ভারতের কৃষি সঙ্কট এখন আর কৃষিক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই।
এই পরিস্থিতি আজ এক সামাজিক সংকটের চেহারা নিয়েছে। সভ্যতার সংকট বললেও অত্যুক্তি হবে না কারণ, নিজেদের জীবন-জীবিকা বাঁচানোর তাগিদে দেশের ক্ষুদ্র কৃষক এবং শ্রমিকদের বৃহত্তম অংশটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে। কৃষি সংকট বলতে এখন আর মাত্র জমির অধিকার হারানোকেই বোঝায় না, বোঝায় না কেবল জীবন, জীবিকা এবং উত্পাদনশীলতা হারানোকেও। এই সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় তলানিতে এসে ঠেকা আমাদের মানবিকতা বোধকে, ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকা আমাদের মনুষ্যত্বকে। নিঃস্ব সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর যন্ত্রণা, বিগত কুড়ি বছরে ৩ লক্ষের অধিক মানুষের আত্মহত্যা দেখেও আমরা নীরব দর্শক হয়ে দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যে থেকেছি! কতিপয় -‘নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ’ - আমাদের চারপাশের এই ভয়াবহ যন্ত্রণাকে উপহাস করেছেন, এমনকি এই সংকটের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন!
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) গত দু’বছর ধরে কৃষকদের আত্মহত্যা বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেনি। তার আগের কয়েক বছর ধরেই, দেশের বড় বড় রাজ্যগুলির পক্ষ থেকে অসত্য, ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দেওয়ায় সংস্থাটির আনুমানিক পরিসংখ্যানে বিস্তর ফাঁক থেকে গেছে। প্রমাণস্বরূপ বলা যায় ছত্তিশগড় ও পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও অনেক রাজ্যের কথা, যেগুলি দাবি করেছে তাদের রাজ্যে একজন কৃষকও আত্মহত্যা করেননি। ২০১৪ সালে ১২টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দাবি করেছে সেখানে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্য। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে, এনসিআরবি রিপোর্টে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস হয়েছে প্রমাণ করার জন্য পরিসংখ্যান-পদ্ধতিতেই এক ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে।
এত প্রয়াস সত্ত্বেও আত্মহত্যার সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
এদিকে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। মধ্য প্রদেশে কৃষকদের উপর গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। মহারাষ্ট্রে কৃষকদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। এবং দেশের প্রায় সর্বত্র নোট বাতিলের কারণে কৃষিজীবীদের জীবন-জীবিকায় বিধ্বংসী প্রভাব পড়েছে। গ্রামীণ মানুষের যন্ত্রণা, ক্ষোভ বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র কৃষকেরাই নন, শ্রমিকেরাও দেখছেন কেমন করে সুপরিকল্পিতভাবে মনরেগা (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন) প্রকল্পের কাঠামোটিকেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ, বিধ্বস্ত সমস্ত মৎস্যজীবী মানুষ, অরণ্যবাসী সম্প্রদায়, গ্রামীণ কারিগর, শোষিত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। ক্ষুব্ধ সেইসব মানুষেরা যাঁরা ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পড়তে পাঠিয়ে টের পাচ্ছেন রাষ্ট্র কেমন করে নিজের স্কুলগুলোকে, শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজের হাতেই হত্যা করছে। এছাড়াও, চাকরির অনিশ্চয়তায় অসন্তোষ বেড়ে চলেছে সাধারণ সরকারি কর্মচারী, পরিবহন কর্মী এবং সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত ছোটোখাটো চাকুরেদের মধ্যেও।
গ্রামীণ জীবনের এই সংকট এখন আর গ্রামের চৌহদ্দিতেই আটকে নেই। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে দেশে কর্মসংস্থান ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।
২০১১ সালের আদমশুমারি সম্ভবত স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে
ব্যাপকতম, সংকটজাত অভিবাসনের
দিকে
ইঙ্গিত
করে। লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ তাঁদের জীবন-জীবিকা ঘিরে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করার তাগিদে দেশান্তরি হয়ে চলে যাচ্ছেন অন্যান্য গ্রাম, গ্রামীণ জনপদ, মফস্বল শহর, শহুরে বসতি এবং বড় বড় শহরগুলিতে – তাঁরা আসছেন কাজের খোঁজে, অথচ এইসব জায়গায় তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থাই নেই। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে ১৯৯১ সালের তুলনায় নথিভুক্ত কৃষকের (প্রধান কৃষক) সংখ্যা প্রায়
১৫ মিলিয়ন (দেড় কোটি) কমে গেছে
। একদা গর্বিত বহু খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষক বর্তমানে গৃহশ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শহুরে এবং গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণির হাতে এখন এই মানুষেরা শোষিত হচ্ছেন।
এইসব নিপীড়িত মানুষের কথায় সরকার বাহাদুর মোটেই কর্ণপাত করেন না। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও তথৈবচ।
আর যদিবা সংবাদমাধ্যম বিষয়গুলির উপর কদাচিৎ দৃষ্টিপাত করে, সেক্ষেত্রেও পুরো সংকটকে ‘ঋণ মকুব’-এর দাবিমাত্রে পর্যবসিত করা হয়। সাম্প্রতিককালে, সংবাদমাধ্যম কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) দাবিটিকে – উৎপাদন খরচ (সিওপি২) + ৫০ শতাংশ – স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের এই দাবিটিকে ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত করা হয়েছে বলে সরকার থেকে যে দাবি করা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম কিন্তু মোটেই তাকে প্রশ্ন করছে না, তার সত্যতা খতিয়ে দেখছে না। জাতীয় কৃষক কমিশন (এনসিএফ, যা স্বামীনাথন কমিশন নামেই পরিচিত) কৃষি এবং কৃষকদের বিষয়ে যে আরও এক গুচ্ছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছিল সে ব্যাপারেও সংবাদমাধ্যম মুখে কুলুপ এঁটেছে। এনসিএফ-এর বেশ কয়েকটি রিপোর্ট সংসদে বিগত ১২ বছর ধরে আলোচনা ছাড়াই পড়ে রয়েছে। এছাড়া ঋণ মকুবের আবেদনের সমালোচনা করার সময় প্রচারমাধ্যম ভুলেও উল্লেখ করে না যে, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এবং ব্যবসায়ীরাই ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় দেউলিয়া করে তোলা অলাভজনক সম্পদের অধিকাংশ হাতিয়ে বসে আছে।
অবিলম্বে একটি বৃহৎ, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ কর্মসূচির পাশাপাশি সংসদে এই সংকট এবং সম্পর্কিত বিষয়গুলির জন্য সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত তিন সপ্তাহ বা ২১ দিনব্যাপী একটি বিশেষ অধিবেশনের দাবি তোলা দরকার। সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে এই আলোচনা হওয়া দরকার।
কিসের উপর ভিত্তি করে এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে? অবশ্যই ভারতবর্ষের সংবিধানের উপর ভিত্তি করে। বিশেষ করে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত সংবিধানের নির্দেশিকাগুলির উপর নির্ভর করে। সংবিধানের এই অধ্যায়টি “আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস” এবং “সামাজিক অবস্থা, সুযোগসুবিধা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা...” বিষয়ে কথা বলে। এই সাংবিধানিক নীতিগুলি এমন “একটি সমাজব্যবস্থার কথা বলে যেখানে জাতীয় জীবনের সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভিত হবে ন্যায়।”
এই সংসদীয় আলোচনার আরেকটি ভিত্তি হবে সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা, কাজ, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি। পুষ্টি এবং জনস্বাস্থ্যের মান বৃদ্ধি করে সুস্বাস্থের অধিকার। জীবনযাত্রার মান উন্নত করার অধিকার। পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য সমান কাজে সমান বেতনের অধিকার। মানবিক এবং ন্যায়সঙ্গত কর্মপরিবেশের অধিকার। এইগুলিই হল সংবিধানের প্রধান প্রধান নীতি। ভারতবর্ষের সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার বলেছে সংবিধানের এই নির্দেশক নীতিগুলি আমাদের মৌলিক অধিকারের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই বিশেষ অধিবেশনের অ্যাজেন্ডা কী হবে? এই বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামতগুলি খতিয়ে দেখা যেতে পারে, সংকটময় পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত মানুষজন অবশ্যই এইগুলিকে সংশোধন এবং এখানে আরও নতুন সংযোজন করতে পারেন:
৩ দিন: স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা – ১২ বছর হল স্থগিত রয়েছে। ডিসেম্বর, ২০০৪ থেকে অক্টোবর, ২০০৬ সাল – এই মেয়াদকালে স্বামীনাথন কমিশন পাঁচটি রিপোর্ট জমা দেয় যার উপজীব্য শুধু এমএসপি ছিল না, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয় এই রিপোর্টে আলোচিত হয়েছিল। রিপোর্টে উল্লিখিত কয়েকটি বিষয় ছিল: জমির উত্পাদনশীলতা, লাভপ্রদতা, স্থায়িত্ব; প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিজনিত সমস্যা; শুষ্কভূমি চাষ, ফসলের মূল্য সংক্রান্ত অভিঘাত এবং স্থিরতা - এবং আরও অনেক কিছু। কৃষি গবেষণা এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বতোভাবে বেসরকারিকরণকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এবং আসন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের মোকাবিলাও করতে হবে।
৩ দিন: জনগণের সাক্ষ্য। এই সংকটের কবলে পড়ে যেসব মানুষ শিকার হয়েছেন, সংসদের কেন্দ্রীয় হলে দাঁড়িয়ে তাঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে দেওয়া হোক। তাঁরা কথা বলবেন এবং এই সংকটের স্বরূপ, কেমন করে এই সংকট লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবীকে বিপন্ন করেছে ইত্যাদি বিষয়ে দেশের মানুষকে অবহিত করবেন। আর এই সংকট কৃষির পরিসর ছাপিয়ে কেমন করে চারদিকে ব্যাপ্ত হয়েছে, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণের ফলে গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র জনতা শুধু নয়, প্রকৃতপক্ষে সব দরিদ্র মানুষের অবস্থাই সঙ্গীন করে তুলেছে সেসব কথাও বলবেন। সারা দেশ জুড়ে গ্রামীণ পরিবারগুলির ঋণের খাতগুলির মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে চলা খাতটি হল স্বাস্থ্য, সম্ভবত দ্রুততম অথবা দ্বিতীয় দ্রুততম খাত।
৩ দিন: ঋণ সংকট । কৃষকদের মধ্যে ঋণের বোঝায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। মৃত কৃষিজীবীরা বাদেও লক্ষ লক্ষ কৃষক ঋণের বোঝায় জর্জরিত। ফলস্বরূপ, তাঁরা নিজেদের চাষের জমি হারাচ্ছেন। অন্যদিকে, ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিষয়ে সরকারি নীতিই প্রকৃতপক্ষে গ্রামে গ্রামে মহাজনদের ব্যবসার পথ প্রশস্ত করেছে।
৩ দিন: দেশের ব্যাপক জল সংকট। শুধুমাত্র খরার প্রেক্ষিতে এই সংকটকে ভাবলে চলবে না, এই সংকট খরার তুলনায় অনেক বড়। বর্তমান সরকার ‘ন্যায্য মূল্যের’ নামে জলের বেসরকারিকরণের প্রয়াস করে চলেছে। একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে পানীয় জলের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন - এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই জীবনদায়ী সম্পদের বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে। একমাত্র এইভাবেই এই মহামূল্য সম্পদের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং জলে সকলের বিশেষ করে ভূমিহীন মানুষের সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
৩ দিন: মহিলা কৃষিজীবীদের অধিকার। দেশের মহিলা কৃষিজীবীদের জমির মালিকানাসহ অন্যান্য অধিকারের কথা বাদ দিয়ে কিছুতেই কৃষি সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না; খেতে খামারে সর্বাধিক পরিশ্রম করেন কৃষিজীবী মহিলারাই , অতএব তাঁদের সমস্যার কথা সর্বাগ্রে ভাবতে হবে সংকটের মোকাবিলা করতে হলে। রাজ্যসভায় অধ্যাপক স্বামীনাথন মহিলা কৃষকদের অধিকার সংক্রান্ত বিলটি ২০১১ সালে পেশ করে ন (২০১৩ সালে তামাদি হয়ে যায়), বর্তমানে, এই বিলটিই প্রাথমিকভাবে এই বিষয়ে আলাপ আলোচনা বিতর্কের জন্য আদর্শ পরিসর হিসেবে কাজ করতে পারে।
৩ দিন: নারী ও পুরুষ উভয়প্রকার ভূমিহীন শ্রমিকদের অধিকার। কৃষি সংকটজনিত দূরাবস্থার কারণে গ্রামগুলি থেকে যে বহুমুখী অভিবাসন হয়েছে তার ফলে এই সংকট এখন আর গ্রামাঞ্চলের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নেই। এই শ্রমিকেরা যেখানেই অভিবাসিত হয়ে থাকুন না কেন, সেখানকার কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের সময় এই ভূমিহীন শ্রমিকদের প্রয়োজন, তাঁদের অধিকার এবং তাঁদের প্রেক্ষাপট যেন অবশ্যই বিবেচিত হয়।
৩ দিন: কৃষি বিষয়ে তর্কবিতর্ক। আগামী ২০ বছরে আমাদের দেশের কৃষির স্বরূপ কী হবে? কর্পোরেট-মুনাফা নিয়ন্ত্রিত এক কৃষি ব্যবস্থা? নাকি সেই কৃষি ব্যবস্থা যা গ্রামীণ সম্প্রদায় এবং পরিবার – যাদের অস্তিত্বই কৃষিনির্ভর - তাদের দ্বারা পরিচালিত হবে? এছাড়াও কেরালার কুদুম্বশ্রী আন্দোলনের মতো শক্তিশালী সংঘ নির্ভর কৃষি (সমষ্টিভিত্তিক চাষ) ব্যবস্থার মতো চাষের ক্ষেত্রে মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাগুলির দৃষ্টান্ত সামনে রেখে এগোতে হবে। এবং সর্বোপরি আমাদের ভূমি সংস্কারের অসমাপ্ত কর্মসূচিটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। উপরের সব তর্কবিতর্কগুলি তখনই প্রকৃতপক্ষে অর্থপূর্ণ হবে, যখন সেগুলি আদিবাসী ও দলিত কৃষক এবং শ্রমিকদের অধিকারের দিকটিকে মাথায় রাখতে সক্ষম হবে - এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
কোনও রাজনৈতিক দলই খোলাখুলিভাবে এই অধিবেশনের বিরোধিতা করবে না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কে এই কর্মসূচি সুনিশ্চিত করবে? দেশের সর্বহারা মানুষ নিজেরাই এই কর্মসূচি পরিচালনা করবেন।
এই বছর মার্চ মাসে নাসিক থেকে মুম্বই পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী লং মার্চে ৪০,০০০ হাজার কৃষক, শ্রমিক সামিল হয়েছিলেন, উপরোক্ত দাবিদাওয়াগুলির বেশ কয়েকটি তাঁদের লং মার্চের দাবির মধ্যে ছিল। মুম্বইয়ের দাম্ভিক সরকার পদযাত্রায় সামিল হওয়া এই মানুষগুলোকে ‘শহুরে মাওবাদী’ বলে দেগে দেয়, তাঁদের সাথে সরকার কথা বলার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। কিন্তু রাজ্য বিধানসভা ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে এই জনসমুদ্র যখন মুম্বইয়ে আছড়ে পড়ল, তখন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সরকার মাথা নোয়াতে বাধ্য হল। এইভাবে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সরকারকে শায়েস্তা করেছিলেন।
শৃঙ্খলাবদ্ধ এই প্রতিবাদীরা মুম্বইয়ে এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেবল শহরের শ্রমিক শ্রেণি নয়, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষও গভীর সহানুভূতিতে প্রতিবাদী কৃষক শ্রমিকদের সমর্থনে চারদেওয়ালের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
এই কর্মসূচিকে এইবার জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে – ২৫ গুণ জোরালো প্রতিবাদসহ। সর্বহারার লং মার্চ - আর শুধুমাত্র কৃষক ও শ্রমিকের লং মার্চ নয়, এই সংকটে বিধ্বস্ত সমস্ত মানুষই সামিল হবেন এই লং মার্চে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, যাঁরা এই সংকটে সরাসরি প্রভাবিত হননি, কিন্তু সহনাগরিকদের দুর্দশায় সমব্যাথী হয়েছেন, তাঁরাও সামিল হবেন এই প্রতিবাদে। সামিল হবেন তাঁরা, যাঁরা ন্যায় এবং গণতন্ত্রের পক্ষে। সারাদেশের প্রতিটি অংশ থেকে এই পদযাত্রা শুরু হয়ে দেশের রাজধানীতে এসে মিলিত হবে। আর লাল কেল্লার উদ্দেশ্যে যাত্রা নয়, আর জন্তর মন্তরে মৃত কৃষকের খুলি নিয়ে অবস্থান নয়। এই লং মার্চে সামিল হওয়া প্রতিবাদী মানুষ সংসদভবন ঘেরাও করে তাঁদের কথা শুনতে, বুঝতে এবং সেইমতো কাজ করতে জনপ্রতিনিধিদের বাধ্য করবেন। হ্যাঁ, তাঁরা দিল্লি দখল করবেন।
এই কর্মসূচি সংগঠিত করতে হয়তো অনেক মাস লাগবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা করা একটি বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রকাণ্ড চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় দরকার কৃষিভিত্তিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং আরও অন্যান্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মিলে গঠিত বৃহত্তম, ব্যাপকতম, অভূতপূর্ব একটি জোট। এই জোট শাসকের রোষের শিকার হবে, শাসকের বশংবদ সংবাদমাধ্যমও তাদের ছেড়ে কথা বলবে না, প্রতি মুহূর্তেই সংবাদমাধ্যম এই প্রতিবাদকে তাচ্ছিল্য করার প্রয়াস করে যাবে।
কোনওকিছুই অসম্ভব নয়, সবকিছুই সম্ভব হতে পারে। দরিদ্র জনতার ক্ষমতাকে খাটো করলে খুব বড় ভুল হবে। বড় বড় বুলি আওড়ানো শ্রেণি নয়, বরং এইসব অগুনতি সাধারণ দরিদ্র মানুষের হাতেই আজও গণতন্ত্র বেঁচে আছে।
এই কর্মসূচিটি হবে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের এক চূড়ান্ত, অভূতপূর্ব রূপ – মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যাতে নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন, তা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রায় দশ লক্ষ বা তারও বেশি মানুষ এই পদযাত্রায় যোগ দেবেন। হয়তো ভগত সিং বেঁচে থাকলে বলতেন: বধিরকে শোনানোর, অন্ধকে দেখানোর আর বাকশক্তিহীনের মুখে বুলি ফোটানোর এইটাই একমাত্র পথ।
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর