকল দেহ বুদ্ধবাবার মতো।
ভীমের খাটের কোনে, একা
একা দিন গোনে, দোয়াত কলম আর জেদখানি তাঁর
হইয়া বেজায় খুশি,
শুধাইল মীরাপিসি, "বল কত জয় করা বাকি আছে আর?"
ঘড়ঘড়াঘড় ছুটছে
জাঁতা, আপসে হলেম বুড়ি, উড়কি আটায় ভরছে লো সই সাত সোহাগীর ঝুড়ি,
মহৌ গাঁয়ের সেই যে
খুদে আম্বেদকর বাবা, আজকে লো সই বসাইছে ওই দিল্লিতে তাঁর থাবা।
হাজার টাকার ঘোটকী
তাহার বড্ড দেমাক হায়, তেষ্টা পেলেও নদীর জলে নামতে নাহি চায়,
তাহার তরে পুকুর
খুঁড়ে রামজি ঢালে জল, এমন মিঠা সোয়াদ রে সই পাইব কোথা বল?
হাজার টাকার ঘোটকী
তাহার তিনশো টাকার জিন,
আইলো রে বাপ, য্যামনে
গোলাপ, উঠল বসে ভীম।
শোন শোন যদি আজও
জাঁতাখানা টানি, কব্জিতে জোর পাব এই কথা জানি,
আফিমে মিশায়ে কতি
জায়ফল গুঁড়ি, আমারে খাইয়েছিল মাতা রমাবুড়ি।
উঠানে জীবন পাতা,
টানিতে টানিতে জাঁতা, চুপচুপে হয়ে সখী ঘেমে যাবি পুরো,
বারোটা বছর মোর,
জাঁতাকলে দিনু গোর, যৌবনও হয়ে গেছে একইসাথে গুঁড়ো।
যাইলে রে সই বাপের
বাড়ি, কথায় তারে ধরতে নারি হইব এমন খুশি,
ভীমরাজা মোর প্রাণের
সখা, তার তরে এই জীবন রাখা, বোস না হেথায় মাসি।
যাইলে রে সই মায়ের
বাড়ি, হায় রে আরাম করতে নারি, দুঃখ এটাই মোর,
ছোট্ট ভীমের
দোলনাখানি, সামনে রাখা আমার জানি, দোলাই যতন ভোর।
দেশগাঁয়ে সই যাইব
এবার, রইছে যেথায় আম্মা আমার, ধান গুঁড়িয়ে দিন ফুরিয়ে বানাইব সই পিঠে,
প্রাণপ্রিয় ওই সোঁদর
রমা, বৌদি সে মোর জানিস রে মা? দুখের দিন হাত বাড়ানোর স্বভাবটি তাঁর মিঠে।
আসিছে অতিথি কত, সহস্র
শত শত, হিথাহুথা বসে আছে ঠাঁই নাহি পাই,
ভীমবাবা এসো মোর, জয়
ভীমে হল ভোর, "ভীম! ভীম!" জয়নাদে দেশগাঁ কাঁপাই।
পরিবেশক/গায়িকা : পার্বতী ভাদার্গে (মা), রঙ্গু পোটভরে (মেয়ে)
গ্রাম : মাজালগাঁও
জনপদ : ভীম নগর
তালুক : মাজালগাঁও
জেলা : বীড
জাতি : নববৌদ্ধ
পেশা : একাধারে চাষি ও খেতমজুর ছিলেন পার্বতী ভাদার্গে। নিজেদের জমিতে কয়েক বছর চাষ করেছিলেন রঙ্গু পোটভরে
পোস্টার: উর্জা
অমূল্য সহায়তা প্রদানের জন্য মাজালগাঁও নিবাসী রাজরত্ন সালভে ও বিনয় পোটভরের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
হেমা রাইরকার ও গি পইটভাঁর হাতে তৈরি জাঁতা পেষাইয়ের গানের আদি
প্রকল্পটির কথা
পড়ুন
।
অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)