গুদালুর ব্লকের মহিলারা জানালেন যে মদ্যপান আর সরকার পরিচালিত মদের দোকান তাঁদের সংসার ভেঙে দিচ্ছে। কোনো [ভোট] প্রার্থীই এ বিষয়ে চিন্তিত না কিন্তু মহিলারা আশা করছেন আজ সেখানে ভোটের পর অবস্থাটা বদলাবে
“চায়ের দোকানের মতো ছড়িয়ে আছে মদের দোকান। আগে দোকানগুলি দূরে দূরে অবস্থিত ছিল ফলে মানুষের পক্ষে সহজে হেঁটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটা আছে সেখানেও যদি আপনি হেঁটে যেতে না পারেন অটোচালক আপনার বাড়িতে তা পৌঁছে দেবে।”
অতএব, “যে-ই সরকারে আসুক না কেন বোতলের কারণে যে সব ঘর ভেঙেছে সেগুলিতে শান্তি ফিরিয়ে আনুক”, এই অনুরোধ নিয়েই আজ কাট্টুনায়াকান আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৩২ বছর বয়সী শান্তিনী নিজের বাড়ি থেকে নির্জন কাদা-মাটির রাস্তা ধরে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে একটি সরকারি বিদ্যালয়ে লোকসভার ভোট দিতে যাবেন।
১৫-১৭ ঘরের একটি জনপদের বাসিন্দা শান্তিনী বললেন যে নির্বাচনে কারা প্রার্থী তা তিনি জানেন না। মুদুমালাই ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যের ঠিক পাশে দেভার্শোলা নগর পঞ্চায়েতের গুদালুর ব্লকে অবস্থিত তাঁর জনপদটি নীলগিরি লোকসভার অন্তর্গত। এই আসনে মোট নথিভুক্ত ভোটদাতার সংখ্যা ২০১৪-তে ছিল ১২.৭০ লাখ।
কিন্তু জয়ী প্রার্থী তাঁর জীবনের উন্নতি ঘটাতে কী করতে পারেন সে বিষয়ে শান্তিনীর স্পষ্ট ধারণা আছে। স্বল্প আয়ের আরও অনেক পরিবারের মহিলাদের মতো শান্তিনী ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সরকারি মদের দোকান দেখে ক্ষুব্ধ। স্থানীয়ভাবে যেগুলি তাসমাক — তামিলনাডু রাজ্য বিপণন নিগম - নামে চিহ্নিত, ২০০২ থেকে সেগুলির রাজ্যে খুচরো ও পাইকারি মদ বিক্রির উপর একচেটিয়া অধিকার রয়েছে।
“আমাদের স্বামীরা বেশিরভাগ, খেতমজুর, তারা তাদের দৈনিক মজুরি মদ খেয়েই উড়িয়ে দেয়। যে ২৫০ টাকা তারা পায় তা মদ খেয়ে সংসার চালাবার পক্ষে যথেষ্ট না। সেই কারণেই বাড়িতে অশান্তি হয়,” বললেন বিপন্ন গৃহকর্ত্রী শান্তিনী, যাঁর সময় কাটে তাঁর তিন সন্তানের দেখাশুনা করে, বড়োটির বয়স ১০।
“আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আগে ধান, চাল, আর ফল থেকে নিজেরাই সুরা প্রস্তুত করতেন। কিন্তু সরকার সমস্ত বেআইনি মদ প্রস্তুত একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর থেকে আদিবাসী পুরুষরা তাসমাক-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এখন তো আদিবাসী বসতির একেবারে কাছে প্রত্যন্ত জায়গায়েও তাসমাক আছে”, বললেন, চেন্নাইয়ে বসবাসকারী এবং তামিলনাড়ুতে মদ ও অন্যান্য মাদক অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫ বছর যাবৎ কর্মরত এ নারায়ণন।
তাসমাক-ওয়েবসাইট জানাচ্ছে যে এই দোকানগুলি থেকে ২০১৬-১৭-এর আর্থিক বছরে মোট রাজস্ব আয় হয় ৩১,৪১৮ কোটি টাকা। “রাজ্যের আয়ে এই অর্থ এত বড়ো যে আমার মনে হয় যে-ই ক্ষমতায় আসুক মদ বিক্রির উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা কেউই জারি করবে না। খুব জোর খচরো বিক্রয় কেন্দ্রগুলির ব্যবসার সময় কমিয়ে দিতে পারে,” মাদ্রাজ উচ্চন্যায়ালয়ের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে চন্দ্রু বললেন।
তামিলনাডুতে তাসমাকগুলি আলাদাভাবেও থাকে আবার সরকার কোনো ব্যক্তিকে নিলাম ডেকে দিয়েছে এমন কোনো পানশালার পাশেও থাকতে পারে। “বার চালাবার অনুমতি পাওয়া বেশ গোলমেলে আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ দ্বারা পরিচালিত হয়,” বললেন বিচারপতি চন্দ্রু।
“এখন অবধি মাদক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি”, নারায়ণন বললেন। “যে পরিমাণ রাজস্ব তসমাক থেকে আয় হয় তাতে মাদকের অপব্যবহারের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্ন যুক্ত জেনেও সরকারের পক্ষে একে বন্ধ করা সম্ভব না।”
২০১৯-২০২০-এর বাজেট অনুসারে তামিলনাড়ুতে এখন ৫,১৯৮টি তসমাক আছে। যদিও আগের ৭,৮৯৬টি আইএফএমএল — ভারতে প্রস্তুত বিদেশী সুরা— খুচরো বিক্রয়কারি তসমাক-এর তুলনায় তা কম এবং যদিও সরকারের দাবি রাজ্যের মাদক সমস্যা খর্ব করার লক্ষ্যেই এই সংখ্যা কমানো হয়েছে বিচারপতি চন্দ্রু অবশ্য অন্য কারণ উল্লেখ করলেন। তার মধ্যে একটি হল ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের ২০১৭-এর একটি নির্দেশ যা রাজ্য বা জাতীয় সড়কের ৫০০ মিটার-এর মধ্যে পানশালা স্থাপন নিষিদ্ধ করেছে। “রাজ্য সরকার অবশ্য এই নির্দেশ এড়াতে কিছু সড়কের নাম বদলে দিয়েছে”, বললেন এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। “সুতরাং বাস্তবে সংখ্যা কমেছে মাত্র ১০ শতাংশ কারণ আইনের ফাঁক গলে কিছু আবার খুলে গেছে।”
শান্তিনীদের মতো গ্রামবাসীদের কাছে মাদকের অপব্যবহারের মতো জরুরি বিষয় লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। নীলগিরি থেকে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম (ডিএমকে) দলের প্রার্থী টু-জি স্পেক্ট্রাম মামলায় অভিযুক্ত ও পরে মুক্ত, পূর্বতন টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী এ রাজা। সর্বভারতীয় দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম-এর (এআইডিএমকে) প্রার্থী এম ত্যাগরাজন। অশোক কুমার আবার বহুজন সমাজ পার্টির প্রার্থী।
সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায় যে আরও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির সঙ্গে ডিএমকে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবার পিছু একজন মহিলাকে ব্যবসা শুরু করার জন্য ৫০,০০০ করে টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছে; তাছাড়া, ৫০ লাখ মানুষকে বেসরাকারি প্রতিষ্ঠানে ১০,০০০ টাকা মাসিক বেতনে চাকুরি; এবং এমজিএনরেগা প্রকল্পে কাজের দিন বাড়িয়ে ১৫০ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
খবরে প্রকাশ, এআইডিএমকে দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প চালু করে, দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ, অসহায় মহিলা, কর্মহীন বিধবা, ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক, গ্রাম ও নগরের কায়িক শ্রমিক ও অসহায় বয়জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সরাসরি মাসিক ১,৫০০ টাকা করে দেবে বলেছে।
“লোকসভা ভোটের দুই প্রার্থী বা ২২ টি বিধানসভা কেন্দ্রের (নীলগিরির নয়) উপনির্বাচনের প্রার্থীদের মাদক নিবারণ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। নির্বাচনে বস্তুত এটি একটি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। নির্বাচিত হওয়ার পর এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো এ বিষয়ে কখনো জনসমক্ষে কখনো আইনসভা কক্ষে কথা তুলবেন,” বললেন বিচারপতি চন্দ্রু।
কিন্তু মাদক-অপব্যবহারে যাঁরা পর্যুদস্ত তাঁরা প্রতিদিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। “খাবার কেনার যথেষ্ট অর্থ নেই, আমাদের বাচ্চারা ঘন ঘন অসুস্থ হয়, তাদের চিকিৎসা করাবার উপায় নেই কারণ কে দেবে সেই অর্থ?” বললেন অসহায় শান্তিনী।
শান্তিনীদের মতো গ্রামবাসীদের পর্যুদস্ত করে দেওয়া মাদক অপব্যবহারের মতো জরুরি বিষয় লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক
তাঁর গ্রাম থেকে ১৫ কিমি দূরে গুদালুর শহরে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত অশ্বিনী স্বাস্থ্যকেন্দ্র আদিবাসীদের ভরতুকিতে চিকিৎসা পরিষেবা দেয়। এর প্রতিষ্ঠাতা, ডঃ শৈলজা দেবী শান্তিনীরর কথা সমর্থন করে বললেন —“অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বিগত কয়েক বছরে লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।” প্রতি তিনজনে একজন মহিলা পরিবারে মাদকের অতিব্যবহারের জন্য মানসিক অবসাদ ও মানসিক চাপের সমস্যা নিয়ে আসেন। এমন ঘটনায় বৃদ্ধি হওয়ায় হাসপাতালটি আদিবাসীদের মধ্যে বাবার মদ্যপান, মায়ের মানসিক অবসাদ ও শিশুদের অপুষ্টির মধ্যে আন্তর্সম্পর্ক নিয়ে একটি সমীক্ষা করতে উৎসাহী হয়েছে। কিছু মহিলাও মদ্যপান করেন কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই কম, জানালেন ডঃ দেবী।
“সর্বত্র তসমাক গজিয়ে উঠছে। কিছু প্রতিরোধ এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল কিন্তু শত্রুপক্ষ আমাদের চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী,” তিনি বললেন।
তাঁদের দুইঘরের বাড়ির দাওয়ায় শান্তিনীর পাশে বসে তাঁর মাসি কুল্লি জানালেন, “তসমাক আছে এমন অঞ্চলে মেয়েরা শান্তিতে চলাফেরা করতে পারে না। বাচ্চারাও পারে না। তাদেরও পিছনে লাগে, কটুক্তি করে।” সরকার যদি আদিবাসী মহিলাদের জীবনকে একটুও সহজ করে তুলতে চায়, তাহলে তসমাক-এর বাড়-বৃদ্ধি রোধ করাই হবে তার প্রথম পদক্ষেপ।
ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়ে তাঁর মত চাওয়া হলে কুল্লি বললেন, “আমরা জঙ্গলে থাকি। সেখানে না আছে খবরের কাগজ না টিভি। আমরা তাদের বিষয়ে কী করে জানব? আমাদের জীবন টিকে থাকার লড়াই করেই কাটে। আমরা সর্বক্ষণ ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টাই চালিয়ে যাই।”
এই বিচ্ছিন্ন জনপদটি স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে কোনো প্রচার দেখতে পায়নি এখনও অবধি (এই প্রতিবেদন রচনার সময়, ১০ই এপ্রিল অবধি)। “কেউ এখনো আসেনি। তাদের এর মধ্যেই আসা উচিত, আর তারা এলে আমরা একটু চা-বিস্কুট পাব — যেন তাতে আমাদের বিরাট উপকার হবে,” বললেন কুল্লি।
সরকারের উপর ভরসা প্রায় না থাকলেও শান্তিনী, আজ, ১৮ই এপ্রিল ভোট দেবেন (কুল্লি ভোট দেবেন না ঠিক করেছেন)। একটু থেমে শান্তিনী বললেন, “ভোট দিয়ে আমাদের কী লাভ হয় আমরা আদিবাসীরা সত্যিই জানি না, কিন্তু বছরের পর বছর আমরা ভোট দিয়ে আসছি তাই একে চালিয়ে নিয়ে তো যেতে হবে।”
বাংলা অনুবাদ : চিলকা