২০১৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর ৪০ বছর বয়সী কৃষি শ্রমিক বান্ডু সোনালে আমডী গ্রামে তাঁর মালিকের তুলোর খেতে কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেইদিন সারাটা সময় তিনি প্রখর খরতাপে কার্পাস গাছে কীটনাশক ছেটানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বিভিন্ন জমিতে কার্পাস ফসলে কীটনাশক স্প্রে করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তিন কিলোমিটার দূরে তিনি ইয়াবতমাল জেলায় তাঁর নিজের গ্রাম, মানোলীতে ফিরে আসেন – বান্ডু কিছুক্ষণ ওই জমিতেই জিরিয়ে নেওয়ার পর, বান্ডুর নিয়োগকর্তা নিজের মোটর সাইকেলে বসিয়ে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান।
দুই দিন পরেও বান্ডুর অবস্থায় উন্নতি হল না দেখে তাঁর স্ত্রী গীতা তাঁকে স্থানীয় অটোরিকশায় করে ইয়াবতমাল শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঘাটানজি তহসিল শহরের উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। তাঁর শারীরিক কষ্টগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল: পেট ব্যাথা, অসংলগ্নভাব এবং ক্লান্তি। সেই রাতেই তাঁর খিঁচুনি হতে শুরু করে। এরপর যখন তিনি দৃষ্টিশক্তি হারানোর কথা বললেন, তখন তাঁকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ইয়াবতমালের বসন্তরাও নাইক সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে (জিএমসিএইচ) স্থানান্তরিত করা হল, প্রতি মুহূর্তে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল।
২৩শে সেপ্টেম্বর, বান্ডু – যিনি মাত্র এক সপ্তাহ আগেও সুস্থ সবল অবস্থায় ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ করে গেছেন - ইয়াবতমাল হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। মারা তিনি সকালে পরদিন অবশেষে যান।
কীটনাশক স্প্রে করার কাজে বান্ডুর বেশ নামডাক ছিল, সকলেই তাঁকে এই কাজে নিয়োগ করতে চাইতেন বলে জানান বান্ডুর রুগ্ন স্ত্রী। নিজেদের এক চিলতে চালাঘরে (কভার ফটো দেখুন), তাঁদের দুই সন্তান, ১৭ বছরের সৌরভ, এবং ১৪ বছরের পূজার সঙ্গে বসে তিনি স্মরণ করেন, “দুই মাস ধরে তিনি একটি দিনের জন্যেও বিশ্রাম করেননি, টানা কাজ করে গেছেন।” বান্ডুর ব্যবহার করা একটি ব্যাটারি চালিত স্প্রে-পাম্প তাঁদের বাড়ির সামনের উঠোনে খড়ে ছাওয়া বারান্দার একদিকে পড়ে আছে।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে যখন আমি তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনও গীতার আতঙ্ক কাটেনি। ঠিক কোন কীটনাশক বান্ডু ব্যবহার করেছিলেন, অথবা তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণটাই বা কী এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন না। ২০১৭ সালে কার্পাস উৎপাদনকারী কৃষকেরা তাঁদের ফসলে বিধ্বংসী পতঙ্গের আক্রমণ ঠেকানোর উদ্দেশ্যে বেশি করে কীটনাশক ছড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন, তখন বান্ডু এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এই কাজে নিযুক্ত হয়ে পড়লেন। অতিরিক্ত উপার্জনের এই প্রচেষ্টাই তাঁর জীবন শেষ পর্ভন্ত কেড়ে নিল।
তাঁর বন্ধু ও প্রতিবেশী, ভূমিহীন কৃষক নারায়ণ কোটরঙ্গে, যিনি নিজে অপর এক জমির মালিকের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ১০ একর জমিতে চাষের কাজ করেন, তাঁর কথায়, “সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে বান্ডুকে হয়তো প্রাণে বাঁচানো যেত।” কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর পরিবার বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করে, এবং তারপর সরকারি হাসপাতালের চিকিত্সায় ত্রুটির জেরে বান্ডু এবং তাঁর মতো আরও অনেকের প্রাণ যায়। প্রত্যেকেই ছিলেন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক, কীটনাশকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সময় দুর্ঘটনাবশতঃ নানারকম রাসায়নিকের সংমিশ্রণে তৈরি কীটনাশকের বিষাক্ত ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের শরীরে প্রবেশ করে। যাঁরা অসুস্থ হওয়া মাত্র হাসপাতালে এসেছিলেন এবং সময় মতো সঠিক চিকিৎসা পেয়েছেন, তাঁরাই একমাত্র বেঁচে ফিরতে পেরেছেন।
সরকারি নজরদারি ব্যবস্থার অভাব এবং অপ্রতুল সরঞ্জামে ধুঁকতে থাকা হাসপাতাল
বেশ কয়েকটি জীবন বাঁচানো সম্ভবপর হত যদি, ইয়াবতমালের জিএমসিএইচ হাসপাতালে এইসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি কোলিনেস্টেরাস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা মজুত থাকত; এই পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১৭ সালের জুলাই–নভেম্বর মাসের কীটনাশক স্প্রে করার মরশুমে, বান্ডুর মতো যাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের রক্তে অর্গানোফসফেট যৌগের উপস্থিতি নির্ধারণ করা সম্ভব হত। এই প্রয়োজনীয় পরীক্ষাটি ছাড়া এবং এই বিষক্রিয়া নিরোধক প্রতিষেধক ছাড়াই, টানা কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালের ডাক্তাররা কৃষক এবং খেতমজুরদের তাৎক্ষণিক শারীরিক উপসর্গ বিচার করে চিকিৎসা চালিয়ে যান, জিএমসিএইচ হাসপাতালের আইসিইউয়ের একজন চিকিৎসক আমাকে এই তথ্য জানান। জরুরি কোনও রক্ত পরীক্ষাই অসুস্থ মানুষগুলির ক্ষেত্রে করা হয় নি।
বিশেষ তদন্তকারী দলের (এসআইটি) তদন্তের রিপোর্টে এই সকল গাফিলতি ধরা পড়েছে। মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃক গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠিত হয় বিদর্ভ এবং ইয়াবতমালে কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় বহু কৃষিজীবীর মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করার লক্ষ্যে। ২০১৭ সালের ১০ই অক্টোবর এই বিশেষ তদন্তকারী দলটি গঠিত হয়, দলের প্রধান ছিলেন অমরাবতীর ডিভিশনাল কমিশনার পীয়ূষ সিং। এসআইটির অন্যান্য ছয়জন সদস্যের মধ্যে ছিলেন নাগপুরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব কটন রিসার্চের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা ডঃ বিজয় ওয়াঘমারে এবং ফরিদাবাদের ডিরেক্টরেট অফ প্ল্যান্ট প্রটেকশন সংস্থার কিরণ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বিশেষ তদন্তকারী দল বা (এসআইটি) মারাঠি ভাষায় লিখিত তাদের তদন্তের রিপোর্ট জমা দিলেও, সামাজিক কর্মী ও কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) প্রাক্তন কর্মী জম্মু আনন্দ কর্তৃক দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির সময়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ সরকারকে নির্দেশ দেয় এই রিপোর্টটি প্রকাশ করতে।
গত ৬ই মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে লোকসভায় জানানো হয় যে, বিগত চার বছরে কীটনাশকজনিত বিষক্রিয়া থেকে মহারাষ্ট্র রাজ্যে ২৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে – এই তথ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এটাই প্রমাণ করার প্রয়াস করা হচ্ছিল যে ২০১৭ সালের কীটনাশক থেকে বিষক্রিয়ায় কৃষিজীবীদের মৃত্যুর ঘটনা অস্বাভাবিক বা অভূতপূর্ব কিছুই নয়। কিন্তু, জিএমসিএইচ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য এবং ২০১৭ সালের কীটনাশক স্প্রে করার মরশুমে অসুস্থ কৃষিজীবীদের চিকিৎসায় নিযুক্ত ডাক্তারদের বয়ান থেকে জানা যায়, ইয়াবতমালে এর আগে এইরকম বিরাট সংখ্যায় দুর্ঘটনাজনিত কীটনাশক বিষক্রিয়ার ঘটনার কোনও নিদর্শন নেই; এইসময় দলে দলে কৃষিজীবী মানুষেরা হাসপাতালে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া বা অন্ধত্ব, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, স্নায়বিক দুর্বলতা, আংশিক পক্ষাঘাত, আতঙ্ক এবং অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে আসতে থাকেন। এঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন মারা গেছেন, হাজারেরও বেশি অসুস্থ হয়েছেন, কেউ কেউ কয়েকমাস ধরে ভুগেছেন। (দেখুন: ধোঁয়া এবং ত্রাসে আচ্ছন্নইয়াবতমাল এবং মারণ কীট, প্রাণঘাতী কীটনাশক )
রাজ্য সরকার দ্বারা বিশেষ তদন্তকারী দল বা এসআইটি প্রতিষ্ঠা স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে এই বিপর্যয় কতখানি ভয়াবহ এবং অভূতপূর্ব ছিল।
এসআইটি খতিয়ে দেখেছে, যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে এই বিপর্যয়ের ভয়াবহতা এবং মাত্রা সম্বন্ধে অবগত করা হয়নি। ১৯৬৮ সালের কীটনাশক আইনের (ইনসেক্টিসাইড অ্যাক্ট) অধীনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি স্থায়ী আন্তঃবিভাগীয় কমিটি গঠনও বাধ্যতামূলক এবং এই কমিটি যাতে গঠিত হয় সেটা সুনিশ্চিত করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। এই কমিটির পক্ষ থেকে সমগ্র বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নজরদারি দল প্রতিষ্ঠা করে খতিয়ে দেখার কথা যে কৃষক, কীটনাশক বিক্রেতা এবং উত্পাদনকারীরা এই সংক্রান্ত আইন অনুসরণ করে চলছেন কিনা; জেলায় যেসব কীটনাশক বিক্রি হচ্ছে, বাজারে তার প্রতিষেধক বা অ্যান্টিডোটগুলি পাওয়া যাচ্ছে কিনা; এবং সর্বোপরি কীটনাশক সংক্রান্ত বিপর্যয় ঘটলেই তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করাও কমিটির কাজ। ইয়াবতমালে না আছে এমন কোনও কমিটির অস্তিত্ব, না আছে নজরদারির ব্যবস্থা।
এসআইটি তার রিপোর্টে সুপারিশ করেছে যাতে ইয়াবতমালের জিএমসিএইচ হাসপাতালে কোলিনেস্টেরাস পরীক্ষা করার উপযুক্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করা হয়, এবং অর্গানোফসফেটজনিত বিষক্রিয়া নিরোধক প্রতিষেধগক ওষুধপত্র যাতে মজুত রাখা হয়। বিদর্ভ অঞ্চলে পতঙ্গ এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে কার্পাস, সোয়াবিন এবং অন্যান্য ফসল বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, জটিল যৌগ রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয় বলেই এই অত্যাবশ্যক সুপারিশগুলি করা হয়েছে।
পশ্চিম বিদর্ভের বিভাগীয় সদর দপ্তর, অমরাবতী জেলার জিএমসিএইচ ২০১৭ সালের এই বিপর্যয়কে অপেক্ষাকৃত সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে কারণ এখানে কোলিনেস্টেরাস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। কোলিনেস্টেরাস হল এক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক যা এসিটিলকোলাইনকে (এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার) সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম করে তোলে। অর্গানোফসফেটজনিত বিষক্রিয়ায় কোলিনেস্টেরাসের ক্ষরণ রোধ করে দেয়, ফলে শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি অকেজো হতে শুরু করে, এমনকি স্নায়ুতন্ত্রও এর আঘাত থেকে মুক্ত থাকে না, এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে। এসআইটি তার রিপোর্টে জানিয়েছে যে অমরাবতীর হাসপাতালে এই বিষক্রিয়া নিরোধক প্রতিষেধকও মজুত আছে।
অমরাবতীর হাসপাতালে কীটনাশকজনিত বিষক্রিয়া থেকে ঘটা বিপর্যয় যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, সেভাবেই আগামী দিনে এই সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলার উদ্দেশ্যে, এসআইটি নিজেদের রিপোর্টে সুপারিশ করেছে, ইয়াবাতমলের জিএমসিএইচের ৩০ শয্যা বিশিষ্ট এবং আকোলার সরকারি জেলা সদর হাসপাতালের ২০ শয্যা বিশিষ্ট পৃথক আইসিইউ ছাড়াও ইয়াবতমালের ওয়াণী ও পুসাদ এই দুটি সদর তহসিল শহরের উপ-জেলা হাসপাতালগুলিতেও যাতে সরকারের তরফ থেকে আইসিইউ স্থাপন করা হয়।
এছাড়াও এই জেলার দীর্ঘদিনের কীটনাশকজনিত বিষক্রিয়ায় প্রাণহানির ইতিহাসকে মাথায় রেখে ইয়াবাতমলের জিএমসিএইচে একটি অত্যাধুনিক বিষবিজ্ঞান বা টক্সিকোলজি পরীক্ষাগার গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের কীটনাশক বিপর্যয়ের সময়, স্বাস্থ্যবিভাগ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিষক্রিয়ার বিস্তারিত টক্সিকোলজি পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা তৎক্ষণাৎ পাঠানো হয়নি, বিষক্রিয়া পরবর্তী জরুরি অবস্থার মোকাবিলায় যা একটি বিশাল বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
মনোক্রোটোফস নিষিদ্ধ করুন , প্রতিষেধক অ্যান্টিডোটগুলি প্রস্তুত রাখুন
বিশেষ তদন্তকারী দল তাদের সুপারিশে মনোক্রোটোফস নামক অর্গানোফসফেটটি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা আনার কথা বলেছে; এই অর্গানোফসফেটটি ফসলের উপর সামগ্রিকভাবে অর্থাৎ আভ্যন্তরীন কাঠামো এবং বাহ্যিকভাবে – উভয়দিক থেকেই কার্যকরী হয় বলে, মানুষ এবং পাখিদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এই কারণে অনেক দেশই এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ।
মহারাষ্ট্র সরকার নভেম্বর মাসে সীমিত সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে পরবর্তী ৬০ দিনের জন্য মনোক্রোটোফসের বিক্রি এবং বিপণন নিষিদ্ধ করে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে উঠতে সক্ষম হয়নি। কীটনাশক আইনের অধীনে একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই দেশে মনোক্রোটোফস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।
অবশ্য, রাজ্যগুলির হাতেও কীটনাশক উৎপাদকারীদের এবং বিক্রেতাদের লাইসেন্স স্থগিত করার, অথবা নতুন লাইসেন্স প্রদান না করার এবং পুরোনো লাইসেন্সের পুনর্নবীকরণ বন্ধ করার ক্ষমতা আছে। পাঞ্জাব রাজ্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে - ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে পাঞ্জাব মনোক্রোটোফসসহ ২০টি কীটনাশকের ক্ষেত্রে নতুন লাইসেন্স না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মনোক্রোটোফসকে “অত্যন্ত বিপজ্জনক” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কেরালা সরকারও কিছুদিন আগে মনোক্রোটোফস নিষিদ্ধ করেছে। এবং সম্পূর্ণরূপে জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজ পরিচালনাকারী রাজ্য সিকিমে, সবরকম রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ।
এসআইটি আরও সুপারিশ করেছে, যেসকল কীটনাশকের প্রতিষেধক অ্যান্টিডোট পাওয়া যায় কেবলমাত্র সেগুলিকেই সরকারের অনুমোদন দেওয়া উচিত, বিষক্রিয়ার মতো বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এসআইটি রিপোর্টে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রবণতার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্য সরকারকে এই ধরনের রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়ার আগে রাসায়নিকগুলির উপর একটি দীর্ঘমেয়াদী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালাতে সুপারিশ করেছে।
রিপোর্টে, বৃহত্তর কৃষি কাঠামোর সম্পূর্ণ ভগ্ন দশা সম্পর্কে কোনও উল্লেখ করা হয় নি - কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা রাষ্ট্রীয় কৃষি বিভাগ জাতীয় সংস্থাগুলির অভাবে নতুন কীটনাশক, নতুন নতুন কীটপতঙ্গের আগমন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহৃত নতুন প্রযুক্তি এবং এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণার কোন ব্যবস্থাই নেই। এই ব্যবস্থাগুলি মজুত থাকলে এমন সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অথচ এই রকম ব্যবস্থার অভাবে, অঞ্চলের কৃষিজীবীরা নতুন নতুন রাসায়নিকের বিষয়ে তথ্যের জন্য খোদ রাসায়নিক সরবরাহকারী বিক্রেতা বা দোকানদারের উপর নির্ভর করেন। একথা বলাই বাহুল্য যে, রাসায়নিকের দালাল, বিক্রেতা অথবা দোকানদার এই যৌগগুলির অত্যন্ত বিষাক্ত চরিত্র বিষয়ে তথ্য মোটেই দেবেন না, অন্যথায় স্বাভাবিকভাবেই এইসব রাসায়নিকের বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। রিপোর্টটি থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধে, ফসলের বৃদ্ধি বাড়াতে এবং অপেক্ষাকৃত বেশি উপার্জনের তাগিদে মরিয়া কৃষকরা ইনপুট ডিলার বা দালাল এবং বিক্রেতাদের পরামর্শে নিজেরাই নানারকম কীটনাশক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “নতুন চরিত্রের কীটনাশক এবং অন্যান্য রাসায়নিকের সংশ্লেষণের ফলে [২০১৭ সালের কীটনাশক স্প্রে করার মরশুমে] বিষের মাত্রায় ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে এবং এর ফলস্বরূপ অত্যন্ত আর্দ্র আবহাওয়ায় নিঃশ্বাসের সঙ্গে এবং স্পর্শজনিত কারণে এই বিষ শরীরে প্রবেশ করার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।”২০১৭ সালের সালের কীটনাশক স্প্রে করার মরশুমে কৃষকেরা গিবব্রালিক অ্যাসিড (গাছের পরিধি বৃদ্ধির জন্য), ইন্ডল অ্যাসিটিক অ্যাসিড (উদ্ভিদের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য) এবং ইন্ডল ব্যুটিরিক অ্যাসিড (আরো অগ্রবর্তী শিকড়ের জন্য) ইত্যাদি নানান বৃদ্ধিবর্ধক রাসায়নিকের সঙ্গে নানারকমের কৃত্রিম পাইরেথ্রয়েড, অর্গানফসফেট এবং অন্যান্য নতুন প্রজন্মের কীটনাশক ব্যবহার করেন। এছাড়াও তাঁরা ব্যবহার করেন হুমিক অ্যাসিড এবং নাইট্রোবেনজাইনের মতো অনুনমোদিত কিছু রাসায়নিক। (এই সংক্রান্ত অনুমোদন কীটনাশক আইন অধীনে গঠিত, কেন্দ্রীয় কীটনাশক বোর্ড থেকে নেওয়ার কথা।) এসআইটি আবিষ্কার করে যে অনেক কৃষক ফিপরোনিল এবং ইমিডাক্লোপরিড ব্র্যান্ডের কীটনাশকের সংমিশ্রণ ব্যবহার করেছেন, যেগুলিকে ব্যবহার করার অনুমোদন দেওয়াই হয়নি। স্থানীয় বাজারগুলি এইসব বিদেশ থেকে আমদানি করা, ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত (রেডি টু ইউজ) রাসায়নিকে ছেয়ে গেছে।
অনুনমোদিত রাসায়নিকের এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রুখবার কোনও উপায় নেই। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়াবতমালে ১৬টি তালুক রয়েছে, কিন্তু জেলায় মান নিয়ন্ত্রণ পরিদর্শকের পদ (কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইন্সপেক্টর) মাত্র একটি এবং এই পদও বিগত দুই বছর ধরে খালি রয়েছে।
রিপোর্টে নিহিত আছে আরেকটি গূঢ় পর্যবেক্ষণ – বিদর্ভের কার্পাস শস্যে ২০১৭ সালে কীটপতঙ্গের আক্রমণ ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং বিশেষত সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল গোলাপি-বোলওয়ার্ম কীটের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু সে আবার অন্য আরেক কিসসা...
কৃষিজীবীদের উপর দোষারোপ
এসআইটির রিপোর্টে কীটনাশকের মিশ্রণের সংস্পর্শজনিত দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট বিষক্রিয়ার এই বিশাল বিপর্যয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে মূলতঃ কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের। রিপোর্টে বলা হয়েছে, কৃষিজীবীরা নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলেন নি, এবং যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি।
রিপোর্টিতে বলা হয়েছে, বিদর্ভের কৃষকরা অনুমোদিত এবং অনুনমোদিত উভয়প্রকার কীটনাশকের সংমিশ্রণ, ফসলের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক ও সার ব্যবহার করেছিলেন, যাতে তাঁদের কার্পাস ফসল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, ঘন এবং লম্বা হয়ে ওঠে। কৃষকদের দেওয়া বয়ানের ভিত্তিতে এসআইটির পর্যবেক্ষণ, তৎকালীন অভূতপূর্ব আর্দ্র আবহাওয়ায় তাঁরা যেন কুয়াশার মধ্যে হেঁটে চলেছিলেন, এবং সেই সাথে ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন , তাঁরা যেমন যেমন কীটনাশক স্প্রে করে চলেছিলেন, ততই স্প্রের সঙ্গে নির্গত বড় বড় বিষকণার সংস্পর্শে আসছিলেন।
২০১৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি নাগপুর নিবাসী জনৈক আইনজীবী - অরবিন্দ ওয়াঘমারে মুম্বই হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চে দ্বিতীয় এসআইটি দ্বারা পুনরায় তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে একটি পিটিশন দায়ের করেন। ওয়াঘমারে চান এই নতুন এসআইটি কীটনাশক বিষক্রিয়া সংক্রান্ত বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য সরকার তথা এইসব বিষাক্ত রাসায়নিক যৌগ বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর ভূমিকা প্রকাশ্যে আনুক।
বাংলা অনুবাদ: স্মিতা খাটোর