“আমার পরিবার এমন একটা বাড়ি খুঁজে বার করল যার প্রবেশ পথ পৃথক যাতে আমি সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারি,” বললেন এস এন গোপালা দেবী। এটা ২০২০ সালের মে মাসের কথা, যখন কিছু পরিবার বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে বাড়ির আর সবাইকে রক্ষা করেই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত পরিবারের সদস্যের ভার লাঘব করার নিরন্তর চেষ্টাও করেছে।
৫০ বছর বয়সী গোপালা দেবী পেশায় একজন নার্স। অতি উচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও ২৯ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গোপালা দেবী অতিমারির সময়ে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় চেন্নাইয়ের রাজীব গান্ধী সাধারণ হাসপাতালের কোভিড বিভাগে কর্মরত ছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ওই শহরেই পুলিয়ান্থোপ নামের একটি স্থানে বিশেষ কোভিড কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রান্ত ছিলেন।
এখন, ধাপে ধাপে লকডাউন উঠতে শুরু করেছে, বেশ কিছু কাজকর্ম স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে, কিন্তু কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে কাজ পড়লেই গোপালা দেবী এখনও সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে থাকেন। হাসিমুখে বললেন, “আমার জন্য লকডাউন এখন চালু আছে। নার্সদের জন্য লকডাউন উঠতে এখনও ঢের দেরি।”
বহু নার্স এই প্রতিবেদককে বলেছেন, “আমাদের তো সর্বদাই লকডাউন আর তার সঙ্গে কাজের পাহাড়।”
গোপালা দেবী বলছিলেন, “সেপ্টেম্বরে আমার মেয়ের যখন বিয়ে হয় তখন আমি তার আগের দিন থেকে মাত্র ছুটি নিয়েছিলাম। আমার স্বামী উদয় কুমার বিয়ের সব দায়িত্ব সামলেছেন।” চেন্নাইয়ের অন্য একটি হাসপাতাল, শঙ্কর নেত্রালয়ে হিসাবরক্ষণ বিভাগে উদয় কুমার কর্মরত। গোপালা দেবীর কথায়, “আমার কাজের চাপ তিনি বেশ বুঝতে পারেন।”
ওই একই হাসপাতালের ৩৯ বছ বয়সী থামিঝ সেলভি একদিনও ছুটি না নিয়ে কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বললেন, “পৃথক থাকার (কোয়ারেন্টিন) দিনগুলি ছাড়া আমি একদিনও ছুটি নিইনি কারণ পরিস্থিতির গুরুত্ব আমি বুঝি।”
“আমার ছোট্ট ছেলে শাইন অলিভারকে একটানা দেখতে না পাওয়াটা খুব কষ্টকর ছিল। কখনো কখনো আমাকে রীতিমতো অপরাধবোধ গ্রাস করত। কিন্তু এই অতিমারির সময়ে আমাদের সামনের সারিতে থাকাটা একান্তই দরকার, আমি বুঝি সেকথা। আমাদের রোগীরা সেরে উঠে নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন দেখে যে আনন্দ হয় তা নিজেদের পরিবারকে ছেড়ে থাকার দুঃখ খানিক পুষিয়ে দেয়। অবশ্য, আমার স্বামী যদি আমার কাজের গুরুত্ব বুঝে আমার ১৪ বছরের ছেলের যত্ন না নিতেন আমার পক্ষে কাজ করা মোটেই সম্ভব হত না।’
কিন্তু সবাই যে এতটা সমঝদার নন, তা নার্সরা ঠেকে শিখেছেন নিজেদের আবাসন, বাসস্থান বা নিজ নিজ পাড়ায় ফিরে।
“প্রতিবার পৃথক হয়ে থাকার পর যে পথে আমি বাড়ি ফিরতাম সেখানে পাড়ার লোক হলুদ আর নিমপাতার জল ছড়াতো। তাঁদের ভয় আমি বুঝি তবু খারাপ তো লাগেই,” বললেন নিশা (নাম পরিবর্তিত)
নিশা চেন্নাইয়ের একটি সরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ কেন্দ্রে (ইন্সটিটিউট অফ গায়নকোলজি) নার্স। কোভিডে সংক্রমিত গর্ভবতী মহিলাদের দেখাশুনা করতে হত তাঁকে। “কাজটা খুব চাপের কারণ আমাদের মা ও শিশু, দুজনেরই রক্ষণাবেক্ষণ করতে হত।” কিছুদিন আগে নিশা নিজেই কোভিডে সংক্রমিত হয়েছেন। মাস তিনেক আগে তাঁর স্বামী কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন। “আমাদের হাসপাতালে অন্তত ৬০ জন নার্সের করোনা হয়েছে বিগত আট মাসে,” বললেন নিশা।
কিন্তু, তিনি বললেন, “ভাইরাসের চেয়েও বেশি কঠিন এই [ভাইরাসের] কলঙ্ক সামলানো।”
পাড়াপড়শিদের তাড়নায় নিশাকে স্বামী, শাশুড়ি আর দুই সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে এক পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় যেতে হয়েছে বার বার।
নিশার সন্তান এখনও মাতৃদুগ্ধ নির্ভর। প্রতিবার কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করে পৃথক থাকার পর নিজের এক বছরের সন্তানের কাছ থেকে আরও কয়েকদিন দূরে থাকতে হত। তিনি বলছিলেন, “আমি যখন কোভিড-১৯ আক্রান্ত মায়েদের প্রসব করাতে ব্যস্ত থাকতাম আমার শাশুড়ি আমার সন্তানের দেখাশুনা করতেন। এখনও অদ্ভুত লাগে ভাবতে।”
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ (আইসিএমআর) স্তন্যদানকারী মা ও অন্য কোনও রোগ আছে এমন মানুষদের কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যব্যাপী নার্সের অভাবের কারণে নিশার মতো আরও অনেকের কাজ না করে কোনও উপায় ছিল না।
২১ বছর বয়সী শাইলা, যাঁর সদ্য নার্সের পেশায় হাতেখড়ি হয়েছে, তিনিও এই কথায় সায় দিলেন। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি দুই বছরের চুক্তিতে অস্থায়ীভাবে চেন্নাইয়ের একটি কোভিড কেন্দ্রে নার্সের কাজে যুক্ত হন। যে সব অঞ্চলে রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল সেখানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সোয়াব সংগ্রহ করা, মাস্ক পরার পক্ষে জনচেতনা সৃষ্টি ও অন্যান্য সাবধানতা সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা ছিল তাঁর কাজ।
“বহু জায়গায় মানুষ পরীক্ষা করাতে রাজি-ই ছিল না আমাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিত,” বললেন শাইলা। এছাড়া সমাজের চিরকালীন ছোঁইয়াছুঁইয়ের বাতিক তো ছিলই। “আমি পরীক্ষা করার জন্য একটা বাড়ি গিয়ে দেখলাম যে পরীক্ষার সরঞ্জাম যে ব্যাগে আছে তার মুখ কাটার কাঁচি আনতে ভুলে গেছি। সেখানকার মানুষের কাছে একটা কাঁচি চাওয়ায় তারা এমন একটা কাঁচি দিল যে তা দিয়ে প্যাকেট কাটাই যাচ্ছিল না। কোনওরকমে কাজ শেষ করে কাঁচিটি ফেরত দিতে চাইলে তারা নিল না — বলল ফেলে দিতে!”
তার উপর চেন্নাইয়ের গরমে ৭-৮ ঘন্টা পিপিই পোশাক পরে থাকাও এক অস্বস্তিকর বিষয়। এছাড়াও তিনি জানালেন, “আমরা খাবার তো দূরের কথা জল অবধি না খেয়ে কাজ করতাম, লোকের বাড়ির কলঘরটা অবধি ব্যবহার করতে পারতাম না।”
এতকিছুর পরেও তিনি কাজে লেগে রইলেন। তাঁর কথায়, “আমার বাবার স্বপ্ন ছিল যাতে আমি ডাক্তার হই। শত অস্বস্তি নিয়েও আমি যখন নার্সের পোশাক আর পিপিই জামা গায়ে চাপালাম, আমার মনে হল আমি বাবার স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছেছি।” তাঁর সাফাইকর্মী পিতা স্বহস্তে সেপ্টিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার কাজ করতে গিয়ে মারা যান।
বিপদের ঝুঁকি আর বৈষম্য ছাড়াও নার্সদের লড়াই করতে হয় ভয়াবহ কাজের পরিবেশ ও অত্যন্ত কম বেতনের সঙ্গেও। শাইলা মাস গেলে ১৪,০০০ টাকা বেতন বাবদ পেতেন। ১০ বছর নার্সের পেশায় নিযুক্ত থাকা নিশা, যিনি কিনা ছয় বছর চুক্তির ভিত্তিতে একটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করার পর মাস গেলে মাত্র ১৫,০০০ টাকা মাইনে পান। তিন দশক কাজ করার পর গোপালা দেবীর বেতন সাকুল্যে ৪৫,০০০ টাকা যা যে কোনও সরকারি ব্যাঙ্কের প্রাথমিক স্তরের ক্লার্কের বেতনের চেয়ে খুব একটা বেশি হবে না।
সরকারি পরিসংখ্যান অমিল হলেও স্বাস্থ্যকর্মীদের হিসাব অনুসারে সারা তামিলনাডু জুড়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট নার্স আছেন প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৮০,০০০। নার্সদের কাজ অতি কঠিন এ কথা স্বীকার করে ইন্ডিয়ান মেডিকাল কাউন্সিলের সভাপতি ডঃ সি এন রাজা জানালেন যে আইএমসি নার্সদের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। “বিশেষত যাঁরা আইসিইউতে কাজ করেন তাঁরা ঝুঁকির কথা জেনেই কাজ করতে আসেন, এবং আমি মনে করি তাঁদের পূর্ণ যত্ন করা আমাদের কর্তব্য।”
তবে, তাঁদের অবস্থার প্রতি নজর আদৌ রাখা হচ্ছে বলে নার্সরা মনে করেন না।
“এই রাজ্যে ১৫,০০০-এর বেশি অস্থায়ী নার্স আছেন,” জানালেন কে শক্তিভেল যিনি একজন পুরুষ নার্স হওয়ার পাশাপাশি তামিলনাডু সরকারি নার্স সংঘের সভাপতি। “উপযুক্ত বেতন আমাদের অন্যতম দাবি। ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিলের নীতি মেনে না নিয়োগ হয়, আর না হয় পদোন্নতি।”
“১৮,০০০ অস্থায়ী নার্সদের মধ্যে মাত্র ৪,৫০০ জনকে স্থায়ী করা হয়েছে,” বললেন তামিলনাডুর স্বাস্থ্যক্ষেত্রের যাবতীয় কর্মীদের সংগঠন, হেলথ ওয়ারকার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, ডঃ এ আর শান্তি। “বাকি নার্সরা একই পরিমাণ, এমনকি স্থায়ী নার্সদের তুলনায় বেশি কাজ করে হাতে পান ১৪,০০০ টাকা। স্থায়ী নার্সদের মতো ছুটিও তাঁরা পান না। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে ছুটি নিলেও তাঁদের বেতন কাটা যায়।”
আর এইসবই কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের হালহকিকত।
গোপালা দেবী যিনি সরকারি বেসরকারি দুই ধরনের হাসপাতালেই কাজ করেছেন, মনে করেন যে, বিগত একবছর ধরে কোভিড-১৯ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, “ভারতের প্রথম এইচআইভি রোগী পাওয়া গেছিল চেন্নাইয়ের ম্যাড্রাস মেডিক্যাল কলেজে (রাজীব গান্ধী হাসপাতালের অধিভুক্ত)। কিন্তু এইচআইভি রোগীর চিকিৎসা করতেও আমরা এতটা শঙ্কিত হতাম না। নিজেদের সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে হত না। কোভিড-১৯ অনেক বেশি অনিশ্চিত এবং এর মোকাবিলা করতে যথেষ্ট সাহস দরকার।”
অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই দৈনন্দিন জীবনকে একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে। “গোটা পৃথিবী যখন লকডাউনে স্তব্ধ, কোভিড ওয়ার্ডে আমাদের ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে। এমনটা নয় যে আপনি যেমন আছেন তেমনভাবেই দিব্যি কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকে পড়বেন। ডিউটি ৭.০০টায় শুরু হলে আমাকে ৬.০০টা থেকে প্রস্তুতি পর্ব শুরু করতে হবে। পিপিই পোশাক পরা ছাড়াও পেট ভরে খেয়ে নিতে হবে যাতে কাজ শেষ করা অবধি খিদে না পায় — পিপিই পরে তো জল অবধি খেতে পারব না, ফলে বুঝতেই পারছেন কাজ আসলে শুরু হয় [নির্ধারিত সময়ের] অনেক আগে থেকেই।”
“ব্যাপারটা এইরকম - সাতদিন কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করলে পরবর্তী সাতদিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হয়,” বললেন নিশা। আমাদের ওয়ার্ডের ৬০-৭০ জন নার্স ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করি। রোগীর সংখ্যার বুঝে ৩ থেকে ৬ জন নার্স একটানা এক সপ্তাহ কাজ করেন। (যাতে ওই একই সময়ে ৩ থেকে ৬ জন নার্স নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারেন কোয়ারেন্টিনে)। মোটামুটি প্রতি ৫০ দিনে একবার আমাদের কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি করতে হয়।”
অর্থাৎ একজন নার্সের নির্ঘণ্টের প্রতি সাত সপ্তাহের দুই সপ্তাহ কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অতি ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের মধ্যে কাটে। নার্সের সংখ্যায় ঘাটতি বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কাজের এই ভার আরও বেড়ে যায়। কোভিডের কাজে যুক্ত নার্সদের কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য দরকারি সুযোগ সুবিধা সরকার দেয়।
কাজের শিফটের মেয়াদ খাতায় কলমে ছয় ঘণ্টা হলেও নার্সরা তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাজ করেন। নিশা জানালেন, “রাতের শিফট তো অবধারিতভাবে ১২ ঘণ্টারই হয় - সন্ধে ৭টা থেকে সকাল ৭টা। তাছাড়াও আমরা ছয় ঘণ্টা পর কখনওই কাজ বন্ধ করতে পারি না। যে কোনও শিফটের মেয়াদ এক ঘণ্টা দুয়েক বেড়েই যায়।”
নিয়োগ সংক্রান্ত ভ্রান্ত নীতির জেরে সবার কাজের বোঝা বেড়ে যায়।
ডঃ শান্তি বলছিলেন, “নতুন নার্স নিয়োগ না করে কোভিড কেন্দ্রগুলি অন্যান্য হাসপাতাল থেকে নার্সদের নিয়ে আসছে। এতে কাজের ক্ষেত্রে নিদারুণ আপোস করতে হয়। একটি শিফটে কাজ সামাল দেওয়ার জন্য ছয় জন নার্স দরকার হলে বহু হাসপাতালকেই দুজন নার্স দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। তাছাড়াও একমাত্র চেন্নাই বাদে আর কোনও জেলায় ‘একজন রোগী পিছু একজন নার্স’ নীতি কোভিড আইসিইউতে পালিত হচ্ছে না। পরীক্ষা এবং রোগী ভর্তিতে বিলম্বের কারণ এটাই।”
জুন ২০২০তে রাজ্য সরকার চেন্নাই, চেঙ্গাল্পাট্টু, কাঞ্চিপুরম ও থিরুভালুর জেলার জন্য ১৪,০০০ টাকা বেতনে কোভিড ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ২,০০০ নার্স নিয়োগ করে। ডঃ শান্তির মতে এই সংখ্যা প্রয়োজনের ধারেকাছেও যায় না।
২৯শে জুলাই নার্সরা রাজ্যব্যাপী একদিনের প্রতিবাদে সামিল হন। কেন্দ্রীয় সরকারি নার্সদের সমতুল বেতন ছাড়াও এই সঙ্কটকালে কোভিড ওয়ার্ডে কর্মরত নার্সদের জন্য তাঁরা বোনাস দাবি করেন; এর সঙ্গেই কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত নার্সদের পরিবারের জন্য তাঁরা আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবিও জানান।
কোভিড ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডে নিযুক্ত নার্সদের জন্যও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্মরত সমাজকর্মীরাও সমান চিন্তিত। “ভাইরাসের থেকে দূরত্বে থাকলেও কোভিড ছাড়া অন্য ওয়ার্ডে কর্মরত নার্সদেরও কিন্তু ঝুঁকি থাকছেই। কোভিড ওয়ার্ডের নার্সরা পিপিই পোশাক, এন-৯৫ মাস্ক পান — এগুলি তাঁদের অধিকার বলে তাঁরা [এই সুরক্ষা সরঞ্জামগুলি] দাবি করতে পারেন, ফলে তাঁরা খানিকটা হলেও সুরক্ষিত বলে আমি মনে করি। অন্য নার্সরা তো এইসব দাবি করতে পারবেন না,” বললেন ডঃ শান্তি।
অনেকেই এ প্রসঙ্গে ৫৫ বছর বয়সী নার্স আন্থোনিয়াম্মল অমৃতাসেলভির কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি সুপারিনটেনডেন্ট নার্স হিসাবে বহির্বিভাগীয় রোগীদের জন্য তৈরি রামনাথপুরম জেলার মণ্ডপম ক্যাম্পে কাজ করতেন। ১০ই অক্টোবর হৃদরোগী আমৃতাসেলভি নিজে কোভিড-১৯-এর সঙ্গে লড়াইয়ে হার মানেন। তাঁর স্বামী এ গণরাজ জানালেন, “সামান্য অসুস্থ হওয়ার পরও ও কাজ করে গেছে। ও ভেবেছিল সাধারণ সর্দিজ্বর। পরে যখন পরীক্ষায় ধরা পড়ল তখন আর কিছুই করার ছিল না।” মাদুরাই সাধারণ হাসপাতাল থেকে বছর খানেক আগেই অমৃতাসেলভিকে মণ্ডপম ক্যাম্পে বদলি করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এছাড়া কলঙ্কের বোঝা তো আছেই — দলিত সমাজভুক্ত নার্সদের ক্ষেত্রে তো এই বোঝা দ্বিগুণ।
থামিঝ সেলভি (উপরের কভার ফোটোতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে) এ কথা হাড়ে হাড়ে জানেন। রানীপেটের (পূর্বতন ভেল্লোর) ওয়ালাজাপেট তালুকের লালাপেট গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ তিনি। বৈষম্য চিরকাল তাড়া করেছে এই পরিবারটিকে।
দলিত পরিচয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আর এক নতুন সামাজিক কলঙ্ক — কোভিড-১৯ অতিমারির বিরুদ্ধে যোদ্ধা নার্স যে তিনি। থামিঝ সেলভি জানালেন, “পৃথক হয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকার পর ব্যাগ হাতে রাস্তায় নামা মাত্র চেনা মানুষেরাও আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। আমার খারাপ লাগে বটে কিন্তু বুঝি যে ওরা নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।”
বিখ্যাত তামিল কবি তথা থামিঝ সেলভির বোন সুকির্থারানি জানালেন কেন তাঁর তিন বোন নার্স হবেন ঠিক করেছিলেন — “শুধু আমাদের পরিবার না, অন্য বহু দলিত পরিবারের সদস্যরাও এই জীবিকা বেছে নেন। আমার বড়ো বোন যখন নার্স হলেন তখন আমাদের বাড়ি আসতে যারা চিরকাল দ্বিধা করেছে, তারাও সাহায্য চাইতে চলে আসত। ‘ঊর’ থেকে মানুষজন ‘চেরি’তে আমাদের বাড়ি চলে এসে জানাত যে আমার বাবা শানমুগমের মতো তারাও নিজেদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চায়। (জাতিভিত্তিক বৈষম্যের জেরে প্রথাগতভাবে তামিল গ্রামগুলিতে উচ্চবর্ণের মানুষের পাড়া ঊর ও দলিত সম্প্রদায়ের পাড়া চেরিতে বিভক্ত)। আমি এবং আমার ভাই স্কুলে পড়াই। আমার বোনেরা নার্স।”
“আমাদের এক ভাই ইঞ্জিনিয়ার — সে ছাড়া আমরা আর সবাই এই সমাজকে পথ দেখানোর কাজে যুক্ত আছি। আমাদের মতো পরিবারের মানুষের কাছে এ এক দারুণ গর্বের বিষয়। নার্সের পোশাক পরে আমার বড়ো বোন অর্জন করেছিল সৌম্য রূপ আর সম্মান। কিন্তু এ তো নার্স হতে চাওয়ার একটি মাত্র কারণ। আসলে বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো আমরা গোটা সমাজের উদ্ধারের জন্য কাজ করতে চাই।”
তার জন্য বোন থামিঝ সেলভির কোভিড-১৯ ওয়ার্ডের কাজ সারা হলে তাঁর কোভিড পরীক্ষার সময়ের যাবতীয় উৎকণ্ঠাও মেনে নেওয়া যায়। হেসে বললেন সুকির্থারানি, “আমি তো চিন্তিত ছিলাম যে ও ওর কাজ করে উঠতে পারবে কিনা। কিন্তু প্রাথমিক দুশ্চিন্তার পর এখন ব্যাপারটা আমাদের সয়ে গেছে।”
গোপালা দেবীর কথায়, “কোভিড ডিউটি করা মানে বিপদ জেনেও আগুনে ঝাঁপ দেওয়া। কিন্তু আমরাই তো এই পেশা বেছে নিয়েছি। এই পথেই আমরা সমাজের সেবা করি।”
ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশান থেকে প্রাপ্ত একটি স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা অনুদানের সাহায্যে কবিতা মুরলীধরন জনস্বাস্থ্য এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে লেখালিখি করেন। এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ঠাকুর ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন কোনওরকম সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ করেনি।
কভারচিত্র: এম. পালানী কুমার
অনুবাদ: চিলকা