“মেয়ে হয়েছে,” ডাক্তার ঘোষণা করলেন।
আশার এটি চতুর্থ সন্তান – তবে শেষ সন্তান নয় অবশ্যই। তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন গাইনেকোলজিস্ট তাঁর মা কান্তাবেনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, “মা, আপনি কাঁদবেন না। দরকার হলে আমি আরও আটটা সিজেরিয়ান করব। কিন্তু যতক্ষণ না ওর ছেলে হচ্ছে আমি আছি। ওর দায়িত্ব আমার।”
আশার আগের তিন সন্তানই মেয়ে। সিজারিয়ান অপারেশান করেই তারা জন্মেছে প্রত্যেকে এবং এখন আহমেদাবাদ শহরের মনিনগর অঞ্চলে একটা বেসরকারি ক্লিনিকে তিনি শুনছিলেন ডাক্তার ঘোষণা করছেন ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষার ফলাফল। (এই ধরনের পরীক্ষা বেআইনি হলেও সর্বত্রই করানো যায়)। চার বছরে এটা তাঁর চতুর্থ প্রেগন্যান্সি। তিনি এখানে এসেছিলেন নিজের মায়ের সঙ্গে, ৪০ কিলোমিটার দূরে খানপার গ্রাম থেকে। মা-মেয়ে দুজনের অবস্থাই সান্ত্বনার অতীত। তাঁরা জানতেন, আশার শ্বশুর কখনই গর্ভপাতে রাজি হবেন না। “আমাদের ধর্মে এটা নিষিদ্ধ,” বললেন কান্তাবেন।
ঘুরিয়ে বললে মোদ্দা কথা যেটা দাঁড়ায়, তা হল এটাই আশার শেষ প্রেগন্যান্সি নয়।
আশা এবং কান্তাবেন ভারওয়াড় রাখালিয়া যাযাবর জনগোষ্ঠীর সদস্য। সাধারণত ভেড়া এবং ছাগল প্রতিপালন করে এই গোষ্ঠী। কিন্তু আমেদাবাদের ঢোলকা তালুকের অন্তর্গত খানপার গ্রামে ১৫০০-এরও কম জনসংখ্যার (২০১১ জনগণনা) ২৭১টি পরিবার স্বল্পসংখ্যক গরু এবং মোষ প্রতিপালন করে। প্রথাগত সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে মেষপালক জাতের মধ্যে এই গোষ্ঠীর স্থান সবথেকে নিচে। গুজারাতে ভারওয়াড়রা তফশিলি জনজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত।
*****
খানপারের যে ছোটো ঘরে আমরা অপেক্ষা করছি, সেখানে ঢোকার সময় মাথা থেকে আঁচল সরিয়ে নেন কান্তাবেন। এখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এই গ্রাম এবং নিকটবর্তী গ্রামের কয়েকজন মহিলা। তাঁরা কথা বলবেন প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে – কথোপকথনের বিষয়টা মোটেও সহজ নয়।
“এই গ্রামে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে ৮০ থেকে ৯০টা ভারওয়াড় পরিবার আছে,” বললেন কান্তাবেন। “হরিজন [দলিত] আছে, ভাগ্রি, এমনকি ঠাকোরও, আর কয়েক ঘর কুম্ভার [কুমোর]। কিন্তু ভারওয়াড়রাই সংখ্যায় বেশি।” কোলি ঠাকোর হল গুজারাতের একটি বৃহৎ জাত – অন্য রাজ্যের ঠাকুরদের সঙ্গে গোলালে চলবে না।
“আমাদের মেয়েদের বিয়ে আগেই হয়ে যায়, কিন্তু ১৬ বা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যতদিন না তারা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত হচ্ছে, ততদিন তারা বাপের বাড়িতেই থাকে,” বুঝিয়ে বললেন কান্তাবেন। পঞ্চাশের কোঠায় তাঁর বয়স। তাঁর মেয়ে আশারও অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে গেছিল। চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যেই তিন সন্তানও হয়ে যায়। এখন আবার চতুর্থবারের জন্য সন্তানসম্ভবা। বাল্যবিবাহই নিয়ম। এখানে বেশিরভাগ মহিলাই নিজের বয়স ঠিক করে জানেন না, জানেন না কোন বয়সে বিয়ে হয়েছিল কিংবা প্রথম সন্তান কবে জন্মেছিল।
কান্তাবেন বলছিলেন, “আমার কবে বিয়ে হয়েছিল আমার মনে নেই, তবে এটা বেশ মনে আছে যে প্রায় প্রতিবছরই আমার গর্ভ হত।” তাঁর আধার কার্ডে লেখা তারিখ তাঁর স্মৃতির চেয়ে বেশি ভরসাযোগ্য নয়।
“আমার নয় মেয়ে, আর এই দশ নম্বর – ছেলে,” বললেন হীরাবেন ভারওয়াড়, সেদিন জড়ো হওয়া মহিলাদের একজন। “আমার ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। আমার মেয়েদের মধ্যে ছয় জনের বিয়ে হয়ে গেছে, দুজনের বাকি আছে। আমরা জোড়ায় জোড়ায় ওদের বিয়ে দিয়েছি।” এই তালুকের খানপার এবং অন্যান্য গ্রামে বারবার এবং লাগাতার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া বেশ প্রচলিত ব্যাপার। “আমাদের গ্রামে এক মহিলার ১৩ বার গর্ভে সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অবশেষে এক ছেলে জন্মায়,” বললেন হীরাবেন। “একেবারে পাগলামি। যতক্ষণ না ছেলে হচ্ছে ততক্ষণ গর্ভধারণ করে যেতে হয়। এরা কিচ্ছু বোঝে না। এদের শুধু ছেলে চাই। আমার শাশুড়ির [শেষের দিকে] ৮টি সন্তান জন্মেছিল। আমার কাকিমার ১৬টা। কী বলবেন আপনি?”
“শ্বশুরবাড়িতে ছেলে চায়,” সংযোজন রমিলা ভারওয়াড়ের, চল্লিশের কোঠায় বয়স তাঁর। “আর আপনি যদি সায় না দেন, তাহলে আপনার শাশুড়ি থেকে শুরু করে ননদ, পড়শি সবাই আপনাকে গালমন্দ করবে। এখনকার দিনে বাচ্চা মানুষ করা সহজ কাজ নয়। আমার বড়ো ছেলে দুবার ক্লাস টেনের পরীক্ষায় ফেল করেছে। এই নিয়ে তিনবার পরীক্ষা দিচ্ছে। শুধু আমরা মহিলারাই বুঝতে পারি এই বাচ্চাদের মানুষ করার ঝক্কি। কিন্তু আমরা কীই বা করতে পারি বলুন?”
ছেলে সন্তান জন্মানোর বিষয়ে এই পক্ষপাতকে ঘিরে পরিবারের নানান সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয় এবং শেষ অবধি মহিলাদের হাতে প্রজনন-সংক্রান্ত কোনও বিকল্পই থাকে না। “ভগবান যখন ছেলের জন্য আমাদের অপেক্ষা করাচ্ছেন তখন কী করা যেতে পারে?” প্রশ্ন রমিলার। “আমারও ছেলে হওয়ার আগে তিনটি মেয়ে হয়েছিল। আগে আমরা সবাই ছেলে হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম, এখন হয়তো অবস্থা খানিক পাল্টেছে।”
“কী পাল্টেছে? আমার চারটে মেয়ে হয়নি?” বিরক্তির সঙ্গে বললেন রেখাবেন। তিনি থাকেন পাশের গ্রাম লানায় – জনসংখ্যা ১৫২২। আমরা যে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তাঁরা এই তালুকের খানপুর, লানা, আম্বালিয়ারা গ্রামের ছোটো ছোটো জনপদ থেকে এসেছেন – এগুলি আমেদাবাদ শহরের ৫০ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে। এবং ইতিমধ্যে তাঁরা শুধু এই সাংবাদিকের সঙ্গেই নয়, নিজেদের মধ্যেও বেশ উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন। পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে – রমিলার এই বক্তব্যকে প্রশ্ন করলেন রেখাবেন: “আমিও তো ছেলের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, করিনি?” তিনি প্রশ্ন করলেন। “আমরা ভারওয়াড়, আমাদের তো ছেলে হতেই হবে। শুধু মেয়ে হলে আমাদের বাঁজা বলবে।”
এই গোষ্ঠীর চাহিদা সম্পর্কে রমিলাবেনের যতই খোলামেলা সমালোচনা থাক না কেন, বেশিরভাগ মহিলা নিজেই জানালেন যে ‘ছেলে সন্তানই পছন্দ’ তাঁদের – এর পিছনে রয়েছে সামাজিক চাপ এবং সাংস্কৃতিক প্রথা। ইন্টারন্যাশানাল জার্নাল অফ্ হেলথ সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী আমেদাবাদ জেলার গ্রামীণ অঞ্চলের ৮৪ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁরা ছেলে চান। এই গবেষণাপত্রটি জানাচ্ছে যে মহিলাদের মধ্যে এই পছন্দের কারণ হল পুরুষরা: “বেশি টাকা উপার্জনে সক্ষম, বিশেষ করে কৃষি-প্রধান অর্থনীতিতে; তারা বংশ জিইয়ে রাখে; আর তারাই সাধারণত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।”
অন্যদিকে, এই গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে যে মেয়েরা বহুক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বোঝা হিসেবে পরিগণিত হয়। এর কারণ: “পণপ্রথা; বিয়ের পর তারা সাধারণত স্বামীর পরিবারের সদস্য হয়ে যায়; এবং [সেই সঙ্গে] নিজের মা-বাবা বৃদ্ধ বা অসুস্থ হলে তাদের আর কোনও দায়দায়িত্ব থাকে না।”
*****
কাছেই আম্বালিয়ারা গ্রামের জনসংখ্যা ৩৫৬৭। এই গ্রামের বাসিন্দা জীলুবেন ভারওয়াড়ের বয়স তিরিশ। তাঁর ধারণা ঢোলকা তালুকার কোঠ (কোঠা নামেও পরিচিত) গ্রামের কাছে একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁর টিউবাল লাইগেশান করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তবে চার সন্তান জন্মানোর পরেই কিন্তু এই বন্ধ্যাত্বকরণ অপারেশনটি করা হয়। তিনি বললেন, “দুই ছেলে হওয়া অবধি আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিয়ের সময় আমার বয়স ৭ কিংবা ৮ ছিল। তারপর বড়ো হলে আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয়। তখন হয়তো আমার বয়স ১৯ হবে। বিয়ের পোশাক গা থেকে খুলতে না খুলতেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলাম। তারপর থেকে প্রায় একবছর অন্তর চলতে থাকল।”
ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল অথবা ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস (কপার-টি) – দুইয়ের ব্যাপারেই সংশয় ছিল তাঁর। “আমি এসব ব্যাপারে তখন খুব অল্পই জানতাম। যদি আরেকটু জানা থাকত, তাহলে হয়তো এত ছেলেমেয়ে হত না,” কথাটা নিজের মনেই যেন বলছিলেন তিনি। “কিন্তু ভারওয়াড়দের মধ্যে মাতাজি (মেলাদি মা, এই গোষ্ঠীর কূলদেবী) যা দিচ্ছেন তাই মেনে নিতে হয়। আমি আরেকবার সন্তানধারণ না করলে সেই নিয়ে কথা উঠত। লোকে ভাবত আমি হয়তো অন্য পুরুষ চাই। সেসবের মুখোমুখি হতাম কেমন ভাবে?”
জীলুবেনের প্রথম সন্তান ছেলে। কিন্তু পরিবারের দাবি ছিল আরেকটি সন্তান হোক। এবং দ্বিতীয় ছেলের অপেক্ষা করতে গিয়ে পরপর দুইবার মেয়ে জন্মায়। একটি মেয়ে শ্রবণ তথা বাকশক্তি রহিত। জীলুবেনের কথায়, “আমাদের ভারওয়াড় সমাজে দুই ছেলে দরকার। আজকাল অনেক মহিলা ভাবে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হওয়াই যথেষ্ট, কিন্তু আমরা মাতাজীর আশীর্বাদের আশায় থাকি।”
দ্বিতীয় ছেলে জন্মানোর পর, অপেক্ষাকৃত বেশি সচেতন মহিলাদের পরামর্শে, জীলুবেন শেষ অবধি সিদ্ধান্ত নেন যে কোঠে গিয়ে টিউবেকটমি করাবেন, সঙ্গে যাবেন তাঁর ননদ। তিনি বলছিলেন, “আমার স্বামীও আমাকে বলেছিলেন এটা করিয়ে নিতে। তিনিও জানতেন কতটা রোজগারপাতি করতে পারবেন তিনি। আমাদের তো কোনও ভদ্রস্থ কাজকর্মের সুযোগও নেই। পশুপালনই আমাদের একমাত্র কাজ।”
সৌরাষ্ট্র বা কচ্ছ এলাকার এই ভারওয়াড় মেষপালক গোষ্ঠীটির থেকে বেশ আলাদা ঢোলকা তালুকের গোষ্ঠীটি। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির বিরাট বিরাট ভেড়া আর ছাগলের পাল থাকতে পারে, কিন্তু ঢোলকার ভারওয়াড়দের শুধু কিছু গরু আর মোষই সম্বল। আম্বালিয়ারার জয়াবেন জানাচ্ছেন, “এখানে পরিবার পিছু ২–৪টে করে পশু আছে। তাতে নিজেদের ঘরের প্রয়োজনই ঠিকমতো মেটে না, এর থেকে কোনও উপার্জন তো দূর অস্ত। জাবের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করি। মাঝেসাঝে লোকে আমাদের মরশুমি ধান দেয় – নইলে সেটাও আমাদের কিনতে হয়।”
"এই অঞ্চলের পুরুষরা মূলত অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে পরিবহণ, নির্মাণ, এবং কৃষি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেন,” বললেন ভাবনা রাবারি, মালধারি সংগঠনের আহমেদাবাদ-নিবাসী সভাপতি। গুজারাতের ভারওয়াড় সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এই সংগঠন। “কাজ পেলে তাঁরা দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা উপার্জন করেন।”
জয়াবেনও বলছেন যে পুরুষরা “মজুরের কাজ করতে যায়। আমার বর সিমেন্টের বস্তা তোলার কাজ করে দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা পায়।” তিনি ভাগ্যবান যে কাছে একটা সিমেন্টের কারখানা আছে যেখানে বেশিরভাগ দিন কাজ জুটে যায়। বহু পরিবারের মতো, তাঁদেরও বিপিএল (দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী) রেশন কার্ড নেই।
দুই ছেলে এবং এক মেয়ে জন্মানোর পরেও গর্ভনিরোধক বড়ি অথবা কপার-টির মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা করতে ভয় পান জয়াবেন। চিরস্থায়ী কোনও অস্ত্রোপচারও তিনি করাতে চান না। “আমার সব সন্তান বাড়িতেই জন্মেছে। ওদের ওইসব যন্ত্রপাতি দেখে আমি ভয় পাই। অপারেশানের পর ঠাকোরের বউকে কষ্ট পেতে দেখেছি আমি।”
“শেষে আমি ঠিক করি যে আমাদের মেলাদি মাকেই জিজ্ঞেস করব। তাঁর অনুমতি ছাড়া আমি অপারেশান করাতে পারব না। একটা ফলন্ত গাছকে কেটে ফেলার অনুমতি মাতাজী আমাকে দেবেন কেন? কিন্তু আজকাল সবকিছুর খুব দাম। এতগুলো মুখে খাবার জোটাব কোথা থেকে? তাই আমি মাতাজীকে বললাম যে আমার সন্তান তো যথেষ্টই আছে কিন্তু অপারেশানে আমার খুব ভয়। একটা মানত করেছিলাম আমি। দশ বছর ধরে মাতাজী আমার খেয়াল রেখেছেন, তবেই না একটাও ওষুধ খেতে হয়নি।”
*****
তাঁর স্বামীর যে ভ্যাসেকটমি (পুরুষদের বন্ধ্যাত্বকরণ) হতে পারে এটা শুনে আশ্চর্য হলেন জয়াবেনসহ ওখানে আগত মহিলাদের প্রত্যেকেই।
তাঁদের প্রতিক্রিয়া আদতে জাতীয় স্তরে পুরুষদের বন্ধ্যাত্বকরণের ঘিরে নেতিবাচক মনোভাবেরই প্রতিফলক। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭–১৮ সালে সারা ভারতে “১৪,৭৩,৪১৮টি স্টেরিলাইজেশানের মধ্যে মাত্র ৬.৮ শতাংশ ছিল পুরুষদের, এবং ৯৩.১ শতাংশ মহিলাদের।
পঞ্চাশ বছর আগে সামগ্রিকভাবে স্টেরিলাইজেশানের ক্ষেত্রে ভ্যাসেকটমির প্রচলন এবং গ্রহণযোগ্যতা আজকের তুলনায় বেশি ছিল। সাতের দশকের শেষের দিকে এটা ভীষণভাবে কমতে শুরু করে, বিশেষ করে ১৯৭৫-৭৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে কুখ্যাত বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণের পরে। ১৯৭০ সালে ৭৪.২ শতাংশ থেকে এটা কমে ১৯৯২ সালে এসে দাঁড়ায় ৪.২ শতাংশে – জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যুলেটিনে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র ।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার পরিকল্পনা এখনও মহিলাদেরই দায়িত্ব বলে বিবেচিত হয়।
এই মহিলাদের দলে একমাত্র জীলুবেনই টিউবেকটমি করিয়েছেন। তিনি বলছেন যে অপারেশানের আগে “আমার স্বামীকে কিছু ব্যবহার করতে বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। আমি জানতামই না যে তিনিও অপারেশান করাতে পারেন। যাই হোক, আমরা এই বিষয়ে কোনওদিনই কথা বলিনি।” অবশ্য তিনি জানালেন যে কখনও কখনও তাঁর স্বামী নিজেই তাঁকে ঢোলকা থেকে জরুরি প্রয়োজনে এমারজেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল এনে দিয়েছেন। “৫০০ টাকায় তিনটে।” এটা তাঁর টিউবেকটমির হওয়ার আগের কথা।
এই রাজ্যের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফ্যাক্ট শীট জানাচ্ছে (২০১৫–২০১৬) গ্রামীণ গুজারাতের যাবতীয় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারী মোট মানুষের মধ্যে পুরুষদের বন্ধ্যাত্বকরণের হার মাত্র ০.২ শতাংশ। পরিবার পরিকল্পনার নানান উপায় গ্রহণ করার বোঝা মহিলাদেরই বইতে হয়েছে, মহিলাদের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগুলির মধ্যে রয়েছে স্টেরিলাইজেশান, ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস এবং ওষুধ।
ঢোলকার ভারওয়াড় মহিলাদের কাছে টিউবেকটমি হল সমাজের পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ভয়কে জয় করারও এক পথ।
“আশা [অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট] কর্মীরা আমাদের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়,” বললেন কনকবেন ভারওয়াড়, কনকবেনের ছেলের বউয়ের বয়স বিশের কোঠায়। তাঁর কথায়, “আমরা সবাই কিন্তু ভয় পাই।” তিনি শুনেছেন, “একটা অপারেশানের কথা যেখানে এক মহিলা স্পটেই মারা গেছিল। ডাক্তার ভুল করে অন্য টিউব কেটে দিয়েছিল, আর সে অপারেশান টেবিলেই মারা যায়। সেই ঘটনার পর এখন এক বছরও পার করেনি।”
গর্ভধারণের ব্যাপারটাও কিন্তু ঢোলকাতে কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ‘সামুহিক আরোগ্য কেন্দ্রের’ এক চিকিৎসক জানাচ্ছেন যে দারিদ্র এবং নিরক্ষতাজনিত কারণে এত কম ব্যবধানে এত বেশি গর্ভসঞ্চার হতে দেখা যায়। এবং “নিয়মিত চেক-আপ করাতেও কেউ আসে না”, তিনি জানালেন। যে সমস্ত মহিলারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন, তাঁদের বেশিরভাগই অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতায় ভোগেন। “এখানে যাঁরা আসেন তাঁদের মধ্যে ৯০ শতাংশের হিমোগ্লোবিন ৮ শতাংশের কম থাকে,” হিসেব করে বললেন তিনি।
তার উপর রয়েছে পরিকাঠামোর দুর্দশা এবং দক্ষ কর্মীর অভাব। কোনও সোনোগ্রাফি যন্ত্র নেই। দীর্ঘ সময় ধরে কোনও সর্বক্ষণের স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ বা অ্যাফিলিয়েটেড অ্যানাস্থিসিওলজিস্ট পাওয়া যায় না। একজন অ্যানাস্থেসিস্ট ছটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এবং ঢোলকার অজস্র বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে কাজ করেন এবং তাঁকে দেখানোর জন্য রুগীদের আবার আলাদা করে টাকা দিতে হয়।
খানপার গ্রামের সেই ঘরের কথোপকথনের মধ্যে হঠাৎ কানে আসে এক রাগত কণ্ঠস্বর। কথোপকথনের বিষয় – মেয়েদের নিজেদের শরীরের উপর তাদের নিজেদের কোনও অধিকার না থাকা। কোলে এক বছরের শিশু, এক কমবয়সী মা কিছুটা রুক্ষভাবেই প্রশ্ন তোলেন, “কে ঠিক করবে মানে? আমি ঠিক করব। আমার শরীর; অন্য কেউ ঠিক করবে কেন? আমি জানি আমি আর বাচ্চা চাই না। আর আমি ওষুধ খেতেও চাই না। আমি যদি অন্তঃসত্ত্বা হই, তাহলে সরকারের কাছে আমাদের জন্য ওষুধ আছে, তাই না? আমি সেই ওষুধ নেব [গর্ভনিরোধক ইঞ্জেকশান]। একমাত্র আমি তা ঠিক করব।”
এটা অবশ্যই এক বিরল কণ্ঠস্বর। তাছাড়া, রমিলা ভারওয়াড় একেবারে গোড়াতেই বলেছিলেন, “এখন পরিস্থিতি খানিক পাল্টেছে।” হয়তো বা একটুখানি সত্যিই বদলেছে।
গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এই নিবন্ধে সমস্ত মহিলার নাম পালটে দেওয়া হয়েছে।
সমবেদনা ট্রাস্টের জানকী ভাসান্তকে বিশেষ ধন্যবাদ তাঁর সহায়তার জন্য।
পারি এবং কাউন্টার মিডিয়া ট্রাস্টের গ্রামীণ ভারতের কিশোরী এবং তরুণীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দেশব্যাপী রিপোর্টিং প্রকল্পটি পপুলেশন ফাউন্ডেশন সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগের অংশ যার লক্ষ্য প্রান্তবাসী এই মেয়েদের এবং সাধারণ মানুষের স্বর এবং যাপিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই অত্যন্ত জরুরি বিষয়টিকে ঘিরে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।
নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করতে চাইলে [email protected] – এই ইমেল আইডিতে লিখুন এবং সঙ্গে সিসি করুন [email protected] – এই আইডিতে।
বাংলা অনুবাদ : সর্বজয়া ভট্টাচার্য