করোনা মহামারি বিষয়ে প্রথম বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীকে থালা বাসন পিটিয়ে অশুভ আত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর নিদান দিয়েছিলেন।
পরের বক্তৃতা শুনে ভয়ে আমাদেরই থরহরিকম্প অবস্থা!
সাধারণ মানুষ, বিশেষত দরিদ্র মানুষ কীভাবে খাবার ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাবে সে বিষয়ে একটি কথাও না বলে সামনে কি ভয়ানক বিপদ অপেক্ষা করছে তাই বলে আমাদের আতঙ্কিত করলেন। মধ্যবিত্ত দোকান-বাজারে ভিড় জমালো যা দেশের হতদরিদ্র মানুষের পক্ষে করা সহজ নয়। সহজ নয় সেইসব পরিয়ায়ী শ্রমিকদের পক্ষে যাঁরা শহর ছেড়ে নিজেদের গ্রামের পথে পাড়ি দিয়েছেন; সহজ নয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গৃহশ্রমিক, কৃষিশ্রমিকদের পক্ষে। যেসব কৃষক রবিশস্য খেত থেকে তোলার ব্যবস্থা করতে পারেননি বা পারলেও বিক্রি করতে পারেননি, তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। শত সহস্র প্রান্তিক মানুষের পক্ষে সহজ নয়-ই।
গতকাল — ২৬শে মার্চ অর্থমন্ত্রী প্যাকেজ ঘোষণা করে মুখ রক্ষা করেছেন — গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেয় ৫ কিলোর উপরে আরও ৫ কিলো গম অথবা চাল দেওয়া হবে আগামী তিন মাস। এখানেও পরিষ্কার নয় যে এই অতিরিক্ত ৫ কিলো বিনামূল্যে দেওয়া হবে কি না। যদি বিনামূল্যে না হয় তাহলে লাভ নেই। বিভিন্ন চালু প্রকল্পে যে অর্থ বরাদ্দ করা আছে তা-ই এই প্যাকেজের উপাদান। এমজিএনরেগা প্রকল্পে ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়েছিল — কাজের দিন বাড়াবার কথা কোথায় বলা হল? আর তা যদি তাঁরা এখনই করতে শুরু করেন তাহলে সামাজিক দূরত্বের নিয়ম কেমনভাবে পালন করবেন? কাজ আবার শুরু হতে যে বিস্তর সময় লাগবে সেইসময়ে মানুষ কী করবে? তাঁদের স্বাস্থ্য তখনও কাজ করার মতো অবস্থায় থাকবে তো? এমজিএনরেগা কর্মীদের প্রাপ্য মজুরি কাজ থাক না থাক প্রতিদিন সব মজুর ও কৃষককে আমাদের দিতেই হবে।
পি এম-কিষান যোজনা মোতাবেক ২,০০০ টাকা সুবিধা আগেই ঘোষিত হয়েছিল, যা এখনও দেয় - তাহলে নতুন কী পাওয়া গেল? তিন মাসের শেষে না দিয়ে এই অর্থ দেওয়া হবে শুরুতেই। এই মহামারি এবং লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে যে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হল তার হিসাব অর্থমন্ত্রী ভেঙে বলেননি - এর নতুন উপাদানগুলি কী? এর কোন কোন অংশ পুরোনো অথবা চালু প্রকল্পের বরাদ্দ জোড়াতালি দিয়ে এই অর্থের পরিমাণটি সাজিয়ে তোলা হয়েছে? একে মোটেই জরুরি অবস্থা সামাল দেওয়ার উপায় হিসাবে ধরা যায় না। তার উপর আবার, ভাতাভোগী, বিধবা ও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের, আগামী তিনমাসের জন্য মোট ১,০০০ টাকা দু ই দফায় দেওয়া হবে ! আর জন-ধন যোজনার অধীনে ২০ কোটি মহিলা প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে পাবেন আগামী তিনি মাসের জন্য ! এ তো নামমাত্রও নয় - চূড়ান্ত অশ্লীল।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ালে কী লাভ হবে যখন চালু ঋণের অর্থ পেতেই কালঘাম ছুটে যায়? আর এই ব্যবস্থা ঠিক কেমনভাবে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের গ্রামে ফিরতে সাহায্য করবে? পরিযায়ীরা এর দ্বারা উপকৃত হবেন বলে যে দাবী করা হচ্ছে তা তো প্রমাণ হচ্ছে না। আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারা খুবই দুশ্চিন্তার ব্যাপার, তার উপর প্যাকেজ ঘোষণাকারীদের হাবভাবও কম ভয়াবহ নয়। তৃণমূল স্তরের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে এদের কোনও ধারণাই নেই।
কোনওরকম সামাজিক সুরক্ষা বা সামাজিকভাবে দুর্বলদের জন্য কোনও পরিকল্পনা ছাড়া আমরা এই যে ধরনের লকডাউন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি তাতে উল্টো-পরিযান শুরু হয়ে যেতে পারে এবং তা শুরু হয়েও গেছে। এর গভীরতা ও ব্যাপ্তি সঠিকভাবে পরিমাপ করা অসম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা খবর থেকে বোঝা যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ যে নগর ও শহরগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন সেগুলিতে লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় নিজেদের গ্রামের পথে পাড়ি দিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে সবেধন নীলমণি পরিবহনটিই এই ঘরমুখো মানুষদের একমাত্র সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে - নিজেদের দুটি পা। কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের বাড়ি। ট্রেন বাস ভ্যান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে মাঝ রাস্তায় আটকে পড়েছেন। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হবে।
ভাবুন দেখি, একদল মানুষ গুজরাটের শহর থেকে হেঁটে চলেছেন রাজস্থানের গ্রামের দিকে; হায়দ্রাবাদ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার দূর দূরান্তের গ্রামের পথে; দিল্লি থেকে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের গ্রামের দিকে; মুম্বই থেকে না জানি কত দিকে। এঁরা যদি কোনও ত্রাণ না পান তাহলে খাবার আর জলের অভাবেই একটা সর্বনাশ ঘটে যাবে। এঁরা কলেরা ও উদরাময় ইত্যাদির মতো পরিচিত ব্যাধির কবলে পড়বেন।
তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে যে ধরনের অর্থনৈতিক দুর্দশা তৈরি হতে পারে তাতে মৃত্যু হবে মূলত শ্রমিক ও কমবয়সীদের। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী, টি সুন্দরারামন পারি-কে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক দুর্দশা ছাড়াও দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা শেষমেশ করোনা-ঘটিত মৃত্যু ছাড়িয়ে অন্যান্য অসুখে মৃত্যু নিয়ে জেরবার হবে।
“৬০-এর কোঠায় এবং তার উপরে থাকা ৮ শতাংশ নাগরিকের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবায় অব্যবস্থা দেখা দিলে কর্মক্ষম ও কমবয়সীদের উপরেও বড়ো আঘাত নেমে আসতে পারে।”
ন্যাশানাল হেল্থ সিস্টেমস রিসোর্সেস সেন্টারের প্রাক্তন আধিকারিক ডঃ সুন্দরারামন জোরের সঙ্গে যে কথাটি বলছেন তা হল এইসময়ে আশু প্রয়োজন হল, “ঘরফেরতা মানুষের উলট-পরিযান এবং কর্মহীনতার দিকে নজর দিয়ে তার সমাধানের বন্দোবস্ত করা। তা না করতে পারলে এ যাবৎ দরিদ্র মানুষকে জেরবার করে রেখেছে যে সব রোগ, তদ্বজনিত মৃত্যু করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।” বিশেষত যে নামমাত্র মজুরিটুকু পান তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনাহারের কবলে পড়ে শহরের কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকরা যদি গ্রামমুখো পরিযানে বাধ্য হন।
পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের কাজের জায়গাতেই থাকেন। সেই জায়গা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদেরও সেখান থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে — তাঁরা যাবেন কোথায়? সবাই এই বিশাল দূরত্ব হেঁটে অতিক্রম করতে মোটেই সক্ষম নন। তাঁদের রেশন কার্ডও নেই — এঁদের কাছে খাবার পৌঁছাবেনই বা কেমন করে?
ইতিমধ্যে, অর্থনৈতিক দুর্দশা তুখোড় গতিতে এগোচ্ছে।
এও দেখা যাচ্ছে যে আবাসনগুলির মানুষজনের মাথায় একথা ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে যে এই সব পরিয়ায়ী শ্রমিক, গৃহ সহায়ক, বস্তিবাসী দরিদ্র মানুষরাই সমস্যার কারণ। বাস্তবে, কোভিড-১৯-এর বাহক, যেমনটা হয়েছিল সার্স-এর ক্ষেত্রে, বিমান যাত্রায় অভ্যস্ত উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা – অর্থাৎ আমরা। এদিকে নজর না দিয়ে আমরা এই অনভিপ্রেত মানুষদের বিতাড়িত করে শহর পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করছি! ভেবে দেখুন – কোনও সংক্রমিত বিমানযাত্রী যদি এই ফিরতি পরিযায়ী শ্রমিকদের একজনকেও সংক্রমিত করে থাকেন, তাহলে এঁরা যখন নিজ নিজ গ্রামে ফিরবেন, তখন সেখানকার অবস্থা কী দাঁড়াবে?
অবশ্য একই কিংবা কাছাকাছি রাজ্যের কিছু পরিযায়ী শ্রমিক চিরকালই হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফেরেন। যাত্রাপথে ধাবা অথবা চায়ের দোকানে কাজ করে খাওয়া জুটিয়ে নেওয়া আর রাতে সেখানেই ঘুমানো — এই ছিল চিরাচরিত পদ্ধতি। এখন এগুলির বেশিরভাগ বন্ধ থাকায় অবস্থা কী দাঁড়াবে?
সম্পন্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মাথায় ঢুকেছে যে তাঁরা বাড়িতে থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অন্তত তাতে আমরা নিজেরা এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাব! আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে এই অর্থনৈতিক দুর্দশা একসময় আমাদের দিকেই ধেয়ে আসবে। অনেকের জন্যই ‘সামাজিক দূরত্ব’-এর দ্যোতনা ভিন্ন। আমরা দুহাজার বছর আগেই বর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সবচেয়ে শক্তিশালী রূপটি আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম! আমাদের এই লকডাউনের বন্দোবস্তটিও সেই শ্রেণি ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্যেই গাঁথা!
দশ লক্ষ মানুষ যে আমাদের দেশে প্রতি বছর যক্ষ্মা রোগে মারা যান তাতে কোথাও কোনও ফারাক পড়ে বলে মনে হয় না। ১০০,০০০ শিশুর যে প্রতি বছর উদরাময় রোগে প্রাণ যায় তা নিয়েও আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। ‘ওরা’ তো আর আমরা না। সুন্দর মানুষজন যখন দেখে যে কিছু মারণ রোগের থেকে তাদেরও মুক্তি নেই তখনই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিল সার্স রোগের সময়ে, হয়েছিল ১৯৯৪ সালে সুরাটের প্লেগের সময়ে। দুটিই ছিল মারাত্মক রোগ কিন্তু ভারতবর্ষে যত মানুষের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রকৃতপক্ষে মৃতের হার ছিল তার চেয়ে কম। অবশ্য এগুলি বেশ অনেকটাই মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আমি তখন সুরাটের বিষয়ে লিখেছিলাম —“প্লেগের জীবানু অতি মারাত্মক কারণ এ শ্রেণি বৈষম্য মানে না... তার চেয়েও খারাপ কথা এই যে এগুলি প্লেনের অভিজাত ক্লাব ক্লাস সিটে চড়ে সোজা নিউ ইয়র্ক পৌঁছে যেতে পারে।”
আমাদের এই মুহূর্তেই কিছু করা দরকার। আমরা কেবলমাত্র একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধেই লড়ছি না — মহামারি নিজেই একটি ‘প্যাকেজ’। এর মধ্যে নিজেদের সৃষ্টি করা বা বাড়িয়ে তোলা অর্থনৈতিক দুর্গতি এমন এক উপাদান যা আমাদের চরম দুর্দশা থেকে একেবারে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে
আর আমাদের এই ধারণা যে আমরা একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধেই মাত্র লড়ছি — একবার একে নির্মূল করতে পারলেই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে — এই ভাবনাটিই বিপজ্জনক। অবশ্যই আমাদের কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে — ১৯১৮ সালের সেই মহামারি যাকে ভুল করে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নাম দেওয়া হয়েছিল— বর্তমান সংকট তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। (ভারতবর্ষে ১৯১৮-২১ সালের মধ্যে ১৬-২১ মিলিয়ন মানুষ মারা যান। বস্তুত ১৯২১ সালের আদমশুমারিতেই একমাত্র গ্রামীণ জনসংখ্যায় ব্যাপক হ্রাস লক্ষ্য করা গিয়েছিল।)
কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র কোভিড-১৯ কে নিয়ে মেতে থাকা মানে সবকটা জলের কল খোলা রেখে মেঝে মুছে শুকনো করার চেষ্টার সামিল! আমাদের দরকার এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অধিকার, ও ন্যায্য পাওনাগুলির দাবিকে জোরদার করে তুলতে সক্ষম হবে।
১৯৭৮ সালে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত কিছু মহতী মানুষ আলমা আটা ঘোষণাপত্র রচনা করেছিলেন — এই কাজটি যখন হয়েছিল তখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) পাশ্চাত্য দেশের সরকারি মদতপুষ্ট বাণিজ্যসংস্থাগুলির লেজুরবৃত্তি শুরু করেনি। এই ঘোষণাপত্রটিই “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য” এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। “বিশ্বের সম্পদ সম্পূর্ণ ও যথাযথভাবে ব্যবহার করে...” এই কাজ করা সম্ভব বলে এই ঘোষণাপত্রের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
৮০-এর দশক থেকে স্বাস্থ্যের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নির্ধারকগুলিকে বোঝার ঝোঁক যেমন বাড়ছিল সেই সময়ে আরও একটি প্রবণতাও বাড়ছিল। বরং আরও দ্রুত গতিতে বাড়ছিল: নয়া উদারনীতিবাদ।
৮০ থেকে ৯০-এর দশকের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান যে আদতে মানবাধিকার, এই ভাবনা সারা বিশ্ব জুড়ে আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই পেল।
১৯৯০-এর মাঝামাঝি শুরু হল ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বায়ন। কিন্তু এই মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে বহু রাষ্ট্র সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও বেশি করে ব্যক্তিমালিকানাধীন করে তুলল। ভারতবর্ষে চিরকাল ব্যক্তিমালিকানার রমরমা ছিলই। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ন্যূনতম যেসব দেশে আমাদের দেশ তাদের মধ্যে পড়ে — মোট জাতীয় উৎপাদনের ১.২ শতাংশ মাত্র। যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই রুগ্ন ছিল ৯০-এর দশক থেকে তাকে আরও দুর্বল করে দেওয়া হল গৃহীত নীতির ভিত্তিতে। দেশের বর্তমান সরকার জেলা স্তরের হাসপাতাল ব্যবস্থাতেও বেসরকারিকরণকে স্বাগত জানাচ্ছে।
আজকের তারিখে দেশে গ্রামীণ পরিবারের ঋণের দ্রুততম হারে বেড়ে চলা খাতটি হল স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে নেওয়া ঋণ। ২০১৮ সালের জুনে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানান তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছিল, ২০১১-১২ – এই একটি বছরেই ভারতবর্ষের ৫.৫ কোটি মানুষ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে দরিদ্র হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হয়েছিলেন। তার মধ্যে আবার ৩.৮ কোটি মানুষ শুধুমাত্র ওষুধপত্রের খরচ বইতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নিচে চলে গিয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে কৃষক আত্মহত্যার কোপে পড়া হাজার হাজার পরিবারে একটি চমকপ্রদ সাধারণ বিষয় লক্ষ্য করা যায়: চিকিৎসার ভয়াবহ খরচ মেটাতে অধিকাংশ সময়েই ঋণ নিতে হয় মহাজনদের কাছ থেকে।
কোভিড-১৯-এর সঙ্গে এঁটে উঠতে প্রস্তুত এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে সবচেয়ে কম। দুঃখের বিষয় এই যে ভবিষ্যতে অন্য নানা নামে আরও কোভিড আসবে। ৯০-এর দশক থেকে আমরা সার্স এবং মার্স (দুটিই করোনাভাইরাস ঘটিত রোগ) দেখেছি; দেখেছি সারা বিশ্বে একই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া আরও বিভিন্ন রোগ। ভারতের সুরাটে ১৯৯৪ সালে প্লেগ দেখা দিল। কোন বিশ্ব আমরা গড়ে তুলেছি এবং কোথায় এসে পৌঁছেছি তা এর থেকেই ঠাহর হয়।
বিশ্ব ভিরোম প্রকল্পের অধ্যাপক ডেনিস ক্যারোল সম্প্রতি জানিয়েছেন - “আমরা বাস্তুজগতের এমন গভীরে প্রবেশ করেছি যার দখলদারি আগে কখনও হয়নি...” তেল এবং খনিজ পদার্থ উত্তোলন করতে এমন সব নির্জন স্থানে ঢুকে পড়েছি যেখানে পূর্বে মানুষের খুব সামান্যই বসত ছিল - এখন এর মূল্য তো দিতেই হবে। ভঙ্গুর বাস্তুব্যবস্থায় আমাদের এই বহিরাক্রমণ, কেবল পরিবেশেই বদল আনছে না স্বাস্থ্যহানির সম্ভবনাও তৈরি করছে; যেমন মানুষ আর অপর জীবজন্তুর মধ্যে স্থানিক ব্যবধান কমে যাওয়ার ফলে স্বল্পপরিচিত অথবা একেবারে অপরিচিত সব ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
সুতরাং, আগামী দিনে আমরা এমন আরও অনেক কিছু দেখব।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা অপেক্ষা করে আছে।
এক, আমাদের স্বার্থে এই ভাইরাস বিবর্তন ঘটে এক সপ্তাহের মধ্যে নিকেশ হয়ে যেতে পারে।
অথবা নিজের স্বার্থে পরিবর্তিত হয়ে অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে এক নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হবে।
আমরা কী করতে পারি? ভারতবর্ষের গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে থেকে বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বরা যে সকল মত দিয়েছেন সেগুলি ছাড়া অথবা তার সঙ্গেই আমি এই প্রস্তাবগুলি রাখছি। (কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাকে ঋণ, ব্যক্তিমালিকানার প্রাধান্য ও লগ্নি পুঁজির ব্যর্থতার বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চাওয়ার প্রবণতাও আছে) কেরল সরকারের ঘোষিত নীতির কয়েকটিকে অনুপ্রেরণা হিসাবে নিয়ে বলা যায়-
Ø প্রথমেই যা করতে হবে: আমাদের ৬ কোটি টনের কাছাকাছি ‘উদ্বৃত্ত’ মজুত খাদ্য জরুরি ভিত্তিতে বন্টন করা। এই খাদ্য সত্বর পৌঁছে দিতে হবে কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে বিধ্বস্ত দরিদ্র মানুষের কাছে। বর্তমানে বন্ধ থাকা সামাজিক ক্ষেত্রগুলিকে (যেমন স্কুল, কলেজ, কমিউনিটি হল, ও অন্যান্য ভবনগুলি) আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক ও গৃহহীনদের আশ্রয় স্থল হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।
Ø দ্বিতীয় এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি হল সমস্ত কৃষককে খারিফ মরশুমে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করা। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি এক ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছাবে। এমতাবস্থায় অর্থকরি ফসল চাষ মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। করোনা ভাইরাসের টিকা/ওষুধ আবিষ্কার হতে এখনো ঢের দেরি। তার মধ্যে সঞ্চিত খাদ্যশস্য তলানিতে ঠেকবে।
Ø সরকারকে কৃষকের ফসল একবারে কিনে নিতে হবে। অনেকে লকডাউনের কারণে রবি ফসল তোলা শেষ করতে পারেননি। যাঁরা পেরেছেন তাঁরাও তা বিক্রির জন্য কোথাও পাঠাতে পারছেন না। খারিফ ফসল চাষের জন্যেও কৃষকের দরকার পড়বে চাষের সামগ্রী, অন্যান্য পরিষেবা ও বিপণন ব্যবস্থায় সহযোগিতা।
Ø ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থাকে সরকারের অধিগ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। হাসপাতালগুলিকে নিজেদের চৌহদ্দির ভিতরে একটি করে ‘করোনা কেন্দ্র’ স্থাপন করার পরামর্শ দেওয়া আদৌ যথেষ্ট হবে না। গত সপ্তাহে স্পেন সব হাসাপাতাল ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার জাতীয়করণ করেছে কারণ তারা বুঝেছে যে লাভের লক্ষ্যে কাজ করা কোনও ব্যবস্থা এই সংকট সামাল দিতে পারবে না।
Ø সাফাই কর্মচারীদের এই মুহূর্তে সরকারি/পৌরসভার নিয়মিত পূর্ণসময়ের কর্মীতে পরিণত করে, তাঁদের বর্তমান বেতনের উপর আরও ৫,০০০ টাকা করে দিতে হবে এবং তাঁদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা সুবিধা দিতে হবে, যা তাঁদের কোনওদিন দেওয়া হয়নি। তাছাড়াও তাঁদের এত দিন যা দেওয়া হয়নি সেই সুরক্ষা সরঞ্জামও দিতে হবে। এমনিতেই সামাজিকভাবে দুর্বল সাফাইকর্মীদের আমরা তিন দশক ধরে আরও ক্ষতি করেছি — সরকারি পরিষেবা ব্যবস্থার বাইরে ঠেলে দিয়ে, বেসরকারি সংস্থার হাতে তাঁদের কাজের দায়িত্ব তুলে দিয়ে — যে সংস্থাগুলি এই কর্মীদের বাড়তি কোনও সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে কম মজুরিতে পুনর্নিয়োগ করে।
দেশের গরিব মানুষের জন্য বিনামূল্যে আগামী তিনমাসের রেশন ঘোষণা করে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তা বণ্টনের বন্দোবস্ত সুনিশ্চিত করতে হবে।
Ø এই মুহূর্তে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি ও মিড-ডে মিল কর্মী — যাঁরা সামনের সারিতে থেকে এই লড়াই করছেন — তাঁদের বিধিবদ্ধ সরকারি কর্মীতে পরিণত করতে হবে। ভারতবর্ষের শিশুদের জীবন ও স্বাস্থ্য তাঁদের হাতে রয়েছে। তাঁদেরও পূর্ণ সময়ের কর্মীতে পরিণত করে, সঠিক বেতন ও সুরক্ষা সামগ্রী দিতে হবে।
Ø কৃষক ও দিনমজুরদের এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতে দৈনিক এমজিএনরেগা নির্ধারিত মজুরি দিতে হবে। শহরের দিনমজুরদের ওই সময়েকালে, মাসে ৬,০০০ টাকা করে দিতে হবে।
এই মুহূর্তেই আমাদের এই বন্দোবস্তগুলি করা শুরু করতে হবে। সরকারি ‘প্যাকেজ’ আদতে মূঢ়তা ও নির্বুদ্ধিতার খিচুড়ি বিশেষ। আমরা কেবলমাত্র একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছি না —মহামারি নিজেই একটি ‘প্যাকেজ’। এর মধ্যে নিজেদের সৃষ্টি করা বা বাড়িয়ে তোলা অর্থনৈতিক দুর্গতি এমন এক উপাদান যা আমাদের চরম দুর্দশা থেকে একেবারে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ভাইরাসের এই গতি যদি আর সপ্তাহ দুয়েক থাকে তাহলে কৃষকদের খারিফ মরশুমের জন্য খাদ্যশস্য চাষ করতে বলাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একই সঙ্গে আমরা কি যথেষ্ট নিরপেক্ষভাবে পারব কোভিড-১৯ কে একটি লক্ষণীয়, চোখ খুলে দেওয়ার মতো ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে দেখতে? এ এমন এক মোড় যেখান থেকে আমাদের পথদিশা ঠিক করে নিতে হবে। অসম ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার ন্যায্য অধিকার নিয়ে বিতর্ক নতুন করে শুরু তথা নিশ্চিত করার মুহূর্ত এটি।
এই লেখাটির অন্য একটি সংস্করণ প্রথমবার ২৬শে মার্চ, ২০২০ তারিখের দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা অনুবাদ : চিলকা